» » গাদ্দার

বর্ণাকার

তখন হালকা হালকা বাতাস বইতে আরম্ভ করলো। সূর্যের কিরণ বালিতে পড়ে যে চমক সৃষ্টি করছিল, বাতাসের উড়ে আসা বালিতে ঢেকে গেল সে চমক।

সূর্য পশ্চিম দিগন্তের দিকে নেমে যেতে লাগলো। উত্তাপের দাবদাহ কমতে লাগলো একটু একটু করে। ক্লান্ত সূর্যের মত ওই চার মুজাহিদের পা-ও শ্রান্তিতে অবশ হয়ে আসছিল।

পশ্চিমের দিগন্তে হারিয়ে যাওয়ার মত সূর্যের একটি ঠিকানা আছে, যেখানে সে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারবে একটি পুরো রাত। কিন্তু এই মুজাহিদদের বিশ্রামের মত কোন নিশ্চিত আশ্রয় ছিল না। ধীরে ধীরে অবশ পায়ে ওরা চলতেই থাকলো। কিন্তু সে চলায় ছিল ক্লান্তি ও অবসন্নতার ছাপ। ওদের ঠোঁটগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল, মুখ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের উদ্দীপনাময় গান।

তাদের ছায়া যখন পূর্ব দিকে লম্বা হতে হতে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়লো, সাথীদের মুখ থেকে হারিয়ে গেল গান, তখনও আন নাসের বিড়বিড় করে পড়ছিল,

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

জানের মালিক এক আল্লাহ।

তার নামে হও ফানাফিল্লাহ।

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ

তিনি নেতা নাবিয়াল্লাহ

নিপাত যাবে গায়েরুল্লাহ।

এক সময় আন নাসেরের বিড়বিড় জপমালাও বন্ধ হয়ে গেল।

আন নাসের বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘প্রিয় সাথীরা আমার! আমাদের বোধহয় এখন একটু বিশ্রামের দরকার।’

ওরা থামলো। সূর্যের শেষ লালিমায় রক্তিম হয়ে উঠেছিল ওদের চেহারাগুলো। এখন আর সূর্যের সেই তেজ নেই। অনেক সহনীয় হয়ে এসেছে বাতাস ও বালি।

সেই নরম বালির ওপর বসে পড়লো ওরা। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। অবশেষে নিরবতা ভাঙলো আন নাসেরই, শরীরের অবশিষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে বললো, ‘তোমরা নিরাশ হয়ো না, মুমীনের জীবন খাতায় নিরাশার কোন ছায়া থাকে না। হয়তো আমাদের ঈমান এখনো কমজোর। তাই আমাদের চেহারায় খেলা করছে দুশ্চিন্তার ছায়া। ঈমানকে মজবুত করো। বাঁচতে হলে আমাদেরকে ঈমানের জোরেই বাঁচতে হবে।’

সে কথা বলছিল আর সাথীদের চেহারা বার বার লক্ষ্য করছিলো। তাদের চেহারা, ও মুখ রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখগুলো ঢুকে গেছে ভিতরের দিকে।

সূর্য ডুবে গেল। অন্ধকারে ছেয়ে গেল মরু চরাচর। বালিও ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে এলো। আন নাসেরের সঙ্গীরা শুয়ে পড়লো সেই ঠাণ্ডা বালির ওপর।

আন নাসের তাদের কোন বাঁধা দিল না, বরং সেও শুয়ে পড়লো তাদের পাশে। ওরা যদি কমাণ্ডো সেনা না হয়ে কোন সাধারণ মুসাফির হতো, তবে অনেক আগেই মাটিতে পড়ে যেত। ওরা একে তো সৈনিক, তার ওপর কমাণ্ডো সেনা। সাধারণ মানুষ থেকে অনেক বেশী কষ্ট ও বিপদ সহ্য করার শক্তি ও ক্ষমতা রাখে তাদের শরীর। তাই এখনো টিকে আছে ওরা।

ঠান্ডা বাতাসে ওদের শরীর জুড়িয়ে গেল। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল আইয়ুবীর চার কমাণ্ডো সেনা। মরু শেয়াল তাদের হামলা করতে পারে, ঘটে যেতে পারে কোন অযাচিত বিপদ, এমন কোন চিন্তাই জাগলো না ওদের মধ্যে।

তখনও সকাল হয়নি, তবে হতে বেশী দেরীও নেই ঘুম ভাঙতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে তারকারাজি দেখে অনুমান করলো আন নাসের। তারার আলোয় আরেকবার দিক নির্ণয় করে সে সঙ্গীদের ডেকে তুললো। বললো, ‘রাত প্রায় শেষ, চলো রোদ উঠার আগেই যতদূর পারা যায় এগিয়ে থাকি।’

ওরা আবার যাত্রা শুরু করলো। সারা রাত ঘুম ও বিশ্রামের কারণে শরীর অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। চলার গতি মােটামুটি ভালই, তবে ক্ষুধা ও পিপাসার কথা কেউ মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না।

‘এখানে মরুভূমি এত বিস্তৃত হতে পারে না।’ আন নাসের আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বললো, ‘আজ নিশ্চয়ই পানির সন্ধান পেয়ে যাবো।’

সঙ্গীরা তার এ কথার কোন জবাব দিল না। তবে দিনের বেলায় মরীচিকা দেখে পানির জন্য যত পেরেশানী ছিল, রাতের আঁধারে পেরেশানী ততটা প্রখর ছিল না। বরং আন নাসেরের মত তারাও আশা করছিল, রাত পেরোলে হয়তো কোন মরুদ্যান বা ঝর্ণা তাদের সামনে পড়ে যেতেও পারে। এ আশা নিয়েই তারা পথ চলতে লাগলো।

সকাল হলো। পূর্ব দিগন্তে দেখা দিল আলোর রেখা। রক্তিম সূর্য উদয় হলো ওদের দিকে চোখ রাঙানি দিয়ে। একটু পরই তেতে উঠতে শুরু করলো বালি। কিন্তু আশার দিক হলো, ক্রমেই বালির পরিমাণ কমে গিয়ে মাটি দেখা দিতে শুরু করলো।

এই জানবাজ কমান্ডোদের জন্য দিনের প্রথম দু:খ নিয়ে এলো উত্তপ্ত সূর্য। পানির আশায় আশায় জান বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তাদের। বালি আর ছিল না, তবে মাটি ছিল খুব কঠিন। সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে সে মাটিতে লম্বা লম্বা ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল।

সেই সব ফাটল টপকে পথ চলতে হচ্ছিল তাদের। এতে মাঝে মাঝেই পায়ে ঠোকর খাচ্ছিল। দ্বিতীয় দুঃখ হিসাবে দেখা দিল এই পায়ে ঠোকর খাওয়া। কারণ এতে করে ক্লান্ত পাগুলো আহত হয়ে পড়ছিল।

আট দশ মাইল দূরে হঠাৎ মাটির স্তম্ভ চোখে পড়লো ওদের। এতেই ওরা উৎফুল্ল হয়ে পড়লো। কিন্তু পরে দেখা গেল, আসলে সেগুলো ছিল মাটির টিলা ও বালির ঢিবি। সেখানে কোন গাছপালা বা পানির উৎস ছিল না। মাটির অবস্থা যা তাতে মনে হচ্ছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী এ মাটি পিপাসায় মরছে। এখন পানি কেন, এ মাটি মানুষের রক্ত পান করতেও আপত্তি করবে না।

আন নাসের তার সঙ্গীদের দিকে তাকালো। তাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারলো নিজের চেহারাটা এখন কেমন হয়েছে। পিপাসায় তার এক সাথীর ততক্ষণে জিহ্বা বের হয়ে এসেছিল। ঠোঁটের অবস্থা ছিল আরো করুণ, শুকিয়ে তা কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বোধহয় সে ঠোঁট কিছুটা ফেটেও গিয়েছিল, কারণ একটু একটু জ্বালা করছিল ঠোঁটে।

আলামত খুব সুবিধের নয়। আর বেশী সময় এভাবে টেকা যাবে না। পানি না পেলে হয়তো মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মৃত্যু ঘটবে তাদের। এসব আলামত তারই করুণ ইঙ্গিত বহন করছে। মরুভূমি তার মাশুল নিতে শুরু করেছে। সুলতান আইয়ুবীর চার চৌকস কমাণ্ডো এখন রক্ত পিপাসু মাটির খোরাক হতে যাচ্ছে।

আন নাসের আবার তাকালো বন্ধুদের দিকে। তার দুই সৈন্যের অবস্থা এখন এতটাই নাজুক যে, তারা আর ঐ স্তম্ভ বা মাটির টিলার কাছেও পৌঁছতে পারবে বলে মনে হয় না।

আন নাসের নিজের দিকে মনোযোগ দিল। তাকে স্মরণ করিয়ে দিল, আন নাসের, তুমি এই জানবাজ কমাণ্ডোদের কমান্ডার। এদের বাঁচানোর দায়িত্ব এখন তোমার। তুমি তোমার অনুভূতিকে তীক্ষ্ণ করে তোল। নিজের বুদ্ধি ও বিবেককে সজাগ ও নিয়ন্ত্রণে আনো। যদিও তোমার শারীরিক অবস্থা সাথীদের তুলনায় তেমন উন্নত নয়, কিন্তু মানসিক অবস্থা তাদের মত হলে চলবে না তোমার। যদি তাই হয় তাহলে তুমি কেমন কমাণ্ডার? একই যদি হবে তোমার অবস্থা তাহলে তোমার পদমর্যাদাও হতো এক। কিন্তু সেটা যখন হয়নি, যখন সুলতান তোমাকে অর্পন করেছেন উচ্চতর মর্যাদা
ও পদবী, তখন তোমাকে তার মর্যাদা রক্ষা করতেই হবে। আন নাসের এভাবে নিজেকে বুঝাচ্ছিল আর উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল সঙ্গীদের। সে তাদের পড়ে শোনাচ্ছিল আল্লাহর কালাম ও রাসূলের ত্যাগ-তিতীক্ষাপূর্ণ হাদিসগুলো। কিন্তু তাতে বন্ধুদের মনে কোন প্রভাব পড়ছে কিনা বুঝতে পারলো না। বুঝতে পারলো না, এতে কোন কাজ হচ্ছে, নাকি সবই ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।

যতই সূর্য উপরে উঠতে লাগলো, মাটির তাপ ততই বাড়তে লাগলো। এই চার জন হতভাগা সৈন্যের চলার শক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে এলো। তারা আর পা উঠাতে পারছিল না। কোন রকমে পা টেনে টেনে তবু চলা অব্যাহত রাখলো ওরা।

যে সৈনিকটির জিহ্বা বের হয়ে পড়েছিল, তার শক্তি এতটাই নিঃশেষ হয়ে এলো যে, তার হাত থেকে খসে পড়ে গেল বর্শা। পরে সে তার কোমরবন্ধ থেকে তলোয়ারও খুলে ফেলে দিল। সে যখন এসব করছিল তখন তার আদৌ হুশ ছিল কিনা বলা মুশকিল, কারণ তখন সে কোন কথা বলছিল না।

মরুভূমি তখন তাকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে। যখন কোন পথিক এমন অবস্থায় পড়ে যায় তখন সে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে পতিত হয়। সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোরে সে এমন সব কাজ করতে থাকে যার কোন ঠিক ঠিকানা থাকে না।

সে তার দেহকে হালকা করার জন্য শরীরের সমস্ত কাপড় চোপর ও অস্ত্র খুলে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করলো।

তার মনে হলো, তার সামনে মরুভূমিতে এলোমেলো পড়ে আছে কোন দিকভ্রান্ত মুসাফিরের লাশ। সে দেখতে পেলো, হতভাগা সেই মরুযাত্রীর হাড় ক’খানা বাতাসে দুলছে। না না, ওরা তো দুলছে না, বরং হাত ইশারায় তাকে ডাকছে। সে সেই ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য তার সকল সম্বল রাস্তায় ফেলে দিয়ে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

মরুভূমি আন নাসেরের এক সাথীকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেল, যখন সে তার সব সাজ-সরঞ্জাম দুনিয়াতেই ফেলে দিয়ে তার দুনিয়ার দায়িত্ব শেষ করতে চাচ্ছিল।

আন নাসের তার সঙ্গীর বর্শা ও তলোয়ার উঠিয়ে নিল এবং তার কাঁধে হাত রেখে সঙ্গীকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, ‘এত তাড়াতাড়ি জীবনে হার মানতে নেই বন্ধু! আল্লাহর সৈনিক মৃত্যুবরণ করে কিন্তু অস্ত্র ফেলে দেয় না। তোমার সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এসব তোমাকে সাথে রাখতে হবে।’

সাথী তার দিকে ঘোলাটে চোখে তাকালো। আন নাসের চেয়ে রইল তার দিকে। চার চোখ মিলিত হলো পরস্পর। সহসা সে হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে, হাত দিয়ে ইশারা করে বলে উঠলো, ‘পানি! ঐ দেখো বাগান, পানি পেয়ে গেছি।’ সে সামনের দিকে দৌঁড় দিল।

সে যেদিকে হাত ইশারা করেছিল, সেখানে কোন পানি ছিল না, এমন কি পানির কোন মরীচিকাও ছিল না। কারণ ওই অঞ্চল মরুভূমি ছিল না, জায়গাটা ছিল নিরেট কঠিন মাটিতে পরিপূর্ণ। এ মাটি মরীচিকা হওয়ারও যোগ্য ছিল না। কারণ মরীচিকা সৃষ্টি হয় বালির চাকচিক্যে।

এটা ছিল তাদের ওপর মরুভূমির দ্বিতীয় নিষ্ঠুর তৎপরতা। এ ব্যাপারটা ঘটে সম্পূর্ণ কল্পনার মধ্যে। হতাশার মাঝে আশার কাল্পনিক ধারণা হঠাৎ মূর্ত হয়ে উঠে মৃত্যুপথযাত্রী মুসাফিরের মধ্যে। কল্পনা তখন বাস্তব রূপ ধরে চোখের সামনে দেখা দেয়। পানির ঝর্ণা, ফলের বাগান, অট্টালিকা সবই সে দেখতে পারে সেই কল্প-বাস্তবতার চোখে। এমনও চোখে পড়ে, যেন সামনেই আছে কোন শহর নগর। এমন কি সে ইচ্ছা করলেই দেখতে পায়, বিশাল কাফেলা এগিয়ে যাচ্ছে তার পাশ ঘেঁষে। নর্তকী ও গায়িকার দলকে দেখতে পায় নৃত্যরত অবস্থায়। মৃত্যু পথযাত্রী মুসাফিরের সামনে এমনি নির্দয়-নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠে বিরান মরুভূমি।

আন নাসেরের এক সঙ্গীকে এমনি ধোঁকা দিতে আরম্ভ করলো সেই বিরাণ প্রান্তর। তার প্রাণ নিয়ে শুরু করলো মরণ খেলা। একে মরুভূমির সান্ত্বনাও বলা চলে। কোন যাত্রীর প্রাণ কেড়ে নেয়ার আগে অপূর্ব মনোরম দৃশ্য ও ছবির বহর দেখিয়ে তার মৃত্যু কষ্ট কিছুটা লাঘব করে দেয়।

আন নাসেরের সঙ্গী সামনের দিকে দৌঁড়াতে শুরু করলো। যে সৈনিক একটু আগেও কোন রকমে পা টেনে টেনে পথ চলছিল, সে সুস্থ্য মানুষের মত দৌঁড়াতে শুরু করলো। এই দৌঁড়ানো ঠিক প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগের অবস্থার মত। আন নাসের তার পিছনে দৌঁড় দিলো এবং তাকে ধরে ফেললো। তার অন্য দুই সাথীর মধ্যে প্রাণশক্তি তখনও কিছুটা অবশিষ্ট ছিল, তারাও দৌঁড়ে এসে তাকে ধরে ফেললো। সে তাদের থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো এবং চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘চলো, ঐ পানির ঝিলের ধারে যাই। ঐ দেখো হরিণ ও পাখি ঝিলে পানি পান করছে।’

সাথীরা তাকে ধরে পা টেনে টেনে আস্তে আস্তে চলতে লাগলো। আন নাসের তার মাথার কাপড় দিয়ে তার মুখ-চোখ ঢেকে দিল যেন ধোকার দৃশ্য তার সামনে থেকে বন্ধ হয়ে যায়।

সূর্য মাথার ওপর উঠে এলো। তখন আর এক সিপাহীও চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, ‘ঐ যে বাগানের মধ্যে নর্তকী নাচছে। ধূর, পানির আশা বাদ দাও, চলো নাচ দেখি। চলো বন্ধু সেখানে পানিও পাওয়া যাবে। ঐ যে লোকেরা আহার করছে, আমি তাদের সবাইকে চিনি, চলো, চলো।’

সেও দৌঁড়াতে উদ্যত হলো। প্রথম যে সৈনিকের দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল সে কিছুক্ষণ পর নীরব হয়ে গিয়েছিল। ফলে সাথীরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল।

সে তার সাথীকে দৌঁড়াতে দেখে নিজেও পিছু পিছু দৌঁড়াতে শুরু করলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘নর্তকী খুবই সুন্দরী, তাকে আমি কায়রোতে দেখেছি। সেও আমাকে চিনে। আমি তার সাথে আহার করবে, তার সাথে সরবত পান করবো।’

এ দৃশ্য দেখে আন নাসেরের মাথাও খানিকটা এলোমলো হয়ে গেল। সে মরুভূমির কষ্ট ও বিপদ সহ্য করতে পারে কিন্তু সাথীদের এ করুণ অবস্থা তার সহ্যের বাইরে। তাদেরকে সামাল দেয়াই এখন তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো। তার যে সহকারী এখনো সুস্থ্য আছে, শারীরিক দিক দিয়ে সেও একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এমনকি তার নিজের শারীরিক অবস্থাও খুবই শোচনীয়।

তার দুই সাথী, যারা বাগানে নর্তকীর নাচ দেখার কাল্পনিক ছবি দেখে দৌঁড়াচ্ছিল, তারা কয়েক কদম গিয়েই পড়ে গেল। তারা তো পড়বেই। কারণ তাদের শরীরে আর আছেই বা কি। আন নাসের ও তার সাথী দু’জনকে ধরে তুলে বসালো এবং চোখ ও মাথার ওপর কাপড়ের আবরণ ফেলে দিল। তাদের চোখ বন্ধ হয়ে গেল, তারা বসে টলতে লাগলো।

‘তোমরা আল্লাহর সৈনিক!’ আন নাসের আস্তে তাদের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘তোমরা আল্লাহর রাসূলের অনুসারী। তোমরা ইসলামের শত্রুদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছো। তোমাদের দেখে কাফেররা ভয়ে কাঁপে। তোমরা অগ্নিশিখাকে মাড়িয়ে চলা বীর সৈনিক! এই মরুভূমি, পিপাসা, সূর্যের তাপকে তোমরা কি মনে করো? তোমাদের ওপর শীঘ্রই আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে। আল্লাহর ফেরেশতারা বেহেশতের ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে আনবে তোমাদের জন্য। তোমাদের শরীর তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত কিন্তু তোমার আত্মা তৃষ্ণার্ত নয়। ঈমানের উষ্ণতায় তোমাদের দীল ভরপুর। মোমিন জিন্দা থাকে তার এই ঈমানকে সম্বল করে।’

দু’জন সঙ্গে সঙ্গে চোখের ওপর থেকে ফেলে দিল কাপড়ের আচ্ছাদন। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ওরা আন নাসেরকে দেখলো। আন নাসের একটু হাসতে চেষ্টা করলো। সে আবেগের আতিশয্যে যে কথাগুলো বলেছিল সে কথা ওদের মনে এমন প্রভাব ফেলবে ভাবতে পারেনি আন নাসের। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর দু’জন সৈনিকই কল্প-বাস্তবতার পথ ত্যাগ করে বাস্তব জগতে ফিরে এলো। তারা সজোরে আন নাসেরের হাত আকড়ে ধরে বললো, ‘আমরা কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?’

আন নাসের বললো, ‘না, একটু তন্দ্রার ঘোর লেগেছিল। ও কিছু নয়, চলো, এখনো অনেক পথ বাকী।’

তারা উঠে দাঁড়ালো এবং ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো।

ওরা টিলা ও বালির যে স্তম্ভ দেখেছিল অনেক আগে, তার কাছাকাছি এসে গেল। এখন সেগুলো অনেক বড় বড় দেখা যাচ্ছে। তারা আশা করলো, সেখানে আর কিছু না হোক, অন্তত পানি পাওয়া যাবে। সেখানে নিম্নাঞ্চল আছে, সেই নিম্নাঞ্চলে নিশ্চয়ই পানির নালা ও ঝর্ণা থাকবে।

আন নাসের তাদের বুঝালো, আমরা পানির কাছাকাছি এসে গেছি, আজ সন্ধ্যার আগেই ইনশাআল্লাহ পানি পাওয়া যাবে।

তারা সেই প্রান্তরে এসে পা রাখলো। কিন্তু এখানকার মাটি এত শুকনো ও কঠিন যে, এখানে পানির আশা শিশির কণার মত বাষ্প হয়ে উড়ে গেল। তারা মাটির টিলা ও ঢিবির ওপর বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

সহসা এক সিপাই দৌঁড় দিল ও চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘আমরা গ্রামে এসে গেছি! আমি সবার জন্য খানা পাকাতে যাচ্ছি। ওই দেখো কূপ থেকে আমাদের গায়ের মেয়েরা পানি উঠাচ্ছে।’

তার পিছনে দ্বিতীয় সৈনিকও দৌঁড়ালো এবং চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘ঐ যে হংস মিথুন।’

তারা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে মুষ্টি ভরে মাটি ও বালি মুখে পুরে নিল।

আন নাসের ও তার অপর সঙ্গী দৌঁড়ে তাদের কাছে গেল। তাদের মুখ থেকে মাটি বের করে কাপড় দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে তাদের দুজনকেই তুলে বসালো। কিন্তু তাদের আর চলার শক্তি ছিল না। তখনো এক সৈনিক বলছিল, ‘কূপ থেকে আগে পানি পান করি, তারপর তোমাদের জন্য রান্না চড়াবো।’

আন নাসের দোয়ার জন্য হাত উঠালো। আকাশের দিকে দু’হাত উঠিয়ে বললো, ‘আয় আল্লাহ জাল্লে জালাল! আমরা তোমার নামের ওপর লড়তে ও মরতে এসেছি। আমরা কোন পাপ করিনি, কোন চুরি-ডাকাতিও করিনি। যদি কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করা আমাদের অপরাধ হয়ে থাকে, তবে আমাদের ক্ষমা করে দাও। হে মরুভূমি ও এই অসহনীয় পরিবেশের মালিক! হে আমাদের দয়ালু খোদা! তুমি আর আমাদের কষ্ট দিও না। তুমি আমার প্রাণ নিতে চাও, নিয়ে নাও। তাতে, আমার কোন আফসোস নেই। শুধু তোমার রহমতের কাছে আমার প্রার্থনা, তুমি আমার রক্তকে পানি বানিয়ে দাও, যাতে আমি আমার মুমূর্ষ সাথীদেরকে তা পান করাতে পারি। এরাইতো তোমার প্রথম কেবলাগ্রাসকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তুমি আমার রক্তকে পানি বানিয়ে এদেরকে পান করিয়ে দাও খোদা।’

মোনাজাত শেষ করে সে তার সঙ্গীদের দিকে ফিরলো। সঙ্গীরা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো এবং চলতে লাগলো।

আন নাসের তার সাথীদেরকে দেখলো এবং পা টেনে টেনে চলতে লাগলো ওদের সাথে।

এ সময় আন নাসেরের চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না এ অন্ধকার, সহসাই সেখানে যেন আলোর নাচন শুরু হলো। চাঁদকে মুক্ত করে কালো মেঘ সহসা সরে গেল যেমনটি হয় অনেকটা সে রকম। অন্ধকার দূর হওয়ার সাথে সাথে তার মনে হলো, যেন শস্য ক্ষেত। কিন্তু তার সামনে আসলে বালির টিলা ও পাথরের স্তম্ভ ছাড়া আর কিছু ছিল না। সে এক মুহূর্তের জন্য সবুজ মাঠ দেখলো, সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ বন্ধ করে ফেললো। সে বুঝতে পারলো, মরুভূমি তাকেও ধোঁকা দিতে শুরু করেছে।

তারা এক টিলার মাঝ দিয়ে যাচ্ছিল। টিলাটি ছিল বেশ প্রশস্ত। কোথাও কোথাও বালির মাঝে পাথরের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। তারা একটু সামনে অগ্রসর হলো, তখন তাদের সামনে পড়লো একটি মরা নদীর শুকনো পাড়। স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, এখানে পানির চিহ্ন ছিল, তবে তা কত শত বছর আগে, তা বলা মুশকিল।

আন নাসের আগে ও তার সাথীরা পিছনে তাকে অনুসরণ করছিল। আন নাসের চলতে চলতে থেমে গেল। সে তার মাথাকে জোরে ঝাকি দিয়ে সামনে তাকালো। সে পূর্বে যা দেখেছিল, তাই দেখতে পেল। শুকনো নদীর অপর তীরে বালির পাহাড়। সে পাহাড় উপরে উঠে আবার ঝুঁকে গেছে উল্টো দিকে। সম্ভবত বহু শতাব্দী আগে এর তলদেশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো। এখনও তার সেই আকৃতি বহাল আছে। পাহাড়ের একাংশ ঝুঁকে আছে নিচের দিকে, তার নিচে ঘন ছায়া। আন নাসের দেখতে পেল, সেই পাড়ের ছায়ায় দুটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। আর তার কাছেই দুই যুবতী বসে আছে। তাদের গায়ের রং ধবধবে ফর্সা, চেহারাও কোমল ও আকর্ষণীয়। আন নাসের ভাবলো, আবার সে মরুভূমির হেলোসিনেশনে পড়েছে। সে আবারও চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকালো এবং চোখ খুলে তাকালো সেদিকে। না, সে ভুল দেখছে না। তার ইন্দ্রিয়ও প্রতারণা করছে না তাকে।

আন নাসের দূর থেকে দেখছিল তাদের। সে পাশ ফিরে তাকালো, সঙ্গীরা ততক্ষণে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারাও সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে। সে সাথীদের জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কি আমার মতো সামনের ছায়ায় দু’টি ঘোড়া ও দু’জন মেয়েকে দেখতে পাচ্ছো?’

মানসিক ভারসাম্যহীন তার দুই সাথী নীরব থাকলো, কথা বললো না। অন্যজন বললো, ‘হ্যাঁ, আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি, দু’টি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে বসে আছে দুই যুবতী।’

‘আল্লাহ আমাদের ওপর রহম করুন!’ আন নাসের বললো, ‘আমাদের দু’জনেরও কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! আমরাও কি সেই ভৌতিক দৃশ্য দেখতে শুরু করেছি, যা সত্য নয়! নইলে এই বিরান জাহান্নামে, এমন নিস্তব্ধ নির্জন প্রান্তরে এত সুন্দরী মেয়ে আসবে কোথেকে? তাদের পোষাক যদি মরুভূমির বেদুইনদের মত হতো, তবু না হয় ভাবতাম, এটা কোন ভৌতিক কাণ্ড নয়!’

তার সাথী বললো, ‘কিন্তু এমন নাগরিক পোষাক পরা মেয়ে এখানে আসতেই পারে না। তোমার ধারনাই বোধহয় ঠিক, আমরাও মানসিক দু:স্বপ্নের কবলে পড়ে গেছি। চলো এক কাজ করি, সামনের ছায়ায় গিয়ে বসি। হয়তো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে আমাদের এ ভ্রান্তি কেটে যাবে।’

‘কিন্তু আমি তো স্বাভাবিক অবস্থায় আছি।’ আন নাসের বললো, ‘আমি তোমাকে চিনতে পারছি, তোমার কথাও আমি বুঝতে পারছি। আমার মাথা এখনও আমার নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে!’

‘আমিও তো সজ্ঞানেই আছি!’ তার সাথী বললো, ‘আমি তো আসলে মেয়েই দেখছি, পরীর মত সুন্দরী দুই মেয়ে!’

হঠাৎ কি মনে হতে একটি মেয়ে মুখ উপরে তুললো, সাথে সাথে তার নজরে পড়ে গেল কয়েকটি মনুষ্য মূর্তি। সে সঙ্গের মেয়েটিকে কিছু বললো, তারপর দুজনেই তাকালো তাদের দিকে।

মেয়েরা তাদেরকে দেখে এতটাই বিস্মিত হলো যে, তারাও বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো। মনে হলো, তারাও অনড় অনুভূতিহীন পাথর হয়ে গেছে। তারা অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা অনড় মনুষ্য মূর্তিগুলোর দিকে।

আন নাসের ভীরু বা কাপুরুষ ছিল না। জ্বীন-ভূত যাই হোক, সে তাদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে বিস্ময় কাটিয়ে নিজের মধ্যে একটা সপ্রতিভ ভাব ফিরিয়ে আনলো। তারপর বীরের মতই ধীর অথচ দৃঢ় পায়ে তাদের দিকে অগ্রসর হলো।

এ দেখেও মেয়ে দুটির মধ্যে তেমন কোন ভাবান্তর এলো না। তারা তাদের জায়গায় তেমনি অনড় হয়ে বসে রইলো, পালিয়ে যাওয়ার বা রুখে দাঁড়াবার কোন চেষ্টাই তাদের মধ্যে দেখা গেল না।

আন নাসের ও তার সঙ্গীরা তাদের থেকে আর মাত্র চার পাঁচ গজ দূরে, এমন সময় একটি মেয়ে তার ডান হাত সামনে বাড়িয়ে আন নাসেরের দিকে তাক করলো এবং তাদেরকে ওখানেই থেমে যাওয়ার ইঙ্গিত করলো।

আন নাসের ও তার সঙ্গীরা থেমে গেল। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেই রূপসীদের দিকে। এমন সুন্দরী মেয়ে তারা জীবনেও দেখেনি। মেয়েদের মাথায় রঙিন ওড়না। ওড়নার পাশ দিয়ে কাঁধের ওপর পড়ে আছে রেশমের মত কোমল চুলের গুচ্ছ। চোখের তারায় আশ্চর্য মোহিনী আকর্ষণ। সেই চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো চার কমাণ্ডো সেনা।

‘দেখেই বুঝতে পারছি তোমরা সৈনিক! ওদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যে বড় সে বললো, তোমরা কার সৈনিক?’

‘সব কথাই বলব।’ আন নাসের বললো, ‘আগে আমাকে বল, তোমরা মরুভূমির ধোকা, নাকি পরীস্থানের পরী।’

‘আমরা যা কিছুই হই না কেন, আগে বলো, তোমরা কে, আর কোনদিক থেকে এসেছো?’ মেয়েটি প্রশ্ন করলো।

অন্য মেয়েটি বললো, ‘আমরা মরুভূমির ধোকাও নই, পরীস্থানের পরীও নই। তোমরা আমাদের যেমন দেখছো আমরা ঠিক তেমনটিই। আমরা তোমাদের দেখে যেমন বুঝতে পারছি, তোমরা সৈনিক, চোখ থাকলে তোমরাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমরা দুই নারী ছাড়া আর কিছু নই।’

‘আমরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইবীর কমাণ্ডো সৈনিক।’ আন নাসের বললো, ‘আমরা রাস্তা ভুলে এদিকে চলে এসেছি। যদি তোমরা জ্বীন জাতির হও, তবে হযরত সোলায়মানের কসম! দয়া করে আমার এই সাথীদের পানি পান করাও, বিনিময়ে ইচ্ছে করলে আমার জান নিয়ে নিও। এরা আমার অধীনের সৈনিক, এদের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার।’

‘তোমার সব কথাই আমি শুনতে রাজি, তবে সবার আগে তোমাদের অস্ত্র ত্যাগ করতে। অস্ত্রের মুখে কোন শর্ত মানাকে আমি অপমানজনক মনে করি।’ মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হযরত সোলায়মানের কসম দিয়ে চাওয়া জিনিস তুমি পাবে। তোমার সঙ্গীদেরকে আগে ছায়ায় নিয়ে এসো।’

আন নাসেরের অস্তিত্বে জীবনের নতুন স্রোত বয়ে গেল। সে অনুভব করলো, এই স্রোত তার মাথা দিয়ে প্রবেশ করে পায়ের তলা দিয়ে বের হয়ে গেল। এই স্রোতের অনুভব অন্যরকম। সে মানুষের সঙ্গে মােকাবেলা করতে পারে, রাতের অতর্কিত আক্রমণে সে বরাবর সঙ্গীদের চমক লাগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু কোন জ্বীনের সঙ্গে লড়াই করার ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতা তার নেই। তার মনে হলো, এরা বাস্তব দুনিয়ার কোন মানুষ নয়। আর এ কথা মনে হতেই সে এই দুই অবলা নারীর কাছে নিজেকে খুব অসহায় অনুভব করতে লাগলো। তার অন্তরে এমন ভয় ঢুকে গেল যে, সে কাপুরুষের মত এই দুই মেয়ের কাছে আত্মসমর্পন করবে কিনা ভাবতে লাগলো।

সে জ্বীন-পরীদের বহু গল্প শুনেছে, কিন্তু নিজে কোন জ্বীন বা পরীর সামনে কোনদিন পড়েনি। তার ভয় হলো, যদি মেয়ে দু’টি বা তাদের ঘোড়া এখন চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়! অথবা তারা যদি আকৃতি পরিবর্তন করে ফেলে! এমন হলে তো তার কিছুই করার থাকবে না। সে অসহায় ও নিরুপায় ভঙ্গিতে তার সাথীদের বললো, ‘তোমরা ছায়ায় চলো।’

তার এক সাথী তখন বেহুশের মত পড়েছিল মাটিতে। অন্য সাথীরা তাকে ধরাধরি করে টেনে ছায়াতে নিয়ে গেল।

ওরা ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার পর অপেক্ষাকৃত বড় মেয়েটি বললো, ‘এবার আমাদের বলো, তোমরা কি করে এখানে এসেছো?’

‘আগে পানি পান করাও!’ আন নাসের অনুরোধ করলো, ‘শুনেছি, জ্বীন-পরীরা সব জিনিস সবখানে উপস্থিত করতে পারে।’

‘ঘোড়ার সাথে পানির মশক আছে, একটা খুলে নাও।’ মেয়েটি বললো।

আন নাসের নিজেই এগিয়ে গিয়ে ঘোড়ার জ্বীনের সাথে বাঁধা মশক খুলে আনলো। মশকটি পানিতে পূর্ণ। সে প্রথমে বেহুশ সাথীর ওপর ঝুঁকে পড়ে তার মুখে পানির ফোটা ঢেলে দিল। কয়েক ফোঁটা মুখে যেতেই সে চোখ খুললো। তার ওপর কমাণ্ডারকে ঝুঁকে থাকতে দেখে নিজে থেকেই উঠে বসলো। আন নাসের তার মুখে মশক চেপে ধরলো।

কয়েক ঢোক পান করার পর আন নাসের তার মুখ থেকে সেই মশক একরকম কেড়েই নিয়ে নিল। ও চাচ্ছিল, সে পেট ভরে পানি পান করবে; কিন্তু আন নাসের তাকে বেশী পানি পান করতে দিল না।

তার পানি খাওয়া হয়ে গেলে একে একে সবাই পানি পান করলো। আন নাসের ও তার সাথীদের ক্লান্তি ও অবসাদ তাতে অনেকটাই দূর হয়ে গেল। তখন তাদের চিন্তা শক্তি নতুন করে সচল হয়ে উঠতে লাগলো।

আন নাসের ভেবে দেখলো, এই নারীরা যদি কাল্পনিক কিছু হতো তবে এই সজীবতা ফিরে পাবার পর তাদের আর দেখা যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু মেয়েরাতো এখনও বর্তমান, সে সম্পূর্ণ সজ্ঞানে এবং নিজ চোখেই তাদের দেখতে পাচ্ছে। তার চেয়ে বেশী বাস্তব হলো, তারা পানি পান করতে দিয়েছে। আর এ পানি যদি কাল্পনিকই হতো, তবে শরীরে সজীবতা ফিরে আসতো না। সে মেয়েদের দিকে আর একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। তখন মেয়ে দু’টিকে আরও সুন্দরী ও আকর্ষণীয় মনে হলো তার কাছে। সেদিকে তাকিয়েই তার আবার মনে হলো, এরা সত্যি মানুষ নয়, কারণ মানুষ এতো সুন্দর হতে পারে না।

এই যখন আন নাসেরের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা তখন আবার সে নিজেকে খুব দুর্বল ও অসহায় অনুভব করলো। নিজেকে তার এতটাই হীনবল মনে হচ্ছিল যে, নিজের উপর থেকে নিজেই আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিল। সে অনুভব করছিল, তার বুদ্ধি সব গুলিয়ে যাচ্ছে, সে আর সুস্থ মাথায় চিন্তা করারও যােগ্য নেই।

পানি পান করার কারণে তার সাথীদের চেহারায়ও জীবন ফিরে এসেছিল। মেয়েদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে সাথীদের দিকে তাকালো। কয়েক ফোটা পানির কি অপূর্ব মহিমা তাই দেখে বিস্মিত হলো সে। পানিটুকু যেন তাদের শরীরের প্রতিটি কোষে ও শিরায় শিরায় অনুপ্রবেশ করে তাদেরকে জীবন্ত করে তুলেছে।

আন নাসেরের মত তার সাথীদের মনেও ভয় সঞ্চারিত হয়েছিল। তারাও ভাবছিল, এরা কি মানুষ, না জ্বীন!

মেয়ে দুটিও তাদেরকে দেখছিল প্রস্ফুটিত নীরব দু’চোখ মেলে। বাইরের দুনিয়া তখন জ্বলছে মরু সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে। মাটি জ্বলন্ত কয়লার মত উত্তপ্ত হয়েছিল, কিন্তু ওরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল পাহাড়ের সেই ছায়াঘন জায়গাটি ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও উত্তাপের ভয়াবহ তাপ মুক্ত।