সুলতান আইয়ুবীর এ আশংকা ভিত্তিহীন ছিল না। তিনি হিম্মত পর্বত শৃঙ্গের যুদ্ধে সাইফুদ্দিনের সেনাপতি, মুজাফফরুদ্দিনকে ভাল মতই শিক্ষা দিয়েছিলেন। সে শিক্ষার কথা ভুলে গিয়ে না থাকলে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা মুজাফফরুদ্দিন অবশ্যই করবে।
এই মুজাফফরুদ্দিন এক কালে সুলতান আইয়ুবীরই সেনা সদস্য ছিল। নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভাগুণে দৃষ্টি কেড়েছিল আইয়ুবীর। আইয়ুবী তাকে ধাপে ধাপে প্রমোশন দিয়ে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। গাদ্দারীর খাতায় নাম লেখানোর সময় সে-ই ছিল সুলতান আইয়ুবীর সেনাপতির দায়িত্বে। সুলতান তাকে এতটাই বিশ্বাস করেছিলেন যে, সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমাণ্ড তিনি তার হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু শক্তি ও ক্ষমতার মোহ এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধি, যা বশে রাখতে না পারলে তা নিজের বিবেক ও মনুষত্বকেই ধ্বংস করে দেয়। মুজাফফরুদ্দিনকেও ধরেছিল সেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে। আইয়ুবীর বাহিনীর সেনাপতি হওয়ার পরও গাদ্দারের খাতায় নাম লেখাতে বাঁধেনি তার।
ফলে তারা উভয়ে উভয়কে ভাল মতো চিনতো। সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধ কৌশল, নিপূণতা ও দক্ষতার কথা যেমন জানা ছিল মুজাফফরুদ্দিনের, তেমনি আইয়ুবীরও জানা ছিল মুজাফফরুদ্দিনের দৌঁড় কতদূর যেতে পারে।
মুজাফফরুদ্দিনের এ দিকটিও সুলতান নজরে রেখেছিলেন যে, সে জন্মগতভাবেই যোদ্ধা প্রকৃতির লোক, এটা তার বংশীয় উত্তরাধিকার। আর সে সামরিক শিক্ষা লাভ করেছে সুলতানের নিজের কাছেই। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর শিক্ষা তিনি তাকে দেননি।
মুজাফফরুদ্দিন ছিল সাইফুদ্দিনের নিকটাত্মীয় অর্থাৎ চাচাতো ভাই। সুলতান আইয়ুবী যখন মিশর থেকে দামেশকে চলে আসেন তখন সেখানকার একদল মুসলমান আমীর সুলতানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। সে সময় দৃশ্যতঃ শক্তির পাল্লা ভারী ছিল ওই ষড়যন্ত্রকারীদের। সাইফুদ্দিন তখন তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। আত্মীয়তার সূত্র ধরে মুজাফফরুদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করে সাইফুদ্দিন এবং তার মধ্যে সৃষ্টি করে লোভ ও ক্ষমতার মোহ। সেই মোহ তাকে আর সুলতানের দলে থাকতে দেয়নি। মুজাফফরুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীকে কিছু না বলে পালিয়ে গিয়ে যোগ দেয় সাইফুদ্দিনের সাথে। উদ্দেশ্য, দুই ভাই মিলে নতুন এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে। কিন্তু সে স্বপ্ন তাদের এখনো পূরণ হয়নি।
তুর্কমান যুদ্ধের আগে হিম্মত পর্বত শৃঙ্গের যুদ্ধে সুলতান প্রথম মুজাফফরুদ্দিনের মুখোমুখি হন। মুজাফফরুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর ওপর পার্শ্বদেশ থেকে এমন আক্রমণ চালিয়েছিল যে, সে আক্রমণ ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত সুলতান আইয়ুবীকে নিজের হাতে কমাণ্ড নিয়ে সরাসরি ময়দানে নেমে আসতে হয়েছিল।
কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ লিখেছেন, যদি সুলতান আইয়ুবী সে যুদ্ধে নিজের হাতে কমাণ্ড নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে না পড়তেন, তবে যুদ্ধের ফলাফল হতো ভিন্ন রকম।
সে যুদ্ধে মুজাফফরুদ্দিন সেনানায়ক হিসেবে যথেষ্ট দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছিল। সমর নৈপূণ্যের ওস্তাদী প্রদর্শনে সে কোনরূপ কার্পণ্য করেনি, কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, সে লড়ছিল তারই ওস্তাদ সুলতান আইয়ুবীর সাথে, যে জন্য বিজয়ের দেখা পাওয়া তার ভাগ্যে ঘটেনি।
মরু সাইমুম উপেক্ষা করে ছুটে আসা মিল্লাতের এক দুঃসাহসী কন্যা ফৌজির কাছ থেকে খবর পেয়ে আইয়ুবীর গোয়েন্দারা ছুটে গিয়েছিল তুর্কমানের সেই ময়দানে। সেখান থেকে তারা সম্মিলিত শত্রু বাহিনীর যেসব তথ্য ও বিবরণ সংগ্রহ করতে পেরেছিল সুলতানের কাছে তা যথাসময়েই পৌঁছে দিয়েছিল। গোয়েন্দা বাহিনীর দেয়া সে তথ্য বিবরণী থেকে জানা যায়, মুজাফফরুদ্দিনও এ বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে সে ঠিক কোথায় ছিল, অগ্রবর্তী বাহিনীতে, নাকি মূল বাহিনীতে, না ডান ও বায়ের, রিজার্ভ বাহিনীতে, তার কিছুই জানার সুযোগ হয়নি। এটা জানা থাকলে সুলতান এখন, ঠিকই আন্দাজ করতে পারতেন, মুজাফফরুদ্দিন এখন কোথায় কি করছে।
সুলতান আইয়ুবী কয়েকজন যুদ্ধবন্দীকে ডেকে এনে মুজাফফরুদ্দিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা জানালো, তিনি সম্মিলিত বাহিনীর সাথেই ছিলেন। কিন্তু এখন কোথায় তা তারা বলতে পারে না।
হতে পারে বন্দীরা আসলেই মুজাফফরুদ্দিন সম্পর্কে বেশী কিছু জানে না অথবা জেনেও তারা তা গোপন করে গেছে। ঘটনা যাই হোক, সুলতান আইয়ুবী যে তার ব্যাপারে তেমন কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারলেন না এটাই সত্যি হয়ে দাঁড়ালো।
তিনি সেনাপতিদের বললেন, আমি বিশ্বাস করি না, সে যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেছে। সে আমার সাগরেদ! আমি তার সামরিক যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে জানি। কেবল তার যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কেই জানি না, তার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কেও ভাল রকম খবর রাখি। সে অবশ্যই আক্রমণ চালাবে। সে যদি মনে করে যুদ্ধে পরাজিত হবে, তবুও সে আক্রমণ চালাবে। তাকে আক্রমণ চালাতেই হবে, কারণ প্রতিহিংসা চরিতার্থ না করা পর্যন্ত তার নাওয়া খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে যাবে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আর যাই হোক, এ কথা মানতে পারে না, মুজাফফরুদ্দিন পালিয়ে গেছে।
সুলতান আইয়ুবী এত জোর দিয়ে এ কথা বলার পেছনে একটা কারণ আছে। হিম্মত পর্বত শৃঙ্গের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন চিৎকার করে বলছিল, ‘সালাহউদ্দিন, আবার আমাদের দেখা হবে যুদ্ধের ময়দানে। যতক্ষণ তোমাকে পরাজিত করতে না পারবো বা নিজে নিঃশেষ হয়ে যাবো ততক্ষণ আমি ক্ষান্ত হবে না।’ মুজাফফরুদ্দিনের মুখের সে আওয়াজ বহু দূর থেকেও সৈনিকরা শুনতে পাচ্ছিল।
তুর্কমান রণাঙ্গণ থেকে বহু দূরে হিম্মত পর্বত শৃঙ্গের সে আওয়াজ এখনো যেন সুলতান শুনতে পাচ্ছেন। সাইফুদ্দিনের পরিত্যক্ত ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে সে আওয়াজের প্রতিধ্বনিই শুনছিলেন আইয়ুবী।
❀ ❀ ❀
তুর্কমান যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত। সাইফুদ্দিনের এক গোয়েন্দা কমান্ডার মুজাফফরুদ্দিনের কাছে পৌঁছে বললো, “এই মাত্র দু’জন অশ্বারোহীকে দূর থেকে দেখতে পেলাম, তারা তীর বেগে ছুটে যাচ্ছে আইয়ুবীর ক্যাম্পের দিকে। সম্ভবত এরা আইয়ুবীর তথ্য অনুসন্ধানী সদস্য। যদি আমার অনুমান সঠিক হয় তাহলে বলতে পারি, আক্রমণের আগেই আমাদের এখানে এসে পৌঁছার সংবাদ সুলতান সালাহউদ্দিনের কাছে পৌঁছে যাবে। আর আইয়ুবী আমাদের আক্রমণের খবর পাওয়ার মানে হচ্ছে, যত সহজে আমরা বিজয় আশা করছি তা সম্ভব হবে না। আমাদের আক্রমণের আগেই সে আমাদের বাঁধা দিতে ছুটে আসবে। মুজাফফরুদ্দিনের জন্য এ ছিল এক তাৎপর্যময় খবর। সে আর কালবিলম্ব না করে কাউকে কিছু না জানিয়ে যুদ্ধের ছক নতুন করে আঁকলো। আইয়ুবীর বিরুদ্ধে এখন এখানে মুখোমুখি যুদ্ধ করা বৃথা। এ মুহূর্তে এ যুদ্ধে জয় লাভ করার একটাই উপায়, প্রাথমিক লড়াই থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া। সবচেয়ে ভাল হয়, বাহিনীকে কোন নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখে যুদ্ধের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। তারপর যদি আইয়ুবী জিতেই যায়, তখন বিজয়ের আনন্দে বিভোর হয়ে ওরা যখন মেতে উঠবে আনন্দ কোলাহলে, তখন তাদের ওপর অতর্কিতে চড়াও হওয়াটাই হবে তার একমাত্র কাজ।
সেই মোক্ষম সময় আসার আগ পর্যন্ত ময়দান থেকে নিজের বাহিনী সরিয়ে নেয়ার দ্রুত উদ্যোগ নিল মুজাফফরুদ্দিন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সে তার বাহিনী নিয়ে সেখান থেকে সরে পড়লো।
‘আমরা আপনার প্রতিটি আদেশ পালন করবো।’ মুজাফফরুদ্দিনের এক সহ-সেনাপতি বললো, ‘কিন্তু এই অবস্থায়, যখন আমাদের সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত, সৈন্যদের অধিকাংশই হয় মৃত, আহত বা বন্দী, যে সামান্য সংখ্যক সৈন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত, সেই অবস্থায় আমাদের এই সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আক্রমণ চালানো মোটেই সমীচীন হবে না।’
‘আমার এই সৈন্যবাহিনীকে আমি নগণ্য সংখ্যক বলতে পারি না। একেই আমি যথেষ্ট মনে করি।’ মুজাফফরুদ্দিন বললো, ‘এই সৈন্য আমাদের সম্মিলিত সৈন্যের এক চতুর্থাংশ। সুলতান আইয়ুবী এর চেয়েও কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করতেন ও সফলতা লাভ করতেন। আমি তার বাহিনীর এক পাশ থেকে আক্রমণ করবো। তাকে সে কৌশল চালানোর সুযোগ দেবো না, যে কৌশল তিনি হিম্মত পর্বত শৃঙ্গে চালিয়েছিলেন। তোমরা সবাই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও।’
‘আমাদের সুপ্রিম কমাণ্ড সাইফুদ্দিন গাজী মুশেলের আমীরসহ তিনটি বাহিনীর সম্মিলিত ফোর্স নিয়েও হেরে গেলেন।’ সহ-সেনাপতি বললো, ‘আমাদের পরামর্শ নিয়ে আবারও চিন্তা করুন। কারণ এই সামান্য সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করা আত্মহত্যার সামিল।’
‘যুদ্ধের ময়দান নারী, মদের পিপা ও সুরাহী রাখা লোক দিয়ে ভরে ফেললেই যুদ্ধ জয় করা যায় না। মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিন সে চেষ্টা করতে গিয়েই পরাজিত হয়েছে।’ মুজাফফরুদ্দিন বললো, ‘আমিও শারাব পান করি। কিন্তু সব সময় না। সুলতান আইয়ুবী আমাকে গাদ্দার বলে গাল দেয়।
আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার সময় সে যখন চিন্তা করে না আমি তার সাগরেদ ছিলাম, তখন আমিও এ কথা মনে রাখতে চাই না, তিনি আমার ওস্তাদ ছিলেন। তিনি আমাকে গাদ্দার বলেন, আমি গাদ্দার নাকি মুসলমান এখন আর এ হিসাব করতে চাই না। আমার হিসাব হচ্ছে, এখানে দুই সেনাপতির লড়াই ও সংঘর্ষ হবে, দুই বীর যোদ্ধার শক্তি পরীক্ষা হবে। এ শক্তি পরীক্ষায় দুই তলোয়ারের সংঘর্ষে সেই জিতবে, যার বাহুর জোর বেশী। আমার বাহুর উপর আমার আস্থা আছে। তোমরা নিজেদের বাহিনী প্রস্তুত করো।’
মুজাফফরুদ্দিনকে বুঝানোর চেষ্টা বৃথা ভেবে সহ – সেনাপতি যাবার জন্য পা বাড়ালো, মুজাফফরুদ্দিন বললো, ‘আর স্মরণ রেখো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের দৃষ্টি মাটির নিচেও যেতে পারে। তোমাদের থাকতে হবে খুবই হুশিয়ার। মোক্ষম সময়ের জন্য আমাকে হয়তো আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। সুলতান আইয়ুবী খেকশিয়ালের মতই চালাক আর খরগোশের মত ক্ষীপ্র। আমাকে আমার গোয়েন্দারা জানিয়েছে, তিনি এখনও গনিমতের মাল বন্টন শুরু করেননি। তার সৈন্যদেরও স্ব-স্ব স্থান ত্যাগ করার হুকুম দেননি। এতে বোঝা যায়, তিনি আর অগ্রাভিযান চালাবেন না। আর এ কথাও আমার মোটেও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, তিনি আশংকা করছেন, আমরা আবারও তার ওপর আক্রমণ চালাতে পারি।
আমি ভাল ভাবেই জানি, তিনি কেমন ধরনের চিন্তা করছেন। আমি তাকে ধোঁকা দেবো, তাকে বুঝিয়ে দেবো, আমরা সবাই পালিয়ে গেছি। এখন আর বিপদের কোন সম্ভাবনা নেই। এরপর শুরু হবে যুদ্ধের নতুন খেলা। অস্ত্র নয়, শুরু হবে বুদ্ধির লড়াই।
এ জন্য দিন দুইয়ের বেশী তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে না। তার গতিবিধির ওপর আমি পূর্ণ নজর রাখছি। তার গোয়েন্দারা ঘুরবে বুকে সন্দেহ আর সংশয় নিয়ে আর আমার গোয়েন্দারা নজর রাখবে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর স্থির লক্ষ্যে। যখনই আইয়ুবী তার সৈন্যদের মাঝে লুটের মাল বন্টন করতে আরম্ভ করবে, তখনই আসবে সেই কাংখিত সময়। তখন সৈন্যদের শৃংখলা ভেঙ্গে যাবে, লক্ষ্য থাকবে শুধু গনিমতের মালের দিকে, তখন আমি অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বো তাদের ওপর।
সুলতানের মত আমিও জানি, অস্ত্র বা লোকবল দিয়ে যুদ্ধে বিজয় আসে না, যুদ্ধে জয় হয় শত্রুর দুর্বল জায়গায় সময় মত আঘাত হানার মাধ্যমে। আইয়ুবী বহু লড়াই করেছে, কিন্তু কেউ তার দুর্বল জায়গায় সময় মত আঘাত হানতে পারেনি। ফলে বার বার সে বিজয়ী হয়েছে, কিন্তু সে সুযোগ আর আমি তাকে দেবো না।’
সহ-সেনাপতি স্থির চোখে তাকিয়েছিল তাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেনাপতির দিকে। তার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তিনি ঠিকই বলছেন। আইয়ুবী যত বড় সেনানায়কই হোক না কেন, তার কোন না কোন দুর্বলতা না থেকেই পারে না। হয়তো এই দিগ্বিজয়ী সেনানায়কের পরাজয় আমাদের হাতেই লেখা আছে। হয়তো তাকে অন্তিম আঘাত হানার জন্য নিয়তি আমাদেরকেই বাছাই করে রেখেছে।
সে মুজাফফরুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার দূরদর্শিতার তারিফ করার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি। আপনি যেমনটি ভেবেছেন তাই ঘটবে। সময় মত আপনি আমাদের প্রস্তুত পাবেন।’
মুজাফফরুদ্দিন বললো, ‘আজ রাতেই সৈন্যদেরকে এখান থেকে আরো দূরে কোথাও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেবে। আর দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেবে নিজেদের গোয়েন্দাদের। তাদের বলে দেবে, সন্দেহজনক কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলেই যেন তাকে গ্রেফতার করে ধরে আমাদের গোপন ক্যাম্পে নিয়ে আসে।’
আক্রমণের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ ও সময় সম্পর্কে মুজাফফরুদ্দিন কিছুই বললো না। সহ-সেনাপতি তাকে বললো, আপনার ধারনাই ঠিক, সুলতান আইয়ুবী নিশ্চয়ই কিছু সন্দেহ বা আশংকা করেছেন। নইলে এতক্ষণে, তিনি গনিমতের মাল বন্টন শুরু করে দিতেন। রাতে মুজাফফরুদ্দিনের নির্দেশে সৈন্যদলকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব এমন একটি জায়গা বেছে নিয়ে ক্যাম্প করলো সহসেনাপতি।
❀ ❀ ❀
সাইফুদ্দিনের সেনাদলের ওপর সুলতান আইয়ুবীর আক্রমণ ছিল যেমন অতর্কিত ও তাদের কল্পনার অতীত, আইয়ুবীর বাহিনীর জন্যও তেমনি এক অতর্কিত ও কল্পনাতীত আক্রমণের প্রস্তুতি চলছিল মুজাফফরুদ্দিনের ক্যাম্পে। সাইফুদ্দিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আইয়ুবী তার এত সতর্ক ও অতর্কিত অভিযানের খবর আগেই পেয়ে যাবে এবং তার স্বপ্ন ও আশা ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে তার বাহিনী তছনছ করে তাকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য করবে।
আইয়ুবীও ভাবতে পারেনি, তাঁর এত সতর্কতাকে ডিঙিয়ে মুজাফফরুদ্দিন তাকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে ঝড়ের বেগে আঘাত হানতে পারে তার বাহিনীর ওপর। কিন্তু যুদ্ধ এমন এক জিনিস, যা পূর্ব নির্ধারিত ধারনা ও কল্পনাকে মুহূর্তে পাল্টে দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করত পারে।
সুলতান আইয়ুবী তার সৈন্যদেরকে সাইফুদ্দিনের সম্মিলিত বাহিনীর ডান, বাম ও পিছনে এমনভাবে সুবিন্যস্ত করেছিলেন যে, চতুর্মুখী আক্রমণে সাইফুদ্দিন যেন ধরাশায়ী হতে বাধ্য হয়। এ ছাড়াও তার কমাণ্ডো বাহিনীকে আশেপাশে আগে থেকেই মোতায়েন করে রেখেছিলেন, যাতে আশপাশের এলাকাতেও তাদের প্রাধান্য বজায় থাকে।
এসব কমাণ্ডো বাহিনীর কমাণ্ডার ও সৈনিকরা ছিল বিশেষভাবে বাছাই করা। তারা সবাই ছিল অসাধারণ প্রতিভাধর। বুদ্ধিমত্তা, বীরত্ব ও ক্ষীপ্রগতির জন্য এরা ছিল দুশমনের আতংক। এদেরকে এমনভাবে কমাণ্ডো ও গোয়েন্দা ট্রেনিং দেয়া হতো, যাতে তারা যে কোন ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারে।
এই গোয়েন্দা বাহিনীর প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল নিচে চার, উপরে বারো জন। চার থেকে শুরু করে বারো জনের একেকটি ছোট্ট গ্রুপ কাজ করতো স্বাধীনভবে। যে কোন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ভোগ করতো এরা। এরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দুশমনের বাহিনীর ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে শত্রু শিবিরে ত্রাস ও আতংকের সৃষ্টি করতো।
শত্রুদের পিছু ধাওয়া করে এমনি একটি কমাণ্ডো দলের বারো জন সদস্য যুদ্ধের ময়দান থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিল। দফায় দফায় শত্রুদের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয় এবং এই সংঘর্ষে বারো জনের মধ্যে আট জনই শহীদ হয়ে যায়।
এই কমাণ্ডো দলের কমাণ্ডার ছিল আন নাসের। সঙ্গে তিন জন সদস্য নিয়ে আন নাসের তখনো ছুটছিল সাইফুদ্দিনের পলাতক বাহিনীর পিছনে। তার কমাণ্ডো বাহিনী তখন তুর্কমান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরে।
সাইফুদ্দিনের এ বাহিনীটি ছিল রসদবাহী। কমাণ্ডোদের লক্ষ্যবস্তু ছিল শত্রুদের সেই রসদপত্র। তারা সবাই ছিল অশ্বারোহী। তাদের কাছে ছিল পেট্রোল ভেজা সলতে জড়ানো তীর, তবে তা পরিমাণে খুব কম। এ ছাড়াও ছিল বর্শা, তলোয়ার ও খঞ্জর।
রসদ তখনো তাদের নাগালের অনেক দূরে। এলাকাটি মরুভূমি না হওয়ায় ধাওয়া করতে সুবিধা হচ্ছিল আন নাসেরের। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছিল পাহাড়ী এলাকা, টিলা ও নিম্নাঞ্চল। এলাকাটি লুকিয়ে অনুসরণ করার জন্য ছিল খুবই উপযোগী। দিনের বেলায়ও লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি পৌঁছে ঘোড়া লুকানোর সুযোগ ছিল। সম্মিলিত বাহিনীর সৈন্যদের যাবতীয় খাদ্যদ্রব্য, পশুর শুকনো ঘাস, খড়, দানা, ভূষি যতটুকু সম্ভব নিয়ে পালাচ্ছিল তারা। এ ছাড়াও এদের কাছে ছিল যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম, তীর, ধনুক, বর্শা ও তলোয়ার।
আন নাসের প্রথম রাতেই রসদপত্রের ওপর সফল আক্রমণ চালিয়েছিল। অনেক খাদ্যশস্য ঐ সলতে জড়ানো তীর নিক্ষেপের ফলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।
দিনের বেলা পলায়নপর বাহিনী লুকিয়ে এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিল। আন নাসেরও তার দলবল নিয়ে লুকিয়ে ছিল একটু দূরে পাহাড়ের এক গোপন গুহায়।
তারা বিশ্রাম নিলেও তাদের চোখ ছিল দুশমন কাফেলার ওপর। তারা দেখতে পেলো, শত্রু সেনারা নিম্নাঞ্চলে গর্ত, নালা ও টিলার আড়ালে তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। সাথে সাথে আন নাসের তার দলের কমাণ্ডোদের নিয়ে সরে গেল পাহাড়ের চূড়ার দিকে।
তাদেরকে পাহাড়ের উঁচু জায়গায় ঝোপের আড়ালে এদিক-ওদিক সুবিধামত স্থানে বসিয়ে দিল। তারা ধনুকে তীর জুড়ে বসে রইল কমাণ্ডারের নির্দেশের অপেক্ষায়। শত্রু সেনারা আশপাশের নিম্নাঞ্চল ঘুরে কাউকে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে গেল।
সূর্য ডোবার পর খাদ্যশস্যবাহী কাফেলা আবার যাত্রা শুরু করলো এবং মধ্য রাতের দিকে সৈনিকদের বিশ্রাম দেয়ার জন্য আবার এক স্থানে ক্যাম্প করে সে রাতের মত আশ্রয় নিল। কিন্তু গত রাতের মত অতর্কিত আক্রমণ আসতে পারে এই ভয়ে সে রাতে পর্যাপ্ত পাহারার ব্যবস্থা রাখলো।
আন নাসের ভেবে দেখলো, আজ রাতে গুপ্ত আক্রমণ তত সহজ হবে না। শত্রুরা ক্যাম্প ছাড়াও তার আশেপাশে কঠিন পাহারার ব্যবস্থা করে রেখেছে। পদাতিক ছাড়াও এ পাহারায় অংশ নিয়েছে অশ্বারোহী বাহিনী।
এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আন নাসের একটি রাত নষ্ট করতে চাইলো না। সে গুপ্ত হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কারণ তার সামনে এখনও পড়ে আছে শত্রুদের বহু রসদ-সম্পদ। এ সম্পদ শত্রুরা তাদের চোখের সামনে দিয়ে ফেরত নিয়ে যাবে, তা হতে পারে না। সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশ ও শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল তার। কমাণ্ডোদের কাজ বুঝিয়ে দেয়ার সময় তিনি বলতেন, শত্রুদের রসদপত্র ধ্বংস করা কমাণ্ডো বাহিনীর অন্যতম কাজ।
কমান্ডো বাছাই ও ট্রেনিংয়ের সময় এ জন্যই তিনি এমন সব সৈন্যদের দিকে নজর দিতেন, যারা বীরত্ব, সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় অসাধারণ! যাদের মধ্যে জাতীয় চেতনা বোধ ও ঈমানী জযবা প্রখর। এসব জানবাজ কমান্ডোরা দায়িত্ব পালনে এমন নিষ্ঠার পরিচয় দিত যে, বিপদসংকুল, মরুভূমিতে, যেখানে কেউ সাহায্য করার নেই, সেখানেও গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন কোরবানী করতে কুণ্ঠিত হতো না।
আন নাসের তাদের অনুসরণ করে তাদের ক্যাম্প থেকে নিরাপদ দূরত্বে নিজেদের ক্যাম্প করলো। ঘোড়াগুলো গোপন জায়গায় বেঁধে রেখে সঙ্গীদের বললো, “চলো আমার সঙ্গে।”
সে সঙ্গীদের নিয়ে হেঁটে গিয়ে পৌঁছলো দুশমনের ক্যাম্পের কাছে। তারপর পাহারাদারদের এড়িয়ে একটি গুপ্ত রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করলো তাদের রসদের ক্যাম্পে। সেখানে ওদের খাদ্যগুদামে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে সঙ্গীদেরকে যার যার মত পালিয়ে যাওয়ার হুকুম দিল। কিন্তু আগুন জ্বলার সাথে সাথেই পাহারাদাররা তৎপর হয়ে উঠলো। বেপরোয়া তীর বর্ষণ শুরু করলো ওরা।
আন নাসের ও তার এই সঙ্গীরা তখনো এক সাথেই ছিল। তীর বর্ষণ শুরু হতেই আন নাসের ওদের বললো, “খবরদার, দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে এখন আমরা বাঁচতে পারবো না। বাঁচতে চাইলে আমার সঙ্গে এসো।”
আন নাসের ওদের নিয়ে দুশমনের আস্তাবলের মধ্যে ঢুকে গেল। সেখানে তুলনামূলকভাবে আলো ছিল কম। তারা ঘোড়া এবং ঘোড়াগাড়ির আড়াল নিয়ে একটু একটু করে সরে এলো সেখান থেকে। এক সময় সেখান থেকে বেরিয়ে সন্তর্পনে নিজেদেরকে ছুঁড়ে দিল ক্যাম্পের বাইরে অন্ধকারের রাজ্যে।
এ যাত্রায়ও আন নাসের ও তার তিন জন সঙ্গী আল্লাহর অসীম রহমতে বেঁচে গেলো। শত্রু সেনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে এসে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো চার জন।
আন নাসের আকাশের দিকে তাকালো। কিন্তু আকাশ ছিল মেঘলা, তাই সেখানে কোন তারার আলো দেখা গেল না।
রাতের তারকা কামণ্ডোদের পথ দেখিয়ে থাকে। আলোর অভাবে দিকভ্রান্ত হলো আন নাসের ও তার সঙ্গীরা। যে অন্ধকারকে একটু আগে মনে হচ্ছিল আল্লাহর রহমত, সেই অন্ধকারই হয়ে দাঁড়ালো ওদের চলার পথের প্রতিবন্ধক।
সঙ্গীরা বললো, ‘আমাদের তাড়াতাড়ি ক্যাম্পে ফেরা দরকার। ওরা আমাদের সন্ধানে টহল বাহিনী পাঠাতে পারে।’
আন নাসের তাদের কথার যৌক্তিকতা অনুভব করলো। অনুভব করলো এখানে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করা ঠিক নয়। সে বন্ধুদের বললো, ‘চলো।’
আন্দাজের ওপর পথ চলছিল ওরা। আন নাসের ও তার সঙ্গীরা দীর্ঘক্ষণ পথ চলার পর অনুভব করলো, তারা পথ হারিয়েছে। যেখানে তারা ক্যাম্প করেছিল ঠিক পথে এগুলে আরো অনেক আগেই তাদের ক্যাম্পে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু আশায় আশায় বহু পথ মাড়িয়েও তারা ক্যাম্পের কোন হদিস পেল না। আন নাসের ওদের বললো, ’আমরা বোধহয় পথ হারিয়েছি।’
‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।’ বললো এক সঙ্গী।
ওরা থমকে দাঁড়ালো। পেছনে ফিরে দেখতে চেষ্টা করলো দুশমন ক্যাম্পের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা। কিন্তু তারা তখন দুশমন ক্যাম্প থেকে বহু দূর চলে এসেছিল, কোন আলোর শিখাই তাদের নজরে এলো না।
তখনও তাদের চোখে লেগে ছিল দুশমন শিবিরের রসদ ছাউনি, প্রজ্জ্বলিত আগুনের লাল শিখা ও দুশমনের তীর বৃষ্টির ঘোর। তাদের কোনই খবর ছিল না যে, তারা বেহুশের মত ছুটতে ছুটতে কোথায় চলে এসেছে।
কিছুক্ষণ তারা হতবুদ্ধি হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আবার শুরু করলো হারানো ক্যাম্পের অন্বেষণে অনিশ্চিত যাত্রা।
দিকনির্দেশনাহীনভাবে তারা সারা রাত ঘুরে মরলো। পথ চললো শ্লথ পায়ে, অন্ধকারে গভীর দৃষ্টি ফেলে তালাশ করলো নিজেদের ক্যাম্প, দুশমনের তাঁবু। কিন্তু চার জোড়া চোখ বার বার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। শত্রুদের ক্যাম্পের লেলিহান শিখা দূরে থাক, সে অগ্নিশিখার সামান্য লাল আভাও ওরা কোথাও দেখতে পেলো না।
হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের এক টিলা থেকে আরেক টিলায় উঠে যাচ্ছিল, ঘন জঙ্গল ও ঝোপঝাড় পেছনে ফেলে ঢুকে যাচ্ছিল আরেক জঙ্গলে, কিন্তু কোন ঘোড়া বা বাহনের দেখা পাচ্ছিল না এই ক্ষুদ্র কাফেলা।
দুশমনের খাদ্যগুদামে দেয়া আগুনের সামান্য আলোর রেখাও যদি ওরা দেখতে পেতো, তবু না হয় নিজেদের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হতো। কিন্তু তাও নেই, তাই তারা এলোমেলো পথ চলতেই থাকলো।
এক সময় পাহাড় ও জঙ্গলের সীমানা শেষ হলো। মাটির উঁচু নিচু ভাব শেষ হয়েছে, সামনে সমান্তরাল ভূমি, কিন্তু তাতে গাছপালার কোন চিহ্নমাত্র নেই।
তারা পায়ের তলে কঠিন মাটির ছোঁয়ার পরিবর্তে বালির প্রান্তর অনুভব করতে লাগলো। টিলা ও পাথরের কোন চিহ্ন নেই এখানে। বালির পথে তাদের অনিশ্চিত চলার গতি ভারী ও শিথিল হয়ে পড়লো। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তারা পিপাসার্ত হয়ে পড়লো। অসম্ভব ক্লান্তি এসে ঘিরে ধরলো তাদের।
খাদ্য ও খাবার পানি ঘোড়ার সাথে ক্যাম্পে রয়ে গেছে। এক ফোটা খাবার পানিও সাথে নেই যে তারা পিপাসা নিবারণ করে। ক্ষুধা, পিপাসা ও ক্লান্তিতে তাদের চলার শক্তি ক্রমশ: শিথিল হয়ে এলো। চলতে না পেরে এক সময় আন নাসের থেমে গেলো। বললো, ‘আর পারছি না। একটু পানি পেলে হতো!’
এটা কেবল আন নাসেরের কথা ছিল না, এটা ছিল সবারই মনের অব্যক্ত কষ্টের প্রতিধ্বনি। তারা সেখানেই বালির ওপর বসে পড়লো।
কতক্ষণ ওরা এভাবে বসেছিল বলা মুশকিল। এক সময় আন নাসেরের এক সঙ্গী বললো, ‘কিন্তু আমরা কি এভাবে বসে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবো? খাদ্য নেই, পানীয় নেই, এটা বাস্তবতা। কিন্তু মুজাহিদ কখনো আল্লাহর সাহায্য থেকে নিরাশ হয় না। আমরা-মরবো, তবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করে মরবো।’
আন নাসের ও তার সাথীরা আবার উঠে দাঁড়ালো। তারা এই আশা নিয়ে পথ চলতে লাগলো যে, সামনে কোথাও না কোথাও পানি পাওয়া যাবেই।
ওরা পথ চলছে। কিন্তু ঐ অঞ্চলে পানির কোন চিহ্নও ছিল না, বরং যত দূর এগুচ্ছিল ততই সে অঞ্চলকে মনে হচ্ছিল আরও কঠিন মরুভূমি।
ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। ক্রমশ: সূর্য তার প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়িয়ে উপরে উঠতে লাগলো। ক্লান্ত পায়ে পথ চলতে চলতে এক সময় বসে পড়তে বাধ্য হলো ওই কাফেলা। সামনে পানির কোন নিশানাও দেখা যাচ্ছে না। মাথার ওপর উত্তপ্ত সূর্য নিয়ে ওরা মরুভূমির সেই গনগনে বালির উপরই স্থির হয়ে বসে রইলো।
আন নাসের চোখ খুললো। দেখলো তার তিন সাথী বেহুশ হয়ে পড়ে আছে বালির ওপর। সূর্য দিগন্তের পাড় থেকে উপরে উঠে ছুটে যাচ্ছে গোধূলির দিকে। আন নাসের চারদিকে তাকালো। দেখলো, বালির সীমাহীন সাগরের মাঝে পড়ে আছে ওরা।
তার মন ছেয়ে যেতে লাগলো গভীর বেদনায়। সে তো মরুভূমিতেই লালিত-পালিত হয়েছে এবং মরুভূমিতে যুদ্ধও করেছে। মরুভূমিকে ভয় পাওয়ার লোক সে নয়। তার দুঃখের কারণ, সে ধারণা বা আশাও করেনি যে, হাঁটতে হাঁটতে সে তার বন্ধুদের এমন মরুভূমিতে এনে ফেলবে। দিগন্ত বিস্তৃত এই মরু এলাকায় পানির কোন চিহ্নও নেই।
পিপাসায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত, কিন্তু সে নিজেকে নিয়ে ভাবছে না, ভাবছে তার সাথীদের কথা। তার বোকামীর কারণেই তার সাথীদের এখন এ করুণ অবস্থা। সে তীব্রভাবে অনুভব করলো, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে পড়তে হবে তাদের।
সে উঠে বসলো এবং সূর্যের গতিপথ দেখে অনুমান করলো, কোন দিকে তুর্কমান। সে তার সঙ্গীদের জাগালো। তারা যখন উঠলো, তখন তাদের চেহারায় ভয় ও শংকার শিহরণ খেলা করছিল।
আন নাসের সাথীদের বললো, ক্ষুধা ও পিপাসা নিয়ে বেঁচে থাকার ট্রেনিং আমরা পেয়েছি। সুলতান আমাদের এ জন্য ট্রেনিং দেননি যে, অসহায়ের মত আমরা ভাগ্যের হাতে নিজেদের সমর্পন করবো। আমরা আরও দু’চার দিন খিদে ও পিপাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো। আর এই সময়ের মধ্যে যদি আমরা আমাদের ঠিকানায় পৌঁছতে না পারি, তবে আল্লাহ নিশ্চয়ই পানির কোন না কোন সন্ধান অবশ্যই দিয়ে দেবেন।
আন নাসেরের কথা শেষ হলে সঙ্গী তিন জনও তাদের কথা বললো। আন নাসের তুর্কমান কোন দিকে হতে পারে সে সম্পর্কে তার ধারনা পেশ করে বললো, ‘তোমাদের কি মনে হয়?’
সঙ্গীরা নিজ নিজ মতামত প্রকাশ করে বললো, ‘আমরা আমাদের এলাকা ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি। কিন্তু এতটা দূরে নয় যে, দুদিন চলার পরও এই মরুভূমি আমরা পার হতে পারবো না। আমাদেরকে এ মরুভূমি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে এবং এখন থেকে নতুন উদ্যমে ও আশায় বুক বেঁধে আমাদের পথ চলতে হবে।’
এক সঙ্গী বললো, ‘যদি আমাদের কাছে ঘোড়া থাকতো তবে এই মুস্কিল অনেকটা আসান হয়ে যেতো। আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই কোন লোকালয়ে পৌঁছে যেতে পারতাম।’
‘কিন্তু যা নেই তা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই।’ বললো অন্য জন, ‘আমি এখন অনেকটা সতেজ অনুভব করছি। মনে হয় আমরা যে কিছুটা সময় ঘুমোতে পারলাম তাতেই শরীরে এ সজীবতা ফিরে এসেছে। এটাকেও আমি আল্লাহর এক রহমত মনে করি।’
অন্যরাও তার সাথে একমত হলো।
আন নাসের বললো, ‘হে সাথীরা আমার! আল্লাহ জাল্লে শানুহু আমাদেরকে যে অগ্নি পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছেন, সে পরীক্ষায় আমাদেরকে কোন রকম অভিযোগ ছাড়াই উত্তীর্ণ হতে হবে। এখানে চুপ করে বসে থাকলে সমস্যার কোন সমাধান হবে না।’
এক সঙ্গী বললো, ‘বরং মাথার ওপর সূর্য বসে থেকে আমাদের কেবল পোড়াইে থাকবে। অতএব আর বসে থাকা নয়, চলো যাত্রা শুরু করি। আল্লাহ চাইলে আমাদের পথ খাটো ও সহজ করে দিবেন।’
তারা যাত্রা শুরু করলো, তবে এবারও অনুমানের ওপর নির্ভর করে। পার্থক্য এটুকু, রাতে অনুমান করারও কোন মাধ্যম ছিল না, এখন অনুমান ও দিক নির্ণয় করার জন্য অন্তত সূর্য আছে।
তারা পথ চলছে। পায়ের নিচে উত্তপ্ত বালির সমুদ্র। সূর্যের তাপে সেখানে এক ধরনের তরঙ্গ উঠছে। মনে হচ্ছে বালির ওপর দিয়ে নদীর পানির মত অবিরাম ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে নেচে উঠছে হাজারটা মরীচিকা। সমুখে কিছু দূর থেকে যত দূর দৃষ্টি যায়, মনে হয় বালি নয়, যেন পানির তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। পায়ের নিচের মাটির উত্তাপ অসহ্য ঠেকছে, তবু পথ চলছে ওরা। এরা চার জনই মরুভূমির সাথে পরিচিত। মরুভূমির গজব ও বিভীষিকার সাথে অভ্যস্থ এদের জীবন। তাই যতই মরীচিকা ওদের হাতছানি দিক, ওরা তাতে ভুলবার নয়। মরুভূমির এই মরীচিকার সাথে পরিচিত বলেই তারা মরীচিকার লোভাতুর আহবান ও আকর্ষণ উপক্ষো করে চলতে লাগলো।
‘হে, সাথীগণ!’ আন নাসের বললো, ‘আমরা ডাকাত নই। জেহাদের ময়দানে এসে আমরা এমন কোন অপরাধ করিনি, যার জন্য আল্লাহ আমাদের শাস্তি দিতে পারেন। যদি আজ এই অবস্থায় আমাদের মৃত্যু হয়, আমাদের মৃত বলা যাবে, আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী আমরা শহীদ হয়ে যাবো। যে শাহাদাতের তামান্না নিয়ে আমরা এ জেহাদের ময়দানে এসেছি, যে শাহাদাতের মর্যাদা আমাদের প্রতি মুহূর্তের স্বপ্ন-সাধ ও কামনা। সে জন্যই কোন ভয়, হতাশা, নৈরাশ্য আমাদের স্পর্শও করতে পারবে না। আর, কোন মানুষকে যদি ভয় বা হতাশা স্পর্শ করতে না পারে সে কখনো দুর্বল হয় না। ক্ষুৎপিপাসার কাতরতা আত্মশক্তির ঐশ্বর্যের কাছে কিছুই না। নিশ্চয়ই আমাদের এই পরীক্ষায় ফেলা আল্লাহরই ইচ্ছা এবং তিনিই আমাদেরকে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করতে পারেন। আল্লাহকে স্মরণ করো, আল্লাহর জিকির করতে করতে পথ চলো, দেখবে ক্লান্তি কমে যাবে।’
‘রাস্তায় যদি কোন যাত্রীর কাছে পানি পাই, তবে তা ছিনিয়ে নিতে দ্বিধা করবো না আমি।’ বললো এক সাথী।
‘ছিনিয়ে নিতে যাবে কেন, যদি আল্লাহ তাদেরকে দিয়ে আমাদের জন্য পানি পাঠানোরই ব্যবস্থা করতে পারেন, তবে সে পানি আমরা কেমন করে পাবো, তার ব্যবস্থাও তিনিই করবেন।’
‘একেই বলে গাছে খেজুর গোফে রুমাল। যেখানে পানির ‘প’ও নাই সেখানে উনি ছিনতাইয়ের জন্য পেরেশান হয়ে উঠেছেন।’ বললো অন্য জন।
তার এ কথায় সবাই একটু হাসলো। এ হাসিই যেন তাদের সবার মন আরো হালকা করে দিল। কিন্তু যদি অন্য কেউ এ হাসিটুকু দেখতে পেতো তাহলে অনুভব করতো, হাসি দেয়াটা কোন সহজ কাজ নয়, এর জন্যও লাগে প্রচুর শক্তি। গনগনে সূর্য মাথার ওপর বসে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। সেই উত্তাপের কথা ভুলে যেতে আন নাসের যুদ্ধের সঙ্গীতের সুর গুন গুন করে গাইতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে তার সাথীরাও সেই সুরে সুর মিলালো। সঙ্গীতের সেই সুরে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতা। তারা সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়ে চললো,
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
জানের মালিক এক আল্লাহ
তার নামে হও ফানাফিল্লাহ।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ
তিনি নেতা নাবিয়াল্লাহ
নিপাত যাবে গায়েরুলাহ।’