নবম পরিচ্ছেদ
নুরল এসলামের কলিকাতা যাইবার চারিদিন পরে একটি বৈষ্ণবী ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলিয়া তাঁহার বাড়ির উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। বৈষ্ণবীর কপালে, কণ্ঠে ও বাহুতে হরিনামের তিলক কাটা, গায়ে নামাবলী, কাঁধে কন্থার ঝুলি, মাথার চুল উর্দ্ধমুখে খোঁপা করা।
এই সময় আনোয়ারা দক্ষিণদ্বারী ঘরের দাওয়ায় তাহার ফুফু-শাশুড়ীর নিকট বসিয়া, দাসীর ব্যবহারের জন্য একটি বালিসের খোল সেলাই করিয়া দিতেছিল। তাহার সরল ফুফু- শাশুড়ী বৈষ্ণবীকে দেখিয়া কহিলেন, “কি গো, তোমাকে যে অনেকদিন পরে দেখিলাম?”
বৈষ্ণবী। মা দুই বৎসর নবদ্বীপে ছিলাম। অল্পদিন হইল দেশে আসিয়াছি, এখন ঘন ঘন দেখিবেন। আপনাদের দুয়ারে না আসিলে কি আমাদের উপায় আছে?
ফুফু-শাশুড়ী দাসীকে ভিক্ষা দিতে ডাকিবেন, কোন উত্তর পাইলেন না। আনোয়ারা তখন সেলাই রাখিয়া ভাণ্ডার-ঘর হইতে ভিক্ষা আনিয়া বৈষ্ণবীর সম্মুখে রাখিল। বৈষ্ণবী আনোয়ারার আপাদমস্তক বিস্ময় বিস্ফারিত তীব্র দৃষ্টিতে সতর্কতার সহিত দেখিয়া লইল। এবং ফুফু-শাশুড়ীকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “মা, ইনি কে?”
ফুফু। ছেলের বৌ।
বৈষ্ণবী। সিঁধির সিন্দুর অক্ষয় হউক।
আনোয়ারার কপালে সিন্দুর ছিল না। মুলমান-মহিলাগণ সিন্দুর ব্যবহার করেন না। বৈষ্ণবীর এইরূপ উক্তি তাহার বাঁধা গত। অতঃপর সে ভিক্ষা লইয়া প্রস্থান করিল।
বৈষ্ণবীর নাম দুর্গা। তাহাকে দুর্গার মত সুন্দরী দেখাইত বলিয়া তাহার পৈতৃক গুরুদেব দুর্গা নাম রাখিয়াছিলেন। দুর্গা রাজবংশী ধীবরের মেয়ে। বাল্যকালে বিধবা হইয়া ভরা- যৌবনে প্রতিবেশী এক স্বজাতি যুবকের অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হইয়া আসাম নওগাঁয় চলিয়া যায়। তথায় সাত বৎসর অবস্থানের পর যুবক চিররোগা হইয়া পড়িলে, দুর্গা তাহাকে ত্যাগ করিয়া এক উত্তরদেশীয় যুবকের আশ্রয় গ্রহণ করে। সে চাকুরি উপলক্ষে তাহাকে কামরূপ লইয়া যায়। সেখানে যাইয়া দুর্গা অনেক তন্ত্রমন্ত্র শিক্ষা করে। কিছুদিন অবস্থানের পর, রক্ষক ও রক্ষিতার মধ্যে মনোমালিন্য ঘটায়, রক্ষিতা তথা হইতে পুনরায় নওগাঁ পলাইয়া আসে এবং এক বিখ্যাত বাবাজীর আখড়ায় যাইয়া বৈষ্ণবী হয়। আখড়ায় অবস্থান করিতে করিতে দুর্গা অন্য এক নবীন বৈষ্ণবের অধীনতা স্বীকার করিয়া, শেষে তাহাকে লইয়া পিতার দেশে চলিয়া আইসে; কিন্তু পিত্রালয়ে বা পিতার গ্রামে যাইতে সে আর সাহস পাইল না। আব্বাস আলীর পিতা রহমতুল্লা মিঞা, নিজ গ্রাম ভরাডুবার উপকণ্ঠে, নিজ তালুক মধ্যে দুর্গার আখড়া স্থাপন করিয়া দিলেন। সেই হইতে সে তথায় বসবাস করিয়া আসিতেছে। অনেকদিন হইল দুর্গার শেষ বৈষ্ণব ঠাকুরের লোকান্তর ঘটিয়াছে। অতঃপর সে আর নির্দিষ্ট অন্য বৈষ্ণব গ্রহণ করে নাই। এখন দুর্গা প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধকালের সন্ধিস্থলে দণ্ডায়মানা। ভিক্ষা ও কামরূপী মন্ত্রে চিকিৎসা তাহার জীবিকা নির্বাহের ভান মাত্র। হীরা যেমন সুন্দরের মাসী ছিল, দুর্গা সেইরূপ আব্বাস আলীর মাসী হইল এবং তাহার অনুগ্রহে মাসীর গ্রাসাচ্ছাদন চলিতে লাগিল।
দুর্গা ভিক্ষা লইয়া আখড়ায় উপস্থিত হইলে, আব্বাস আলী যাইয়া হাজির হইল।
আব্বাস বলিল, “মাসী খবর কি?”
মাসী। যাদু একদিনেই খবর। ৩/৪ মাসে পাও যদি তাহাও ভাল।
আব্বাস বিলম্বের কথায় বিষণ্ন হইল, তথাপি উদ্দাম বাসনাবশে কহিল, “মাসী, দেবীদর্শন ঘটিয়াছে ত?”
মাসী। যাদু, দেবী নয়, তার চেয়েও বেশি। ভুবন ঘুরিয়াছি, এ জীবনে অমনটি দেখি নাই। হিন্দু-মুসলমান, রাজা-বাদশার ঘরেও অমন পাত্রী জন্মায় না; যেন সাক্ষাৎ পরী, এখন তোমার কপাল।
আবাস। আশা পুরিবে ত?
মাসী। দুর্গা যাহা মনে করে, তাহা সম্পন্ন করে। তবে আজকার ভাবে যাহা বুঝিলাম, তাহাতে কাজ হাসিল করিতে বিলম্ব ঘটিবে।
আব্বাস। কত বিলম্ব?
মাসী। ঠিক বলিতে পারি না। মাস দুই তিন লাগিতে পারে।
আব্বাস। মাসী, এত বিলম্ব প্রাণে সহিবে না; টাকা যত লাগে লও, সত্বর আশা পূরণের চেষ্টা দেখ। একবার হাতে পাইলে আর ছাড়িব না, দেশ ত্যাগ করিতে হয় তাও কবুল।
মাসী। যাদু, শীতে কষ্ট পাইতেছি, হাত খালি, উপায় কি? তারপর ভবানীর মা পরশু নবদ্বীপে যাইবে, তাহাকেও কিছু না দিলে নয়।
আব্বাস কোমর হইতে ২৫টি টাকা খুলিয়া মাসীর হাতে দিল এবং কহিল, “টাকা যত লাগে দিব, কিন্তু—”
মাসী। বিলম্বে কার্যসিদ্ধি—যদি প্রাণে বাঁচি।
আব্বাস চলিয়া গেল।