» » ভক্তি-পর্ব

বর্ণাকার

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

যেদিন আনোয়ারা দুর্গাকে তাড়াইয়া দেয়, তার পরদিন সালেহা সকালবেলা চুপে চুপে নুরল এসলামের আঙ্গিনায় গেল, তখন আনোয়ারা রান্নাঘরের আঙ্গিনায় উপস্থিত ছিল।

সালেহা। ভাবি, ভাই সাহেব কেমন আছেন?

আনোয়ারা। পূর্বের ন্যায়, কিন্তু কাশি একটু বাড়িয়াছে।

সালেহা। কাল বিকালে যে বৈষ্ণবী আপনাদের আঙ্গিনায় ভিক্ষা করিতে আসিয়াছিল, তাহাকে আপনি তাড়াইয়া দিয়াছেন কেন?

আনোয়ারা। (সালেহার মুখের দিকে চাহিয়া) তুমি কিরূপে জানিলে?

সালেহা। সে আমাদের বাড়িতে বলিয়া গিয়াছে।

আনোয়ারা। তাহার কথা ও ভাবভঙ্গি আমার নিকট ভাল বোধ হইল না।

সালেহা। আপনি তাহাকে তাড়াইয়া দিয়া ভাল করেন নাই।

আনোয়ারা। কেন?

সালেহা। সে কহিল, ভাইজানের ব্যারাম ডাক্তার-কবিরাজের অষুধ-পত্রে আরাম হইবে না। যাহাতে আরাম হইবে সে তাহা জানে।

আনোয়ারা। বদ্ স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস করিতে নাই।

সালেহা। ফকির বৈষ্ণব কাহার মধ্যে কি গুণ আছে বলা যায় না। মামুজানের মুখে শুনিয়াছি, ঠাকেঠিকে দুনিয়া। হয়ত ঐ বৈষ্ণবীর অষুধপত্রে ভাইজান আরামও হইতে পারেন।

আনোয়ারা ভাবিতে লাগিল, সালেহা ত’ মন্দ কথা বলিতেছে না। বৈষ্ণবীই বা মন্দ কথা কি বলিয়াছে? দাদিমাও বলিতেন, ঠাকেঠিকে দুনিয়া। ফকির সন্ন্যাসীকে অবজ্ঞা করিতে নাই। গোলেস্তায় পড়িয়াছি, সামান্য ঝিনুকে মতি থাকে, লতা-গুল্মেও সিংহ বাস করে। বৈষ্ণবী সালেহার কাছে বলিয়াছে, যাহাতে ব্যারাম সারে তাহা আমি জানি। বহু দেশে ঘোরে, অনেক জানাশুনা থাকিতে পারে; সুতরাং তার ঔষধে রোগ সারিবে বিচিত্র কি? এইরূপ চিন্তা করিয়া আনোয়ারা সালেহাকে বলিল, “বুবু, সত্যই কি বৈষ্ণবী তোমার ভাইজানের পীড়ার ঔষধ জানে বলিয়াছে?”

সালেহা। আমি কি আপনার নিকট মিথ্যা বলিতেছি?

আনোয়ারা। তবে ত’ বৈষ্ণবীর উপর রাগ করিয়া ভাল করি নাই। এখন তাহাকে পাইবার উপায় কি?

সালেহা। আপনি যখন তাহাকে তাড়াইয়া দিয়াছেন, তখন সে বিনা ডাকে আসিবে বলিয়া বোধ হয় না।

আনোয়ারা। কাহাকে দিয়া ডাকাইব?

সালেহা। আচ্ছা, আমি চেষ্টা করিয়া দেখি।

আনোয়ানা। বুবু, তোমার পায়ে পড়ি, সে যাহাতে আসে অবশ্য তাহাই করিবে।

বৈষ্ণবীকে তাড়াইয়া দিয়া সে যারপরনাই অন্যায় কার্য করিয়াছে বলিয়া মনে করিল এবং তজ্জন্য অনুতাপে দগ্ধ হইতে লাগিল।

এদিকে দুর্গা আখড়ায় বসিয়া আব্বাস আলীকে ডাকিয়া পাঠাইল। সে শ্রবণমাত্র ব্যস্ত হইয়া উপস্থিত হইল।

দুর্গা। যাদু, বড় কঠিন স্থান। তোমার মনোমোহিনী আমাদের সীতা সাবিত্রীকে হারাইয়া দিয়াছে।

আব্বাস। সে কেমন?

দুর্গা ভিক্ষা নিষেধের কথা প্রভৃতি আব্বাস আলীর নিকট খুলিয়া বলিল।

আব্বাস। তবে এখন উপায়?

দুর্গা। দুর্গা নিরুপায়ের খুব উপায় জানে?

আব্বাস। মাসী, কি উপায় করিবে?

দুর্গা। উপায়ের পথে পা দিয়া তবে বলিব। বাছা, দু’দিন সবুর কর, আজ নিজের ভাবনায় ব্যস্ত আছি।

আব্বাস। মাসী, তোমার আবার নিজের ভাবনা কি?

দুর্গা। ঘরে একমুঠা চালও নাই, ভিক্ষা ত কেবল তোমারই কার্যোপলক্ষে। কাল হাট হইবে কি দিয়া, তাই ভাবিতেছি।

আব্বাস পকেট হইতে ১০টি টাকা বাহির করিয়া দুর্গার হাতে দিল এবং বলিল, “মাসী, অভাবের ভাবনা মোটেই ভাবিনও না! মোনবাঞ্ছা সিদ্ধি হইলে একযোগে তিনশত টাকা পাইবে।”

পরদিন আব্বাস আলী বেলগাঁও বেড়াইতে গেল। তথায় খাদেম আলী তাহাকে বলিল, ভাই এক সুখবর, তোমার প্রাণমোহিনী দুর্গাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছে, তুমি যাইয়া অদ্যই তাহাকে তাহার নিকট পাঠাইয়া দাও।

আব্বাস। তোমার মুখে সন্দেশ। আমি এখনই চলিলাম।

দুর্গার সহিত আব্বাস আলীর ষড়যন্ত্রের কথা খাদেম আলী সব জানে। তাহার চরিত্র মন্দ, এ নিমিত্ত নুরল এসলাম যারপরনাই দুঃখিত এবং তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট! পাপমতি খাদেমও নুরল এসলামের প্রতি দারুণ বিদ্বেষপরায়ন এবং এই কারণে সে এই ষড়যন্ত্র দলভুক্ত। খাদেম আলীর স্ত্রী সেই দিনই তাহার নিকট দুর্গাকে নুরল এসলামের বাড়িতে আসার সংবাদ দিতে অনুরোধ করে।

আব্বাস আখড়ায় আসিয়া দুর্গাকে কহিল, “মাসী, এইবার বুঝি তোমার শ্রম সার্থক হয়।”

দুর্গা। মাসীর শ্রম বিফলে যাইবার নহে; তবে আজ শ্রম সফল হইবে কিরূপে বুঝিতেছি না।

আব্বাস। তোমার উর্বশী তোমাকে ডাকিয়া পাঠইয়াছে।

দুর্গা। কে বলিল?

আব্বাস। উর্বশীর নন্দাই খাদেম আলী।

দুর্গা। এত সত্ত্বর, তবে অষুধ ধরিয়াছে! আচ্ছা, দু’দিন পরে যাইব। আব্বাস। আজই যাও না কেন?

আব্বাস। যাদু, এরূপস্থলে ডাকামাত্র হাজির হইলে বুজুর্কি কমিয়া যায়, যত গৌণ করিব, ততই আগ্রহ হইবে। বাড়া আবেগের মুখে কাজ হাসিলের সুযোগ বেশি।

আব্বাস। বুঝিলাম, এমন চিক্কণ বুদ্ধি না হইলে কি তুমি যেখানে সুঁচ চলে না সেখানে ফাল চালাও!