সপ্তম পরিচ্ছেদ
খাদেম আলীর এই সুখ-সম্পদের সময়, তাহার আর ৩/৪ টি নূতন ইয়ার জুটিল। ইয়ারগণ তাহার সমবয়স্ক নবীন যুবক। প্রায় সকলেই ধনীর সন্তান, সকলেই পিতামাতার অন্যায় আব্দারে, অনুচিত বাৎসল্যে লালিত-পালিত-আদরের পুতুল। বিলাস-ব্যসন ও ইন্দ্রিয়সেবা ইহাদের নিত্যনৈমিত্তিক কার্য। ইহারা না পারে এমন দুষ্কার্য ছিল না। ইন্দ্রিয়পরায়ণ খাদেম আলীর অর্থোন্নতি দেখিয়া পাপিষ্ঠেরা ঘন ঘন তাহার দোকানে যাতায়াত আরম্ভ করিল। ক্রমে তাহারা খাদেম আলীকে নিজ দলে টানিয়া লইল। ক্রমে তাহাদের সহিত খাদেম আলীর অকৃত্রিম হৃদ্যতা জন্মিয়া গেল।
এই সময় একদিন ইয়ারদল, খাদেম আলীর দোকানে বসিয়া তাহাকে বিশেষভাবে চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “ভাই খাদেম! মিঠাই খাইতে খাইতে নাড়ীতে ময়লা ধরিয়াছে। তোমার নূতন দোকানে নূতন রোজগার, আজ রাত্রিতে দোকানে তোমাকে পোলাওয়ের ভোজ দিতে হইবে।
খাদেম। এ ত’ আনন্দের কথা! কিন্তু এসলাম ভাইকে দেখে ভয় হয়। তোমরা জান, তিনি আমার কুটুম্ব—সাহেবের বড় বাবু। আমার স্বভাব মন্দ বলিয়া তিনি আমার বিবাহে নারাজ ছিলেন। আমার শাশুড়ী বলিয়াছেন, নুরল এসলাম যেখানে, তুমিও সেখানে আছ; সে যেন তোমাকে মন্দ বলিতে না পারে, এমনভাবে চলিবে। আমাদের আমোদ-আহ্লাদ, গান বাজনার কথা যদি নুরল এসলাম ভাই সাহেবের কানে যায়, তবে মুস্কিল।
সমসের। তাঁর চাপরাসীর মুখে শুনিলাম, তিনি আজই বাড়ি যাইবেন!
করিম। তবে আর ভয় কি?
গনেশ। কি ভাই খাদেম, মোরগের না খাসির যোগাড় দেখবো?
গণেশ হিন্দুর ছেলে, লেখাপড়া জানে; আজন্ম ভীত পরন্তু মাথা পাগলা; পাপ ঘনিষ্ঠতায় তাহার জাতিভয় ধর্মভয় বিলুপ্ত হইয়াছে।
খাদেম। তা হ’লে তোমরা যা ভাল বুঝ।
রাত্রিতে মোরগ পোলাওয়ের দাম দেওয়া হইল। দোকান ঘরের প্রকোষ্ঠে পাক ও পানাহার শেষ করিয়া ইয়ারগণ গান-বাজনা, গল্প-গুজব আরম্ভ করিল। কথা প্রসঙ্গে আব্বাস আলী কহিল, “আচ্ছা, তোমরা এ যাবৎ যত স্ত্রীলোক দেখিয়াছে, তাহার মধ্যে কাহাকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী বলিয়া জান?” আব্বাস আলীর কথায় ইয়ারগণ খুশি হইয়া স্ব স্ব মত ব্যক্ত করিতে লাগিল। গণেশ কহিল, “বেশ কথা তুলিয়াছ হে আব্বাস, তোমাকে ধন্যবাদ! এমন না হইলে তোমাকে দলপতি বলিয়া মানে কোন্ শালা!”
সমসের গণেশের গা ঘেঁষিয়া বসিয়াছিল সে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বল সমসের, তোমারি মত আগে শুনা যাক্!”
সমসের। আমাদের পাড়ার আলী মামুদের মেয়ে জমিলা।
করিম। না, না, রামজয় ঘোষের বউ।
গণেশ। এসব চেয়ে বেশি সুন্দরী, আমাদের জগত্তারণ বাবুর ভগ্নী নিস্তারিণী ঠাকুরাণী। আহা, বলিব কি, এমন সুন্দরী তোমাদের দুনিয়ায় নাই হে, বেশি আর কি বলিব :
“তড়িৎ ধরিয়া রাখে কাপড়ের ফাঁদে
তারাগণ লুকাইতে চাহে পূর্ণ চাঁদে।”
সমসের। ভেরী গুড।
গণেশ। “কে বলে শারদশশী সে মুখের তুলা,
পদনখে পড়ে তার আছে কতগুলা!”
পয়জার উদ্দিন। এক্সেলেন্ট!
তিলক দাস নামে আর একজন মূর্খ লম্পট সেদিন ইয়ারদলভুক্ত হইয়াছিল। সে গণেশের রূপ বর্ণনা শুনিয়া কহিল, ‘গণেশদা ও কি ঘোড়ার ডিম ক’লা তোমার ওসব কিড়িমিড়ি ত’ বুঝলেম না।’
গণেশ। তিলক-দা এমন প্রাণমাতান কথা বুঝিলে না! তোমার মত গর্ভস্রাবত’ আর দেখি নাই। যদি না বুঝিয়া থাক তবে শুন :
ঠানের মাথারচুল যেন অমাবস্যার আঁধার। মুখখানি তার পূর্ণিমার চাঁদ। কথাতে লবণ-ঝাল দুই-ই আছে। গাল দুটি যেন হলুদ মাখান। দাঁত-গুলি তার পুঁটি মাছ। বুকখানি লাইয়ের জাংলা আর কি। আহা! ঠাকুরুণের পেটটি যেন সুন্দর একটি হাঁড়ী! নিতম্ব যেন মশলাপেষা আস্ত পাটা। পা দু’ খানি মস্ত দুটো কলাগাছ। গায়ের রং আগুনের মত। শরীর ঠাণ্ডা—জলের ন্যায়। অধিক কি বলিব, দিবসেই যেন ধরিয়া খাইতে চায়।
রূপ বর্ণনা শুনিয়া সকলেই হোঃ হোঃ করিয়া হাসিতে লাগিল; কিন্তু তিলক হাসিল না। গণেশ কহিল, “কি হে তিলক, ঠাণের রূপের কথা শুনিয়া দশা ধরিল নাকি?”
তিলক। না ভাই, আমি একটা হিসাব করিতেছিলাম।
গণেশ। কিসের হিসাব?
তিলক। গণেশ-দা, ঠাণ নিকা বসিলে আমি মুসলমান হইতাম।
গণেশ। একেবারে জাত দিবি? কেন রে, এত সখ কেন?
তিলক। ভাই আমি গরিব মানুষ, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটি, তবু সংসার চলে না; তুমি ঠাকুরুণের রূপের যে তালিকা দিলে, তাতে আমি হিসাব করিয়া দেখিলাম ঠাকুরুণ গিন্নী হইলে কেবল চাল কিনিয়া দিলেই গোজরান চলিবে কারণ—ময়মশলা, মাছতরকারী, হাঁড়ি- পাতিল সব ত ঠাণের সঙ্গেই আছে।
পুনরায় সকলে হোঃ হোঃ করিয়া হাসিয়া উঠিল। এইরূপ হাসি-ঠাট্টায় রমণীরূপের ব্যাখ্যা চলিতে লাগিল। সর্বশেষ খাদেম আলী কহিল, “তোমরা যদি কারো কাছে না বল, আমি একটি যুবতীর কথা জানি, তাঁর মত সুন্দরী এদেশে আর নাই। তাঁর মাথায় চুল পায়ে ঠেকে, শরীরের বর্ণ কাঁচা হরিদ্রার মত।” সকলেই তখন দম ধরিয়া খাদেমের মুখের দিকে চাহিল। সে পুনরায় কহিল, “তোমরা বলবে না ত?” সমস্বরে উত্তর হইলে, ‘না, না, না, “ খাদেম তথাপি অনুচ্চস্বরে ভয়ে ভয়ে কহিল, “আমাদের নুরল এসলাম ভাইয়ের স্ত্রী।” সকলে শুনিয়া স্তম্ভিত হইল। শেষে আব্বাস কহিল, “তোমার সঙ্গে কথাবার্তা চলে ত’?”
খাদেম। আমি তাঁকে এ পর্যন্ত দেখি নাই।
সকলে অট্টহাস্য করিয়া উঠিল! আব্বাস হাসির স্বরেই কহিল, “এক বাড়িতে থাক, অথচ তাঁকে দেখ নাই, কেমন কথা হে? বিশেষত তুমি তাঁর নন্দাই!
খাদেম। বাড়ি একই বটে, কিন্তু পৃথক আঙ্গিনা। ভাই সাহেবের আঙ্গিনার আটা-পেটা উঁচু বেড়া, চাঁদ-সূর্য প্রবেশের যো নাই। বিশেষত তাঁহার সহিত আমাদের বনিবনাও নাই। যাওয়া-আসা একরূপ বন্ধ।
আব্বাস। তোমার স্ত্রীও কি সে আঙ্গিনায় যায় না?
খাদেম। সে মাঝে মাঝে যায়। আমি তাহারই মুখে একদিন শুনিয়াছি!
আব্বাস। তারি সাহায্যে একদিন দেখিবার উপায় করিতে পার না?
খাদেম। বাড়ি যাই না বলিয়া সে আমার কতকটা অবাধ্য হইয়া উঠিয়াছে।
আব্বাস। আচ্ছা, তোমাকে কাল হইতে তিন দিনের ছুটি দেওয়া গেল, ইহারই মধ্যে বউ বাধ্য করিয়া তাহার সাহায্যে বড় বাবুর বউকে দেখিবে। সত্যই তার মাটি-ঠেকান চুল আর হদির মত রং কি-না?
অতঃপর আব্বাস খাদেমকে নির্জনে ডাকিয়া লইয়া কহিল, “ভাই আমি যাহাতে দেখিতে পাই, সে সুযোগটাও করিয়া আসিও। এ কয়টা দিন আমি তোমার দোকানের কাজ চালাইব। বলি, আমাকে বিশ্বাস কর ত’?”
খাদেম। তোমরা বড় লোক, টাকার কুমীর, তোমাদিগকে কে অবিশ্বাস করিবে?
বাস্তবিক বেলগাঁও অঞ্চলে আব্বাসের পিতার খুব নামডাক মানসম্ভ্রম। অবস্থাও খুব ভাল। কেবল তেজারতি কারবারে ৬/৭ লাখ টাকা খাটে, ৩০/৩১ টি গোলাবাড়িতে বিভিন্ন জেলায় তাঁহার ধান-চাউল, পাটের ব্যবসায় চলে; এতদব্যতীত কিছু ভূ-সম্পত্তিও আছে। আব্বাস আলী পিতামাতার অতি সোহাগের একমাত্র সন্তান, গ্রাম্য-স্কুল-পাঠশালায় পড়িয়া তাহার বিদ্যা সাঙ্গ হইয়াছে। যৌবনের প্রারম্ভে সংসর্গ দোষে তাহার এইরূপ মতিগতি। আজকাল আমাদের দুর্ভাগা সমাজে এইরূপ পিতা ও পুত্রের সংখ্যা কম নহে।
খাদেম আলী বাড়ি আসিয়া রাত্রিতে অনেক সাধ্য-সাধনায় সালেহাকে বশ করিল অনন্তর তাহার সাহায্যে পরদিন নুরল এসলাম সাহেবের স্ত্রীকে দেখিল। তার পরদিন দোকানে গিয়া আব্বাসের নিকট কহিল, “ভাই, এমন চিজ আর কখন দেখি নাই। স্ত্রীলোক যে এমন খুবছুরত থাকিতে পারে, তাহা আগে জানিতাম না। সত্যই বলিতেছি, এমন রূপসী এদেশে কেন, এ পৃথিবীতে নাই। সাক্ষাৎ বেহেস্তের হুর। আমি দেখিয়া বেহুঁশ হইয়াছিলাম, আল্লা মেহেরবান তাই রক্ষা।”
আব্বাস দম বন্ধ করিয়া শুনিতেছিল। উদ্বেগাতিশয্যে কহিল, “আমাকে দেখাইবে না?”
খাদেম। দেখাইবার ত’ খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পারা কঠিন।
আব্বাস। কেন? তুমি কিরূপে দেখিলে?
খাদেম। আমার স্ত্রীর নিকটে দেখার কথা পাড়াতে সে কহিল, চাঁদ-সূর্য তাঁর মুখ দেখিতে পায় না, আপনি দেখিবেন কিরূপে? তবে রোজ যদি বাড়ি আসেন, তবে কলাকৌশলে একদিন দেখাইতে পারি। আমি ভাবিলাম বাড়ি আসার জন্য স্ত্রী এই ফিকির খাটাইতেছে। স্বীকার করিয়া কহিলাম, কাল দেখাইতে পার কিনা? সে কহিল, চেষ্টা করিব, আপনি সারাদিন বাড়িতে থাকিবেন।
পরদিন একপ্রহর বেলার সময়ে স্ত্রী আমাকে কহিল, ভাই কাল বাড়ি আসেন নাই, চাকর দুইজন স্থানান্তরে গিয়াছে, আপনি এ অবসরে বৈঠকখানার আট-চালার পশ্চিম দিকের আড়ার উপর নিঃশব্দে উঠিয়া দেখিয়া আসুন, নিচে থাকিলে দেখা যাইবে না, ভাবী এখন তাঁহার খিড়কীর বাগানে চুল শুকাইতেছেন, ঐ স্থান দুই মানুষ উঁচু বেড়ায় ঘেরা। স্ত্রীর আদেশ মত আমি যথাসময়ে যাইয়া এইরূপ কষ্ট করিয়া দেখিয়া আসিয়াছি।
আব্বাস। ভাই খাদেম, তুমি আমার হৃদয়বন্ধু। তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে ঐরূপ করিয়া একটিবার দেখাও।
খাদেম কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিল, “তবে আমাকে পুনরায় আজ বাড়ি যাইতে হইবে।” আব্বাস আলী কহিল, “ভাই খাদেম যতবার ইচ্ছা বাড়ি যাও, যেমন করিয়া চালাইতে হয়, আমি তোমার দোকান চালাইব। দেখ, গত তিন দিনে তোমার চাইতে অনেক বেশি বিক্রয় করিয়াছি।”
খাদেম বৈকালে বাড়ি গেল। পরদিন দোকানে আসিয়া কহিল, “ভাই আব্বাস, তোমার জোর কপাল; হুর দর্শনের শুভযোগ উপস্থিত অদ্য ভাই সাহেব কলিকাতা যাইবেন, বৈকালে আমরা দুইজন আমাদের বাড়িতে যাইব। তারপর নির্ভাবনায় তোমাকে হুর দেখাইব।”