» » ভক্তি-পর্ব

বর্ণাকার

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

আনোয়ারা কি হইয়াছিল?

পূর্বে বলা হইয়াছে বেলগাঁও হইতে জেলা পর্যন্ত নৈঋত কোণে যে বাঁধা সড়ক আছে তাহা রতনদিয়া বাজারের দক্ষিণ পার্শ্ব দিয়া চলিয়া গিয়াছে। রতনদিয়া হইতে সেই পথে এক মাইল গেলে প্রায় অর্ধ মাইল ব্যাপিয়া সড়কের উভয় দিকে নিবিড় বেতস বন, নিম্ন সমতলে অবস্থিত। দুইখানি গাড়ি বা পাল্কী পরস্পর ঘেঁষাঘেষি ভাবে পাশাপাশি যাতায়াত করিতে পারে, সড়কের প্রস্থ এই পরিমাণ। পাপিষ্ঠেরা আনোয়ারাকে অজ্ঞানবস্থায় পাল্কীতে তুলিয়া এই সঙ্কীর্ণ বেতসবন-পথের মধ্যস্থলে আসিলে, অদূরে সম্মুখে আলো দেখিতে পায়, গণেশ ও কলিম সম্মুখে ছিল। গণেশ কহিল “ভাই আব্বাস; প্রমাদ দেখিতেছি।”

আব্বাস। কেনরে, কেন?

গণেশ। সম্মুখে আলো দেখিতেছি।

আব্বাস লম্ফ দিয়া গণেশের স্থান অধিকার করিল, গণেশ হটিয়া গেল।

আব্বাস। পাল্কী বলিয়া বোধ হইতেছে।

কলিম। পাল্কী ত বটেই; আবার একখানা নয়, দুইখানা।

আব্বাস। হাজারখানা হউক, হাতে কি লাঠি নাই?

কলিম। ওরে, আবার দুই পাল্কীর আগে পিছে যে অনেক লোক দেখিতেছি।

আব্বাসের মুখ শুকাইল। তথাপি সে সাহসে ভর করিয়া কহিল, “আমাদের পাল্কীতে বাতি আছে। উহারা আমাদিগকে কিছু বলিবে না।” পাপিষ্ঠেরা আনোয়ারাকে পাল্কীতে তুলিয়া পাল্কীর সম্মুখে অসীম সাহসে আলো জ্বালাইয়া দিয়াছিল।

দেখিতে দেখিতে সন্মুখের পাল্কী নিকটে আসিল। পাল্কীর আগে পাছে কনেস্টবল দুইজন, চৌকিদার দশ বারজন। অগ্রগামী কনেস্টবল আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা পাল্কী কাঁহাছে আয়া হ্যায়?”

আব্বাস। স্টিমার ঘাটছে।

কনেষ্টবল। কাঁহা যাতা হ্যায়?

আব্বাস। জেলাকো উপর।

কনেষ্টবল। পাল্কীকা আন্দার কোন্ হ্যায়?

আব্বাস। উকিল সাহেবকা বিবি হ্যায়।

কনেষ্টবল। কোন্ উকিল সাহেবকা।

আব্বাস উকিল সাহেবের নাম জানে না। দুই একবার ফিয়ালসিনি মোকদ্দমায় পড়িয়া পিতার সহিত উকিল সাহেবের বাসায় গিয়াছিল মাত্র। উকিল সাহেব খুব জবরদস্ত নামজাদা এবং মুসলমান, সেই মাত্র জানিত। তাই কনেস্টবলের কথার উত্তরে বলিল, “মুসলমান উকিলকা।” অসম্পূর্ণ উত্তর শুনিয়া কনেস্টবলেরা হাসিয়া উঠিল। গণেশ ভাবিল,–আব্বাস ঠকিয়া গিয়াছে, মুসলমান উকিলের নামে বিপদ কাটিবে না। এইরূপ ভাবিয়া সে কহিল, “সিপাই সাহেব, ও শালা লোক বোকার ওস্তাদ হ্যায়, চুড়ানকো ঢেঁকি বলিয়া ফেলতা হ্যায়। পাল্কীর ভিতর ডেপুটি বাবুর মেম সাহেব বিবি রতা।” কনেস্টবলেরা অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। পাল্কীর মধ্য হইতে ডেপুটি গণেশবাহন বাবুও হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। দুইতিন মিনিটে এই সকল কথার রহস্য হইল। এই সময় মধ্যে আব্বাস আলীদিগের পাল্কী ডেপুটি বাবুর পাল্কী অতিক্রম করিয়া আর এক পাল্কীর সম্মুখীন হইল। এ পাল্কীরও আগে-পাছে লোকজন পাইকপ্যাদা। ডেপুটিবাবু নিজ পাল্কী থামাইয়া অনুচরদিগকে কহিলেন, “আভিওস্কা পাল্কী পাকড়লেও।” পশ্চাদ্বর্তী পাল্কী লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “উকিল সাহেব, আপনার সঙ্গের লোক দিয়া সম্মুখের পাল্কী ঠেকাইয়া দেন।” কথানুসারে কার্য হইল। ডেপুটি বাবু হাটিয়া উকিল সাহেবের পাল্কীর নিকট উপস্থিত হইলেন। আব্বাস আলী ও কলিম প্রভৃতি তখন অনন্যোপায়ে লাঠি অবলম্বনে বিপক্ষের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিল। আব্বাসের লাঠির আঘাতে একজন কনেস্টবল ও দুইজন চৌকিদার আহত হইল। কলিম একজন বেহারা ও তিনজন চৌকিদারকে আহত করিল। ডেপুটি বাবু ও উকিল সাহেব দুইটি লোকের পরাক্রম দেখিয়া অবাক হইলেন; কিন্তু তাহারা আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইল না। অবশিষ্ট চৌকিদার ও কনেস্টবলের অবিশ্রান্ত যষ্টি প্রহারে তাহারা মাটিতে পড়িয়া গেল। খাদেম ও গণেশ পলাইতে চেষ্টা করিয়া সড়কের নিচে গড়াইতে গড়াইতে বেতস বনে আটকাইয়া পড়িল। দুইজন বেহারারও ঐ দশা ঘটিল। চৌকিদারগণ তাহাদিগকে পরে খুঁজিয়া বাহির করিল। পূর্বে বলা হইয়াছে ‘গণেশ ভীরু ও মাথা পাগল; সে যখন ধরা পড়িল, তখন উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, শালা আব্বাস এখন কোথায় গিয়াছ? সতীকে ত’ ছুঁইতেও পারিলে না, মাঝ হইতে গণেশ বেটার প্রাণ যায়! হায়, হায়—জাতিও গেল, পেটও ভরিল না!” চৌকিদার হাসিয়া কহিল, “আরে চল্ চল্, তোদের সকলেই সড়কের উপরে আছে, চল্ সেখানে গেলে টের পাবি এখন।”

গণেশ। বাবা, বেতের কাঁটায় বিলক্ষণ টের পাইয়াছি। দেখ না গা দিয়া রক্তগঙ্গা ছুটিয়াছে। ইহার উপর আর টের পাওয়াইলে প্রাণের আশা কোথায়?

চৌকিদার হাসিতে হাসিতে গণেশের হাত ধরিতে উদ্যত হইল।

গণেশ। চৌকিদার বাবা, আমাকে ধ’র না বাবা! আমি কোন দোষ করি নাই বাবা! আমি তোমার বাবা, না না, তুমি আমার–আমাকে রক্ষা কর বাবা!

এই বলিয়া সে স্বেচ্ছায় সড়কের উপর উঠিল। চৌকিদার খাদেম ও দুইজন বেহারাকে বাঁধিয়া সেই সঙ্গে উপরে আনিল।

ডেপুটি বাবু উকিল সাহেবকে কহিলেন, “দেখুন পাল্কীর ভিতরে কে আছে?” একজন চৌকিদার আলো ধরিল, উকিল সাহেব স্বহস্তে পাল্কীর দরজা খুলিয়া দেখিলেন, একজন অনিন্দ্য-সুন্দরী যুবতী অজ্ঞানাবস্থায় পাল্কীতে পড়িয়া আছে; তাঁহার মুখে কাপড় গোঁজা। উকিল সাহেব মুখের কাপড় টানিয়া বাহির করিলেন। যুবতী গোঙাইয়া উঠিল এবং তাঁহার মুখ দিয়া এক ঝলক রক্ত নির্গত হইয়া পড়িল। উকিল সাহেব বাতির আলো তাঁহার মুখের কাছে ধরিয়া ভাল করিয়া দেখিলেন। দৃষ্টিমাত্র তাহার শরীর শিহরিয়া উঠিল। তিনি উচ্চৈস্বরে কহিলেন, “জলদী পানি।” ইংরেজি ভাষায় কহিলেন, “ডেপুটি বাবু, আমার যে বন্ধুকে দেখিতে যাইতেছি, হায়! হায়!! তাঁহারই সর্বনাশ! তাঁহারই স্ত্রী অজ্ঞানাবস্থায় পাল্কীতে পড়িয়া, গলা দিয়া রক্ত উঠিয়াছে!” ডেপুটি বাবু—”এ্যা বলেন কি?” বলিয়া কনেস্টবল ও চৌকিদারগণকে কড়া হুকুম দিলেন, “বেটারা যেন পলাইতে না পারে, বিশেষ সাবধানে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া ফেল।” ডেপুটি বাবুর হুকুম শুনিয়া গণেশ কহিল, ‘হুজুর, এ শালারা বদমাইশের গোড়া, তার মধ্যে ঐ আব্বাস শালাই আদত শিকড়। শালা আমাকে নানা প্রলোভনে ভুলাইয়া সতী-হরণে নিযুক্ত করিয়াছে। আমি ওর পিতার নিকট ৩ শত টাকা ধারি। ঐ টাকার এক পয়সাও সুদ লইবে না বলিয়া প্রলোভন দেখাইয়া আমাকে এই পাপ কার্যে নিযুক্ত করিয়াছে। ও টাকার বলে এ দেশের সুন্দরী কুলবধূ ও কুলকন্যা কিছু বাকি রাখে নাই। কিন্তু আজ শালার বড় আশায় ছাই পড়িল। আমাকে বাঁধিবেন না, আমি ওর সমস্ত সলা-পরামর্শের কথা আপনার নিকট খুলিয়া বলিতেছি।

ডেপুটি বাবু। আচ্ছা, তুই যদি সত্য কথা বলিস, তবে তোকে বাঁধিব না।

গণেশ। হুজুর, কালী মা’র দিব্বি, সত্য ছাড়া একরত্তি মিথ্যা বলিব না। আপনি আমার জন্মের বাবা।

ডেপুটি বাবু গণেশকে একজন চৌকিদারের জিম্মায় দিয়া উকিল সাহেবের নিকট আসিলেন। এদিকে উকিল সাহেব যুবতীর মাথায় পানির ধারা দিতে দিতে সে ক্রমে নিঃশ্বাস ফেলিতে লাগিল, ক্রমে চক্ষু মেলিয়া চাহিল। কিয়ৎক্ষণ পরে অস্ফুটস্বরে কহিল, “আমি কোথায়?” উকিল সাহেব কহিলেন, “আপনি ভাল স্থানে আছেন।” যুবতী উকিল সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া পুনরায় নয়ন মুদ্রিত করিল।

ডেপুটি বাবু কহিলেন, “খুবই অবসন্ন হইয়াছেন আর বিলম্বের প্রয়োজন নাই। যাওয়ার বন্দোবস্ত করুন।” উকিল সাহেবের পাল্কীতে আটজন বেহারা ছিল। তাহাদের চারজন যুবতীকে স্কন্ধে লইল। ডেপুটি বাবু ঘড়ি খুলিয়া দেখিলেন রাত্রি ১টা।

পথে রওয়ানা হইয়া উকিল সাহেব ডেপুটি বাবুকে ইংরেজিতে কহিলেন, “আমার বন্ধুর এই দুর্ঘটনা যাহাতে প্রকাশ না হয়, আপনি তৎসম্বন্ধে বিশেষ সাবধানতা ও বিবেচনার সহিত কার্য করিবেন। আমরা মুসলমান।”

ডেপুটি বাবু ‘আচ্ছা’ বলিয়া বদমাইশদিগকে লইয়া বেলগাঁও থানার দিকে এবং উকিল সাহেব বন্ধুপত্নীকে লইয়া বন্ধুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হইলেন।

তারপর যাহা ঘটিয়াছে পূর্ব পরিচ্ছেদে সকল কথা লিখিত হইয়াছে।