অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
এদিকে নুরল এসলাম কাশিতে কাশিতে কিছুক্ষণ পরে জাগিলেন। ঘরে বাতি জ্বলিতেছিল। অন্যান্য দিন কাশিবামাত্র আনোয়ারা উঠিয়া তাঁহার সম্মুখে পিদান ধরে, আজ তিনি কাশি ফেলিবার পিক্দান নিকটে পাইলেন না; উঠিয়া বসিলেন। পীড়ার আরম্ভ হইতে আনোয়ারা স্বামীর শয়ন-খাটের সংলগ্ন চৌকিতে পৃথক শয্যায় শয়ন করে। নুরল দেখিলেন, সে বিছানা শূন্য। ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিলেন ১টা বাজিয়া গিয়াছে; মনে করিলেন বাহিরে গিয়াছে, এখনই আসিবে; কিন্তু হায়! বহুক্ষণ অতীত হইয়া গেল—তথাপি আনোয়ারা ঘরে ফিরিল না। নুরল এসলাম তখন ‘ফুফু-আম্মা’ বলিয়া ২/৩ বার ডাকিলেন। তিনি শশব্যস্তে দরজা খুলিয়া ছেলের ঘরের বারান্দায় আসিলেন। চাকরানী ফুফু-আম্মার ঘরে থাকিত, সেও তাঁহার পাছে পাছে উঠিয়া আসিল।
ফুফু। বাবা ডাক কেন?
নুরল। আপনাদের বউ কোথায়?
ফুফু। ওমা, সে কি কথা। বউ ত আমার কাছে যায় নাই। খুসী, তুমি পাকের আঙ্গিনায় দেখিয়া আইস।
চাকরানীর নাম খুসী, সে আলো জ্বালিয়া রান্নার আঙ্গিনার দিকে গেল। ফুফু ভাণ্ডারঘুর তাঁর শয়নঘর দেখিতে গেলেন। নুরল এসলামের মাথা ঘুরিতে লাগিল। ফুফু-আম্মা ও খুসী হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিল। নুরল এসলাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইল? পাওয়া গেল না?” ফুফু ও খুসী নীরব। নুরল এসলাম হায়! হায়!! করিতে করিতে শয্যায় পড়িয়া গেলেন। ফুফু-আম্মা তাড়াতাড়ি কাছে গিয়া দেখেন, ছেলের মুর্চ্চা হইয়াছে। তিনি ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, এমন সময় “হুরে হু হামবোল হুম” রবে দুইখানি পাল্কি বাড়ির মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। উকিল সাহেব পাল্কীর ভিতর হইতে নামিয়া বন্ধুর ঘরে প্রবেশ করিলেন। ফুফু-আম্মা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “বাবা আমার সর্বনাশের উপর সর্বনাশ! বউ-মা আমার ঘরে নাই! ছেলে তাহা শুনিয়া অজ্ঞান হইয়াছে।” উকিল সাহেব কহিলেন, “আপনার বউ-মা উঠানে পাল্কীর ভিতরে আছেন, তাহাকে ঘরে তুলিয়া লউন। তাঁহার অবস্থাও শোচনীয়। একটা পাতলা গরম দুধ এ সময় তাঁহাকে খাওয়াইতে পারিলে ভাল হয়। আমি দোস্ত সাহেবের মূৰ্চ্ছা ভাঙ্গার চেষ্টা করি।” ফুফু-আম্মা কতকটা বিস্মিত, কতকটা আশ্বস্ত হইয়া বউয়ের কাছে গেলেন।
এদিকে উকিল সাহেব দেখিলেন তাঁহার দোস্তের দাঁত লাগিয়াছে। ব্যারামের শরীর, রাত্রিতে মাথায় পানি না দিয়া তিনি পকেট হইতে একটা ঔষধ বাহির করিয়া তাহার নাকের, নিকট ধরিলেন। ৫/৬ মিনিট পরে জোরে নিঃশ্বাস চলিল, তারপর নুরল এসলাম চক্ষু মেলিয়া ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া তাকাইতে লাগিলেন। উকিল সাহেব বলিলেন, “আমাকে চিনিতে পারিতেছ না?”
নুরল। দোস্ত, তুমি আসিয়াছ! আমার প্রাণের আনোয়ারা—আবার অজ্ঞান হইলেন। উকিল সাহেব চিন্তিত হইলেন। শেষে ইতস্তত করিয়া সাহসের সহিত মাথায় ঠাণ্ডা পানির ধারা দিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে নুরল আবার চক্ষু মেলিলেন, “আমার আনোয়ারা কোথায়?” বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। উকিল সাহেব বলিলেন, “তুমি আশ্বস্ত হও, তিনি ফুফু-আম্মার ঘরে আছেন।” নুরল উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, “মিথ্যা কথা! তাহাকে আর পাইব না।” উকিল সাহেব নুরল এসলামকে আশ্বস্ত করার জন্য কহিলেন, “আমি সত্যই বলিতেছি, তিনি ফুফু-আম্মার ঘরে আছেন, একটু পরে দেখিতে পাইবে।” নুরল এসলাম কহিলেন, “তবে আমি এখনই দেখিতে চাই,”–এই বলিয়া তিনি বিছানায় উঠিয়া বসিলেন এবং ‘কোথায়’ বলিয়া খাট হইতে নামিরার চেষ্টা করিলেন। উকিল সাহেব তাঁহাকে জুড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, “তুমি অত অস্থির হইও না; অসুখ শরীর, পড়িয়া যাইবে।”
নুরল। আমার ব্যারাম সারিয়া পিয়াছে, আমাকে ছাড়িয়া দাও।
বাস্তবিকই তখন তাঁহাকে সুস্থ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। উকিল সাহেব তাঁহাকে ছাড়িয়া দিয়া কহিলেন, “চল, আমিও সঙ্গে যাইতেছি।”
এদিকে ফুফু-আম্মা ও দাসীর যত্ন-চেষ্টায় আনোয়ারা অনেকটা সুস্থ হইয়া উঠিল। নুরল ঘরে প্রবেশ করিলে সে মাথায় কাপড় টানিয়া দিল। তখন অন্যান্য সকলে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। নুরল আনোয়ারার শয্যাপাশে বসিয়া তাহার ঘোমটা খুলিয়া দিলেন। মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাহার গোলাপগণ্ড বহিয়া অশ্রু গড়াইতেছে।
পলকে যেন প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়া গেল। সতী জাগ্রতে যেন স্বপ্ন দেখিতে লাগিল; স্বামীর হস্তস্পর্শে তাহার শিরায় শিরায় তড়িৎ সঞ্চারিত হইতে লাগিল। সে অভাবনীয় শক্তিলাভে শয্যায় উঠিয়া বসিল। কাহারও মুখে কোন কথা নাই। যেন শতাব্দীর বিচ্ছেদের পর পরস্পরের সন্দর্শন, কিন্তু ভাবোচ্ছ্বাসে উভয়ে নীরব। কাহারও বাক্যস্ফুর্তি হইতেছে না, যেন বিশ্বের যাবতীয় প্রেম প্রীতি, সুখ-শান্তি একীভূত হইয়া দম্পত্তির বাকশক্তিকে চাপিয়া ধরিয়াছে। তাই তাহারা শত চেষ্টা করিয়াও মুখ ফুটিতে পারিতেছে না। এই সময় ঊষা দেবী দম্পত্তির এই স্বর্গীয় প্রেমলীলা দর্শনেচ্ছায় পূর্বাশার দ্বার খুলিয়া আসিয়া লীলা গৃহের বাতায়নে উঁকি মারিল। তিনটা দুষ্ট কোকিল নুরল এসলামের আম্রকাননের আশেপাশে পত্রান্তরালে চুপটি করিয়া বসিয়াছিল তাহারা, ‘কি কর ঊষা’ বলিয়া সমস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। ঊষা চোখ রাঙাইয়া তাহাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিল; কিন্তু দুষ্টেরা তাহাকে আরও ক্ষেপাইয়া বাতায়ন হইতে তাড়াইবার চেষ্টা করিল। নুরল এসলাম এই সময় মৌনভাব ভঙ্গকরিয়া আনোয়ারাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কাঁদিতেছ কেন?’ আনোয়ারা নিরুত্তর।
নুরল। এ ঘরে আসিয়াছ কেন?
আনো। ফুফু-আম্মা ধরাধরি করিয়া পাল্কীর ভিতর হইতে আমাকে এ ঘরে আনিয়াছেন।
নুরল। পাল্কী! আমাকে ফেলিয়া কোথায় গিয়াছিলে?
আনো। বলিব না।
নুরল। আমাকে না বলিবার তোমার কিছু আছে না-কি?
আনোয়ারা লজ্জিত হইল এবং উত্তর চাপা দেওয়ার জন্য কহিল, “আপনার শরীর কেমন আছে?”
নুরল। তোমাকে পাইয়া নবজীবন লাভ করিয়াছি। আমার যেন কোন পীড়া হয় নাই বলিয়া বোধ হইতেছে।
আনোয়ারা নুরল এসলামের পদ চুম্বন করিয়া কহিল, “আমি যদি সতী হই, কায়মনোবাক্যে যদি খোদাতালার নিকট আপনার আরোগ্যের জন্য মোনাজাত করিয়া থাকি, তবে অদ্য হইতে আপনি নিরোগ হইবেন।”
নুরল। তুমি যে কোন্ সাধনা বলে আমাকে যমদ্বার হইতে ফিরাইয়াছ বুঝিতেছি না। সত্যিই, এখন আমার কোন পীড়া নাই। আশ্চর্যভাবে শরীরে বলধবন হইয়াছে।
আনোয়ারা স্মিতমুখে স্বামীর মুখের দিকে চাহিল, কোন উত্তর করিল না।
নুরল। চল, ঘরে যাই।
আনো। আমার শরীর দুর্বল, উঠিতে পারিব না। এখানে বসিয়াই ফজরের নামাজ পড়িব।
নুরল এসলাম কিছু বলিলেন না। আস্তে আস্তে বাহিরে আসিলেন! বসন্তের প্রাতঃসমীরণস্পর্শে তিনি যারপরনাই সুখবোধ করিতে লাগিলেন। যষ্টিহস্তে কিয়ৎক্ষণ প্রাঙ্গণে পদচারণ করিয়া বহির্বাটির উদ্যানমুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। উকিল সাহেব এই সময় ঘুম হইতে জাগিলেন। তিনি নুরল এসলামকে বাগানপার্শ্বে দণ্ডায়মান দেখিয়া কহিলেন, “কাতর শরীর লইয়া এত প্রত্যুষে উঠিয়াছ কেন?
নুরল। আজ আমার শরীর খুব সুস্থবোধ হইতেছে; আমি যেন নবজীবন লাভ করিয়াছি।
এই বলিয়া তিনি বৈঠকখানা ঘরের বারান্দায় উঠিয়া ইজিচেয়ারে উপবেশন করিলেন। উকিল সাহেব এই বৈঠকখানা ঘরে শয়ন করিয়াছিলেন।
উকিল। সই কেমন আছেন?
নুরল। অনেকটা ভাল; কিন্তু তার কথাবার্তায় আমি ধাঁধায় পড়িয়া গিয়াছি।
উকিল। সে কেমন?
নুরল। রাত্রিতে তার ঘর হইতে উঠিয়া যাওয়া, চেষ্টা করিয়া না পাওয়া, পাল্কীতে চড়া, ফুফু-আম্মার ঘরে শোওয়া, তার সুস্থ শরীর দুর্বল হওয়া,–এই সকল কারণ জিজ্ঞাসা করায় ‘বলিব না’ বলিয়া উত্তর দেওয়ায় মনে অত্যন্ত খটকা লাগিয়াছে।
উকিল। (সহাস্য) সইয়ের প্রতি অবিশ্বাস জন্মিয়াছে নাকি?
নুরল। তার প্রতি আমার বিশ্বাস, হিমাচল হইতেও অচল, অটল।
উকিল। তবে আইস, নামাজ পড়ি।
উভয়ে একত্রে ফজরের নামাজ পড়িলেন। উকিল সাহেব বেহারাদিগকে পাল্কী প্রস্তুত করিতে আদেশ দিয়া পোশাক পরিতে লাগিলেন।
নুরল। কোথায় যাইবে?
উকিল। একটু বেলগাঁও হইতে বেড়াইয়া আসি। তারপর তোমার খটকা দূর করিব। রাত্রির ঘটনা সরল ফুফু-আম্মা কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। আনোয়ারা কাহার যেন দৈত্যবৎ মূর্তি দেখিয়াছিল। পলকমাত্রকাল স্পর্শ কাঠিন্য অনুভব করিয়াছিল, আর কিছু জানিত না, কিছুই বুঝিতেও পারে নাই; তাহার সেই মুহূর্তমাত্রের ক্ষীণস্মৃতি পতির আরোগ্যজনিত আনন্দে ডুবিয়া গিয়াছিল।