দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
আব্বাস আলী প্রভৃতি বদমাইশেরা জেলায় আসিয়া হাজতে পচিতে লাগিল। বহু বহু চেষ্টা ও অর্থব্যয় করিয়াও আব্বাস আলীর পিতা ছেলের হাজত মুক্তির জন্য জামিন মঞ্জুর করাইতে পারিলেন না। ম্যাজিস্ট্রেট বিচারান্তে মোকদ্দমা দায়রায় দিলেন। আব্বা আলীর পিতার ব্যারিস্টার নিযুক্ত করিলেন। খাদেম আলীর পিতা বেলগাঁওয়ের দোকানপাট ও গোপীনপুরের তালুক বিক্রয় করিয়া আব্বাস আলীর পিতার সহিত এজমালিতে মোকদ্দমার খরচ চালাইতে লাগিলেন। কলিমের পিতা ও গণেশের অভিভাবক প্রভৃতি ব্যয়বাহুল্য করা নিষ্ফল মনে করিলেন। জজ সাহেবের আদেশানুসারে জনৈক উকিল আনোয়ারার জবানবন্দী লইতে রতনদিয়ায় আসিলেন। আসামীর ব্যারিস্টারও সঙ্গে আসিলেন। গভর্নমেন্টের পক্ষ হইতে একজন উকিল নিযুক্ত হইলেন।
নুরল এসলাম স্ত্রীকে কহিলেন, “তোমার জবানবন্দী করিতে জেলা হইতে উকিল- ব্যারিস্টার আসিয়াছেন।”
পূর্বেই বলা হইয়াছে পতিপরায়ণা আনোয়ারার সে করালকালরাত্রির মুহূর্ত মাত্রের ক্ষীণস্মৃতি পতির আরোগ্যজনিত আনন্দে ডুবিয়া গিয়াছিল, তাই যে স্বামীর উত্তরে কহিল, “কিসের জবানবন্দী।”
নুরল। যে যোগ-সাধনায় এই খাকছারকে আজরাইলের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছ।
আনো। আল্লাহতায়ালার দয়ায় রক্ষা পাইয়াছেন, তাহার আবার জবানবন্দী কি?
নুরল দুর্গা বৈষ্ণবীর শয়তানী লীলা ও ষড়যন্ত্রের কথা বর্ণনা করিয়া কহিলেন, “দোস্ত সাহেব পাপিষ্ঠদিগের শাস্তির জন্য এক মোকদ্দমা উপস্থিত করিয়াছেন। সেই মোকদ্দমায় তোমার জবানবন্দী দরকার।”
আনোয়ারা বৈষ্ণবীর বজ্জাতির কথা মনে করিয়া শিহরিয়া উঠিল। ঘৃণায় লজ্জায় সে মরিয়া যাইতে লাগিত। তথাপি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে কহিল, “উহাদিগকে ছাড়িয়া দিলে হয় না?”
নুরল। আমি তোমার মনের উন্নত অবস্থা বুঝিতে পারিয়াছি, কিন্তু ছাড়িয়া দিবার অধিকারী আমরা নহি, স্বয়ং গভর্নমেন্ট বাদী; তা ছাড়া, এ-ক্ষেত্রে পাপীকে শাস্তি প্রদান করিলেই জগতের মঙ্গল বিধান করা হইবে।
আনো। আমি কেমন করিয়া জবানবন্দী দিব?
নুরল। সেই রাত্রির ঘটনা সম্বন্ধে উকিল-ব্যারিস্টার তোমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তুমি তাহার উত্তর দিবে।
আনো। (প্রেমকোপে স্বামীর দিকে চাহিয়া) উকিল-ব্যারিস্টারের মুখে আগুন, আনোয়ারা খাতুন তাহাদের সহিত কথা বলিবে?
নুরল। (হাসিমুখে) পর্দার অন্তরালে থাকিয়া তাহাদের জিজ্ঞাস্য কথার উত্তর দিবে, তাহাতে দোষ কি?
আনো। (অভিমান কটাক্ষে স্বামীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া) দেশমান্য দেওয়ান সাহেবের অসূর্যস্পশ্যা সহধর্মিনী পরপুরুষের সহিত কথা বলিতে ঘৃণা বোধ করে।
নুরল। তবে জবানবন্দী কিরূপে দিবে?
আনো। উকিলের জিজ্ঞাস্য বিষয়ের উত্তর অন্দর হইতে লিখিয়া দিব।
নুরল এসলাম তখন স্বপক্ষে উকিলকে যাইয়া কহিলেন, “আপনারা অনুগ্রহ করিয়া আমার স্ত্রীর লিখিত জবানবন্দী গ্রহণ করুন।”
উকিল। আইন অনুসারে লিখিত জবানবন্দী গ্রাহ্য নহে।
নুরল এসলাম অগত্যা স্ত্রীকে অনেক উপদেশ দিয়া মৌখিক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করিলেন। আনোয়ারা স্বামীর আদেশে মরমে মরিয়া পর্দার অন্তরালে থাকিয়া অনুচ্চভাবে উকিল-ব্যারিস্টারের কথার উত্তর দিতে আরম্ভ করিল।
গভর্নমেন্টের উকিল দুর্গা বৈষ্ণবীর ভিক্ষা করা হইতে আরম্ভ করিয়া বদমাইশদের গ্রেফতার পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনা তন্ন তন্ন করিয়া একে একে সসম্মানে আনোয়ারাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। আনোয়ারার যাহা স্মরণ ছিল, সমস্ত কথার উত্তর দিল। বাহুল্য ভয়ে এখানে তৎসমস্ত উল্লেখিত হইল না; কিন্তু আনোয়ারা যেরূপ সত্যতা ও তেজস্বিতার সহিত উকিলের জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের উত্তর করিল, তাহাতে আসামীর ব্যারিস্টার আসামীকে রক্ষা করা সম্বন্ধে নিরাশ হইয়া পড়িলেন। তবে আসামীর আশু মনোরঞ্জনের জন্য আনোয়ারাকে নিম্নলিখিতরূপ কয়েকটি জেরা করিলেন।
ব্যারিষ্ট্যার। আপনি কত রাত্রিতে ঘরের বাহির হইয়াছিলেন?
আনো। দুপুর রাতে——১২টায়।
ব্যারিস্টার। আপনি কি ঘড়ি দেখিয়া বাহির হইয়াছিলেন?
আনো। হ্যাঁ।
ব্যারিস্টার। আপনার সঙ্গে আর কেহ ছিল না?
আনো। না।
ব্যারিস্টার। অত রাত্রিতে একাকিনী ঘরের বাহির হইতে আপনার ভয় হইল না?
আনো। না।
ব্যারিস্টার। অমন সময় পুরুষ মানুষের ভয় হয়, আর আপনার ভয় হইল না?
আনোয়ারা নিরুত্তর।
ব্যারিস্টার। যখন বাহির হন তখন আপনার স্বামী কোথায় ছিলেন?
আনো। ঘরে।
ব্যারিস্টার। নিদ্রিত না জাগ্রত?
আনো। নিদ্রিত।
ব্যরিস্টার। বাহিরে যাইতে আপনাকে কেহ ডাকিয়াছিল কি?
আনো। কেহ না।
ব্যারিস্টার। তবে কোন্ সূত্রে বাহিরে গেলেন?
আনো। বৈষ্ণবীর সঙ্কেতানুসারে।
উকিল বাবু ব্যারিস্টার সাহেবকে বলিলেন, “আপনার প্রশ্নের উত্তরেই উনি সকল কথা বিশেষভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন, সুতরাং পুনরায় জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন।” ব্যারিস্টার প্রবর ভ্রূকুটি করিয়া কহিলেন, “আমার প্রয়োজন আছে বলিয়াই জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
উকিল। আচ্ছা করুন।
ব্যারিস্টার। আপনি বাহিরে যাইয়া কাহাকে দেখিতে পাইলেন?
আনো। কাহাকেও দেখিতে পাই নাই, তবে ভীষণ দৈত্যের মত হঠাৎ কে যেন পশ্চাদ্দিক হইতে আসিয়া আমার গলা টিপিয়া ধরিল।
ব্যারিস্টার। আপনি তখন কি করিলেন?
আনো। জানি না।
অতঃপর ব্যারিস্টার আর জেরা করা নিষ্প্রয়োজন বোধ করিয়া চুপ করিলেন। জজের প্রতিনিধি আনোয়ারার জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করিয়া যথাসময়ে জজ সাহেবের নিকট দাখিল করিলেন।
যথাসময়ে জজকোর্টে মোকদ্দমা উঠিল। ডেপুটি বাবু ও উকিল সাহেব একে একে সাক্ষ্য দিলেন। ব্যারিষ্টার সাহেব ডেপুটি বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে সময়ে আপনারা বদমাইশদের গ্রেপ্তার করেন, তখন রাত্রি কত?”
ডেপুটি। ১২ টা ১৫ মিনিট।
ব্যারিষ্টার। ঘটনাস্থল হইতে রতনদিয়া গ্রাম কতদূর?
ডেপুটি। ঠিক জানি না।
ব্যারিস্টার উকিল আমজাদ সাহেবকে একটু কৌশলের সহিত জেরা করিলেন, “আপনারা যখন আসামী প্রেপ্তার করেন তখন রাত্রি কত?”
উকিল। ১২ টা ১৫ মিনিট। ব্যারিষ্টার সাহেবের মুখে মলিনতার ছায়া পড়িল।
ব্যারিস্টার। ঘটনাস্থল হইতে আপনার দোস্তের বাড়ি কতদূর?
উকিল। দেড় মাইল।
গণেশ সাক্ষীরূপে সরলমনে সব ঘটনা খুলিয়া বলিল। আব্বাস, কলিম প্রভৃতি পাষণ্ডেরা দুর্গা বৈষ্ণবীর সাহায্যে যেরূপ কৌশলে কুলবধূকে ঘরের বাহির করে, অতি বিশ্বাস্য প্রমাণ প্রয়োগে গণেশ যে সকল কথা বলিয়া গেল। ব্যারিস্টারের জেরার উত্তরে সে বলিল, ‘আমরা বড় বাবুর স্ত্রীকে পাল্কীতে তুলিয়াই বিরামপুর গ্রামের দিকে ছুটিয়াছিলাম। তথায় আব্বাস আলীর ন্যায় আর একটি লোকের বাড়ি। সে আব্বাস আলীদিগের খাতক। তথায় বড় বাবুর বিবিকে লইয়া রাখিবার কথাবার্তা পূর্বেই সাব্যস্ত হইয়া গিয়াছিল কিন্তু পথেই ধরা পড়িলাম।”
অতঃপর উকিল, ব্যারিস্টারের বক্তৃতা ও আইন-ঘটিত যুক্তি-তর্কের কথা জজ সাহেব শুনিলেন। তদন্তর জুরিদিগকে মোকদ্দমার অবস্থা বুঝাইয়া দিলেন। জুরিগণ একবাক্যে আসামীদিগকে অপরাধী সাব্যস্ত করিলেন।
পরিশেষে জজ সাহেব রায় লিখিয়া হুকুম দিলেন—আব্বাস আলী ও দুর্গা বৈষ্ণবীর প্রতি কঠিন পরিশ্রমের সহিত ৭ বৎসর, কলিম ও খাদেম আলীর প্রতি ৪ বৎসর কারাদণ্ডের আদেশ হইল। বেহারাগণেরও এক বৎসরের শাস্তি হইল। গণেশ প্রকৃত ঘটনার সাক্ষী দেওয়ায় বেকসুর খালাস পাইল। সদাশয় জজ রায়ে আনোয়ারার সরলতা ও পতিপরায়ণতার উল্লেখ করিতে ত্রুটি করিলেন না।
আব্বাস আলী ও খাদেমের পিতা ‘হায় হায়’ করিতে করিতে বাড়ি ফিরিলেন। দেশময় রাষ্ট্র হইল—বেলগাঁও জুট অফিসের বড়বাবুর বিবিকে ঘরের বাহির করিতে যাইয়া গুণ্ডাদলের নিপাত হইল। দীন-দরিদ্র-হিন্দু-মুসলমান কুল-লননাগণ আনোয়ারাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিতে লাগিল, “মা, তোমার সতীপনায় আজ হইতে আমাদের জাতি-মান রক্ষা হইল। অনেক গুণ্ডাভীত মহিলা কেহ কালীর দুয়ারে, কেহ মসজিদে মানত শোধ করিল। কেবল সালেহার মা মাথা কুটিয়া আনোয়ারাকে অভিসম্পাৎ করিতে লাগিলেন। একদিন মাতার এই অবৈধ গালাগালি শুনিয়া সালেহা তাহার প্রতিবাদ করিল। মা ক্ষিপ্তার ন্যায় হইয়া সালেহাকে স্বহস্তে প্রহার করিলেন। কন্যা দুঃখে অভিমানে কাঁদিতে কাঁদিতে যাইয়া আনোয়ারার নিকট উপস্থিত হইল। আনোয়ারা তাহাকে সস্নেহে সাদরে গ্রহণ করিল।
এদিকে খাদেম আলীর পিতা, পুত্রের দোষে সর্বস্ব হারাইয়া সপরিবারে ভগ্নির বাড়ি যাইয়া আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।
আল্লার ফজলে সতীর সেবা-সাধনায় নুরল এসলাম পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করিয়া কোম্পানির কার্যে পুনঃপ্রবৃত্ত হইলেন।