» » ভক্তি-পর্ব

বর্ণাকার

দশম পরিচ্ছেদ

নুরল এসলাম তিন সপ্তাহ পর কলিকাতা হইতে বাড়ি আসিলেন। তাঁহার চেহারা মলিন, গলার আওয়াজ বসা। দেখিয়া আনোয়ারার প্রফুল্ল মুখ শুকাইয়া গেল। সে বিষাদস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “অমন হইয়াছেন কেন? শরীর যে মাটি হইয়াছে।”

নুরল। কয়েকদিন শীতে ভুগিয়া সর্দি ধরিয়াছে। সর্দিতে গলার আওয়াজ বসিয়া গিয়াছে। আবার গতকল্য গাড়িতে উঠিতে বুকে আঘাত লাগিয়া অত্যন্ত কষ্ট পাইতেছি। আজ যেন একটু জ্বর জ্বর বোধ হইতেছে।

আনো। আর আফিসে যাইয়া কাজ নাই, শরীর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আপাতত দুই সপ্তাহের ছুটি দিন।

নুরল। আচ্ছা, কাল প্রাতে দেখা যাইবে।

রাত্রিতে নুরল এসলামের জ্বর একটু বেশি হইল। তিনি খুক খুক্ করিয়া কাশিতে লাগিলেন। প্রাতঃকালে দেখা গেল, তাঁহার গলার স্বর আরও বসিয়া গিয়াছে, কাশির সঙ্গে রক্ত উঠিয়াছে। রক্ত দেখিয়া আনোয়ারার আত্মা চমকিয়া গেল। নুরল এসলাম বিবাদের আরজীর সহিত ম্যানেজার সাহেবকে লিখিলেন, “অনুগ্রহ পূর্বক আমার জন্য এসিস্ট্যান্ট সার্জন বাবুকে পাঠাইবেন। রাত্রিতে চাকর বেলগাঁও গেল। এসিস্ট্যান্ট সার্জন আসিলেন ও দেখিয়া ঔষধ দিয়া ভিজিট লইয়া চলিয়া গেলেন। ম্যানেজার সাহেব এসিস্ট্যান্ট সার্জনকে ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “নুরল এসলামকে কেমন দেখিলেন?”

এঃ সাঃ। অবস্থা ভাল নয়। ক্ষয়কাশের পূর্ব লক্ষণ বলিয়া বোধ হইল।

সাহেব শুনিয়া দুঃখিত হইলেন।

ইহার এক সপ্তাহ পরে দুর্গা বৈষ্ণবী পুনরায় নুরল এসলামের বাড়িতে ভিক্ষার নিমিত্ত উপস্থিত হইল। সে দাসীর মুখে শুনিল, নুরল এসলাম কলিকাতা হইতে পীড়িত হইয়া বাড়ি আসিয়াছেন।

নুরল এসলামের পীড়ার প্রথম হইতেই আনোয়ারার অর্ধাশন, অনিদ্রা আরম্ভ হইল। সে ফুফু শাশুড়ীর হস্তে সাধারণ পাকের ও গৃহস্থালির অন্যান্য বিষয়ের ভার ন্যস্ত করিয়া স্বামীর শুশ্রূষায় আত্মপ্রাণ উৎসর্গ করিল। সে স্বামীর পার্শ্বে বসিয়া তাঁহার পার্শ্ব পরিবর্তন ও নিঃশ্বাস ত্যাগ গণিতে লাগিল। আদেশ শ্রবণে কর্ণকে সতর্ক করিয়া রাখিল। পথ্য বন্ধন, ঔষধ সেবন প্রভৃতি কার্য নিজ হাতে অতি সাবধানে করিতে লাগিল; কিন্তু দিন যতই যাইতে লাগিল, নুরল এসলামের পীড়া ততই বাড়িয়া চলিল। আনোয়ারা হতাশ মনে তীর-বিদ্ধা হরিণীর ন্যায় সে পীড়া নিজ হৃদয়ে অনুভব করিতে লাগিল। সে থাকিয়া থাকিয়া স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনার কেমন বোধ হইতেছে? কি করিলে শান্তি পাইবেন, বলুন, আমি তাহাই করিতেছি।” নুরল এসলাম স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া বলেন, “প্রিয়ে! অদৃষ্টে বুঝি আর শান্তি নাই।” শুনিয়া বুক ভাঙ্গিয়া গেলেও আনোয়ারা স্বামীর সাহস ও ধৈর্যাবলম্বনের নিমিত্ত অশ্রু সম্বরণ করিয়া বলে, “সে কি কথা! এই ত শীঘ্রই ভাল হইবেন। “

২৫/২৬ দিন ডাক্তারী মতে চিকিৎসা চলিল; কিন্তু কিছুই সুফল বুঝা গেল না। রোজ দ্বিপ্রহরের পর হইতে ২/৩ ডিগ্রী করিয়া জ্বর হইতে লাগিল। কাশি পাকিয়া পুঁজে পরিণত হইল, পুঁজে রক্তমিশ্রিত হইয়া উঠিতে লাগিল; কন্ঠস্বর ভাঙ্গা-ভাঙ্গা—আরও অস্পষ্ট হইয়া উঠিল, চক্ষু বসিয়া গেল, কন্ঠের হাড় বাহির হইয়া পড়িল। নুরল এসলাম ক্রমশ ক্ষীণ হইয়া একেবারে শয্যাশায়ী হইলেন। আনোয়ারা অনন্যোপায়ে প্রিয়সখী হামিদাকে জেলার ঠিকানায় পত্র লিখিতে বসিল। চোখের পানিতে তাহার পত্র ভিজিয়া গেল। সে আদ্র কাগজেই লিখিল, “সই, তোমার সয়া গুরুতর পীড়িত, পত্র-পাঠ সয়াকে দেখিতে পাঠাইবে।”