চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পনর দিন পর নুরল এসলামকে ছয় শত টাকা দিতে হইবে,—এই ভাবনার তিনি অস্থির হইয়া পড়িলেন। তাঁহার হাতে যাহা ছিল, বিবাহের ব্যয়ে তাহাও নিঃশেষ হইয়াছে; তবে তিনি ঋণগ্রস্ত হন নাই—এই যা’ লাভ। সোমবারে তিনি চিন্তিত মনে বেলগাঁও অফিসে গমন করিলেন। পতিপ্রাণা আনোয়ারা পতির মনোভাব বুঝিয়া তাঁহার নিজ হৃদয়ে ধারণ করিল সে মধুপুরে পত্র লিখিল:
“দাদিমা! আমার ভক্তিপূর্ণ শত সহস্র সালাম জানিবে। অনেক দিন তোমাদের পত্র পাই না, এজন্যও চিন্তিত ও দুঃখিত আছি। সত্বর তোমাদের কুশল সংবাদসহ পত্র লিখিবে।
“গতকল্য আম্মাজান পৃথক হইয়াছে। তজ্জন্য আমাদের কিছু ঠেকাঠেকি হইয়াছে। পত্রপাঠ আমার নিজ টাকা হইতে, ছয় শত টাকা তোমার দুলাভাইজানের নামে—যাহাতে পরবর্তী সোমবার বেলগাঁও পৌঁছে, এইরূপ তাগিদে পাঠাইবে। বাবাজান ও মা’কে এবং ওস্তাদ চাচাজান ও চাচি আম্মাকে আমার সালাম জানাইবে। বাদশা ভাই কেমন আছে? সে স্কুলে যায় তো? ভোলার মা, গদার বৌ, মার সই—ইহাদের কুশল সংবাদ লিখিবে। আমাদের বালিকা-বিদ্যালয় কেমন চলিতেছে? জেলা হইতে হামিদার পত্র পাইয়াছি। সই কিছু খুলিয়া লিখে নাই; কিন্তু চিঠির ভাবে বুঝিলাম, সে অন্তঃসত্ত্বা। উকিল সয়া দৈনিক ৫০ টাকা ফি লইয়া মফঃস্বলে মোকদ্দমায় গিয়াছেন। আমরা ভাল আছি।”
ইতি–
তোমার জীবনসর্বস্ব–”আনার”
সপ্তাহ শেষ—শনিবার নুরল এসলাম বাড়ি আসিলেন। টাকা সংগ্রহ না হওয়ায় তাঁহার মুখ মলিন। আনোয়ারা জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার চেহারা এত খারাপ হইতেছে কেন?”
নুরল। আর কয়েকদিন পরেই সালেহাদিগকে টাকা দিতে হইবে, এ পর্যন্ত তাহা সংগ্রহ হইল না। ম্যানেজার সাহেব সহকারী তহবিল হইতে বিনা সুদে দুই শত দিতে চাহিয়াছেন; অবশিষ্ট টাকা কোথায় পাইব, সেই ভাবনায় বড়ই চিন্তিত হইয়াছি।
আনো। মার মরণকালে আমাকে উপদেশ দিয়াছিলেন, ‘মা সংসারে যত বিপদে পড়িবে, ততই খোদাকে আঁকড়াইয়া ধরিবে, বিপদ আপনা-আপনি ছাড়িয়া যাইবে।’ নুরল সোৎসাহে স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিল। আনোয়ারা পতির মুখের দিকে চাহিয়া বিস্মিতভাবে কহিলেন, কি! আপনার মুখে হঠাৎ যেন বেহেস্তের জ্যোতি ফুটিয়াছে।”
নুরল। তোমার মুখে স্বর্গীয়া আম্মার উপদেশের কথা শুনিয়া আমার মনের অবসাদ যেন নিমিষে অন্তর্নিহিত হইয়াছে! আমি আজ সারারাত্রি বন্দেগীতে কাটাইব।
আনো। ভাগা-ভাগির গণ্ডগোল-অসুখে এ কয়েকদিন আমিও ওজিফা পড়িতে পারি নাই। আজ রাত্রিতে প্রাণ ভরিয়া কোরান শরিফ পড়িব।
আহারান্তে রাত্রিতে ধর্মশীল দম্পতি, সঙ্কল্পিত ধর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন।
নুরল এসলাম বেলগাঁও যাইবেন। আনোয়ারা অতি প্রতুষ্যে উঠিয়া তাঁহার পাকের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইয়াছে। পাকান্তে নিজ হস্তে স্বামীকে স্নান করাইল। স্নানান্তে উপাদেয় অন্নব্যঞ্জন আনিয়া তাঁহার সম্মুখে রাখিল। নুরল এসলাম আহারে প্রবৃত্ত হইলেন। আনোয়ারা পান তৈয়ারী করিতে বসিয়া হাসি হাসি মুখে কহিল, “আজ রাত্রিতে আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি, এক পরমা ধার্মিকা বৃদ্ধা আপনাকে অর্থাভাবে চিন্তিত দেখিয়া বলিতেছেন, “বৎস, চিন্তিত হইও না; তোমার প্রাপ্য কিছু টাকা আমার নিকট মওজুদ আছে, তাহা হইতে কতক টাকা তোমার সংসার খরচের জন্য দিলাম।’ আমার বিশ্বাস, আপনি বেলগাঁও যাইয়া আজ কি কাল তাহা পাইবেন। দাসীর অনুরোধ, স্বপ্ন সফল হইলে টাকা গ্রহণে সঙ্কোচ করিবেন না।”
নুরল এসলাম স্ত্রীর স্বপ্নের ভাব কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। খোদা ভরসা করিয়া বিস্মিতচিত্তে অশ্বারোহণে বেলগাঁও রওয়ানা হইলেন। তিনি বরাবর ঘোড়ায় চড়িয়া বেলগাঁও যাতায়াত করেন।
নুরল এসলাম বেলগাঁও উপস্থিত হইয়া সবেমাত্র অফিসের কার্যে মনোযোগী হইয়াছেন, এমন সময় ডাকপিয়ন যাইয়া তাঁহাকে সালাম করিয়া দাঁড়াইল এবং ব্যাগ হইতে একখানি মনি অর্ডারের ফরম বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিল। তিনি ফরম পড়িয়া দেখিলেন, ছয়শত টাকার মনি অর্ডার। প্রেরিকা দাদিমা, গ্রাম, মধুপুর। নুরল তখন স্ত্রীর স্বপ্নের অর্থ বুঝিলেন এবং খোদাতায়ালার নিকট কৃতজ্ঞতা জানাইয়া কহিলেন, “দয়াময়! আমি নগণ্য নরাধম, তুমি আমাকে এমন স্ত্রী-রত্ন দান করিয়াছ!”
শনিবার নুরল টাকা লইয়া বাড়ি আসিলেন। আনোয়ারা টাকার ব্যাগ দেখিয়া হাসিতে হাসিতে কহিল, ‘দাসীর স্বপ্ন ত বৃথা যায় নাই। ‘
নুরল। শুনিয়াছি বেহেস্তের হুরেরা স্বপ্নের নায়িকা; সুতরাং তাহা বৃথা হইতে পারে না।
এই বলিয়া তিনি ছয়শত টাকার তোড়া আনোয়ারার নিকটে দিলেন এবং কহিলেন, “এ টাকা আমি লইব না।”
আনো। কেন?
নুরল। কেন আর বলিতেছ কেন? তিন হাজার টাকার কাবিন গেল। তারপর আরও কত কি উপহার, আবার এককালে এই ছয়শত টাকা।
আনো। তাতে কি?
নুরল। তাহা হইলে যে, বেচারার নিজস্ব বলিয়া কিছু থাকে না।
আনো। প্রয়োজন?
নুরল। সংসার বড় কঠিন স্থান।
আনোয়ারার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, সে ছলছল নেত্রে উর্ধ্বে তাকাইয়া কহিল, “তবে আমি কি পর? আমার জিনিস কি আপনার নয়?” নুরল তাহার কথার ভাবে ও অবস্থাদৃষ্টে একান্ত মুগ্ধ ও বিচলিত হইলেন।
অনন্তর নুরল এসলাম কহিলেন, “টাকাগুলি কার?”
আনো। আপনার।
নুরল। দাদী-আম্মা পাঠাইয়াছেন?
আনো। আপনার টাকা তাঁর কাছে মজুদ ছিল।
নুরল। বুঝিলাম না।
আনো। বাবাজান যদি আমার বিবাহ বাবদ আপনার নিকট টাকা চাহিতেন, আর আপনি যদি তাহা দিতে অস্বীকার করিতেন, তবে এ বিবাহে বিঘ্ন ঘটিত। তজ্জন্য দাদিমা সংকল্প করিয়াছিলেন, আপনি টাকা দেওয়া অস্বীকার করিলে, গোপনে আপনার নিকট (বাপজানকে দিবার জন্য) ইহা পাঠাইতেন। এ সেই টাকা। এই টাকা বিবাহের জন্য আবশ্যক হয় নাই, আপনার নামেই মজুদ রাখা হইয়াছিল।
নুরল। বাপজান যদি হাজার টাকা চাহিয়া বসিতেন?
আনো। দাদিমা আপনার প্রতি আমার মনের ভাব টের পাইয়া বলিয়াছিলেন, যত টাকা লাগে দিয়া আনোয়ারাকে সুখী করিব।
নুরল। তিনি সেকেলে লোক, প্রেম-মাহাত্ম্যের পক্ষপাতী?
আনো। তিনি বলিয়াছেন যে, ‘আমিও স্বরম্বরা মতে বিবাহিতা হইয়াছি।’
আনোয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধে নুরল এসলাম শেষে টাকা গ্রহণে স্বীকৃত হইলেন এবং পরদিন ২/৪ জন সম্ভ্রান্ত প্রধানের মোকাবিলায় তিনি বিমাতাকে নগদ ছয়শত টাকা গুণিয়া দিলেন। পত্নীর পতিপ্রাণতায় তাঁহার চিত্তের ভার কমিয়া গেল।