ষোড়শ পরিচ্ছেদ
শনিবারের আর দুইদিন মাত্র বাকী। চিন্তার অনন্ত-তরঙ্গঘাতে বালিকার কোমল হৃদয় আলোড়িত ও ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত হইতে লাগিল। সে একবার ভাবিল, সমস্ত কথা স্বামীর নিকট খুলিয়া বলি; আবার ভাবিল, তিনি যদি বিশ্বাস না করেন, অথবা প্রাণের বদলে প্রাণ রক্ষা করা ঘৃণা বোধ করেন, তবে আর তাঁহাকে বাঁচাইতে পারিলাম না। অতএব আগে তাঁহাকে এই কথা জানাইব না। এইরূপ বিতর্ক করিয়া আনোয়ারা স্বামীকে কিছু জানাইল না।
রাত্রিতে আনোয়ারা ঘরে আসিল; এশার নামাজ অন্তে অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করিল। তাহার পর যথাবিধানে পতি পরিচর্যায় নিযুক্ত হইল। সতীর সেবা-সাধনায় রোগক্লিষ্ট অতি শান্তির কোলে সুনিদ্রিত হইলেন। সতী তখন পতির পদপ্রান্তে বসিয়া একখানি চির বিদায়লিপি লিখিতে আরম্ভ করিল। রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর। উদ্বেগ ও চিন্তার আতিশয্যে বালিকা পরিশ্রান্ত। তথাপি লিখিতে আরম্ভ করিল,–
“জীবনসর্বস্ব!
মনে করিয়াছিলাম—এ জীবন বাসন্তী পূর্ণিমার রাত্রি স্বরূপ আপনার পবিত্র সহবাসসুখে অতিবাহিত হইবে; কিন্তু হায়। ভাগ্যে তাহা ঘটিল না।” এই পর্যন্ত লিখিয়া মুগ্ধ বালিকা ধীরে অবসন্ন দেহে পতিচরণ তলে তন্দ্রাভিভূতা হইয়া পড়িল। তন্দ্রাবেশে সে স্বপ্নে দেখিতে লাগিল, তাহার সম্মুখে দণ্ডধারী এক মহাপুরুষ দণ্ডায়মান, তাঁহার জ্যোতির্ময় দেহ হইতে কর্পূরের সুবাস নির্গত হইতেছিল। তিনি বালিকার প্রতি সকরুণ স্নেহদৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে তাহার দেহে হস্তার্পণ করিলেন। তাঁহার জ্বালাময় স্পর্শে বালিকা শিহরিয়া উঠিল। আবার পর মুহূর্তে দেখিতে লাগিল-বিশ্বগ্রাসী গভীর অন্ধকার, গভীরতমরূপে দশদিক হইতে তাহার নিকটে ঘনাইয়া আসিতেছে, এবং তাহার মধ্য হইতে তামস-ঝটিকার আবর্ত মহাকায় বিস্তার করিয়া মহাবেগে, মহাগর্জনে ঊর্ধ্বগামী হইতেছে। নিচে তামস-সাগর বক্ষে কালের করাল-কল্লোলে মহাভেরীর ন্যায় অনবরত ভীমরব তুলিয়া যেন তরঙ্গভঙ্গ তাণ্ডব নৃত করিতেছে। আকাশ সাগর একাকারে একের গায়ে অন্যে মিশিয়া গিয়াছে; মিলনের কেন্দ্র হইতে কোটি বজ্রনাদে ভীমরব ধ্বনিত হইতেছে; সে ভীমরবে গ্রহগণ যেন কক্ষত্যাগ করিয়া দিগন্তে ছুটাছুটি করিতেছে; মুহুর্মুহু বিদ্যুদ্বিভায় নয়ন ঝলসিয়া যাইতেছে। কি ভীষণ দৃশ্য! বিভীষীকাময়ী লীলা! বালিকা স্তব্ধনিঃশ্বাসে নিস্পন্দ নয়নে, ভীতিশূন্য মনে এই দৃশ্য দেখিতে লাগিল। আবার একি! আরও ভীষণ দৃশ্য! সর্বসংহারক লগুড়হস্তে যুগল জ্যোতির্ময়ী মূর্তি বালিকার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত! বালিকা একবার সভয়ে করুণ বিলাপে কহিল, “কে তোমরা? আইস, পতি পরিচর্যায় ত্রুটি হইয়া থাকিলে তোমাদের হস্তের লগুড়াঘাতে দাসীর মস্তক চূর্ণ করিয়া ফেল।’ দৃপ্তা তেজোময়ী বালিকার মুখের কথা শেষ হইতে না হইতেই যুগল মূর্তি অন্তর্হিত হইল। অতঃপর সে দেখিতে পাইল, অনন্ত অপূর্ব এক আলোকময় দেশ তাহার পুরোভাগে প্রকাশিত। কি সুন্দর সোনার দেশ! বালিকা হর্ষোৎফুল্ল চিত্তে স্বর্ণরাজ্যে প্রবেশ করিল; চতুর্দিকে দৃষ্টি যোজনা করিয়া দেখিতে লাগিল, সে দেশের উদ্যান সমতল গহ্বর নির্ঝর আলোকমালা বক্ষে নিত্য উদ্ভাসিত। সে দেশের অধিবাসিগণ জ্যোতির্ময় বস্ত্রলঙ্কারে চিরশোভিতহিংসা-বিদ্বেষ, শোক-তাপ, মায়া-মোহবর্জিত—নিত্য শান্তিসুখে পরিসেবিত। বালিকা দেখিল, তাহার সম্মুখে সতীমহল। সতীমহলের শোভা অনুপম। স্বর্ণময় অট্টালিকার মধ্যে মণিখচিত পর্যাঙ্কে পয়ঃফেনসন্নিভ শয্যায় সতীকুল সমাসীনা। শত শত রূপসী শিরোমনি হুর তাহাদের, সবার রত আছেন। সতীগণ পতিসেবা পুণ্যফলে সারাবন তহুরা পানে আত্মহারা হইয়া বিভূ গুণ-গাণে রত আছেন। বালিকা সতীমহলের একটি বিরাট অট্টালিকা দেখিয়া সুখরোমাঞ্চ কলেবরে তাহার দ্বারদেশে দণ্ডায়মান হইল। সে সৌধ কারুকার্যে অতুলনীয়, সৌন্দর্যে অদ্বিতীয়। সে সৌধ গৌরবে সমুন্নত সৌরভে পুরিত, শোভন উদ্যানে বেষ্টিত। সর্বোৎকৃষ্ট অট্টালিকা হইতে একে একে খোদেজা, ফাতেমা, রহিমা, হাজেরা, আছিয়া, আয়েশা, জোবেদা প্রমুখ সতীকুলরমণীগণ বাহির হইয়া বালিকাকে স্বৰ্গীয় পুষ্পমাল্য ভূষিত করিয়া স্নেহাশীর্বাদ জ্ঞাপন করিলেন। বালিকা সেই অট্টালিকার অন্য প্রকোষ্ঠে তাহার জননীকে দেখিতে পাইল। সে তখন মা-মা, বলিয়া মাতৃ-মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করিল। মা ভিতর হইতে দ্বাররুদ্ধ করিয়া কহিলেন “বৎসে, এখন নয়, স্বামীসেবা ব্ৰত শেষ করিয়া যথা সময়ে আসিবে, কোলে তুলিয়া লইব।“
হঠাৎ বালিকার তন্দ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। সে জাগিয়া থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল এবং ভাবিতে লাগিল, একি দেখিলাম! আমি সুপ্ত না জাগ্রত? কোথায় গিয়াছিলাম? মা যাহা বলিলেন, তাহাতে ত, বুঝিতেছি সঙ্কল্প সফল হইবে। দয়াময় আল্লা, দাসীর স্বামীকে রক্ষা কর!
বালিকা ধীরে ধীরে উঠিয়া দুই রেকাত নফল নামাজ পড়িল। তারপর চিঠি লিখিতে আরম্ভ করিল।
“প্রিয়তম
যে বৈষ্ণবী আমাদের বাড়িতে ভিক্ষা করিতে আইসে, সে আপনার পীড়ার অবস্থা শুনিয়া বলিল,—মৃতসঞ্জীবনী লতা ভিন্ন কোন ঔষধে ঐ ব্যাধি আরোগ্য হইবে না।
দীর্ঘদিন ঔষধ সেবনেও আপনার পীড়ার উপশম হইতেছে না দেখিয়া অগত্যা বৈষ্ণবীর ঔষধ পরীক্ষা করিতে মনস্থ করিয়াছি। কিন্তু যে সেই লতা তুলিবে তাহার শরীরে পীড়া সংক্রামিত হইয়া সে মৃত্যুমুখে পতিত হইবে এবং রোগী নিরোগ হইবে। হে হৃদয়সৰ্বস্ব! আপনার জন্য জীবন দেওয়া ত তুচ্ছ কথা, জীবন অপেক্ষাও যদি কিছু অধিকতর মূল্যবান থাকে তাহাও আপনার জন্য অকাতরে দান করিতে দাসী সর্বদা প্রস্তুত। তাই প্রিয়তম, দুই দিন পরে আমি আপনার নিকট হইতে বিদায় লইতেছি; কিন্তু এ বিদায় নহে—অনন্ত স্বর্গে আমাদের অনন্ত মিলন হইবে।
প্রাণপ্রিয় মৃতসঞ্জীবনী লতার গুণ সম্বন্ধে পাছে আপনি অবিশ্বাস করেন বা আমাকে লতা তুলিতে নিষেধ করেন,—এই ভয়ে আপনাকে আগে জানাইলাম না; দাসীর অপরাধ ও ধৃষ্টতা নিজগুণে ক্ষমা করিতে মর্জি হইবে। আপনাকে পতিরূপে পাইয়া অল্প সময়ে যেরূপ সুখী হইয়াছি, যুগ-যুগান্তে বুঝি অন্য কোন নারীর ভাগ্যে তাহা ঘটিবে না। আমি শনিবার নিশীথকে সাদরে আহ্বান করিতেছি আপনাকে রোগমুক্ত করিতে পারিব ভাবিয়া, দাসীর হৃদয়ে যে উল্লাস-লহরী খেলিতেছে, তাহার তুলনা খুঁজিয়া পাইতেছি না। বধির শ্রবণ-শক্তি পাইলে, জন্মান্ধের চক্ষু ফুটিলে, পঙ্গুর পদলাভে যে আনন্দ, আজ ততোধিক আনন্দে দাসীর হৃদয় উৎফুল্ল। আপনার সম্মুখে প্রাণত্যাগ করিব, আহা! আমার তাতে কত সৌভাগ্য! কত সুখ! আপনি বাঁচিয়া থাকিলে সংসারের যে উপকার করিতে পারিবেন, দাসী দ্বারা তাহার শতাংশের একাংশ হইবে না। অতএব দাসীর অভাবে আপনি দুঃখিত হইবেন না। ইতি—
চিরসেবিকা দাসী-
আনোয়ারা”
বালিকা পত্র লিখিয়া নিদ্রিত স্বামীর উপাধানের নীচে তাহা রাখিয়া দিল।