পঞ্চম পরিচ্ছেদ
একযোগে ৬০০ টাকা হাতে পাইয়া নুরল এসলামের বিমাতা, গোপীনপুর হইতে ভ্রাতাকে আবার ডাকিয়া পাঠাইলেন।
ভগ্নিপতির মৃত্যু হইয়াছে; কিন্তু ভগ্নি আছে, তাহার নামেই দুই হাজার টাকার কাবিনের তালুক আছে, বিবাহযোগ্য সুন্দরী ভগিনেয়ী আছে, তদপুরি নিজের বিবাহযোগ্য পুত্রও আছে। এই সকল উপকরণ যোগে আলতাফ হোসেন সাহেব পূর্ব হইতেই দুরাশার সংসারে এক সুখের সুরম্য সৌধ নির্মাণের সঙ্কল্প করিয়া বসিয়াছিলেন। বাসনা পথে যে বিঘ্ন ছিল, ভগ্নী পৃথক হওয়ায় তাহা দূর হইয়াছে; সুতরাং ভগ্নীর এ আহ্বানে তিনি সেই কথা মনে করিয়া অনতিবিলম্বে রতনদিয়া উপস্থিত হইলেন। যথাসময়ে ভ্রাতা-ভগ্নীকে নির্জনে কথোপকথন আরম্ভ হইল।
ভ্রাতা। ডাকিয়াছ কেন?
ভগ্নী। অনেক কথা আছে।
ভ্রাতা। নুরল টাকা দিয়াছে?
ভগ্নী। জী হ্যাঁ।
ভ্রাতা। ধাঁ করিয়া এত টাকা কোথায় পাইল? তলে তলে বুঝি অনেক টাকা পুঁজি করিয়াছিল?
ভগ্নী। তা কি আর বলিতে হইবে? তালুকের খাজনা বছরে প্রায় ৫/৬ শত টাকা, তার মাহিনা ৫/৬ শত টাকা, এত টাকা কোথায় যায়? ইচ্ছামত খরচের জন্য একটি পয়সাও হাতে পাইতাম না। কেবল এক মুঠো ভাত ও একখানি বস্ত্ৰ।
ভ্রাতা। তাতে আর ভুল ‘কি? আমি ভাবিয়া দুঃখিত হইতাম, তোমার থাকিয়াও নাই। যাক, পৃথক হইয়া ভালই করিয়াছ, এখন দু’ পয়সা হাতে পাইবে।
ভগ্নী। ভাইজান, আমার বাড়ি-ঘরের বন্দোবস্ত করিয়া দিন। আমাকে স্থিতি না করিয়া আর বাড়ি ফিরিতে পারিতেছেন না। তারপর স্থিতি হইলে সংসার কিভাবে চলিবে, তাহারও ঠিকঠাক করিয়া দিতে হইবে।
ভ্রাতা। পৃথক হওয়ার পর হইতে তোমাদের ভাবনায় রাত্রিতে ঘুম হয় না। এখন দেখিতেছি বাড়িঘর যেন করিয়া দিলাম, এক-আধজন পুরুষ মানুষ না থাকিলে চলিবে কিরূপে? তালুকের খাজনাপত্র আদায় হেফাজত এসবও করিতে হইবে; উপায় কি? তালুক যখন পৃথক করিয়া লওয়া হইল, তখন নুরল তোমার দিকে একেবারেই ফিরিয়া চাহিবে না।
ভগ্নী একটু রাগভরে কহিলেন, “সে না দেখিলে কি আমার চলিবে না?”
ভগ্নী। যদি কথা রাখেন তবে বলি।
ভ্রাতা। তোমার কথা না রাখিলে চলিবে কেন?
ভগ্নী। আপনার খাদেম আলীকে আমি চাই; সালেহার পতি মানান মত হইবে।
ভ্রাতা মনে মনে হাতে স্বর্গ পাইলেন। তথাপি ভগিনীর নিকট একটু আদর জানাইয়া কহিলেন, “তার মাকে একবার জিজ্ঞাসা করিতে হইবে!”
ভগ্নী। আমি গত বৎসর আভাসে ভাবী সাহেবাকে একটু বলিয়াছিলাম, তিনি বলিলেন, “তোমাদের ছেলে তোমরা লইবে তাতে আপত্তি কি?”
ভ্রাতা। তিনি রাজী হইলে আর কথা নাই।
ভগ্নী। খাদেমকে পাইলে আমার সবদিক বজায় থাকিবে। সে সংসার, তালুক সব দেখিবে; আমিও কূল রক্ষা করিয়া মেয়ে বিবাহ দেওয়ার দায় হইতে খালাস পাইব।
ভ্রাতা আচ্ছা, তোমার ইচ্ছামতই কাজ হোক
আলতাফ হোসেন সাহেবের পূর্বকথিত পুত্রের নাম খাদেম আলী। খাদেম আলী দুইবার মাইনর পরীক্ষায় ফেল হইয়া অধ্যয়ন শেষ করিয়াছে। এক্ষণে সে নবীন যুবক, দেখিতে সুন্দর। কখন দুবেলা, কখন একবেলা, কখনও বা দুই একদিন পর বাড়িতে আহার করে তদ্ব্যতীত সে বাড়ির সহিত আর কোন সম্বন্ধ রাখে না। গ্রামের দুষ্ট যুবকদের সহিত তাহার ঘনিষ্ট সম্বন্ধ। পার্শ্ববর্তী হাটবাজার, শহর-বন্দরের কু-স্থানগুলি তাহার সুপরিচিত।
নগদ টাকা হাতে পাইয়া আলতাফ হোসেন সাহেব ২০/২৫ দিনের মধ্যে ভগ্নীর ঘরবাড়ি প্রস্তুত করিয়া দিলেন। মহানন্দে ভগ্নী নিজ বাটিতে আসিলেন। এখানে আসিয়া তিনি প্রস্তাবিত বিবাহ, কার্যে পরিণত করিতে ইচ্ছা করিলেন। অভিমান ও জিদের বশে নুরল এসলামকে উপেক্ষা করিয়াই বিবাহের বন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু নুরল এসলাম লোক পরম্পরায় যখন বিবাহের কথা শুনিলেন, তখন তাঁহার মহান হৃদয়ে দারুণ আঘাত লাগিল। তিনি বিমাতার ব্যবহারে দুঃখিত হইয়াও নূতন বাড়ি দর্শন উপলক্ষে তাঁহার বাড়িতে উপস্থিত হইলেন। বিমাতা তাঁহাকে খানিকটা গর্বের সহিত কহিলেন, “বাপু, পায়ে ঠেলিয়াছে, কুঁড়েঘর দেখিয়া কি করিবে?” নুরল এসলাম কহিলেন, “মা, উল্টা বলিতেছেন, তা বলুন, আমি একটা কথা বলিতে আসিয়াছি, শুনুন। “
বিমাতা। কি কথা?
নুরল। শুনিলাম, খাদেমকে নাকি আপনি ঘর-জামাই রাখিতেছেন?
বিমাতা। হ্যাঁ, তাহাই ত’ মনে করিয়াছি।
নুরল। আমার অমতে আপনি সালেহার বিবাহ দিতে পারেন না; তবে আপনি সুখ- স্বচ্ছন্দে থাকিবেন বলিয়া যখন পৃথক হইয়াছেন, তখন বিবাহে বাধা দিব না। তবে এ বিবাহ আমার মত নাই জানিবেন। বিবাহ দিলে সালেহাকে দোজখে ফেলা হইবে। কারণ, খাদেম মূর্খের মধ্যে গণ্য, বিশেষত তাহার চরিত্র মন্দ
বিমাতা। তা’ হইলেও বড় ঘরের ছেলে ত’? আর সালেহা আমার চোখের উপর থাকিবে। আমি ত’ বিবাহ দিবই।
নুরল বাক্যব্যয় নিস্ফল জানিয়া বাড়িতে ফিরিয়া আসিলেন।
সময়ান্তরে ভগ্নী ভাইকে কহিলেন যে, “উপস্থিত বিবাহ কার্যে নুরল এসলাম নিষেধ করিতে আসিয়াছিল।”
ভ্রাতা। তোমার সুখ-সুবিধা যাতে না হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত শয়তান যে কত চেষ্টা করে, তাহার সীমা নাই।
ভগ্নী। আমিও তাই মনে করিয়া তাহার কথা গ্রহ্য করি নাই।
যথাসময়ে যথাবিধি খাদেম আলীর সহিত সালেহা খাতুনের বিবাহ হইল।