একবিংশ পরিচ্ছেদ
আব্বাস আলী নামজাদা ধনীর একমাত্র আদরের পুত্র। দুষ্কার্য করিয়া এ পর্যন্ত কেবল অর্থ বলেই রক্ষা পাইয়াছে; কখনও ধরা পড়ে নাই। সে অদ্য থানার ঘরে বন্দী। তাহার হাতে আজ হাতকড়া। তাহার সহিত খাদেম আলী, করিম, দুর্গা তদবস্থায় আবদ্ধা।—একথা বন্দরময় রাষ্ট্র হইয়া পড়িয়াছে। আব্বাস আলীর পিতা রহমতুল্লা মিয়া প্রাতঃকালে আসিয়া দারোগা বাবুকে একশত টাকার নোট দিয়া সেলাম করিয়াছেন। উকিল সাহেবের বিদায়ের পর দারোগা বাবু রহমতুল্লা মিঞাকে কহিলেন, “বড়ই কঠিন ব্যাপার, স্বয়ং জেলার বড় ডেপুটি বাবু গ্রেপ্তারকারী। তাঁহার মত কড়া হাকিম এদেশে আর নাই।”
রহমতুল্লা। যত টাকা লাগে দিতেছি, আপনি আমার ছেলেকে রক্ষা করুন।
দারোগা। কোন উপায় দেখিতেছি না।
রহমতুল্লা। আপনি হাকিমকে যত টাকা লাগে দিয়া উপায় করুন।
দারোগা। বাপরে! তবে এখনই চাকুরিটা খোয়াইয়া জেলে যাইতে হইবে।
রহমতুল্লা মিঞা হতাশ হইয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।
দারোগা। আপনি নিজে যাইয়া তাঁহার পা ধরিয়া কবুল করাইতে পারেন কি না চেষ্টা করুন। তবে ২/৫ হাজার টাকার কথা মুখে আনিবেন না। অনেক উপরে উঠিতে হইবে।
রহমতুল্লা মিঞা তখন অসীম সাহসে ডাকবাংলায় উপস্থিত হইয়া ডেপুটি বাবুর নিকট নিজ পরিচয় দিলেন এবং পুত্রের রক্ষার জন্য তাঁহার পা ধরিয়া একেবারে দশ হাজার টাকা ঘুষের কথায় হাকিম প্রবরের মনে কিঞ্চিৎ ভাবান্তর উপস্থিত হইল, তথাপি তিনি মুখে ক্রোধ জানাইয়া কহিলেন, “তোমার এতদূর সাহস? আমার কাছে ঘুষের প্রস্তাব! তোমাকে জেলে দিব।” আব্বাস আলীর পিতা এগার হাজার স্বীকার করিলেন।
এবার ডেপুটি বাবু সদয়ভাবে কহিলেন, “এ ত’ আচ্ছা লোক দেখিতেছি।”
আব্বাস আলীর পিতা আরও এক হাজার স্বীকার করিলেন।
ডেপুটি। পা ছাড়ুন, উঠিয়া বসুন।
বলিয়া তিনি মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, লোকটাকে রক্ষা করা উচিত কি না? পরে রহমতুল্লাহ মিঞাকে কহিলেন, “যেভাবের চুরি, ইহাতে আপনার পুত্র চৌদ্দ বৎসর জেলের কাবেল।” তখন আরও হাজার টাকা স্বীকার করিয়া আব্বাসের পিতা পুনরায় ডেপুটি বাবুর পা জড়াইয়া ধরিলেন। তখন ডেপুটি বাবু তাঁহার হাত ধরিয়া তুলিয়া বসাইলেন। তাহার পর বড়ে দিয়া দাবা মারিয়া জিতিবার মানসে এক নতুন চাল চালিলেন। কহিলেন, “আপনি জেলার বড় উকিল মীর আমজাদ হোসেন সাহেবকে চিনেন?”
রহমতুল্লাহ। চিনি, তাঁর দ্বারা অনেকবার মোকদ্দমাও করাইয়াছি।
ডেপুটি। তিনি এক্ষণে রতনদিয়ায় তাঁহার বন্ধু নুরল এসলাম সাহেবের বাড়িতে আছেন। তিনি এই মোকদ্দমার সাক্ষী, আপনি তাঁহাকে বশ করিতে পারিলে আপনার ছেলের সম্বন্ধে বিবেচনা করা যাইতে পারে।
ডেপুটি বাবুর বিশ্বাস, এক যোগে বেশি টাকা উৎকোচ পাইলে মুসলমান উকিল তাঁহার দোস্তকে রাজী করাইয়া নিশ্চয় মোকদ্দমাও ছাড়িয়া দিবেন।
উকিল সাহেব রতনদিয়ায় আসিয়া নাশতা করিয়া সবেমাত্র বাহির বাড়িতে আসিয়াছেন, এমন সময় রহমতুল্লাহ মিঞা তথায় উপস্থিত হইলেন। উকিল সাহেব তাঁহাকে পূর্ব হইতে জানেন। এজন্য কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিয়া বসিতে বলিলেন। মিয়া সাহেব আদর পাইয়া আশ্বস্ত হইলেন। একটু পরে তিনি সসম্মানে উকিল সাহেবকে নির্জন উদ্যান-অন্তরালে লইয়া গিয়া ছেলের চুরিরকথা বলিয়া ক্রমে ৫ হাজার হইতে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত স্বীকার করিলেন। উকিল সাহেব লোকটা কত টাকা দিতে পারে শুধু এইটুকু জানিবার ইচ্ছায় অপেক্ষা করিতেছিলেন, যখন কুড়ি হাজার টাকা স্বীকার করিয়া মিঞা সাহেব তাঁহার পায়ের উপর পড়িয়া গেলেন, তখন তিনি সজোরে পা ছাড়াইয়া বৈঠকখানার দিকে চলিয়া আসিলেন। উকিল সাহেব অন্তঃপুর হইতে বাহিরে আসিবার কিছু কাল পরে নুরল এসলাম যষ্টিহস্তে বাহির বাড়িতে আসিয়া ঐ ঘটনা দেখিয়াছিলেন। উকিল সাহেব বৈঠকখানায় আসিয়া উপবেশন করিলে নুরল তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ব্যাপারখানা কি?”
উকিল। ব্যাপার চমৎকার।
নুরল। শুনিতে পাই না?
উকিল। শুনু, গতরাত্রিতে ভরাডুবার দুর্গানাম্নী এক বৈষ্ণবী, ঐ তালুকদারের পুত্র আরও কয়েকটি কুল-প্রদীপের সাহায্যে একটি ব্রত করিয়াছিলেন, কিন্তু ফল বিপরীত হওয়ায় ব্রতসাহায্যকারীর পিতা, ব্রতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর ক্রোধ শান্তির নিমিত্ত আমার নিকট কিছু দক্ষিণা লইয়া আসিয়াছিল।
নুরল এসলাম মনে করিলেন, বন্ধু উকিল মানুষ, তালুকদারের পুত্র ভয়ানক গুণ্ডা, বোধ হয় কোনো ফিয়ালসিনি মোকদ্দমায় পড়িয়া পুত্র রক্ষার্থে উৎকোচ দিতে আসিয়াছেন। তাই জিজ্ঞাসা করিলেন, “দক্ষিণা কত?”
উকিল। কুড়ি হাজার টাকা।
নুরল। গ্রহণ করিলে না?
উকিল। আমাকে তুমি এত ছোট মনে কর?
নুরল। কোন দেবীর ব্রত করিয়াছিলেন?
উকিল। আমার সই আনোয়ারা দেবীর।
নুরল এসলামের চক্ষু বড় হইয়া, উঠিল দম বন্ধ হইবার উপক্রম হইল।
উকিল। (সহাস্যে) ভয় নাই, দম ফেল। তোমার মনের খট্কা দূর করিতেছি!
এই বলিয়া উকিল সাহেব রাত্রির সমস্ত ঘটনা এবং ডেপুটি বাবুর মুখের জীবসঞ্চার ব্রতের কথা ও সঞ্জীবনী লতা তোলার কথা যাহা শুনিয়াছিলেন সমস্ত খুলিয়া বলিলেন। নুরল এসলাম দম ফেলিয়া আশ্বস্ত হইলেন। তিনি স্ত্রীর অভূতপূর্ব পতিপরায়ণতায় অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দ রসে আপ্লুত হইতে লাগিলেন। তিনি স্ত্রীর প্রতি কোন সন্দেহ না করিয়া যে সুখী হইলেন, ইহাতে উকিল সাহেবও পুলকিত হইলেন। এদিকে আব্বাসের পিতা পুনরায় ডেপুটি বাবুর নিকট গিয়া কাঁদিয়া পড়িলেন, কিন্তু কোন ফল হইল না।
উকিল সাহেব সোমবার প্রত্যুষে জেলায় রওয়ানা হইলেন, যাইবার সময় সঙ্গে আনীত হেবানামাখানি বন্ধুর হস্তে দিয়া কহিলেন, “দলিল প্রস্তুত করিয়াছিলাম বলিয়া ইহা তোমাকে দিয়া গেলাম, নচেৎ সতীমাহাত্ম্যের যে ফল দেখিতেছি তাহাতে আল্লাহর ফজলে উহার দরকার হইবে না।”
নুরল। দোস্ত, খোদাতা’লার অনুগ্রহে গতকল্য হইতে সত্যি আমার শরীর বেশ সুস্থ বোধ হইতেছে।
উকিল। সত্যই বলিতেছি, সই-এর মত স্ত্রী যার, তিনি অজয়, অমর।
নুরল এসলাম কহিলেন, “দানের বস্তু আর প্রতিগ্রহণ করিব না। আল্লাহ ভাল রাখিলে অবসর মত উহা রেজিস্টারী করিয়া দিব।”
উকিল সাহেব বিদায় গ্রহণ করিলেন। নুরল এসলাম দলিলখানি লইয়া স্ত্রীর হস্তে দিলেন।
অনন্তর আনোয়ারার ঐকান্তিক সেবা-শুশ্রূষায় নুরল এসলাম অল্প দিনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া উঠিলেন। পতির আরোগ্যলাভে সতীর মনে আনন্দ আর ধরে না। এজন্য সতী খোদাতায়ালার নিকট অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে লাগিল।
একদিন আনোয়ারা তাহার শয়ন ঘরের যাবতীয় শস্য ও বস্ত্রাদি দাসীকে রৌদ্রে দিতে আদেশ করিল। দাসী একে একে বালিশ, গদি, তোষক বস্ত্র প্রভৃতি রৌদ্রে দিল। আনোয়ারা সঞ্জীবনী-লতা তুলিবার পূর্ব-রাত্রিতে স্বামীকে যে চিরবিদায়-লিপি লিখিয়া তাহার উপাধান নিম্নে রাখিয়া দিয়াছিল, তাহার স্মরণ ছিল না। নুরল এসলামেরও ইতিপূর্বে তাহা হস্তগত হয় নাই। দাসী বালিশের নিচের সেই চিঠি প্রয়োজনীয় মনে করিয়া মনিবের একটি আচকানের পকেটে রাখিয়া দিল।