সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
দুই দিন পর, স্বামী-পরিচর্যা করিতে পারিবে না ভাবিয়া বালিকা কায়মনোবাক্যে তাঁহার সেবা করিতে লাগিল। পাঁচবার নামাজ শেষ করিয়া সঙ্কল্পসাফল্য নিমিত্ত খোদাতায়ালার কাছে পুনঃ পুনঃ মোনাজাত করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে শুক্রবার অতীত হইল। আজ শনিবার প্রাতঃকাল। আনোয়ারা পৌর্বাহ্নিক কর্তব্য সম্পন্ন করিয়া স্নানান্তে স্বামীর শয্যাপার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। ভিজা চুলে তাহার শুষ্ক বস্ত্র ভিজিয়া উঠিয়াছে দেখিয়া, নুরল ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, তুমি আমার সাক্ষাতে আজ কাঠের আলনায় চুলরাশি শুকাও। তোমার চুল শুকানোর জন্য সোনার আলনা তৈয়ার করিয়া দিব আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে তাহা ঘটিল না।”—বলিতে বলিতে নুরল এসলামের চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি উচ্ছ্বসিত শোকাবেগ প্রশমিত করিয়া পুনরায় কহিলেন, “আমি তোমাকে মুক্তকেশে দেখিতে ভালবাসি, আমার অন্তিম বাসনা পূর্ণ কর।” আনোয়ারা সসন্তোষ উত্তেজনায় কহিল, “আমি আর লজ্জা করিব না।” এই বলিয়া সে দক্ষিণ দরজার পার্শ্বে গিয়া মাথার কাপড় খুলিয়া ফেলিল এবং কাঠের আলনায় চুলগুলি ছড়াইয়া দিয়া শুকাইতে লাগিল। নুরল মুক্তকেশী সতীর পানে অনিমেষ তাকাইলেন। দৃষ্টিপাতমাত্র তাঁহার রোগজীর্ণ দেহে যেন তড়িৎ প্রবাহিত হইতে লাগিল। তিনি একাল পর্যন্ত স্ত্রীর এরূপ সতেজ ভাব, এরূপ পূর্ণ লাবন্যোদ্ভাসিত মূর্তি আর কখনও দেখেন নাই। সবিস্ময়ে ভাবাবেশে তিনি শয্যার উপর উঠিয়া বসিলেন। বসিয়া সতৃষ্ণনয়নে সতীর স্বর্গীয় তেজোদীপ্ত মূর্তি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আনোয়ারা চুল শুকাইয়া মুক্তকেশেই অনাবৃতমস্তকে পতিপাশে আসিয়া পুনরায় দাঁড়াইল। নুরল আবেগভরে হাত ধরিয়া তাহাকে নিকটে বসাইলেন। সতী প্রেমবিহ্বলচিত্তে পীড়িত পতির কোলে মস্তক স্থাপন করিয়া বলিয়া উঠিল, “হে আমার দয়াময় খোদা, আগামীকল্য হইতে তুমি আমার স্বামীকে রোগমুক্ত কর। আমি যেন তাঁহার কোলে এই ভাবে মস্তক রাখিয়া প্রাণত্যাগ করিতে পারি।” নুরল এসলাম কহিলেন, “প্রিয়ে ও কি বলিতেছে, তোমার হতভাগ্য পতি যে তোমাকে রাখিয়া অগ্রেই মৃত্যুপথের যাত্রী সাজিয়াছে। প্রাণাধিকে, অবধারিত মৃত্যুকে ভয় করি না কিন্তু শত আক্ষেপ, তোমাকে আশানুরূপ সুখী করিতে পারিলাম না। অপার্থিব প্রেমঋণে, স্বর্গীয় ভক্তিপাশে হতভাগ্যের হৃদয় বাঁধিয়াছ; কাবিনের স্বত্বত্যাগ, উপরন্ত অর্থ সাহায্য করিয়া এ-দীনের সংসার ঠিক রাখিয়াছ, ছয় মাস যাবত অনাহারে-অনিদ্রায় সেবাশুশ্রূষা করিয়া দুর্বিষহ রোগযন্ত্রণায় শান্তি দান করিয়াছ, কিন্তু হায় তাহার কণামাত্ৰ প্রতিদানও এই হতভাগ্যের দ্বারা হইল না।”—বলিতে বলিতে উচ্ছ্বসিত শোকাবেগে নুরল এসলামের বাকরোধ হইয়া গেল। তিনি অবলার ন্যায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। আনোয়ারা তাঁহার কোলে মাথা রাখিয়া প্রেমাশ্রুনেত্রে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়াছিল, সুতরাং নুরল এসলামের চোখের জল আনোয়ারার চোখের জলে মিশিয়া গেল। আনোয়ারা স্বাগত বলিয়া উঠিল, “দয়াময়, চোখের পানি যেমন চোখে মিশাইল, বৈষ্ণবীর লতার গুণে রোগের পরিণতি যেন এইরূপ হয়।” নুরল এসলাম শুনিয়া কহিলেন, প্রিয়ে, আবার ও-কি কহিতেছ?” আনোয়ারার চমক ভাঙ্গিল, সে সাবধান হইয়া কহিল, “ কৈ, কিছু না।” নুরল সে কথা আর ধরিলেন না; কহিলেন, “প্রিয়তমে, আমার আয়ুষ্কাল ত পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে; বাঁচিবার আশা নাই। আজ যে আমাকে এতখানি সুস্থ দেখিতেছ, ইহা নির্বাণোন্মুখ প্রদীপের উজ্জ্বলতা বলিয়া মনে করিবে। যাহা হউক, আমার অন্য শরীক নাই। ভূ-সম্পত্তির মূল্য ১০/১২ হাজার টাকা হইবে, তাহার অর্ধেক তোমাকে, অপরার্ধেক ৯ আনা তুল্যাংশে রশিদন ও মজিদনকে এবং ৯ আনা ফুফু আম্মাকে দিয়া গেলাম। বন্ধুবর উকিল সাহেবকে আমমোক্তার নিযুক্ত করিয়াছি; তিনি খুব সম্ভব অদ্য কি কল্য দানপত্ৰ লইয়া এখানে আসিবেন। দানপত্রের লিখিত সম্পত্তি তোমার ইচ্ছামত দান-বিক্রয় বা হস্তান্তর করিতে পারিবে।’
নুরল এসলামের অন্তিমবাণী শুনিয়াও আনোয়ারা বিচলিত হইল না বরং তাহার বিম্বাধারে হাসির তড়িৎ খেলিয়া গেল। তাহার শতদল-বিনিন্দিত বদনমণ্ডলে সৰ্গীয় আভা প্রদীপ্ত হইতে লাগিল। নুরল এসলাম স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিলেন, কিন্তু সতী প্রকৃতির মর্মাবধারণে অক্ষম হইয়া কিঞ্চিৎ বিমনা হইলেন।
পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে শনিবারের দিনের আলো নিভিয়া গেল। সতী মৃত্যুপথের যাত্রীরূপে প্রস্তুত হইতে লাগিল। সন্ধ্যার পূর্বেই সে স্বামীকে আহার করাইল। যথাসময়ে স্ফটিক- শামাদানে মোমের বাতি জ্বালাইল; মগরেবের নামাজ শেষ করিয়া রন্ধন-আঙ্গিনায় প্রবেশ করিল। তাহার হাবভাব স্ফুর্তি দেখিয়া ফুফু-আম্মা স্তম্ভিত হইলেন। বিষাদের প্রতিমূর্তি বউ বিবিকে আজ এরূপ উৎফুল্ল দেখিয়া সুশীলা দাসীও সুখী হইল।
আহারান্তে সকলেই ঘরে গেল। আনোয়ারা ঘরে আসিয়া একাগ্র চিত্তে এশার নামাজ পড়িল। নামাজ অন্তে কায়মনোবাক্যে সঙ্কল্প-সাফল্য হেতু শেষ মোনাজাত করিল। আরাধনা শেষে হৃদয়ের সমস্ত ভক্তি দিয়া পতির চরণে হাত বুলাইতে লাগিল। সতীর হস্তস্পর্শে নুরল এসলাম ক্রমে নিদ্রাভিভূত হইয়া পড়িলেন। আনোয়ারা ঘড়ির দিকে চাহিয়া দাখিল, রাত্রি ১ টা। আর এক ঘন্টা পরে রাত্রি দ্বিপ্রহর হইবে। তখন তাহাকে সঙ্কল্পসাধনের জন্য বহির্বাটিতে উপস্থিত হইতে হইবে। অসূর্যস্পর্শা বালিকা বধূর গাঢ় তিমিরাচ্ছন্ন গভীর নিশীথে একাকিনী বহির্বাটিতে গমন, ইহাও কি সম্ভব?
রাত্রি ১২টা। আনোয়ারা উৎকণ্ঠিতচিত্তে ঘর-বাহির যাতায়াত আরম্ভ করিল। এদিকে ভীমবৈরবী করাল-কৃষ্ণ-পাপীয়সী কালনিশীথিনী তাহার আগমন ভয়ে ভীত হইয়াই যেন যামঘোষ ঘোষণা ত্যাগ করিয়াছে; ঝিল্লীরব থামিয়া গিয়াছে, দ্বিজগণ শাখিশাখে নীরবে উপবিষ্ট, বায়ু গতিশূন্য বৃক্ষ-পত্ররাজি শব্দহীন। জীবকোলাহল-পূরিত প্রকৃতি একেবারে নীরব নিস্তব্ধ, যেন নিঃশ্বাসরোধে বিগতপ্রাণ। কেবল জাগাত যোগী প্রকৃতির ভয়-কাতর অন্তরোদ্ভূত শাঁশী শব্দমাত্রের অস্তিত্ব অনুভব করিয়া শঙ্কিত। এই ভীষণাদপি ভীষণ সূচিভেদ্য নিবিড় তমসাচ্ছন্ন নীরব নিশীথে পতির রোগমুক্তির কামনায় সতী গৃহ হইতে প্রাঙ্গনে আসিয়া দাঁড়াইল। ঠিক এমন সময় দুইটি ঢিল পর পর আসিয়া প্রাঙ্গনে পতিত হইল। সতী সঙ্কেত বুঝিয়া তাড়াতাড়ি বহির্বাটীর উদ্যান পার্শ্বে আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু হায়! পরক্ষণে গালপাট্টা-বান্ধা একজন যুবক পশ্চাদ্দিক্ হইতে আসিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিল। পরপুরুষ স্পর্শে সতীর দেহ কন্টকিত হইয়া উঠিল, তাহার সংজ্ঞা লুপ্ত হইয়া গেল।