দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
নুরল এসলামের বিবাহের পর দেখিতে দেখিতে চারটি বৎসর অতীতের পথে অনন্ত কালসাগরে মিশিয়া গিয়াছে। সময়ের এই ক্ষুদ্র অংশটুকুর মধ্যে পারিবারিক জীবনে তথা বিরাট বিশ্বপরিবারের ছোট বড় কত ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে, কে তাহার সংখ্যা করিবে।
নুরল এসলাম সতীনের ছেলে; উপার্জনক্ষম। জুট-কোম্পানির ম্যানেজার সাহেব তাঁহার কর্মদক্ষতায় ও স্বভাবগুণে ক্রমশ বেতন বৃদ্ধি করিয়া দিতেছেন। এখন তাহার বেতন ৮০ টাকা।
নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে নুরল এসলামের সহিত সাধিয়া বিবাহ দিতে যাইয়া প্ৰত্যাখ্যাত হইয়াছেন এই জন্য নুরল এসলামের বিমাতা আপনাকে যারপরনাই অপমানিত বোধ করিয়াছেন। পরন্তু নুরল এসলাম তাঁহার প্রস্তাব উপেক্ষা করিয়া হুরপরীর মত সুন্দরী স্বভাব- সুশীলা বিদূষী ভাষা গৃহে আনিয়াছেন—তাহার উপর যে ভার্যা সর্বগুণান্বিতা এবং গৃহস্থালির সর্ববিষয়ে পরিষ্কার পরিছন্নতায় ঘরবাহিরের সমস্ত কার্যের শৃঙ্খলা পারিপাট্য বিধানে ও অবিশ্রাম কর্মপ্রিয়তায় সে অল্পদিনেই প্রবীণা গৃহিণীর ন্যায় গৃহলক্ষ্মী হইয়া উঠিয়াছে। তাহার হাতের গুণে শাক-ভাতও অমৃতের মত বোধ হইতেছে।
এক রাত্রি আহারান্তে সালেহা তাহার মায়ের কাছে শুইয়া বলিতে লাগিল, “মা, আজ সকালে ভাবী যে মুড়িঘন্ট পাক করিয়াছিলেন, তাহার স্বাদ এখনও জিহ্বায় লাগিয়া রহিয়াছে। তিনি যে ডাইল পাক করেন, শুধু তাই দিয়া ভাত খাইয়া উঠা যায়।”
মা। (দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া) ও ভাল পাকে বিষ মাখান; তাহাতে আমাদের মরণ।
মেয়ে। সে কি মা! ৩/৪ বছর হইল খাইতেছি মরি ত’ না?
মা। অভাগীর বেটি তুই তা বুঝবি কি করিয়া
মেয়ে। বুঝাইয়া দেও না!
মা। বৌ-এর রূপে নুরল আজকাল ভেড়া বনিয়াছে। বৌ ঘরগৃস্থালী, চাকর-চাকরাণী সব আপনার করিয়া লইয়াছে। রকমে রকমে বুঝিতেছি, বৌ-ই সংসারের সব, নুরল এখন তালে তালে তারি আদেশ-উপদেশ মত সংসার চালায়। সে আর সংসারের জমা খরচ রাখে না, বৌ-এর হাতে সব ছাড়িয়া দিয়াছে। সেদিন রাত্রে জমাখরচ লিখিবার সময় নুরলকে বলিয়াছে কাপড় থাকিতে সকলকে জোড়ায় জোড়ায় কাপড় দিবার কি দরকার ছিল? তাহাতেই ত’ এ মাসে খরচ বাড়িয়া গিয়াছে। সকলের মানে তুই আর আমি।
মেয়ে। তুমি যতই বলনা কেন, ভাবী আমাদের অনিষ্ট করবেন না। তিনি আমাকে কত ভালবাসেন, আদর করেন, হাতে তুলে কত জিনিস খাইতে দেন, কত মিঠা কথা বলেন। তোমাকেও ত’ খুব ভক্তি করেন, আদরের সহিত কথা কন। সকলের কাপড়ের কথা বলিয়াছেন মিথ্যা কথা কি? তোমার আমার জোড়া-ধরা কাপড় ত’ ঘরেই তোলা রহিয়াছে।
মা। বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “তুই গোল্লায় যা, বুঝাইলাম কি, আর বুঝিলি কি।”
মেয়ে। কি বুঝাইলে?
মা। দুইদিন পরে আমাদিগকে বৌ-এর বাঁদী হইয়া সংসারে থাকিতে হইবে। একটু আগেই এক জোড়া কাপড় দিয়াছে, তাই তাহার পরানে সয় নাই। এমন ছোট লোকের মেয়ে কি আছে!
মেয়ে। না, ভাবী ছোটলোকের মেয়ে নয়। আমি শুনিয়াছি, ভাবীর বাপের বাড়িতে বড় বড় টিনের ঘর, পালে পালে গরু-ভেড়া, চাকর-বাকর বাড়ি ভরা।
মা। হাবা মেয়ে, বড় বড় টিনের ঘর থাকিলেই বুঝি বড় লোক হয়? ওর বাপ দাদা যে ভুঁইমালী ছিল, তার মা আবার চোরের মেয়ে।
মেয়ে। তুমি বল কি! তবে কি ভাবীর বাপ-দাদারা আমাদের ঝাড়ুদার বলাই মালীদের জাত? ওরা নাকি হিন্দু ছোটলোক। বলাইয়ের বৌ ত’ আমাদের ঘরে ঢুকিতেই সাহস পায় না।
নুরল এসলামের প্রপিতামহের আমল হইতে হিন্দু ভূঁইমালী তাহাদের উঠান পরিষ্কার করিত, ঘরের ডোয়া বাঁধিত, এজন্য মালার চারকান জমি ছিল। এক্ষণে বলাই মালী সেই কাজ করে।
মা বলিল, “হ্যাঁ, ওর বাপ-দাদারা আগে হিন্দু ভূঁইমালী ছিল, শেষে জাত যাইয়া মুসলমান হয় এবং ভূঁইয়া খেতাব পায়।”
মেয়ে। ভাবীর মা কি সত্যই চোরের মেয়ে?
মা। নয় ত’ কি?
মেয়ে। তুমি এত কিরূপে জান?
মা। তোমার মামুর মুখে শুনিয়াছি বৌ-এর বাপ-দাদার খবর; আর বৌ-এর বাপের বাড়ির বাঁদীর মুখে শুনিয়াছি তার মার পরিচয়।
সালেহার মামু ও আনোয়ারার বাঁদী যে ঐরূপ কথা বলিয়াছিল, তাহা সত্য। তাহাদের ঐরূপ বলিবার কারণ ছিল। সালেহার মামু নুরল এসলামের সহিত কন্যা বিবাহ দিতে যাইয়া প্রত্যাখ্যাত হন এবং আনোয়ারার দাসীকে আনোয়ারার বিমাতা গোলাপজান জ্বালাতন করিত
মেয়ে। শুনিয়া ঘেন্নায় পরাণ যায়। এতদিনে বুঝিলাম ভাবী আমাকে এত আদর করে কেন। আর তোমাকেই বা ভক্তি করে কেন। আমার মনে হয়, ভাইজান কেবল মাথার চুল ও রূপ দেখিয়া এমন ঘরে বিবাহ করিয়াছেন। আমি কাল হইতে বৌ-এর কাছে এক বিছানায় বসিব না, তাহাকে মালীর মেয়ে ডাকিব।
মা। তুই যে আমার কথা বুঝিতে পারিয়াছিস, এ-ও ভাগ্গির কথা।