ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বিবাহের পর ছয় মাস এইরূপে কাটিল। এ কয় মাস খাদেমের স্বভাব প্রকাশ পায় নাই, পরে পুরাতন স্বভাব আবার দেখা দিল।
অনন্তর খাদেম আলীর বিলাসপূর্ণ বেলগাঁও যাতায়াত আরম্ভ করিয়া স্বীয় দুশ্চরিত্রের পরিচয় দিতে লাগিল। টাকার অভাব হইল না শাশুড়ীর তালুকের খাজনা, বাজে খাজনাও জোর-জুলুম করিয়া সে যাহা আদায় করিত, তাহার হিসাব-নিকাশ তাহার শাশুড়ীকে বড় দিত না। অধিকাংশ টাকা ইন্দ্রিয়সেবা ও বিলাস-ব্যসনে ব্যয় করিতে লাগিল। শাশুড়ী মনে করিয়াছিলেন—ক্ষুদ্র সংসার, তালুকের খাজনা-পত্রে সুখে-স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইবে; কিন্তু জামাতার গুণে তাহা চলিল না। অল্পদিন মধ্যেই ভগ্নী ভ্রাতাকে সংসার অচল হওয়ার কথা জানাইলেন। ভ্রাতা আসিয়া পুত্রকে শাসন করিলেন; কিন্তু বাৎসল্যপ্রযুক্ত তাহার সর্বনিবাশী চরিত্র-দোষের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া ধীরে ধীরে ভগ্নীকে কহিলেন “আমি তোমার খুব স্বচ্ছলভাবে দিনপাতের নিমিত্ত এক বুদ্ধি স্থির করিয়াছি।” ভগিনী শুনিয়া আশ্বস্থচিত্তে কহিলেন, “কি বুদ্ধি করিয়াছেন, ভাইজান।
ভ্রাতা। ঘর-বাড়ি প্রস্তুত ও ছেলেমেয়ের বিবাহ-খরচ বাদ তোমার হাতে এখন কত টাকা আছে?
ভগ্নী। শতখানেক পরিমাণ টাকা হইবে।
ভ্রাতা। তাছাড়া, তোমার নিজ তহবিল কিছু নাই কি?
ভগ্নি। অনেক দুঃখ-কষ্ট করিয়া হাজার খানেক টাকা রাখিয়াছিলাম।
ভ্রাতা। তুমি ঐ টাকা হইতে সাতশত টাকা আমার হাতে দাও। বেলগাঁও নূতন উন্নতশীল বন্দর হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু জুতার দোকান একটিও নাই, বড়ই সুযোগ। কলিকাতায় আমার দোস্ত মোহাম্মদ সাহেব বড় দোকানদার। ঐ টাকা দিয়া এবং দোস্তের নিকট হইতে বাকি করিয়া আনিয়া, হাজার বারশত টাকার একটি জুতার দোকান খুলিয়া দেই। খাদেম আমার দুইবার ইংরেজি পরীক্ষা দিয়াছে। সে চাকর-বাকর রাখিয়া স্বচ্ছন্দে দোকান চালাইতে পারিবে।
ভগিনী শুনিয়া কিছু মলিন মুখে কহিলেন, “ভাল মানুষের ছেলের জুতা বিক্রি করা কি অপমানের কথা নয়?”
ভ্রাতা। কলিকাতায় যে সকল বড় লোকেরা জুতার দোকান চালায়, তাহাদের কাছে আমরা মানুষই নই।
ভগ্নী। নুরল এসলাম যে ঠাট্টা করিবে?
ভ্রাতা। তাহার গোলামীর অপেক্ষা এ কার্য ভাল।
ভগ্নী। ইহাতে কত লাভ হইবে?
ভ্রাতা। তোমার সাতশত টাকা মজুতই থাকিবে। তাহা হইতে মাসে মাজে ৭০/৮০ টাকা লাভ দাঁড়াইবে। দোকান ক্রমে বড় হইলে আরও বেশি লাভ হইবে। ফল কথা, সাহেবের গোলামী করিয়া নুরল এসলাম যাহা রোজগার করে, এ কার্যে তাহার অপেক্ষা বেশি লাভ হইবে। লাভের টাকাতেই তোমাদের খুব স্বচ্ছন্দে সংসার চলিয়া যাইবে, সঙ্গে সঙ্গে তালুকের টাকা তুমি সিন্দুকে তুলিতে পারিবে।
সতীনের ছেলের চাইতে জামাতা বেশি উপার্জন করিবে শুনিয়া ভগিনী ভ্রাতার হাতে তখনই সাতশত টাকা গণিয়া দিলেন।
আলতাফ হোসেন সাহেবের বৈষয়িক বুদ্ধি মন্দ ছিল না; কিন্তু চরিত্রহীন পুত্রের দোষে যে সমূলে ব্যবসায়ে হানি হইবে, তাহা তিনি ভাবিয়া দেখিলেন না।
আড়ম্বর সহকারে বেলগাঁও বন্দরে জুতার দোকান খোলা হইল। খাদেম আলী দোকানে সর্বেসর্বা হইল। ক্রয়-বিক্রয় প্রথম প্রথম খুবই চলিতে লাগিল। খাদেম গেরদায় ঠেস দিয়া, আলবোলার রজত-নল মুখে ধরিয়া দোকানে বসিল। বিনামা-বিক্রিত নগদ মুদ্রা ঝনাৎ-ঝন – ঝনাৎ শব্দে তাহার সম্মুখে আসিতে লাগিল। ইন্দ্রিয়পরায়ণ নবীন যুবকের বিকৃত মস্তিষ্ক রৌপ্য-চাক্তির চাচিক্যে একেবারে বিগ্রাইয়া গেল। সে অধিকতর পাপাচারী হইয়া উঠিল।