» » ভক্তি-পর্ব

বর্ণাকার

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

ইতিমধ্যে একদিন দুর্গা পুনরায় ভিক্ষাচ্ছলে নুরল এসলামের বাড়িতে আসিল। দাসী তাহাকে ভিক্ষা আনিয়া দিল। আনোয়ারাকে না দেখিয়া দুর্গা দাসীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমাদের বৌঠাকুরাণীকে ত’ দেখি না?” দাসী কহিল, “দেওয়ান সাহেব পীড়িত হওয়ার পর তিনি সর্বদা তাহার নিকটে থাকেন।”

দুর্গা। দেওয়ান সাহেবের কি ব্যারাম?

দাসী। জ্বর, কাশ ও গলার আওয়াজ বসা।

দুর্গা। কে চিকিৎসা করেন?

দাসী। বন্দরের বড় ডাক্তার।

দুর্গা কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিল, তারপর চলিয়া গেল। এই সময়ে আনোয়ারা শয়নঘরে স্বামীকে নিজ হাতে তুলিয়া পথ্য সেবন করাইতেছিল।

দুর্গা পথে যাইতে যাইতে চিন্তা করিতে লাগিল, একবার কথাবার্তা ধরাইতে পারিলে বুঝিতে পারিতাম, আমার যাদুর শিকারের গতি কোন দিকে। তা’ নির্জনে রহস্যালাপই যে কঠিন ব্যাপার দেখিতেছি।

কয়েকদিন পর আব্বাস আলী মাসীর সহিত দেখা করিল ও কহিল, “মাসী, আর যে সহে না!”

মাসী। যাদু, সবুরে মেওয়া ফলে; ভাগ্য তোমার অনুকূল বলিয়াই বোধ হইতেছে। আব্বাস। কেমন করিয়া বুঝিতেছ?

মাসী। দেওয়ান সাহেবের কঠিন ব্যারাম, অবস্থা এখন-তখন

আব্বাস। আমিও ত’ বেলগাঁও রতীশবাবুর কেরানীর নিকট শুনিলাম, তাঁহাকে ক্ষয়কাশে ধরিয়াছে, বড় ডাক্তার বলিয়াছেন, বাঁচা কঠিন।

মাসী। আমিও দেখিয়াছি ক্ষয়কাশের রোগী প্রায়ই বাঁচে না।

আব্বাস। মাসী, তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক, তাহা হইলে চারিমাস দশ দিন আর যাইতে দিব না, শাদী করিয়া সাধ পুরাইব।

মাসী। ঘন ঘন শিকারের সন্ধানে ঘুরিলে লোকে সন্দেহ করিতে পারে; এ নিমিত্ত দুই তিন সপ্তাহ আর আমি রতনদিয়ায় যাইতেছি না। তুমি বেলগাঁও যাইয়া তাহার অবস্থার খবর লইও।

আব্বাস। তাই বলিয়া তুমি নিশ্চিন্ত থাকিও না।

মাসী। তোমার কার্য হাসিলের জন্য আমার রাত্রিতে ঘুম হয় না; নিশ্চিন্ত থাকা দূরের কথা।

এদিকে উকিল সাহেব বাসায় যাইয়া, অতি প্রত্যুষে টাউনের বড় কবিরাজ বিষ্ণুপদ কবিভূষণ তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং বন্ধু নুরল এসলামের পীড়ার অবস্থা জানাইয়া তাঁহাকে রতনদিয়ায় যাইতে অনুরোধ করিলেন। কবিরাজ মহাশয় খ্যাতনামা গঙ্গাধর কবিরাজের ছাত্র। এ নিমিত্ত শহরে তাঁহার নাম ডাক খুব বেশি, হাতযশও মন্দ নয়। তিনি উকিল সাহেবকে কহিলেন, “আমি মফঃস্বলে বড় যাই না, বিশেষত আমার তিলমাত্র অবসর নাই।”

উকিল সাহেব কহিলেন, “তবে কি আমরা গরিব মানুষ আপনার অনুগ্রহ লাভে বঞ্চিত হইব?” কবিরাজ মহাশয় উকিল সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, তবে আপনার অনুরোধে স্বীকৃত হইলাম। আমার ভিজিটের কথা বোধহয় আপনি জানেন? মফঃস্বলে দৈনিক ৫ টাকা।

উ। রোগী গরিব, টাকা আমাকে দিতে হইবে। অনুগ্রহপূর্বক দৈনিক ৩ টাকা করিয়া স্বীকার করুন, কৃতজ্ঞ থাকিব।

কবি। পাল্কীভাড়া ও ঔষধের দাম পৃথক লাগিবে—অবশ্য জানেন।

উ। আমার ৮ বেয়ারার পাল্কী আছে, তাহাতেই যাতায়াত করিবেন।

কবিরাজ মহাশয় মুখখানি একটু ছোট করিলেন; কারণ পাল্কীভাড়া দ্বিগুণ চার্জ করিয়া অর্ধেক টাকায় কাজ সারিতেন, তাহা হইল না। উকিল সাহেব ৫০ টাকার একখানি নোট কবিরাজ মহাশয়ের হাতে দিয়া কহিলেন, “এখনই পাল্কী পাঠাইতেছি, আপনি এই বেলাতেই যাইয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিবেন। অবস্থা বুঝিয়া দুই একদিন থাকিতে হইলেও থাকিয়া আসিবেন।” কবিরাজ মহাশয় সম্মত হইলেন।

কবিরাজী মতে চিকিৎসা আরম্ভ হইল। নুরল এসলাম প্রথমত অনেকটা সুস্থ হইলেন। তাঁহার জ্বর ও স্বরভঙ্গ কমিয়া আসিল, কাশির সঙ্গে পুঁজ-রক্ত উঠা বন্ধ হইল। তিনি ক্রমে শয্যায় উঠিয়া বসিলেন, যষ্টিভরে ক্রমে ক্রমে ২/১ পা করিয়া হাঁটিতে লাগিলেন। তুষার- শৈত্য-সঙ্কুচিতা নলিনী যেমন তরুণ-অরুণ-আভা বক্ষে লইয়া হাসিতে হাসিতে ফুটিয়া উঠে, পতির আরোগ্য লক্ষণ দৃষ্টে আনোয়ারাও সেইরূপ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। একদিন নুরল এসলাম স্ত্রীকে কহিলেন, “অনেকদিন হয় গোসল করি নাই, নামাজও কাজা হইতেছে; আজ আমাকে গোসল করাও, প্রাণ ভরিয়া নামাজ পড়িব।

স্ত্রী। কবিরাজকে না জিজ্ঞাসা করিয়া গোসল করিবেন?

নুরল। কবিরাজ ত বলিয়াছেন গরম জলে স্নান করিতে পারেন।

আনোয়ারা পানি গরম করিয়া নিজ হাতে স্বামীকে গোসল করাইল। পুষ্টিকর লঘুপাক খাদ্যাদি নিজ হাতে প্রস্তুত করিয়া তাঁহাকে তৃপ্তির সহিত ভোজন করাইল। প্রথম বেলা একরূপ কাটিল; কিন্তু, হায়! অপরাহ্ণে নুরল এসলামের গা গরম হইয়া উঠিল, রাত্রিতে কাশি বৃদ্ধি পাইল। তিনি পুনরায় পূর্ববৎ কাতর হইয়া পড়িলেন। পুনরায় কবিরাজ আসিলেন, ঔষধ চলিতে লাগিল; কিন্তু প্রথমবারের ন্যায় সত্বর আর ফল হইল না। নুরল এসলাম চিররোগা হইয়া পড়িলেন। প্রিয় সুহৃদ উকিল সাহেব মাঝে মাঝে আসিয়া দেখিয়া যাইতে লাগিলেন। আনোয়ারার ধৈর্য ও পতিব্রতা যেন নারীজাতির শিক্ষার জন্য ক্রমশ স্ফূর্তিলাভ করিতে লাগিল।

আনোয়ারা স্বামীর পীড়ার আরম্ভকাল হইতেই, নামাজ অন্তে তাঁহার আরোগ্য-কামনায় মাথা কুটিয়া মোনাজাত করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। মোনাজাতের সময় তাহার বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া যাইত। খোদাতালার নিকট মোনাজাত করিতে লাগিল। প্রত্যহ এশার নামাজ বাদ হাত তুলিয়া বলিত, “হে দয়াময়! তোমার পবিত্র নামে আরম্ভ করিতেছি। সমস্ত প্রশংসা তোমার। হে সর্বশক্তিমান খোদা! তুমি আঠার হাজার আলমের মালিক। তুমি মানুষের নিকট নিরানব্বই নামে প্রকাশিত। হে দয়াময়! দাসীকে বলিয়াকে দাও, কোন নামে ডাকিলে তুমি তুষ্ট হইবে? কোন্ নামে ডাকিলে তুমি দাসীর স্বামীকে আরোগ্য করিবে? নাথ! আমি জ্ঞানহীন মূঢ়মতি বালিকা, আজ তোমাকে তোমার প্রকাশিত সমুদয় নাম ধরিয়াই ডাকিতেছি।” এইরূপ কাতরতা প্রকাশ করিয়া বালিকা খোদাতালার নিরানব্বই নাম ধরিয়া প্রার্থনা করিত। ভক্তি-জনিত অশ্রুধারায় তাহার দেহবস্ত্র সিক্ত হইয়া যাইত। বালিকা শেষে বলিত “প্রভো! আঁধারে থাকিয়া ডাকিতেছি বলিয়া কি দাসীর প্রার্থনা শুনিবে না? হে রহিম-রহমান! তুমি বুঝিতেছ—দেখিতেছ, তবে কোন্ প্রার্থনা শুনিবে? দয়াময়! দাসীর হৃদয়ের ভাব বুঝিয়া যদি পতি-সেবার অধিকার দিয়াছ, তবে এত সত্ত্বর তাহা হইতে বঞ্চিত করিও না। তাঁহার চরণ সেবায় দাসীর নারীজন্ম ধন্য হইতে দাও।”

আনোয়ারা কায়মনোবাক্যে এইরূপ প্রার্থনা শেষ করিয়া স্বামীর চরণে হাত বুলাইত। বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক বিশ্বাস না করিলেও আমরা জানি, বালিকা যেদিন এইরূপ বিশেষভাবে মাথা কুটিয়া পতির আরোগ্য-কামনায় প্রার্থনা করিত, সেদিন, নুরল এসলামের সুনিদ্রা হইত এবং পরদিন তিনি আপনাকে অনেকটা সুস্থ বোধ করিতেন।