» » ভক্তি-পর্ব

বর্ণাকার

বিংশ পরিচ্ছেদ

উকিল সাহেব বেলগাঁও উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, থানার আঙ্গিনায় ও আশেপাশে চৌকিদার গিগিজ করিতেছে। থানার দারোগা কামদেব বাবুর উৎকোচপ্রিয়তার ও অর্থলোভে চৌকিদারগণ সময়মত পুরাহালে অনেক দিন যাবৎ মাহিনা পায় না, তাই তাহারা ধর্মঘট করিয়া গোল বাঁধাইয়া তুলিয়াছে। জেলার সিনিয়ার ডেপুটি সেই গোলযোগ নিষ্পত্তির জন্য বেলগাঁও আসিয়াছেন।

শনিবার কোর্টের কার্য শেষ করিয়া বাসায় আসিবার সময় পথে উকিল সাহেবের সহিত ডেপুটি বাবুর দেখা। কথা প্রসঙ্গে ডেপুটি বাবু বলেন, “আগামী কল্য আমাকে বেলগাঁও যাইতে হইবে।” উকিল সাহেব বলেন, “আমিও তাহার সন্নিকটে রতনদিয়া গ্রামে আমার বন্ধুকে দেখিতে যাইব।” ডেপুটি বাবু শুনিয়া কহিলেন, “অসম্ভব গরম পড়িয়াছে, দিনে পথচলা কঠিন। সুতরাং অদ্য রাত্রিতে একসঙ্গে যাওয়া যাক।” উকিল সাহেব কহিলেন, “তাহাই হোক।” পরে উভয়ে রাত্রিতে আহারান্তে একসঙ্গে গমন করিলেন। তারপর পথিমধ্যে যেরূপ ভাবে দস্যুদিগকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে, তাহা পূর্ব পরিচ্ছেদে বিবৃত হইয়াছে।

ডেপুটি বাবু ডাকবাংলায় অবস্থিতি করিতেন। উকিল সাহেবের পাল্কী তথায় উপস্থিত হইলে, ডেপুটি বাবু তাঁহাকে সাদরে সম্ভাষণপূর্বক ঘরে লইয়া গেলেন। এই সময় ঘরের ভিতর একটি রমণী ও একটি নবীন যুবক উপস্থিত ছিল। উকিল সাহেব আসন গ্রহণ করিলে ডেপুটি বাবু আগ্রহ সহকারে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার বন্ধুপত্নী কেমন আছেন?”

উকিল। অনেকটা সুস্থ হইয়াছেন।

ডেপুটি। তাঁহার পতিপরায়ণতায় শত ধন্যবাদ। এই যে স্ত্রীলোকটি দেখিতেছেন, এইটি বদমাইশ দলের গোড়া। ইহার নাম দুর্গা। আর যুবকের নাম গণেশ। ইহারা নানাবিধ প্রলোভন ও কৌশলে বশীভূত করিয়া সতী হরণের চক্রান্ত করিয়াছি। ইহাদের মুখে যাহা শুনিলাম তাহা যদি সত্য হয়, তবে আপনার বন্ধুপত্নীর মত সাধ্বী সতী জগতে বিরল বলিতে হইবে। পতির প্রাণরক্ষার জন্য সরল বিশ্বাসে, সরল প্রাণে এইরূপ ভাবে প্রাণদানে উদ্যতা কোন রমণীর কথা এ পর্যন্ত শুনি নাই; এমন কি কোন পুরাতন ইতিহাসে আছে কি না তাহাও জানি না।

এই বলিয়া তিনি উকিল সাহেবের নিকট দুর্গার কথিত জীবন-সঞ্চার ব্রতের কথা ও সঞ্জীবনী লতার কথা সবিস্তারে বলিলেন। উকিল সাহেব কহিলেন, “আমার বন্ধুপত্নী যে সতীকুলে কোহিনূর হইবেন, তাহা আমি তাঁহার বিবাহের পূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম; কিন্তু এই বৈষ্ণবীর শয়তানী কাণ্ডের কথা শুনিয়া অবাক হইতেছি। এমন ভাবে স্বাধী-সতী কুলবধূকে ঘরের বাহির করিবার এমন অদ্ভুত পন্থার কথা জীবনে কদাচ শুনি নাই।”

ডেপুটি। ইহাদের কঠিন ভাবে শাস্তি দিতে হইবে।

উকিল। আমি আপনার নিকট সর্বান্তঃকরণে তাহাই প্রার্থনা করিতেছি।

ডেপুটি। আপনি যে অপহরণ বৃত্তান্ত গোপন রাখার অনুরোধ করিয়াছেন; আমি তৎসম্বন্ধে এই সমস্ত কথা বিবেচনা করিতেছি

প্রথমতঃ আসামীদিগকে কঠিন শাস্তি দিতে গেলে, মোকদ্দমা দায়রায় সোপর্দ করিতে হইবে; সুতরাং তথায় তৎসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রকাশিত হইয়া পড়িবে।

দ্বিতীয়তঃ আপনার বন্ধুর ঘরজামাই ভগ্নিপতি খাদেম আলী এই অপহরণের পদ প্রদর্শক আসামী। সুতরাং অগ্রে এ কথা আপনার বন্ধুর বাড়ি হইতে সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িবে।

উকিল সাহেব খাদেম আলীর নাম শুনিয়া লজ্জিত ও মর্মাহত হইলেন। সড়কের উপর সে যখন ধরা পড়ে, তখন উকিল সাহেব তাহাকে চিনিতে পারেন নাই।

তৃতীয়তঃ আমি বুঝিতেছি, এই চুরি প্রকাশিত হইলে শুভ ব্যতিত অশুভ হইবে না। কারণ, সীতা-হরণে যেমন যুগ-যুগান্তরাবধি তাঁহার সতীত্ব-মাহাত্ম্য জগতে বিঘোষিত হইতেছে, পরন্তু তাহাতে সূর্যবংশের গৌরবই বর্ধিত হইয়াছে; এ চুরিতেও অবশ্য তদ্রূপ ফল ফলিবে।

উকিল। এস্থলে রাম-পক্ষ হইতে না হইলেও সীতার দিক হইতে বনবাস ঘটিতে পারে। কারণ যে স্বামীর প্রাণরক্ষায় অসঙ্কোচে নিজ প্রাণ বিসর্জনে উদ্যতা, সে যে তাহার স্বামীর লোকাপবাদ দূরীকরণের জন্য স্বেচ্ছায় স্বামীসংসর্গ ত্যাগ করিবে ইহাতে বিচিত্র কি?

ডেপুটি। এমন সতী, স্বামীকে ত্যাগ করিতে পারে না।

উকিল সাহেব কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আপনি জ্ঞানী, বহুদর্শী বিচারপতি। যাহা ভাল বোধ করিবেন তাহাই শিরোধার্য।”

ডেপুটি। ইহাদিগকে এই বেলাতেই জেলায় চালান দিব। মোকদ্দমা গভর্নমেন্টবাদী হইয়া চলিবে।

তারপর হাসিয়া কহিলেন, “আপনাকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে হইবে।”

উকিল। আপনি ত’ মূর্তিমান গভর্নমেন্ট। এই পবিত্রাসনে আপনাকেই আগে পা দিতে হইবে।

ডেপুটি। (স্মিতমুখে) তাহা ত’ বুঝিতেছি। এই গণেশ বেটাকে সাক্ষী শ্রেণীভুক্ত করিয়া লইতে হইবে।

উকিল। আমিও তাহাই মনে করিয়াছি। একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছি, বদমাইশদিগের প্রতি আপনার সন্দেহ হইয়াছিল কিরূপে?

ডেপুটি। সে এক হাসির কাণ্ডকারখানা; মোটকথা এই গণেশ ও আব্বাসের কথার অনৈক্য হওয়াতে আমার সন্দেহ হয়।

“তবে এখন আসি” বলিয়া উকিল সাহেব বিদায় গ্রহণ করিলেন।