» » ভক্তি-পর্ব

বর্ণাকার

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পরদিন রবিবার। আজ নুরল এসলামের অফিস হইতে বাড়ি আসিবার দিন। ইংরেজ বণিকেরা রবিবারে অফিস বন্ধ না রাখিলেও সেদিন তাঁহাদের বৈষয়িক কার্যাদি কম হয়। ম্যানেজারের প্রিয়পাত্র নুরল এসলাম এ-নিমিত্ত শনিবার বৈকালে বাড়ি আসিয়া থাকেন, সোমবার অপরাহ্ণে অফিস হাজির হন।

আনোয়ারা রোজ প্রাতে কোরান শরীফ পাঠ করে। আজ পড়িতে পড়িতে একটু বেলা হইয়াছে। সালেহা তাহার ঘরের কাছে গিয়া কহিল, “আজ যে মালীর মেয়ে কোরান পড়া এখন শেষ হ’লো না? রোজই ভাতের বেলা হয়, আমি যে খিদেয় মরি, তা কে দেখে?” একথা নুরল এসলামের ফুফু-আম্মার কানে গেল।

ফুফু-আম্মার নাম পূর্বেও দুই তিনবার করা হইয়াছে; কিন্তু তাঁহার বিশেষ কোন পরিচয় বলা হয় নাই। তিনি নুরল এসলামের পিতার চাচাতো ভাগিনী; পৌঢ় বয়সে বিধবা হইয়া একটি পুত্র ও একটি কন্যাসহ অনন্যোপায়ে নুরল এসলামের পিতার আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইহার ন্যায় ধার্মিক স্ত্রীলোক কম দেখা যায়। ইনি বারো মাস রোজা রাখেন এবং সর্বদা তী পাঠে রত থাকেন। ইনি নুরল এসলামের পিতার কনিষ্ঠ ছিলেন; কিন্তু ইঁহার স্বভাব ও ধর্মশীলতা দেখিয়া, নুরল এসলামের পিতা ইঁহাকে সহোদরা জ্যেষ্ঠা ভগিনী অপেক্ষা অধিক ভক্তি ও যত্ন করিতেন। নুরল এসলামের পিতার মৃত্যুর অল্প দিন পরেই ক্রমে ফুফু-আম্মার পুত্রকন্যাদ্বয় কাল কবলে পতিত হয়। এক্ষণে নুরল এসলামই তাঁহার পুত্র-কন্যা। নুরল এসলামের গৃহস্থালীই তাঁহার নিজের গৃহস্থালী। অতঃপর আমরা তাঁহাকে কেবল ফুফু-আম্মা বলিয়া ডাকিব।

ফুফু-আম্মা সালেহার কথা শুনিয়া কহিলেন, “তুই ও কি কথা বলিলি? তোর কি আদব আক্কেল কিছুই নাই? হইলই যেমন সৎ-ভাইয়ের বৌ; সম্বন্ধে তাহার বাপ-মা যে তোর তা- ঐ মা-ঐ হন। আনোয়ারা সালেহার কথায় ভাবিল, “আমি রোজই বাগানের ফুল দিয়া তার খোঁপা বাঁধিয়া দিই, ছেলেমানুষ তাই না বুঝিয়া ঐভাবে বুঝি ঠাট্টা করিয়াছে।” কিন্তু সালেহার মা ননদের কথায় গর্জিয়া উঠিয়া কহিলেন, “ছুঁড়িটা রোজই খিদেয় কষ্ট পায়, তাই সকাল সকাল বৌকে পাক করিতে বলিতে গিয়াছে, তাতে তুমি আদব-আক্কেল তুল্লে? আদব- আক্কেল কাকে বলে তা কি তোমরা জান?”

ফুফু। আমরা জানি না বটে; কিন্তু আপনার মেয়ের যে তা’ আছে— দেখা গেল।

সালেহা। আপনি আর বড়াই করিবেন না, আপনার ভাই-পুত যে মালীর ঘরে বিয়ে করিয়াছে, তা বুঝি আমি জানি না?

ফুফু। ও মা, সে কি কথা!

সালেহা। ভাবীর বাপ-দাদারা ভূঁইমালী ছিল, শেষে জাত যেয়ে মুসলমান হয়ে ভূঞা হয়েছে; তার মা আবার চোরের মেয়ে; এসব কথা আর চাপা দিলে চলিবে না। আমি সব শুনিয়াছি। ছি, ছি! এমন বৌ ঘরে আনিয়া আবার বড়াই?

ফুফু-আম্মা ত’ শুনিয়া অবাক। আনোয়ারা আকাশ পাতাল ভাবিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল। কথিত আছে—পৃথিবী সর্বংসহা হইলেও সূঁচের ঘা সহ্য করিতে পারে না; আর স্ত্রীলোক পরম ধৈর্যশীলা হইলেও পিতা-মাতার অযথা নিন্দাবাদ সহিতে পারে না। সালেহার কথায় আনোয়ারার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গেল, সে উচ্চবাচ্য না করিয়া সারাদিন অনাহারে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাটাইল।

অপরাহ্ণ ৪টায় নুরল এসলাম বাড়ি আসিলেন। তাঁহার আগমনে আজ কেহই আনন্দিত নহে। ফুফু-আম্মা তাঁহাকে স্নেহ-সম্ভাষণ করিলেন না। বিমাতার মুখ বিষাদ-বিষে পূর্ণ। সরলা সালেহাও উৎফুল্লা নহে। নুরল এসলাম কাপড় ছাড়িতে ঘরে প্রবেশ করিলেন; কিন্তু হায়, গৃহে প্রবেশ মাত্র যে জন ভক্তির সহিত তাঁহার পদচুম্বন করিয়া নিজ হাতে গায়ের পোশাক খুলিয়া লয়, সে নিকটে আসিল বটে। কিন্তু তাহার চাঁদপানা মুখ আজ বিষাদ-মেঘে আবৃত, তাহার প্রেমময় সাদর-সম্ভাষণ নীরব; নুরল এসলাম ব্যাকুলভাবে কহিলেন “তোমার মুখ ত’ কখনও এরূপ মলিন দেখি নাই, কারণ কি?” আনোয়ারা ভগ্ন হৃদয়ের অদম্য দুঃখ চাপা দিয়া কহিল, “অসুখ করিয়াছে।” নুরল এসলাম তাহা বিশ্বাস করিলেন না।

বিবাহের কিছুদিন পর হইতে নুরল এসলামের বিমাতা, তাঁহার স্ত্রীকে নানা প্রকার অকথ্য, অশ্রাব্য কথায় জ্বালাতন করিতেছেন, ছল-ছুতায় ছোটলোকের মেয়ে বলিয়া কত মর্মাঘাতী ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিয়া আসিতেছেন; কিন্তু ধৈর্যের প্রতিমা আনোয়ারা পিতৃগৃহে অবস্থানকালে যেরূপ বিমাতার অত্যাচার নীরবে সহ্য করিয়া কাল কাটাইয়াছে, পতিগৃহে আসিয়াও সেই সৎ-শাশুড়ীর দুর্ব্যবহার সহ্য করিয়া তাহারই মুখাপেক্ষীনী হইয়া, তাঁহারই মনস্তুষ্টি সম্পাদনে দেহ-মন নিয়োজিত করিয়া স্বীয় কর্তব্য পালন করিতেছে। স্বামী শুনিলে মনে ব্যথা পাইবেন বলিয়া শাশুড়ীর দুর্ব্যবহারের কথা সে একদিনের জন্যও স্বামীর কানে দেয় নাই। যখন শাশুড়ীর নিষ্ঠুর বাক্যবাণে তাহার হৃদয়ের অন্তস্থল ছিদ্র হইয়া যাইত, তখন সে নির্জনে নীরবে অশ্রুপাত করিয়া শান্তিলাভ করিত।

নুরল এসলাম স্ত্রীর মুখে কোন কথা না জানিতে পারিলেও তাঁহার সরলা ফুফু-আম্মার মুখে যাহা শুনিলেন, তাহাতেই বুঝিয়াছিলেন, বিমাতা তাঁহার পারিবারিক সুখ-শান্তির ঘরে আগুন ধরাইয়া দিয়াছেন এবং সে আগুন তাহার প্রেমময়ী প্রাণাধিকা জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইতেছে; কিন্তু ধৈর্যবশত মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিতেছে না। এ পর্যন্ত নুরল স্ত্রীর দেখাদেখি নীরবে সব সহ্য করিয়া আসিতেছেন কিন্তু আজ স্ত্রীর বিষাদমাখা মুখ দেখিয়া তাঁহার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করিল। তিনি ফুফু-আম্মাকে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বাড়িতে আজ কি হইয়াছে?’

ফুফু। বাবা, হবে আর কি? তোমার জাতি-পাতের কথা শুরু হইয়াছে।

নুরল। (ব্যাকুল ভাবে) সমস্ত কথা খুলিয়া বলুন!

ফুফু। তুমি নাকি মালীর মেয়ে বিবাহ করিয়াছ? বৌমার বাপ-দাদারা নাকি ভূঁইমালী ছিল, শেষে জাত যাইয়া মুসলমান হয়, সেই হইতে তাহাদের ভূঁইয়া খেতাব হইয়াছে। তার মা নাকি আবার চোরের মেয়ে?

নুরল এসলাম শুনিয়া স্তম্ভিত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন, “এমন কথা কে বলিল?”

ফুফু। সকাল বেলা সালেহা বলিয়াছে।

নুরল। সে এমন সৃষ্টিছাড়া কথা কোথায় পাইল?

ফুফু। জানি না।

নুরল এসলাম সালেহাকে ডাকিলেন। সালেহা নুরল এসলামের ক্রোধ দেখিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে উপস্থিত হইল। নুরল সহোদরা ভগিনি জ্ঞানে সালেহাকে এতদিন স্নেহের ‘তুই’ শব্দ ব্যবহার করিতেন। আজ কহিলেন, “সালেহা! তুমি ঠিক করিয়া বল, তোমার ভাবী যে মালীর মেয়ে, একথা তোমাকে কে বলিয়াছেন?” সালেহা নীরব। নুরল তাহাকে ধমক দিয়া কহিলেন, “বল না ঠিক কথা, না বলিলে তোমার ভাল হইবে না।” সালেহা পিছন ফিরিয়া মায়ের ঘরের দিকে চাহিল, মা ইশারায় বলিতে নিষেধ করিলেন। নুরল আবার কহিলেন, “বল না?” সালেহা কহিল, “বলিতে পারিব না।” নুরল সক্রোধে কহিলেন, “ কেন পারিবে না? তোমাকে বলিতেই হইবে।” সালেহা ভয় পাইয়া কহিল, “মা বলিয়াছে।” নুরল কহিলেন, ‘যাও।”

অনন্তর নুরল মায়ের ঘরের নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন, “মা, আপনাকে কয়েকটি কথা বলিব। বাবাজানের মৃত্যুর সময় আপনার যে ব্যবহার দেখিয়াছি, তাহাতেই মর্মে মরিয়া আছি! আপনার আচার-ব্যবহার দেখিয়া, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বিবাহ করি নাই। করিলে এতদিনে উৎসন্ন যাইতাম। আপনি শরিফের ঘরের মেয়ে বলিয়া সর্বদাই অহঙ্কার করেন, কিন্তু ইহা আপনার অশিক্ষার ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। বংশ গৌরব কাহারও একচেটিয়া নহে। আল্লাহতায়ালা বড় ছোট করিয়া কাহাকেও পয়দা করেন নাই। সকলের মূলেই এক আদম! তবে কার্যবশত সংসারে বড় ছোট হইয়া গিয়াছে। আমাদের মোগল, পাঠান, শেখ প্রভৃতি শ্রেণীভাগের মূল ইহাই। ফলত বংশমর্যাদা সব দেশে, সব কালে সৎ-অসৎ কার্যফলের উপর নির্ভর করিয়া আসিয়াছে। আমরা সম্ভ্রান্ত শেখ বংশোদ্ভূব। যে বংশে আমি বিবাহ করিয়াছি, তাহারাও সম্ভ্রান্ত শেখ। আপনার বাপ-দাদারাও বুনিয়াদি শেখ ব্যতিত আর কিছুই নহেন। সুতরাং বংশের গৌরব করা আপনার উচিত নয়। আবার যাহারা ভূমির অধিপতি তাঁহারা ভৌমিক বা ভূঞা। আমার শ্বশুরের পূর্ব পুরুষেরা ভূমির অধিপতি অর্থাৎ রাজা ছিলেন, তজ্জন্য তাহাদের খেতাব হইয়াছে ভূঞা। আপনি যদি কল্পনা করিয়া এই সম্মানিত উপাধি কদর্য করিয়া থাকেন, তবে আপনার তওবা করা উচিত। আর যদি অন্য কাহারও নিকট শুনিয়া ঐরূপ বলিয়া থাকেন, তবে তাহাকে হিংসুক, নীচাশয় বলিতে হইবে। আমার শাশুড়ী-আম্মা জীবিত নাই; কিন্তু তিনি আমার শ্বশুরদিগের অপেক্ষাও সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ছিলেন। আমার সৎ-শাশুড়ী এখন আছেন, তাঁহার পিতৃবংশ আশরাফ না হইলেও অধুনা তাঁহারা আশরাফের ক্রেতা। যাহা হউক, একাল পর্যন্ত আপনার ব্যবহারে আমি মর্মপীড়া ভোগ করিয়া আসিতেছি। এক্ষণে বিনীত প্রার্থনা, আর আমাকে কষ্ট দিবেন না, সদয়-স্নেহ দৃষ্টিপাতে সংসার করুন।”

নুরল এসলামের কথা শুনিয়া, তাহার বিমাতা ক্রোধে, অভিমানে উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, “আমি যদি বড় ঘরের মেয়ে হই, তবে এ অপমানের প্রতিফল তোকে ভোগ করিতেই হবে। আমি কসম করিলাম, আজ হইতে তোর ভাত-পানি আমার পক্ষে হারাম আমি কি একেবারেই মরিয়াছি যে, তোর সোহাগের বৌ-এর বাঁদী হইয়া সংসার করিব? পৃথক হইলে আমার ভাত খায় কে? কালই ভাইকে ডাকিব, তোর মুখ দোরস্ত করিব, পৃথক হইলে, তবে ভাত-পানি ছুইব।”

নুরল এসলাম কহিলেন, “তাহাই হইবে, কিন্তু অনাহারে দুঃখ পাইবেন না; এখন এই অন্নে আপনার অধিকার আছে।’

অতঃপর নুরল এসলাম ঘরে যাইয়া স্ত্রীকে কহিলেন, “তুমি আর দুঃখ করিও না, এখন হইতে যদি ওঁর শিক্ষা না হয়, তবে উপায় নাই।”

আনো। আমি যে ভয়ে আপনার নিকট আম্মাজানের কোন কথা খুলিয়া বলি না, আপনি আমার সেই ভয় দশ গুণ বাড়াইয়া তুলিলেন।

নুরল। কিসের ভয়ের কথা বলিতেছ?

আনো। উনি যেরূপ কসম করিলেন, যদি রাগের মাথায় কালই পৃথক হ’ন, তবে দেশময় আমাদের দুর্নাম রটিবে। লোকে আপনাকে বলিবে, স্ত্রৈণ হইয়া মাকে পৃথক করিয়া দিল; আমাকে বলিবে, বৌটি ডাইনী, ভাল সংসার নষ্ট করিল। তখন উপায় কি?

নুরল। ন্যায় পথে থাকিলে লোকে কি বলিবে, সে ভয় আমি করি না।

আনো। না করুন, তথাপি আম্মাজানকে তিরস্কার করিয়া ভাল করেন নাই। হাজার হইলেও তিনি আমাদের গুরুজান; বিশেষতঃ আমার জন্য তাঁহাকে অতদূর বলা ভাল হয় নাই।

নুরল। আমি ত তাঁহাকে তিরস্কার করি নাই। কেবল তাঁহার ব্যবহারে দুঃখিত হইয়া উপদেশ ভাবে কয়েকটি কথা বলিয়াছি মাত্র।

ক্ষণমাত্র মৌনাবলম্বন করিয়া কহিলেন, “সংসার বড়ই কঠিন স্থান; এক আধটুকু উচ্চবাচ্য না করিলে তিষ্টান কঠিন।”

আনো। আমার বিবাহের পূর্বেও কি আম্মাজান সর্বদা সংসারে অশান্তি ঘটাইতেন?

নুরল। আমার ফুফু-আম্মাজান পবিত্রতা ও সরলতার প্রতিমূর্তি। মা এ সংসারে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে হাড়ে হাড়ে জ্বালাইতেছেন। আমার প্রতি মা’র হিংসা চিরদিনই আছে, তবে বিবাহের পর তাঁহার হিংসা যেন আরও বাড়িয়া উঠিয়াছে।

আনো। বাড়া কমাইলে ক্রমে সবই কমিতে পারে।

নুরল। এ বাড়া কমাইবার উপায় নাই।

আনো। এক উপায় আছে।

নুরল। কি উপায়?

আনো। আমি তাঁহার মতিগতি যেইরূপ বুঝিতেছি, তাহাতে বোধ হয় আপনি এ দাসী ত্যাগ করিলে, তাঁহার সমস্ত হিংসার আগুন পানি হইতে পারে।

নুরল এসলাম শিহরিয়া উঠিল এবং বিস্ফারিত নয়নে দৃঢ়তার সহিত কহিলেন, “চন্দ্ৰ সূৰ্য কক্ষচ্যুত হইতে পারে, তথাপি তোমাকে পরিত্যাগ অসম্ভব পরস্তু ওরূপ কথা চিন্তা করিবার পূর্বে এ হৃদয় যেন দোজখের আগুনে পুড়িয়া ভস্ম হয়।”

এই সময় চাকরানী আসিয়া পাকের আঙিনায় যাইতে আনোয়ারাকে ইঙ্গিতে ফুফু- আম্মার আদেশ জানাইল। আনোয়ারা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

পরদিন রবিবার পূর্বাহ্নে নুরল এসলামের বৈঠকখানায় গ্রামের গণ্যমান্য প্রধান প্রধান লোক আসিয়া সমবেত হইতে লাগিলেন। কিছু বেশি বেলায় একটা তাজী ঘোড়ায় চড়িয়া গোপীনপুর হইতে নুরল এসলামের সত্মার ভাই—আলতাফ হোসেন সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অবস্থা শোচনীয় হইলেও তাঁহার সম্পদকালের আমীরী চালচলন কমে নাই। আমাদের অপরিণামদর্শী আভিজাত্যাভিমানী মহাত্মা অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হইয়া অধঃপাতের চরম সোপানে পদার্পণ করিয়াছেন এবং এখনও করিতেছেন। ইহা যে আমাদের সমাজের দুর্ভাগ্যের একটি কারণ, তাহা বলাই বাহুল্য।

যাহা হউক, বৈঠক বসিল। সমবেত ভদ্রমণ্ডলীর মধ্যে যাহারা প্রকৃত অবস্থা জানেন, তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, “আমরা মনে করিয়াছিলাম, দেওয়ান সাহেবের মৃত্যুর পর ছেলের সহিত তাঁহার সৎ-মা পৃথক হইবেন; কিন্তু ছেলের গুণেই এতদিন সংসারটি বাঁধা ছিল।” যাঁহারা ভিতরের অবস্থা জানেন না, তাঁহারা কহিলেন, “পুরান সংসার, একত্র থাকাই ত ভাল ছিল, হঠাৎ এরূপ পৃথক হওয়ার কারণ কি?” আলতাফ হোসেন সাহেব কহিলেন, “জামানার দোষ, আজকালকার ছেলেরা বৌ-বশ হইয়া তাহাদের পরামর্শ মত অনেক ভাল সংসার নষ্ট করিয়া ফেলিতেছে।” ২/৪ জন প্রাচীন ব্যক্তি তাঁহার কথায় সমর্থন করিলেন।

যাহা হউক, একত্র থাকার জন্য অনেকে নুরল ও তাঁহার বিমাতাকে নানা প্রকারে বুঝাইলেন; কিন্তু বিমাতার উৎকট জেদের ফলে বণ্টনই সাব্যস্ত হইল। অনেক বাদানুবাদের পর স্থিরীকৃত হইল, নুরল এসলাম পুরান বাড়িতে থাকিবেন। পুরান বাড়ির পশ্চিমাংশে তাঁহার সৎ-মার বাড়ি হইবে। নূতন ঘরবাড়ি করিয়া দেওয়ার নিমিত্ত নগদ আড়াই শত এবং সালেহার বিবাহের খরচ সাড়ে তিন শত, মোট ছয় শত টাকা ১৫ দিনের মধ্যে নুরল এসলামকে তাহার বিমাতার হাতে দিতে হইবে। বিমাতার কাবিন বাবদ অর্ধেক ভূ-সম্পত্তি লেখা ছিল, তাহা তাহাকে নির্দিষ্ট করিয়া পৃথক করিয়া দেওয়া হইল। এই সম্পত্তি স্বাধীনভাবে ভোগের নিমিত্তই তিনি পরিণাম চিন্তা না করিয়া সগর্বে-পৃথক হইলেন।

বন্টনের পর বিমাতা পৃথক পাকের বন্দোবস্ত করিয়া পানি স্পর্শ করিলেন। হায় রে জিদ! হায় রে অশিক্ষিতা কৌলিণ্যাভিমাণী রমণী! তোমাদের জন্য কত সুখের সংসার যে দুঃখে ভাসিয়াছে ও ভবিষ্যতে আরও ভাসিবে তাহার সংখ্যা করা অসম্ভব।