একাদশ পরিচ্ছেদ
একদিন শনিবার অপরাহ্ণে আট বেহারার একখানি পাল্কি নুরল এসলামের বৈঠকখানার সম্মুখে আসিয়া থামিল। একজন নবকান্তি সোনার চশ্মাধারী যুবক পাল্কী হইতে বাহির হইয়া বৈঠকখানায় উঠিল; এবং তথায় অল্পক্ষণ বিশ্রামের পর বাটীস্থ জনৈক দাসীর আহ্বানে বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। ইনি হামিদার স্বামী, জজকোর্টের উদীয়মান উকিল—মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন।
উকিল সাহেব বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলে আনোয়ারা পতির নিকট হইতে খিড়কীর দ্বার দিয়া বাহির হইয়া পাকের আঙ্গিনায় চলিয়া গেল। উকিল সাহেব ঘরে প্রবেশ করিলেন। ফুফু-আম্মা মাথায় কাপড় দিয়া দরজার পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বন্ধু, বন্ধুর চেহারা দেখিয়া মর্মাহত হইলেন। বন্ধুদর্শনে পীড়িত বন্ধুর চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, তিনি অস্পষ্টস্বরে কহিলেন, “দোস্ত, আর বাঁচিবার আশা নাই। অভাগিনী আনোয়ারা রহিল, দেখিও।” উকিল সাহেব নিজে চোখের পানি মুছাইয়া দিলেন এবং আশ্বাস দিয়া কহিলেন, “এর অপেক্ষা কঠিন পীড়ায় লোকে আরোগ্যলাভ করে, খোদার ফজলে তুমি সত্বর আরাম পাইবে। আমাকে পূর্বে খবর দাও নাই কেন?” নুরল দুর্বলতায় ও ভাঙ্গা গলায় ভালমত উত্তর দিতে পারিলেন না। তাঁর ফুফু-আম্মা বারান্দা হইতে কহিলেন, “বাবা ব্যারামের শুরু হইতেই বেলগাঁও-এর বড় ডাক্তার ঔষধ করিতেছেন। তাই আমরা প্রথমে তোমাকে জানাই নাই। কিন্তু দুই একদিন করিয়া প্রায় একমাস যায়, ঔষধে কোন ফল হইতেছে না। ছেলে দিন দিন আরও কাহিল হইয়া পড়িতেছে।” উকিল সাহেব সমস্ত অবস্থা শুনিয়া কহিলেন, “এ পীড়ার ডাক্তারী ঔষধে ভাল ফল হইবে না, কবিরাজী মতে চিকিৎসা করিতে হইবে। আমি এখনই বাসায় গিয়া কাল ভোরে তথাকায় বড় কবিরাজকে পাঠাইব, আল্লার ফজলে তাঁহার ঔষধে ভাল ফল হইবে। আমি মাঝে মাঝে আসিয়া দেখিয়া যাইব, আপনারা চিন্তিত হইবেন না।” এই সময় রৌপ্য-ফুরসীতে দাসী তামাক আনিয়া উকিল সাহেবের নিকট রাখিল। তিনি তামাক খান, আনোয়ারা তাহা জানিত; তাই দাসীকে আদেশ করিয়াছিল। উকিল সাহেব তামাক খাইয়া প্রস্থানে উদ্যত হইলেন, ফুফু-আম্মা কহিলেন, ‘বাবা আজ থাক, এখন রাতমুখে কিরূপে যাইবে?” উকিল সাহেব কহিলেন, “আজ না গেলে কাল পূর্বাহ্নে কবিরাজ ঔষধ করিতে পারিবেন না। যতই বিলম্ব হইবে ততই অনিষ্ট।” এই সময় দাসীর আসিয়া কহিল, “বউ-বিবি আপনাকে সালাম জানাইয়াছেন এবং একটু অপেক্ষা করিতে বলিতেছেন।” এই বলিয়া সে পুনরায় উকিল সাহেবকে তামাক সাজিয়া দিল।
অনুমান ১৫ মিনিট পরে দক্ষিণদ্বারী ঘরের বারান্দায় দাসী পরিবেশনের স্থান করিয়া উকিল সাহেবকে তথায় ডাকিয়া লইয়া বসিতে দিল। একটু পরে এক রেকাব গরম পরোটা ও এক পেয়ালা হালুয়া তাহারা সম্মুখে আসিল। তিনি দেখিয়া সহর্ষে কহিলেন, “একি! এত সত্বর এরূপ আয়োজন কিরূপে হইল।” দাসী কহিল, “বউ-বিবি এখনই ইহা নিজ হাতে করিয়াছেন।” উকিল সাহেব খাদ্যসামগ্রীর যথাযোগ্য সদ্ব্যবহার করিতেছেন; আনোয়ারা ইত্যবসরে দাসীর দ্বারা ৮ জন বেহারা ও একজন চাপরাশীর উপযুক্ত জল-খাবার বাহির বাড়িতে পাঠাইয়া উকিল সাহেবের পান-তামাকের বন্দোবস্ত করিল।
উকিল সাহেব যাইবার সময় সকলকে বিশেষভাবে আশ্বস্ত করিয়া পাল্কীতে উঠিলেন।