» » ভক্তি-পর্ব

বর্ণাকার

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

চিকিৎসার ত্রুটি নাই, তথাপি পীড়া উপশমের কোন লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। পীড়া যখন বেশি বাড়িয়া উঠে, তখন পতিপ্রাণা বালিকার ক্ষুদ্র হৃদয়খানি নানা আশঙ্কায়, নানা সন্দেহে আলোড়িত হইতে থাকে। সে কখন ভাবে, তাহার সেবা-শুশ্রূষার ত্রুটিতেই বুঝি এরূপ হইতেছে। আবার ভাবে, তাহার নিয়মিত রূপে ঔষধ সেবন করানোর ভুল-ভ্রান্তিতে বুঝি পীড়া বৃদ্ধি পাইতেছে। তাই সে নামাজ অন্তে প্রার্থনার সময় মাথা কুটিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলে, ‘দয়াময় খোদা! দাসীর দোষে স্বামীর পীড়া বাড়াইও না। জননী উপদেশ দিয়া গিয়াছেন, ‘মা, নিজের দোষে স্বামীর অসুখ-অশান্তি যাহাতে না হয়, তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখিবে; অন্যথায় পরকালে দোজখের আগুনে দগ্ধিয়া দগ্ধিয়া কাল কাটাইতে হইবে।’ নাথ! জননীর উপদেশ দাসীর হৃদয়ে চিরাঙ্কিত হইয়া রহিয়াছে। প্রভো! চারিমাস যাইতে বসিল, রোগের যন্ত্রণা স্বামী আর কতকাল সহ্য করিবেন? হায় বিধাতঃ! তাঁহার সুগঠিত দেহ অস্থি কঙ্কালসার হইয়াছে; তাহার সুন্দর মুখখানি একেবারে মলিন হইয়া গিয়াছে, তাঁহার সুধামাখা কথা নিদারুণ রোগযন্ত্রণায় আর বাহির হইতেছে না। হে রহিম-রহমান! আমায় ফেরেস্তার মত পতির এ অবস্থা যে আর প্রাণে সহিতেছে না? করুণাময়! দাসীর শেষ প্রার্থনা, তুমি তাঁহার দুরারোগ্য ব্যাধি দাসীর দেহে সঞ্চারিত কর দাসী অক্লেশে অম্লানচিত্তে তাহা সহ্য করিবে। অনাথপতি! দাসীকে আর কাঁদাইও না। “

কিন্তু হায়! বিধাতা বুঝি সতীর সাধনায় কর্ণপাত করিলেন না। পতি ক্রমশ মৃত্যুর নিকটবর্তী হইতে লাগিল। একদিন আনোয়ারা স্বামীর পদপ্রান্তে বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিল, “বৈষ্ণবীকে তাড়াইয়া দেওয়াতে বুঝি স্বামীর পীড়া বাড়িয়া উঠিয়াছে। এবার সে আসিলে তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিব, স্বামীর আরোগ্য হেতু সে যাহা বলিবে তাহাই শুনিব। সালেহা বলিয়া গিয়াছে, আমি তাহার আসিবার উপায় করিব। সে কি কোন উপায় করিতে পারে নাই? হায়! বৈষ্ণবী বুঝি আর আসিবে না। কেন তাহাকে আসিতে নিষেধ করিয়াছি? তাহার ঔষধে বুঝি স্বামী আমার নিরাময় হইতে পারিতেন। হায়! কি সর্বনাশ করিয়াছি! নিজ দোষে পতির মৃত্যুর কারণ হইলাম।” ভাবিতে ভাবিতে বালিকার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল । কিয়ৎক্ষণ পর চোখের জল মুছিয়া স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিল, “আজ আপনার কেমন বোধ হইতেছে?” নুরল এসলাম কহিলেন, “কিছু বুঝি না। যখন তুমি গায়ে পায়ে হাত বুলাও, তখন মনে হয় ব্যারাম বুঝি সারিয়া গিয়াছে। আবার ধীরে ধীরে শরীর খারাপ হইতে থাকে।” আনোয়ারা দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলিয়া আগ্রহের সহিত স্বামীর পদে হাত বুলাইতে লাগিল; এমন সময় ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলিয়া দুর্গা নুরল এসলামের আঙ্গিনায় আসিয়া দাঁড়াইল; আনোয়ারা বৈষ্ণবীর গলার আওয়াজ শুনিয়া ধীরে ধীরে তখন বাহিরে আসিল এবং দুর্গাকে দেখিয়া যেন হাতে স্বৰ্গ পাইল।

হায় পতিপ্রাণা বালিকা! প্রথম দিন ভিক্ষা দিতে যাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করাও আবশ্যক মনে কর নাই, দ্বিতীয়বার যাহার কথা শুনিয়া ঘৃণা প্রকাশ করিয়াছিলে, অসতী বলিয়া যাহাকে বাড়ির উপর আসিতে পর্যন্ত নিষেধ করিয়াছিলেন, আজ তাহার কন্ঠস্বর মাত্র শুনিয়া বাহিরে আসিলে, দেখিয়া হাতে স্বর্গ পাইলে; পতির প্রাণরক্ষায় উন্মাদিনী তুমি! তোমার এ ব্যবহার, তোমার মনের এ ভাব, সতী ব্যতীত অন্যে কি বুঝিবে?

আনোয়ারা দুর্গাকে রন্ধনশালার দিকে ডাকিয়া লইয়া গেল।

দুর্গা। মা, ডাকিয়াছেন কেন?

আনোয়ারা। না বুঝিয়া তোমাকে বাড়ির উপর আসিতে নিষেধ করিয়াছিলাম, মনে কিছু করিও না।

দুর্গা। না মা, সে কথা আমি তখনই ভুলিয়া গিয়াছি। দেওয়ান সাহেবের শরীর কেমন?

আনোয়ারা। তাঁর কাশি একটু বাড়িয়াছে।

দুর্গা। যে দুরন্ত ব্যাধি, কবিরাজি ঔষধ-পত্রে তাহা আরাম হইবে না।

আনোয়ারা বুক চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “তবে কিসে আরাম হইবে?

দুর্গা। আরামের উপায় আছে, কিন্তু বড় কঠিন।

আনোয়ারা। হাজার কঠিন হোক তুমি আমাকে খুলিয়া বল।

দুর্গা। মা, আমরা হিন্দু, আমাদের তেত্রিশ কোটি দেবতা; ক্ষয়কাশ, যক্ষ্মাকাশ, ওলাওঠা প্রভৃতি রোগকেও আমরা দেবতা বলিয়া মানি। ইহারা যাহাকে ধরেন, তাহার নিস্তার নাই; তবে দেবতাগণকে তুষ্ট করিতে পারিলে তাহারা ছাড়িয়া দেন।

আনোয়ারা। তোমার দেবতারা কিসে তুষ্ট হন?

দুর্গা। আপনার স্বামীকে ক্ষয়কাশ-দেবতা আশ্রয় করিয়াছেন, তাঁহাকে ছাড়াইতে হইলে, জীব-সঞ্চার-ব্রত সাধন করিতে হইবে, কিন্তু তা করা বড় কঠিন ব্যাপার।

আনোয়ারা। জীব-সঞ্চার-ব্রত কিরূপ?

দুর্গা। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে মঙ্গলবার বা শনিবার দুপুর রাত্রিতে শ্মশান হইতে মরা আনিয়া তাহার উপর বসিয়া যোগমন্ত্র পড়িতে হয়। তারপর গলায় কাপড় দিয়া ধন্বন্তরী দেবতাকে বলিতে হয়, ‘হে মহাপ্রভু! আমার অমুক রোগীর শরীর হইতে অমুক রোগকে ছাড়িবার আদেশ করুন! তার ভোগের জন্য জীব দিতেছি।’ এই কথার পরই, যিনি ব্ৰত করিবেন, তিনি মরার শিয়রের দিকে দাঁড়াইয়া কাহারো নাম তিনবার উচ্চারণ করিবেন, রোগটি তখনই রোগীর দেহ হইতে যাইয়া তাহাকে আশ্রয় করিবে। ফলে, রোগী সুস্থ হইয়া উঠিবে; কিন্তু যাহার নাম করা হইবে, সে এ রোগে আক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিবে। ইহাই জীবন-সঞ্চার-ব্রত।

দুর্গার কথা শুনিয়া সভয়ে বালিকার দেহ কন্টকিত হইয়া উঠিল, মুখের বর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গেল। তাহার মনে এক বিষম আন্দোলন উপস্থিত হইল, ‘স্বামী এবং ধর্ম কাহাকে রক্ষা করি?’ এই বিরোধের ঘাতপ্রতিঘাতে তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়খানি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। সে কিছুই করিতে না পারিয়া নীরব হইয়া রহিল।

দুর্গা। মা, আপনি কি ভয় পাইলেন?

আনো। না ভয় পাই নাই।

দুর্গা। তবে ব্রত করাইবেন?

আনোয়ারা। বৈষ্ণবী, তুমি বড়ই ভয়নাক কথা তুলিয়াছ। আমি স্বামীর জন্য প্রাণ দিতে তিলমাত্রও কুণ্ঠিত নহি; কিন্তু ধর্মভয়ে আমার প্রাণ কাঁপিতেছে। আমাদের কেতাবে এরূপ ব্রত করা শেরেক্। যিনি প্রাণ দিয়াছেন তিনিই রক্ষা করিবেন-আমি স্বামীর প্রাণের বদলে আমার হৃদয়ের রক্ত দিতে প্রস্তত আছি।

বল, তোমার এই ধর্মবিরুদ্ধ ব্রত ভিন্ন আর কোন উপায় আছে কি? কিন্তু আমি কোন শেরেকের কাজ করিতে পারিব না। আমাকে খোদার কাছে এক দিন অবশ্যই জবাব দিতে হইবে।

দুর্গা চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। কিছু পরে বলিল, “মা, অন্য আর এক উপায়ে আছে।”

আনোয়ারা। ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “আর কি উপায়?”

দুর্গা। সে উপায়ও বড় কঠিন।

আনোয়ারা। যতই কঠিন হোক না, তুমি খুলিয়া বল।

দুর্গা। মৃতসঞ্জীবনী বলিয়া এক রকম গাছ আছে। অমবস্যার মাথায় দুপুর রাতে এলো চুলে পূর্বমুখো হইয়া সেই গাছের শিকড় এক নিঃশ্বাসে তুলিতে হয়।

সেই শিকড় বাটিয়া খাইলে সকল রোগ আরাম হয়।

আনোয়ারা। এ আর কঠিন কি?

দুর্গা। না মা, যে সেই শিকড় তুলিবে তার সেই ব্যারাম হইবে। তাতে তার মরণ নিশ্চয়; প্রাণের বদলে প্রাণ, বুঝিলেন ত? এখন সেই শিকড় তুলিবে কে?

আনোয়ারা। লোকের অভাব হইবে না। তবে সে গাছ চেনা যায় কিরূপ?

আনোয়ারার উত্তেজিত ভাবদৃষ্টে দুর্গা বুঝিল, সে জালে পড়িয়াছে। তখন দুর্গা বলিল, “আগামী শনিবারে অমাবস্যা, সুতরাং আপনার স্বামীর প্রাণরক্ষার শুভ লক্ষণ দেখা যাইতেছে। আমি সেই রাত্রিতে গাছ চিনাইয়া দিব।”

আনোয়ারা। বৈষ্ণবী, তুমি কি অভাগিনীর এতখানি উপকার করিবে?

দুর্গা। সে কি মা! আপনাদের খাইয়া দাইয়া আমরা মানুষ। এখন যদি কিছু উপকার করিতে পারি সে ত আমার ভাগ্যের কথা।

আনোয়ারা। খোদা তোমার মঙ্গল করুন। আচ্ছা তুমি যে দুপুর রাতে আসিবে তাহা আমি কি করিয়া জানিব?

দুর্গা। তাও ঠিক, তবে চলুন, গাছ এখনই দেখাইয়া দিতেছি।

আনোয়ারা। না, আমি ত পর্দার বাহিরে যাই না।

দুর্গা। তবে শনিবার রাতে আসাই স্থির রহিল। আমি আসিয়া আপনাকে ডাকিব। আনোয়ারা। তা করিও না, কি জানি, ফুফু-আম্মা যদি কিছু বলেন। তুমি কোন সংকেতে ঠিক সময়ে আমাকে জানাইতে পার না?

দুর্গা। (একটু চিন্তা করিয়া) আচ্ছা, আমি ঠিক দুপুর রাত্রির সময় আপনাদের উঠানে পর পর দুইটি ঢিল ফেলিব, তাহাতে আপনি বুঝিবেন, আমি আসিয়াছি। সেই সময় আপনি আপনাদের বৈঠকখানার বাগানের সামনে আসিবেন।

আনোয়ারা আশ্বস্ত হইয়া বৈষ্ণবীকে একটু বসিতে বলিয়া ঘর হইতে ২০ টি টাকা আনিয়া দুর্গার হাতে দিল এবং কহিল, “আজ তুমি আমার মা’র কাজ করিলে; তোমার জল খাইবার জন্য এই সামান্য কিছু দিলাম, কিছু মনে করিও না।’

দুর্গা জিব কাটিয়া কহিল, “হরে কৃষ্ণ! না, মা, আমি কিছুতেই আপনার টাকা নিতে পারি না। আপনার দুঃখ যদি কিছু দূর করিতে পারি, তবে তাহাই আমার পুরস্কার। আমি টাকা চাই না।”

আনোয়ারা তবুও তাহার হাতে টাকা গুঁজিয়া দিল। পাপীয়সী আর দ্বিরুক্তি করিল না। কেবল যাইবার সময় বলিয়া গেল, “মা, দেখিবেন এ কথা অন্য কাহারও নিকট প্রকাশ করিবেন না।”