ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
মাসাধিক পর একদিন অপরাহ্ণে দুর্গা আবার নুরল এসলামের বাড়িতে ভিক্ষার ভানে উপস্থিত হইল। সেদিন দেখিল, আনোয়ারা পশ্চিমদ্বারী ঘরে আসরের নামাজ অন্তে হাত তুলিয়া মোনাজাত করিতেছে, তাহার নেত্রদ্বয় হইতে অবিরাম অশ্রু ঝরিতেছে। দুর্গা আনোয়ারার এবম্বিধ অবস্থা দেখিয়া দ্বারের চৌকাঠের উপর বসিল। বসিয়া মনে মনে ভাবিতে লাগিল, ‘স্বামী অনেকদিন ধরিয়া কাতর—সেবা-শুশ্রূষায় বিরক্ত ধরিয়াছে; তাই যাতনা সহিতে না পারিয়া হয় স্বামীর, না হয় নিজের মৃত্যু কামনা করিতেছে। শিকারের উপযুক্ত সময় বটে।’ আনোয়ারা অনেকক্ষণ পর মোনাজাত শেষ করিয়া চোখের পানি মুছিয়া পাশ ফিরিয়া বসিতেই দেখিল, সম্মুখে দুর্গা। দুর্গা কহিল, “মা, কাঁদিতেছেন কেন?” আনোয়ারা দুর্গার কথার ভঙ্গি ও মুখের চেহারায় বিরক্ত হইয়া কোন উত্তর করিল না। দুর্গা ব্যথার ব্যথী হইয়া কহিল, “মা, ও দুঃখ আমিও পোহাইয়াছি। আপনার এই বয়সেই একবার ঠাকুর মরণাপন্ন কাতর হয়; তখন সুখ-সন্তোষ বিসর্জন দিয়া না খাইয়া না শুইয়া তাহার সেবা করিলাম; কিন্তু তাহাকে আর ফিরাইতে পারিলাম না। কি করিব? সবই অদৃষ্টের লেখা। আমরা হিন্দুর মেয়ে, সারা জীবন বিধবা থাকিয়া কাটাইলাম।” দুর্গার কথা আনোয়ারার কানে ভাল লাগিল না, সে ঘর হইতে উঠিয়া গেল। রান্নার আঙ্গিনায় যাইয়া দাসীকে আদেশ করিল, “বৈষ্ণবীকে ভিক্ষা দিয়া বল, ও যেন এ বাড়িতে আর ন আসে।” দাসী ভিক্ষা দিয়া দুর্গাকে কহিল, “তুমি এ বাড়িতে আর আসিও না।”
দুর্গা। কেন গো, কেন?
দাসী। বউ-বিবির হুকুম।
দুর্গা। কি অপরাধ করিলাম?
দাসী। তা তুমি জান।
দুর্গা “আচ্ছা” বলিয়া, রাগে গর্গর্ করিতে করিতে চলিয়া গেল এবং পথে বলিতে বলিতে যাইতে লাগিল, ‘কত রূপসী দেখিয়াছি এমন বদ-দেমাগী ত কোথায় দেখি নাই; যেন কত বড় নবাবের কন্যা; ঘেন্নায় কথা কন না। দুর্গার কথা আর কেহ শুনিল না। কেবল সালেহার মার কানে গেল। তিনি প্রাচীরের আড়ালে থাকিয়া দুর্গাকে ইশারায় ডাকিতেছেন। সে সালেহাদিগের আঙ্গিনায় ঢুকিয়া পড়িল। সালেহার মা তাহাকে আদর করিয়া বসিতে দিয়া কহিলেন, “তুমি অমন বকাবকি করিতেছ কেন?”
দুর্গা। মা, আমরা দশ দুয়ার মাগিয়া খাই, তা ও-বাড়ির বউ আমাকে ভিক্ষা দিবে না বলিয়া জবাব দিয়াছে।
সালেহার মা। বউকে তুমি কি বলিয়াছিলে?
দুর্গা। মা, বলিব আর কি। একালে কি কারো ভাল করিতে আছে? আমি ভিক্ষার জন্য যাইয়া দেখি, বউ পশ্চিমদ্বারী ঘরে পশ্চিম মুখে বসিয়া হাত তুলিয়া কাঁদিতেছে, তাহার দুঃখ দেখিয়া দুঃখ হইল, তাই বলিয়াছিলাম,–সোয়ামী কাতর, কাঁদবার কথাই ত’, উপায় কি? বিপদে ভগবান ভরসা!
সালেহার মা। এ ত’ ভাল কথা। তা’ তুমি ত’ বৈষ্ণবী, আমি বড় ঘরের মেয়ে হইয়া বৌয়ের জ্বালায় দু’দিন সংসারে তিষ্টিতে পারিলাম না। স্বামী-সোয়াগী স্বামীকে পরামর্শ দিয়া আমাকে পৃথক করিয়া দেওয়াইয়াছে।
দুর্গা। আমার নাম দুর্গা বৈষ্ণবী। আমি এ অপমানের শোধ লইব, তবে ছাড়িব।
সালেহার মা। কেমন করিয়া লইবে?
দুর্গ। যেমন করিয়া হোক।
কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া দুর্গা কহিল, “আপনারা ও-বাড়িতে যাতায়াত করেন না?”
সালেহার মা। বেশি না, নুরল কাতর শুনিয়া একবার দেখিতে গিয়াছিলাম। আমার এক অবুঝ মেয়ে আছে, সে চুপে চুপে অনেক সময় যায়।
এই সময় সালেহা সেখানে আসিল।
দুর্গা। এইটি কি আপনার মেয়ে? সালেহার মা। হ্যাঁ।
হীরা প্রকৃতি দুর্গা, তাহাকে শুনাইয়া কহিল, “দেওয়ান সাহেবের যে ব্যারাম তা তাহার বড় ডাক্তার-কবিরাজের অষুধ খাইলেও সারিবে না।’
সালেহার মা। তবে কিসে সারিবে?
দুর্গা। যাহাতে সারিবে আমি তাহাই বউটিকে বলিতে গিয়াছিলাম, তা’ কালের দোষ। ভাল করিতে গেলে লোকে মন্দ বুঝে। আমাকে বউটি তাহাদের বাড়ি যাইতে নিষেধ করিয়াছে।
সালেহা। তোমরা যাহাই বল অমন ভাল বউ কোথাও নাই। অমন মিষ্টি কথা আর কোন মেয়েলোকের মুখে শুনি নাই।
সালেহার মা চোখ রাঙ্গাইয়া কহিলেন, “দ্যাখ বজ্জাতের বেটি, তোর যে বড়ই বাড়াবাড়ি দেখিতেছি।”
মেয়ে চুপ করিল। দুর্গা বিদায় হইল।