এই সে মুসাদা পাহাড়, যার অন্য পাশে অপেক্ষা করছিলেন সম্রাট বিলডন। তিনি এ খবরে খুবই উল্লসিত হলেন। ভাবলেন, একেই বলে মহাপ্রভুর কৃপা। এই দুরাচারকে ধ্বংস করার জন্য মহাপ্রভু তাকে হাতের নাগালে এনে দিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাড়াহুড়ো নয়, খুবই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে এগুতে হবে এবার। সুলতান আইয়ুবী ও তার বাহিনী রণক্লান্ত। তারা এখন বিশ্রাম নেবে। তিনি মনে মনে এ বিশ্রামকে চির জীবনের বিশ্রামে পরিণত করার জন্য পায়তারা কষতে লাগলেন। পাহাড়ের পাদদেশে অপেক্ষমান তার বাহিনীকে বললেন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে অবস্থান নিতে। তিনি যেদিন হেমসের নিকট থেকে ক্যাম্প তুলে সমরাভিযান চালাতে হুকুম দিলেন, সেদিন জাভীরা সম্রাটকে বললো, ‘আমি তো আপনার কাছে আশ্রয় নিতে এসেছিলাম। আপনার সাথে অভিযানে যাওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমাকে ছুটি দিন।’
‘তুমি একা কোথায় যাবে? তারচেয়ে আমার সঙ্গেই থাকো, অভিজ্ঞতা বাড়বে।’
‘আমি একা যাবো কেন? তানভীর যাবে আমার সাথে। এখন তো আপনি যুদ্ধের ময়দানে যাচ্ছেন। ওখানে আমার বা আপনার কি লাভ?’
‘জাভীরা, আমার লাভ আমি বুঝি। লাভ-লোকসানের হিসাব আমাকে বুঝাতে এসো না। তুমি ভাল করেই জানো, আমার কাছে মেয়ে মানুষের কোন কমতি নেই।’ বিলডন বললেন, ‘কিন্তু তুমি এমন এক মেয়ে, যে আমার মন জয় করেছে। তুমি যখন আমার কাছে থাকো তখন আমি আত্মায় শান্তি পাই। তুমি আরও কিছুদিন আমার সাথেই থাকো।’
জাভীরা সম্রাট বাদশাহদের মেজাজ মর্জি ভাল মতই বুঝতো। বিলডনের নিয়ত বুঝতেও তার কষ্ট হয়নি। সে তাকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিল, “আত্মার শান্তির কথা যদি বলেন তবে সে শান্তি আমি ওই মুসলমান লোকটির কাছ থেকে পেয়েছি, যার পরিবার ও বংশকে আমি ধ্বংস করেছি। তার পুরো গ্রাম ধ্বংস করে, আপনজনদের হত্যা করে, এখন তাকে আমি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি এখনো তাকে বলতে পারিনি, আমি তোমাকে নির্বংশ করেছি, তোমার গ্রাম ও বাড়ীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছি। আমি যে পাপ করেছি সে পাপের প্রায়শ্চিত্য কিভাবে করবো এ চিন্তায় বিবেকের দংশনে মরে যাচ্ছি আমি। তাইতো তার সামান্য সেবা করতে পারলে আমি আমার আত্মায় শান্তি পাই।’
‘তোমারও কি আত্মা এবং বিবেক আছে!’ বিলডন বিদ্রুপের স্বরে বললেন, ‘তোমাদের আবার মন কি? এতকাল মুসলমান আমীরদের সঙ্গ দিয়ে যে পাপ করেছে, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্যের কথা চিন্তা করেছো?”
সম্রাটের এ কথায় আহত হলো জাভীরা। বললো, ‘আপনার কাছে আমি একটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় দেহ ছাড়া আর কিছু নই! কিন্তু যখন আমি তানভীরের কাছে থাকি তখন মনে হয়, আমিও একজন মানুষ। আমারও মন আছে, আত্মা আছে, বিবেক আছে। আমার আত্মাও অন্যদের মত একটু শান্তি চায়, একটু ভালবাসার জন্য কাঙালের মত তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে! সেই শান্তি ও ভালবাসা আমি পাই তানভীরের কাছে গেলে।’
বিলডন একজন সম্রাট! সম্রাটের মতই তার আচরণ। জাভীরার কথা শুনে তিনি ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ভুলে যেও না জাভীরা, তুমি একজন সম্রাটের সাথে কথা বলছো। আমার হুকুম স্পষ্ট, তুমি আমার সাথেই থাকবে।’
ক্ষিপ্ত বিলডন এতেই শান্ত হলেন না। তিনি প্রহরীকে ডেকে বললেন, ‘ওই মুসলমান লোকটার পায়ে শিকল বেঁধে তাকে বন্দী করে রাখো।’
যখন বিলডন মুসাদা পাহাড়ের উপরে ক্যাম্প করে আইয়ুবীর ওপর হামলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনও তানভীর শিকলপরা এক কয়েদী! জাভীরার পায়ে শিকল না থাকলেও কয়েদীর চাইতে ভাল ছিল না তার অবস্থাও। রক্ষীরা তাকে পাহারা দিচ্ছিল।
সেনাবাহিনী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠছে। সম্রাট বিলডন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করছেন সৈন্যদের কাজ। এক সময় ক্লান্ত হয়ে তাঁবুতে ফিরে এলেন। মনে পড়লো জাভীরার কথা। তিনি জাভীরার ছটফটানি দেখতে চাইলেন। মানুষর ওপর অত্যাচার করার বিকৃত মানসিকতা নিয়ে তিনি প্রহরীকে বললেন, ‘তানভীর নামের বন্দী মুসলমানটাকে নিয়ে এসো। ও কি নামেই মুসলমান, নাকি ঈমানও আছে একটু পরখ করে দেখি। আর জাভীরাকে পাঠিয়ে দাও আমার তাঁবুতে।’
প্রহরী জাভীরাকে সম্রাটের হুকুম জানিয়ে দিয়ে তানভীরকে হাজির করলো সম্রাটের সামনে। জাভীরা আগেই বিলডনের তাঁবুতে হাজির হয়েছিল। তানভীরকে পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে গেল প্রহরী। সম্রাট বিলডন উঠে চাবুক হাতে গিয়ে দাঁড়ালেন তানভীরের পাশে। তারপর শপাং করে চাবুকের একটি আঘাত হানলেন তানভীরের পিঠে। যন্ত্রনায় বিকৃত হয়ে গেল তানভীরের চেহাড়া। তার থেকে অধিক বিকৃত চেহারা হলো জাভীরার। প্রথমে ধীর লয়ে এবং পরে আস্তে আস্তে লয় দ্রুত করলেন বিলডন।
চাবুকের ক্রমাগত কষাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল তানভীরের দেহ। তানভীরের বেদনার্ত চিৎকারের ধ্বনিতে বিষাক্ত হয়ে উঠল তাঁবুর বাতাস। যন্ত্রণাবিদ্ধ হরিণীর মত বিলাপ শুরু করলো জাভীরা। বিলডন চাবুক থামিয়ে জাভীরাকে বললেন, ‘তুমি আমার হাত থেকে নিস্তার পাবে না। আমি তোমার ঝগড়া করার মজা বুঝাচ্ছি। সামান্য এক নষ্টা গোয়েন্দা, সে কিনা আমার সাথে ঝগড়া করে!’
তানভীর একেবারে বোবা ও বধির হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না, কি কারণে হঠাৎ করে তার ওপর এ নির্যাতন হচ্ছে। জাভীরার চিৎকার ও আহাজারীতে সে বুঝতে পারছিল, জাভীরাও তারই মত মজলুম, তারই মত অসহায়। কিন্তু কেন হঠাৎ করে এ অসহায়ত্ব তাকে চেপে ধরলো, কিছুতেই তা অনুমান করতে পারল না।
তানভীর তখনো সহ্য করে যাচ্ছিল এ অত্যাচার। কিন্তু জাভীরার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে বিলডনের কাছে ছুটে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তুমি যেমন চাইবে, যতক্ষণ চাইবে তোমার কাছেই থাকবো, দয়া করে তানভীরকে ছেড়ে দাও।’
বিলডন থামলেন। প্রহরীকে ডেকে বললেন, ‘একে নিয়ে যাও। এর বাঁধন খুলে দিয়ে চিকিৎসককে বলো এর ক্ষতে মলম পট্টি দিতে। এর চিকিৎসায় যেন কোন রকম ত্রুটি না হয়।’ প্রহরী তানভীরকে বাইরে নিয়ে গেলো।
বিলডনের রাগ থামাতে তার হাতে মদের পেয়ালা তুলে দিল জাভীরা। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন সম্রাট বিলডন। এক সময় মদের নেশায় মাতাল বিলডন জড়িত কণ্ঠে জাভীরাকে বললেন, ‘যদি আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে তানভীরের মত শিকল পরিয়ে তোমার সামনে হাজির করি, তবে কি তুমি খুশী হবে? বলো, তখনো কি তুমি আমাকে বুড়ো বলে তিরস্কার করবে, ঘৃণা করবে?’
তখন আমি গর্ব ভরে বলব, ‘আমি সম্রাট বিলডনের সামান্য এক দাসী।’ জাভীরা বললো, ‘আরও বলবো, তলোয়ার নিয়ে বাহাদুরী করার দরকার নেই সম্রাট। এবার তলোয়ার আমার পদতলে রেখে দিয়ে আমার কাছে এসে বিশ্রাম নিন। আমাকে আপনার সামান্য সেবা করার সুযোগ দিন।’
‘দুদিন পরে আমি তোমাকে তাই করে দেখাবো।’ বিলডন বললেন।
‘তুমি কি দেখছো না, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আমার পদতলে ক্যাম্প করে বসে আছে?’ বিলডন বললেন, ‘কালই আমি রাতের আঁধারে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। এমন আক্রমণ করব, যার মোকাবেলা করার সাধ্য তার হবে না।’
‘আইয়ুবীকে এত হালকাভাবে নেবেন না।’
‘আইয়ুবী এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। তিনি জানেন না, তার মাথার ওপর আমরা বসে আছি। আক্রমণ করার পর তিনি যখন জানতে পারবেন, ততোক্ষণে তিনি আমার বন্দী হয়ে যাবেন।’
তানভীরের জখমে মলম পট্টি বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। সে এখন আর বন্দী নয়, ফলে কোন প্রহরী তাকে পাহারাও দিচ্ছিল না। সে বিছানায় উঠে বসলো এবং তাঁবুর দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল।
সে থাকলে কি চলে গেলো এ নিয়ে বিলডন বা তার বাহিনীর কারো কোন মাথাব্যথা ছিল না। বরং সে শাহী মেহমান হিসেবে সবার কাছে সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিল। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার কোন চিন্তা তখনো তার মাথায় আসেনি।
বিলডন আবার সৈন্যদের কাজ তদারক করার জন্য বেরিয়ে গেলেন। জাভীরা এ সুযোগে তানভীরকে দেখতে তার তাঁবুতে গেল। তানভীর তাকে অধীর হয়ে স্বাগত জানালো, কিন্তু জাভীরার আচরণে কোন উচ্ছ্বাস বা আবেগ নেই। জাভীরা ধীর পায়ে তার কাছে গিয়ে বসলো। তানভীর ব্যাকুল কণ্ঠে বললো, ‘কি হয়েছে জাভীরা?’
জাভীরা তেমনি উচ্ছ্বাসহীন কণ্ঠে বললো, ‘আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। বেশী কথা বলার সময় নেই, যা বলছি সব মনের ভেতর গেঁথে নাও।’ জাভীরা বললো, ‘আমি তোমাকে তোমার ভালবাসার প্রতিদান দিতে এসেছি। আমি তোমাকে যা বলবো বিনা প্রশ্নে তাই তোমাকে মেনে নিতে হবে। দয়া করে আর একটি কথাও জিজ্ঞেস করবে না আমাকে।’
তানভীর হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। জাভীরা কথা বন্ধ করে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল। এরপর মুখ তুলে বলল, “আমি জীবনে বহু পাপ করেছি। তোমাদের এলাকা হেমস ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে তুমি আর কোনদিন যাবে না। সেখানে শুধু ধ্বংসস্তুপ পড়ে আছে। সেই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে তোমার আপনজনদের হাঁড়গোড় ছাড়া আর কিছুই খুজে পাবে না।’
সে তানভীরকে তার এলাকা ধ্বংসের সমস্ত বিবরণ শোনাল। তাকে শোনাল বিলডন বাহিনীর বর্বরতা ও নৃশংসতার কাহিনী। তারপর বললো, ‘এ নৃশংসতার প্রতিশোধ নিতে হবে। আজ রাতেই এ পাহাড়ী এলাকা থেকে বেরিয়ে যাবে তুমি। এমনভাবে যাবে যেন তোমাকে কেউ দেখতে না পায়। পাহাড়ের উল্টো পাশে নেমে যাবে তুমি। ওখানে দেখতে পাবে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বাহিনীর তাঁবু। ওরা ওখানে বিশ্রাম নিচ্ছে।
সেখানে গিয়ে তুমি সোজা সুলতানের সাথে দেখা করতে চাইবে। তাঁকে বলবে, ‘খৃষ্টান বাহিনী আপনার মাথার উপর বসে আছে। আজ মধ্য রাতের পরপরই তারা আপনার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাবে।’
জাভীরা তাকে সম্রাট বিলডনের যুদ্ধের সমস্ত পরিকল্পনা বলে দিয়ে আবার বললো, ‘এখন আর আমার দিকে তাকাবে না, তাকালে আর বের হতে পারবে না। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, আমাদের দুজনের ঠিকানা দুদিক থেকে এসে একই মোহনায় মিলিত হয়ে গেছে। আজ তোমাকে যে কথা বললাম, তা না হলে কোনদিনই তুমি তা জানতে পারতে না। যাও, নিজের জাতিকে বাঁচাও। যদি আল্লাহর মঞ্জুর থাকে তবে আবারও আমাদের দেখা হবে। আর যদি এ দেখাই আমাদের শেষ দেখা হয়, তবে আমি সেখানে বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, যেখানে এ পৃথিবীর নোংরা মানুষগুলোর হাত কোনদিন পৌঁছতে পারবে না।’
যদি জাভীরা তাকে হেমসের ধ্বংসযজ্ঞের কথা ও নির্মম গণহত্যার কাহিনী না শোনাতো তবে তানভীর এত জলদি সেখান থেকে বের হতো না। জাভীরার কথা শুনে তার চোখে নেমে এসেছিল অশ্রুর বন্যা। জাভীরা তার চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বললো, ‘যাও, দেরী করো না। দেরী করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বিলডন ঝাপিয়ে পড়বে তোমার মুসলমান ভাইদের ওপর। প্রস্তুত হওয়ার আগেই নিভে যাবে তাদের অনেকের জীবন প্রদীপ।’
তানভীর কোন কথা বলল না। জাভীরার হাত থেকে নিজের হাতটা আস্তে টেনে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। বেরিয়ে গেল তাঁবুর বাইরে। জাভীরা দু’হাতে মুখ ঢেকে লুটিয়ে পড়লো তানভীরের বিছানায়।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার একটু গভীর হতেই সে পাহাড়ের ওপর থেকে উল্টো দিকে পা বাড়াল। সাবধানে চুপি চুপি নেমে যেতে লাগলো নিচের দিকে। গভীর রাত। নৈশ প্রহরী এক আগন্তুককে ধরে সুলতানের সামনে হাজির করলো। সুলতান যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কে যুবক? এখানে কোথেকে কেমন করে এলে?’
সে ব্যগ্ৰ-ব্যাকুল কণ্ঠে বললো, ‘সুলতান, আমার পরিচয় দেয়ার মত সময় আমার হাতে নেই। বিলডনের বাহিনী পাহাড়ের ওপর চড়ে বসে আছে। একটু পরই তারা আপনার ও আপনার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিলডন স্বয়ং এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগে নিজেদের সামলানোর ব্যবস্থা নিন, আমার পরিচয় আমি আপনাকে খুলে বলছি।’
সুলতান আইয়ুবি তাকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। জবাব শুনে সঙ্গে সঙ্গে সব সেনা কমাণ্ডার ও সেনাপতিদের ডাকলেন তিনি। তাদের পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করলেন।
হুকুমনামা জারি করেই তিনি আবার তানভীরের দিকে ফিরলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, এবার বলো তুমি কে এবং কোথেকে কেমন করে এখানে এলে? বিলডন যে পাহাড়ের ওপর চড়ে বসেছে এ তথ্যই বা তুমি পেলে কি করে?’
সুলতান আইয়ুবী তার সমস্ত কাহিনী খুব ধৈর্য সহকারে শুনলেন। তিনি বিলডনের সৈন্যদলের অবস্থান ও পরিকল্পনা সম্পর্কে নানা তথ্য প্রশ্ন করে করে জেনে নিলেন। তারপর তাকে নিয়ে তাঁবুর বাইরে এলেন। বললেন, ‘চলো দেখি এদিকের প্রস্তুতি কতদূর এগোলো?’
সম্রাট বিলডন রাতের তৃতীয় প্রহরে অতি সন্তর্পনে এসে সুলতান আইয়ুবীর সেনা ক্যাম্পে হামলা চালালেন। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে গেলেন, সেখানে শুধু তাঁবুই আছে, কোন সৈন্য নেই। হতভম্ব বিলডন রাতের অন্ধকারে চারদিকে তাকালেন। চারদিকে ছোট ছোট টিলা, ঝোপঝাড়, কিন্তু কোথাও কোন সৈন্যের অস্তিত্ব নেই।
এ সময়ই এক দিক থেকে ছুটে এলো একটি সলতেওয়ালা তীর। বিলডনের বাহিনী তখন সুলতান আইয়ুবীর ক্যাম্পের তাবুগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
তীর সুলতানের সৈনিকদের এক তাঁবুতে গিয়ে পড়লো। দেখতে দেখতে শুরু হয়ে গেল চারদিক থেকে অবিরাম তীরের বর্ষণ। এ সব তীর আইয়ুবীর সৈন্যদের তাঁবু ও জায়গায় জায়গায় জড়ো করে রাখা শুকনো খড়ের গাদায় গিয়ে আঘাত হানলো। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জ্বলে উঠলো দাউ দাউ অগ্নিশিখা।
এসব তীরের সলতে পেট্রোল জাতীয় তেলে ভিজানো ছিল। ফলে মুহূর্তে আইয়ুবীর পুরো ক্যাম্প একটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়ে গেল। বিলডনের বাহিনী সেই আগুনের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেল।
বিলডন এ অবস্থা দেখে তৎক্ষণাৎ আত্মরক্ষার জন্য ছুটে পালালেন। তার সৈন্যরাও পড়িমড়ি ছুটছি। আক্রমণ দূরে থাক, আত্মরক্ষার কোন পথও তারা খুঁজে পাচ্ছল না। ভোর হতেই আইয়ুবীর সৈন্যরা ছুটলো পাহাড়ের চুড়ায় এবং নানা টিলা ও গহবরে। বিলডনের লুকানো সৈন্যদের ধরে ধরে এক জায়গায় জড়ো করা হলো তাদের।
সম্রাট বিলডনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। যখন বিলডন বুঝতে পারলেন, তিনি সুলতান আইয়ুবীকে অজ্ঞাতে আক্রমণ করতে পারেননি, বরং সুলতান আইয়ুবীর পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন, তখন তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। তিনি কোনমতে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেলেন এবং নিজের রক্ষী বাহিনী নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। পাহাড়ে উঠার পথে দু’টি তীর তার দুই দেহরক্ষীকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। অন্ধকারের জন্য সুলতানের সৈন্যরা বুঝতে পারেননি, সম্রাট বিলডন তার রক্ষী বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা তাকে মরিয়া হয়ে ধাওয়া করার প্রয়োজন বোধ করেনি, নইলে ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতো।
১১৭৯ সালে অক্টোবর মাসে (হিজরি ৫৭৫) এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে সম্রাট বিলডন অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও তার বাহিনী তছনছ হয়ে যায়। বহু সংখ্যক সৈন্য মারা পড়ে, কিছু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, বাকীরা সুলতান আইয়ুবীর ঝটিকা বাহিনীর হাতে পরাজিত ও ধৃত হয়। এভাবেই সুলতান আইয়ুবী তাঁর রমলার রণক্ষেত্রের পরাজয়ের জবাব দিলেন। এ যুদ্ধ সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনীর মনে নতুন উদ্যম ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনলো।
তানভীর যোগ দিল সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীতে। কিন্তু জাভীরা? জাভীরা কোথায় তার কেন হদিস পেল না তানভীর। শুধু তার আত্মত্যাগের ইতিহাস ও স্মৃতি বুকে লয়ে ময়দান থেকে ময়দানে ছুটে চলল হেমসের বীর।
নুরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুনকে তাঁর চাকরানী এসে সংবাদ দিল, “এক মহিলা গেটে এসে বলছে তার নাম শামসুন্নেসা। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চান।
খবরটি শুনে রাজিয়া খাতুনের চোখ স্থির হয়ে গেল। হঠাৎ করে শামসুন্নেসা নামটি শুনেই তাঁর হৃদয়ে ঝড় উঠল। এ ঝড়ের গতি বুঝে নেয়া সম্ভব ছিল না দাসীর পক্ষে।
রাজিয়া খাতুনের চোখ দুটি বেয়ে তখন নেমে এসেছে অশ্রুর ধারা। কে এই মেয়ে। এই কি তাঁর একমাত্র আদুরে কন্যা শামসুন্নেসা! যে মেয়ের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটেছিল যখন মেয়ের বয়স মাত্র নয় বছর!
‘কোন শামসুনেসা! কেন দেখা করতে চায়?’ আবেগ সংযত করে বললেন তিনি।
‘বলছেন, উনি নাকি আপনার একমাত্র কন্যা।’
রাজিয়া খাতুনের চোখে ভেসে উঠল সাত বছর আগের একটি ঘটনা। তিনি ভেবে দেখলেন, এতদিনে নিশ্চয়ই সে মেয়ে শাহজাদীর মত রূপসী হয়ে উঠেছে। কারণ এর মধ্যে কেটে গেছে দীর্ঘ সাতটি বছর, যার একটি দিনও তাঁর অন্তরের রক্তক্ষরণ বন্ধ থাকেনি। এতদিন পর দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর ষোড়শী কন্যা, খবরটি শুনে দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরার কথা। কিন্তু না, তাঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো ভিন্নতর উচ্চারণ। রাগতঃ স্বরে তিনি বললেন, ’কেন এসেছে। কি চায় সে আমার কাছে?’
‘আপনার সাথে একটু দেখা করতে চায়। আমি কি তাকে ভেতরে আসতে বলবো?’
মা নিরব হয়ে গেলেন। দাসী তার উত্তরের আশায় দাঁড়িয়ে রইলো নির্বাক হয়ে। মা বললেন, ‘তাকে বলো, আমি তার সাথে দেখা করবো না। সে ফিরে যাক তার বিশ্বাসঘাতক ভাইয়ের কাছে। আমার সামনে আসার সাহস যেনো আর কোনদিন না করে।’
ভেতর থেকে রাজিয়া খাতুনের পুরনো দাসী এসে দাঁড়াল মায়ের সামনে। বললো, ‘মা, তখন তো এ মেয়ে অবুঝ শিশু ছিল। ভাই তাকে সঙ্গে করে যখন নিয়ে যায় তখন কি সে জানতো তার ভাই তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এখন মেয়ের বয়স হয়েছে। মায়ের সন্তান ফিরে এসেছে মায়ের কোলে। তাকে আপনি এভাবে ফিরিয়ে দেবেন?’
‘আমি জানি তার ভাই-ই তাকে এখানে পাঠিয়েছে।’ রাজিয়া খাতুন বললেন, “আর আমি এটাও জানি, কেন আমার গাদ্দার ছেলে নিজে না এসে তার বোনকে পাঠিয়েছে। আমি এ মেয়ের সাথে দেখা করবো না।’
রাজিয়া খাতুন। এক মহিয়সী নারী। নুরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী। নুরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর তার আমীর, উজির এবং কিছু সংখ্যক সামরিক নেতা তাদের সুবিধার জন্য জঙ্গীর নাবালগ সন্তান আল মালেকুস সালেহকে সুলতান ঘোষণা করলে মা হয়ে তার বিরোধিতা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন এ মহিলা। যাঁর স্বামী ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার সংগ্রামে ছিলেন অকুতোভয় বীর সিপাহসালার, কি করে তিনি স্বার্থান্ধ মহলের সাথে হাত মেলাবেন? তাইতো তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। সুলতান আইয়ুবীকে সবকিছু জানিয়ে আহবান জানিয়েছিলেন আল্লাহরওয়াস্তে এর প্রতিবিধান করতে।.. যখন আল মালেকুস সালেহকে সুলতান ঘোষণা করা হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র এগারো বছর। আর তার ছোট বোন শামসুন্নেসার বয়স মাত্র নয়।
এ ষড়যন্ত্রের ফলে মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর রাজ্যের বিভিন্ন আমীর ও কেল্লা অধিপতিগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাগদাদ খেলাফতের অধীন থেকে বিছিন্ন হয়ে যাওয়ার সুযোগ লাভ করে। তারা নামে মাত্র আল মালেকুস সালেহকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেরা স্বাধীনভাবে রাজ্য চালাতে থাকে। আর এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন যিনি তাঁর নাম রাজিয়া খাতুন, সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর যোগ্য সহধর্মিনী।
সে সময় ষড়যন্ত্রকারীরা সবাই মিলে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে এক সামরিক জোট গঠন করেছিল। সুলতান আইয়ুবী তখন মিশরে।
মরহুম জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবির বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল, তারা রাজকীয় বিলাসিতা, আমোদ ফুর্তি ও নিজের অর্জিত সম্পদ স্বাধীনভাবে ব্যয় করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে অভিজাত সম্প্রদায়ের অধিকার খর্ব করে রেখেছিলেন। বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার নামে ক্রমাগত ক্রুসেড বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার মাধ্যমে তাঁরা মুসলমানদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলেন। ফিলিস্তিন মুক্ত করা এবং ইসলামী রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর নাম করে তারা মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে চলেছেন।
এ বিদ্রোহী ঐক্যজোটকে পূর্ণ সহযোগিতা ও মদদ জোগাচ্ছিল খৃস্টানরা। তারাই সরবরাহ করছিল বিদ্রোহের পরিকল্পনা ও মদদ। চিত্তবিনোদনের জন্য নেশা ও বিলাসদ্রব্য সরবরাহ করছিল অকাতরে। আমোদ ও ফুর্তির যাবতীয় উপকরণ, সোনাদানা ও হীরা জহরত দিয়ে তারা ওইসব বিলাসী আমীরদের ঈমান কিনে নিয়েছিল। তাদেরকে বিপথগামী করার জন্য, এরপর পাঠালো সুন্দরী মেয়েদের। খৃস্টানদের পাঠানো এসব মেয়েরা আমীরদের মনোরঞ্জনের সাথে সাথে তাদের কাছ থেকে লুটে নিচ্ছিল খৃস্টানদেরই পাঠানো মূল্যবান সোনাদানা ও হীরা জহরতগুলো।
নুরুদ্দিন জঙ্গী মারা গিয়েছিলেন। এখন বাকী শুধু সুলতান আইয়ুবী। তাঁকে পরাজিত করতে পারলে আর কোন ভয় থাকে না। কেউ আর তাদের ভোগের পথে বাঁধা দিতে আসবে না। এজন্যই তারা সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করার দৃঢ় সংকল্প করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। মরহুম জঙ্গীর অর্ধেকের বেশী সৈন্যকেও তারা চাকরী দিয়ে বিদ্রোহী গ্রুপে টেনে নিয়েছে।
খৃস্টানদেরও উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। তারাও মরহুম জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবীর ভয়ে ভীত ছিল। জঙ্গীর তিরোধানের পর এ ভয় কিছুটা কমলেও তখনো আতঙ্ক হয়ে বিরাজ করছিল সুলতান আইয়ুবী। তারা সুলতান আইয়ুবীর মসজিদুল আকসা মুক্ত করার সংকল্পের কথা জানতো। আইয়ুবীকে বিদায় করতে পারলে তাদের এ ভয় তো দূর হয়-ই, সেই সাথে মুসলিম অঞ্চলে নতুন করে অভিযান চালানোর পথেও আর কোন বাঁধা থাকে না। তাই তারা অকৃপণ হাতে বিলাসী আমীরদের সহায়তা করে যাচ্ছিল।
সুলতান আইয়ুবী যখন মরহুম জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুনের চিঠি পেলেন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের খবর জানতে পারলেন তখন তিনি মাত্র সাতশ অশ্বারোহী নিয়ে কায়রো থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন অভিযানে। তিনি দামেশকে প্রবেশ করলে দামেশকের নগরবাসী তাকে সম্বর্ধনা জানালো এবং সবাই তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলো। দামেশকের প্রধান বিচারক শহরের চাবি তুলে দিলেন তার হাতে। কিন্তু বিদ্রোহী গ্রুপের সৈন্যরা যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল। তারা তাঁর শহরে প্রবেশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে শুরু হলো লড়াই। কিন্তু এ ছিল এক গৃহযুদ্ধ। সুলতান বেপরোয়া আঘাত হেনে মুসলমানদের ব্যাপক রক্তপাত ঘটানোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিরূপায়। এসব বিদ্রোহীদের দমন করতে না পারলে ইসলামী সালতানাত ধ্বংস হয়ে যাবে।
নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী সুলতান আইয়ুবীর সমর্থনে এগিয়ে এলেন। তিনি যে কোন মূল্যে স্বামীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল করার ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ।
এক রাতের লড়াইতেই জনসমর্থনহীন বিদ্রোহীরা পরাজিত হলো। রাতারাতি আল মালেকুল সালেহ ও তার সঙ্গী আমীর এবং সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী সদস্যরা রণে ভঙ্গ দিয়ে দামেশক থেকে পালিয়ে হলবের দিকে পা বাড়াল।
এই পালানোর সময়ই আল মালেকুস সালেহ তার আদরের ছোট বোনটিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। যে সব আমীর ও কেল্লাধিপতি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল তাদের মধ্যে হারানের কেল্লাধিপতি গুমাস্তগীন ও মুসেলের আমীর সাইফুদ্দিন গাজী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। তারাই আল মালেকুস সালেহকে হলবে পুনর্বাসিত করার ব্যবস্থা করেছিল।
আল মালেকুস সালেহ হলবে গিয়ে হলবকেই তার রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা দেয়। পরে এ শহরই ঐক্যজোটে শামিল সম্মিলিত বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে রূপান্তরিত হয়। সাইফুদ্দিন এবং গুমাস্তগীনের বাহিনীও শামিল হয়ে যায় এই সম্মিলিত কমান্ডে। এদের প্রধান উপদেষ্টা এবং উপকারী বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হয় খৃস্টান প্রতিনিধিরা। তারাই তাদেরকে সব ধরনের পরামর্শ এবং অস্ত্র ও রসদের যোগান দিতে শুরু করে। সেই সাথে আমদানী করে মদ ও মেয়ে মানুষ। এসব মেয়েরা ছিল খৃস্টানদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। প্রকারান্তরে তখন দেশের শাসনভার খৃস্টান উপদেষ্টা এবং এইসব গোয়েন্দাদেরই করায়ত্ব ছিল। তারাই নিয়ন্ত্রণ করতে বিদ্রোহী মুসলিম আমীরদের সকল সিদ্ধান্ত। তারা গোপনে খৃস্টান কমাণ্ডো এবং দুষ্কৃতকারীদের জাল পাততে থাকলো মুসলিম প্রতিটি পরগণায়।
সেই সাথে শুরু হলো তাদের মিশনারী প্রচারণা। তারা এমনভাবে কাজ শুরু করলো যাতে মানুষের মনে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এভাবেই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জনমত গঠনের শক্ত আন্দোলন গড়ে উঠে। সুলতান আইয়ুবী দামেশক অধিকার করার পর এবং জঙ্গীর নাবালগ পুত্র আল মালেকুস সালেহ হলবে পালিয়ে গেলেও নুরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুন দামেশকেই অবস্থান করতে থাকেন। তিনি সেখানে চুপচাপ বসে না থেকে মেয়েদেরকে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে লাগলেন। ছোটখাট নিরাপত্তামূলক কাজে মেয়েদের ব্যবহার করে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ করে দিলেন।
তিনি ছিলেন খুবই করিকর্মা এবং উদ্যমী মহিলা। শারীরিক দিক থেকেও ছিলেন শক্তসামর্থ। বয়সের দিক থেকেও বুড়িয়ে যাননি, মাত্র দুই সন্তানের মা হওয়ার পরই তার স্বামী নুরুদ্দিন জঙ্গী মারা যান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বিদ্রোহীরা তার দুটি সন্তানই তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। দুই মাসুম শিশুকে হারিয়ে বুকে পাথর বেঁধে দিন গুজরান করেছেন তিনি। সহ্য করেছেন অন্তরের অসহ্য রক্তক্ষরণ। মাঝেমধ্যে সন্তানদের এক নজর দেখার প্রবল ইচ্ছা জেগে উঠতো তাঁর মনে। তখন নিজেকে তিনি বার বার এই বলে শান্তনা দিতেন, আমার দুই সন্তানই মারা গেছে।
কিন্তু মায়ের মমতা এমন এক জিনিস, কোনকিছু দিয়েই যা ধ্বংস করা যায় না। তাই মাঝেমধ্যেই বুকের ভেতরটা তাঁর হাহাকার করে উঠতো। মমতার বরফ গলে অশ্রু হয়ে তা গড়িয়ে পড়তো সবার অলক্ষ্যে।
সুলতান আইয়ুবী তার গোয়েন্দাদের হলব, হারান ও মুশেলে পাঠিয়ে দিলেন সর্বশেষ খবর ও তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারা ওইসব অঞ্চল থেকে ভয়ংকর সব খবর পাঠাতে লাগল। তারা জানাল, প্রতিটি অঞ্চলেই সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জোরেশোরে যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে। তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে খৃস্টান সেনা অফিসার ও উপদেষ্টাবৃন্দ।
সুলতান আইয়ুবী মিশরে খবর পাঠালেন আরো সেনা প্রেরণের জন্য। দামেশকের সেনাবাহিনীর একটা বড় দলও তার বাহিনীর সাথে শামিল হয়ে গিয়েছিল। নতুন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও প্রস্তুত হচ্ছিল সুলতানকে সাহায্য করার জন্য।
তিনি প্রথমে সকল বিদ্রোহীদের কাছে কাসেদ মারফত এই পয়গাম পাঠালেন, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য আমি তোমাদের দাওয়াত দিচ্ছি। একজন মুসলমান হিসাবে খৃস্টানদের হাতের খেলার পুতুল হওয়া তোমাদের পক্ষে শোভা পায় না। এমন কাজ, কেবল বেঈমান ও গাদ্দাররাই করতে পারে। যদি তোমাদের দীলে ঈমানের আলো এখনো থেকে থাকে তাহলে খৃষ্টানদের বিদায় করে দাও তোমাদের দরবার ও এলাকা থেকে। তার পরিবর্তে এসো আমরা আবার সবাই আশ্রয় গ্রহণ করি ইসলামের ছায়াতলে। আবার আমরা আমাদের ক্ষুদ্র ভেদাভেদ ও সংকীর্ণতা ভুলে এক হয়ে যাই। ইসলামের স্বার্থে যদি আমরা আবার এক সঙ্গে মিলিত হতে পারি তবে খৃস্টানদেরকে মুসলিম এলাকা থেকে বিতাড়িত করাই কেবল সম্ভব নয়, চাই কি আমরা ইউরোপ এবং স্পেনের দিকে অগ্রসর হতে পারবো। আমি ইসলামের এই অগ্রযাত্রায় শামিল হওয়ার জন্য তোমাদেরকে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।’
কিন্তু আল মালেকুস সালেহ, গুমাস্তগীন বা সাইফুদ্দিন কেউ এ আহবানে সাড়া দিল না। গাদ্দাররা সুলতান আইয়ুবীর দূতকে বিদ্রুপ করে বলল, ‘তোমাদের সুলতানকে রাজ্য জয়ের নেশায় পেয়ে বসেছে। ওই নেশায় কেবল রক্ত আর প্রাণের বিনাশ ঘটে। তারচেয়ে তোদের সুলতানকে গিয়ে বলো, আমাদের মতো মদের নেশা করতে। তাতে জীবনের ঝুঁকি নেই, বরং আছে সুন্দরী নারীর সান্নিধ্যের মাতাল করা আমেজ। এই মধুর আমেজ রেখে আমরা কেন অযথা তার সাথে মরতে যাবো?’
এ উত্তর নিয়েই ফিরে এলো সুলতানের পাঠানো দূত।
গুমাস্তগীনের ওখানে ঘটলো ভিন্ন ঘটনা। গুমাস্তগীনের কেল্লায় যখন সুলতান আইয়ুবীর দূত পৌঁছলো তখন গুমাস্তগীন সেই দূতকে বন্দী করে কারাগারে পাঠিয়ে দিল। যথাসময়ে এ খবর পৌঁছলো সুলতানের কানে। সুলতান আইয়ুবী গাদ্দারদের আর অধিক বাড়াবাড়ির সুযোগ দিতে চাইলেন না। কায়বোর বাহিনীর অপেক্ষা না করে তিনি নিজের সাতশ সৈন্য, দামেশক থেকে মরহুম জঙ্গীর রেখে যাওয়া সৈন্যদের একটি বড় দল, যারা গাদ্দারদের সাথে না গিয়ে মরহুম জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর প্রেরণায় সুলতানের বাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন এবং দামেশকের যুবকদের দ্বারা সংগঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়েই আবার অভিযানে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
সুলতান আইয়ুবী যখন সমরাভিযান শুরু করেন তখন নুরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী তাঁর নারী বাহিনী নিয়ে দামেশক থেকে বের হয়ে বহুদূর পর্যন্ত তাকে বিদায় সম্বর্ধনা জানাতে এগিয়ে যান। সেনাবাহিনীর মতই তাঁরাও ছিলেন অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার। সুলতান কয়েকবারই তাদেরকে শহরে ফিরে যেতে অনুরোধ করলেন কিন্তু এই বিপ্লবী নারী সুলতানকে এই বলে থামিয়ে দিলেন, দ্বীনের মুজাহিদদের আরো কিছু পথের ধুলা আমাদের গায়ে মাখতে দাওনা ভাই!’
শহর ছাড়িয়ে শহরতলীর লোকালয় ছাড়িয়ে বিস্তীর্ণ মরুভূমির প্রান্তে এসে পৌঁছলো কাফেলা।
বিদায়ের শেষ মুহুর্ত। সেই মহিয়সী নারীর সামনে দাঁড়ানো সুলতান আইয়ুবী। রাজিয়া খাতুন বললেন, ’যদি আমার বেটা তোমার তীর ও তলোয়ারের আওতায় এসে যায়, তবে এ কথা মনে করবে না যে, সে আমার বেটা। সে বিশ্বাসঘাতক এক গাদ্দার ছাড়া আর কেউ নয়। আর যদি তার লাশ পাও সেটা দাফন করবে না। শিয়াল ও শকুনের জন্য তা উন্মুক্ত ময়দানে ফেলে রাখবে।’
মায়ের চোখ তখন খরখরে শুকনো। সেখান থেকে ঠিকরে পড়ছিল আগুনের উত্তাপ। যখন মা তাঁর সমস্ত দরদ ও ভালবাসা মাটি চাপা দিয়ে এ কথা বলছিলেন, তখন কঠিনপ্রাণ সুলতান আইয়ুবীর চোখে নেমে এসেছিল নোনা পানির ধারা।
রাজিয়া খাতুন বয়সে সুলতান আইয়ুবীর ছোটই ছিলেন। কিন্তু জঙ্গীর শিষ্য হিসাবে তিনি তাকে তুমি করেই সম্বোধন করতেন। তিনি সুলতান আইয়ুবীর দিকে হাত তুলে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে বিজয় দান করুন। যাও ভাই, তোমাকে আর দেরী করিয়ে দিতে চাই না।’
সুলতান তাঁকে সালাম জানিয়ে নেমে পড়লেন মরুভূমিতে।
যতক্ষণ তিনি তাদের দেখতে পাচ্ছিলেন ততক্ষণ রাজিয়া খাতুন সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন। আস্তে আস্তে দৃষ্টি আড়ালে হারিয়ে গেল সৈন্যদের আবছা ছায়াটুকুও। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ, যার বিবরণ আগেই দেয়া হয়েছে। খৃস্টানরা দীর্ঘদিন ধরে এ গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর জন্যই এতসব সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিল বিদ্রোহী মুসলিম আমীর ও শাসকদের। তারা চাচ্ছিল মুসলমানরা যেন পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেরাই নিঃশেষ হয়ে যায়। তারা জানতো, গৃহযুদ্ধ মুসলমানদের কেবল দুর্বলই করবে না, তাদের ঐক্য বিনষ্ট করার সাথে সাথে সমর শক্তিও শেষ করে দেবে।
এ গৃহযুদ্ধের সময়ই তারা হাসান বিন সাবাহর ফেদাইন গ্রুপকে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছিল। আল্লাহ অন্যান্য বারের মত সেবারও তার প্রিয় বান্দাকে আপন মহিমায় রক্ষা করেছিলেন। এ গৃহযুদ্ধ চলেছিল কয়েক বছর। মুসলমানরা তিন চার বছর ধরে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যুদ্ধের প্রতিটি ময়দানেই সুলতান আইয়ুবীকে সফলতা দান করেছিলেন, যে কারণে মুসলমানদের ঈমানী চেতনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
এমনি এক যুদ্ধের সময়। মহিয়সী রাজিয়া খাতুনের নারী বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার জন্য আর্জি পেশ করলো তাঁর কাছে। তিনি তাদের নিষেধ করেও তাদের জেদ ও যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে অবশেষে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন। শত শত মেয়ে জেহাদের জযবা নিয়ে ছুটে গেল যুদ্ধের ময়দানে। সেই যুদ্ধে এ নারী বাহিনী না থাকলে যুদ্ধে জয় লাভ করা সুলতানের জন্য কঠিন হয়ে যেতো। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সুলতান আইয়ুবী কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারী করে ওদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। আর রাজিয়া খাতুনের কাছে পয়গাম পাঠালেন, ‘ভবিষ্যতে কোন ময়দানেই যেন মেয়েদেরকে যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো না হয়।’
এভাবে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে সুলতান আইয়ুবী হলব পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে তিনি হলব শহরের প্রতিরক্ষা দুর্গ এজাজ দখল করে নিলে আল মালেকুস সালেহ তার বোন শামসুন্নেসাকে দূত করে সুলতানের কাছে প্রস্তাব পাঠাল সন্ধির জন্য। শামসুন্নেসা সুলতান আইয়ুবীর কাছে এলে আবেগে তিনি কাতর হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘বলো, তোমার ভাই কি প্রস্তাব দিয়ে তোমাকে পাঠিয়েছে?’
শামসুন্নেসা ভাইয়ের পক্ষ থেকে এজাজ দুর্গ ফেরত দেওয়ার আর্জি পেশ করে বলল, ‘ভাইয়া আপনার বশ্যতা মেনে নিয়েছে।’
সুলতান আইয়ুবী আবেগ সামলে স্নেহের সুরে বললেন, ‘এজাজ কেল্লা আমি আল মালেকুস সালেহকে নয় তোমাকে দান করলাম।’
তিনি সন্ধি প্রস্তাব মেনে নিয়ে এজাজ কেল্লা মেয়েটাকে দান করে দিলেন। শর্ত হলো, আল মালেকুস সালেহ তার সৈন্যের অর্ধেক সুলতানকে দিয়ে দেবে। অবশিষ্ট অর্ধেক সৈন্য নিয়ে শামসুন্নেসার পক্ষ থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করবে আল মালেকুস সালেহ। হলবের আমীরের দায়িত্ব তার হাতেই ন্যস্ত থাকবে। সে হলবে শাসনকার্য পরিচালনা করবে সুলতান আইয়ুবীর বশ্যতা মেনে নিয়ে। আর যদি কখনো সুলতান আইয়ুবীর সেনা সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে তখন সৈন্য দিয়ে তাকে সাহায্য করবে আল মালেকুস সালেহ। প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে সালেহের সৈন্য আবার তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এরপর আল মালেকুল সালেহ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের দায়ে হত্যা করে গুমাস্তগীনকে। অন্য সব আমীররা আল মালেকুস সালেহের মতই সুলতান আইয়ুবীর আনুগত্য স্বীকার করে নিলে পরিসমাপ্তি ঘটে সেই দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের।
ইয়াজুদ্দিনের আহবান পেয়ে সুলতান আইয়ুবী যখন ইবনে লাউনের দিকে তাঁর বাহিনীর মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তখনই তাঁর মনে হলো হলবের সৈন্যদেরকেও এ অভিযানে শামিল রাখলে ভাল হয়। চলতি পথেই তিনি চুক্তির শর্ত মোতাবেক হলবের সৈন্য চেয়ে পাঠালেন এবং যথাসময়ে সেই বাহিনী এসে তাঁর সাথে শামিল হলো। ইবনে লাউনকে পরাজিত করার পর তিনি হলবের বাহিনীকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।
এরপরই সুলতান আইয়ুবী এক বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েন। যুদ্ধ শেষে তিনি যখন তাঁর বাহিনী নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন খৃস্টান রাজা বিলডন তার উপর আক্রমণ করার জন্য পাহাড়ের উপর চড়ে বসলো। বিলডন যদি পরিকল্পনা মতো সুলতানের ওপর হামলা চালাতে পারতো তবে রমলার ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আল্লাহর অপরিসীম দয়ায় সময় মতোই এ খবর পেয়ে যান সুলতান। খৃস্টান গোয়েন্দা কন্যা জাভীরা সুলতানকে সতর্ক করার জন্য রাতের আঁধারে তানভীর নামক এক যুবককে পাঠিয়ে দেয় মুসলিম ক্যাম্পে। পাহাড় ডিঙিয়ে তানভীর সুলতানের কাছে এসে পৌঁছলে ঘটনার মোড় সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যান সুলতান এবং পাল্টা ফাঁদ পাতেন সম্রাট বিলডনের জন্য।
সুলতান আইয়ুবীকে চূড়ান্ত শিক্ষা দিতে এসে অবশেষে সম্রাট বিলডন চরমভাবে পরাজিত হন। বন্দী হতে গিয়েও অল্পের জন্য বেঁচে যান রাত্রির অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে। কিন্তু তার সৈন্যদের পরিণাম হয় খুবই ভয়াবহ।
সুলতান আইয়ুবী তখনো সেই পাহাড়ের কোলেই ক্যাম্প করে আছেন। তানভীর এরই মাঝে যোগ দিয়েছে সুলতানের বাহিনীতে। জাভীরার কোন খবর জানে না তানভীর। খৃস্টানদের ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে ক্যাম্প সম্পূর্ণ ফাঁকা। সুলতানের হাতে যারা মারা পড়েছে বা বন্দী হয়েছে তারা ছাড়া বাকীরা প্রাণ রক্ষা করেছে পালিয়ে। কিন্তু তারা পালিয়ে কোথায় গেছে জানা নেই মুসলিম বাহিনীর।
বিলডন নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে গোয়েন্দা মারফত জানার চেষ্টা করছিল সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর তৎপরতা। সুলতান আইয়ুবী এরপর কোন দিকে যুদ্ধাভিযান চালাবে তার কিছুই বুঝতে পারছিল না বিলডন।
এটা ১১৮১ খৃস্টাব্দের নভেম্বর মাসের (৫৭৭হিঃ) ঘটনা। আল মালেকুস সালেহের ছোট বোন শামসুন্নেছা এ সময়ই হলব থেকে দামেশকে এসেছিল তার মায়ের সাথে সাক্ষাত করতে। মায়ের কাছ থেকে যখন সে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন তার বয়স ছিল নয়। এখন সে ষোল বছরের পূর্ণ যুবতী। আর আল মালেকুস সালেহের বয়স এখন আঠারো। কৈশোর পেরিয়ে সেও এখন পরিপূর্ণ যুবক।
শামসুন্নেসার সঙ্গে ছিল আটজন রক্ষী। দাসীকে বাড়ীর ভেতর পাঠিয়ে দিয়ে রক্ষীসহ সে গেটেই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী মেয়ের সাথে সাক্ষাত করতে অস্বীকার করলেন। বাড়ির পুরনো দাসী মেয়ের পক্ষ হয়ে বলল, “মেয়েটি বহু দূরের পথ মাড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে আপনার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে কথা না বলুন, অন্ততঃ তাকে ভেতরে এসে বসতে বলুন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে না হয় সে ফিরে যাবে!’
‘আমার মায়া মমতা মরে গেছে।’ রাজিয়া খাতুন বললেন।
ইতিমধ্যে কামরায় এসে প্রবেশ করলো এক ষোড়শী মেয়ে। তার মুখে ও পোষাকে ধুলা লেগে আছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘ পথশ্রমে সে ক্লান্ত।
দীর্ঘক্ষণ গেটে দাঁড়িয়ে থেকে দাসীর অপেক্ষা করে অবশেষে সে নিজেই ঢুকে পড়েছে বাড়িতে।
রাজিয়া খাতুন নেকাবপরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সাথে বললেন, “তুমি! কে তুমি?’
মেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো মায়ের সামনে। দাসী এক দিকে সরে গেল। রাজিয়া খাতুন ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেলেন। তার বাহু দুটো নিজে থেকেই প্রসারিত হতে লাগলো। তার মুখ থেকে সহসা বেরিয়ে এলো ক্ষীণ কণ্ঠ, ‘তুমিই আমার কন্যা! আমার শামসুন্নেসা! আমার শামছি!’
তিনি এগুতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, “তুমি! তুমি এতো বড় হয়ে গেছো!’
শামসুন্নেসা দরোজার কাছে নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো। রাজিয়া খাতুন তার কন্যা থেকে দু’তিন কদম দূরে থাকতেই থেমে গেলেন। তার প্রসারিত হাত দুটো নেমে গেল নিচে। ঠোঁট থেকে হাসির রেখা অদৃশ্য হয়ে গেল। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর আবার দু’তিন কদম পিছিয়ে এলেন। যেনো কিছু দেখে ভয় পেয়েছেন তিনি।
তাঁর মুখের হাসি মলিন হয়ে সেখানে ফুটে উঠল রাগ ও গোস্বা। স্বাভাবিকভাবে যে মমতা ফুটে উঠেছিল চেহারায় সেখানেই তিনি জমা করলেন ক্ষোভ। ‘তুমি এখানে কেন এসেছো?’ মা চাপা অথচ রাগান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
‘মা!’ শামসুন্নেসা বিমর্ষ কণ্ঠে আর্ত চিৎকার করে বাহু প্রসারিত করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি, মা। আমি বারো দিনের সফর তিন দিনে শেষ করেছি। আমি তীর বেগে ছুটে এসেছি আপনাকে একটু দেখতে।’
ধমকে উঠলেন মা, ‘থাম, কেন এখানে এসেছো বলো?’
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়ে। মা আবার জোরালো কণ্ঠে বললেন, ’হ্যাঁ, আমার থেকে দূরেই দাঁড়িয়ে থাকো। আমি খৃস্টানদের ছায়ায় প্রতিপালিত মেয়েকে আমার কাছে আসতে দেবো না।’
‘মা! তুমি আমার কথা আগে শোনো।’ মেয়ে মিনতির স্বরে বললো, ‘দেখো আমার শরীরে এখনো পথের ধুলাবালি জমে আছে। আমি এই ধুলাবালি নিয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি কিছু কথা বলার জন্য।’
‘এই ধুলাবালির মলিনতার মধ্যে লেপ্টে আছে ইসলামের বীর মুজাহিদদের করুণ আর্তি। তাদের রক্তের ঘ্রাণ। আমার সন্তানের সৈন্যদের হাতে যারা শহীদ হয়েছে, জখম হয়েছে, আমার চোখে ভেসে উঠছে সেই নিবেদিতপ্রাণ মুখগুলো। গৃহযুদ্ধের বিভৎসতার কাছে তোমার এই মলিনতার কি মূল্য আছে?’
‘মা!’ শামসুন্নেসা দৌড়ে মায়ের পায়ের উপর আছড়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো, ‘মা, এই অভাগীর দিকে একটু তাকাও। আমার একমাত্র ভাই আল মালেকুস সালেহ মারা যাচ্ছে! সম্ভবত এতক্ষণে মারাই গেছে! সে মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে আর আপনাকে ডাকছে। ভাই-ই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে। সে বলেছে, ’যা, মাকে নিয়ে আয়। আমি তার দুধের দেনা ও পাপের ক্ষমা চেয়ে মরতে চাই।’
‘আমি তার দুধের দেনা ক্ষমা করে দিতে পারি।’ মা বললেন, ‘কিন্তু তার খুনের অপরাধকে কে ক্ষমা করবে? সে মুসলমানের সন্তান হয়ে মুসলমান ভাইদের হত্যা করিয়েছে। এক মা তার হকের অংশ ক্ষমা করে দিতে পারে কিন্তু সন্তানের গাদ্দারীর ক্ষমা করার কোন অধিকার তার নেই। এটা জাতীয় অপরাধ, জাতি কি তাকে ক্ষমা করবে?’
‘মা! সে তো আপনার একমাত্র পুত্র।’ শামসুন্নেসা বললো, ‘আপনার মহান স্বামীর একমাত্র নিদর্শন।’
‘সে তার পিতার মহান গৌরব খৃস্টানদের পদতলে ঢেলে দিয়েছে।’ মা বললেন।
‘মা, সে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সঙ্গে সন্ধি চুক্তিতে সাক্ষর করেছে। সুলতানের বাহিনীর সাথে তার সৈন্যদের পাঠিয়ে দিয়েছে জেহাদের ময়দানে। এখন আর কোন গৃহযুদ্ধ হবে না। আইয়ুবীর বশ্যতা সে মেনে নিয়েছে।’
‘তুমি কি শপথ করে বলতে পারো, তার আশেপাশে এখন আর কোন খৃস্টান সৈন্য বা উপদেষ্টা নেই? বলো, তার হেরেমে কি কোন খৃস্টান বা ইহুদী মেয়ে নেই? সে এখন আঠারো বছরের যুবক। তার ঘোড়াও বুঝতে পারে, তার পিঠের সওয়ার এক বীর পুরুষ। তুমি শুধু আমাকে এ আশ্বাসটুকু দাও, আমার ছেলের দরবার থেকে খৃস্টানদের অশুভ ভুতের ছায়া সরে গেছে। তা হলে তুমি যেমন বারো দিনের পথ তিন দিনে অতিক্রম করে ছুটে এসেছে মায়ের কাছে, আমি সে পথ দেড় দিনে অতিক্রম করে পৌঁছে যাবো ছেলের কাছে।’
‘এখন আর তার কোন মেয়ের দিকে নজর করার শক্তিও নেই মা! তার জীবনের জন্য তুমি দোয়া করো।’
‘আমি তার জন্য দোয়া করবো না। মা বললেন, ’আর বদ দোয়াও দেবো না।’