ইহুদী বণিক বললো, ‘এখানে মুসলমানদের দুটি বাড়ী আছে, যাদের সাথে আমার খুবই আন্তরিক সম্পর্ক। তোমার মত চিন্তা করলে তাদের বাঁচানোর অবদার করতে হয় আমাকে। তুমি কি চাও, আমি তাদের রক্ষার আবেদন জানাই।’
এক খৃষ্টান বললো, ‘এমন বন্ধুত্ব তো আমাদেরও আছে। কিন্তু আমি তাদের কাউকেই বাঁচানোর চিন্তা করছি না। যদি আমরা মুসলমানদের রক্ত চাই, তবে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা ভুলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোন কোন মুসলমান আমার ব্যক্তিগত বন্ধু হতে পারে কিন্তু তারা আমাদের ধর্মীয় এবং জাতীয় শক্র। যে কোন মূল্যে তাদের বিনাশই আমাদের সবার কাম্য।
জাভীরা জেদের সঙ্গে বললো, ‘কিন্তু আমি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই এ জন্য যে, সে আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। জীবনের বদলে সে জীবনই পাওনা। সে ওই দিন আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে না আনলে এখন আমি তোমাদের সাথে তর্ক করার জন্য বেঁচে থাকতাম না।’ জাভীরার কষ্ঠে উত্তাপ।
‘সে তোমাকে বাঁচিয়েছে বলে আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। এ জন্য আমরা তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দিতে অস্বীকার করিনি। তুমি নিজেও জানো, তাকে আমরা এমন পুরষ্কার দিতে চেয়েছিলাম, যা সে কল্পনাও করেনি। কিন্তু তাই বলে সাপকে তো মুক্তার মালা বানাতে পারি না!’
ইহুদী বণিক বললো, ‘আমাদের দায়িত্ব আমাদের পালন করতেই হবে। এখন সে আমাদের শত্রু, আমরাও তাদের শত্রু। যখন তার পুরস্কার পাওনা ছিল, তাই দিয়েছি। এখন আঘাত পাওনা হয়েছে, আঘাত পাবে, এ নিয়ে বিতর্কের কি আছে?’
‘আমি তাকে শত্রু মনে করি না।’ জাভীরা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আমার কাছে একটাই পুরুষ এসেছে, যে আমার দেহের প্রতি সামান্য লোভও করেনি। তোমরা তো সবাই পাপিষ্ঠা। তোমাদের মধ্যে এমন কে আছো যে আমার কাছে পবিত্র বলে দাবী করতে পারো? কিন্তু সে পারে। তার নিয়ত পবিত্র। আচরণ পবিত্র। সে শুদ্ধতম এক পবিত্র পুরুষ। এমন পুরুষকে আমি পূজা করতে পারি, আঘাত করতে পারি না।’
‘তুমি শুধু তানভীরকেই বাঁচাতে পারো।’ জাভীরার ক্রোধ ও জেদ দেখে ইহুদী বণিক বললো, ‘কিন্তু কি করে তাকে বাঁচাবে? কি ঘটতে যাচ্ছে যদি তুমি তাকে তা বলে দাও, সে কি তখন চুপচাপ বসে থাকবে? সে কি সমস্ত লোককে তা বলে দেবে না?’
বৃদ্ধ খৃস্টান বললো, ‘আর তার সমস্ত পরিবারকে সরে যেতে বললে তারা কি এর কারণ জিজ্ঞেস করবে না?’
‘হ্যাঁ তাই।’ অন্য একজন বললো, ‘এক মুসলমানের বদলা আদায় করতে গিয়ে কি তুমি সমস্ত মুসলমানকে সতর্ক করতে চাও? যারা আমাদের জন্য বিপদের কারণ তাদের বাঁচিয়ে দিতে চাও?’
‘আমাকে অত বোকা মনে করো না।’ জাভীরা বললো, আমি কি আমার জাতিকে ভালবাসি না? জাতির জন্য আমি কি কোনই ত্যাগ ও কোরবানী করিনি? বিষয়টা আমার ওপর ছেড়ে দাও, আমাকে দিয়ে কখনও খৃস্টান ও ইহুদীদের ক্ষতি হবে না।’
আক্রমণের দিন সন্ধ্যায় জাভীরা তানভীরের বাড়ী গেল। সে তাকে বাড়ীর বাইরে নিয়ে এলো। তানভীর জানতেই পারল না, সারা রাত তার গ্রামে কি ঘটলো। কি তুফান বয়ে গেল তার বাড়ীর ওপর দিয়ে।
রাতের অধিকাংশ সময় জাভীরা কোথায় থাকে কোথায় যায়, তার লোকেরা সব জানতো। জাভীরা তার লোকদের জানিয়েছিল, তানভীরের সাথে ভালবাসার ভান করে সে তার কাছ থেকে অনেক গোপন তথ্য আদায় করছে। ওই রাতে সে যখন তানভীরকে বাইরে নিয়ে গেল তখন গ্রামের এক ইহুদী যুবক গোপনে তাকে লোকালয়ের বাইরে বেরিয়ে যেতে দেখলো। যুবকটি একাকী তাকে গ্রামের বাইরে যেতে দেখে তার পিছু নিয়েছিল। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর অন্ধকারে তাকে হারিয়ে ফেলল। তাই যুবকটি জাভীরার নাম ধরে বার বার ডাকছিল।
জাভীরা সে ডাক শুনে তানভীরকে নিয়ে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। সে তাকে এতটা দূরে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল, যেখানে তাদের কানে গ্রামের লোকদের শোরগোল শোনা না যায়। জাভীরার অনুসন্ধানে যে যুবক বেরিয়েছিল, পাহাড় পর্যন্ত গিয়ে তাকে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এলো যুবক।
গ্রামের লোকজন এশার নামাজের পর খেয়েদেয়ে শোয়ার উদ্যোগ করছিল। শিশুরা অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। খৃস্টান পদাতিক সৈন্য ও অশ্বারোহী বাহিনী গোপনে নিঃশব্দ বিড়ালের মত পা টিপে টিপে লোকালয়ের কাছে পৌঁছে গেল। সে এলাকার লোক সংখ্যায় কয়েকগুণ বেশী ছিল সৈন্যদের সংখ্যা। পদাতিক বাহিনী যখন গ্রামের কাছে এসে ঘিরে ফেলল সাৱা গ্রাম, তখন অশ্বারোহী বাহিনী পিছন থেকে ছুটে এলো তীব্র বেগে। তারা এসে ঘুমন্ত মানুষের উপর তুফানের বেগে আক্রমণ করলো। অশ্বারোহীরা মশাল হাতে ছুটে গেল মুসলমানদের বাড়ী ঘরের দিকে। তারা কয়েকটি বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিল যাতে সারা গ্রাম আলোকিত হয়ে যায়।
খৃষ্টান পদাতিক সেনারা বাড়ীর দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো। বেশীর ভাগ মুসলমান জেগে উঠার আগেই নিহত হলো। যারা শোরগোল শুনে জেগে উঠে হাতিয়ার নেয়ার সুযোগ পেল, বাঁচতে পারলো না তারাও। বরং অস্ত্র হাতে লড়াই করে শহীদ হয়ে গেলো তারা।
বৃস্টান অশ্বারোহীরা গ্রাম ঘিরে রেখেছিল। কেউ পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলে তার ভাগ্যে জুটতো বর্শা ও তলোয়ারের আঘাত। আর সেই আঘাত তাকে এনে দিত শহীদের মর্যাদা।
লাঞ্ছিত হচ্ছিল মেয়েরা। যারা বাঁধা দিত তারা ঢলে পড়তো মৃত্যুর কোলে। এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি শিশুরাও। মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকেও ওরা নির্মমভাবে হত্যা করতো। এই ছিল সেই চিৎকার ও আর্তনাদ, যে আর্তনাদের শব্দ পাহাড়ের পিছন থেকে তানভীর শুনতে পাচ্ছিল।
তার বাড়ীঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরিবারের সবাই নিহত হয়েছিল সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞে। সম্রাট বিলডন এভাবেই তার হিম্মতের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল। গ্রামের নিরীহ ও ঘুমন্ত মানুষগুলোকে হত্যা করে পুষিয়ে নিল তার ক্ষোভ ও ক্ষতির সিংহভাগ।
“তুমি আজ আমাকে এত দূর কেন নিয়ে এলে?’ তানভীর জাভীরাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আজ তুমি কিছুই বলছ না যে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’
‘এই কারণে যে, তুমি আমার সাথে থাকবে কিনা জানি না।’ জাভীরা খুব চালাক মেয়ে। সে বলতে লাগলো, ‘আমি তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যেতে চাই। তুমি যদি আমার সাথে না যাও তাহলে আমি একা এই অন্ধকার রাতে কেমন করে সেখানে যাবো?’
‘কোথায় যাবে? কেন যাবে?’
‘কেন, তোমার কি আমার উপর বিশ্বাস নেই?’ জাভীরা তাকে বাহু বেষ্টনীতে নিয়ে বললো, ‘আমরা কালকেই আবার ফিরে আসবো।’
তানভীর স্তম্ভিত বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। জাভীরার কথার মাথামুণ্ডু সে কিছুই বুঝতে পারছিল না।
জাভীরার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পাচ্ছিল তানভীর। তার মুখে কাঁধে ছড়িয়েছিল জাভীরার রেশম কোমল চুল। এটা সেই চুল, গুহায় হাত-মুখ ধুয়ে আসার পর যে চুল দেখে তানভীর প্রথম নিজের মধ্যে বিস্ময় বোধ করেছিল।
এখন তো জাভীরা তার ভালবাসা দিয়ে তানভীরকে পুরোপুরি জয় করে নিয়েছে। তানভীর তার অন্তরের গভীরে এখন সর্বদাই জাভীরার ভালবাসা টের পায়। এ ভালবাসা এখন তার কাছে নেশার মত হয়ে গেছে। যার জন্য সব সময় তার মন উন্মুখ হয়ে থাকে। মনে হয়, এ ভালবাসার নামই জীবন। যেখানে এ ভালবাসা নেই, সেখানে জীবনেরও কোন দরকার নেই। তানভীর আকাশের তারকারাজির দিকে তাকিয়ে জীবনের এই উষ্ণ মধুর কথাই ভাবছিল।
‘আমরা আর কতকাল এভাবে চোরের মত মেলামেশা করতে থাকবো?’ জাভীরার প্রশ্নে ধ্যান ভাঙল তানভীরের। সেও স্বগতোক্তির মত উচ্চারণ করলো, ‘তাইতো! আমরা আর কতকাল এভাবে চোরের মত মেলামেশা করবো?
জাভীরা নিজেকে তানভীরের কোলে সঁপে দিয়ে বলল, ‘এখন যে আমি তোমাকে ছাড়া আর চলতে পারি না। যদি তোমার অন্তরে আমার জন্য ভালবাসা থেকে থাকে তবে কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছে, আমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? তুমি কি আমার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখো না?’
‘জাভীরা, বিশ্বাসের কথা যদি বলো তবে বলতে হয়, আমি নিজেকে যতটা বিশ্বাস করি, তোমাকে বিশ্বাস করি তারচেয়ে বেশী। বিশ্বাসের জন্য নয়, এমনি জানতে চাচ্ছিলাম, তুমি কোথায় যেতে চাও?’
‘ধরো, তোমাকে আমি এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখানে আমাদের মাঝে ধর্মের কোন প্রাচীর খাঁড়া থাকবে না।’
‘ধর্মের কথা তুলছো কেন? ধর্ম তো আমাদের মিলনের পথে কোন অন্তরায় নয়। আমার ধর্ম আহলে কিতাবদের মধ্যে বিয়ে বৈধ গণ্য করে। ধর্ম নয়, বলো সমাজ এটা ভাল চোখে দেখবে না।’
‘তুমি পুরুষ মানুষ! তোমার কথা আলাদা। তুমি আমার দিকে তাকাও! আমি অতি দুর্বল এক মেয়ে। তারপরও শুধু তোমার জন্য কত বড় ঝুঁকি আমি নিচ্ছি তা ভাবতে পারো?’
‘কি ঝুঁকি?’
‘আমি তোমাকে নিয়ে দেশান্তরী হতে চাই। আর সেটা আজ এবং এক্ষুণি।’
‘কেন! কেন আজই পালাতে হবে আমাদের? আমার তো মনে হয়, আমাদের পরিবার তোমার আমার মিলনকে কষ্ট হলেও মেনে নেবে?’
‘দেখো, সব কিছু জানতে চেও না, সব কিছু বুঝতে যেও না। যদি তেমন কোন দরকার না হতো তবে এমন দাবী আমি করতাম না। শুধু জেনে রাখো, আজ এবং এক্ষুণি এখান থেকে আমরা পালাতে না পারলে আর কোনদিন তুমি আমাকে পাবে না।’
জাভীরার এ কথায় কেঁপে উঠল তানভীরের অন্তর। আসলে এখন দুর্বল যদি কাউকে বলতেই হয়, সে তানভীর। জাভীরা এখন তার জ্ঞান ও বিবেকের উপর কর্তৃত্ব করছিল। সে চেষ্টা করছিল, যেন তানভীর আর গ্রামে ফিরে না যায়। কারণ সে জানে, তানভীরের বাড়ী এতক্ষণে ছাই হয়ে গেছে। সেই ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে আছে তার স্বজনদের পোড়া লাশ। এ দৃশ্য তানভীর সইতে পারবে না। হয়তো এ দৃশ্য দেখলে সে পাগল হয়ে যাবে। হয়তো এর পেছনে জাভীরার ষড়যন্ত্র আছে বলে সন্দেহ করে বসবে। হয়তো সেই সন্দেহের বশে উন্মত্ত তানভীর তাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। তাই জাভীরা চাচ্ছিল, তানভীর আর গ্রামে ফিরে না যাক।
এতে কোন সন্দেহ নেই, একমাত্র ভালবাসার খাতিরেই জাভীরা তাকে এ দুর্যোগ থেকে বাঁচিয়েছে। খৃষ্টানদের কাছে যদিও সে বলেছে, তাকে সসম্মানে হেমসে নিয়ে আসার ঋণ শোধ করার জন্যই সে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাকে খৃস্টানদের কবল থেকে রক্ষা করতে চায়, সেটা ছিল তাকে বাঁচানোর একটা কৌশল। সেটা ছিল বিশ্বাসযোগ্য একটা অজুহাত। কিন্তু প্রকৃত সত্য জানতো তার অন্তর। হৃদয়ে ভালবাসার ফুল না ফুটলে এসব কৃতজ্ঞতাবোধ কবেই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেতো।
এই ভালবাসাই এখন তাকে প্ররোচিত করছিল তানভিরকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। যে ভালবাসা তাকে বাধ্য করেছে তানভীরের জীবন বাঁচাতে, সেই ভালবাসাই তাকে বলছিল, জাভীরা, পালাও। এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও তানভীরকে। নইলে সে তার বাড়ী ঘর ও আত্মীয় স্বজনের ধ্বংস ও মৃত্যু দেখে যে কষ্ট পাবে, তার ধকল সে সইতে পারবে না। এ কষ্ট পাওয়ার কবল থেকে তাকে রক্ষা করো। পাগল হওয়ার হাত থেকে বাঁচাও তাকে। এমন সুন্দর মনের মানুষ এত ধ্বংসলীলা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।
জাভীরার শেষ কথা, ‘নইলে তুমি আর কোন দিন আমাকে পাবে না’র কোন কারণ বুঝতে পারছিল না তানভীর। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিল, যে কোন কারণেই হোক, জাভীরা আজ অশান্ত, অস্থির। হয়তো এমন কোন কারণ ঘটেছে, যা তার জানা নেই।
তানভীর চুপচাপ বসেছিল। উঠে দাঁড়াল জাভীরা। তার হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বললো, ‘চলো।’
জাভীরা যাত্রা শুরু করলো। তানভীর তার সাথে এমনভাবে চললো, যেন তাকে কেউ জাদু করেছে। মোহগ্রস্ত মানুষের মত তাকে টেনে নিয়ে চললো জাভীরা, তানভীর বোবা মানুষের মত তার সাথে সাথে চলল।
যখন সকাল হলো তখন হেমসের গ্রামে জ্বলন্ত ছাইয়ের গাদা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেখানে কোন মুসলমানই জীবিত থাকতে পারেনি। খতিব এবং তার সঙ্গীরাও সকলেই কেউ ঘুমন্ত অবস্থায়, কেউ লড়াই করে শহীদ হয়ে গেছে।
জাভীরা তানভীরকে সঙ্গে নিয়ে খৃষ্টানদের এক ক্যাম্পে গিয়ে উপনিত হলো। ততোক্ষণে তানভীরের ঘোর কেটে গেছে। সে জাভীরাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে কি জন্য এসেছো।’
‘এতো অস্থির হচ্ছো কেন? একটু দাঁড়াও, দেখো কি করি? কেন এসেছি।’
চুপ করে গেল তানভীর। জাভীরা তাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে বললো, ‘তুমি একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।’
সে একটু দূরে ক্যাম্পের গেটে গেল। সেখানে সে সৌভাগ্যক্রমে ক্যাম্পের এক কমাণ্ডারকে পেয়ে গেলো। সে কমাণ্ডারের সাথে কি কথা বললো তানভীর শুনতে পেলো না। কিন্তু দেখতে পেলো কমান্ডার তাকে হাতের ইশারায় কোন রাস্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে।
জাভীরা ফিরে এলো তানভীরের কাছে। বললো, ‘চলো।’ তানভীরকে সঙ্গে নিয়ে সে কমাণ্ডারের দেখানো পথে হাঁটা ধরলো।
এটাই ছিল সম্রাট বিলডনের ক্যাম্প! সম্রাটের তাঁবুও এখানেই ছিল। তখনকার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সম্রাটের তাঁবু রাজমহলের মতই সুসজ্জিত থাকতো। রক্ষী ও গার্ডরা অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করার পর জাভীরাকে সম্রাট বিলডনের ক্যাম্পে যেতে দিল। তানভীরকে বাইরে রেখে ক্যাম্পের ভেতর ঢুকে গেল জাভীরা। কিছুক্ষণ পর এক রক্ষী এসে তানভীরকেও ভেতরে ডেকে নিলো।
সম্রাট বিলডন তাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, ‘এই মেয়েটা তোমাকে তার সাথে রাখতে চায়। সে তোমার জন্য এমন ব্যগ্র যে, তোমাকে না পেলে সে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসতে পারে। আমি তার মনের ভাব বুঝতে পারছি। এ জন্যই আমি তার ইচ্ছায় বাঁধা দিতে পারছি না। আমার মনে হয়, তোমার মনের অবস্থাও একই রকম। নইলে তুমি তার সাথে এখানে আসতে না। তোমাদের দুজনের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই আমি তার আবদার মঞ্জুর করলাম। এখন তোমরা এখানে কোন প্রকার ভয় ও সংশয় ছাড়াই থাকতে পারবে।’
‘আমি আমার ধর্ম পরিবর্তন করবো না।’ তানভীর বললো।
‘তোমাকে ধর্ম পরিবর্তনের কথা কে বলেছে?’ জাভীরা বললো।
‘এখানে থেকে কি হবে? তানভীর জিজ্ঞেস করলো, আর এখানে আমার করার কি আছে? কেন আমি এখানে থাকবো? না, আমি এখানে থাকতে চাই না। আমি আমার বাড়ীতে ফিরে যেতে চাই।’
‘তানভীর! জাভীরা তার দিকে গভীর চোখে চেয়ে বললো, ‘আমার দিকে তাকাও। আমি কি তোমাকে বলিনি, আমাদের দুনিয়া এখন এক হয়ে গেছে। বাঁচতে হলে আমরা দুজন এক সাথেই বাঁচবো, মরতে হলেও এক সাথে মরবো? তুমি কি জানো, এখানে ছাড়া আর কোথাও আমার জীবন নিরাপদ নয়? মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যই আমি এখানে ছুটে এসেছি। আমার বাবা আমাকে পেলে খুন করে ফেলবে। সে তোমার আমার মিলন মেনে নিতে পারছে না। কাল রাতে পালাতে না পারলে এতক্ষণে আমি আমার বাবার গৃহে বন্দী হয়ে যেতাম।’
তানভীর জাভীরার উত্তেজিত ও আবেগময় কথা শুনে আর কিছুই বলতে পারলো না। সে মাথা নিচু করে নিল।
❀ ❀ ❀
ইয়াজুদ্দিনের দূত সুলতান সালাহউদ্দিনের কাছে পাঠানো চিঠির মৌখিক উত্তর নিয়ে ইয়াজুদ্দিনের কাছে পৌঁছে গেল। দূতের কাছ থেকে সব কথা শুনলেন ইয়াজুদ্দিন। সুলতান আইয়ুবীর পরামর্শ অনুসারে ইয়াজুদ্দিন ইবনে লাউনের সাথে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হলেন। বৈঠকে তিনি তাকে আশ্বাস দিলেন, ‘আমি আপনার সাথে বন্ধুত্ব কায়েম করতে চাই।’
‘কিন্তু আমি জানি সুলতান আইয়ুবী এদিকেই আসছেন। সম্ভবত তিনি আপনাকে সাহায্য করার জন্যই ছুটে আসছেন। এ অবস্থায় আপনি এমন প্রস্তাব কেন দিচ্ছেন?’
‘যেহেতু আমি জানি, সুলতান আইয়ুবী কোন সাধারণ যোদ্ধা বা শাসক নন। তিনি যেখানেই যান সেখানেই তার শাসন কায়েম করে নেন। এখানে আমাকে সাহায্য করার নামে তিনি এলেও শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, এখানেও তিনি তারই শাসন জারি করছেন। তখন তার মোকাবেলা করার কোন সাধ্য আমার থাকবে না। বাধ্য হয়ে আমাকে আমার শাসনভার তার হাতে অর্পণ করে দিতে হবে। অপর পক্ষে আপনি আমার প্রতিবেশী। আপনার সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের না হলেও আপনি আমার রাজ্য গ্রাস করতে আসেননি। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে টুকটাক মনোমালিন্য হলেও তা পারস্পারিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু কোন বৃহৎ শক্তি আমাকে আজ পদানত করলে কাল ধরবে আপনাকে। এ জন্যই এ আজদাহার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের নিজেদের ক্ষুদ্র ভেদাভেদ ভুলে আজ ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। রাজনীতিতে চিরন্তন শত্রু বা বন্ধু বলে কিছু নেই। অবস্থা ও পরিস্থিতির আলোকে বন্ধুও কখনো শক্ত হয়ে যায় আবার শত্রু হয় বন্ধু। বাস্তবতা আজ আমাদেরকে বন্ধু হওয়ার জন্য বলছে। নইলে আমরা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’
‘কিন্তু সুলতান আইয়ুবীকে সামলাবেন কেমন করে?’
‘সেটা এখনি বলতে পারছি না। যদি আপনি আমার বন্ধুত্ব কবুল করে নেন তবে আপনার সাথে পরামর্শ করেই তা ঠিক করবো। প্রয়োজনে তাকে ধোঁকা দিয়ে এমন অবস্থায় ফেলবো যে, তিনি আমাদের এ এলাকা দখল করার সংকল্প পাল্টাতে বাধ্য হবেন। মুখোমুখি লড়াই করে খৃস্টানদের বড় বড় সম্রাটও তার কাছে হেরে গেছেন। এ অবস্থায় তাকে বেকায়দায় ফেলার একমাত্র উপায় বন্ধু বেশে তাকে কোন কঠিন ফাঁদে ফেলা।’
“আপনার চিন্তা সঠিক। আমি আপনার বন্ধুত্ব কবুল করে নিলাম। কিন্তু আপনিও স্বীকার করবেন, বিপদটা প্রাথমিকভাবে আপনার ওপরই এসে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে আমি আপনার সহযোগী হলে এবং আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুলতান আইয়ুবীকে নিঃশেষ বা প্রতিহত করা গেলে আমার কি লাভ হবে?’
ইয়াজুদ্দিন কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। শেষে বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি অযৌক্তিক কিছু বলেননি। আমাদের মিলিত চেষ্টায় আমি বেঁচে গেলে আপনারও কিছু লাভ হওয়া দরকার। আমি কথা দিচ্ছি, যদি আমরা সফল হই তবে আমি আমার শস্য শ্যামল উর্বর অঞ্চল ‘কারা হেদা’ আপনাকে দান করবো। আমার এ আশ্বাসের ওপর আপনার আস্থা না থাকলে এ ব্যাপারে আমি লিখিত চুক্তি করতে সম্মত আছি।’
শস্য শ্যামল উর্বর এলাকা কারা হেদার নাম শুনেই ইবনে লাউনের মুখে আলোর আভা ফুটে উঠলো। তিনি বললেন, ‘আপনার কথার ওপর আমার আস্থা আছে। বিষয়টা গোপন থাকলেই কেবল সুলতান আইয়ুবীকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব। তাই এ আলোচনার বিষয় কোথাও প্রকাশ করা উচিত নয়। চুক্তিপত্র করে কোন দলীল রাখাও ঠিক নয়।’
এভাবেই ইবনে লাউনের সাথা ইয়াজুদ্দিনের এক গোপন চুক্তি হয়ে গেল। এ চুক্তির কারণে ইবনে লাউনের আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে গেলেন ইয়াজুদ্দিন।
তার কিছুদিন পরই সুলতান আইয়ুবী স্বসৈন্যে এসে কারা হেদার কাছে তার সেনা-ক্যাম্প স্থাপন করলেন। বিরতিহীনভাবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সুলতানের বাহিনী খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সুলতান বিশ্রামে বেশী সময় নষ্ট করার পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, আক্রমণে দেরী করলে ইবনে লাউনের কাছে খবর পৌঁছে যাবে যে, সুলতান আইয়ুবী স্বসৈন্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সে অবস্থায় মোকাবেলার জন্য ইবনে লাউন প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে।
তিনি মনে করছিলেন, ইবনে লাউনের সাথে কঠিন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে তাকে। এই ভয়ে তিনি হলব থেকেও চুক্তি অনুসারে কিছু সৈন্য সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এ চুক্তি তিনি করেছিলেন আল মালেকুস সালেহকে পরাজিত করার পর।
মধ্য রাতের পর সুলতান আইয়ুবী তার সৈন্যদেরকে আক্রমণের আদেশ দিলেন। পোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে তিনি জেনে নিয়েছিলেন, আরমেনিয়ান সীমান্ত ফাঁড়িতে কি পরিমাণ সৈন্য আছে। তিনি সীমান্ত ফাঁড়িগুলোর অবস্থানও জেনে নিয়েছিলেন। কারা হেদা পৌঁছেই তিনি ইয়াজুদ্দিনের সাথে দেখা করে তাকে প্রকৃত অবস্থা অবহিত করেন।
সুলতান আইয়ুবীর আক্রমণ ছিল ছয় দিক থেকে। ছয়টি সীমান্ত চৌকিতে ছয় গ্রুপ এক যোগে আক্রমণ করার জন্য রওনা হয়ে গেল। প্রত্যেক গ্রুপের সাথে সুলতানের নিশান বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ইয়াজুদ্দিনের লোক। কৃষ্ণ নদীর দিক থেকে যে গ্রুপটি মাখজাতুল আহামে আক্রমণ চালিয়েছিল, সুলতান আইয়ুবী ছিলেন সেই গ্রুপের সাথে।
এ নদীটি ছিল ইবনে লাউনের সীমান্ত বরাবর। ইয়াজুদ্দিনের সহযোগিতায় সুলতান নদীর উপর নৌকার পুল বানিয়ে নিলেন। নদীর অপর পারেই ছিল আর্মেনীয়দের দুর্গ মাখজাতুল আহাম। ইবনে লাউন এ কেল্লাতেই অবস্থান করছিলেন।
তাকে শেষ করতে পারলে সমস্ত এলাকাই দখল হয়ে যায়, এ কথা ভেবেই সুলতান আইয়ুবী এ গ্রুপের সাথে ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে গ্রুপের কমাণ্ড করছিলেন না, এ গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুলতান আইয়ুবীর ভাতিজা ফররুখ শাহের হাতে।
এই ফররুখ শাহও ছিলেন অসাধারণ রণকুশলী ও বীর যোদ্ধা। তিনি বীর বিক্রমে আক্রমণ করলেন মাখজাতুল আহামে। ফাঁড়ির শত্রু-সৈন্যরা এ আকস্মিক হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা বাঁধা দিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারল না। ফররুখ শাহের বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে কেউ কেউ নিহত হলো। কতক সৈন্য মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য বন্দীত্ব কবুল করে নিল।
ফররুখ শাহ ফাঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। মুহূর্তে আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। ফাঁড়ির চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো আতংক। সেই আতংক আরো বাড়িয়ে দেয়ার জন্য ফাঁড়ির পাশে গড়ে উঠা বস্তিতেও আগুন ধরিয়ে দিল ফররুখ শাহের সৈনিকরা।
ইবনে লাউনের ঘুম যখন ভাঙল তখন তিনি দেখতে পেলেন সুলতান আইয়ুবীর জানবাজ সৈন্যরা রশি বেয়ে তার কেল্লার প্রাচীর টপকে ভেতরে লাফিয়ে পড়ছে। তাদেরই কয়েকজন ছুটে গিয়ে কেল্লার গেট খুলে দিল। এর আগেই মিনজানিক দিয়ে নিক্ষেপ করা পাথরের আঘাতে কেল্লার ফটক ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ফলে ফটক প্রহরীরা সরে পড়েছিল সেখান থেকে।
ইবনে লাউন দৌড়ে কেল্লার এক মিনারের উপর উঠলেন। মিনারে উঠে চারদিকে তাকিয়ে তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন। তার চোখে ভেসে উঠল সীমাহীন আগুনের লেলিহান শিখা। তিনি তখনও চিন্তা করে কোন কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না কি ঘটছে। কারা কেল্লা আক্রমণ করেছে, এখন তিনি কি করবেন, এসব যখন ভাবছিলেন তিনি, তখনই সুলতান আইয়ুবীর এক জানবাজ সৈন্য মিনারে উঠে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। নিরস্ত্র ইবনে লাউন বন্দী হয়ে গেলেন। সেই সাথে আত্মসমর্পন করলো কেল্লার বাদ বাকী সৈন্য।
যখন সকাল হলো, ইবনে লাউনকে হাজির করা হলো সুলতান আইয়বীর সামনে। সুলতান আইয়ুবী তাকে বললেন, ‘আমাদের সৈন্যরা সীমান্তের সব কটা ফাঁড়িতেই আক্রমণ করেছে। ইতিমধ্যেই হয়তো সে সব ফাঁড়িও আমাদের দখলে চলে এসেছে। আমি জানতে চাচ্ছি, সব কটা ফাঁড়িই কি আমাদের লড়াই করে জিততে হবে, নাকি এখনো যেসব ফাঁড়ির পতন হয়নি, তুমি সে সব ফাঁড়ির সৈন্যদের হাতিয়ার সমর্পন করতে বলবে?’
‘আমি তাদেরকে এখুনি অস্ত্র সমর্পন করার চিঠি দিচ্ছি।’
‘কিন্তু এ চিঠি কে তাদের কাছে বহন করে নিয়ে যাবে।’ এ সময় সামনে এগিয়ে এলেন ইয়াজুদ্দিন। বললেন, ‘সুলতান, এ দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।
ইবনে লাউন চিঠি লিখলেন। সেই চিঠি বয়ে নিয়ে গেল তার কাসেদ, সঙ্গে গেল ইয়াজুদ্দিনের লোক। চিঠিতে তিনি পত্র পাওয়া মাত্র সুলতানের বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পন করতে বললেন সব ফাঁড়ি প্রধানদের। পত্র পেয়ে তারা অস্ত্র সমর্পন করে দলে দলে মাখজাতুল আহাম কেল্লায় এসে সমবেত হতে লাগলো।
ইবনে লাউনের সেনাবাহিনীর সদস্যরা দলে দলে কেল্লায় এসে সমবেত হচ্ছিল। ইয়াজুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীকে বললেন, ‘ইবনে লাউনের সাথে আমার একটি অলিখিত চুক্তি ছিল। যদিও এখন আর সেই চুক্তির কোন দাম নেই তবু বিষয়টি নিয়ে তার সাথে একটু আলাপ করা দরকার। আমার মনে হয়, তার সাথে আমরা নতুন শর্তে চুক্তিবদ্ধ হতে পারি।’
তারা কেল্লার ভেতরেই সন্ধির শর্ত নিয়ে বৈঠকে বসলেন। আইয়ুবী ইবনে লাউনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘কার্যত এখানে এখন আমার কাজ হওয়া উচিত আপনার কাছ থেকে এলাকার শাসন ভার বুঝে নেয়া। কিন্তু আপনাকে নিরস্ত্র ও বিতাড়িত করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি খুবই সহজ শর্তে আপনাকে আপনার এলাকা ফিরিয়ে দিতে চাই। আপনি কি আমার কাছ থেকে সে সব শর্ত শুনতে আগ্রহী?’
ইবনে লাউনের মনে হলো তিনি ভুল শুনছেন। বিজিত রাজ্য কেউ স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দেয়, এমন কথা তিনি বাপের জন্যে শুনেননি। ভাবলেন, সুলতান তার সাথে মশকরা করছেন। বললেন, ‘আপনি বিজয়ী বীর। যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আপনি রাখেন। একজন পরাজিত শাসককে আপনি নিকৃষ্ট কোন শাস্তি না দিলে সেটাই হবে আমার বড় পাওনা। আপনাকে মহানুভব বলেই জানি। আপনার সেই মহত্ব ও মহানুভবতা ক্ষুন্ন না হলেই আমি খুশী হবো। আপনি আমার জন্য কি শান্তি নির্ধারণ করেছেন তা শোনার মত মানসিকতা আমার এখনো আছে।’
‘হ্যাঁ, এটাকে আপনি এক ধরনের শাস্তিই বলতে পারেন। আপনাকে আমি অবসর জীবন যাপনের সুযোগ দিতে চাই না। আমি কয়েকটি শর্তে আপনার রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চাই।’
‘কি শর্ত?’ বিষন্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন ইবনে লাউন।
‘এক, আপনাকে ইসলামী খেলাফতের আনুগত্য মেনে নিতে হবে। এ আনুগত্যের প্রমাণ স্বরূপ আপনাকে বাৎসরিক নির্ধারিত হারে জিজিয়া দিতে হবে।
দুই, আপনার অর্ধেক সৈন্য আমার হেফাজতে দিয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যতে কখনো ইসলামী হুকুমতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে পারবেন না।
তিন. খৃষ্টান এবং ইসলাম বিরোধী কোন শক্তির সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবেন না।
চার, পার্শ্ববর্তী ইসলামী শাসকদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবেন এবং বিপদে আপদে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবেন।
পাঁচ, সীমান্তে আপনি চৌকি স্থাপন করতে পারবেন তবে কোন চৌকিতে কখনো দুইশতের অধিক সৈন্যের সমাবেশ ঘটাতে পারবেন না।
ছয়, মাখজাতুল আহাম দূর্গ গুড়িয়ে দেয়া হবে। আপনি আপনার অঞ্চলের মধ্যভাগে আপনার মূল কেন্দ্র বানিয়ে রাজ্য পরিচালনা করবেন, যাতে সকল অঞ্চল সমভাবে আপনার সেবা পেতে পারে।’
তিনি সানন্দে এসব শর্ত মেনে নিলেন এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক তিনি তার হারানো রাজ্য পুনরায় ফিরে পেলেন। কিন্তু এসব শর্তের ফলে ইবনে লাউন নামে মাত্র শাসক থাকলেন।
ইবনে লাউনের সৈন্যরা কেল্লার সামনে সমবেত হয়ে অস্ত্র সমর্পন করলো। সুলতান আইয়ুবী তাদের আদেশ দিলেন, ‘এ কেল্লা ভেঙ্গে মিসমার করে দাও, যাতে এখানে তার কোন চিহ্নও না থাকে।’
পরাজিত সৈন্যরা তৎক্ষণাৎ কেল্লা ভাঙা আরম্ভ করে দিল।
সুলতান আইয়ুবী মুসাদা নামক এক পাহাড়ের কাছে তার সৈন্যদের নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি হলবের সৈন্যদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, “যেমন দ্রুত এসেছিলে তেমনি দ্রুত ফিরে যাবে।’
নিজের সৈন্যদেরকে পূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে তিনি ফিরলেন ইবনে লাউনের সৈন্যদের দিকে। ইবনে লাউনের যে অর্ধেক সৈন্য তিনি সাথে নিয়ে এসেছিলেন তাদেরকে ইয়াজুদ্দিনের হেফাজতে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এদেরকে বুঝিয়ে বলো, মুসলমানরা কেন যুদ্ধ করে। রাজ্য জয় বা গনীমতের মালের জন্য যে আমরা যুদ্ধ করি না এ কথা তাদের বুঝতে হবে। তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত।’
সুলতান আইয়ুবী সব কাজ সমাধা করে ফিরে গেলেন নিজের তাঁবুর কাছে। কিন্তু তিনি তখনো জানতে পারেননি, তিনি যে পর্বতমালার পাশে সৈন্য সমাবেশ করেছেন, সেই পর্বতমালার ওপারে বিলডনের বাহিনী এসে পৌঁছে গেছে। তারা সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ আয়োজনে ব্যস্ত।
ইবনে লাউনের পরাজয়ের পর সুলতান আইয়ুবী সে এলাকায় আর সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। কারণ ইবনে লাউন ছাড়া সেখানে কোন শত্রু সৈন্যের ভয় বা আক্রান্ত হওয়ার আশংকা ছিল না।
কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধই। কখন কেমন করে কার ঘাড়ে বিপদ লাফিয়ে পড়বে সে কথা কেউ আগে থেকে বলতে পারে না। অনেক সমরবিদ লিখেছেন, সুলতান আইয়ুবী যদিও জানতেন না, সম্রাট বিলডন আশপাশেই কোথাও ক্যাম্প করে আছেন, তবু তার এতটা অসতর্ক হওয়া উচিত হয়নি। যদি বিলডন তার পরিকল্পনা মত সুলতানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পেতেন তবে এখানেও রমলার ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটতো। কিন্তু সুলতানের ওপর আল্লাহর বিশেষ রহমত ছিল, তাই এক অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
ঘটনা হচ্ছে, সম্রাট বিলডন সময় মতই সুলতান আইয়ুবীর দিক পরিবর্তনের খবর পেলেন। তিনি তাঁর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কুশলী সেনানায়কের মতই ওঁৎ পাতলেন সুলতানের এগিয়ে যাওয়ার পথে। সুলতান যখন মুসাদা নামক পাহাড়ের পাদদেশে তাঁর বাহিনীকে পরিপূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ দিলেন তখন বিলডন তার বাহিনী নিয়ে সেই পাহাড়ের উল্টো পাশে সৈন্য সমাবেশ ঘটালেন। তারপর রাতের আঁধারে তিনি তার বাহিনীকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাওয়ার হুকুম দিলেন। সন্তর্পনে সম্রাট বিলডনের বাহিনী পাহাড়ের চুড়ায় গিয়ে অবস্থান নিল। পুরো বাহিনী পাহাড়ে উঠতে এবং অবস্থান নিতে নিতেই ভোর হয়ে গেল। বিলডন সে রাতে আক্রমণ না করে পরিপূর্ণ প্রস্তুতিসহ আগামী রাতে বেপরোয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিল।
সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদল পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু টানিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবী তখনো জানতে পারেননি, সম্রাট বিলডন তার মাথার উপর বসে আছেন। সুলতানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অস্ত্র শানাচ্ছেন।
পাহাড়ের উপর থেকে বিলডনের সৈন্যরা সুলতান আইয়ুবীর তাঁবুর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। তারা বিলডনকে জানাচ্ছিল সুলতানের বাহিনীর অবস্থান ও সৈন্যের পরিমাণ। এই প্রথম সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা নিষ্ক্রিয় ছিল। নির্বিঘ্নে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সুলতান ও তার বাহিনী।
তানভীর তখনো বিলডনের বাহিনীর সাথেই ছিল। জাভীরা তখনো তাকে বলেনি, কেন সে তাকে সঙ্গে নিয়ে বিলডনের বাহিনীর সাথে সাথে ঘুরছে। হয়তো সে তাকেও তার মত খৃস্টানদের গোয়েন্দা বানাতে চেয়েছিল।
জাভীরার মধ্যে একই সাথে বিরাজ করছিল খৃষ্টানদের আনুগত্য ও তানভীরের প্রতি গভীর ভালবাসা। সম্রাট বিলডনের অবশ্য তানভীরের কোন প্রয়োজন ছিল না। জাভীরার প্রতি আকর্ষণের কারণেই তানভীরকে সে ক্যাম্পে থাকতে দিয়েছিল। জাভীরা ছিল অসম্ভব সুন্দরী। এ রূপের কারণেই বিলডন তার প্রতি ছিল আসক্ত।
একদিন জাভীরা বিলডনকে বললো, ‘আমাকে আক্রার হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিন।’
কিন্তু বিলডন তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বললেন, ‘হেড কোয়ার্টারের চাইতে সম্রাটের সঙ্গেই তোমাকে বেশী মানায়। কেন, আমার সঙ্গ কি তোমার খারাপ লাগছে?’
এটা সে সময়ের কথা যখন ক্যাম্প ছিল হেমসের কাছে।
একদিন গোয়েন্দারা বিলডনকে সংবাদ দিল, ‘সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনী দামেশকের পথ ছেড়ে আর্মেনীয়, সীমান্তের দিকে যাচ্ছে।’
এ খবর ছিল বিলডনের জন্য অভাবনীয়। সম্রাট বিলডন ধারণাও করতে পারেননি, সুলতান আইয়ুবী ইবনে লাউনের মত ক্ষুদ্র শক্তির ওপর আক্রমণ করার জন্য ছুটে আসছেন।
তিনি এ এলাকা খুব ভাল মতই চিনতেন। তিনি জলদি তার বাহিনী হেমস থেকে মুসাদা পাহাড়ের দিকে সরিয়ে আনলেন। তার প্ল্যান ছিল, সুলতানের বাহিনী এ পাহাড়ের পাশ দিয়ে যখন যাবে তখন তিনি অতর্কিত আক্রমণ করে সুলতানকে শেষ করে দেবেন।
প্ল্যান অনুযায়ী তিনি তার বাহিনী নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গেলেন। সেখানেই তিনি ওঁৎ পেতে সুলতানের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু তাকে বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। ওখানে পৌঁছার পরদিনই তিনি গোয়েন্দা মারফত খবর পেলেন সুলতান আইয়ুবী ইবনে লাউনের উপর আঘাত হেনেছে। তারপর দিন খবর পেলেন, বিজয় শেষে তিনি মুসাদা পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু গেড়েছেন।