উমরু দরবেশ কতক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। শেষে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে।’
সেনাপতি বিদায় হলো। রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো উমরু দরবেশ। একটু পর তলিয়ে গেল ঘুমের অতল তলে। যখন চোখ খুললো, রাত শেষ হয়ে দিনেরও অর্ধেক পার হয়ে গেছে।
দীর্ঘদিন কারাগারে নির্যাতন সহ্য করে তার শরীর বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল অসহ্য ব্যথা ও কষ্ট। এমন আরামের বিছানায় কতকাল ঘুমায়নি সে! তাই রাতে সে বেহুশের মত ঘুমিয়েছিল।
অল্পদিনেই পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রামের ফলে তার স্বাস্থ্য কিছুটা ফিরে এলো। দ্রুত আরোগ্যের জন্য ডাক্তার তাকে যে ঔষধপত্র দিয়েছিল, তাও ভালো ফল দিল। দুর্বলতা বেশ কাটিয়ে উঠলো উমরু দরবেশ।
দু’দিন পর। চোখ খুলেই সে দেখতে পেলো, কামরায় এক মেয়ে। তাকে চোখ খুলতে দেখে মেয়েটি মিষ্টি করে হাসলো। মেয়েটি অসাধারণ সুন্দরী। তার সোনালী চুল কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে আছে। মেয়েটির সুডৌল বাহু, কাঁধ এবং বুকের অর্ধেকটা খোলা।
উমরু দরবেশ এক সামরিক অফিসার। শৈশব কেটেছে পাহাড়ে, জঙ্গলে। যৌবনের শুরুতে যোগ দিয়েছে সামরিক বিভাগে। যুদ্ধের ময়দানেই কেটে গেছে বাকিটা জীবন।
মেয়েটাকে দেখে তার মনে হলো স্বপ্ন দেখছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোন পরী। কিন্তু মেয়েটা যখন অগ্রসর হয়ে তার মাথায় হাত রাখলো, তখন তার বিশ্বাস হলো, এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব।
মেয়েটি বললো, ‘এখন কেমন বোধ করছেন? দাঁড়ান, আমি ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসছি।’
ও পাশের কামরা থেকে ডাক্তারকে ডেকে আনলো। ডাক্তার এসে তাকে ঔষধ খাইয়ে চলে গেল। একটু পর এলো দুই খৃস্টান, তারা চমৎকার শুদ্ধভাবে সুদানী ভাষায় তার সাথে কথা শুরু করলো। এরা এসেছিল উমরু দরবেশকে সেই মিশনের জন্য তৈরি করতে, যার জন্য সুদানীরা এতদিন অপেক্ষা করছিল। তারা তাকে বললো, ‘আপনি নিজের এলাকায় গিয়ে কখনো কাউকে বলবেন না, আপনি কারাগারে ছিলেন। তাদের আপনি বলবেন, মিশর বাহিনীর সুদান আক্রমন ঠিক হয়নি। নেতাদের এ ধরণের আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে নিরীহ সৈনিকদের। নেতাদের ভুলের কারনেই তাদের ভাগ্যে নেমে এসেছে মৃত্যু ও বন্দিত্ব। মুসলমানদের উচিত সুদানীদের সহযোগিতা করে তাদের বন্ধুত্ব ক্রয় করা। নইলে সুদানীদের হাতে তাদের বরবাদী ও ধ্বংসের এ ধারা চলতেই থাকবে।’ খৃস্টানরা তাকে আরও উপদেশ দিল, ‘আপনি সব সময় আল্লাহ ভক্ত আলেমের পোশাকে থাকবেন। দিনভর তসবী তাহলিল ও দোয়া দরূদ নিয়ে পড়ে থাকবেন। সময় সুযোগ বুঝে মুসলমানদের মনে ঢুকিয়ে দেবেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও মিশর সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও অবজ্ঞার ভাব।’
উমরু দরবেশ খুশী মনে তাদের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গেল তার ট্রেনিং ও রিহার্সাল। সন্ধ্যা পর্যন্ত এ দুই খৃস্টান তার সাথে সময় কাটালো। সন্ধায় বিদায় নিল তারা।
রাতেও মেয়েরা তার সামনে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করলো। খাবারের সাথে পরিবেশন করলো শরাব। কিন্তু তিনি শরাব স্পর্শ করলেন না। খাওয়ার পর মেয়েরা এঁটো থালা বাসন গুটিয়ে নিয়ে চলে যেতেই একটি মেয়ে ফিনফিনে পাতলা নাইটি পরে কামরায় প্রবেশ করলো। তার চোখে মুখে খেলা করছিল অশ্লীল আবেদন।
‘তুমি কেন এসেছ?’ উমরু দরবেশ মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো।
‘আপনার সেবা করতে।’ মেয়েটি উত্তর দিল, ‘রাতে আপনার যে কোন প্রয়োজনে আমাকে আপনার পাশে পাবেন।’
‘তোমার নাম কি?’
‘আশী!’ মেয়েটি উত্তর দিল এবং নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে গিয়ে পালঙ্কের ওপর তার পাশে বসে পড়লো।
‘আশী!’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমার তোমাকে প্রয়োজন নেই। তুমি বরং এখান থেকে চলে যাও।’
‘আজ সারা রাত আপনার পাশে আমার ডিউটি আমার। দায়িত্বে অবহেলা করলে এর জন্য আমাকে জবাবদিহী করতে হবে। আপনার আমাকে প্রয়োজন না হতে পারে, কিন্তু আমার ডিউটিতে আমি অবহেলা করতে পারি না।’
‘এরা যে শর্ত মানাতে আমাকে এখানে এনেছে আমি তা মেনে নিয়েছি।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমাকে বশ করতে এখন তোমার রূপের ঝলকের প্রয়োজন নেই।’
‘আমি তা জানি।’ আশী বললো, ‘আপনার সম্পর্কে আমাকে সবই বলা হয়েছে। শর্ত মানার কারণেই আমাকে পুরস্কার হিসেবে পাঠানো হয়েছে আপনার কাছে। আপনি অস্বীকার করলেও কর্তৃপক্ষ জানে, সৈন্যরা যখন যুদ্ধের ময়দান থেকে আসে তখন তার প্রাণ মেয়েদের কোমল পরশ পেতে আগ্রহী থাকে।’
‘আমি পরাজিত সৈনিক।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমার মন ও প্রাণ মরে গেছে। ঘৃণা ধরে গেছে নিজের প্রতি। আমার দেহ মন দু’য়েরই আজ ফুরিয়ে গেছে সব প্রয়োজন। আমি পরাজিত সৈনিক। স্বাদ আহলাদ আমার জন্য নয়।’
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠলো, যেন কোন জলতরঙ্গের বাজনা। বললো, ‘শরাবের দু’চার ঢোক পান করলেই আপনার এ অনুভূতি কেটে যাবে। দূর হয়ে যাবে দেহ ও মনের সব অবসাদ। আনন্দের সুর শুনতে পাবেন নতুন করে।’ মেয়েটি বললো, ‘তখন আমার দিকে তাকালে আপনি আমার মধ্যে ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য দেখতে পাবেন।’
‘আমাকে মাফ করো আশী! আমি এক মুসলমান।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘মুসলমান কোন মেয়ের সম্ভ্রম নিয়ে খেলা করে না, বরং তাদের সম্ভ্রম হেফাজত করে।’
‘আপনি মুসলমান হিসাবে মেয়েদের সম্ভ্রমের হেফাজতের চিন্তা করতে পারেন, কিন্তু আমি মুসলমানও নই, আর আমার সম্ভ্রম বলতেও কিছু নেই। আপনি কিসের হেফাজত করবেন?’
‘তুমি মুসলমান না হতে পারো, তোমার নিজের সম্ভ্রম না থাকতে পারে, কিন্তু আমি মুসলমান। আমার ইজ্জতের ভয় আছে, পরকালের ভয় আছে। তুমি সারা রাত আমার পাশে বসে থাকলেও আমাকে তুমি পাথরের মত নিষ্প্রাণ পাবে। হালাল মেয়ে ছাড়া আমরা কারো দিকে হাত বাড়াই না।’
‘কেন, আমি কি তাদের মত সুন্দরী নই?’ প্রশ্ন করলো আশী।
‘তুমি যেমনই হওনা কেন, আমার তাতে কিছু যায় আসে না।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘হ্যাঁ, তুমি যদি এ জঘন্য জীবন থেকে মুক্ত হও, তবে আমি তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারি। তুমি চাইলে কোন সম্মানিত ঘরে তোমাকে আশ্রয় দিতে পারি।’
‘আপনার আগেও একজন এখানে এসেছিল। সেও আপনার মতই কথা বলতো। সেও সুদানী মুসলমান ছিল।’ আশী বললো, ‘তবে আমি আপনার একথা মেনে নিতে পারছি না, মুসলমান বলেই মেয়েদের প্রতি আপনার কোন আগ্রহ নেই। আমি মিশরের অনেক মুসলমানকে দেখেছি, তারা মেয়েদের দেখলে ক্ষুধার্ত পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি তিনজন মিশরী মুসলমানের কথা বলতে পারি, যাদের আমি এ শরাবের বোতল দিয়ে বিশ্বাসঘাতক ও গাদ্দার বানিয়ে ছিলাম। তারা কি তবে মুসলমান নয়?’
‘তারা বেঈমান! তারা নিজেদের ঈমানকে বিক্রি করে দিয়েছিল তোমাদের ফাঁদে পড়ে।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আশী! আমি ভাবছি, তুমি কেমন মা বাবার সন্তান? তারা কি তোমার এ ভূমিকার কথা জানে?’
‘জানি না! কে আমার বাবা আর কে মা, সে কথাও জানিনা আমি। তারা এখন কোথায়, বেঁচে আছে না মৃত, তাও জানি না!’ আশী বললো, ‘আপনার আগেও এক ব্যাক্তি আমাকে এ প্রশ্ন করেছিল। জানিনা এখন তিনি কোথায়?’
‘কি নাম ছিল তার?’
‘তার নাম ছিল ইসহাক। এ কামরাতেই তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমার মা-বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করে আমাকে ভীষণ অশান্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন। তার আগে এমন প্রশ্ন কোন দিন কেউ আমাকে করেনি। তার প্রশ্ন শুনে আমি সারা রাত চিন্তা করেছিলাম, আমার মা-বাবা কারা, কোথায় ও কেমন ছিল? আমার স্মৃতিতে যে ছবি ভেসে উঠে আমি তা স্মরণ করতে চাই না। আমি তাদের ভুলে থাকতে চেষ্টা করি। কিন্তু আপনাদের প্রশ্নে তা সম্ভব হয় না। তখন আমার মা-বাবার স্মৃতি আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমার সব আনন্দ ও সুখ তখন কোথায় যেন হারিয়ে যায়। উদাসীনতায় ছেয়ে যায় আমার প্রফুল্ল বদন। কষ্টের ভূত চেপে বসে ঘাড়ে।’
‘তোমার কোন ভাইও বোধ হয় ছিল না।’
‘কিছুই মনে পড়ে না।’ আশী বললো, ‘আমি রক্তের সম্পর্ক কাকে বলে তা জানি না।’
‘তোমার চোখে ঘুম আসছে, শুয়ে পড়ো।’ উমরু দরবেশ বললো।
‘না, আমার চোখে আপনি যা দেখছেন তা ঘুম নয়, হতাশার হাহাকার ও কষ্টের ছোঁয়া। যা মানুষের চোখের আলোকে নিভিয়ে দেয়। আলোর এ নিষ্প্রভতাকেই আপনার মনে হচ্ছে ঘুম।’ আশী বললো, ‘আমার তো মন চাচ্ছে আপনার সাথে সারা রাত এভাবে গল্প করে কাটাই। কিন্তু আপনি কেন আমার জন্য জেগে থাকবেন! আপনি বরং ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আপনার শান্তিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে চাই না।’
‘আশী! তোমার মনে আমি কষ্ট দিতে চাইনি। আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছো, এ জন্য আমি দুঃখিত।’
‘বিশ্বাস করুন, আপনার মত লোক আমার খুব পছন্দ। আমি যে সব লোকের সাথে সময় কাটাই তাদের আমি ঘৃণা করি, তবুও তাদের সামনে আমাকে হাসতে হয়। সেই সুদানী মুসলমান, যার কথা আপনাকে একটু আগে বলেছি, তার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। তারপর এলেন আপনি। আপনার কথাও আমি চিরদিন সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবো। আপনার সামান্য একটু কথা আমার মধ্যে এক নতুন আবেগ ও অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, আমিও মানুষ, আমারও প্রাণ আছে। আপনি আমার মনে এ কোন আত্মা জাগিয়ে দিলেন? অন্যেরা আমাকে কেবল ভোগের সামগ্রী মনে করে। এতদিন আমিও নিজেকে তাই ভাবতাম। আপনি আমার মনে এ কোন সুর সৃষ্টি করলেন?’
‘আশী! তুমি তো সেই মানুষ, যাকে আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলেছেন। তোমার এ দেহের মাঝেই আছে আত্মা ও বিবেক। তুমি তোমার বিবেকের কথা কান পেতে শোন, বুঝতে পারবে তুমি কে? সবাই তোমাকে ভোগের সামগ্রী মনে করে, কিন্তু আল্লাহ তোমাকে যে জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়েছেন, তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করো, তুমি কে?’ উমরু দরবেশ বললো।
‘আমি এক মনোরম সুমিষ্ট বিষ।’ আশী বললো, ‘পাথরকে গলিয়ে মোম করার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে আমাকে। আমি কোন কোমলমতি সরল-সহজ গ্রাম্য মেয়ে নই। আমি অত্যাচারী শাসকের তলোয়ার লুটাতে পারি আমার পদতলে। ধ্যান ভাঙাতে পারি মুনি-ঋষির। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমি এখন এমন মোম, যার কোন দাহ্যগুণ নেই, সে আর পাথরকে গলাবে কি করে?’
‘এটা আমার কথার প্রভাব নয়!’ উমরু দরবেশ বললো, ‘এটা ঘটেছে তোমার ভেতরে সত্যের প্রতি যে টান আছে, সে টানের কারণে। তোমার বিবেক তোমাকে শাসন করছে। রক্তের বন্ধনের মধ্যে যে উষ্ণতা, সেই উষ্ণতার জন্য হাহাকার জুড়ে দিয়েছে তোমার হৃদয়। আমি তো কেবল তোমাকে রক্তের সম্পর্কের ব্যাপারে সামান্য সজাগ করে দিয়েছি। তুমি কারো মেয়ে, কারো বোন। কারো তুমি আদরের ধন, আবার কারো কাছে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র। তোমার স্নেহের কাঙ্গাল কেউ, আবার কারো স্নেহ পাবার জন্য তোমার মন আকুলি বিকুলি করে। এই আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে লোক ভেদে তোমার পরিচয় হয় ভিন্ন ভিন্ন। এভাবেই গড়ে উঠে সমাজ, সভ্যতা। বিচিত্র বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। নানা রকম সুর-ছন্দ, রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধ ও চিত্তের বিত্ত বৈভবে ভরে ওঠে আল্লাহর এ সাজানো বাগান। মানুষ কোন জড় পদার্থ নয় যে, ভোগের মত স্থুল কোন একক উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’
সম্মোহিতের মত তার কথা গিলছিল আশী! কখনো কল্পনার পাখা মেলে হারিয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ে-জঙ্গলে। কখনো স্বপ্নের তরীতে পাড়ি দিচ্ছিল দরিয়া, সাগর। একজন কথা বলছিল নিজের ভেতর নিমগ্ন হয়ে, অন্যজন আত্মমগ্ন হয়ে শুনছিল তার কথা। উমরু দরবেশের চোখের দৃষ্টি চষে ফিরছিল পৃথিবীর প্রান্তর, আশী ডুবে গিয়েছিল ভাবনার অতল তলে।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কখন যে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেল আশী, নিজেই টের পেলো না। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। পালঙ্কের ওপর বসে ছিল সে, সেখানেই কাত হয়ে পড়লো। সকালে যখন চোখ খুললো, দেখলো পালঙ্কের ওপর শুয়ে আছে সে, উমরু দরবেশ নিচে বিছানা পেতে তখনো ঘুমুচ্ছে। সে উমরু দরবেশকে না জাগিয়ে তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো। মনের ভেতর অনুভব করলো, দুরন্ত সাইমুম ঝড়ের অসহ্য দাপাদাপি। গালে হাত দিয়ে তন্ময় হয়ে বসে রইল আশী। এক সময় অনুভব করলো, তার দু’চোখ থেকে নেমে এসেছে অশ্রুর দু’টি ক্ষীণ ধারা। সে আশ্চর্য হলো, তার চোখেও অশ্রু আছে! জীবনে এত দুঃখ পেয়েছে, কই, কখনো তো কান্না পায়নি! সে উমরু দরবেশের পাশে নতজানু হয়ে বসলো। তার হাত ধরে তুলে নিজের চোখের সাথে লাগালো।
উমরু দরবেশের ঘুম ভেঙ্গে গেল। চঞ্চল হয়ে উঠে বসলো সে। আশীর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। আশী তার হাত ছেড়ে দিল, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। সে এ কথাও বললো না, আমাকে পালঙ্কে শুইয়ে আপনার নিচে শোয়া উচিত হয়নি। সে নীরবে আমরা থেকে বেরিয়ে গেল এবং একটু পর অজুর পানি নিয়ে ফিরে এলো। উমরু দরবেশ অজু করে ফজরের নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। আশী ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
সকালে নাস্তার পরে সুদানী সেনাপতি দুই খৃস্টান উপদেষ্টাকে নিয়ে আবার দেখা করলো উমরু দরবেশের সাথে। উমরু দরবেশ তাদের বললো, ‘আমার একটি কথা আপনারা ভালভাবে শুনে নিন। আমাকে যে কাজের ভার দিয়েছেন সেটা ইসহাকের এলাকা। আমার চেয়ে ওই এলাকায় ইসহাকের প্রভাব অনেক বেশী। ইসহাকের সহযোগিতা পেলে সহজেই আপনাদের উদ্দেশ্য সফল করা যাবে। আপনারা ইসহাককে দলে টানতে চেষ্টা করুন।’
‘এ জন্য হেন চেষ্টা নেই, যা আমরা করিনি। লোভ, ভয়, নির্যাতন কোনটাই বাদ রাখিনি। কিন্তু সে আমাদের প্রস্তাব কিছুতেই গিলছে না।’ বললো সেনাপতি।
‘আপনাদের সে শত্রু মনে করে, তাই আপনাদের কোন প্রস্তাব সে কবুল করেনি। সে খুব দৃঢ় চরিত্রের লোক। কোন রকম নির্যাতন, উৎপীড়ন করে তাকে আপনারা বশ করতে পারবেন না। কিন্তু আমি তার শত্রু নই, আমার কথাকে সে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবে। আমার কথা হচ্ছে, আমি যখন আপনাদের দলে যোগ দিয়েই ফেলেছি, তখন তাকেই বা দূরে থাকতে দেব কেন? আমি তার জন্য অন্য রকম ফাঁদ পাতবো। দেখা যাক, সে ফাঁদ কেটে সে বেরিয়ে যেতে পারে কিনা! সে জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, তার ওপর আর কোন নির্যাতন করবেন না। তাকে মুক্ত আলো-বাতাসে এনে সুস্থ করে তুলুন। অসহ্য যাতনার কারণে তার মাথা হয়ত বিগড়ে গেছে। এ অবস্থায় কোন কিছু সে ভালো ভাবে চিন্তা করতে পারবে না। তাকে একটু সুস্থ হতে দিন। কারাগার থেকে বের করে ভালো কামরায় রাখুন। সে আমার বন্ধু। একটু সুস্থ হলে পুরনো বন্ধুত্বের রেশ ধরে তার সাথে দেখা করবো আমি। আমার বিশ্বাস, আপনারা যা পারেননি, বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে আমি তা ঠিকই আদায় করে নিতে পারবো।’
‘তার ব্যাপারে আমরা নিরাশ হয়ে পরেছি। যদি তুমি ব্যর্থ হও?’
‘ব্যর্থ আমি হবো না। সে হবে আমার প্রথম টার্গেট। আপনারা জানেন না, ভালো মানুষ খারাপ হলে সে কতোটা খারাপ হতে পারে। শয়তান কাউকে নষ্ট করতে ব্যর্থ হলে নাকি বাঁকা পথ ধরে। সারা রাত নফল নামাজে দাঁড় করিয়ে রেখে মুসল্লির ফরজ কাজা করিয়ে দেয়। আমিও সেই পথ ধরবো। এমন সুন্দর করে ছলনা ও মিথ্যা পরিবেশন করবো, সে টেরও পাবে না, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছি। তারপরও বলছি, যদি একান্তই ব্যর্থ হই, তখন আপনারা তার সঙ্গে যেমন খুশী ব্যবহার করতে পারবেন।’
সুদানী সেনাপতি বললো, ‘ঠিক আছে, তাই হবে।’
খৃস্টান উপদেষ্টারা উমরু দরবেশকে ট্রেনিং দিতে আরম্ভ করলো। তিনিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিখতে লাগলেন প্রতারণার নানা কলাকৌশল। তারা যেভাবে তাকে কথা বলতে শেখাল, সে তারচেয়েও চমৎকার ভাষায় তা ওদের শুনিয়ে দিল। এভাবেই চললো চার পাঁচ দিন। তার প্রশিক্ষণ চলতেই লাগলো। দিনে খৃস্টান উপদেষ্টারা তাকে সঙ্গ দেয়, রাতে তার পাশে থাকে আশী। ইসহাকের মত আশীকে তাড়াতে চেষ্টা করেনি, বরং তাকে সে তার মুরিদ বানিয়ে নিয়েছে। আশী যখন কামরায় আসতো তখন তার মধ্যে কোন পাপ বোধ জাগতো না; বরং নিজের মধ্যে পবিত্রতার এক নতুন অনুভূতিতে ভরে যেতো তার হৃদয়।
এভাবেই কেটে গেল ছয়-সাত দিন। উমরু দরবেশ ওদের বললো, ‘আমি ইসহাকের সাথে এখন দেখা করবো না। প্রথমে আমি এলাকায় যেতে চাই। সেখান থেকে তাকে রাজী করাতে পারে এমন লোক ও খবর নিয়ে ফিরে আসবো আমি। তার আগে সেখানকার বিস্তারিত পরিবেশ বুঝে নেয়ার চেষ্টা করবো। আমার এ মিশনের সফলতার ব্যাপারে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যায় তার বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তখন আপনাদের কাছে করতে পারবো।’
সেনাপতি তার এ প্রস্তাবেও সম্মত হলো। বললো, ‘ঠিক আছে, ততদিন সে আমাদের হেফাজতে আরামেই থাকবে।’
পরদিন এক দরবেশের পোশাকে এলাকায় যেতে প্রস্তুতি নিতে লাগলো উমরু দরবেশ। দরবেশের বেশ ধারন করে সে যখন তৈরি হলো, আশী বললো, ‘আপনি যেখানেই যান না কেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান।’
উমরু দরবেশ সেনাপতিকে বললো, ‘এ মেয়েটিকে উপহার হিসেবে সঙ্গে রাখতে চাই।’
আশীকে তার খেদমতে দিয়ে দেয়া হলো। বোরকা পরে সে এক পর্দানসীন মহিলার বেশ ধারণ করলো। তিনটি উট তাদের উপহার দিল সেনাপতি। একটায় উমরু দরবেশ, দ্বিতীয়টায় আশী ও তৃতীয় উটে তাঁবু, খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য দ্রব্য বোঝাই করা হলো।
রওনা করার সময় সুদানী সেনাপতি উমরু দরবেশকে দু’টি কথা বললো, ‘আপনার অনুরোধে ইসহাককে কারাগার থেকে মুক্ত করে ভালো কামরায় আনা হয়েছে। তার ব্যাপারটি আপনি কখনই ভুলে যাবেন না। আর মুসলমান এলাকায় আমাদের লোকেরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা আপনার সঙ্গে স্বেচ্ছায় মিশে যাবে ও সাহায্য করবে। আপনি তার যে কোন সাহায্য গ্রহণ করতে পারবেন। আপনার নিরাপত্তার দিকেও তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।’
উমরু দরবেশ আশীকে সঙ্গে নিয়ে এক ভয়াবহ ও জটিল অভিযানে যাত্রা করলো।
সুদানী সেনাপতি তাদের বিদায় দিয়েই ছুটে গেল তার নিজের কামরায়। সেখানে ছয়জন লোক বসা ছিল। ওরা সবাই সুদানী মুসলমান এবং পার্বত্য এলাকার বাসিন্দা। তাদের জন্য সুদান সরকারের নিয়মিত ভাতা ও উপহার বরাদ্দ থাকতো। তারা নিজের এলাকায় পাকা মুসলমান হয়ে সুদানীদের চর হিসাবে মিশে থাকতো স্থানীয় জনগণের সাথে।
‘সে চলে গেছে!’ সেনাপতি তাদের বললো, ‘তোমরা অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যাও। সবাই আলাদা আলাদা ভাবে যাবে। তার প্রতি প্রত্যেকেই করা দৃষ্টি রাখবে। যদি তোমাদের সন্দেহ হয়, সে ঠিকমতো কাজ করছে না, ধোঁকা দিচ্ছে, এমন পদ্ধতিতে তাকে হত্যা করবে, যেন কেউ টের না পায়। আমি আরো লোক পাঠাচ্ছি, তোমরা তাদেরকে নিজের বাড়ীতে আশ্রয় দেবে।’
তারা সকলেই একের পর এক যাত্রা করলো।
সুদানী সেনাপতি সুদানী কিন্তু মুসলমান নয়, এমন দু’জনকে ডাকলো। তাদেরকে সেনাপতি বললো, ‘এ মুসলমানদের ওপর কোন ভরসা নেই। তারা নিজেদের এলাকায় গিয়ে সব এক হয়ে যেতে পারে। এ ছয়জন আমাদেরই লোক, কিন্তু একথা ভুলো না, এরা মুসলমান। এখান থেকে গিয়ে তাদের নিয়ত বদলে যেতে পারে। যদি উমরু দরবেশ বা এদের কারো নিয়ত বদলে যায়, তবে তোমাদের অস্ত্র ও বারুদের প্রয়োজন হবে। আমাদের অস্ত্র কোথায় গোপন আছে তা তোমরা জানো। আর সে অস্ত্র কোথায়, কখন এবং কেমন করে ব্যবহার করতে হবে তাও তোমাদের অজানা নয়। যাও, এবার জলদি রওনা হও।’
এ দু’জনও রওনা হয়ে গেল।
সেই প্রহরী, যে ইসহাকের মেয়ে ও কন্যাকে রক্ষা করেছিল এবং কমান্ডারকে হত্যা করেছিল, সে ইসহাকের বাড়ীতেই থাকতো। যেদিন উমরু দরবেশ যাত্রা করলো, সেদিনের ঘটনা। প্রহরী বাইরে ঘোরাফিরা করছিল। হঠাৎ একটা তীর ছুটে এসে তার শরীর ছুঁয়ে পাশ কেটে এক গাছে গিয়ে বিঁধল। প্রহরী দৌড়ে ইসহাকের বাড়ীতে ঢুকে পড়লো।
সে ইসহাকের বাবাকে বললো, ‘আমার ওপর কে যেন তীর চালিয়েছে।’ কিন্তু কে তীর চালিয়েছে, কেন চালিয়েছে, কিছুই ওরা বুঝতে পারলো না। কেউ জানতেও পারলো না, সুদানীরা তাকে হত্যা করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে প্রথমবারের মত ব্যর্থ হয়েছে।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান তখনো কায়রোতে। সুলতান আইয়ুবি খৃস্টানদের বন্ধু ও ক্রীড়নক মুসলিম আমীর সাইফুদ্দিন, গুমাস্তগীন ও আল-মালেকুস সালেহের সম্মিলিত সৈন্যদের পরাজিত করে সম্মিলিত বাহিনীর হেডকোয়ার্টার হলবের দিকে অগ্রসর হলেন। ওসব গাদ্দার ও স্বার্থলিপ্সু মুসলিম শাসকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ভয়ে তখন পালাচ্ছিলো। আতঙ্ক গ্রাস করে নিয়েছিল তাদের সৈন্যদের মন-মগজ। পথে বিশ্রামের কথা চিন্তা করারও কোন অবকাশ ছিল না তাদের। তবু সেনাপতিরা রাস্তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান নিয়ে বিচ্ছিন্ন সৈন্যদের একত্রিত করার চেষ্টা করলো। তখনো কারো কারো মাথায় কাজ করছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মোকাবেলা করার চিন্তা। কিন্তু সৈন্যরা পালানোর জন্য ছিল ব্যতিব্যস্ত। এ পলায়নী মনোবৃত্তি সামরিক বিবেচনায় তাদের জন্য ধ্বংস ও ক্ষতির যে কারণ সৃষ্টি করছিল, তা পূরণ করা সহজসাধ্য ছিল না।
সুলতান আইয়ুবীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলো। পথের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো একের পর এক দখল করে এগিয়ে চললেন তিনি। তাঁর এখন একমাত্র লক্ষ্য হলব শহর। মিশরের অভ্যন্তরে কোথায় কি ঘটছে সেসব দেখার কোন অবকাশ নেই সুলতানের। তাঁর সমস্ত মনোযোগ এখন যুদ্ধের ময়দানের দিকে। তবু মিশরের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিতই খোঁজখবর রাখছিলেন তিনি। কাসেদ যথারীতি তাঁকে সারা দেশের সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছিল। ময়দানের অবস্থা ছাড়াও এ সংবাদের মাধ্যমে তিনি মিশরের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সব সময় অবহিত থাকতেন।
গোয়েন্দা মারফত এমন কিছু সংবাদ তিনি পেলেন, সাদামাটা চোখে যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু বিচক্ষণ সেনাপতি ও দূরদর্শী শাসক হিসাবে ঘটনা বিশ্লেষণের যে অপূর্ব দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন, তাতে তিনি কয়েকটি ঘটনার যোগফল টানতে গিয়ে শিউরে উঠলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, মিশরের আকাশে নতুন এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছে। এ চক্রান্তের শিকড় অনেক গভীরে। তিনি অনুভব করলেন, এ চক্রান্ত নতুন যে সমস্যার আবর্তে মিশরকে নিয়ে যাবে, এখনি সতর্ক না হলে সে আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসা দুস্কর হবে।
যুদ্ধের ময়দানে কখনও সুলতান অস্থির হন না। কিন্তু চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের যে কোন ইঙ্গিত তাঁকে পেরেশান করে তোলে। নতুন করে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পেয়ে তাই তিনি যথেষ্ট বিচলিত বোধ করলেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন, এ ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কাজের পিছনে রয়েছে খৃস্টানদের কূটবুদ্ধি, আর তাদের হাতের পুতুল হয়ে যে কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে মুসলমানরা, তখন বেদনায় ছেয়ে গেল তাঁর অন্তর।
আলী বিন সুফিয়ান ছিলেন সুলতান আইয়ুবীর ডান হাত। পর্যবেক্ষকদের ভাষায়, আইয়ুবীর চোখ ও কান। সুলতান আইয়ুবী তাঁকে নিজের অবর্তমানে মিশরে রেখে যান এই আশায়, যে বিপদ তাঁর ছোট ভাই তকিউদ্দিন দেখতে পাবে না, বিপদ আসার আগেই তাঁর গন্ধ টের পেয়ে যাবে আলী বিন সুফিয়ান। মিশরের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে সঙ্গে না এনে তাঁর সহযোগী হাসান বিন আব্দুল্লাহকে নিয়ে এসেছেন যুদ্ধের ময়দানে।
মিশরের শাসন ক্ষমতায় এখন সুলতান আইয়ুবীর ছোট ভাই সুলতান তকিউদ্দিন। ভাইয়ের অবর্তমানে এতবড় জিম্মাদারী পালন করতে যেয়ে তিনি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন নানা রকম প্রশাসনিক জটিলতায়। রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারেন না। কিন্তু যখনি মনে হয়, আলী বিন সুফিয়ান তাঁর সর্বক্ষণের সাথী ও উপদেষ্টা, তখন কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন। এভাবেই মিশরের নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষায় দু’জনেই ছিলেন আন্তরিক, সচল ও সজাগ। ভালভাবেই বুঝতে পারছিলেন, সুলতান আইয়ুবীর অবর্তমানে মিশরে ধ্বংসাত্মক কাজ বেড়ে চলেছে। নাশকতামূলক তৎপরতা চলছে খৃস্টানদের ইন্ধনে। এ ছাড়া সুদানের দিক থেকেও চলছে ভয়ানক ষড়যন্ত্র। চার মাস আগে তকিউদ্দিন সুদানীদের এক অদ্ভুত ও খুবই ভয়ংকর আক্রমণ অসাধারণ সফলতার সাথে বানচাল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সুদানীরা দমে যায়নি। তারা এখনো সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের যে আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল, সেটা সামরিক আক্রমণ ছিল না।
সুদানের আক্রমণের আশংকায় সীমান্তে রক্ষীদের প্রহরা আরও দৃঢ় করা হলো। সীমান্তে রক্ষীদের সংখ্যা বাড়ানো হলো। এ ছাড়াও আলী বিন সুফিয়ান তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের অসংখ্য লোককে সীমান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলেন। এরা যাযাবর ও মুসাফিরের পোষাকে সীমান্তে ঘোরাফিরা করতো। এদের যোগাযোগ ছিল সীমান্তের ফাঁড়িগুলোর সঙ্গে। এদের জন্য সীমান্ত ফাঁড়িতে ঘোড়াও মজুদ থাকতো। সীমান্ত বাহিনীর টহলদার গ্রুপের সাথেও এদের যোগাযোগ ছিল। তাদের জন্য আরও একটা ব্যবস্থা ছিল, আলী বিন সুফিয়ানের কিছু দক্ষ গোয়েন্দা বণিকের বেশে সুদানের সাথে অবৈধ কারবার করতো। তাদেরকে মালামাল দিয়ে সীমান্ত পার করে দেয়া হতো; এরা সুদানে গিয়ে জানাতো, তারা মিশরের সীমান্ত রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে এসেছে। সুদানে খাদ্য-শস্যের অভাব ছিল তীব্র। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দক্ষ প্রশাসন ও কড়া তদারকির কারণে মিশরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল। ফলে বাড়তি খাদ্যশস্য স্মাগলিং করার জন্য পৃথক করে রাখা হতো। আইয়ুবীর গোয়েন্দারা সেগুলো সীমান্তের ওপারে পাচার করে অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি সংগ্রহ করতো প্রয়োজনীয় তথ্য।
সুদানের যে বণিকরা মিশরের বণিকদের সাথে এ কারবার করতো তাদেরও অধিকাংশই ছিল আইয়ুবীর গোয়েন্দা। এরা মিশরের জন্য সারা দেশ ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে আনতো। বণিকের বেশে গোয়েন্দাগিরি করার সুবিধা ছিল অনেক। খাদ্যশস্যের অভাবের কারণে এসব চোরাকারবারীদের চাহিদা ছিল সর্বত্র। প্রশাসন টের পেলেও তাদের কিছু বলতো না, কারণ দেশের খাদ্য ঘাটতির অভাব ওরাই পূরণ করছিল। সুলতান আইয়ুবীও নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, ‘চোরাপথে সুদানে আরও কম দামে শস্য চালান দাও, যেন সুদানের সবখানে গোয়েন্দারা সহজে বিচরণ করতে পারে।’
এভাবে সুদানের সর্বত্র মিশরের গোয়েন্দারা ছড়িয়ে পড়ল। ফলে সুদানের সরকার ও সৈন্যদের সব কার্যকলাপের সংবাদ নিয়মিত কায়রোতে পৌঁছে যেতে লাগল।
আলী বিন সুফিয়ান সীমান্তের কয়েক স্থানে ঘাঁটি বানিয়ে রেখেছিলেন। কোন সংবাদ ওপার থেকে এসে পৌঁছুলে সঙ্গে সঙ্গে সে খবর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। বিদ্যুতগতি ঘোড়া সেখান থেকে ছুটে যেতো কায়রো। এ জন্য সেখানে নিয়োজিত থাকতো আলাদা অশ্বারোহী। তারা রাত দিন বিরামহীনভাবে পথ চলতো কায়রোর উদ্দেশ্যে।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জানতেন, সুদানে একটি বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চল আছে, যেখানে শুধুমাত্র মুসলমানরাই বাস করে। সে অঞ্চলের অধিকাংশ লোক মিশরের সেনাবাহিনীর সমর্থক। যুবকরা সবাই মিশরের সেনা সদস্য। তিনি আরও জানতেন, ওখানকার মুসলমানরা সুদানের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয় না। এর কি কারণ তা তিনি জানেন না, তবে দীর্ঘকাল ধরেই এমনটি চলে আসছে।
সুলতান আইয়ুবীর শাসনকাল শুরু হওয়ার আগের কথা। মিশরের সেনাবাহিনীতে তখনো সুদানী মুসলমান ও হাবশীরা ছিল। তাদের কমান্ডারও থাকতো সবসময় সুদানী।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সুলতান হওয়ার আগে তাদের প্রধান সেনাপতি নাজীই (পাঠকের হয়তো স্মরণ আছে, কমান্ডার নাজীর নাম। ক্রুসেড সিরিজের প্রথম বইতে তাদের প্রধান সেনাপতি নাজীর বিস্তারিত বর্ণনা আছে) মিশরের সর্বেসের্বা শাসনকর্তা ছিল। তখন মিশরের শাসন চলতো কেন্দ্রীয় খেলাফতের অধীনে। সে হিসেবে মিশরের শাসক ছিলেন আমীর। সেনাপতি নাজী তখন আমীরের মর্যাদাও ভোগ করতো। কি খলিফা, কি আমীর সবাই ছিল দারুণ স্বেচ্ছাচারী।
খৃস্টানরা মিশরকে কেন্দ্রীয় খেলাফত থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করে দিয়েছিল। নাজী তখন তাদের দোসর। সে মিশরের সুদানী সৈন্যদের পৃথক করে তাঁর অধীনে নিয়ে নিল। এ সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় পঞ্চাশ হাজার।
সুলতান আইয়ুবী মিশরের শাসন ভার গ্রহণ করলে প্রথম সংঘর্ষ বাঁধলো নাজীর সঙ্গেই। সুলতান আইয়ুবী নাজীর বিদ্রোহ দমন করে বিদ্রোহী সেনাপতিদের বন্দী এবং সৈন্যদেরকে মিশরের অন্যান্য সৈন্যের সাথে একীভূত করে নতুন বাহিনী গঠন করেছিলেন। যারা নাজীর সহযোগী হয়েছিল তাদের ব্যপারে যখন সুলতানের এ আদেশ জারী হলো, তারা আনুগত্য পরিবর্তন করে মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইলে তাদেরকে মিশরের বাহিনীতে ভর্তি করে নেয়া হবে, তখন সুদানের সমস্ত মুসলমান সৈন্য মিশরের বাহিনীতে ফিরে এলো। তারা এও জানতে পারলো, তাদেরকে খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীতে যোগদান করে তারা একাধিক যুদ্ধে বিক্রমের সাথে লড়াই করে তাদের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের যুদ্ধের কৌশল ও গতি নিকট থেকে লক্ষ্য করে তাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। পরে তাদেরকে সামরিক এবং সেই সাথে ধর্ম, ঈমান ও জাতীয় মর্যাদাবোধের ব্যাপারেও ট্রেনিং দিলেন। তিনি তাদের বুঝাতে সক্ষম হলেন, মুসলমানের শত্রু কোন ব্যক্তি মানুষ নয়, যিনিই ইসলামের দুশমন তিনিই মুসলমানের শত্রু। মানবতার সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেয়াই মুসলমানের ধর্ম। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো মুসলমানের দায়িত্ব। মেয়েদের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করা তাদের কর্তব্য। মানবতার বিরদ্ধে কোন অমুসলমান দাঁড়ালে সেটা যেমন অপরাধ, তেমনি অপরাধ কোন মুসলমান দাঁড়ালেও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা ফরজ, নীতির প্রশ্নে কারো সাথে আপোসের কোন অবকাশ নেই। বংশ, গোত্র, বর্ণ নয়, মানুষকে বিচার করতে হবে আদর্শ দিয়ে। এ জন্যই সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনী যখন আরবের বিদ্রোহী মুসলিম আমীরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ময়দানে এগিয়ে গেলো, এসব সুদানী সেনারা একবারও দ্বিধায় ভোগেনি, কেউ বলেনি, মুসলিম হয়ে মুসলমানের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র ধরতে পারবো না।
কায়রোর গোয়েন্দা সংস্থার কাছে রিপোর্ট এলো, সুদান সরকার নানাভাবে পাহাড়ী এলাকার মুসলমানদের আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করছে। মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরিবর্তে সুদানী বাহিনীতে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে তাদের। কিন্তু পাহাড়ী মুসলমানরা সরকারের এ আদেশের প্রতি কর্ণপাত না করায় তারা এ ব্যাপারে উৎপীড়ন-নির্যাতনও চালাচ্ছে। পাহাড়ীদের বাধ্য করতে সামরিক অভিযানও চালিয়েছে। কিন্তু এর ফল ভালো হয়নি। পাহাড়ীদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেছে সুদানী বাহিনী। সুদান সেনাবাহিনীর সিনিয়র এক অফিসার গোপনে সে এলাকায় এলে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছে। পাহাড়ী এলাকা দুর্ভেদ্য, ফলে সুদানীদের সামরিক অভিযান সেখানে সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্বাধীনচেতা মুসলমানদের আত্মরক্ষার জন্য অঞ্চলটি খুবই উপযোগী। পাহাড়ের ঘেরাও এবং উপত্যকার সারি সব সময় তাদেরকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখে। সেখানকার মুসলমানরা স্বভাব-যোদ্ধা, তাদের সাহস ও অটুট মনোবলই তাদের নিরাপত্তার জামিন।
সুলতান আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানের মাধ্যমে তাদের সব খবরই জানতে পেরেছিলেন। তিনি মিশরের গোয়েন্দা বাহিনীর যে সব সদস্য চোরাকারবারী হিসাবে দক্ষতা অর্জন করেছিল তাদের দ্বারা সেই পাহাড়ী এলাকায় ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করলেন। অল্প দিনের মধ্যেই সেখানকার মুসলমানদের হাতে এত অস্ত্র জমা হয়ে গেল যে, সারা বছর যুদ্ধ চালালেও তাদের অস্ত্র ঘাটতি দেখা দেবে না। তারা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিভিন্ন লোকের বাড়ী ও পাহাড়ের গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখলো। তাদের অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে সুলতান আইয়ুবীর যুক্তি ছিল, স্বাধীনচেতা এসব মুসলমানরা যেন প্রকৃত পক্ষেই স্বাধীন থাকতে পারে সে জন্য তাদের সব রকম সাহায্য করা অন্য মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব।
আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দারা চোখ-কান খোলা রেখেই সে এলাকায় অবস্থান করছিল। তারা কেবল তথ্য সন্ধানী গোয়েন্দাই ছিল না, দক্ষ এবং পরীক্ষিত কমান্ডো যোদ্ধাও ছিল। সেখানকার মুসলমান নারী পুরুষ সকলেই শারীরিক ও মানসিকভাবে যুদ্ধের জন্য পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল। এদের মধ্য থেকে এলাকার নিরাপত্তা বিধানের জন্য পাঁচ হাজার শক্ত সামর্থ যুবক যোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলা হলো একটি বাহিনী। আলী বিন সুফিয়ানের পাঠানো কমান্ডো অফিসাররা তাদের প্রশিক্ষণ দিল। আইয়ুবীর পাঠানো অস্ত্রগুলো হাওলা করে দেয়া হলো তাদের। সুদানী হাবশী সৈন্যদের থেকে এদের প্রকৃতি আলাদা। হাবশীরা যুদ্ধ করে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে। খৃস্টানরা তাদের যে বর্বরতার ট্রেনিং দিয়েছে তাই ওদের সম্বল। যুদ্ধের ময়দানে তাদের চাল-চলন হয় পশুর মত। দুশমন দুর্বল হলে তারা ব্যাঘ্র হয়ে যায়, আবার শত্রু সামনে অগ্রসর হলে নিজেকে বাঁচিয়ে সরে পড়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা।
সম্প্রতি এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। মিশরের কিছু মুসলমান গাদ্দার সেনাপতি অর্থ-সম্পদের লোভে সুদানে চলে এসেছিল। এসব সেনাপতিরা সুদানের সামরিক বাহিনীকে ট্রেনিং দিয়ে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। তারপরও সুদান সরকার মিশরের ওপর প্রকাশ্যে আক্রমণ চালাতে এখনও ভয় পায়। এ জন্যই সুদান সরকার পাহাড়ী মুসলমানদেরকে সুদানী বাহিনীতে ভর্তি করার ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। খৃস্টান উপদেষ্টারাও জানে, পঞ্চাশ হাজার হাবশী সৈন্যের বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার মুসলিম সৈন্য যথেষ্ট।