সুদানের মুসলিম এলাকা এখনো অনেক দূরে। দুই উটে ওরা দু’জন, তৃতীয় উটের উপর তাদের মালামাল ও তাঁবু। আশীর অর্ধ উলঙ্গ দেহ এখন কালো কাপড়ে ঢাকা। তাকে দেখে কেউ বলতে পারবে না, এ মেয়ে বারবণিতা, যাকে খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করেছে।
ওদের সাথে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দূর দিয়ে সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এক ঘোর সওয়ার। বার বার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে ওদের গমন পথের দিকে। উমরু দরবেশ কয়েকবারই সে অশ্বারোহীকে দেখলেন। ভাবলেন, সুদানীদের কোন চর হবে এ আরোহী। সুদানীরা যে তার পিছনে ছায়ার মত লেগে আছে, সে তো তার জানাই আছে। কিন্তু তার মনে হঠাৎ অন্য খেয়াল জাগতেই ভয় ও আতঙ্কে তার বুক শুকিয়ে গেল। গোয়েন্দারা হলে তার তো একা থাকার কথা নয়! অন্তত তার একজন সঙ্গী তো থাকতোই! তাহলে কি এ লোক কোন মরু ডাকাত? মরু ডাকাতরা কি পরিমান ভয়ংকর হয় তা তো আর অজানা নেই উমরু দরবেশের। পলকে তিনি পেরেশান হয়ে আবারও তাকালেন সে আরোহীর দিকে। নির্বিকার ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে আরোহী। সে সে ওদের অনুসরণ করছে তা তার চলার ভঙ্গিতে এখন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
‘আশী!’ তিনি আশীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘তুমি কি ওই অশ্বারোহীকে লক্ষ্য করেছো? অনেকক্ষণ ধরে এ আরোহী আমাদের অনুসরণ করে চলেছে।’
‘হ্যাঁ, আমিও অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছি।’
‘এ লোক কি সুদানের গোয়েন্দা? নাকি কোন মরু ডাকাত?’
‘কি জানি! গোয়েন্দা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। ওরা সাধারণত এভাবে একাকী পথ চলে না।’
‘আশী! মরু ডাকাত হলে তো খুব ভয়ের কথা! আমরা মাত্র দু’জন। মরুভূমির দুর্ধর্ষ ও সুসংগঠিত ডাকাত দলের বিরুদ্ধে আমরা দু’জন কি মোকাবেলা করতে পারবো!’ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তার কন্ঠে।
‘এত ঘাবড়াচ্ছ কেন? তুমি সৈনিক, আমিও অস্ত্র চালাতে জানি। আমরা নিরস্ত্রও নই।’ আশীর সাহসী কণ্ঠ, ‘রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আক্রান্ত হলে হয়তো সাবধান হওয়ার সুযোগ থাকতো না। কিন্তু এখন দিন। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করে যেতে পারবো। আমাকে নিয়েই যদি তোমার ভয়, তাহলে শুনে রাখো, তোমার পাশে থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি লড়ে যেতে পারবো। আমাকে জীবিত ধরে নিয়ে যাওয়ার সাধ্য কারো হবে না।’
ভয় এবং আশঙ্কা নিয়েই তারা মরুভূমির সে ভয়ংকর পথ অতিক্রম করে চলতে লাগলো। মাথার ওপর কড়া রোদ। এক সময় সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়লো। এগিয়েই চললো ওরা। তাদের অনুসরণ করে তখনো সে আরোহী সেভাবেই পথ চলছে। দূরে আবছা করে ভেসে উঠল কাঙ্খিত পাহাড়ী এলাকা। আরেকটু এগুতেই আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগলো পাহাড়ের চূড়া।
সুউচ্চ পাহাড় চূড়া তখনও বহু দূরে। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত পাহাড় চূড়া চোখে পড়তেই উমরু দরবেশের মনোবল ও শক্তি বেড়ে গেল। তার মনে হলো, গন্তব্য আর বেশী দূরে নয়। আশীকে বললো, ‘আমরা এসে পড়েছি আশী! ওই পাহাড় চূড়াই আমাদের গন্তব্যস্থল।’
উট চলতে লাগলো, তারা গন্তব্য স্থানের কাছাকাছি চলে এলো। এখানেই সুদানীদের নির্দেশ মোতাবেক মিশনের কাজ শুরু করতে হবে তাদের। উমরু দরবেশ এ এলাকারই বাসিন্দা। উটের ওপর বসে থেকেই তিনি যেন জন্মভূমির মাটির ঘ্রাণ পাচ্ছেন। পুলকিত উমরু দরবেশের চেতনা যখন জন্মভূমির মাটির স্পর্শ পাবার জন্য লালায়িত তখনই তিনি লক্ষ্য করলেন, সে অশ্বারোহী দূরত্ব কমিয়ে সোজা ছুটে আসছে তাদের দিকে। উমরু দরবেশের উৎফুল্ল চেহারায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো। তিনি চলার গতি কমিয়ে দিয়ে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অশ্বারোহীর দিকে। একটু পরই তাদের কাছে এসে পৌঁছুলো অশ্বারোহী।
‘তোমাদের ক্যাম্প ও অবস্থান হবে সামনের ওই পাহাড়ী অঞ্চলে।’ অশ্বারোহী উমরু দরবেশের কাছে এসে বলল, ‘তুমি আমাকে চেন না, কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। তুমি যাতে নির্বিঘ্নে তোমার মিশনের কাজ চালিয়ে যেতে পারো সে জন্য আমরা আশেপাশেই থাকবো। তুমি এখানে একা ও নিঃসঙ্গ নও। তোমার যে কোন বিপদে সাহায্য করার মত লোক সব সময়ই তোমার কাছাকাছি থাকবে। আশা করি তুমি তোমার মিশনের গুরুত্ব ও কথা ভুলে যাওনি!’
তাকে দেখে আশী তার মুখের আবরণ মুক্ত করলো এবং হাসতে হাসতে বললো, ‘যাক, এতক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেল। যেভাবে তুমি আমাদের অনুসরণ করছিলে, আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, মরু ডাকাতের পাল্লায় পড়ে গেলাম না তো?’
আরোহীও হাসতে হাসতে বললো, ‘কিন্তু যাই বলো আশী, আমার তো মনে হয় সফরটা বেশ ভালই হয়েছে। কি বলো?’
‘হ্যাঁ! তা ভালই হয়েছে বৈকি! তবে তুমি পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছো জানলে আরো স্বস্তি পেতাম।’ মুখের হাসি অক্ষুন্ন রেখেই উত্তর দিল আশী।
আরোহীও হাসতে হাসতেই বললো, ‘তোমরা যে এত ভীতু তা তো জানতাম না! যাক, এখন আর ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, বুঝলে তো!’ আরোহী ওদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য উমরু দরবেশের দিকে ফিরে বললো, ‘সফরের সময় পুরো পথেই তোমাদের হেফাজতের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তোমাদের ভয়ের কোন কারণ আগেও ছিল না, এখনও নেই। আমরা ছায়ার মত তোমাদের কাছাকাছি ছিলাম এবং আছি। তোমরা হয়তো সব সময় আমাদের দেখতে পাওনি, কিন্তু আমাদের নজর সব সময়ই তোমাদের ওপর আটকে ছিল। নইলে এমন সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এত দূর রাস্তা এতটা নিরাপদে পার হয়ে আসতে পারতে না।’
‘তুমি কে?’ উমরু দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি একজন সুদানী মুসলমান!’ আরোহী উত্তরে বললো, ‘তুমি কে বা আমি কে এখন আর এ ধরনের প্রশ্ন করো না। তুমিও যা আমিও তাই। আমি আর তুমি দু’জনেই এ এলাকার মুসলমান।’ আরোহী উমরু দরবেশকে সতর্ক করে দিয়ে বললো, ‘নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। তোমার তো ভাল করেই জানা আছে, আমাদের ওপর যে দায়িত্ব আছে তা পালনে সামান্য একটু ভুল হয়ে গেলে এখানকার মুসলমানরা আমাদের হাড্ডি গুঁড়ো করে দেবে।’ আরোহী তাকে আরো বললো, ‘আর এ কথাও মনে রেখো, তুমি যদি তোমার কাজে কোন রকম গাফলতি বা অবহেলা করো কিংবা কোন রকম চালাকী বা বেঈমানী করো তবে কোন রকম সতর্ক না করেই তোমাকে খুন করে ফেলা হবে। তোমাকে এখানে কি করতে হবে সব মনে আছে তো?’
উমরু দরবেশ বললেন, ‘সব মনে আছে। আর আমি আমার দায়িত্বের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন।’
আরোহী বললো, ‘তাহলে আজ রাতটা ওই পাহাড় চূড়ায় তাঁবু খাঁটিয়ে বিশ্রাম নাও। কাল থেকেই তোমার কাছে এখানকার মুসলমানরা আসতে থাকবে।’ তারপর আশীর দিকে ফিরে বললো, ‘সব ঠিকঠাক আছে তো? তুমিও সতর্ক থেকো। এ মিশনের গুরুত্বের কথা মুহূর্তের জন্যও ভুলে যেও না। চলো যাওয়া যাক।’
ওরা আবার চলতে শুরু করলো। উমরু দরবেশ চিন্তা করছিল তার দায়িত্বের কথা। এ এলাকার মুসলমানদের বিপথগামী করার ওয়াদার বিনিময়ে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর ওয়াদা করে রক্ষা পেয়েছেন দুঃসহ নির্যাতনের হাত থেকে। এ অঞ্চলের জনগণের আনুগত্য সুদানের পক্ষে নেয়া এবং এখানকার মুসলমানদেরকে সুদানী সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার জন্য উদ্বুদ্ধ কড়া এ মিশনের অন্যতম গুরু দায়িত্ব।
সুদানীরা মিশরের ওপর আক্রমণ করার পায়তারা কষছে। তাদের ভরসা, সুলতান আইয়ুবী এখন মিশর থেকে দূরে অবস্থান করছেন। সিরিয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে দূরে ক্ষমতাচ্যুত আল মালেকুস সালেহ ও তার সহযোগীদের সাথে এক কঠিন সমরে জড়িয়ে আছেন তিনি। এ সুযোগে মিশর আক্রমণ করলে সহজেই তা অধিকার করা যাবে বলে সুদানীদের বিশ্বাস। এ নিয়ে খৃস্টানদের সাথেও সুদানীদের ব্যাপক আলাপ আলোচনা হয়েছে। খৃস্টানরা তাদের উৎসাহিত করে বলেছে, ‘শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে মিশর আক্রমণ করার এটাই উপযুক্ত সময়।’ কিন্তু একটি কারণে সুদানীরা এ আক্রমণ করার ব্যাপারে গড়িমসি করছে। তাদের প্রধান সমস্যা, সুদানী মুসলমানরা সুদানের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক। মিশরের সাথে সংঘর্ষ শুরু হলে তাদের পক্ষ থেকে খোদ সুদানেই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হওয়ার আশংকা আছে। উমরু দরবেশ এসেছেন মুসলমানদের এ বিশ্বাসের মূলে আঘাত করার জন্য। সেনাবাহিনী দিয়ে যা সম্ভব হয়নি সে অসাধ্য সাধনের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে।
সূর্য ডুবে গেছে। উমরু দরবেশ অশ্বারোহীর সহযোগিতায় পাহাড়ের চূড়ায় এক স্থানে তাঁবু টানিয়ে নিলেন। অশ্বারোহী বিদায়ের আগে বললো, ‘আগামীকাল তোমার সাথে আর আলাদাভাবে কোন কথা বলার সুযোগ হবে না। লোকেরা ভোর থেকেই এখানে আসতে শুরু করবে।’ সে সামনে এক পাহাড় চূড়ার দিকে ইশারা করে বললো, ‘ওদিকে দেখো।’ উমরু দরবেশ তাকালো সেদিকে। অশ্বারোহী বললো, ‘ওখানে ছাতির মত একটি গাছ দেখতে পাচ্ছো?’ সন্ধ্যার আবছা আলোর মধ্যেও সেখানে ছাতির মত গাছটি উমরু দরবেশ ঠিকই দেখতে পেলেন। বললেন, ‘পাচ্ছি।’ অশ্বারোহী বললো, ‘ওদিকে লক্ষ্য রাখবে। আগামীকাল রাতে সেখানে আলো জ্বেলে সাহায্য করা হবে তোমাকে।’ আশীকে বললো, ‘কাল রাতে যে পোশাক তোমার পরার কথা সে কাপড় দিনের বেলাতেই প্রস্তুত করে রাখবে। আমি চললাম। এখন প্রতিটি মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বাবস্থায় সাবধান থাকবে।’
লোকটি চলে যাওয়ার আগে আশীকে ইশারায় কাছে ডাকলো। উমরু দরবেশ যেন তাদের কথা শুনতে না পায় এমন দূরত্বে গিয়ে সে আশীকে বললো, ‘মিশনের এ পর্যায়ে তোমার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি খুবই সাবধান ও সতর্ক থাকবে। এখানকার পাহাড়ী মুসলমানরা স্বভাবতই জংলী। ওদের স্বভাবের সাথে মিশে আছে বন্যতা। যদিও আমরা তোমার হেফাজতে সব সময় দৃষ্টি রাখছি তবু তোমার হেফাজত তোমাকেই করতে হবে। এ লোকটির প্রতিও সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। ওকে তোমার বশে রাখতে চেষ্টা করবে এবং যখন যে কাজ করানো দরকার করিয়ে নেবে।’ সে আশীর কাঁধের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলে হাত দিয়ে একটু হেসে দুষ্টুমির ছলে বললো, এই বেনীর বাঁধনে তো তুমি সিংহ পুরুষকেও বাঁধতে পারো, এবার এ লোকটিকে বেঁধে নাও।’
‘তুমিও তো এখানকারই মুসলমান!’ আশী একটু বিদ্রূপের স্বরে বললো, ‘তুমি পশু নও?’
‘তোমাকে দেখলে কে না পশু হয়ে যায়!’ লোকটি হাসতে হাসতে ঘোড়ার পিঠে উঠে সন্ধ্যার অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এ অশ্বারোহী সেই সব ঈমান বিক্রেতাদের একজন, যারা এরই মধ্যে সুদানীদের খপ্পরে পড়ে গেছে। লোকটি পাহাড়ী অঞ্চলে সুদানীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। পাহাড়ী এলাকার সহজ সরল মুসলমানদের ঈমান ক্রয়ের ব্যাপারে সে ছিল খুবই তৎপর। লোকটি এ অঞ্চলেরই বাসিন্দা। কিন্তু কেউ জানে না, তাদের ঘরের পাশেই বাস করছে এক কেউটে সাপ, জাতির চরম দুশমন ও বিশ্বাসঘাতক। এ ষড়যন্ত্রে সে শুধু একা নয়, তার গ্রুপে এখন কাজ করছে আরো আট-দশজন মুসলমান।
অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে সে তার গ্রামের দিকে চলে গেল। রাস্তায় তার সাথে দেখা হলো দলের আরেক সদস্যের। সে লোক জিজ্ঞেস করলো, ‘খবর কি উস্তাদ, সব ঠিকঠাক আছে?’
‘হ্যাঁ, সবই ঠিক আছে। এদিকের অবস্থা কি বলো?’
পথিক বললো, ‘এদিকের অবস্থাও ভাল। সব ঠিকই আছে!’
অশ্বারোহী বললো, ‘কিন্তু যে কোন মুহূর্তে একটা উলট-পালট ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। আমাদের খুবই হুশিয়ার থাকতে হবে। আরেকটা কথা, তুমি জানো আমি আগে থেকেই বিপদের কথা গন্ধ টের পাই। খৃস্টানরা আমাকে যে ট্রেনিং দিয়েছে তাও আমাকে সতর্ক হতে শিক্ষা দিয়েছে। আমার মন বলছে, মেয়েটার নিয়ত বদলে যেতে পারে। কারণ তাকে যখন আমি অভিযানের গুরুত্ব বুঝাচ্ছিলাম, তখন তাকে অন্যমনস্ক ও নীরব দেখাচ্ছিল।’
‘আশীকে তো খুব সতর্ক ও কর্মপটু বলেই জানতাম।’ লোকটি বললো, ‘লম্বা সফরের কারণে হয়তো ক্লান্তি ও অবসাদে ভুগছে, তাই অমন মনে হয়েছে আপনার। তাছাড়া উমরু দরবেশের মত পশুর অত্যাচারও তার ক্লান্তির কারণ হতে পারে!’
কথা বলতে বলতে ওরা গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলো। অন্ধকার রাত। রাস্তার মোড়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’ব্যক্তি কথা বলছিল। আরোহী ও তার সঙ্গী তাদের পাশ কেটে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে যায়?’
ওরা তাদের পাশে থেমে নিজেদের নাম ও গাঁয়ের নাম বললো। অন্ধকারের কারণে ওরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু গাঁয়ের নাম শুনে ওরা চিনতে পারলো ওখান থেকে আরো দুটো গ্রাম পার হলে পড়ে সে গ্রাম পড়বে। ওরা দু’জন তাদের পরিচয় দিয়ে বললো, ‘ভাই, তোমাদের গাঁয়ে পীর সাহেব কবে এলেন?’
‘পীর!’ লোক দু’জন অবাক হয়ে বললো, ‘কিসের পীর? এখানে কোন পীর তো আসেনি!’
‘কি যে বলো! গ্রামের বাইরে ওই যে বড় পাহাড়টা আছে না, আসার পথে দেখলাম তার চূড়ায় এক পীর সাহেব বসে আছেন। আগে কোনদিন দেখিনি তো, তাই একটু কৌতূহল হলো। আমরা দু’জনই চূড়ায় পীর সাহেবকে দেখতে গেলাম। দেখি এক বুজুর্গ লোক তাঁবু টানিয়ে বসে আছেন। তিনি নাকি শুধু খোদার সাথেই কথা বলেন। দিনের বেলাতেও ডানে বামে মশাল জ্বালিয়ে রাখেন। আমি তাঁকে দেখে তার পাশে গিয়ে বসলাম, দেখলাম তিনি কোরআন পড়ছেন! তিনি কোরআন সামনে রেখেই পড়ছিলেন সে কারণে তিনি আমার দিকে তাকাতে পারেননি। আমি তাঁকে ডাকলাম, তিনি কোন কথা বললেন না। তার তাঁবুর পাশে মাটি থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছিল। এ ধোঁয়ার কুণ্ডলী উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে ধোঁয়ার মধ্য থেকে একটি অপূর্ব মেয়ে বের হয়ে নেমে এলো নিচে। তার রূপের বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। মনে হলো, মেয়েটি মানুষ নয়, জীন জাতির কেউ। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মেয়েটি বুজুর্গ লোকের সামনে গিয়ে সিজদা করলো। সিজদা থেকে উঠে মুখ বুজুর্গ লোকের কানে লাগালো। বুজুর্গের ঠোঁট নড়ে উঠলো। এরপর মেয়েটি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
আমি ভয় পেয়ে পালাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু মাটি আমাকে টেনে ধরলো। মনে হলো, মেয়েটির দৃষ্টি আমাকে অবশ করে দিয়েছে। সে আমার ভীত-চকিত চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভয় পেয়ো না, এ বুজুর্গ খোদার দূত! তোমাদের সকলের কল্যাণের জন্য খোদা একে পাঠিয়েছেন। তাঁকে তোমরা বিরক্ত করো না। তিনি এখন খোদার সাথে কথা বলছেন। তুমি বরং কালকে এসো। যদি তোমাদের ওপর তাঁর মেহেরবানী হয়, তবে তোমাদেরকে তিনি তুর পাহাড়ের জ্যোতি দেখাবেন। তাঁর ডাক পেয়ে আমি এই মাত্র তুর পাহাড় থেকে এসেছি। তিনি আমার কানে কানে বললেন, এ হতভাগাদের বলো, আমি তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবো। কিন্তু কিছু সময় তাদের ধৈর্য ধরতে হবে। যদি তারা অধৈর্য হয়ে যায় তবে আমি অন্যত্র চলে যাবো। তখন তাদের ভাগ্যে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু থাকবে না।’
আমরা মেয়েটির সঙ্গে কোন কথা বলেতে পারলাম না। মোহগ্রস্তের মত আমরা তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। শেষে মেয়েটি বললো, ‘আমার দিকে নয়, হুজুরের দিকে তাকাও।’
আমরা বুজুর্গ লোকের দিকে তাকালাম, দেখলাম তাঁর মাথার উপর জ্যোতির কিরণ। মেয়েটি বললো, ‘যাও! যাও! জলদি চলে যাও! মনের কোন আশা পূরণ করতে চাইলে কাল সকালে এসো।’ আমরা আর দেরী না করে সেখান থেকে চলে এলাম।’
লোকটি কথা বলছিল কাঁপা কাঁপা স্বরে। সে স্বরে ভয় ও বিস্ময়ের এমন ঘোর লেগে ছিল, যেন তার সামনে এখনো সেই জীনকন্যা দাঁড়িয়ে আছে।
মানুষের এই এক দুর্বলতা, বিস্ময়ের কোন কিছু শুনলে তা স্বচক্ষে দেখার আগ্রহ বোধ করে প্রতিটি মানুষ। কৌতূহল এমন এক অদম্য শক্তি, যা না মেটা পর্যন্ত তাকে থামানো যায় না। কৌতূহল তার আবেগকে নাড়া দেয়, মনে আনে শিহরন ও আনন্দের এক অপার্থিব উচ্ছ্বাস। এ উচ্ছাসেরই শিকার হলো ওই দুই শ্রোতা।
আগন্তুকরা চলে গেল। লোক দু’জন কতক্ষণে এ কথা অন্যদের বলবে এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তারা কথা থামিয়ে পাশের বাড়ীর দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে দিল বাড়ীর লোকজন। ওরা তাদের শোনালো সেই জ্বীন-বশ করা পীরের কথা। তারা অশ্বারোহী ও তার সাথীর কাছ থেকে শোনা কাহিনী আরও রং চং মিশিয়ে বললো ওদের। মেয়েটার রূপের এমন রসালো বর্ণনা দিল, শ্রোতারা আল্লাহ, কোরআন আর ওই বুজুর্গের কথা ভুলে মেয়েটার ধ্যানেই মগ্ন হয়ে পড়ল। বাড়ীর মেয়েরাও শুনল এ গল্প। তারা এ খবর পৌঁছে দিল পাশের ঘরে। এশার নামাজের সময় মসজিদের মুসল্লীদের কানে তুলে দেয়া হলো বুজুর্গের কাহিনী। এভাবেই রাতের মধ্যেই গ্রামের অন্যান্য বাড়ীতেও পৌঁছে গেল এ চাঞ্চল্যকর খবর।
ভোর হল। পূর্বাকাশ রাঙিয়ে গোল সূর্য উঁকি দিল আকাশে। ফজরের নামাজের পর মুসল্লীরা মসজিদ থেকেই রওনা দিল সেই পাহাড়ের দিকে। ছেলে-ছোকরার দলও সঙ্গী হলো তাদের। গ্রামের বিভিন্ন রাস্তায় তখন মানুষের স্রোত। সবারই গতি একদিকে। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে উমরু দরবেশ ও আশী ক্যাম্প করে আছে।
তাঁবুর সামনে ছোট একটি কার্পেট বিছানো। তার উপর বসে আছেন উমরু দরবেশ। সংসার বিবাগী ফকিরের মত নির্লিপ্ত চেহারা। দুই চোখ বন্ধ করে ঠোঁট নেড়ে বিড় বিড় করে কিছু পাঠ করছেন। তার ডান ও বাম পাশে একটি করে দু’টি লাঠি মাটিতে পোতা। লাঠির মাথায় তেলে ভেজা কাপড় জড়ানো মশাল জ্বলছে।
গ্রামের লোকেরা সেখানে পৌঁছে উমরু দরবেশের কাছ থেকে আট দশ হাত দূরে তিনজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। গ্রামের লোকেরাও ওদের কাছে এসে থেমে গেল। দাঁড়িয়ে থাকা লোক তিনজনের একজন বললো, ‘আমি সামনে যাচ্ছি, হুজুরের সাথে কথা বলবো।’ সে তিন চার হাত অগ্রসর হতেই পিছনের দিকে ছিটকে পড়ে গেল। এমনভাবে ছিটকে পড়লো, মনে হলো সামনে থেকে কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে ওকে। সে তাড়াহুড়া করে উঠে বসলো এবং পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের সাথে মিশলো। ভয়ে তখনো কাঁপছে লোকটি। চোখে মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। সে ভীত কণ্ঠে বললো, ‘সাবধান, কেউ সামনে যাবেন না। আমাকে কে যেন সামনে ধাক্কা দিয়েছে। নিশ্চয়ই কোন জীন হবে, যাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
অন্য দু’জন বললো, ‘রাখো তোমার জীন! তুমি একটা ভীতুর ডিম। তুমি ভয়ে পেয়ে পড়ে গিয়ে পিছনে চলে এসেছো। তুমি থাকো, আমরা সামনে যাচ্ছি।’
দু’জন এক সাথে হাত তিনেক অগ্রসর হয়েছে, অমনি আগের লোকটির মতই পিছন দিকে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। এ অভাবিত ঘটনায় উপস্থিত সব লোকের মধ্যেই আতঙ্ক ও ভয় ছড়িয়ে পড়ল। সবার মধ্যে এ ধারনা ও বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেলো, হুজুরকে জ্বীনরা পাহারা দিচ্ছে। হুজুরের অনুমতি ছাড়া তারা কাউকে হুজুরের কাছে যেতে দিচ্ছে না।
তাঁবুর মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো আশী। উপস্থিত লোকদের মনে হলো তারা বেহেশতের হুরপরী দেখছে। পরণে তার কালো রেশমী পোষাক। ফিনফিনে পাতলা ওড়না মুখের ওপর। চোখ খোলা। মাথার চুল পেছন থেকে কাঁধের ওপর দিয়ে এনে সামনে বুকের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে। কাপড় পড়েছে সে পর্দানসীন মেয়েদের মতই। কিন্তু সে কাপড় এতই হালকা যে, তাকে প্রায় অর্ধ উলঙ্গ বলতে হয়। এ পার্বত্য এলাকার গ্রাম্য লোকেরা এমন রূপসী মেয়ে জীবনেও দেখেনি। তারা তাকে মনে করলো জ্বীনদের মেয়ে। লোকগুলো তার আকর্ষণীয় দেহবল্লরীর দিকে বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো।
মেয়েটি এগিয়ে হুজুরের সামনে গিয়ে সিজদায় পড়ে গেল। সিজদা থেকে উঠে হুজুরের মুখের কাছে নিয়ে গেল নিজের কান। হুজুরের ঠোঁট নড়ে উঠলো। ঠোঁট নড়া বন্ধ হতেই মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো।
‘তোমরা সবাই ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো!’ আশী লোকদের বললো, ‘কেউ এক কদমও সামনে আসতে চেষ্টা করো না। খোদার দূত জিজ্ঞেস করেছেন, তোমরা এখানে কেন এসেছো? তোমরা নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করতে পারো, কথা বলতে পারো।’
যে লোকটি হুজুরের কাছে আসতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল, সে গলা উঁচু করে বললো, ‘হে খোদার দূত! আপনি কি ভবিষ্যতের সংবাদ বলে দিতে পারেন?
‘কি জিজ্ঞেস করবি, তাই জিজ্ঞেস কর?’ উমরু দরবেশ চোখ বন্ধ রেখেই গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন।
‘আমরা কি এ অঞ্চলে ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবো, যে রাজ্য সুদানী শাসন মুক্ত হবে?’ লোকটি জিজ্ঞেস করলো।
উমরু দরবেশ রাগে প্রচণ্ড জোরে মাটিতে থাপ্পড় মারলেন। আশী দৌড়ে হুজুরের কাছে গিয়ে বসলো। তারপর নিজের কান তাঁর মুখের কাছে লাগিয়ে রাখলো। উমরু দরবেশের ঠোঁট নড়ে উঠলো। আশী উঠে লোকদের বলতে লাগলো, ‘খোদার দূত বলছেন, যদি কখনো পানিতে আগুন জ্বলতে দেখো, তখন তোমরা চেষ্টা করলে এ অঞ্চলকে ইসলামী রাজ্যে পরিণত করতে পারবে, তবে সেখানে সুদানীদেরই নিয়ন্ত্রন থাকবে।’ আশী বললো, ‘কারো কাছে পানি থাকলে সে পানি এই কাপড়ের উপর ঢেলে দাও। তারপর লক্ষ্য করে দেখো সে ভেজা কাপড়ে আগুন জ্বলে কি না।’
উমরু দরবেশের সামনে ফাঁকা জায়গায় এক টুকরো কাপড় পড়েছিল। যে লোকটি একটু আগে প্রশ্ন করেছিল, তাঁর হাতে চামড়ার মশক ছিল। সে সবাইকে শুনিয়ে বললো, ‘আমার কাছে পানি আছে।’ সে সামনে এগিয়ে মশকের মুখ খুললো এবং কাপড়ের ওপর পানি ঢেলে দিল।
আশী উমরু দরবেশের ডান পাশের মশালটি মাটি থেকে উঠিয়ে তাঁর হাতে দিল। উমরু দরবেশ আকাশের দিকে মুখ করে ঠোঁট নাড়লো। তারপর ফিসফিস করে কি যেন বললো, শেষে মশালটি কাপড়ের ওপর চেপে ধরলো। দপ করে জ্বলে উঠলো কাপড় এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কাপড়ই আগুনের শিখায় রুপান্তরিত হয়ে গেলো। কেউ আশা করেনি, ভেজা কাপড় এভাবে জ্বলে উঠবে। কিন্তু তারা স্বচক্ষেই দেখলো, তাদের সামনে ভেজা কাপড় দাউ দাউ করে জ্বলছে। উপস্থিত লোকেরা বিস্মিত হয়ে ফিসফিস করে বলাবলি করতে লাগলো, ‘হায় আল্লাহ! কি তাজ্জব ব্যাপার! আমাদের চোখের সামনেই পানিতে আগুন ধরে গেল?’
‘খোদার ইশারা এখন তোমরা বুঝে নাও।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আর আমার পরিচয় জেনে যাও। আমি তোমাদেরই একজন! এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে যে জেনান পর্বত তার পাদদেশের বস্তিতে আমার বাড়ী। আমি হাশেম দরবেশের ছেলে, আমি নবী নই, পয়গম্বরও নই। খোদার শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। আমি তোমাদের মতই তাঁর একজন নগণ্য উম্মত এবং আল্লাহর শেষ নবীর এক সাধারণ প্রেমিক। আল্লাহর ধ্যানে থাকতে থাকতে একদিন আমি তার জ্যোতির দেখা পেলাম। গায়েবী হুকুম পেলাম, ‘হে উমরু! উঠো যে জ্যোতি তোমাকে দেখালাম সে আলো তাদের দেখাও, যারা এখনও অন্ধকারে ডুবে আছে।’
তিনি এমন ভাবে কথা বলছিলেন, যেন, তাকে দিয়ে কেউ এসব কথা বলাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সেনা অফিসার ছিলাম। আমি সেই বাহিনীতে ছিলাম, যে বাহিনী সুদানের ওপর আক্রমণ করেছিল। মরুভূমির মধ্যে পানির অভাবে পড়ে আমাদের বাহিনী যখন মৃত্যুমুখী সে সময় সুদানী বাহিনী আমাদের পরাজিত করে। এ ব্যর্থতায় আমরা সব মুসলমানই দুঃখ পেয়ছিলাম। তোমরাও হয়তো আমাদের পরাজয়ের খবর শুনে ব্যথিত হয়েছিলে। কিন্তু আল্লাহ জাল্লে শানুহু মিশরের সৈন্যদের লাশের মধ্য থেকে আমাকে উঠালেন এবং আমাকে ইঙ্গিতে জানালেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যদের কেন পরাজয় হলো। আমার দুঃখ আনন্দে রুপান্তরিত হলো। আমি একটি গাছের শাখে খোদার নূর দেখতে পেলাম। এ জ্যোতি ছিল এক উজ্জ্বল তারকার। আকাশ থেকে ছিটকে এসে তা গাছে আটকে ছিল। সেই তারকা থেকে শব্দ এলো, ‘সামনে দ্যাখ! পিছনে দ্যাখ! ডাইনে দ্যাখ বামে দ্যাখ!’
আমি সব দিকেই দেখলাম। আবার আওয়াজ এলো, ‘কোন লোক কি জীবিত দেখতে পাচ্ছো?’ আমার সব দিকেই শুধু লাশ আর লাশ দেখতে পেলাম। এরা সবাই আমারই সেনা দলের লশকর ছিল। এদের মধ্যে কয়জন আহত ও জীবিত আমার জানা ছিল না। কারণ সবাই মরার মত পড়েছিল। একটু আগেও কাউকে কাউকে পিপাসায় ছটফট করতে দেখেছি। এরা সবাই ছিল দুঃসাহসী যোদ্ধা। প্রাণপণ লড়াই করেছে সবাই, মৃত্যু কবুল করেছে, কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেনি। তারকার আলো থেকে আবার আওয়াজ এলো, ‘তুমি কি দেখোনি তোমার তোমার তলোয়ার ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল? তুমি কি দেখোনি তোমাদের তীরের কোন গতি ছিল না? তুমি কি দেখোনি তোমাদের ঘোড়ার পা মাটিতে ভেঙ্গে পড়েছিল?’
তখন আমার মনে হলো- হ্যাঁ, সবই দেখেছি। তারকার জ্যোতি যা বলছে সবই সত্য! যুদ্ধ করতে করতে শেষের দিকে আমার তলোয়ারে আর তেমন ধার ছিল না। আমি আমার তীর দেখেছিলাম, তার গতি বাতাসের বেগে বাঁধা পেয়েছিল, যেন খরকূটো উড়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘোড়াও পিপাসায় দুর্বল হয়ে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। বালির প্রান্তর সূর্যের সমস্ত তাপ গ্রহণ করে আমাকে ও আমার সাথীদেরকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিচ্ছিল। আমিও জ্বলন্ত লাশ হয়ে পড়েছিলাম। সেই তারকার জ্যোতি থেকে আওয়াজ হলো, ‘আমি তোমাকে দ্বিতীয় জীবন দান করলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করো আমি কেন দয়া করলাম?’ আমি জিজ্ঞেস করলে উত্তর এলো, ‘মুসলমানদের প্রতি আমার ভালবাসা আছে। মুসলমান আল্লাহর কালাম পাঠ করে, তাঁর উদ্দেশ্যে রুকু ও সিজদা করে। যাদের এ লাশ, আমিই তাদের শাস্তি যোগ্য করেছিলাম। কারণ তারা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। আমিই তাদের কাউকে কাউকে আবার সরল পথ দেখানোর ইচ্ছা করেছি। এ জন্যই আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি, কারণ তুমি প্রতিদিন ভোরে কোরআন তেলাওয়াত করো। যাও! তোমাকে আলো দান করলাম। এ আলো আল্লাহর মুসলমান বান্দাদেরকে দেখাও।’
আমি ভাল মতো বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘হে আমার প্রভুর আলো! আমাকে সম্পূর্ণ খুলে বলো, আর বলো আমার কথা কে মানবে ও কেমন করে মানবে? আমাকে বলো, আমার তলোয়ার কেন দুর্বল হয়েছিল? তীরের গতি কোথায় গিয়েছিল?’ সেই আলো থেকে উত্তর এলো, ‘সে তলোয়ার দুর্বল হয়ে যায়, যে তলোয়ারের আঘাত মায়ের উপর পড়ে, সে তীর খরকূটোর মত উড়ে যায়, যে তীর তাঁর মায়ের বুকে নিক্ষিপ্ত হয়। তুমি জানো, মা কে? যে মাটি তোমাকে জন্ম দিয়েছে আর যে মাটিতে তুমি খেলাধুলা করে বড় হয়েছো, সেই তোমার মা! যাও, সুদানের মুসলমানদের বলো, সুদান তোমাদের মাতৃভূমি, তোমাদের মা! তাকে ভালবাসো! এ মাটিই তোমাদের জান্নাত! এ জান্নাতকে দখল করার জন্য যদি বাইরের কোন মুসলমানও আসে, সে দোজখে যাবে। তুমি তো জাহান্নাম দেখেই নিয়েছ! যাও, তোমার কালেমা পড়া ভাইদের গিয়ে বলো, সুদানই তোমাদের মা! সুদানই তোমাদের জান্নাত! যাদের দিলে রহম আছে, মায়ের প্রতি দরদ আছে, তারা তোমার আলোয় আলোকিত হবে।’
‘হে আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি! তোমাকে সম্মান করা সকলের জন্য ফরজ!’ একজন বলল, ‘সুদানের বর্তমান বাদশাহ আমাদের রাসুলের অনুসারী নয় জেনেও কি তুমি আমাদেরকে তার আনুগত্য করতে বলো?’ এ লোক ছিল সেই আছাড় খাওয়া তিনজনের একজন।
‘খোদার আওয়াজ আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, এ বাদশাহ কাফের কিন্তু শীঘ্রই তিনি মুসলমান হয়ে যাবেন।’ উমরু দরবেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তিনি মানসিকভাবে মুসলমান হয়ে আছেন। তার সেনাবাহিনীর অধিকাংশই কাফের বলে তিনি এখনো মুসলমান হওয়ার ঘোষণা দিতে সাহস পাচ্ছেন না। তিনি উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছেন। আল্লাহ ও তার রাসুলের পতাকা হাতে নেয়ার জন্য তিনি কিছু সাহসী সঙ্গী খুঁজছেন। তোমরা সবাই তার হাতকে মজবুত করার জন্য ছুটে যাও! তলোয়ার, বর্শা, তীর-ধনুক যা আছে তাই নিয়ে ছুটে যাও! উট ও ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে যাও! তোমরা দুনিয়াকে দেখিয়ে দাও, মাতৃভূমিকে তোমরা সবাই ভালবাসো। মাতৃভূমির রক্ষকের রক্ষীবাহিনী তোমরা, তোমরা সুদানের সন্তান!’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন দরবেশ। তার সামনে পাহাড়ী অঞ্চলের বিশাল জনতা। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল তার কথা। প্রশান্ত সকালের শান্ত কোমল পরিবেশে দাঁড়িয়েছিল লোকগুলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। নিরবতা ভাঙলেন দরবেশই, ‘আমি খোদার জ্যোতিকে বললাম, আমার মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, কেউ মানবে না আমার কথা। এ কথা বললে, আমার মুসলমান ভাইয়েরাই আমাকে হত্যা করবে।’ খোদার জ্যোতি থেকে আওয়াজ এলো, ‘তোর সাথে আমার নিশানা থাকবে। বল, পানিতে কি কখনো আগুন জ্বলে? তোকে আমি পানিতে আগুন জ্বালানোর ক্ষমতা দেবো। আমি ছাড়া পানিতে কে আগুন লাগাতে পারে? যা, তোকে আমি এ শক্তি শুধু প্রমাণের জন্য দান করলাম, যেন লোকেরা তোর কথা বিশ্বাস করে।’ আমি এ কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলাম। আবারও জ্যোতি থেকে আওয়াজ এলো, ‘যদি তোর কথা লোকেরা তবুও মিথ্যা বলে, তবে তাদেরকে আমার কাছে ডাকবি। আমি তাদেরকে সেই তাজাল্লি দেখাবো, যে তাজাল্লি মুসাকে দেখিয়েছিলাম। তোমরা কি তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখে সত্যকে মানবে?’ উমরু দরবেশ বললেন।
‘হ্যাঁ, হে খোদার দূত, আমরা মানবো।’ সে তিনজনের একজন বললো, ‘যদি তুমি আমাদের তুর পাহাড়ের জ্যোতি দেখাতে পারো তবে আমরা তোমার কথাকে খোদার আওয়াজ বলে মেনে নেবো।’
‘যাও!’ উমরু দরবেশ রাগে মাটিতে হাত মেরে বললেন, ‘তোমরা এখন চলে যাও! তোমরা সেই সময় আসবে, যখন সূর্যের কিরণ পাহাড়ের পিছনে হারিয়ে যায় আর আকাশে তারকার প্রদীপগুলো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠে। যাও! তোমরা এখন চলে যাও!’
লোকেরা সবাই ফিরে চললো। তাদের মুখে এখন দরবেশের কথা ছাড়া আর কোন কথা নেই। ওরা তিনজন, পাঁচজন, সাতজন ছোট বড় নানা আকারের দলে ভাগ হয়ে কলরব করতে করতে গাঁয়ের পায়ে চলা বিভিন্ন পথ ধরে ফিরে যাচ্ছিল গ্রামে। তাদের অধিকাংশের অন্তরেই এখন আর কোন সন্দেহ নেই, এ লোক সত্যি কথাই বলেছে। মানুষের স্বভাবগত দুর্বলতার শিকার হয়ে ওরা ভাবতে লাগলো, হায়! এতদিন আমরা কি ভুলের মাঝেই না ছিলাম! এভাবে নিজের অজান্তেই তার নিজের বিশ্বাস ও ঈমানকে নিঃশেষ করে দিল। এতদিনের জেহাদী জোশ ঠাণ্ডা হয়ে গেল একদিনে। পাহাড়ী অঞ্চলের অশিক্ষিত সরল সহজ লোকগুলো সামান্য কয়টি রহস্যময় কথায় বিভ্রান্তির অতল তলে হারিয়ে যেতে লাগলো। অজানা কৌতূহলের মধুর শিহরণে আন্দোলিত হতে থাকলো ওদের হৃদয়গুলো।
গ্রামের নেতৃস্থানীয় এক লোক বললো, ‘সবই ঠিক আছে। তবু একটু তত্ত্ব-তালাশ করে দেখা দরকার, সে কেমন লোক। তাঁর বাড়ী তো এখান থেকে বেশী দূরে নয়।’
কয়েকজন যুবক এ কথায় লাফিয়ে উঠে বললো, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা এখুনি তাঁর গ্রাম থেকে ঘুরে আসছি।’
নিজেদের কাজ ফেলে ওরা ছুটলো উমরু দরবেশের বাড়ী। কেউ একটু সন্দেহ প্রকাশ করলে অন্যেরা তাকে দাবিয়ে দিত। বলতো, ‘তুমি কি পানিতে আগুন ধরাতে পারবে?’ অন্য একজন বলে উঠতো, ‘ঠিক আছে, তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখে কি বলবে?’
‘আগে তো জ্যোতি দেখি! তারপর বুঝবো তিনি সত্যি কথাই বলেছেন কিনা!’
জনতা উৎসুক আগ্রহে অপেক্ষা করছিল রাতে তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখার জন্য। আশীকে ওরা এক বাক্যে জ্বীনদের মেয়ে স্বীকার করে নিলো।
এরা সেই সব মুসলমান, যারা সুদানের অমুসলিম শাসককে এতদিন কাঁপিয়ে রেখেছিল। সুদানের সেনাবাহিনীকে তারা পার্বত্য অঞ্চল থেকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দা ও রাসূলের একনিষ্ঠ প্রেমিক ছিল। সুদানের নাগরিক হয়েও তারা তাদের পার্বত্য অঞ্চলকে মনে করতো স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। এ জন্যই তারা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে তাদের নেতা মানতো। কিন্তু উমরু দরবেশের সম্মোহনী আকর্ষণ ও কথার জাদু তাদেরকে বিপথগামী করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল তাদের চিন্তাধারার গতি। বলিষ্ঠ ঈমানের অধিকারী একটি যোদ্ধা সম্প্রদায়ের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদেরকে নিরস্ত্র করে দিল। তারা যে দিকে গেল, সে দিকেই এ অলৌকিক পীরের কথা ছড়াতে লাগলো। তারা যা দেখেছে ও শুনেছে তার চেয়ে বাড়িয়ে আকর্ষণীয় রঙ চড়িয়ে পীরের কাহিনী বলে বেড়াতে লাগলো লোকদেরকে।
‘সুদানী মুসলমান মিথ্যা ও চটকদার নিন্দার কাছে শেষে অস্ত্র সমর্পণ করলো!’ সুলতান আইয়ুবী পাহাড়ী অঞ্চলের খবর পাওয়ার পর আক্ষেপের সুরে বললেন। তিনি সুদান থেকে বহু দূরে ফিলিস্তিনের দ্বারপ্রান্তে এক পাহাড়ী উপত্যকায় তার সেনাপতি, কমান্ডার ও উপদেষ্ঠাদের মাঝে বসেছিলেন। তকিউদ্দিনের কাসেদ কিছুক্ষণ আগেই তাঁর কাছে পৌঁছেছে। তিনি তকিউদ্দিনের চিঠি পড়ে বললেন, ‘এটাকে হালকা করে দেখার উপায় নেই।’
তকিউদ্দিন লিখেছিলেন, ‘আলী বিন সুফিয়ান বণিকের বেশে সুদানে যাচ্ছেন।’ চিঠিতে তকিউদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘সুদানের পাহাড়ী মুসলিম এলাকাতে কমান্ডো বাহিনী পাঠানো যাবে কিনা?’
তকিউদ্দিন সন্দেহ প্রকাশ করে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘কমান্ডো বাহিনী পাঠালে তা অতি গোপনে ও সাবধানে পাঠাতে হবে। কারণ ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে প্রকাশ্য যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাতে আমাদের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী। কারণ মিশরের অধিকাংশ সৈন্য আরবের মাটিতে যুদ্ধ করছে।’ চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘সুদান সরকার মুসলমানদেরকে তাদের অনুগত বানানোর জন্য আমাদের যুদ্ধবন্দীদের ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে।’
সুলতান আইয়ুবী চিঠি পড়ে তার সেনাপতি ও উপদেষ্ঠাদের বললেন, ‘সুদানের এ সব মুসলমান সুদানী বাহিনীর জন্য এক আতংকের কারণ! তোমরা তো স্বচক্ষেই দেখছো, সেখানকার যেসব সৈন্য আমাদের বাহিনীতে আছে, তারা কেমন মরণপণ করে যুদ্ধ করছে। কিন্তু শত্রুরা এখন তাদেরকে জাদুর পরশে বিভ্রান্ত করছে। তাদেরকে আরাম ও বিলাসিতার দিকে আকৃষ্ট করছে। ফলে তারা বালির মূর্তি সেজে বসেছে। তকিউদ্দিন আমাকে জানিয়েছে, খৃস্টানরা সুদানের মুসলিম এলাকায় তাদের প্রোপাগান্ডা জোরদার করেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তোমরা তো জানোই, তারা এসব কাজে খুব পটু। আমি যতদূর জানি, সুদানীদের উপদেষ্ঠা খৃস্টানরা সব সময় তাদের পাশে থেকে তাদেরকে এসব কুমন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের পরামর্শেই তারা মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হেনে চলেছে।’