উমরু দরবেশের তাঁবু থেকে দু’আড়াই মাইল দূরে মিশরের একটি বাণিজ্য কাফেলা এসেছে। কাফেলায় মাত্র চারজন বণিক ও ছয়টা উট। কাফেলার সরদার এক বুড়ো। তার লম্বা পাকা দাড়ি, কিন্তু সুঠাম শরীর। চেহারায় খেলা করছে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তি। তার এক চোখে সবুজ রংয়ের কাপড়ের পট্টি, যেন সে চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে। মাত্র দু’রাত আগে এ কাফেলা সুদানের সীমান্ত পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে। সুদানে গোপনে খাদ্য পাচারকারীদেরই একটি দল এ কাফেলা। অন্য স্মাগলাররাও আছে সেখানে।
সুদানে তখন খাদ্য শস্যের চরম সংকট চলছিল। সুদান সরকার তাই এসব চোরাকারবারীদের ব্যাপারে ছিল নির্লিপ্ত। সরকার এদের দেখেও দেখতো না, জেনেও জানতো না। ফলে কোন রকম সরকারী বিধি নিষেধের ভয় ছিল না চোরাকারবারীদের। এ স্মাগলারদের অধিকাংশই ছিল মিশরের গোয়েন্দা। ফলে মিশরের সীমান্ত পুলিশও ওদের কোন রকম বাঁধা দিত না। আর সুদানের সীমান্ত রক্ষীরা তো এদের পথ নিষ্কণ্টক করার জন্যই ব্যতিব্যস্ত থাকতো। ফলে এ কাফেলা বিনা বাঁধা ও ঝামেলায় সীমান্ত পার হয়ে সুদানে প্রবেশ করলো। এ কাফেলা সুদানের কোন শহর বা কোন অঞ্চল যাচ্ছে এ নিয়ে সুদানী রক্ষীদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। তবু সতর্কতার জন্য সুদানে প্রবেশ করেই তারা মুসলিম প্রধান পাহাড়ী অঞ্চলের পথ না ধরে অন্য দিকে চলতে লাগলো।
সুদান সরকার পাহাড়ী মুসলিম এলাকায় গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিল। যেহেতু পাহাড়ী মুসলমানরা সুদান সরকারের অনুগত নয়, তাই নতুন কোন কাফেলা এলে তাদের দিকে কড়া নজর রাখার দায়িত্ব ছিল তাদের। সরকার চাচ্ছিল, খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে ওখানকার জনজীবন যেন দুর্বিসহ হয়ে উঠে। এ জন্য খাদ্যবাহী চোরাকারবারীরা সে এলাকায় গেলে তাদেরকে হেনস্তা করার নির্দেশ ছিল এ গুপ্তচরদের।
সরকারের এ মনোভাব জানতো কাফেলার সরদার। তাই তিনি সারা রাত পথ চলে ভোর বেলা উটগুলোকে টিলার মধ্যে লুকিয়ে ফেলতেন। সারাদিন টিলার আড়ালে থেকে রাত হলে আবার পথে নামতেন। এভাবেই পথ চলছেন তিনি। সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছেন দেশের অনেক গভীরে।
দিন শেষে আবার নেমে এলো রাতের অন্ধকার। কাফেলা যাত্রা শুরু করলো এবং রাতের দ্বিপ্রহরে গিয়ে পৌঁছল তাদের সেই আকাঙ্খিত পাহাড়ী এলাকায়। এক স্থানে তাঁবু গেড়ে কাটিয়ে দিল বাকী রাতটুকু।
ভোর রাতে কাফেলা একটি গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলো। তখনো সূর্য উঠেনি। কাফেলার সরদার এক বাড়ীর সামনে গিয়ে থামলেন ও দরজায় করাঘাত করলেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ীর গেট খুলে এক ব্যক্তি হাতে হারিকেন নিয়ে বাইরে এলো। কাফেলার সরদার তার কানে কানে কিছু বললেন। লোকটি তাদের খোশ আমদেদ জানিয়ে বললো, ‘আপনারা সবাই জলদি ভেতরে প্রবেশ করুন, উটগুলো আমরা হেফাজত করছি।’
চারজন বণিক সে বাড়ীতে মেহমান হিসেবে প্রবেশ করলো। বাড়ীর মালিক বাড়ীর সবাইকে জাগালেন এবং কয়েকজন পড়শীকে ডেকে পাঠালেন। পড়শীরা এলে ছয়টি উট বন্টন করে দিলেন তাদের কাছে। ওরা সেগুলো নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যার যার বাড়ী ফিরে গেল। কাফেলার সরদার বললেন, ‘তোমরা উটের পিঠের মাল-সামান জলদি নামিয়ে লুকিয়ে ফেলো।’
ওরা উটের পিঠের মালসামান নামিয়ে দেখলো তাঁর মধ্যে তীর ও যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া কোন খাদ্যশস্য নেই। ওরা তীর, ধনুক, তলোয়ার, বর্শা ও খঞ্জরগুলো দ্রুত লুকিয়ে ফেললো। তিন চার ড্রাম গোলা বারুদ ও পেট্রোল ছিল, সেগুলোও লুকিয়ে রাখলো গোপন জায়গায়। তারপর ফিরে এলো আগের বাড়ীতে।
‘আমি কি এখন তোমাদের সামনে খোলামেলা কিছু কথা বলতে পারি?’ কাফেলার সরদার বললেন।
‘কোন ভয় নেই, এরা সবাই আমাদের নিজস্ব লোক!’ মেজবান বললো।
কাফেলার সরদার তাঁর লম্বা দাড়ি খুলে ফেললেন এবং চোখ থেকে সবুজ পট্টি সরিয়ে দিলেন। কৃত্রিম দাড়ি সরাতেই তাঁর আসল সুন্দর করে ছাটা দাড়ি বেরিয়ে পড়লো। একদম নতুন মানুষে পরিণত হয়ে গেলেন তিনি। মালসামান লুকিয়ে রেখে যারা এসে সমবেত হয়েছিল মেহমানের কাছে তাদের এক ব্যক্তি কাফেলার সরদারকে আপন চেহারায় দেখতে পেয়ে থতমত খেয়ে গেল। সরদার হেসে বললেন, ‘আমাকে তাহলে এতক্ষণ চিন্তে পারোনি, তাই না?’
‘আলী বিন সুফিয়ান!’ লোকটি বলে উঠলো, ‘সত্যি আমি আপনাকে এতক্ষণ চিন্তে পারিনি।’ তারপর লোকটি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমাদের কি পরম সৌভাগ্য যে, আপনি নিজেই এসে গেছেন। এখানকার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ! অবস্থার নাজুকতায় আমি কোন কূলকিণারা পাচ্ছিলাম না! আপনি এসে গেছেন, এবার পরিস্থিতি সামাল দিন।’
‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছিলাম, এখানকার অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যাবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমি যখন সংবাদ পেলাম, সুদানের কারাগারের এক প্রহরী সুদানের সামরিক বিভাগের কমান্ডারকে হত্যা করেছে, আর জানতে পারলাম, সুদান সরকার মিশরী যুদ্ধবন্দীদের আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছে, তখনই বুঝেছিলাম, এখানে ভয়ংকর কোন ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে।’
এ বহুরূপী লোকটি ছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান। তিনি এখন যে বাড়ীতে এসে উঠেছেন, সেটিই এখানকার মিশরীয় গোয়েন্দাদের প্রধান ঘাঁটি। বাড়ীর মালিক একজন সুদানী! সুলতান আইয়ুবীর এক বিশ্বস্ত ভক্ত। এখানকার গোয়েন্দা প্রধান একটু পর আলী বিন সুফিয়ানকে শোনাল এক নতুন খবর।
‘চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, খোদার এক দূত এসেছেন, যিনি পানিতে আগুন ধরাতে পারেন।’ বাড়ীর মালিক আলী বিন সুফিয়ানকে জানালেন, ‘তিনি মানুষের মাঝে আজগুবী কথা বলে বেড়াচ্ছেন। খোদা নাকি তাঁকে মৃত লাশের মধ্য থেকে উঠিয়ে এনেছেন। তিনি লোকজনদের বলে বেড়াচ্ছেন, ‘মুসলমানদের গিয়ে বলো, তারা যেন সুদানের ভক্ত ও অনুগত হয়ে যায়। কারণ সুদানের মাটি তোমাদের মা।’
তিনি উমরু দরবেশ সম্পর্কে সব কথা আলী বিন সুফিয়ানকে জানালেন।
‘আমার এটিই বড় ভয় ছিল, শত্রুরা এবার মুসলমানদের ঈমানের ওপর আঘাত হানবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘সে কারণেই আমি নিজে এসেছি। খৃস্টানরা ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কাজের নিপূণ ওস্তাদ আর আমাদের জাতি সব সময় হুজুগে মাতাল। খৃস্টানদের কথার যাদুতে মজে যায় ওরা। আমাদের সরল সহজ মুসলমান ভাইদের মনে সন্দেহ সৃষ্টিতে দক্ষ কারিগরের মতই কাজ করে ওরা। আমার জানা দরকার এ ফেৎনার মূল কোথায়! উমরু দরবেশকে আমি ভাল মতই চিনি। তিনি আমাদের সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার ছিলেন। সুদানিদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন তিনি। এমন কথা তাঁর মুখ থেকে বলার কথা নয়। তাকে কখনো দুর্বল ঈমানের লোক মনে হয়নি। সত্যি যদি তিনি এসে থাকেন এবং এসব কথা বলে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি সুদানীদের ফাঁদে পা দিয়েছেন অথবা এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। যাই হোক, আমাকে এর আসল কারণ জানতে হবে।’
এ অঞ্চলে মিশরের গোয়েন্দা ও কমান্ডোদের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। আলী বিন সুফিয়ান মেজবানকে বললেন, ‘তুমি কিছু বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ও কমান্ডোকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করো। এ দুষ্কর্মের সমুচিত জওয়াব দিতে হবে।’
সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। গোয়েন্দা ও কমান্ডোদের ডেকে আনার জন্য লোকজন ছুটলো এদিক-ওদিক। তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই এক অশ্বারোহী তীর বেগে ছুটে এসে সেই বাড়ীর সামনে থামলেন। আরোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে যখন ভেতরে প্রবেশ করলেন, সবাই দাঁড়িয়ে গেল তাঁকে সম্মান জানাতে। এই সেই ইমাম, যিনি উমরু দরবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। লোকেরা তাঁর কথা না শুনে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে তাঁর ওপরই আক্রমণ চালিয়েছিল দু’ব্যক্তি। ইমাম সাহেব তাদের প্রতিহত করলে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ বাড়ীটি যে মিশরী গোয়েন্দাদের গোপন মিলন কেন্দ্র, এ কথা তিনি জানতেন। পাহাড় থেকে ফিরে প্রথমে তিনি মসজিদে যান, সেখান থেকে বাড়ী ফিরেই চড়ে বসেন ঘোড়ার ওপর। কালবিলম্ব না করে সাথে সাথে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এ গ্রামের দিকে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, উমরু দরবেশের কার্যকলাপ ভিলকিবাজী ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি এখানে ছুটে এসেছেন সে কথা জানাতে এবং কি করে এ ভিলকিবাজী ও প্রতারণা বন্ধ করা যায় তা জানতে। তাকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালে আলী বিন সুফিয়ানও উঠে দাঁড়ালেন। কারণ, ইমাম সাহেব ও আলী বিন সুফিয়ান কেউ কাউকে চিনতেন না।
ইমাম সাহেবকে আলী বিন সুফিয়ানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘ইমাম সাহেব, উমরু দরবেশ সম্পর্কে সবকিছু আমাকে খুলে বলুন। এ কি আসলেই উমরু দরবেশ, নাকি তাঁর নামে অন্য কেউ এসব করে বেড়াচ্ছে?’
তিনি তাঁকে উমরু দরবেশের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। কিভাবে উমরু দরবেশ লোকদের সম্মোহিত করছে, ভেলকিবাজির খেলা দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে এসব বলে বললেন, ‘না, এ লোক উমরু দরবেশই। আমরা তাঁর গ্রামের বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে খবর নিয়েছি এবং তাঁকে চিনে এমন লোক দিয়ে সনাক্ত করিয়েছি।’ ইমাম সাহেব আরো বললেন, ‘যদি তার এ কার্যকলাপ ও প্রচার বন্ধ করা না হয় তবে এখানকার মুসলমানরা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ লোক নিজেকে খোদার দূত দাবি করছে। আজ রাতে উমরু দরবেশ সামনের গ্রামে ভিলকিবাজী দেখাবে।’
ইমাম সাহেব ও উপস্থিত লোকজন এর কি বিহীত করা যায় এ নিয়ে আলোচনায় বসলেন। অধিকাংশই বললেন উমরু দরবেশকে হত্যা করা হোক।’ আলী বিন সুফিয়ান এ মতের সাথে একমত হতে পারলেন না। তিনি সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘উমরু দরবেশকে হত্যা ছাড়াই সঠিক পথে আনা যাবে। আর তাঁর মুখ দিয়েই বলানো হবে, সে যা দেখিয়েছে তা সবই ভেলকিবাজী! সব মিথ্যা! কিন্তু তাঁকে হত্যা করা হলে লোকেরা তাকে আরও বেশী সত্য বলে মনে করতে থাকবে।’ আলী বিন সুফিয়ানের সাথে অন্য যে তিনজন বণিকের বেশে এসেছিলেন তারা মিশর সেনাবাহিনীর পরীক্ষিত সৈনিক ও গোয়েন্দা। আলী বিন সুফিয়ান আবার আগের চেহারায় ফিরে গেলেন। এক চোখে সবুজ কাপড়ের পট্টি বাঁধলেন আর মুখে লাগালেন লম্বা পাকা দাড়ি। সঙ্গী তিনজনকে বণিকের বেশেই তৈরী হতে বলে লোকদের ঘোড়া সাজাতে বললেন, আরও কয়েকজনকে বললেন ঘোড়া ও উটে চড়ে তার পিছু নিতে। সবাই তৈরী হলে ইমাম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেদিকে যাত্রা করলেন, যেখানে উমরু দরবেশ আজ রাতে তুর পাহাড়ের নূর দেখাবে বলে প্রচার করেছে।
উমরু দরবেশ পরদিন সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথেই আশীকে নিয়ে নতুন ঠিকানায় যাত্রা করলেন। তাঁর সঙ্গী-সাথীরা সে এলাকায় আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। তারা হুজুরের আগমন বার্তা প্রচার করছিল জোরেশোরে। আশী ছাড়াও তাঁর হেফাজতের জন্য তাঁর সঙ্গে চললো সেই তিন লোক, যারা তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।
উমরু দরবেশের আগমন বার্তা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। পথে তিনি এক গ্রামের পাশে এসে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি করলেন এবং সেখানে তাঁবু টানিয়া বিশ্রাম নিলেন। তারপর দুপুরের পর পরই নির্ধারিত গ্রামে পৌঁছে উপযুক্ত স্থান বেছে নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে রাতের প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। আশীও প্রস্তুত হয়ে গেল।
তাঁবুর সামনে দু’টি মশাল জ্বালিয়ে রাখা হলো। উমরু দরবেশের সাথীরা আশপাশের গ্রামে গিয়ে খোদার দূতের মোজেযার কাহিনী প্রচার করে তিনি যে সেখানে আস্তানা গেড়েছেন সে কথা বলে বেড়াতে লাগলো। লোকজন খোদার দুতকে দেখার জন্য ছুটলো তাঁর আস্তানার দিকে। যারা গতকাল উমরু দরবেশের কেরামতি দেখেছিল তারাও দুরের পথ অতিক্রম করে সেখানে এসে পৌঁছুলো।
সন্ধ্যা হতে তখনো বেশ বাকী। এখনো আছরের আজান হয়নি, এরই মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে তাঁবুর সামনের খোলা প্রান্তর। আশী তাঁর সেই চমকপ্রদ পোষাক পড়ে পরী সেজে বেরিয়ে এলো তাঁবুর বাইরে। আগের দিনের মতই শুরু হলো তাদের অভিনয়। উমরু দরবেশ দুই মশালের মাঝখানে একটি ছোট জায়নামাজ বিছিয়ে সেখানে গিয়ে বসলেন। তাঁর সামনে পড়ে আছে কিছু শুকনো কাপড়, যেমন পড়েছিল গত কালের প্রদর্শনীর সময়। এক ব্যক্তি ঠিক আগের মতই প্রশ্ন করলো, ‘আপনার কথা আমরা কেন বিশ্বাস করবো? আপনি কি আমাদের কোন মোজেযা দেখাতে পারবেন?’
উমরু দরবেশও আগের মতই অভিনয়ের স্বরে বলতে লাগলেন, কারো কাছে যদি কোন পানির পাত্র থাকে তবে সে যেন পানি দিয়ে তাঁর সামনে পড়ে থাকা কাপড়গুলো ভিজিয়ে দেয়। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে উমরু দরবেশের খেলা দেখতে লাগলেন আলী বিন সুফিয়ান ও তার সঙ্গীরা। তিনি উমরু দরবেশকে দেখেই চিনতে পারলেন। মিশরের সেনাবাহিনীর কোন ব্যাটেলিয়নের কমান্ডারকে চিনতে না আলী বিন সুফিয়ান, তা তো হয় না! উমরু দরবেশকে চিনতে পেরে তিনি যে কেবল তাজ্জব হলেন তাই নয়, ব্যথিতও হলেন, শেষ পর্যন্ত উমরু দরবেশও বেঈমানের তালিকায় নাম লেখালো!
আলী বিন সুফিয়ানকে আগেই জানানো হয়েছিল, উমরু দরবেশ পানিতে আগুন জ্বালাতে পারেন। আলী বিন সুফিয়ান অভিজ্ঞ এবং দূরদর্শী মানুষ। তিনি জানেন, পানিতে কখনও আগুন জ্বালানো সম্ভব নয়। মনের সন্দেহ দূর করার জন্য তিনি ছোট একটি মশকে করে কিছু পানি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। উমরু দরবেশ যার কাছে পানি আছে তাঁকে কাপড়ের ওপর পানি ঢালতে আহবান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে এক লোক দ্রুত অগ্রসর হয়ে কাপড়ের ওপর পানি ঢেলে দিল।
আলী বিন সুফিয়ানও সঙ্গে সঙ্গে সামনে অগ্রসর হয়ে মাটি থেকে একটি মশাল তুলে নিয়ে উঁচু করে ধরলেন এবং উপস্থিত লোকদের বললেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যে কোন একজন সামনে এসো।’ আলী বিন সুফিয়ানের তিন সঙ্গীর একজন সামনে এসে দাঁড়ালো। তিনি মশাল তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এ কাপড়ের ওপর মশালের শিখা স্পর্শ করো।’ লোকটি থতমত খেয়ে প্রথমে আলীর দিকে, তারপর উমরু দরবেশের দিকে এবং সবশেষে জনতার দিকে ফিরে তাকালো। আলী বিন সুফিয়ান দর্শক জনতাকে উদ্দেশ্য করে আবারও বললেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকেও যে কোন লোক এ ভেজা কাপড়ে আগুন ধরাতে পারবে।’ আলী মশাল ধরা লোকটির দিকে আবার ফিরে তাকাতেই সে মশালের শিখা কাপড়ের কাছে নিয়ে গেল। দপ করে কাপড়ে জ্বলে উঠলো আগুন। উমরু দরবেশের দলের এক লোক তেড়ে এলো আলীর দিকে। বলে উঠলো, ‘তুমি কোথাকার জাদুকর হে! তুমি জলদি সরে যাও এখান থেকে, নইলে খোদার দূতের ইশারায় তোমার ওপর গজব নেমে আসবে।’
উমরু দরবেশ চুপ করে থেকে বিস্মিত চোখে আলী বিন সুফিয়ানকে দেখছিলেন। আলী বিন সুফিয়ান তাঁর কোমরে জড়ানো কাপড় খুলে উমরু দরবেশের সামনে রেখে তাতে পানি ঢেলে বললেন, ‘যদি তুমি খোদার দূত হও তবে এ কাপড়ে আগুন ধরাও।’ তিনি মশাল উমরু দরবেশের সামনে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু উমরু দরবেশ নির্বাক এবং নিশ্চল, যেন তিনি আলী বিন সুফিয়ানের কথা শুনতেই পাননি অথবা শুনলেও তাঁর কথা তিনি কিছুই বুঝেননি এমন একটি ভাব নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে।
জনতার মধ্যে শুরু হলো পরস্পরের কানাকানি ও ফিসফিসানি। আলী বিন সুফিয়ানের লোকেরা বলতে লাগলো, ‘এ ব্যাটা নিশ্চয় ভন্ডপীর! নইলে এখন আগুন ধরাচ্ছে না কেন?’ ওদিকে উমরু দরবেশের সঙ্গীরাও তৎপর হয়ে উঠলো। তারা বলতে লাগলো, ‘হুজুরের ধ্যানে বিঘ্ন ঘটিয়েছে বলে নাখোশ হয়েছেন হুজুর। হুজুরের সাথে যে লোক বেয়াদবী করেছে তাঁর বিচার না করলে হুজুরের ইশারায় এখানে গজব নেমে আসবে। ধরো, পাকড়াও করো সে বেআদবকে।’ একটা বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোল বেঁধে গেল সেখানে। প্রত্যেকেই কোন না কোন পক্ষ অবলম্বন করলো। কেউ এ দলে তো তার সঙ্গী চলে গেল অন্য দলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনতা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল।
দূর থেকেও শোনা যাচ্ছিল ইমাম সাহেবের আওয়াজ। তিনি উচ্চ কণ্ঠে বলছিলেন, ‘এ লোক দাগাবাজ, প্রতারক! তোমরা এ ভণ্ড দরবেশকে পাকড়াও করো, দেখবে তার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।’
উভয় পক্ষের মূল বাদানুবাদকারীরাই ছিল গোয়েন্দা বিভাগের লোক। ঝগড়া এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছুলো যে, তা এক যুদ্ধের রূপ নিল। জনগণ যখন এ বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত তখন আলী বিন সুফিয়ান উমরু দরবেশের সামনে গিয়ে বললেন, ‘উমরু দরবেশ!’ তিনি খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঈমান বিক্রি করে কত মূল্য পাওয়া গেল?’
‘তুমি কে?’ উমরু দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন।
‘অনেক দূর থেকে এসেছি বন্ধু!’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তোমার সুনাম ও খ্যাতি সীমান্তের ওপার থেকে শুনেছি, তাই তোমাকে দেখতে এসেছি।’
উমরু দরবেশ সাবধানে এদিক-ওদিক তাকালেন ও অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। শেষে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘সত্যি কথা বলার আগে জানতে চাই, তোমাকে কতটুকু বিশ্বাস করতে পারি?’
‘আমার দাড়ির উপর হাত দাও।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন ‘এটা কৃত্রিম দাড়ি। ঈমানের যে মূল্য তুমি পেয়েছো, তাঁর দিগুণ মূল্য পাবে আমার কাছে। এ ভেলকিবাজী ও তামাশা বন্ধ করো। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।’
‘আমি তো খুনীদের বেষ্টনীর মধ্যে বন্দি আছি।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আমার নিজস্ব বলে কিছু নেই। খুনিদের ইশারায় আমি বাঁদর নাচ নাচছি শুধু।’
‘খুনি এখন দু’পক্ষেই। আমার কথা যদি না শোনো তাহলেও তুমি মারা যাবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তুমি জানো না এখানে আমার কত লোক আছে। তোমার সঙ্গে কতজন আছে?’
‘আমার জানা নেই।’ জবাব দিয়েই উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নাম কি?’
‘এখন বলা যাবে না বন্ধু, সময় হলে জানতে পারবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমি যে প্রশ্ন করি তাঁর উত্তর দাও! তুরের তাজাল্লিটা কি? স্পষ্ট করে বলো, তোমার নিরাপত্তার জিম্মা আমি নিচ্ছি।’
‘যখন তুমি উঠবে তখন তোমার ডান দিকে তাকাবে।’ উমরু দরবেশ বললেন, উঁচু পাহাড়ের পাশে একটি উঁচু সমতল উপত্যকা, সেখানে একটি বিরাট গাছ আছে। সন্ধ্যার আগেই সেখানে তোমার লোক লুকিয়ে রাখবে, যেমন তুমি পানিতে আগুন লাগার রহস্য জানতে পেরেছ, তুরের তাজাল্লির খবরও জানতে পারবে। কিন্তু আমাকে এ খেল দেখানোর অভিনয় করতে দিতে হবে, নতুবা তুমি কিছুই জানতে পারবে না। তোমার দায়িত্ব সেখান থেকে যেন কোন আগুনের শিখা না উঠে। আমার নিখোঁজ হওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা তো তুমি আগেই নিয়েছ। এখন আমার ভেলকিবাজী হবে, এখান থেকে নিখোঁজ হওয়া। কিন্তু ইসহাককে সুদানের কারাগার থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব নিয়ে আমি কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছি, তার কি হবে?’
‘সেটাও আমি দেখবো।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘ঠিক আছে। এখন তাহলে উঠো আর ঘোষণা করে দাও, রাতে তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখানো হবে।’
আলী বিন সুফিয়ানের পরিবর্তে যদি অন্য কেউ হতেন তবে তিনি উমরু দরবেশের এ অস্পষ্ট কথা হয়তো বুঝতেই পারতেন না। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান ছিলেন এ ময়দানের এক পাকা খেলোয়াড়। তিনি ইশারাতেই সব বুঝে নিতে পারতেন।
আলী বিন সুফিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা বিবাদ থামাও। খোদার এ মনোনীত ব্যক্তি বলছেন, তাঁর কাছে অলৌকিক ক্ষমতা আছে। আমি তাঁর ধ্যান নষ্ট না করলে তিনি ঠিকই ভেজা কাপড়ে আগুন ধরাতে পারতেন। তিনি ওয়াদা করেছেন, রাতে তিনি তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবেন। আমরা দেখতে চাই আসলেই তিনি খোদার দূত কি না। তাই আমি চাই, এখন আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি না করে আমরা রাতের জন্য অপেক্ষা করি। যদি তিনি সত্যি তা দেখাতে পারেন আমরা তাঁর সব কথা মেনে নেবো। আর যদি না পারেন তবে বুঝতে হবে তিনি ভণ্ড, প্রতারক। তাহলে আমরা তাকে ছাড়বো না। আমার কথা তোমরা বুঝতে পারছো?’
লোকজন হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে তিনি বললেন, ‘তাহলে এখন সবাই বাড়ী ফিরে যাও। সন্ধ্যার পর আমরা তাঁর কেরামতি দেখতে আসবো।’
আলী বিন সুফিয়ান সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। উমরু দরবেশের সঙ্গীরা এসে ঘিরে ধরলো তাঁকে। প্রশ্ন করলো, ‘লোকটির সঙ্গে আপনার কি কথা হলো?’
তিনি উচ্চ স্বরে বললেন, ‘এ লোকের মনে আমার কামেলিয়াত সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। আমি তার সন্দেহ দূর করে দিয়েছি। বলেছি, রাতে তুর পাহাড়ের নূর দেখো। যদি দেখাতে না পারি তখন আমাকে অবিশ্বাস করার অধিকার তোমার রইলো। কিন্তু দেখাতে পারলে তোমাকে আমার মুরীদ হতে হবে। লোকটি আমার কথায় সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে।’
‘কিন্তু এ ব্যক্তি কে?’ একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘এ লোক তো আমাদের ভেজা কাপড়ে আগুন জ্বালানোর রহস্য বের করে ফেলেছে!’
‘ও নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।’ উমরু দরবেশ হেসে বললেন, ‘আজ রাতেই আমি তাঁর সন্দেহের সমাধান করে দেবো।’
‘এ লোক রাতে এলে তাঁকে হত্যা করে ফেলতে হবে। এ রকম ধুরন্ধর লোককে বাঁচিয়ে রাখলে যে কোন সময় আমাদের ফেঁসে যাওয়ার ভয় আছে।’ বললো আরেকজন।
‘না! এখনই তাকে খুন করার দরকার নেই! অযথা খুনোখুনি আমাদের মিশনে ভণ্ডুল করে দিতে পারে।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আগে তাঁকে বাগে আনার চেষ্টা করি। দেখা যাক রাতে তাঁকে গোমরাহ করা যায় কি না! আর যদি তাতেও কাজ না হয় তখন তাঁকে তাঁবুতে ডেকে আনতে হবে। সুযোগ বুঝে তোমরা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।’
তৃতীয় এক লোক বললো, ‘এখানে বসে কথা বলে সময় নষ্ট না করে তাঁর পিছু নেয়া দরকার! এ লোক ভয়ংকর, তাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।’
অপর জন তার কথায় সায় দিয়ে বললো, ‘তুমি ঠিক বলেছো, চলো।’
তারা দু’জন সেখান থেকে উঠে গমনরত লোকদের দলে মিশে গেল। আলী বিন সুফিয়ানকে খুজলো তন্ন তন্ন করে, কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পেল না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘লম্বা দাড়িওয়ালা এক চোখে সবুজ পট্টি বাঁধা লোকটাকে কেউ দেখেছো? ওই লোক কোথায় বলতে পারো কেউ?’ কিন্তু কেউ বলতে পারলো না, তিনি কোথায়? আলী বিন সুফিয়ান ততক্ষণে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সেখানে থেকে বহু দূরে সরে পড়েছেন।
তাঁবুর মধ্যে এখন শুধু আশী ও উমরু দরবেশ। আশী তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ লোকটি কে? তোমার সাথে এমন ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছিলেন, মনে হয় তোমার সাথে আগে থেকেই পরিচয় আছে? তিনি গেলেনই বা কোথায়?’
‘শোনো আশী!’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আজ রাতে একটা কিছু ঘটবে। আমি বলতে পারছি না কি ঘটবে। কারণ আমি লোকটাকে চিনতে পারিনি। পরিচয় জিজ্ঞেস করার পরও তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন না। কিন্তু এ লোক কোন সাধারণ ব্যক্তি নয়। জানি না আজ রাতে আমি নিখোঁজ হবো, নাকি অপঘাতে মারা যাবো। আজই তোমার পরীক্ষার দিন। আজ রাতে তোমাকে প্রমাণ করতে হবে, তুমি প্রকৃতই মুসলিম বাপ-মায়ের সন্তান। তাঁদেরই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তোমার শিরায়। যদি তুমি আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করো, তবে তুমি নির্মম মৃত্যুর শিকার হবে।’
‘আমার যা বুঝার বুঝে নিয়েছি। এখন বলো তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।’ আশী বললো, ‘আমি তোমার জন্য মরতেও প্রস্তুত। কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য সফল না হলে মরেও যে আমি শান্তি পাবো না!’
‘কি করতে হবে আমি নিজেও জানি না। তবে একটা কাজ তোমাকে করতেই হবে।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘কখনও দলের লোকদের ভয়-ভীতি ও চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে না। চেষ্টা করবে তাদের মনের খবর নিতে এবং সময়ের আগেই আমাকে তা জানিয়ে দিতে। কারণ আমি জানি না, আজ রাতে কি হবে। শুধু জানি, আজ আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন, প্রয়োজন যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকা।’
‘তুমি আমাকে কয়েকবারই বলেছো, আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস নেই।’ আশী বললো, ‘কিন্তু আমি তোমাকে একটিবারও বলিনি, তোমার প্রতি আমার ভরসা ও আস্থা নেই। তুমি এ চক্রের হাত থেকে মুক্ত হয়ে গেলে আমাকে কি তোমার সাথে নেবে?’
‘তুমি ফিরে যেতে চাইলে আমি বাঁধা দেবো না, তুমিই বলো, তুমি কি করতে চাও? তুমি কি ফিরে যেতে চাও?’
‘না! কখনো না।’ আশী বেদনাবিধুর কণ্ঠে বললো, ‘তার চেয়ে আমি মৃত্যুই শ্রেয় মনে করবো।’
‘আশী, তুমি তো সুখের পায়রা!’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘কষ্টকর জীবনের সাথে তোমার পরিচয় হয়নি। যখন থেকে বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকেই তুমি দেখে আসছো রঙ তামাশার জীবন। আমি ভাবতেই পারি না, তুমি আমার সাথে যাবে! আমার সাথে গেলে তোমার ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে দেখেছো? তুমি অবশ্যই আমার মত ভয়ংকর জীবন পছন্দ করবে না! কারণ এ জীবনে আছে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। তবে আমি তোমাকে কায়রো নিয়ে যেতে পারি। সেখানে তোমার সম্পর্কে চিন্তা করার অনেক উন্নত মাথা রয়েছে।’
‘তাঁর মানে তুমি আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাও?’ আশী প্রশ্ন করলো, ‘তবে কি তুমি আমাকে তোমার সাথে রাখবে না?’
‘না, এ শর্তে তোমাকে আমি সঙ্গে নিতে রাজী নই।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তাতে লোকে বলবে, তোমাকে পাওয়ার লোভে আমি সুদানীদের টোপ গিলেছি। ঘরে আমার স্ত্রী আছে। তার হক নষ্ট করে তোমাকে আমি স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না। আশী, আমি সৈনিক! আমার ঠিকানা যুদ্ধের ময়দান! আমি আমার স্ত্রীর মুখ দেখি না প্রায় তিন বছর। কোন ভরসায় আমি তোমাকে সঙ্গে নেব! যে তীর আমার বুকে বিদ্ধ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, তোমার ভালবাসা বা দোয়া আমাকে সে তীরের আঘাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। আমার মত লোকের সঙ্গী হতে চাইলে তুমি নিরাশ হবে। এমন ভুল তুমি করো না।’
‘আমি আমার এ ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত জীবন থেকে মুক্তি চাই।’ আশী বললো, ‘এ জন্য তোমার সাহায্যের প্রয়োজন! তার পরে কি হয় সেটা পরে দেখা যাবে। তবে এটুকু কথা দিতে পারি, আমি তোমার চলার পথের প্রতিবন্ধক হবো না।’
‘তুমি এ চক্রের হাত থেকে বাঁচতে চাইলে আমার সাহায্য ও সহযোগিতা থাকবে তোমার সাথে।’
আলী বিন সুফিয়ানকে কথাও খুঁজে না পেয়ে তাঁবুতে ফিরে চললো সুদানী সেই গোয়েন্দা দু’জন। পথে অপর সঙ্গীর সাথে দেখা হতেই সে জানতে চাইল, ‘পেলে সেই কানা বুড়োকে?’
‘না, ভাই।’ একজন আক্ষেপের সুরে বললো, ‘বলতো দেখি কি অবাক কাণ্ড! নিমিষে লোকটি হাওয়া হয়ে গেল?’
‘সত্যি অবাক ব্যাপার, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে শেষ পর্যন্ত লোকটি কোথায় লুকিয়ে পড়লো বলতো?’
উমরু দরবেশের তাঁবু থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আলী বিন সুফিয়ানকে নিয়ে কথা বলছিল ওরা। একজন বললো, ‘এমনও তো হতে পারে, উমরু দরবেশ তার মন জয় করার পরিবর্তে নিজের মনটাই তাকে দিয়ে বসে আছে! এখন আমাদের আরও বেশী সাবধান হতে হবে। উমরু দরবেশকে চোখে চোখে রাখার জন্য আমাদের তো আগেই সতর্ক করা হয়েছে।’
‘লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটি পানিতে আগুন ধরানোর গোপন রহস্য জানার পরও কেন উমরু দরবেশকে ছেড়ে দিল এটা একটা গুরুতর প্রশ্ন।’ একজন বললো, ‘উমরু দরবেশ তার উপর প্রভাব ফেললো, নাকি সে লোকই বশ করে গেল উমরু দরবেশকে, বিষয়টি জানতে হবে আমাদের।’
‘এটা জানা তেমন কঠিন হবে না। আশী আছে না দরবেশের সাথে! এমন ঔষধ থাকতে আর ভাবনা কি?’ তৃতীয় ব্যক্তি বললো।
‘আশীকে নিয়ে এত উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। এ মেয়েটা যে কি করছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সে তো উমরু দরবেশের মনের কোন অবস্থাই আমাদের বলছে না!’
‘তুমি কি বলতে চাও উমরু দরবেশ কোন ষড়যন্ত্র করলে মেয়েটা তারই সহযোগী হয়ে যাবে?’
‘তা বলছি না, তবে এমনটি হতেই বা কতক্ষণ?’
‘আশী যদি সত্যিই ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে তবে তাকেও হত্যা করার হুকুম আছে। মেয়েটি যদি নিজেই তার মরণ ডেকে আনে তবে আমাদের কি করার আছে?’ অন্য একজন বললো।
‘কি বললে!’ এক গোয়েন্দা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললো, ‘তুমি এমন মহামূল্য জিনিস নষ্ট করে ফেলবে?’ সে আরও বললো, ‘না, তাকে বরং উঠিয়ে নিয়ে যাবো, আর কোন ধনীর দুলালের কাছে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করে দেবো। এমন হীরা হাতে পেলে কে তা পায়ে ঠেলে!’
‘এটা কি ঠিক হবে?’
‘কেন, সুদান গিয়ে রিপোর্ট করলেই হবে, ষড়যন্ত্রের দায়ে আশীকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাকে সেখানেই দাফন করা হয়েছে।’