» » গোপন বিদ্রোহী

বর্ণাকার

আনতানুস দ্বিধাজড়িত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলো। কথা বলতে বলতে এক সময় দ্বিধা ও ভয় কেটে গেল তার। তার কথা বলার ভঙ্গী ছিল চমৎকার। মেয়েটি ক্রমশ তার দিকে ঝুঁকে পড়তে লাগলো।

সে বোনের কথা বলতে বলতে শেষে তার নিজের কাহিনীতে চলে এলো। মেয়েটি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনতে লাগলো এক সুন্দর যুবকের বিচিত্র জীবন কাহিনী। তাদের মধ্যে যে সংকোচ ও জড়তা ছিল তা উড়ে গেল আনতানুসের গল্পের তোড়ে।

এক সময় আনতানুস বললো, ‘বেশীক্ষন এভাবে থাকা ঠিক নয় আমাদের। তাতে বিপদ হতে পারে! শেষে যদি কেল্লার মালিক তোমাকে খোঁজ করার জন্য চাকর বাকরদের পাঠিয়ে দেয়, তবে আমরা ধরা পড়ে যাবো!’

মেয়েটি বললো, ‘ভয় নেই, আমার অনুপস্থিতির কথা কেউ তাকে বলবে না। আর তার হাতের নাগালে এত নারী, আমার অভাব সে অনুভবও করবে না!’

‘তবু, অনেকক্ষণ হয় এসেছি। সঙ্গী প্রহরী যদি খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে!’

‘তাহলে বলো, কাল আবার আসবে?’

আনতানুস ফাতেমার কাছে আগামী রাতে আবার দেখা করার অঙ্গীকার করে চলে গেল ডিউটিতে। ডিউটি মানে, গেটের পাশে দুই প্রহরীর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা।

ডিউটিতে ফিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটির কথাই ভাবছিল আনতানুস। ফাতেমা তাকে বলেছে, সে মদকে ঘৃণা করে। তাকে যেভাবে আনন্দ-স্ফূর্তির উপকরন বানানো হয়েছে, তাতেও তার বড় ক্ষোভ ও ঘৃণা।

মেয়েটি হলবের বাসিন্দা। তার বাবা তার প্রভাবশালী বন্ধু গুমাস্তগীনকে খুশী করার জন্য নামকাওয়াস্তে বিবাহের অনুষ্ঠান করে তাকে তুলে দিয়েছে তার হাতে।

ফাতেমার এ বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, বর্তমান জীবনটা তার পছন্দ নয়। সে ভালবাসা ও প্রেমের কাঙাল এক প্রস্ফুটিত গোলাপ।

পরের রাতে সেই বাগানে আবার তাদের দেখা হলো। ফাতেমা আনতানুসের অপেক্ষায় খুবই অধীর ও পেরেশান হয়ে বসেছিল পাথরের এক বেঞ্চের ওপর। বসে বসে আনতানুস এলে তাকে কি বলবে মনে মনে তার রিহার্সেল দিচ্ছিল।

আনতানুস এলে ফাতেমা তাকে দেখেই বললো, ‘যদি তুমি আমার রূপ ও যৌবনের আকর্ষণে মনে কোন খারাপ বাসনা নিয়ে এসে থাকো তবে তুমি ফিরে যাও! তেমন লোকের আমার কোন প্রয়োজন নেই।’

‘যদি তুমি কোনদিন আমার কাছ থেকে কু-মতলবের আভাসও পাও, আমার মুখে থু দিয়ে চলে যেও।’ আনতানুস বললো, ‘আমি তোমাকে আমার বোনের মতই মনে করি।’

‘না না, আগেই তুমি আমাকে তোমার বোন বানিয়ে নিয়ো না।’ ফাতেমা বললো, ‘কারণ আমি এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি, আমি তোমার বোন হবো, না অন্য কিছু।’

‘অন্য কিছু মানে!’

‘ন্যাকা সেজো না। ভালবাসার কাঙাল এক যুবতীর সাথে একজন যুবকের কি সম্পর্ক হতে পারে এটা বুঝার বয়সও এখনো হয়নি তোমার?’

হেসে দিল আনতানুস। বললো, ‘তবে কি তুমি আমার সাথে পালিয়ে যেতে চাও?’

‘এটা নির্ভর করছে তোমার ওপর।’ মেয়েটি বললো, ‘সারা জীবন তো আর চোরের মত এভাবে লুকিয়ে দেখা করা সম্ভব হবে না! আর তুমিও চিরদিন এখানে ডিউটিতে থাকবে না। জানি, হয়তো দশ দিন, বিশ দিন বা এক মাস থাকবে, তারপর? তারপর চলে যাবে অন্য কোথাও।

তুমি চলে গেলেও তোমার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। হয়তো তোমার কথা মনে হলে অন্তরে কষ্ট পাবো। হয়তো তোমার কথা স্মরণ করে গোপনে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবো। কিন্তু আমার করার আর কিছুই থাকবে না। কারণ তোমার মনে কি আছে তা তো আর আমি জানি না!’

এ রাতের সাক্ষাত তাদের উভয়ের জীবনে এক অক্ষয় স্মৃতি হয়ে গেল। একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেললো ওরা।

তার পরের দিন।

ভালবাসার জোয়ার ফাতেমাকে এতই উতলা করে তুললো যে, আবেগের বশে সে ভয়ানক এক দুঃসাহসী কাজ করে বসলো। আনতানুসের আপত্তি সত্তেও সে তাকে নিজের কামরায় নিয়ে গেল।

গুমাস্তগীন সে রাতে বাড়ি ছিল না। তাই এ দুঃসাহসী কাজ করতে সাহস পায় ফাতেমা। এ সাক্ষাৎ উভয়ের জন্য ছিল আতংকজনক। ফাতেমা আবেগের মোহে সব কিছুই ভুলে গেল। ভুলে গেল মহলের মধ্যেও ষড়যন্ত্রের বীজ লুকিয়ে আছে। বেগম থেকে বাঁদী সকলেই একে অন্যের দোষ ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়। বেগমরা স্বামীর কাছে, বাঁদীরা প্রভুর কাছে একে অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকে। আনতানুসের ব্যক্তিত্ব ও কথার যাদু তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। ভালবাসা ও প্রেম পিপাসার আবেগের মোহে সে এসব কথা ভুলেই গিয়েছিল।

গভীর রাত। আনতানুস বসেছিল ফাতেমার কামরায়। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব ছিল প্রখর। সে এমন কোন ইঙ্গিতও করলো না, যাতে ফাতেমার যৌবন বা শরীরের প্রতি সামান্য লোভ-লালসা প্রকাশ পায়। তার এই চারিত্রিক দৃঢ়তা ফাতেমাকে আরো অভিভূত করে তুললো। আপাদমস্তক পবিত্র এক ভালবাসার মানুষ হয়ে গেল আনতানুস।

সে যখন তার কামরা থেকে বের হয়ে গেল, তখন ফাতেমার এমন অবস্থা, পারলে তখুনি সে তার সাথে বের হয়ে যায়।

আনতানুস যখন কামরা থেকে বের হচ্ছিল, তখন অন্দর মহলের অন্য এক মেয়ে তাকে দেখে ফেলে। কিন্তু মেয়েটি এ কথা ওদের বুঝতে না দিয়ে দ্রুত নিজেকে অন্ধকারে লুকিয়ে ফেলে।

অন্য এক রাতের ঘটনা। গুমাস্তগীন এ রাতেও মহলে অনুপস্থিত। ফাতেমা রাতের আঁধারে বাগানে চলে এলো। আনতানুস ও এসে পৌঁছলো ওখানে। এখন দু’জনের মাঝে কোন পর্দা নেই, নেই কোন বাঁধার দেয়াল।

ফাতেমা তাকে বললো, ‘তুমি তো আমাকে বলেছিলে, তুমি তোমার বোনের প্রতিশোধ সুলতান সালাউদ্দিনের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে ছিলে। তবে তুমি এই বাহিনীতে ভর্তি হলে কেন?’

‘কেন, এটা কি সুলতানের বাহিনী নয়?’ আনতানুস এমন ভাবে বললো, যেন সে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। সে বললো, ‘এটাই তো মুসলিম সৈন্য বাহিনী। আর আমি তো জানি, মুসলিম সৈন্য বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী!’

‘এ বাহিনী মুসলিম বাহিনী বটে, তবে এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।’ ফাতেমা বললো।

‘এ তো বড় অন্যায় কথা!’ আনতানুস অবাক হয়ে বললো, ‘কি বলছো তুমি! তবে কি আমাদের এমন বাহিনীতে থাকা উচিত, যে বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়? তারা তো মুসলমানদের সর্বনাশ করবে।’

‘আমিও তাই মনে করি।’ ফাতেমা বললো।

‘আনতানুস বললো, ‘তুমি জানো না, জেরুজালেম ও আশেপাশের যেসব অঞ্চলে খৃষ্টানদের আধিপত্য আছে, সেখানকার মুসলমানরা সুলতান আইয়ুবীকে তাদের ইমাম ও নেতা মনে করে। তারা খৃষ্টানদের অত্যাচারে সদা জর্জরিত ও আতংকগ্রস্থ। তারা বিশ্বাস করে, সুলতান আইয়ুবী তাদেরকে একদিন এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন।

ওসব অঞ্চলের মসজিদের ইমামগণ বলেন, ‘এ জাতি তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। জেহাদের কথা ভুলে গেছে তারা। সুলতান আইয়ুবীর জেহাদীমন্ত্রে উজ্জীবিত মুজাহিদরা যদি কখনো এদিকে আসে, তাহলে হয়তো নাজাত পেতে পারো। তুমিই বলো, এখন আমি কি করবো?’

‘তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও!’

‘কিন্তু তোমাকে রেখে আমি কি করে অন্য কোথাও পালিয়ে যাই!’

‘যদি তোমার সাহস থাকে তবে তুমি আমাকেও সঙ্গে নাও।’

‘কিন্তু কোথায় যাবো?’

‘ফাতেমা বললো, ‘আমি তোমাকে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবো। তোমাকে আর এই সেনা বাহিনীতে থাকতে হবে না।’

‘তুমি কি জন্য তোমার স্বামীর কাছ থেকে পালাতে চাও? সে তোমাকে দাসী বানিয়ে রেখেছে এ জন্য, নাকি সে বুড়ো বলে?’

‘আমি এ ব্যক্তিকে ঘৃণা করি।’ ফাতেমা উত্তর দিল, কেন ঘৃণা করি সে কারণ তো তুমি নিজেই বলে দিয়েছো! সে আমাকে দাসীর মত মহলের চার দেয়ালে বন্দী করে রেখেছে, সে বৃদ্ধও বটে। কিন্তু সবচেয়ে বেশী ঘৃণার কারণ, সে আমার প্রাণপ্রিয় নেতা সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরোধী। মুসলমান হয়েও সে খৃষ্টানদের বন্ধু। যখন দেখি মুসলমানদের স্বার্থের চাইতে খৃষ্টানদের স্বার্থ তার কাছে বড়, তাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে আমার।

এ মহলে বউ হয়ে আসার আগে আমার মনে একটি আকাংখা ছিল। আমার মনে হতো, আমি নুরুদ্দিন জঙ্গীর কাছে গিয়ে বলি, আমাকে আপনার সামরিক বাহিনীতে নিয়ে নিন। আমি খৃষ্টান ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করতে চাই।

সুলতান সালাউদ্দিনের নাম আমি আগেও শুনেছি। তীর নিক্ষেপে আমি যথেষ্ট পটু। নিশানা ঠিক করতে এক সময় বহু প্রাকটিস করেছি। কিন্তু আমার সব আশা ও স্বপ্ন এ হতভাগার মহলে এসে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

যখন আমি এ মহলে আসি, মনে মনে একটু গর্ব ছিল, আমি এক যোদ্ধার স্ত্রী হয়ে এসেছি। যে যোদ্ধা দেশ, জাতি ও দ্বীনের খেদমতে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। কিন্তু সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর একমাত্র হিতৈষী সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ততি নিচ্ছে।’

‘তিনি আসলেই সুলতান আইয়ুবীর বিপক্ষে কি না, সে খবর তুমি সঠিক জানো?’ আনতানুস জিজ্ঞেস করলো।

‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই।’ ফাতেমা বললো, ‘কিন্তু এ লোক বড় গভীর জলের মাছ! খলিফা আল মালেকুস সালেহের সাথেও তার বন্ধুত্ব, আবার তার বিরোধী ওমরাদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠটা রয়েছে। এরা সবাই সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। গুমাস্তগীন তাদের আশ্বাস দিয়ে রেখেছে, যুদ্ধের সময় সে তাদের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবে। আবার খৃষ্টানদের সাথেও সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য গোপনে চুক্তি করে রেখেছে। তার আশা, আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত অভিযানের সময় সে বহু স্থান দখল করে নিতে পারবে। একদিন সে হারান ও বিজিত অঞ্চলের বাদশা হওয়ার স্বপ্ন দেখে।’

‘এ নিয়ে তিনি কি কখনো তোমার সাথে আলোচনা করেছেন?’

‘হ্যাঁ! সে জানে আমি সুলতান আইয়ুবীর ভক্ত।’ ফাতেমা বললো, ‘সুযোগ পেলেই সে সুলতান আইয়ুবীর বিরদ্ধে আমাকে কথা শোনাতো। কিন্তু আমি তাতেও সুলতানের ব্যাপারে আমার মনোভাব পাল্টাইনি দেখে রাগ করে সে আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিল। তাতেও কাজ না হওয়ায় সে আমাকে মারপিটও করেছে।

এ নিয়ে একদিন তার সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হয়। শেষ পর্যন্ত সে রাগ করে এ পর্যন্ত বলেছে, ‘আইয়ুবী কি তোকে জাদু করেছে? আমার এখানে থাকতে হলে সুলতানের নাম কোনদিন মুখেও আনতে পারবি না।’

এ ঘটনার পর কয়েকদিন আমাদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ ছিল। হঠাৎ এক রাতে সে আমার কামরায় এলো। আমার মন গলানোর জন্য মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে লাগলো। শেষে বললো, ‘আরে শরিয়তের হুকুম হচ্ছে, এক মুসলমানের সাথে আরেক মুসলমানের তিন দিনের বেশি কথা বন্ধ রাখতে নেই। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া তো মামুলি ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া না হলে মোহাব্বত বাড়ে না।’

তবু আমি চুপ করে রইলাম। সে বললো, ‘শোন, তুমি যদি আমাকে অপছন্দ করো এবং আমার কাছ থেকে মুক্তি চাও, রাগ না করে থেকে আমাকে খোলাখুলি বলো। আমি এতটা নিষ্ঠুর নই যে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে আমি এই মহলের মধ্যে বন্দী করে রাখবো।’

তার এ কথায় আমি তো অবাক! বলে কি লোকটা! ভুতের মুখে রাম নাম! বললাম, ‘দেখো, মারতে চাও আরো মারো, কিন্তু এ ধরনের নিষ্ঠুর ঠাট্টা করো না।’

‘আমাকে বিশ্বাস করছো না! খোদার কসম, আমি তোমার সাথে কোন ইয়ার্কি করছি না। চাও তো কোরআন ছুঁয়ে শপথ করতে পারি। তুমি যদি চাও তোমার পছন্দের ছেলের কাছে আমি নিজ হাতে তোমাকে তুলে দেবো। সারা জীবন শুয়ে বসে কাটাতে পারো এমন সম্পদ সে বিয়েতে তোমাদের আমি উপহার দেবো।’

‘কিন্তু কেন? কিসের বিনিময়ে এত বড় উদারতা দেখাতে চাও?’

‘তুমি আমার ছোট্ট একটা উপকার করে দেবে এটুকু ওয়াদা শুধু চাই।’

‘কি উপকার? আমার মত সামান্য এক নারী তোমার মত ক্ষমতাধরের এমন কি উপকার করতে পারবো, যার বিনিময়ে তুমি এতো ত্যাগ স্বীকারের ওয়াদা করছো!’

‘পারবে, পারবে, তুমিই পারবে। তুমি তো জানো না, তুমি কি অসামান্য সুন্দরী! তোমার মত ষোড়শী রুপসীদের পক্ষেই এ কাজ করা সম্ভব।’

অবাক হয়ে বললাম, ‘কি কাজ?’

‘তোমাকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠাবো। ওখানে তুমি সুলতানের বড় বড় সেনাপতিদেরকে তোমার রূপ দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে নিয়ে যাবে। যাদের পারো তাদেরকে আমার পক্ষে নিয়ে আসবে।’

সে আরো বললো, ‘তোমার সাথে তোমার মতই আরো দু’জন খৃষ্টান মেয়ে থাকবে। তারা খুবই চালাক ও সতর্ক। তোমরা তিনজনে যদি চেষ্টা করো, মানুষ কেন, পাথরকেও গলাতে পারবে তোমরা।’

সে আমাকে কি করে কি করতে হবে সব বলতে লাগলো। বললো, ‘সেখানে গিয়ে গোয়েন্দাদের মত কাজ করতে হবে তোমাদের। যদি তোমরা এই কাজ করে আসতে পারো, তবে এমন সীমাহীন সম্পদ পাবে, যা কোনদিন তুমি কল্পনাও করোনি। আর তোমাকে মুক্ত করে দিয়ে তোমার পছন্দসই যুবকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো।’ কিন্তু আমি তার কোন শর্তই মানিনি।’

‘তুমি মেনে নিলেই পারতে!’ আনতানুস বললো, ‘তাহলে আমরা নির্বিঘ্নে এখান থেকে বের হয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে চলে যেতে পারতাম।’

‘এই শয়তানটা ও তার খৃষ্টান বন্ধুরা এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে, শত্রু এলাকায় গিয়ে যদি কোন মেয়ে গাদ্দারী করে তবে তাকে সেখানেই হত্যা করে ফেলবে। তাদের সাথে গুপ্তঘাতক ফেদাইন দলের যোগাযোগ রয়েছে। তার কথা শুনে আমার অন্তরাত্মা খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়।’

ফাতেমা আরো বললো, ‘একবার মনে করেছিলাম, তার প্রস্তাব মেনে নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলালো না।’

ফাতেমা আরো বললো, ‘তখনও তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। হলে হয়তো অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিতাম। বিশ্বাস করো, তোমাকে পেয়ে আমার প্রাণে নতুন করে সাহস ফিরে এসেছে, বুকে বল এসেছে। আমি তোমার অনুগ্রহ জীবনেও ভুলতে পারবো না। তুমি আমাকে তোমার মনের মধ্যে স্থান দিয়েছো, সেইটেই যথেষ্ট। চলো, আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাই।’

‘পালিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি এখানে, এ কেল্লাতে থেকেই খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে এবং সুলতান আইয়ুবীর পক্ষে কাজ করতে পারবে।’

ফাতেমা অবাক হয়ে বললো, ‘কি কাজ? কেমন করে?’

‘যে কাজ তোমার মালিক গুমাস্তগীন সুলতান আইয়ুবীর অঞ্চলে গিয়ে করতে বলেছিল, এখানেও আমরা সেই কাজ করবো, তবে তার পক্ষে নয়, বিপক্ষে। সুলতান আইয়ুবীরও নিশ্চয়ই গোয়েন্দার প্রয়োজন আছে। এখানে থেকেই তাঁকে এখানকার গোপন তথ্য জানিয়ে সাহায্য করতে পারি আমরা।’

‘তুমি কেমন করে জানলে, সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দার প্রয়োজন আছে এবং আমরা তার কাজে লাগতে পারবো?’ ফাতেমা বললো।

‘কারণ আমি নিজেই সুলতান আইয়ুবীর পাঠানো এক গোয়েন্দা!’

আনতানুসের এ বাক্যটি শুনে ফাতেমা এমন চমকে উঠলো, সহসা পথ আগলে তার বুকে কেউ খঞ্জর বসিয়ে দিলেও এতটা চমকাতো কিনা সন্দেহ।

‘কেন? তুমি এত অবাক হচ্ছো কেন? সত্যি বলছি, আমি জেরুজালেম থেকে নয়, কায়রো থেকে এসেছি। আমার কোন বোনকে কেউ অপহরণ করেনি। গুমাস্তগীনের আস্থাভাজন হওয়ার জন্যই এ রকম গল্প ফাঁদতে হয়েছে আমাকে।’

‘তুমি যেখানে এতবড় মিথ্যা বলতে পারো, সেখানে তোমার অঙ্গীকার ও ভালবাসা সবই মিথ্যা হতে পারে।’ ফাতেমা বললো, ‘তোমাকে আর কেমন করে বিশ্বাস করতে পারি।’

‘একমাত্র ভালবাসার খাতিরেই আমি তোমাকে আমার গোপন পরিচয় জানিয়েছি।’ আনতানুস বললো, ‘বলতে পারো, আমি আমার জীবন তোমার পায়ের তলায় সমর্পণ করে দিয়েছি। তুমি ইচ্ছে করলে আমার ভালবাসা অস্বীকার করে তোমার স্বামীর কাছে আমার আসল পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে আমাকে হত্যা করতে পারো।

তবে একটা কথা মনে রেখো, কোন গোয়েন্দাই তার পরিচয় অন্যকে জানায় না। কেবল তোমাকে প্রতারনা করতে পারবো না বলেই তোমার কাছে আমার সত্যিকারের পরিচয় প্রকাশ করেছি। আমার আবেগ ও ভালবাসাই আমাকে এ কথা বলতে বাধ্য করেছে। তাই আমি নির্ভয়ে বলে দিয়েছি।

তোমার প্রতি ভালবাসার আরো প্রমাণ তখনি দেবো, যখন আমি এখানকার কাজ সমাধা করে ফিরে যাবো। সেদিন এখান থেকে আমি একাই যাবো না, তুমিও থাকবে আমার সাথে।

কিন্তু একটা কথা তোমাকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, যদি আমার ভালবাসা ও আমার দায়িত্বের মাঝে কখনো সংঘাত বাঁধে, যদি ভালবাসা ও দায়িত্ব একে অন্যের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তবে আমি ভালবাসা কোরবানী দিয়ে আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থে আমার দায়িত্ব পালনে অটল থাকবো। তোমাকে ধোঁকা দেবো না, আমার আসল পরিচয় গোপন রেখে তোমার ভালবাসা নেয়ার অন্যায় থেকে বাঁচার জন্যই তোমাকে এতগুলো কথা বললাম।

তুমি হয়তো জানো না, দায়িত্ব পালনের জন্য গোয়েন্দাদের কাছ থেকে কেমন কঠিন ওয়াদা ও কোরবানী নেয়া হয়। সৈনিকরা যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়ে যায়, সাথীরা তার লাশ সসম্মানে দাফন করে। কিন্তু গোয়েন্দারা মারা যায় না, তারা ধরা পড়ে শত্রুদের হাতে।

শত্রুরা তাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। তার কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য এমন সব শাস্তি দেয়, যে কথা শুনলে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে। সেখানে সে মারা গেলেও পৃথিবীর কেউ তার দায়িত্ব নেয় না। কেউ এগিয়ে আসেন তার লাশটা দাফন পর্যন্ত করতে।

গোয়েন্দাদের জীবন বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ জীবন। ঈমানের বলিষ্ঠতাই ওদের সম্পদ। সে ঈমান নিয়েই আমি এখানে এসেছি। তোমার সঙ্গে ভালবাসা করেছি, কিন্তু দায়িত্বের ব্যাপারে আমি ইস্পাতের মত কঠিন থাকবো। কখনো অবিশ্বাসীর মত কাজ করবো না।’

ফাতেমা তন্ময় হয়ে শুনছিল তার কথা। আবেগে থরথর করে কাঁপছিল আনতানুসের হাত। ফাতেমা তার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে চুমু খেলো। মুখে বললো, ‘তুমিও আমাকে অনুরুপ সুদৃঢ় পাবে। এখন বলো কি করবো?’

আনতানুস তাকে কি করতে হবে সবকিছু বুঝিয়ে বললো। বললো, ‘গান বাজনার আসরে এখন থেকে আর অনুপস্থিত থাকা যাবে না। বিশেষ করে যে মাহফিলে খৃষ্টানরা থাকে সেসব মাহফিলে সারাক্ষণ তোমাকে উপস্থিত থাকতে হবে।

যদি এ জন্য দু’ঢোক মদও পান করতে হয়, মেহমানের সন্তুষ্টির জন্য তাও করতে হবে। তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশায় সংকোচ বোধ করবে না। তাদের সব কথা মনোযোগ সহকারে শুনবে।

সুলতান আইয়ুবীর যতই নিন্দা করুক, তার প্রতিবাদ করবে না। বরং তাদের কথায় সায় দিয়ে খৃষ্টান সেনাপতিদের কাছ থেকে তাদের মনের কথা বের করে নেবে।

তারা কিভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে খুঁটিয়ে বের করার চেষ্টা করবে। বেশী করে মনোযোগ শুনবে খৃষ্টানদের কথা।’

এরপর আনতানুস সেই দুই সেনাপতির কথা জিজ্ঞেস করলো, যারা হিন্দুস্তানী হিসাবে পরিচিত ছিল।

‘শামস বখত ও সাদ বখতকে আমি খুব ভাল করে চিনি।’ ফাতেমা বললো, ‘গুমাস্তগীন তাদের ছাড়া কোন সিদ্ধান্তই নেয় না। তারা প্রায়ই এখানে আসে। তারা গান বাজনায়ও শরীক হয় কিন্তু তারা মদ পান করে না।’

‘তুমি তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করবে!’ আনতানুস বললো, ‘কথায় কথায় তাদের কে প্রশ্ন করবে, ‘আর রিস্তানে কি এখন বরফ গলছে?’

সেও তোমাকে প্রশ্ন করবে, ‘কেন, তুমি কি আর রিস্তান যাবে নাকি?’

তুমি হেসে বলবে, ‘ইচ্ছা তো তাই ছিল।’

তারপরে তারা তোমার সাথে কথা বলবে। আর সম্ভবতঃ জিজ্ঞেস করবে, ‘ওদিক দিয়ে কে আসছে?’

তখন তুমি বলবে, ‘সেখানে গেলেই জানতে পারবে।’

ফাতেমা বললো, ‘আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘আমি যেভাবে বললাম সেভাবে কাজ করো। ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারবে।’ আনতানুস বললো, ‘ফাতেমা! আমি তোমাকে কখনও এমন ঝুঁকি ও ঝামেলায় ফেলতাম না। কিন্তু কঠিন দায়িত্বের খাতিরে, ইসলাম ও মুসলিম জাতির অস্তিত্বের খাতিরে বাধ্য হলাম।

আমার সবচেয়ে প্রিয় যে প্রাণ, সেটাও এই ফরজ পালনের জন্য কোরবানী করতে বাধ্য আমি। ভয় পেয়ো না ফাতেমা, আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, মরার পর আবার তার কাছেই ফিরে যাবো। সামনে যে কঠিন বিপদ ও পরীক্ষা রয়েছে, সে বিপদ আমরা হাসি মুখে বরণ করে নেবো তার সন্তুষ্টির আশায়।

যদি আমরা দু’জন কখনো বন্দী হয়ে যাই, যদি কয়েদখানার দুর্ভোগ নেমে আসে আমাদের জীবনে, অথবা যদি আমরা মরেও যাই, তবু আমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। মহান আল্লাহ কখনো আমাদের কোরবানী ভুলে যাবেন না। ইসলামের খেদমত ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষায় আমাদের এ রক্ত দান আমাদের পরকালীন মুক্তি ও জান্নাতের জামিন হবে।’

‘এ ব্যাপারে তুমি আমাকে পাহাড়ের মতই অটল ও সুদৃঢ় পাবে।’ ফাতেমা বললো, ‘তুমি আমার মনে সেই প্রেরনা জাগিয়ে দিয়েছো, এতদিন আমি যার স্বপ্ন দেখেছি। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ও সাধনাকে সফল করার পথ বের করে দিয়েছো তুমি। আমার প্রতিটি পুন্যের বদলা তুমি আল্লাহর কাছ থেকে পাবে।’

‘আমি চলে যাচ্ছি।’ আনতানুস বললো, ‘তোমার দায়িত্ব পালন আজ এবং এখন থেকেই শুরু করো।’