» » খুনী চক্রের আস্তানায়

বর্ণাকার

আসলেও বিষয়টা বড় জটিল ছিল। পুলিশ ও গোয়েন্দা প্রধানের সাথে আলাপের পর তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, তিনি নিজেই সুলতান আইয়ুবীর কাছে যাবেন এবং তাঁকে মিশর এসে এর সমাধান করার পরামর্শ দেবেন।

আলী বিন সুফিয়ান প্রত্যেক সন্দেহভাজন সেনাপতি ও অফিসারদের পিছনে একটা করে গোয়েন্দা ছায়ার মত লাগিয়ে দিলেন। তকিউদ্দিনকে বললেন, ‘এবার আপনি যেতে পারেন।’

তকিউদ্দিন গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে সাক্ষাতের জন্য গোপনে মিশর ত্যাগ করলেন। তার এ যাত্রার কথা বিশেষভাবে গোপন রাখা হলো। হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া সবাই জানল, তিনি শিকারে বেরিয়েছেন।

“আমি তোমার মুখে নতুন কোন সংবাদ শুনছি না।’ সিরিয়ার কাছে হলবের অনতিদূরে ভ্রাম্যমান হেড কোয়ার্টারে বসে তকিউদ্দিনের কথা শুনে সুলতান আইয়ুবী বললেন, “আমি বলতে পারি না জাতির মধ্যে যে গাদ্দারী ও বিশ্বাসঘাতকতার রোগ ছড়িয়ে পড়ছে, তার চিকিৎসা কেমন করে হবে। আমার দৃষ্টি এখন বায়তুল মুকাদ্দাসে নয়, ইউরোপের ওপর পড়ে আছে। কিন্তু আমার গাদ্দার ও বিশ্বাসঘাতক ভাইয়েরা আমাকে মিশর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। তুমি এই রক্ষীদেরকে এখানে নিয়ন্ত্রণ করো। আমি দামেশকে যাচ্ছি, সেখান থেকে মিশরে চলে যাব।’

সুলতান আইয়ুবী তকিউদ্দিনকে রণাঙ্গনের সমস্ত খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার গোয়েন্দারা ওদের এত ভেতরে প্রবেশ করেছে যে, ক্রুসেড বাহিনীর যে কোন আক্রমণের খবর কমপক্ষে দু’তিন দিন আগেই তুমি জানতে পারবে। আমাদের কমাণ্ডা বাহিনী প্রতি মুহূর্তে সক্রিয় রয়েছে। আমি তাদেরকে শত্রু আক্রমণের সম্ভাব্য রাস্তার আশেপাশে লুকিয়ে রেখেছি। বর্তমান সংবাদ হলো, ক্রুসেড বাহিনী আক্রমণ করবে না। যদি তারা আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিতে চায় তবে তুমি ভয় পেও না। তুমি এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করবে না। শক্রদেরকে সামনে অগ্রসর হতে দেবে আর প্রথম আঘাত ওদেরকেই করতে দেবে। এ জন্য প্রয়োজন হলে তোমরা পিছু হটে যাবে।

এখানে যুদ্ধের অনুকূল পরিবেশ আছে। সব সময় উঁচু স্থানে অবস্থান নেবে। বিশেষ ভাবে স্মরণ রাখবে, আল মালেকুস সালেহ, সাইফুদ্দিন ও যেসব আমীররা আমাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে, যুদ্ধের সময় তাদের কাছে অতিরিক্ত আশা করবে না। কারণ তাদের মগজে ক্ষমতা ও গদীর নেশা যে কোন সময় চেপে বসতে পারে। আমাদের সাথে তাদের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে তারা কোন নিজস্ব বাহিনী রাখতে পারবে না। আমি তাদের মহলেও গোয়েন্দা বসিয়ে রেখেছি। আমি তোমাকে এই নসীহত করে যাচ্ছি, যদি দেখো আমাদের এই মুসলমান ভাইয়েরা যুদ্ধের সময় সামান্য গড়িমসি ও ষড়যন্ত্র করছে, তবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিষয়টি ফায়সালা করে ফেলবে। দ্বিতীয়বারের মত তাদের প্রতি অনুকম্পা দেখানোর কোন প্রয়োজন নেই।’

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তাঁর বইতে এই নির্দেশনামা প্রদানের সময় ৫৭২ হিজরী মুতাবেক ১১৭৬ খৃস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস উল্লেখ করেছেন।

সুলতান আইয়ুবী তার ভাই তকিউদ্দিনকে সেক্টরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দামেশকে চলে যান। এ সময় তার আরেক ভাই শামসুদ্দৌলা তুরান শাহ ইয়েমেন থেকে ফিরে এলেন। ইয়েমেনেও যুদ্ধবাজ খৃস্টানদের তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল। সেখানেও মুসলমানরা তাদের ষড়যন্ত্রে পড়ে ইসলামী হুকুমাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। শামসুদ্দৌলা তাদেরকে শক্ত হাতে দমন করে তবেই সেখান থেকে এসেছেন।

সুলতান আইয়ুবী দামেশকে যাওয়ার পথে তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ইয়েমেন থেকে তিনি সফলতা নিয়েই ফিরে এসেছিলেন। সুলতান আইয়ুবী তাকে দামেশকের গভর্ণর নিযুক্ত করে ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে মিশর যাত্রা করলেন।

কায়রো উপস্থিত হয়েই তিনি গোয়েন্দাদের দেয়া তালিকাটি গভীর মনযোগ দিয়ে পড়লেন। তালিকায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকের নাম ছিল। ছিল একাধিক সামরিক অফিসারের নাম। তিনি তালিকাভুক্ত সবাইকে গ্রেফতার করার আদেশ জারি করলেন।

এই গ্রেফতারীর বেলায় কারো পদমর্যাদা বা সামাজিক সম্মানের দিকে তাকালেন না তিনি। গাদ্দারের পদমর্যাদা বা সামাজিক সম্মান যাই হোক, সে একজন গাদ্দার ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তিনি নির্বিচারে গোয়েন্দাদের দেয়া তালিকা অনুসারে সবাইকে গ্রেফতার করলেন।

গ্রেফতারের পর দিন। তিনি গ্রেফতারকৃতদের সব ধনরত্ন, সোনার বার, মূল্যবান তৈজষপত্র যেগুলো গাদ্দারদের আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, সব এনে প্যারেড ময়দানে জমা করার হুকুম দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এ হুকুম তামিল করা হলো। এরপর তিনি এ যাবত খৃষ্টানদের যত গোয়েন্দা ও গাদ্দারকে ধরা হয়েছিল, সেই মেয়ে কয়টিসহ, সবাইকে এ ধনরত্নের পাশে এনে দাঁড় করালেন।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিল সেই হেকিম। ছিল একাধিক সেনাপতি ও কমাণ্ডার। এদের সবাইকে শিকলে বেঁধে সেখানে হাজির করা হল। সুলতান এদের সবাইকে মিশরের সেনাবাহিনীর সদস্যদের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেনাবাহিনী। তাদের সামনে দিয়ে ওদেরকে শিকলে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি তাদেরকে শহর ঘুরিয়ে প্যারেড ময়দানে হাজির করতে বললেন। তাই করা হলো। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদেরকে শহর ঘুরিয়ে এনে প্যারেড গ্রাউণ্ডের সেই স্তুপীকৃত ধন-সম্পদের সামনে দাঁড় করানো হলো।

সুলতান আইয়ুবী অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করে আসামীদের সামনে এসে থামলেন। তারপর দরাজ কণ্ঠে বললেন, “আমাকে সংবাদ দেয়া হয়েছে, তোমরা নাকি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য জনগণ ও সৈনিকদেরকে উস্কানী দিচ্ছ।’ সুলতান আইয়ুবী গম্ভীর ও উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘যদি তোমাদের মধ্যে এমন কেউ থেকে থাকো, যে আমাকে আশ্বাস দিতে পারবে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বতে তোমরা আমার বিরুদ্ধে, আমার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উস্কানী দিচ্ছ, তবে আমি আমার ক্ষমতা ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছি। যদি তোমরা আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারো, তোমরা মুসলমানের প্রথম কেবলা কাফেরদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত, স্পেনের মাটিতে আবার ইসলামী শাসন কায়েমের সংকল্প নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাও, তবে তাকে আমি আমার সামনে আসার আহবান জানাচ্ছি।’

তিনি বললেন, ‘এই মুহূর্তে যারা অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছো, তাদের মধ্যে যদি এমন কেউ থাকো, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবে, তবে তাকে আমি অপরাধীর সারি থেকে সরে দাঁড়ানোরও সুযোগ দিচ্ছি। আমার এই তলোয়ার আমার ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করার জন্য নয়, এ তলোয়ার আমি হাতে নিয়েছি ইসলামের জন্য। যদি কেউ মনে করো আমার চাইতে তুমি এ তলোয়ার হাতে পেলে ইসলামের অধিক সেবা করতে পারবে, তাহলে এগিয়ে এসো, নিয়ে যাও আমার তলোয়ার। নিয়ে যাও আমার অশ্ব, আমি তোমার পক্ষে শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

চারদিকে টু শব্দটিও নেই। মাঠের চারদিক লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। সুলতান থামতেই পিনপতন নিরবতা যেন গ্রাস করে নিল প্যারেড ময়দান। খানিক বিরতির পর আবার ভেসে, এল সুলতান আইয়ুবীর কণ্ঠ। তিনি অপরাধীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছো, যে আমার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করবে? থাকলে সামনে এসো। কাবার প্রভূর কসম! আমি সত্যি তাকে শাসন ভার অর্পণ করে তার অধীনস্ত সৈনিক হয়ে থাকবো।’

কোন সাড়াশব্দ নেই! গভীর নীরবতা মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রাখলো! ‘আল্লাহর পথের বীর মুজাহিদবৃন্দ।’ সুলতান আইয়ুবী সৈন্যদের লক্ষ্য করে বললেন, “তোমাদের বিদ্রোহের পথে এগিয়ে দিয়ে এরা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকেই স্নান করতে চেয়েছিল। তোমাদের সামনে এই যে ধন-রত্নের স্থূপ, এই সম্পদ ওরা ব্যবহার করছিল ইসলামের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করে দিতে। তোমাদের সামনে এই যে সুন্দরী মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে, এদের পাঠানো হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে তোমাদের উস্কানি দিতে। এ সম্পদ ও নারী সবই পাঠানো হয়েছে তোমাদের জন্য। জাতির সাথে গাদ্দারীর পুরস্কার হিসাবে এ সম্পদ ও নারী তোমাদের দান করা হবে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে, যে তার ঈমানের বিনিময়ে এই সম্পদ ও নারী পেতে চাও? থাকলে এগিয়ে এসো! নিয়ে যাও এসব।’

আবারও নিরবতায় ছেয়ে গেল সমগ্র প্যারেড গ্রাউণ্ড। কেউ এগিয়ে এল না। কেউ টু শব্দটিও করল না। আইয়ুবী তখন অভিযুক্তদের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমরা কি অস্বীকার করতে পারব, এই সম্পদ ও নারী তোমরা বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য হিসাবে পেয়েছিলে? আমি সবাইকে বলছি, যদি আমি মিথ্যে বলে থাকি তবে সবার সামনে এসে বলে যাও, আমি যা বলছি তা মিথ্যে!’

কেউ এগিয়ে এলো না। কেউ সুলতানের কথার কোন প্রতিবাদ করলো না। তখন সুলতান আইয়ুবী ঘোড়া থেকে নামলেন। অপরাধীদের মধ্য থেকে হেকিমের বাহু ধরে টেনে তাকে নিজের ঘোড়ার কাছে নিয়ে এলেন। তিনিই ছিলেন অভিযুক্তদের মধ্যে সবচে বয়স্ক ও মুরুব্বী। তাকে তিনি বললেন, “আমার অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করো আর বলো, সুলতান আইয়ুবী যা বলেছে সব মিথ্যে কথা।’

হেকিম অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করলো বটে, কিন্তু মাথা নত করে রইলো। সুলতান আইয়ুবী ধমকের সুরে বললেন, ‘বলো, সুলতান আইয়ুবী মিথ্যা বলেছেন।’ হেকিম মাথা উঠালো এবং স্পষ্ট স্বরে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী যে কথাগুলো বলেছন, সম্পূর্ণ সত্য বলেছেন।’ এ কথা বলেই হেকিম ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়লো।

হেকিম অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ছিল। সুলতান আইয়ুবী তাকালেন উপস্থিত জনতার দিকে। বললেন, “তোমরা সবাই শুনেছো হেকিম কি বলেছেন। এবার তোমরাই বলো এই গাদ্দারদের কি শাস্তি হতে পারে?’

চতুর্দিক থেকে গগনবিদারী রব উঠলো, ‘গাদ্দারদের কল্লা চাই, বিশ্বাসঘাতকের ক্ষমা নাই।’

কিছুক্ষণ এভাবেই কাটলো। মুহুর্মুহু শ্লোগানে মুখরিত হচ্ছে প্যারেড ময়দান। উত্তেজিত জনতা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ছুটে আসতে চাইছে বন্দীদের দিকে। সুলতান আইয়ুবী দুই হাত উপরে তুলে জনতাকে শান্ত হওয়ার আহবান জানালেন। আস্তে আস্তে কমে এলো কলরব। জনতা থামলে তিনি তলোয়ার বের করলেন এবং এক আঘাতেই হেকিমের শির ভূলুষ্ঠিত করে দিলেন।

এরপর তিনি তার অশ্বপৃষ্ঠে আবার আরোহণ করে উচ্চস্বরে বললেন, ‘হে আল্লাহর সৈনিকগণ, যদি আমি সঠিক বিচার না করে থাকি, তবে আমার তলোয়ার নিয়ে নাও। তারপর আমার তলোয়ার দিয়েই আমার শিরচ্ছেদ করো।’

তিনি তার তলোয়ার বর্শার মত মাটিতে ছুঁড়ে মারলেন। তলোয়ারের মাথা মাটিতে বিদ্ধ হয়ে গেল। বাটসহ তলোয়ারটি দুলতে লাগলো।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এক সেনাপতি ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তলোয়ারটি মাটি থেকে উঠিয়ে দুই হাতের তালুতে রেখে সুলতানের সামনে হাজির হয়ে বললো, ‘মুহতারাম সুলতান! এত বেশী আবেগময় হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি যা করেছেন, ঠিকই করেছেন।’

সৈন্যদের মাঝেও এ সময় ভীষণ শশারগোল উঠলো। সেনাপতির কথা সেই শোরগোলের মাঝে হারিয়ে গেল। সৈন্যরা জনতার সাথে একাত্ম হয়ে গগনবিদারী আওয়াজে অপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করার দাবী জানাচ্ছিল।

সুলতান আইয়ুবী আবার হাত উঠিয়ে সৈন্যদলকে শান্ত হওয়ার আহবান জানালেন। সৈন্য এবং জনগণ শান্ত হলে তিনি ঘোষণা করলেন, “গাদ্দারী এক অমার্জনীয় অপরাধ। যাদের অপরাধ প্রমাণিত হবে তাদেরকে যথাযথ শাস্তি দেয়া হবে।’

এই ঘোষণা সকলকে শুনিয়ে তিনি অপরাধীদের আদালতে হাজির করার হুকুম দিলেন। পুলিশ কড়া নিরাপত্তায় অপরাধীদের আদালতের দিকে নিয়ে চলল। জনগণ তাদের শাস্তি দাবী করতে করতে চলল তাদের পিছু পিছু। কিন্তু আদালতের গেটে তাদের বাঁধা দিল পুলিশ। জনগণ তখন তাদের শাস্তি দাবী করে মিছিল করতে করতে শহরময় ছড়িয়ে পড়লো।

সেদিনই সুলতান আইয়ুবী সুদানে দূত মারফত এক লিখিত চরমপত্র পাঠালেন। তাতে তিনি লিখলেন, “যদি মিশর সীমান্তে সুদানী সেনাদের সামান্য তৎপরতাও পরিলক্ষিত হয় এবং তাতে সীমান্তে অশান্তি দেখা যায়, তবে তা মিশরের উপর আক্রমণ বলে গণ্য করা হবে। আর সে আক্রমণের সমুচিত জওয়াব দেয়া হবে সুদানের উপর সেনা অভিযান চালিয়ে। আর এমনটি হলে, সুদান জয় করে সেখানে ইসলামী রাজ্যের পতাকা উডডীন না করে কোন মুজাহিদ ঘরে ফিরবে না।’

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর তলোয়ার থেকে যে রক্ত ঝরছিল, সে রক্ত পরিষ্কার না করেই তিনি তলোয়ার খাপে আবদ্ধ করেন। এ রক্ত সেই বিশ্বাসঘাতক হেকিমের, যে ক্রুসেড বাহিনীর চর হিসাবে ইসলামী রাষ্ট্রর সংহতি ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়েছিল।

হেকিম ছাড়া আর যেসব অপরাধীদের গাদ্দারী ও শত্রুর সাথে যোগসাজশ করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদেরকে দ্রুত আদালতের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবী সেনাপতি, কমাণ্ডার ও সেনাবাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক পায়চারী করছিলেন। তখনও তার চোখের ওপর ভাসছে বিশ্বাসঘাতকের রক্তের লালিমা।

তিনি অনেক কিছুই বলে ফেলেছেন। আবার অনেক কিছু বলতে বলতে থেমে গেছেন। এই বিশাল সমাবেশে উপস্থিত সর্বস্তরের লোক তার আবেগ ও মনোভাব ভাল মতই বুঝতে পেরেছিল। কেউ সুলতান আইয়ুবীর সাথে কথা বলতে ও চোখে চোখ রেখে তাকাতে সাহস পাচ্ছিল না।

‘মাননীয় সুলতান!’ এক সেনাপতি সাহসে ভর করে বললেন, ‘আমরা ক্রুসেড বাহিনীর কোন ষড়যন্ত্রই সফল হতে দেবো না।’

সুলতান আইয়ুবী তার দিকে তাকালেন। সে চোখে সীমাহীন বেদনার ছাপ। তিনি নিজের রক্তাক্ত তলোয়ার কোষমুক্ত করে তার চোখের সামনে মেলে ধরে বললেন ‘এ রক্ত কার? এ রক্ত আমার, তোমার তোমাদের সকলের! এ রক্ত আমার ভাইয়ের, আমার সন্তানের! যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করেছে, এ রক্ত তাদের। এদের ঘরে রয়েছে পবিত্র কুরআন, রয়েছে নবীর হাদীস। যদি এ রক্তই বিশ্বাসঘাতক ও গাদ্দার হয়ে যায়, তবে মনে করবো, ক্রুসেড বাহিনীর সকল ষড়যন্ত্রই সফল হয়েছে। তারা ইসলামের সেই সৈনিকদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দিয়েছে, যারা খৃস্টানদের কবল থেকে ফিলিস্তিন উদ্ধার করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তারা আমাদের শক্তি এত দুর্বল করে দিয়েছে যে, আমরা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আর ফিলিস্তিন উদ্ধার করতে সমর্থ হবো না। আমাদের গন্তব্যস্থান ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। আজ এই সময় আমাদের কায়রো থাকার কথা নয়, জেরুজালেম থাকার কথা। কিন্তু এত রক্ত ঝরানোর পরও তারা আমাদেরকে কায়রো বসিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছে।’’

সুলতান আইয়ুবী তার তলোয়ার প্রহরীর কাছে দিয়ে বললেন, ‘যদি এ রক্ত কোন কাফেরের হতো তবে আমি তা পরিষ্কার করতাম না। কিন্তু এ রক্ত এক গাদ্দারের! এ রক্তের কোন গন্ধও যেন তলোয়ারে বা কোষে না থাকে।’

প্রহরী তলোয়ার ও খাপ পরিষ্কার করতে বাইরে নিয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী উপস্থিত সেনা সদস্যদের বললেন, ক্রুসেড বাহিনীর প্লান ও ষড়যন্ত্র সত্যি সফল হয়েছে। তারা চাচ্ছিল, আমি যেন হলব থেকে সামনে অগ্রসর হতে না পারি। দেখো, তাই হয়েছে, আমি সামনে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে এখন কায়রোতে ফিরে এসেছি।

এখন ক্রুসেড বাহিনী অগ্রসর হতে থাকবে। আমরা দীর্ঘ তিন বছর আপোষে যুদ্ধ করেছি। এই সুযোগে ক্রুসেড বাহিনী সুসংহত ও সুগঠিত হয়ে আমাদেরকে চির দিনের মত পরাজিত ও নিঃশেষ করতে প্রস্তুত হয়েছে।

ত্রিপলীর খৃস্টান রাজা রিমাণ্ড বলেছেন, আমরা মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে এবং কায়রোতে নাশকতামূলক কাজ বাড়িয়ে সুলতান আইয়ুবীকে কায়াররামুখী করতে সমর্থ হয়েছি। তার এ কথায় কোন মিথ্যা নেই। ক্রুসেড গোয়েন্দারা আমাদের সমস্ত তৎপরতার সংবাদ যথাসময়ে ওখানে সরবরাহ করে থাকে। যখনই আমি হলব থেকে রওনা হয়েছি, তখনই তারা জেনে গেছে, আমি হলব থেকে কায়রো চলে এসেছি। আমার দায়িত্বে আমার ছোট ভাই তকিউদ্দিন এখন রণাঙ্গণে আছে। সঙ্গে সঙ্গে এ সংবাদ জেরুজালেম থেকে আক্রা এবং সমস্ত খৃষ্টান রাজ্যেই পৌঁছে গেছে।

আমরা খবর পেয়েছি, সমস্ত ক্রুসেড নেতারা এখন ত্রিপলীতে গিয়ে একত্রিত হয়েছে। তারা সেখানে কি আলোচনা করছে তাও আমরা জানতে পারছি। রাজা রিমাণ্ড সমবেত নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘সুলতান আইয়ুবী জেরুজালেম জয় করতে বের হয়েছিল। আমরা কোন তীর না চালিয়েই তাকে মিশরের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি। তার হাত দিয়েই মুসলমান আমীর ও শাসক গোষ্ঠীকে অকেজো করে দিয়েছি। আমরা এর চেয়ে বড় সফলতা আর কি লাভ করতে পারি! এখন আমাদের আর সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই।’

‘এই সফলতাকে তেমন বড় সফলতা বলা যায় না, আপনি যেমন বলছেন।’ খৃস্টান রাজা বিলডন তার কথার প্রতিউত্তরে বলেছেন, “আমরা আক্রমণের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত করেছি মাত্র। আসল কাজ তো আক্রমণ করা। তখন সফলতা লাভ করলেই বলবো বড় সফলতা লাভ হয়েছে। এখন সৈন্যবাহিনী সুগঠিত করে অভিযান চালাতে হবে। সুলতান আইয়ুবীকে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না।’

আইয়ুবী বললেন, যদি আমরা আমাদেরকে দ্রুত শুধরে নিতে না পারি তবে বলতে পারি না, এর পরিণাম ফল কি হবে।’

সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের বললেন, ‘আজ থেকেই নতুন ভর্তি শুরু করে দাও। অশ্বারোহী বাড়াও। সুদানী সেই সব সৈনিকদেরকেও নতুন করে ভর্তি করে নাও, যাদের সাত বৎসর আগে বিদ্রোহের অপরাধে সেনাবাহিনী থেকে বের করে ক্ষেতের কষ্টসাধ্য আবাদী কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল। এরা এই কাজ করে মিশরে অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ পেয়েছে। তারা আর বিদ্রোহ করবে না। যে সব যুবক অশ্ব ও তলোয়ার চালনায় পটু তাদেরকে উত্তমরূপে ট্রেনিং দাও। আমি খুব শীঘ্রই মিশর থেকে বের হয়ে যেতে চাই।

যদি ক্রুসেড বাহিনীর মাথা খারাপ হয়ে থাকে তবে তারা আমার অনুপস্থিতিতে দ্রুত আক্রমণ চালিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। তারা রণকৌশলে আনাড়ী নয়। আমার জন্য বর্তমান অবস্থা তারাই সৃষ্টি করেছে, যার দরুণ আমি বাধ্য হয়ে মিশরে চলে এসেছি। তারা বায়তুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করতে চাইলে, অধিকৃত এলাকা থেকে বের হয়ে এসে যুদ্ধ করবে। এই যুদ্ধের জন্য আমাদের অনেক সৈন্যের প্রয়োজন।’

❀ ❀ ❀

ত্রিপলীর রাজ দরবার। কথা হচ্ছিল সম্রাটদের মধ্যে। ‘আমি এই মুহূর্তে আড়াই শ’ বর্ম পরিহিত নাইটকে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড় করাতে পারি।’ ত্রিপলীর কনফারেন্সে প্রসিদ্ধ খৃস্টান রাজা রিজন্যাল্ট বললেন, “এই যুদ্ধের নেতৃত্ব আমার সামরিক বাহিনীর কমাণ্ডে থাকবে। আমি যুদ্ধের প্ল্যানও তৈরি করে রেখেছি। যুদ্ধের প্ল্যান হলো, আমরা সামনাসামনি লড়াই করবো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মত চোরের ন্যায় লুকিয়ে যুদ্ধ করবো না। আমরা প্লাবনের মত সামনে এগিয়ে যাবো। সকল বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করেই এ অভিযান শুরু করতে হবে। তখন আপনারা অনুভব করতে পারবেন, অশ্ব ও মানুষের এই বিশাল প্লাবন আরব দেশের সমস্ত বাঁধা খড় কুটোর মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এমনকি মিশরকেও পদদলিত করতে পারবে এই বাহিনী। আমরা আরব ও মিশর পদদলিত করে একেবারে সুদানে গিয়ে ক্যাম্প করবো।’

আইয়ুবী তাঁর সৈন্যদের বলছিলেন, ‘যদি ক্রুসেড বাহিনী সম্মিলিতভাবে আমাদের ওপর আক্রমণ চালায় তবে আরব ভূমিতে এত বেশী রক্তপাত হবে যে, আবর ভূমির প্রতিটি ধূলিকণা রক্তে সিক্ত হয়ে যাবে। এখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে মাথায় কাফন বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। হে আমার বন্ধুগণ! আমার মন বলছে, আমরা এ যুদ্ধে পূর্ণ প্রস্তুতির সুযোগ পাবো না। তাই আমাদের অতি সাবধানে যুদ্ধের ময়দানে নামতে হবে।’

অপরদিকে ত্রিপলীতে খৃস্টান সম্রাট রিমাণ্ড বলছিলেন, ‘সুলতান আইয়ুবীকে সব সময় ব্যস্ত ও সন্ত্রস্থ রাখতে হবে। তার আয়ত্ত্বাধীন এলাকায় আমাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে।’ রিমাণ্ড এ কথা বলেই তাকাল ক্রুসেড গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হরমনের দিকে। বলল, ‘হরমন! তুমি মিশরের ওপর তোমার তৎপরতা আরও জোরদার করে দাও। আইয়ুবী বিশ্রামে সময় নষ্ট করার মত লোক নয়। তার সামরিক বাহিনীর যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য আমার মনে হয়, তিনি জরুরী ভিত্তিতে নতুন সৈন্য ভর্তি শুরু করবেন। তুমি চেষ্টা চালাও, যেন নতুন ভর্তিতে সে সৈন্য না পায়। যদি এতে সফল হতে না পারে, তবে তার বাহিনীতে গুপ্ত হত্যা চালাও। সেখানে তাঁর সৈন্যের উপরে কড়া দৃষ্টি রাখো। বিশেষ করে মিশর ও কায়রোর গোয়েন্দাদের হুকুম দাও, তারা যেন সুলতান আইয়ুবীর গতিবিধির উপর সব সময় কড়া দৃষ্টি রাখে এবং কোন সংবাদ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।’

তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেক খৃস্টান রাজ রিজনাল্ট বলে উঠল, ‘আর, হরমন! মিশরের খবর যথাসময়ে পাও বা না পাও, তার চেয়ে বেশী সাবধান থাকবে যেন এখানকার কোন সংবাদ ওখানে পৌঁছতে না পারে আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে, সুলতান আইয়ুবী যেম যুদ্ধের ময়দানে আমাদের জন্য মহা বিপদ, তেমনি গোয়েন্দাগিরীতেও আমাদের চেয়ে বেশী সতর্ক! আমাদের মধ্যেও তার স্পেশাল গোয়েন্দারা বিচরণ করছে। এখানকার মুসলিম বসতির উপরে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। যাকে সামান্য সন্দেহ হয়, তাকেই কারারুদ্ধ করবে। ইচ্ছে হলে হত্যা করবে। এ ব্যাপারে তোমার ইচ্ছাই আইন।’

“আমি কারো মনের খবর জানি না।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতকদের মাথায় শিং গজায় না। দেখলেই তাদের চেনা যাবে। তাই আমি আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলকিসকে বলে রেখেছি, যাকেই খৃষ্টান গোয়েন্দা বলে সন্দেহ হবে, তাকেই বন্দী করবে। নিশ্চিত হলে হত্যা করবে। আর যদি তাদের ওপর খুব বেশী করুণা করতে চাও তবে তাদেরকে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। সম্মিলিত খৃষ্টান বাহিনী আমাদের আক্রমণ করার জন্য ছুটে আসছে। এ অবস্থায় কাউকে ক্ষমা করে বিপদ বাড়ানোর ঝুঁকি নেয়ার পক্ষে নই আমি। প্রয়োজনে বিচার কার্য ত্বরান্বিত করো। তার জন্য বিচার পদ্ধতি পরিবর্তনেও আমার আপত্তি নেই।’

সুলতান কথা বলছিলেন আলী বিন সুফিয়ানের সাথে। তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, তুমি শত্রু কবলিত এলাকাতেও জাল বিছিয়ে রেখেছো, ক্রুসেড বাহিনীর আশেপাশে আরও কিছু লোক পাঠিয়ে দাও। আর সেখানকার গোয়েন্দাদের বললো, তারা যেন সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই তা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। প্রয়োজনে বিপদরে ঝুঁকি নিয়েও তাদেরকে তীর বেগে কায়রো পৌঁছতে হবে। আমাকে তোমরা অন্ধ করে রেখো না আলী! আর সতর্ক থেকো, যেন এখান থেকে কোন সংবাদ বাইরে চলে না যায়।’

সাজ সাজ রব চলছে ত্রিপলীতে। ‘যদি আমাদের অভিযান সম্মিলিত কমাণ্ডে হয়, তবে আমাদের যোদ্ধারা আরও বেশী সংহত হয়ে যুদ্ধ করতে পারবে।’ রাজা রিজন্যান্ট বললেন, “আমি সব সময় ঐক্যবদ্ধ কমাণ্ডে যুদ্ধ করার উপর বেশী গুরুত্ব দেবো।’

রাজা রিমাণ্ড বললেন, ‘সম্মিলিত কমাণ্ডের কিছু ক্ষতিও আছে। যুদ্ধের ময়দানে আমাদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে হবে। একে অপরের সম্মুখে যেন বাঁধার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তারচেয়ে বরং আমরা এলাকা ভাগ করে নিয়ে অভিযান চালাতে পারি। তবে এ কথার সাথে আমিও একমত, আমাদের প্রস্তুতির খবর যেন বাইরে না যায় সে ব্যাপারে কঠিন সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।’

এমনিভাবে দুদিকেই শুরু হয়ে গেল যুদ্ধের সাজ সাজ রব। ক্রুসেড বাহিনী এবার সুলতান আইয়ুবীকে শেষ বারের মত পরাস্ত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মাঠে নামছে। সুলতান আইয়ুবীও আহত ব্যাঘ্রের ন্যায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন ক্রুসেড বাহিনীর বেপরোয়া চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র দেখে।

ক্রুসেড বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় তিন মুসলিম শাসক মিলিতভাবে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে শেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করেছে। প্রায় তিন বছর মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে শক্তি ক্ষয় করেছে, নিজের জান ও মাল ধ্বংস করেছে। অবশেষে সুলতান আইয়ুবী চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে তিন মুসলিম শাসককে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করেছে। তারা সুলতান আইয়ুবীর আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তার এই বিজয়কে মুসলিম জাহানের জন্য চরম পরাজয় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এতে ক্রুসেড বাহিনীর স্বার্থ ও ষড়যন্ত্রই সফল হয়েছে।

এই গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার আল্লাহর বান্দা নিহত ও আহত হয়েছে। হয়তো এখনো অনেকে পঙ্গু হয়ে জীবন নিয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু এই বেঁচে থাকায় লাভ কি? অথচ এই সৈন্যরা শুধু ফিলিস্তিন নয়, স্পেনও জয় করে ফিরতে পারতো।

এই গৃহযুদ্ধের অবকাশে ক্রুসেড বাহিনী তাদের সামরিক শক্তি আরও বহু গুণ বৃদ্ধি করে নিয়েছে। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পেরেছে। তাদের দাবী কোন ভিত্তিহীন কথা নয়। দৃশ্যত তারা এখন প্রবল শক্তি নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে পারবে এবং আরব জাহানকে খড়কুটোর মত উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কারণ তারা জানে, সুলতান আইয়ুবীর দক্ষ ও বীর সৈন্য এবং কমাণ্ডাররা প্রায়ই নি:শেষ হয়ে গেছে। লড়াই করার জন্য এখন আইয়ুবীকে নতুন সৈন্য জোগাড় করতে হচ্ছে।

নতুন ভর্তি সৈন্যদের দিয়ে যুদ্ধ করানো কোন সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু এছাড়া তার কোন উপায় নেই। তাছাড়া তাকে মিশরেও অধিক সৈন্য রাখতে হচ্ছে। কারণ মিশরে সুদানী আক্রমণের ভয় আছে। অধিকন্তু দেশের সর্বত্র গাদ্দার ও দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতা বেড়ে গেছে।

খৃস্টানরা তুফানের মত গতি নিয়ে আক্রমণ করার প্ল্যান নিয়েছে এই সংবাদ পেয়ে সুলতান আইয়ুবীও ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতিতে নিমগ্ন হয়ে পড়লেন। তিনি যুদ্ধের গতি ও পদ্ধতি পরিবর্তন করতে নারাজ। তিনি পরিকল্পনা করলেন, তার নতুন ভর্তি সৈন্যদের এক অংশকে তিনি কমান্তো বাহিনীতে রূপান্তরিত করবেন। তারা গেরিলা আক্রমণ চালাবে দুশমনের ওপর। আঘাত করো আর পালাও এই নীতিতেই যুদ্ধ করবেন তিনি।

তবে এখন ক্রুসেড বাহিনী যে ব্যাপক আক্রমণের চিন্তা ভাবনা করছে তাতে সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো অপারেশনের সফলতা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়বে। কারণ তারা কমাণ্ডো বাহিনীকে ঘিরে ফেলে সামনাসামনি মারার চিন্তা-ভাবনা করছে। উভয় পক্ষেই জোর চেষ্টা চলছে, আপন আপন সমর সাজ ও রণ প্রস্তুতির।

নিজেদের পরিকল্পনা ও গতিবিধির গোপনীয়তা রক্ষা করার পূর্ণ চেষ্টা যেমন চলছে, তেমনি চলছে অন্যের গোপন তথ্য জানার জোর প্রচেষ্টা।

রাশেদ চেঙ্গিস তার নাম। এ খৃষ্টান ছদ্মনামেই সবার কাছে পরিচিত। তুরস্কের বাসিন্দা বিধায় খৃস্টানদের মতই সুরত ও বর্ণ পেয়েছে। চাল চলনেও তাই। আর একজন ফ্রান্সের নাগরিক ভীক্টর। এরা দুজনই গোয়েন্দাগিরীতে নিযুক্ত। বর্তমানে খৃস্টান মেহমানদের সমাদর ও দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত। এদের কাজ হচ্ছে খৃষ্টান রাজা ও উর্ধতন সামরিক অফিসারদের ভোজসভায় খাবার ও মদ পরিবেশন করা।

রাশেদ চেঙ্গিস খুব চালাক ও বাচাল প্রকৃতির লোক। বাচাল হলেও হাস্যরসিক বলে সবারই প্রিয়ভাজন। ভিক্টর সম্পর্কে তো কারো কোন সন্দেহই থাকার কথা নয়। কারণ সে জাত খৃস্টান ও ফ্রান্সের নাগরিক। যদিও সে তার পরিচয় গ্রীসের নাগরিক বলেই চালিয়ে দিয়েছে।

খৃস্টানদের এত বড় সমাবেশেও তারা দু’জন তাদের নিজস্ব ওর্দী পরে উপস্থিত। যেহেতু খৃষ্টানরা মদ পান না করে কোন কাজ শুরু করে না, তাই তারা মেহমানদের মদ পান করাচ্ছিল আর মেহমানদের কথাগুলো গভীর ভাবে গিলছিল। মেহমানদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কথা হচ্ছিল। এসব কথা অতি শীঘ্র কায়রোতে পৌঁছানো প্রয়োজন। কিন্তু সভা এখনও শেষ হয়নি। তারা ক্রুসেড বাহিনীর সমস্ত প্ল্যান জেনে নিয়েই কায়রোতে সে সংবাদ পাঠাতে চাচ্ছিল।

আলী বিন সুফিয়ানের পূর্ণ ভরসা ছিল এই দুই গোয়েন্দার ওপর। খৃস্টানরা আলাপ করছিল, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যদি আমাদের গতিবিধি ও প্ল্যান সম্পর্কে জানতে পারে, তবে বিভিন্ন স্থানে ঘাতক লাগিয়ে গোপনে অল্প সংখ্যক কমাণ্ডো সৈন্য দিয়ে আমাদের ব্যাপক ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। অভিযানের সময় এ বিষয়টিও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে।’

‘তার আর সে সুযোগ হবে না। আমাদের পরিকল্পনা এবার সৈন্যদেরও জানানো হবে না। তবে তুমি যখন বলছো, তখন বাহিনী যে পথে যাবে সেখানে আগেই গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দেবো, যাতে তারা সে পথে কড়া দৃষ্টি রাখতে পারে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যাত্রা পথে খৃস্টানরা তাদের গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দিল এবং কোন সন্দেহভাজন লোক পেলে তাকে পাকড়াও করার কঠিন আদেশ জারি করল।

মিশরে সেনা ভর্তির কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে গেল। ভর্তি করার পর বিভিন্ন দলে ভাগ করে ওদের প্রশিক্ষণও শুরু করে দেয়া হলো। আইয়ুবী চাচ্ছিলেন, বিষয়টির ব্যাপক প্রচার। তাই এসব সৈন্যদেরকে সেনা ছাউনী থেকে বের করে শহরময় ঘুরানো হলো। তারা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে শহরময় কুচকাওয়াজ করে বেড়াতে লাগল। উন্মুক্ত ময়দানে এসব সৈন্যরা শক্তি প্রদর্শনী করল। নানারকম শারীরিক কসরত করে দেখাল। জনগণ উৎফুল্ল কণ্ঠে বাহবা ও করতালি দিল তাদের।

সুলতান সকল ইমামদের আহবান জানালেন মসজিদে জেহাদের গুরুত্ব বর্ণনা করে বিশেষ বয়ান পেশ করার জন্য। সুলতানের এ আহবান ইমামদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সংবাদ বাহকরা ছুটল চারদিকে। তারা মসজিদে মসজিদে সুলতানের নির্দেশনামা পৌঁছে দিল।

সুলতান আইয়ুবীর এ আহবান পেয়ে মসজিদের ইমামগণ কোরআন ও হাদীসের আলোকে জিহাদের গুরুত্ব কি তা বর্ণনা করে বিভিন্ন নামাজের পর খুতবা দিতে শুরু করল। তারা বলল, ‘মুসলমান ভাইসব, কাফেররা আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলিম জাহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে অগ্রসর হচ্ছে। এখনও আমাদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসা কাফেররা দখল করে রেখেছে। এই অবস্থায় মুসলমানদের ওপর জিহাদ ফরজ হয়ে গেছে।’

ইমামগণ বিশেষ করে দেশের যুবকদেরকে মিশরের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে লাগল। এতে কাজও হল বেশ। দেখা গেল, ইমামদের ভাষণ শুনে যুবকরা দলে দলে মিশরের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হচ্ছে। তাদের মধ্যে জেগে উঠছে জেহাদী জযবা। আপন ধর্ম ও মিল্লাতের সম্মান রক্ষার্থে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই সেনাবাহিনীতে যোগ দিল।

এরা ছিল অধিকাংশই পল্লীর নিম্নশ্রেণীর যুবক। তারা যেমন সহজে আবেগ তাড়িত হয়ে জেহাদে শামিল হতে ছুটে এসেছিল তেমনি সহজেই তাদেরকে বিভ্রান্ত করাও সম্ভব ছিল। জাতীয় আদর্শের আলোকে তাদের মন-মগজ গড়ে তোলার জন্য যে সময় ও ট্রেনিং দরকার, সেই ট্রেনিং দেয়ার সুযোগ পেল না সেনাবাহিনী। তার আগেই তাদের হাতে তুলে দিতে হল হাতিয়ার।

আবেগের প্লাবন দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না। তারা দু’দিনেই ইমামদের নসিহত ভুলে গেল। সেখানে জন্ম নিল আপন স্বার্থ-চিন্তা সামরিক অফিসাররা জাতীয় আদর্শের কথা বলার সুযোগ পায়নি তাদের কাছে। দলে দলে তারা শুধু ভর্তি করে নিয়েছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে জাতির বেঈমান ও গাদ্দাররা।

এই গণ ভর্তির সুযোগে কিছু বিশ্বাসঘাতকও ঢুকে পড়ল সেনাবাহিনীতে। তারা জিহাদের মর্যাদার কথা না শুনিয়ে কৌশলে এইসব নবাগত সৈনিকদের মনে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়াতে লাগল। সহজ পথ হিসাবে বেছে নিল তাদের মনে ধন-সম্পদের লোভ জাগিয়ে তোলাকে। তারা সবাইকে বুঝাতে চাইল, খৃষ্টানদের শহর নগর দখল করতে পারলে সেখানকার অফুরন্ত ধন-সম্পদ লুট করা যাবে। কেউ কেউ আবার এই আশায়ও ভর্তি হল। সুতরাং দেখা গেল, এই নতুন সেনা সদস্যদের অধিকাংশের মনেই জিহাদের শিক্ষার পরিবর্তে অর্থের লোভ লালসাই প্রকট হয়ে উঠেছে।

এভাবে একদল আনাড়ী ও স্বল্প বুদ্ধির লোক জড়ো হয়ে গেল সামরিক বিভাগে। জেহাদী জযবায় উজ্জীবিত করার আগেই এদেরকে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে রওনা করতে হল। ফলে এসব সৈন্যরা সুলতান আইয়ুবীর জন্য কষ্টদায়ক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।

ওদিকে বিভিন্ন খৃস্টান রাষ্ট্র থেকে ক্রুসেড বাহিনী এসে দলে দলে ত্রিপলীর কাছে সমবেত হতে লাগলো। ফিলিস্তিনের অধিকৃত শহরগুলোতেও ক্রুসেডাররা দূত পাঠালো, তারাও যেন সম্মিলিত বাহিনীতে যোগ দেয়।

হুনায়নের সম্রাট রিনাল্ট বহু সৈন্য নিয়ে ত্রিপোলীতে এসে ক্রুসেড বাহিনীতে শামিল হলেন। তার দম্ভ ছিল দেখার মত। কারণ সমবেত ক্রুসেড বাহিনীতে তার সৈন্য সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশী ও শক্তিশালী। তার সাথে ছিল আড়াইশ নাইট যোদ্ধা। নাইট ক্রুসেড বাহিনীর এক সম্মানজনক সামরিক খেতাব! যারা অসাধারণ বিচক্ষণ, রণবীর ও রণ নিপুন সেই সব অভিজাত সামরিক অফিসারকেই এই খেতাবে ভূষিত করা হয়। এদেরকে দেয়া হয় বিশেষ ধরনের পোষাক ও বর্ম। তারা মূলত বিভিন্ন বাহিনীর কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করে। ওদিকে সম্রাট রিজনাল্টের মনে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন।

১১৭৪ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। খৃস্টানরা সমুদ্র পথে আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দর উপকূলে আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী গোয়েন্দা মারফত এ আক্রমণের খবর আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য এমন ব্যবস্থা করেছিলেন, ক্রুসেডদের নৌবাহিনী বলতে গেলে সেই যুদ্ধে একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেদিন খৃস্টান নৌবাহিনীর সৈন্যরা সাগর কূলে অবতরণেরও সুযোগ পায়নি। এ সময় স্থলপথে আরেকটি বাহিনী সুলতান আইয়ুবীকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছিল। এই স্থল বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সম্রাট রিজম্যান্ট।

তাদের দুর্ভাগ্য, এই অগ্রাভিযানের খবরও আগেভাগেই পেয়ে গিয়েছিল মুসলমানরা। মুসলমানদের পক্ষ থেকে তাকে মোকাবেলা করার জন্য এগিয়ে গেলেন সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী। জঙ্গী গোয়েন্দা মারফত ক্রুসেড বাহিনীর সকল পরিকল্পনা জেনে স্থল পথে তার বাহিনী নিয়ে রাস্তায় ওঁৎ পেতে ছিলেন। রিজনাল্টের বাহিনী সেখানে এলে তিনি পিছন থেকে ও দুই পাশ থেকে রিজন্যাল্টের বাহিনীর ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালান।

রিজন্যাল্ট বিশাল বাহিনী নিয়ে এগুচ্ছিলেন, কিন্তু আক্রমণের পর তার অবস্থা হলো ফাঁদে পড়া ইদুরের মত। সারাদিন তিনি সেই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক সাধ-সাধনা ও ছুটাছুটি করলেন। কিন্তু কোন লাভ হলো না। যুদ্ধ জয় নয়, একটু পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজেও ব্যর্থ হলেন তিনি।

রাতে নূরুদ্দিন জঙ্গীর কমাণ্ডো বাহিনী রিজন্যান্টের হেড কোয়ার্টারে আক্রমণ চালিয়ে তাকে গ্রেফতার ও বহু সৈন্যকে বন্দী করে।

জল ও স্থল পথে ক্রুসেড বাহিনীর এ আক্রমণ শুধু ব্যর্থ হয়নি, তাদের শক্তি এবং মনোবলও একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিল। জান ও মালের অশেষ ক্ষতি ছাড়াও রিজাল্টের মত সাহসী সম্রাট ও যোদ্ধা যুদ্ধ বন্দী হয়ে ধরা পড়ে গেল মুসলমানদের হাতে।

নূরুদ্দিন জঙ্গীর জন্য এই যুদ্ধবন্দী ছিল এক মূল্যবান কয়েদী। তিনি তার মুক্তির বিনিময়ে ইসলামের পক্ষে খৃস্টানদের কাছ থেকে বড় রকমের সুবিধা আদায় করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা আর তার ভাগ্যে ঘটেনি। দুই মাস পর জঙ্গী নিজেই মৃত্যুবরণ করেন।

তার মৃত্যুর পর ক্ষমতালোভী ও সুবিধাবাদী আমলারা তার এগারো বছরের বালক আল মালেকুস সালেহকে পিতার গদীতে আসীন করিয়ে এক পুতুল সরকার গঠন করে। এই সুবিধাভোগীর দলে শামিল হয় উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার, আমলা ও সেনাপতিগণ। মূলত তারাই দেশের শাসক হয়ে বসে।

সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর যোগ্য সহধর্মিনী, এই পুতুল সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সারা জীবন যিনি জেহাদের ময়দানে কাটিয়ে দিলেন তার শিশু পুত্রকে ঢাল বানিয়ে কতিপয় সুযোগ সন্ধানীর এই চক্রান্তকে বিনাশ করার জন্য চাই শক্তি। কিন্তু সেই শক্তি এই মহীয়সী মহিলা কোথায় পাবেন! তখনি তার মনে পড়ল ইসলামের নিষ্ঠাবান খাদেম ও নূরুদ্দিন জঙ্গীর আদর্শের সৈনিক সুলতান আইয়ুবীর কথা। তিনি ইসলামের স্বার্থে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুলতান আইয়ুবীকে আহবান জানালেন।

সুলতান আইয়ুবী এ আহবানে সাড়া দিয়ে দামেশক এলে এক নিরব গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল। জনতার স্বতস্ফূর্ত সমর্থন ও সহায়তায় আইয়ুবী দামেশকের দায়িত্ব নিলে আল মালেকুস সালেহ ও তার পারিষদবর্গ হলবে পালিয়ে গেল।

এ সময় হারানের গুমাস্তগীন, মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিন স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আল মালেকুস সালেহ তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। বাধ্য হয় তাদেরকে নিয়ে সম্মিলিত ভাবে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সামরিক জোট গঠন করতে।

কিন্তু তারা বুঝতে পারে, ত্রিশক্তি মিলেও ইসলামী জনতার রোষ থেকে তারা বাঁচতে পারবে না। আইয়ুবী ইসলামী জনতার সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এলে তাকে বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তখন তারা সম্মিলিতভাবে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সামরিক মোর্চা গঠন করে তাকে পরাজিত করার জন্য ক্রুসেডদের সাথেও জোট বাঁধে। তারা সম্রাট রিজম্যান্ট ও সমস্ত খৃস্টান যুদ্ধ বন্দীদের নি:শর্ত মুক্তি দিয়ে দেয়। খৃস্টান বাহিনী ছাড়াও আইয়ুবীর অগ্রযাত্রায় এবার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তিন মুসলিম শক্তি। তখন থেকেই সুলতান আইয়ুবী অবিরত চতুর্মুখী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।

এভাবেই নূরুদ্দিন জঙ্গীর পুত্র আল মালেকুস সালেহ পিতার একনিষ্ঠ সাগরেদ ও আদর্শের সৈনিক সুলতান আইয়ুবীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন।

এতে মুসলমানদের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেল। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো ইসলামের কট্টর দুশমন রিজন্যাল্ট ও তার যুদ্ধবাজ বাহিনীর মুক্তি। মুসলিম রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতক আমীররা তাদের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা পাওয়ার আশায় বিনা শর্তে তাদের মুক্ত করে দিল। তারপর তিন বছর মুসলিম শক্তি ভ্রাতিঘাতি যুদ্ধে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় তারা সুসংবদ্ধ হয়েছে। এখন তারা এক বিশাল সামরিক শক্তি নিয়ে শুধু সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধেই নয়, বরং মুসলিম বিশ্বকে দুনিয়ার বুক থেকে মুছে দেয়ার জন্য চূড়ান্ত সংকল্প নিয়ে ছুটে আসছে।

রিজন্যান্ট তার পরাজয় ও অপমানের প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা মিটাতে চাচ্ছিল। ক্রুসেডদের এই মিটিংয়ে সবার আলোচনা শুনে সে বলল, ‘সমস্ত ক্রুসেড বাহিনী এক সম্মিলিত কমাণ্ডের অধীনে থাকবে।’ তার এই বক্তব্যের কারণ হলো, এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সে স্বাধীনভাবে একটি পরিকল্পনা তৈরী করেছিল। সম্মিলিত বাহিনীর কমাণ্ড স্বাভাবিকভাবেই সে আশা করেছিল তার হাতে থাকবে।

ঐতিহাসিকরা একমত, ক্রুসেডদের এই দুর্বলতাই আরবে তাদের ক্ষতির কারণ হয়েছে। তারা সংখ্যায় বেশী ও উন্নততর যুদ্ধ উপকরণের অধিকারী হয়েও কেবল এই কারণেই সফল হতে পারেনি। অবশ্য ঐতিহাসিকরা এও লিখেছেন, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দলে যদি গাদ্দার ও বিশ্বাসঘাতক না থাকতো, তবে তিনি আরব ভূখণ্ড থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়িত করে ইউরোপের ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারতেন।

‘যদি আপনারা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে পরাজিত করতে চান, তবে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ বাহিনীকে সম্মিলিত কমাণ্ডের অধীনে দিয়ে দিন।’ ত্রিপলীর রাজা রিমাণ্ড বললেন, ‘নতুবা আমরা সকলেই বিচ্ছিন্নভাবে ব্যর্থ ও পরাজিত হবো।’ তাকে সমর্থন করে অপর এক সম্রাট বললেন, ‘এর কোন প্রয়োজন নেই যে, অভিযানের নেতৃত্ব শুধু রাজা রিজম্যান্টের বাহিনীই করবে। যুদ্ধে কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত সম্মিলিত বাহিনীর কমাণ্ডেই করতে হবে।’

‘আমি আপনাদের থেকে পৃথক থাকবো না।’ রাজা রিজন্যাল্ট বললেন, ‘কিন্তু আমি কোন সম্মিলিত কমাণ্ডের অধীনে থাকবো না। আমাকে পরাজয়ের ও অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে। নূরুদ্দিন জঙ্গী মারা গেছে, কিন্তু আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে ঠিক আমার মতই বন্দী করে আপনাদের সামনে উপস্থিত করতে চাই। যেমন তারা আমাদের দামেশকে নিয়ে গিয়েছিল। নইলে ইতিহাস সব সময় আমাদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকবে। আমি আপনাদের সকলের কাছে প্রশ্ন করি, যখন নূরুদ্দিন জঙ্গী আমার উপর কমাণ্ডো আক্রমণ চালিয়ে আমার বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করেছিল, তখন আপনারা কে আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন? কেউ না। এখন আমাকে আর কেউ বাঁধা দিতে পারবেন না। আমি সেই দিন থেকে সৈন্য যোগাড় করে শক্তি সঞ্চয় করছি। এখন আমার প্রতিশোধ নেয়ার দিন। আমার সৈন্য আপনাদের অন্য কারো সামনে বাঁধার সৃষ্টি করবে না। যাকে আমার সাহায্য দেয়ার প্রয়োজন হবে, তাকে আমরা জীবন বাজী রেখে সাহায্য করবো। কিন্তু আপনাদের সকলের কাছে আমার অনুরোধ, আমাকে বাঁধা দিবেন না।’

‘না, তা করবো না।’ বিলডন বললেন, ‘আমাদের আজকের আলোচনা এখানেই সীমাবদ্ধ থাক। আমরা আজকের আলোচনা থেকে জেনে নিলাম, আমাদের প্রাণপণ চেষ্টায় মুসলমানদের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ হয়েছে তাতে তারা দুর্বল হয়েছে। আমরা এও জানলাম, আমরাই সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে এদিকে আসার পরিবর্তে মিশরে ফিরে যেতে বাধ্য করেছি। সুতরাং আমাদের বিদ্যুৎ বেগে ও ঝড়ের মত আক্রমণ চালাতে হবে।

আসুন আমরা আজ এই সিদ্ধান্তেই একমত হয়ে যাই। এরপর দু-চার দিন সবাই ব্যক্তিগত ভাবে চিন্তা-ভাবনা করুন। আমাদের মধ্যে যারা অনুপস্থিত আছে তাদেরকে খবর দেয়া হয়েছে। তারা এলে সুবিধা মত একটি দিন বেছে নিয়ে আমরা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হবো। আমাদের সৈন্যরা এখন প্রস্তুত! ইতিমধ্যেই হরমন তার গোয়েন্দা বিভাগকে আরও সক্রিয় করে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর চরদের মাটির তলা থেকে বের করে কারাগারে পাঠাতে শুরু করেছে। এখানকার মুসলমানদের উপরও কড়া দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। প্রতিটি মুসলমানের বাড়ীর ওপর নজর রাখছে আমাদের গোয়েন্দারা। এমনকি প্রতিটি ব্যক্তির দৈনন্দিন গতিবিধির ওপরও দৃষ্টি রাখছে ওরা। আমাদের সৈন্য বাহিনীর সমাবেশ শুরু হয়ে গেছে। এদেরকে আর গোপন রাখা যাবে না। তাই এখন থেকে কোন নারী ও পুরুষকে শহরের বাইরে যেতে দেয়া যাবে না। কেউ বাইরে যেতে চাইলেই মনে করতে হবে, সে গোয়েন্দা।’

‘হ্যাঁ, তাই করা হবে।’ হরমন বললেন, ‘এখান থেকে একটি পাখিও বাইরে যেতে পারবে না।’ এভাবেই দু’পক্ষ আরেকটি অনিবার্য ও সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতিতে মেতে উঠল।

সমাপ্ত