সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো। নিচে যেখানে মশালের আলো জ্বলছিল সেখানে এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। লোকটা আয়নার মত স্বচ্ছ নিকেল করা ধাতুর পাত দুই হাতে উঠিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরাচ্ছিল। লোকটার পাশে মনে হয় আরও একজন আছে। অন্ধকারের কারণে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
মেহেদী আল হাসান পাহাড়ের উপরে থাকায় তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। আর অপেক্ষা করা সমীচিন মনে করল মেহেদী। সে মেয়েটিকে কাঁধে উঠিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ের অপর পাশ দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল।
এই পাহাড়ী অঞ্চলের গভীর অরণ্যে যেখানে কখনো কোন পথিক বা রাখাল যায় না, তেমন একটি জায়গায় একটি ছোট্ট পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে পর্বত গহ্বরের একটি খোলা মুখ। এই মুখ দিয়ে গহ্বরের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে প্রশস্ত জায়গা। এটি কোন পর্বত গহ্বর নয়, এটি একটি বিশাল কামরা।
সেই কামরায় অনেকগুলো লোক বসেছিল। এদের মধ্যে দুটি মেয়েও ছিল। তাদের একজন বলল, ‘এতক্ষণে তো ওদের ফিরে আসার কথা।’ তার কথার মধ্যে দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল।
‘অবশ্যই আসবে?’ অন্য মেয়েটি বললো, “ওখানে তো ভয় বা বিপদের কিছু নেই। আজ শিকার নিয়ে আসবে তো, তাই হয়তো একটু দেরী হচ্ছে।’
‘এ শিকারটা খুব কাজের লোক?’ আর একজন বললো, ‘হতভাগা বড় দক্ষ গোয়েন্দা। আমরা তাকে নিজের মত করে গড়ে নেব।’
সেই মুহূর্তেই একটা লোক দৌড়ে ভেতরে এলো এবং বললো, “গোপাল মরে পড়ে আছে, সিনথিয়ার কোন খোঁজ নেই। সে কি এদিকে এসেছে?’
‘না!’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল একজন, ‘গোপাল কিভাবে নিহত হলো?”
‘গোপালকে খঞ্জর দিয়ে খুন করা হয়েছে।’
“সেই লোকটি অর্থাৎ মেহেদী আল হাসান কোথায়?’ অন্য একজন জিজ্ঞেস করলো।
‘কোথাও তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’ লোকটি উত্তর দিল, ‘তার উটটি ওখানেই আছে। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
“কি বেকুবের মত কথা বলছো! উট যদি ওখানেই থাকে তাহলে সেও ওখানেই আছে। হয়তো কোন গর্তে বা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। ভাল মত খোঁজ করো, পেয়ে যাবে।’
‘ভাল মতই তো খুঁজেছি। গুহার বাইরে থেকে কয়েকবার সংকেত দেয়ার পরও সিনথিয়ার কোন সাড়া না পেয়ে দু’টি মশাল নিয়ে আমরা সুড়ংয়ে ঢুকেছিলাম। সেখানে কাউকে না পেয়ে উল্টো পাশের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আমরা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে খুঁজতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে সুড়ং মুখের সামান্য উপরে আমরা গোপালের লাশ পেলাম। সেও আমাদের সাথেই সুড়ং থেকে বেরিয়েছিল এবং সিনথিয়াকে ডাকতে ডাকতে ওদিকে গিয়েছিল।’
‘সুড়ংয়ের ভেতরে গিয়ে তোমরা কি দেখলে?”
‘সেখানে মেয়েটার কাপড়ের একটা টুকরা শুধু পড়েছিল, আর কিছু পাইনি।’
দলনেতা বুঝতে পারল, অবস্থা গুরুতর। সে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘পরিস্থিতি আমার ভাল ঠেকছে না। তোমরা দু’জন আস্তানার বাইরে ডিউটিতে চলে যাও।’ সে দুজনের দিকে ইশারা করে বলল, “যদি বাইরে থেকে কোন বিপদ আসে, তবে সংবাদ জানাবে।’ এরপর আর দু’জনের দিকে ইশারা করে বলল, “আর তোমরা দু’জন সেই পাহাড়ের পথ ধরো। যদি তাদের খোঁজ পাও, ধরে নিয়ে আসবে। আর যদি সে তোমাদের সাথে লড়াই করে তবে হত্যা করবে। অন্য যারা আছে তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাও। একভাগ এখানেই অপেক্ষা করবে যে কোন জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য, বাকীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ো। সে এই পাহাড়ী অঞ্চলেই কোথাও লুকিয়ে আছে। যদি সকাল পর্যন্ত না পাওয়া যায়, তবে দিনের আলোতে তাকে অবশই ধরা দিতে হবে।’
মেহেদী আল হাসান তখন মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে ছুটছে কায়রোর দিকে। পাহাড় থেকে নেমে সে উটের কাছে যাওয়ার ঝুঁকি নিল না। কারণ ইতিমধ্যেই সে যে তাদের ফাঁদে পা দেয়নি, তা জানাজানি হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে তাকে ধরার জন্য এই কুচক্রী মহল চেষ্টার কোন ক্রটি করবে না।
এ কথা ভেবেই সে কায়রো যাবার সহজ রাস্তা ছেড়ে দুর্গম পার্বত্য পথ ধরল। চলতে চলতে এক জায়গায় গিয়ে সে মহা সমস্যায় পড়ে গেল।
ততক্ষণে সে সুড়ংওয়ালা পাহাড় থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, এইভাবে চড়াই উত্রাই পেরিয়ে সে এক দুর্গম পাহাড়ে উঠে গেল।
এখানে কোন রাস্তা ছিল না যে, সে ওই রাস্তা ধরে এগুবে। সে তার আন্দাজ মত কায়রো অভিমুখে ছুটছিল। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখতে পেল সামনে পথ বন্ধ।
সে ডানে বামে তাকিয়ে দেখল। পাহাড়ের ডানে বামে কোথাও কোন ঢাল নেই, যেখান দিয়ে পরবর্তী পাহাড়ে যাওয়া যায়। পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় বিশ গজের মত জায়গা আছে, যা একটা দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে। এটা পেরোলে আবার হাঁটা চলার উপযোগী পাহাড় পাওয়া যাবে। এই বিশ গজের দেয়ালটা খাঁড়া এবং বেশ উঁচু, প্রস্থে কোথাও এক ফুট, কোথাও তারও কিছু কম।
পাহাড়ের এই খাড়া ও উঁচু চূড়াটা মেহেদী আল হাসানের জন্য মস্ত বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। এর ওপর এক সঙ্গে দুটি পা রাখাও সম্ভব নয়। সে এই দুর্গম দেয়াল দেখে সেখানেই থেমে গেল এবং সিনথিয়াকে নামিয়ে ভাবতে বসল। কিন্তু ভাবাভাবির বেশী সময় ছিল না। পেছন থেকে যে কোন সময় দুশমন চলে আসতে পারে। তাই সে সিনথিয়াকে আবার কাঁধে তুলে নিয়ে সেই দেয়ালের ওপর চড়ে বসল। যেভাবে ঘোড়ায় চড়ে সেভাবে দেয়ালের দুপাশে পা ঝুলিয়ে বসে হেঁচড়ে হেঁচড়ে সে সামনে বাড়তে থাকল।
মেয়েটাকে কাঁধে নিয়ে এমনিতেই ওজনের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। তার ওপর মেয়েটা শুরু করল শয়তানী। তাকে ফেলে দেয়ার জন্য কাঁধের উপর ভীষণ নড়াচড়া করতে লাগলো। সেখান থেকে পড়লে হাড়-মাংস এক হয়ে যাবে, এ কথা মেয়েটাও বুঝতে পারছিল। কিন্তু গোপন রহস্য উঘাটন করার চেয়ে জীবন দেয়া শ্রেয় মনে করে মেয়েটা এমন ছটফট করছিল। মেহেদী আল হাসানও বুঝতে পারল, এখান থেকে পড়লে মেয়েটির সাথে সে নিজেও শেষ হয়ে যাবে।
মেহেদী আল হাসান মহা সমস্যায় পড়ে গেল। মেয়েটি এমন দুষ্টামী করলে এ দেয়াল আদৌ পার হওয়া যাবে কিনা তাই সন্দেহ। এদিকে মেয়েটিকে নিষেধ করা সত্ত্বেও সে থামছে না। ওদিকে মেয়েটির লোকজন নিশ্চয়ই তার সন্ধানে এতক্ষণে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দেয়াল পার হওয়াটা মেহেদী আল হাসানের জন্য জীবন মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। দুষ্কৃতকারীদের হাতে ধরা পড়ার অর্থ নির্মম ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। কিন্তু এ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল না। সে ভাবছিল, এর ফলে জাতির অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। সে এই ক্ষতি হতে দিতে পারে না। সে মেয়েটির দু
’টি বাহু বগলের নিচে নিয়ে এমন জোরে চেপে ধরলো, মেয়েটির বাহু ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হলো। মেয়েটি বেদনায় গুঙিয়ে উঠল। সে বলল, ‘সাবধান, আবার নড়াচড়া করলে তোমার বাহু দু’টি ভেঙে ফেলতে বাধ্য হবো।’
এটুকু ঔষধেই কাজ হলো। কিছুটা শান্ত হলো মেয়েটি। মেহেদী আল হাসান তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অতি সাবধানে বুকে ভর করে সামনে এগুতে লাগল। এক সময় তার এ প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা শেষ হলো। তার শক্তি ও সাহস ওই পাহাড়ী দেয়াল তাকে পার করে নিয়ে এল।
সামনে মোটামুটি প্রশস্ত এক উপত্যকা। মেহেদী আল হাসান সেখানে পৌঁছেই মেয়েটিকে ধপাস করে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে ভীষণ রাগের সাথে বললো, ‘তুমি কি আমার রাস্তা বন্ধ করতে পারবে?’
সে মেয়েটাকে রাগের মাথায় দু’চার কদম টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে গেল আর বললো, ‘যদি আমার পথে আর কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করো, তবে এমন ভাবে সারা রাস্তা আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যাবো। যদি মরার ইচ্ছা থাকে তো মরো।’
এ সময় সে দূরে নিচে একটি মশাল দেখতে পেল। সে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সে বুঝতে পারলো, সে বিপদ পার হয়ে এসেছে। কারণ মশালটি সেই ভয়ংকর দেয়ালের ওপাশে। কিন্তু এতে তার উস্ফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। তাকে জলদি কায়রো পৌঁছতে হবে।
সে মেয়েটার পায়ের বাঁধন খুলে দিল। হাত পিছনে পিঠের সাথে আগের মতই বাঁধা থাকল। পায়ের বাঁধন খুলে সে মেয়েটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। খঞ্জরের ধারালো মাথা মেয়েটির গায়ে ঠেকিয়ে বললো, ‘সামনে বাড়ো। আমার হুকুম ছাড়া ডানে বায়ে ঘুরবে না।’
❀ ❀ ❀
তাদের অনুসন্ধানে পিছু নিয়ে যে ব্যক্তি বের হয়েছিল, সে সুড়ংয়ের মধ্যে ও আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। সিনথিয়া ও মেহেদী আল হাসানকে কোথাও না পেয়ে সে সুড়ংয়ের মুখে দাঁড়ানো দুজনকে ডেকে বললো, ‘ওদের তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।’
মেহেদী আল হাসান যেখান থেকে সুড়ংয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছিল লোক দুজন সেখানে এসে দাঁড়ালো।
মেহেদী আল হাসান ততক্ষণে বিপদজনক দেয়াল পার হয়ে একটি সমতল উপত্যকায় এসে পৌঁছলো। সেখান থেকে সামনে অগ্রসর হয়ে তারা আবার একটি দুর্গম পাহাড়ের সামনে পড়ল। এ পাহাড় খাঁড়া এবং এত উঁচু ছিল যে, সেখানে চড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। মেহেদী আল হাসান ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। বিপদ-বাঁধা তুচ্ছ করে এগিয়ে চলাই তার কাজ। অন্ধকারেও জায়গাটা চিনে ফেলল সে।
সে সামনে তাকিয়ে বুঝল, এ পাহাড় অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তারচে ডানে বা বায়ে কেটে এগিয়ে যেতে হবে। এ পাহাড়টার ওপাশেই আছে নীলনদ। নীলনদের পাড় ঘেঁষে একটি রাস্তা সোজা কায়রোর দিকে এগিয়ে গেছে। তাকে এখন সে রাস্তাতেই গিয়ে উঠতে হবে।
সে এবার মেয়েটির হাত এবং মুখের বাঁধন খুলে দিল। তারপর তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে এল পাহাড়ের ঢালে। বললো, ‘বসে পড়ো এবং নিজেকে নিচের দিকে গড়িয়ে দাও।’
দু’জনেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে গড়িয়ে নিচে নেমে এল। তারা পাহাড়ী ঢলের নিচে এসে পৌঁছতেই পানির কুল কুল শব্দ শুনতে পেল। নদীর উঁচু পাড়ে এসে দাঁড়াল তারা। মেহেদী আল হাসানের মনে পড়ে গেল, তাকে এবং মেয়েটিকে তার সাথীরা খুঁজছে। এ অবস্থায় সোজা রাস্তায় কায়রো রওনা দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সঙ্গে সঙ্গে সে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। মেয়েটিকে আদেশ করলো, ‘নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ো!’
মেয়েটি বললো, ‘আমি সাঁতার জানি না।’
মেহেদী আল হাসান খঞ্জরটি খাপের মধ্যে পুরে নিয়ে মেয়েটিকে শক্ত করে চেপে ধরে নদীতে ঝাঁপ দিল। নদীর ভাটির টান ছিল কায়রোর দিকে। সে মেয়েটিকে তার বুদ্ধির উপরে ছেড়ে দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলো। দেখলো, মেয়েটি বেশ সাঁতার কাটছে।
‘আমার ধারণা ছিল তুমি সাঁতার দিতে পারবে।’ মেহেদী বললো, ‘আমি জানি তোমাকে সব ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েই আমাদের দেশে পাঠানো হয়েছে। বেশী শক্তি প্রয়োগ করার দরকার নেই। কেবল গা ভাসিয়ে রাখো, দেখবে নদীর স্রোতই তোমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্রোত এখন আমাদের অনুকূলে। কারণ আমরাও ভাটির দিকেই যাবো।’
তাদের দুই পাশেই পাহাড় ও উপত্যকা। এক পাশে তাদের অনুসন্ধানে পাহাড় জঙ্গল চষে ফিরছে একদল দুষ্কৃতকারী। অন্য পাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে নিরেট পাহাড়। সাঁতরাতে সাঁতরাতে মেয়েটি আরেকবার চেষ্টা করলো মেহেদী আল হাসানকে তার রূপ ও যৌবনের ফাঁদে আটকাতে। কিন্তু ব্যর্থ হলো তার চেষ্টা।
নদী পথে সাঁতরে অনেক দূর চলে এসেছে তারা। মেহেদী আল হাসান দেখলো, তারা বিপদসীমা পার হয়ে এসেছে। সে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বিশেষ ধরনের সিটি বাজাতে লাগলো।
সে স্বাভাবিক গতিতে সাঁতার কাটছিল আর মাঝে মাঝে সিটি বাজাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরই সে অনুরূপ সিটি বাজানো শুনতে পেলো। কয়েকবার সিটি বিনিময়ের পর একটি টহল নৌকা তাদের কাছে এসে থামল।
মেহেদী আল হাসান ভাল মতই জানতো, যেভাবে সীমান্তের প্রহরীরা দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা পাহারায় থাকে তেমনি নদীতেও চব্বিশ ঘন্টা পাহারার ব্যবস্থা থাকে। নদীতে কোন নৌসেনা বিপদে পড়লে একে অপরকে এভাবেই বিপদ সংকেত দেয়, যেমনটি দিয়েছে মেহেদী আল হাসান। সংকেত পেয়েই নৌ প্রহরী ছুটে এসেছে তাদের কাছে। মেহেদী আল হাসান নিজের পরিচয় দিল ওদের কাছে। প্রহরীরা তাকে এবং মেয়েটিকে নৌকায় উঠিয়ে নিল।
আলী বিন সুফিয়ান গভীর ন্দ্রিায় ডুবেছিলেন। তাঁকে তাঁর চাকর জাগিয়ে দিয়ে বললো, ‘মেহেদী আল হাসান এই মুহূর্তে আপনার সাথে দেখা করতে চায়। তার সাথে একটি মেয়েও আছে।’
মেহেদী আল হাসান নামটাই তার কাছে যথেষ্ট ছিল। আলী বিন সুফিয়ান দ্রুত বিছানা ত্যাগ করলেন এবং তড়িঘড়ি বাইরে ছুটে গেলেন। তখনও মেহেদী আল হাসান এবং মেয়েটির কাপড় থেকে পানি ঝরছিল।
দু’জনকেই তার কামরায় নিয়ে গিয়ে বসতে বললেন আলী বিন সুফিয়ান। কামরায় প্রদীপ জ্বলছে। মেহেদী আল হাসান এই প্রথম প্রদীপের আলোয় মেয়েটিকে দেখতে পেলো। সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে স্বীকার করলো, মেয়েটি ঠিকই বলেছিল, যদি তুমি পুরুষ মানুষ হও আর আমাকে কখনও আলোতে দেখতে পাও, তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, তুমি তোমার কর্তব্যের কথা ভুলে যাবে।’
মেহেদী আল হাসান হেকিমের নাম উচ্চারণ করে বললো, তার ঘরে এক্ষুণি তল্লাশী চালাতে হবে। সব কথা আমি আপনাকে খুলে বলছি, আগে তাকে গ্রেফতারের ব্যবস্থা করুন।
‘মেহেদী!’ আলী বিন সুফিয়ান বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কার নাম বলছো, বুঝতে পারছো?’
‘বেয়াদবী মাফ করবেন, বিশ্বাসঘাতক কখনো পরের ঘরে থাকে না। আর চাইলেও সবাই বিশ্বাসঘাতক হতে পারে না। শক্ত পোক্ত আচ্ছাদন না থাকলে বিশ্বাসঘাতকতা করাও যায় না। নামী দামী লোকের বিশ্বাসঘাতক হওয়া কি কোন নতুন সংবাদ?’
আলী বিন সুফিয়ান মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হেকিম সাহেব কি তোমাদের দলেরই লোক? এখানে মিথ্যা বললে কিন্তু পরিণাম ভয়াবহ হবে। অতএব বুঝে শুনে ভেবে উত্তর দাও।’
মেয়েটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আলী বিন সুফিয়ান মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানে তোমাদের সাথে সে রকম কোন ব্যবহার করা হবে না, যেমনটি তুমি ভয় পাচ্ছো। তোমার সৌন্দর্য এবং রূপ যৌবনের মোকাবেলায় আমার সৈনিকরা পাথরের মত মজবুত। কিন্তু অসহায় মেয়েদেৱ সাহায্যের বেলায় আমরা রেশমের মত কোমল ও মোমের মত নরম। তুমি নির্ভয়ে আবার বলো, হেকিম কি আসলেই তোমাদের সাথী?’
সিনথিয়া মাথা নত রেখেই সংক্ষেপে বললো, ‘হ্যাঁ।’
মেহেদী আল হাসান সংক্ষেপে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে তার কাহিনী বর্ণনা করলো। হেকিম কি করে তাকে প্রেতাত্মার ভয় দেখিয়েছিল তাও খুলে বলল।
আলী বিন সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে কমাণ্ডো বাহিনীর কমাণ্ডারকে ডেকে পাঠালেন। কায়রোর পুলিশ প্রধান গিয়াস বিলকিসকেও ডাকলেন। তাকে হেকিমের বাড়ীতে অতর্কিতে অভিযান চালানোর হুকুম দিয়ে বললেন, হেকিমকে গ্রেফতার করে নিজের হেফাজতে নিয়ে নাও। তার বাড়ী ও দাওয়াখানায় তল্লাশী অভিযান চালাও।
তারপর তিনি কমান্ডো বাহিনীর কমাণ্ডারকে বললেন, ‘জলদি বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হও। এখনি অভিযানে বেরোতে হবে।’
রাতের অন্ধকারেই একদল কমাণ্ডো সৈনিক দ্রুত ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এল। যে কোন ধরনের অভিযানের জন্য ওরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই ঐক্যবদ্ধ ভাবে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ওদের কোন জুড়ি নেই। মেহেদী আল হাসানের রিপোর্ট অনুযায়ী সেই দুর্গম পাহাড়ে অভিযান চালানোর জন্য কমাণ্ডো বাহিনী দ্রুত তৈরী হয়ে এলে আলী বিন সুফিয়ান নিজে তাদের পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। গিয়াস বিলকিসকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। অন্য দু’টি ঘোড়ার একটিতে মেহেদী আল হাসান অপরটিতে মেয়েটিকে বসিয়ে রাতের অন্ধকারেই যাত্রা করলেন তিনি।
ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতে চান। কায়রো থেকে জায়গাটি বেশী দূরে ছিল না। মেয়েটির খোঁজে তার বাহিনীর লোকজন তখনো পাহাড়ের প্রতিটি খানাখন্দ ও ঝোপঝাড় চষে ফিরছিল। সর্বত্র তন্ন তন্ন করেও খুঁজে তাকে না পেয়ে ওরা অধীর ও হতাশ হয়ে পড়ল।
শেষ রাতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আস্তানায় ফিরে এল তারা। দলের কমাণ্ডার বলল, ‘অবস্থা গুরুতর, নিশ্চয়ই এ কথা সবাই বুঝতে পারছো? সিনথিয়া এবং মেহেদীকে কোথাও না পাওয়ার মানে হচ্ছে, তারা কায়রো চলে গেছে। যদি তাই হয় তাহলে সে ফৌজ পাঠাতে দেরী করবে না। তাই অনতিবিলম্বে আমাদেরকে এ স্থান ত্যাগ করতে হবে।’
কয়েকজন তার কথার প্রতিবাদ করল। বলল, ‘তার উট এখানে রয়ে গেছে। পালালে সে নিশ্চয়ই তার উটটি নিয়েই পালাতো। একটা মেয়েকে নিয়ে এতদূর হেঁটে যাওয়ার মত বোকামী করার লোক সে নয়। তাছাড়া আমরা কায়রোর পথে একাধিক গ্রুপ পাঠিয়েছি। ওই পথে গেলে আমাদের গ্রুপের চোখে ওরা পড়তোই।’
কিন্তু এ যুক্তি মেনে নিতে পারল না কমাণ্ডার। আরো কয়েকজন কমাণ্ডারকে সমর্থন করে বলল, “এখন এখানে বসে থাকাই বোকামী হবে।’
ফলে সিদ্ধান্ত হল, ওরা এ আস্তানা থেকে পালিয়ে যাবে। দলনেতা বলল, ‘যদি সিনথিয়াকে মেহেদী কোনভাবে কায়রো নিয়ে যেতে পারে তবে তার কাছ থেকে ওরা সব তথ্য আদায় করে ছাড়বে। তাই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য আমাদের দ্রুত সরে পড়ার চেষ্টা করতে হবে।’
সিনথিয়াকে খুঁজতে গিয়ে এমনিতেই ওরা অনেক সময় ব্যয় করে ফেলেছিল, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে রওনা করতে গিয়ে তাদের আরো দেরী হয়ে গেল।
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে ওরা যখন আস্তানা থেকে বেরোতে যাবে তখনি ওদের কানে এল ঘোড়ার সম্মিলিত পদধ্বনি। তারা আস্তানা থেকে বের হয়ে দেখলো, পালাবার সমস্ত পথ তাদের বন্ধ হয়ে গেছে।
আলী বিন সুফিয়ানের কমাণ্ডারা মশাল জ্বালিয়ে এলাকাটা আলোকিত করে তুলল। সিনথিয়া তাদের সাথেই ছিল, সে সব কথাই বললো ওদের। তার কাছ থেকেই জানা গেল দলের কে কোথায় আছে।
আস্তানাতেই পাওয়া গেল পাঁচ ছয় জন ক্রুসেডার। ভেতরে পাওয়া গেল বিভিন্ন আসবাবপত্র ও মালামালের স্তুপ। যার মধ্যে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, তীর, ধনুক, খঞ্জর, তলোয়ার এবং লোহার সিন্দুকে প্রচুর সোনা-দানা ও মনি মুক্তা। মিশরের প্রচলিত মুদ্রাও ছিল প্রচুর পরিমাণে।
ধৃত লোকদের মধ্যে মাত্র একজন বিদেশী ছিল, সেই ছিল দলের একমাত্র খৃস্টান। বাকি সবাই ছিল মিশরের মুসলমান। তাদের দ্বারাই অন্যান্য সঙ্গীদের ধরা ও অনুসন্ধান আরম্ভ হলো। সারা রাত এবং পরের দিনও অনুসন্ধান ও তল্লাশী কাজ চললো অব্যাহতভাবে। শেষ পর্যন্ত তাদের অবশিষ্টরাও ধরা পড়ে গেল। ধৃতদের মধ্যে সিনথিয়া ছাড়াও ছিল আরও দুটি মেয়ে।
মধ্য রাত পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। সারা শহর তলিয়ে আছে ঘুমের ঘোরে। এক দঙ্গল পুলিশ রাতের অন্ধকার উপেক্ষা করে কায়রোর হেকিমের বাড়ীর সামনে এসে হাজির হলো। তাদের মধ্য থেকে একজন গিয়ে হেকিমের বাড়ীর গেটে আঘাত করতে লাগলো।
বাড়ীর বুড়ো চাকর ‘এত রাতে আবার কার মরার শখ হলো’ বলতে বলতে ঘুম থেকে উঠে এসে দরজা খুলে দিল। গিয়াস বিলকিস বুড়োকে উপেক্ষা করে পুলিশ নিয়ে ঢুকে গেল বাড়ীর ভেতর। সরাসরি হেকিমের শয়ন কক্ষের সামনে এসে থামল তারা।
তাদের হাতে ছিল মশাল। একজন মশাল বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতে হেকিমের শয়ন কক্ষের দরজার কড়া নাড়ল। ভেতর থেকে দরজায় খিল লাগানো। লোকটি উপর্যুপরি কয়েকবার আঘাত করার পর এক অর্ধ উলঙ্গ মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। হেকিমও অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। হেকিমের মাথার কাছে পালংকের পাশে মদের সুরাহী ও পিয়ালা সাজানো।
হেকিমের তখন কোন হুঁশ ছিল না। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে ছিল বিছানায়। তার রোগীরা কখনও কল্পনাও করতে পারবে না, তাদের শ্রদ্ধেয় হেকিমের অবস্থার এত অধপতন হতে পারে।
মেয়েটি তার স্ত্রী ছিল না, এমনকি মুসলমানও না। এই মেয়ে ছিল হেকিমকে দেয়া খৃস্টানদের নানা উপহার সামগ্রীর মতই এক উপহার। খৃস্টানদের দেয়া উপহার সামগ্রীতে ভরা ছিল তার কামরা ও গৃহের বিভিন্ন কোণ। স্বর্ণ, রৌপ্য ও নানা রকম মূল্যবান ধাতুর তৈজষপত্রে ঘরটি ভরা। এ অঢেল সম্পদ নিশ্চয়ই হেকিমের সৎ উপায়ে অর্জিত নয়, ভাবতে বাধ্য হলো গিয়াস বিলকিস।
হেকিমের তখনও জ্ঞান ফেরেনি। সেই অজ্ঞান অবস্থায়ই তাকে তুলে আনা হয় তার ঘর থেকে। যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে কারাগারের এক গোপন কক্ষে।
পুলিশ সুপার গিয়াস বিলকিসকে খবর দেয়া হলো, হেকিমের ঘুম ভেঙ্গেছে। তিনি হেকিমের কাছে গেলেন। বললেন, ‘এখন দয়া করে কোন কিছু গোপন করতে চেষ্টা করবেন না।’
হেকিম দুজন সেনা অফিসারের নাম উল্লেখ করে বললো, ‘এরা দুজন মিশরে সুলতান আইয়ুবীর ক্ষমতা ও গদীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরা দুজনই খৃস্টানদের সাথে সম্পর্ক রাখে। ক্রুসেডাররা এদের নেতৃত্বে এখানে একটি গোপন দল সৃষ্টি করেছে।’ হেকিম স্বীকার করলো, তিনি নিজেও এই দলের সাথে যুক্ত।
‘এই মেয়েটি কে?” গিয়াস বিলকিস প্রশ্ন করলেন।
‘এই মেয়েটিকে উপহার হিসেবে খৃষ্টানরা আমাকে দান করেছে।’
‘আপনি কি করে ওদের সাথে শামিল হলেন?’
‘আমি ওদের সাথে শামিল হতে চাইনি। কিন্তু ওদের নানা রকম প্রলোভনে পড়ে যাই আমি। যেই মেয়েটিকে আমার বাসায় দেখেছেন সে মেয়েই আমাকে ফাসিয়ে দিয়েছে। ওদের সাথে শামিল না হলে ওরা সমাজে আমার মান সম্মান ধূলার সাথে মিশিয়ে দিত। আমি তাদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছি।’
‘শুধু কি এই ভয়েই আপনি তাদের সাথে শামিল হয়েছেন?”
“না, এক দিকে লোভ, অন্য দিকে ভয় আমাকে এদের সাথে যুক্ত করেছে। ওরা আমাকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দিয়েছে তারা। আমার এ দাবী মেনে নিয়েছে যে, তাদের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে, আমাকে মন্ত্রীর পদ দান করা হবে।’
হেকিম ছিলেন কায়রোর বিখ্যাত চিকিৎসক। বড় বড় অফিসারদের কাছে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। এই সুবাদে তার বেশ প্রভাব ছিল তাদের ওপর। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কাজে তাকে ব্যবহারের জন্য ক্রুসেডাররা প্রথমে তাকে টার্গেট করে। পরে তাকে ঘায়েল করার জন্য মেয়েটিকে লেলিয়ে দেয়। মেয়েটি হেকিমকে ঘায়েল করার পর তার আশ্রয়ে থেকে তারা নানা রকম ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করে দেয় তারা।
কায়রোতে যে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চলছিল তার মূলে ছিল এই হেকিম। সে তার যোগ্যতা বলে আলী বিন সুফিয়ানের বন্ধুত্ব এবং তাঁর বিশিষ্ট কিছু গোয়েন্দাকে চিনে নিয়েছিল। এদের মধ্যে মেহেদী আল হাসানও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
যখনই সে পাহাড়ী এলাকায় যাতায়াত এবং দুষ্কৃতকারীদের আড্ডা আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু করল, সাথে সাথে টের পেয়ে গেল হেকিম। ক্রুসেডাররা অন্য দুই কমাণ্ডারের মতই তাকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করল। কিন্তু হেকিম তাকে দেখে ভিন্ন ফন্দি আঁটল। হেকিম সিদ্ধান্ত নিল, এমন একজন সুন্দর, শক্তিশালী, সাহসী, বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ গোয়েন্দাকে হত্যা করার পরিবর্তে নিজেদের জালে আঁটকে ফেললে কেমন হয়! কথাটা সে দলের নেতৃস্থানীয় কয়েক জনকে বলল। সবাই বলল, ‘কিন্তু সে তো আইয়ুবীর খুবই বিশ্বস্তদের একজন। কিভাবে আপনি তাকে দলে টানবেন?’
সে ব্যবস্থা আমার আছে। আমাকে যেভাবে তোমরা বশীভূত করেছো, ঠিক সেভাবেই তাকে বশীভূত করারও অনেক পদ্ধতি জানা আছে আমার। আমি যে কয়েকজন মিশরীয় গোয়েন্দাকে হাত করার পরিকল্পনা করেছি, সে তালিকার শীর্ষেই আছে তার নাম। আমি তাকে নিয়ে বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছিলাম। আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগ তাকে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও দায়িত্বশীল মনে করে। সে এই দায়িত্ব পাওয়ায় আমার কাজ আরো সহজ হয়ে গেল।’
সবাই বলল, “ঠিক আছে, আপনি যা ভাল মনে করেন তাই হবে।’ ফলে সে ক্রুসেডারদের খুনের হাত থেকে বেঁচে যায়। হেকিম অনেক ভেবে-চিন্তে মেহেদী আল হাসানকে এই যাদুময় ইন্দ্রজালে আটকানোর চেষ্টা করে। তার পূর্ণ আস্থা ছিল, এমন পরী রূপী প্রেতাত্মার মোহে সে অবশ্যই বশে এসে যাবে।
একবার তাকে রূপের মোহে ফেলতে পারলে পরবর্তীতে তার চিন্তার পরিশুদ্ধির কাজ নিয়ে আর মোটেও ভাবতে হবে না। নারী ও হাশিশের নেশায় সে আপনাতেই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। কারণ এই প্রক্রিয়াটির সাফল্য বহুল পরীক্ষিত, যত জায়গায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে ততবারই তা সাফল্য বয়ে এনেছে।
কিন্তু যাদের ঈমান দৃঢ় তারা নারীর ইন্দ্রজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে যায়। যদি মেহেদী আল হাসানও তেমনি দৃঢ়মনা ঈমানদার হয়ে থাকে তবে তার নিজের মৃত্যুর জন্য সে। নিজেই দায়ী হবে।
যে দু’জন কমাণ্ডার রহস্যপূর্ণভাবে নিহত হয়েছিল, হেকিম তাদের সম্পর্কে বলেছিল, তাদেরকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিল। দু’জনকেই হেকিম এমন বিষ প্রয়োেগ করেছিল, যার স্বাদ ও গন্ধ সামান্যতম তিক্ত বা ঝাঁঝালো নয়। এতে মানুষ তার দেহের মধ্যে কোন প্রকার কষ্ট ও পরিবর্তন অনুভব করে না। এ বিষ প্রয়োগের বার থেকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কোন এক সময় লোকটি হঠাৎ মারা যায়।
সেই দুই কমাণ্ডারকে হত্যা করার কারণ ছিল, তারাও ঈমান বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তারা সুলতান আইয়ুবী ও তাঁর সরকারের প্রতি একান্ত অনুগত ও বাধ্য ছিল। তাদের দু’জনকে কেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ক্রুসেডাররা। তারা দুজনেই বিশ্বঘাতকতার পরিবর্তে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করল। স্বাভাবিক ভাবেই তারা বিশ্বাসঘাতকদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
হেকিম প্রথম জনকে পথে পেয়ে কথায় কথায় তাকে দাওয়াখানায় নিয়ে যায়। পরে তার চোখ ও নাড়ি দেখে তার মধ্যে গোপন অসুখ বাসা বেঁধে আছে বলে তাকে বিচলিত করে তোলে। তারপর তাকে বলে, ঘাবড়াবার কিছু নেই। এ ঔষধটুকু খেয়ে দেখো, যদি অসুখ না থাকে ক্ষতি নেই, আর থাকলে এতেই ভাল হয়ে যাবে। ভয় নেই, ঔষধের দাম তোমাকে দিতে হবে না। দ্বীনের পথের মুজাহিদ তোমরা, এটুকু সেবা করার সুযোগ এই বুড়োকে দাও।’
ঔষুধের পরিবর্তে বিষ খাইয়ে বিদায় করে দেয় সেই কমাণ্ডারকে। এ বিষ হেকিম পেয়েছিল ফেদাইনদের কাছ থেকে।
দ্বিতীয় কমাণ্ডারের বেলায়ও একই রকম ঘটনা ঘটে। তাকেও প্রথমে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাগে আনতে না পেরে একই পদ্ধতিতে গোপন ব্যাধির ধোঁকায় ফেলে ঔষুধের পরিবর্তে বিষ পান করায়। হেকিম অবশ্য এসব তথ্য সহজে প্রকাশ করেনি। তার মুখ খুলতে, তাকে বাধ্য করা হয়। কয়েদখানার ভয়াবহ শাস্তির যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে বুড়ো সব কথাই গিয়াস বিলকিসের কাছে প্রকাশ করে দেয়।
হেকিম তার জবানবন্দীতে আরো জানায়, একদিকে সৈন্যদের মাঝে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। অপরদিকে গোপনে নেশার দ্রব্য সরবরাহ করা হচ্ছে সৈনিক ও যুবকদের মাঝে। যুবকদের চরিত্র হনন ও ব্ল্যাকমেইলিং করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মেয়ে কর্মীদের। সামরিক অফিসারদেরকেও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে নানা কায়দায়। এদের মধ্যে যারা কট্টর দেশপ্রেমিক তাদেরকে কৌশলে গোপনে হত্যা করার কাজও শুরু হয়ে গেছে। সুদানী বাহিনী শীঘ্রই মিশর সীমান্তে আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছে। এ আক্রমণে নেতৃত্ব দেবে ক্রুসেড বাহিনী। মিশরের সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোর লোকদেরকে অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করার পরিকল্পনাও রয়েছে ওদের।
এই ষড়যন্ত্রের উৎঘাটন, দেশদ্রোহীদের গ্রেফতার ও তাদের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে মিশরের মাত্র তিনজন লোক সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। এঁরা হলেন গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান, পুলিশ প্রধান গিয়াস বিলকিস এবং মিশরের ভারপ্রাপ্ত সুলতান আমীর তকিউদ্দিন। কিন্তু এ গোপন তৎপরতার খবর অন্য আর কাউকেও জানানো হয়নি।
হেকিম ও তার দলের লোকেরা যাদের নাম উল্লেখ করেছে সে সব সেনাপতি ও অফিসারদের গ্রেফতার করা আবশ্যক ছিল। কিন্তু সুলতান তকিউদ্দিন এ ব্যাপারে একটু ভীত হয়ে পড়েন। তিনি এই গোপন চক্রান্তকে গোপন রাখারই আদেশ দিলেন। তিনি বললেন, ‘এই বিষয়টি এতই নাজুক যে, এ ব্যাপারটা সুলতান আইয়ুবী নিজে এসে সামাল দিলেই সব দিক থেকে মঙ্গলজনক হবে। আমি বিষয়টি সবার আগে তাকে জানাতে চাই।’