ফ্লোরী জানতে চাইল, ‘কে সেই বিপজ্জনক লোক?’
রউফ কুর্দি তার পরিচয় দিয়ে বললো, ‘ এ লোক আমাদের গোয়েন্দা। তাই তার কাছ থেকে সাবধান থাকবে’।
রউফ কুর্দি তখনো মেয়ে দুটিকে যাযাবরের কন্যা মনে করতো। তাই সে গোয়েন্দা লোকটির পরিচয় তার কাছে ফাঁস করে দিল।
ফ্লোরী ছিল ঝানু গোয়েন্দা। সে বুঝে নিল, রউফ কুর্দি যার কথা বলছে, তাকে সে সহ্য করতে পারছে না। লোকটি যদি গোয়েন্দা হয় তাহলে সে তাদেরকে জাহাজে থাকতে দেবে না। আর রউফ কুর্দিও চাইবে না মেয়েরা জাহাজ থেকে বিদায় হয়ে যাক। হয়তো এটাই তাদের দ্বন্দের মূল কারণ।
পরের রাতের ঘটনা। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আল ফারেস ডিউটি তদারক করার জন্য অন্য জাহাজে চলে গেলেন। রউফ কুর্দি তখন জাহাজের দায়িত্বে।
মাঝ রাতের একটু পর। রউফ কুর্দি ও ফ্লোরী জাহাজের ছাদের এক কোণায় গোপন অভিসারে মেতে ছিল। ওখানে জড়ো করে রাখা ছিল বিভিন্ন জিনিসপত্র। ওগুলোর আড়ালে বসেছিল ওরা।
হাসান বিন আবদুল্লাহর গোয়েন্দা ছাদে উঠছিল ঘুরে দেখতে। ছাদে উঠেই তার মনে হলো জঞ্জালের আড়ালে কাড়া যেন ফিসফাস কথা বলছে। সে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে গেল এবং হঠাৎ করেই উদয় হলো তাদের সামনে।
রউফ কুর্দি ভয় পেলেও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠলো, ‘আরে, এত রাতে তুমি এখানে?’
তারপর তার হাত ধরে তাকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে বললো, ভালই হয়েছে তুমি এসেছো। তুমি বলেছিলে, এরা গোয়েন্দা হতে পারে। তাই মেয়েটাকে লোভ লালসা দেখিয়ে জানতে চাচ্ছিলাম ওদের আসল পরিচয়। কিন্তু না, তেমন কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না’।
সে গোয়েন্দাকে বললো, ‘তুমি যখন এসেছো এবার আমি চলে যাই। তুমি চেষ্টা করে দেখো কৌশলে কিছু জানতে পারো কিনা? তুমি তো অভিজ্ঞ গোয়েন্দা, তোমার জেরার মুখে পড়লে হয়তো গোপন কোন তথ্য বেরিয়েও আসতে পারে’।
সে গোয়েন্দাকে ফ্লোরীর কাছে পাঠিয়ে দ্রুত রোজীর কাছে চলে গেল। তাকে বললো, ‘আরেকটু হলে ফেঁসে গিয়েছিলাম’।
‘কেন? কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো রোজী।
কি ঘটেছে সে সব খুলে বললো রোজীকে। রোজী বললো, ভালই শিকার যোগাড় করেছো। তুমিও মরবে, আমাদেরও মারবে’।
রোজী, তুমি ওখানে যাও। ওকে বুঝানোর চেষ্টা করো আমি তোমাদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করার চেষ্টা করেছিলাম। সে যদি টের পায় তোমাদের সাথে আমার কোন রকম সম্পর্ক আছে তবে আমার প্রেম করার শখ মিটিয়ে দেবে’।
‘ঠিক আছে, তুমি এদিকে পাহারা দাও কেউ যেন উপরে যেতে না পারে। আমি যাচ্ছি ছাদে’।
রোজী উপরে চলে গেল। রউফ কুর্দি এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে পাহারা দিতে লাগলো যেন কেউ উপরে যেতে না পারে।
রোজী যাওয়ার আগে একটুকরো শক্ত রশি নিল সাথে। তারপর সেই রশি ওড়নায় ঢেকে চলে গেল যেখানে গোয়েন্দাটি ফ্লোরীর কাছে বসেছিল সেখানে। জঞ্জালের আড়াল থাকায় জায়গাটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। রোজীও তাদের পাশে বসে গেল।
গোয়েন্দা গল্প গুজবের মাধ্যমে তাদের আসল পরিচয় জেনে নিতে চেষ্টা করছিল। রোজী হঠাৎ গোয়েন্দার গলায় রশি পেঁচিয়ে শক্ত করে টেনে ধরলো।
ফ্লোরীও ফাঁসের ওপর প্রান্তে টেনে ধরলো শক্ত করে। তারা উভয়েই ছিল ট্রেনিংপ্রাপ্ত সাহসী গোয়েন্দা। সেই ট্রেনিং এবার কাজে লাগাচ্ছে তারা।
হাসান বিন আবদুল্লার গোয়েন্দা নিজেকে বাঁচানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালালো। কিন্তু দু’জনের দু’দিক থেকে রশি টানাটানির ফলে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। দেহ শিথিল হয়ে গেল এবং এক সময় সে ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে।
মেয়ে দুটি গোয়েন্দার লাশটি ধরাধরি করে নিয়ে গেল জাহাজের কিনারে। তারপর তা গড়িয়ে ফেলে দিল গভীর সমুদ্রে। এভাবেই সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দার সলিল সমাধি ঘটলো সবার অজান্তে। সে হয়ে গেল ভূমধ্যসাগরের সামান্য মাছের খোরাক।
লাশটা পানিতে ফেলেই রোজী নিজের ক্যাবিনের দিকে হাঁটা ধরলো। ফ্লোরী দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই।
রউফ কুর্দি রোজীকে দেখেই তার কাছে এগিয়ে এলো। বললো, ‘খবর কি?
‘প্রেম করতে হলে মাথায় কিছু বুদ্ধিও রাখতে হয়। যাও, এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিলাম। তোমার প্রতিপক্ষ এতক্ষণে নিশ্চয়ই মাছের পেটে চলে গেছে। ক্যাবিনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই বললো রোজী।
রউফ কুর্দি দ্রুত উঠে এলো ছাদে। দেখলো রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ফ্লোরী। তাকিয়ে আছে সমুদ্রের অনন্ত ঢেউ রাশির দিকে, আলতো পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো রউফ কুর্দি। বললো, ‘কি দেখছো?’
ফ্লোরী ঘুরে দাঁড়ালো। আচমকা জড়িয়ে ধরলো তাকে। তার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কান্নাকাতর কণ্ঠে বললো, ‘তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে শেষে লোকটাকে মেরেই ফেললাম’। যেন অনুশোচনায় মরে যাচ্ছে সে।
রউফ কুর্দিও তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এসবই নিয়তির খেলা। নইলে এত রাতে মরার জন্য সে ছাদে উঠে এসেছিল কেন? মন খারাপ করো না। যা হবার হয়ে গেছে, এখন সব ভুলে যাও’।
আল ফারেস যেমন জানতো না, তার জাহাজে কোন গোয়েন্দা আছে আর রউফ কুর্দি তাকে কোন কাজে লাগিয়ে দিয়েছে তেমনি তার করুণ পরিনতির কথাও সে জানতে পারেনি। জাহাজীদের জীবন আগেও যেমন ছিল তেমনি চলছিল। গোয়েন্দার আগমন যেমন কোন আলোড়ন তুলতে পারেনি জাহাজে তেমনি তার অস্তিত্বও নিঃশব্দে মুছে গেল দুই খৃষ্টান মেয়ের হিংস্রতার কবলে পড়ে।
গোয়েন্দা নিহত হওয়ার দুই দিন পর। আল ফারেস তার ক্যাবিনে বসে চিন্তা করছিল। নিজেরও আরও পাঁচটি জাহাজের মাল্লা ও নৌসেনারা মাসের পর মাস সমুদ্রে কাটিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের একঘেয়েমি পেয়ে বসেছে সবাইকে। সবাই কেমন নির্জীব ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ডাঙার স্বাভাবিক আলো বাতাস থেকে দূরে মাটির স্পর্শহীন মানুষগুলোর জীবন ক্রমেই তিক্ত ও বিরক্তিকর হয়ে উঠছে।
যদি ওরা সংঘাত ও যুদ্ধে জড়িয়ে থাকতো তবে তাদের মানসিক অবস্থা এমন হতো না। সে জন্য আল ফারেস ভাবলো, সৈনিক ও মাল্লাদের উজ্জীবিত করার জন্য কোন আনন্দ অনুষ্ঠান করা উচিত। বিষয়টি নিয়ে সে রউফ কুর্দির সাথে পরামর্শ করলো। রউফ কুর্দি তাকে বললো, ‘রাতে সবকটা জাহাজকে একত্রিত করে মাল্লা ও নৌসেনাদের নিয়ে ভোজ সভার আয়োজন করা যেতে পারে’।
এ আনন্দ সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে সময় নিল না। জাহাজের মাল্লা ও সৈনিকদের কানে পৌঁছে গেল এ খবর। মেয়েদের কানেও গেল। মেয়ে দু’জন বললো, ‘আমরা ভোজসভায় নাচবো ও গান করবো’।
আল ফারেস ফুর্তিবাজ লোক, এ প্রস্তাবে তিনিও তাল দিলেন। কিন্তু কোন রাতে এ অনুষ্ঠান করা হবে এখনও তা নির্ধারণ করেননি। তিনি সুলতান আইয়ুবীর কাসেদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সুলতানের কাছ থেকে কোন শুভ সংবাদ এলে সেই উপলক্ষেই এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। আল ফারেসের এ ঘোষণার দু’দিন পরেই কাসেদ এসে গেল।
সে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী টায়ার থেকে সামান্য দূরে আছেন। সুলতান আপনাকে নৌবহর নিয়ে টায়ারের কাছে চলে যেতে বলেছেন। রাতে তিনি যখন টায়ার আক্রমণ করবেন তখন নৌবাহিনী যেন টায়ারের সমুদ্র বন্দরে অবস্থিত ওদের যুদ্ধ জাহাজগুলোর ওপর দ্রুত আক্রমণ করতে পারে’।
কাসেদ বিশেষ করে আরো বললো, ‘সুলতান আপনাকে এখন থেকে সদা সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলেছেন। সুলতানের ধারনা, তার আগমনের খবর পেলে খৃষ্টান রণতরী আপনাদের ওপর আগাম আক্রমণ করে বসতে পারে’।
আল ফারেস কাসেদকে বিদায় জানিয়ে সেই রাতেই তার সমস্ত জাহাজকে একত্র হওয়ার আদেশ দিলেন। রউফ কুর্দিকে বললেন, ‘সম্ভবত কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। তাই কাল রাতেই ভোজ সভার আয়োজন করো’। রউফ কুর্দি সব কটা জাহাজে এ ঘোষণা প্রচার করে দিল।
এণ্ডুর কিস্তি নিয়মিতই আসতো জাহাজে। হাসান বিন আবদুল্লাহর গোয়েন্দা তাকে কয়েকটি স্থানে দেখেছিল। কিন্তু সে কোন ব্যবস্থা নেয়ার আগে নিজেই দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেল। ফলে এণ্ডুকে সনাক্ত করার আর কেউ রইলো না জাহাজে।
জাহাজ উপকূলের কাছে এসে থামলো। এণ্ডুও তার নৌকা নিয়ে হাজির হয়ে গেল সেখানে। মেয়েরা আগের মতই তাকে উপরে ডেকে নিয়ে গেল। তারা তার কাছ কিছু কেনার বাহানায় এণ্ডুর কানে কানে বলে দিল, ‘কাল রাতে জাহাজ সব একত্রিত হবে। জাহাজের উপরে ভোজ সভা হবে, নাচ গান হবে’।
সে মেয়েদের বললো, ‘আমি রাতে যথাসময়ে নৌকা নিয়ে হাজির হয়ে যাবো। তোমরা তাকে তাকে থাকবে এবং সুযোগ মত সিঁড়ি ফেলে নেমে আসবে নৌকায়। তারপরের কাজ করবে আমাদের কমাণ্ডো বাহিনী’।
দেখতে দেখতে এসে গেল কাঙ্খিত রাত। ছয়টি জাহাজ পাল তুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেল। জাহাজের ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য অফিসাররা সবাই আল ফারেসের জাহাজে সমবেত হলো।
এশার নামাজের পর শুরু হলো আহারাদি পরিবেশন। মাল্লা ও সিপাইরা নিজ নিজ জাহাজে আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছিল। আল ফারেসের জাহাজেই মেয়ে দুটি নাচগান করছিল। অফিসাররা উপভোগ করছিল সে নাচগান।
মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করে তোলা হয়েছিল সব কটি জাহাজ। মাল্লারা অফিসারদের থেকে আলাদা হয়ে গান বাজনা ও আমোদ ফুর্তি করছিল।
এই আনন্দ উৎসব যখন তুঙ্গে তখন রাত গভীর। খৃষ্টানদের দশ বারোটি জাহাজ আলো নিভিয়ে আল ফারেসের জাহাজের দিকে অগ্রসর হলো। তারা নতুন চাঁদের হালকা আলোতে ছিল বলে দূর থেকে তাদের দেখার উপায় ছিল না।
তারা যখন কাছে এলো তখন শেষ রাত। ক্লান্ত সিপাইরা অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। অফিসাররাও ফিরে গেছে নিজ নিজ ক্যাবিনে। কেউ জানতে পারলো না তাদের অলক্ষ্যে এগিয়ে আসছে মৃত্যু।
শেষ রাতের বিসন্ন প্রহরে একটি ছোট নৌকা আল ফারেসের জাহাজের দিকে অগ্রসর হলো। সবার অলক্ষ্যেই তা ভিড়লো আল ফারেসের জাহাজের সাথে। সন্তর্পণে সিঁড়ি নামিয়ে তাতে চড়ে বসলো সেই দুই মেয়ে। একটু পরেই চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
সহসা আল ফারেসের জাহাজের দিকে অগ্নিবান ও গোলা নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল। ঘুমন্ত সৈন্য ও মাল্লারা জেগে উঠলো গোলার আওয়াজ পেয়ে। দাউ দাউ করে জাহাজে জ্বলে উঠলো আগুন।
মাল্লা ও সৈন্যরা ছুটে বেরিয়ে এলো ডেকে। আর তখন এমন তীর বর্ষণ শুরু হলো যে, তীরের আঘাতে ডেকের ওপর লুটিয়ে পড়তে লাগলো জাহাজের সৈন্যরা। আল ফারেস ও জাহাজের ক্যাপ্টেনরা আকস্মিক আক্রমনের আওতা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু তখন আর তা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু এরা ছিল আইয়ুবীর সৈন্য। ভড়কে যাওয়ার শিক্ষা তিনি তাদের দেননি। এই অবস্থায়ও তারা পাল্টা জওয়াব দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। তারাও মেঞ্জানিক দিয়ে অগ্নি নিক্ষেপ শুরু করলো শত্রুর জাহাজের ওপর।
খৃষ্টানরা পাল্টা আক্রমনের সম্মুখীন হবে ভাবতে পারেনি। তারা সতর্ক হওয়ার আগেই খৃষ্টানদের একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কিন্তু খৃষ্টান বাহিনীর কাজ তখন শেষ পর্যায়ে। তারা বেপরোয়া ভঙ্গিতে আরো কিছুক্ষণ গোলা বর্ষণ করে ফিরে গেল।
যুদ্ধ যেভাবে শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই শেষ হয়ে গেল। আল ফারেসের পাঁচটি জাহাজই পুড়ে গিয়েছিল। মুসলিম বাহিনীর বহু সৈন্য নিহত হয়েছিল। যেহেতু জাহাজ জ্বলছিল, সেই আলোতেই সৈন্যদের দেখে দেখে তীর বিদ্ধ করছিল খৃষ্টানরা।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আল ফারেস দেখতে পেলেন, একটি নৌকা তাদের কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাতে একজন পুরুষ ও দু’জন মেয়ে মানুষ। আল ফারেস দ্রুত জাহাজ থেকে একটি নৌকা নামিয়ে তাতে একদল নৌসেনাকে তুলে দিয়ে বললেন, ‘ছুটে যাও। ওদেরকে ধরতে চেষ্টা করো’।
ওরা ধাওয়া করলো সে নৌকাকে। টের পেয়ে ওরা তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। বাধ্য হয়ে পাল্টা তীর ছুঁড়লো মুসলিম নৌ সেনারা।
প্রথমেই তীরবিদ্ধ হলো নৌকার চালক এণ্ডু। এরপর একটি মেয়ে। নৌকা থেমে গেল। তীর চালনা বন্ধ করে ওরা গিয়ে ধরে ফেললো নৌকাটি।
একটি মেয়ে তখনো বেঁচে আছে। তাকে বন্দী করা হলো। যুদ্ধের পর যখন আল ফারেসের কাছে তাকে হাজির করা হলো তখনই তিনি জানতে পারলেন, তার এ শোচনীয় পরিণতির জন্য দায়ী কে?
মেয়েটি পড়ে সবই স্বীকার করলো। তার মুখ থেকেই আল ফারেস জানতে পারলেন এ ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে ছিল তাদেরই হাত। মেয়েটি আরো জানালো। তারা এর আগে এক মুসলিম গোয়েন্দাকে হত্যা করে জাহাজ থেকে সাগরে ফেলে দিয়েছে। সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আল ফারেস।
এই জাহাজে কোন গোয়েন্দা ছিল এটা তো তার জানাই ছিল না। তার মনে পড়লো হাসান বিন আবদুল্লাহর সতর্কবাণী। কথার এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শরীয়ত পাল্টে দেয়ার অধিকার কবে থেকে পেলে?’
তাইতো! শরীয়তের বিধান মেনে এই মেয়েদের যদি তিনি জায়গা না দিতেন তবে এই বিপর্যয়ের মুখে তাকে পড়তে হতো না। অনুশোচনায় তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত ও দগ্ধ হতে লাগলো। কিন্তু সর্বনাশের কোন হেরফের হলো না। মুসলমানদের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেলো।
এ সময় সুলতান আইয়ুবী টায়ার থেকে সামান্য দূরে এক জায়গায় ক্যাম্প করে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি সোজা টায়ারের উপর আক্রমণ চালাতে চাচ্ছিলেন।
তিনি আক্রমণ করার আগের দিন জানতে পারলেন, আল ফারেসের নেতৃত্বাধীন ছয়টি জাহাজের পাঁচটিই পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। এ খবরে সুলতান আইয়ুবী একেবারে থ মেরে গেলেন।।
তিনি এমন দুঃসংবাদ শোনার আশা কখনও করেননি। এই খবরে তিনি এতটাই স্তম্ভিত হলেন যে, তিনি অভিযান চালানো স্থগিত করলেন। অভিযান স্থগিত করে তিনি আল ফারেস ও অন্যান্য ক্যাপ্টেনদের ডেকে পাঠালেন। আল ফারেস সুলতানের সামনে হাজির হয়ে যা সত্য তাই তুলে ধরলেন। নিজের দুর্বলতা ও ত্রুটি স্বীকার করে বললেন, ‘নৌবাহিনীর সকল কর্মচারী, মাল্লা ও সৈন্যরা কেমন নির্জীব ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের একঘেয়েমী দূর করার জন্য সে রাতে ভোজ সভার আয়োজন করেছিলাম।
কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, আমাকে বোকা বানিয়ে আমারই জাহাজে দুই খৃষ্টান গোয়েন্দা যাযাবরের পরিচয়ে অবস্থান করছিল। আমাদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে তারা এই বিপর্যয় সৃষ্টি করে’।
সুলতান আইয়ুবী এই পরিস্থিতিতে টায়ারে অভিযান চালানো ঠিক হবে কিনা এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি তার সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন।
সৈন্যদের অবস্থা সবার কাছেই পরিষ্কার ছিল। তদুপরি কঠিন শীত পড়তে শুরু করেছে। সেই সাথে বৃষ্টিও হচ্ছে। সবাই বুঝতে পারছিল, এমন মওসুমে যুদ্ধ চালু রাখা খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
সৈন্যরা দ্রুত ও ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সুলতান বললেন, ‘এ অবস্থায় নতুন করে তাদের ময়দানে পাঠালে তা তাদের জন্য জুলুম হয়ে যাবে। ক্রমাগত সাফল্যের পর একবার পরাজিত হলেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। পরাজিত শত্রু নতুন করে মনোবল ফিরে পাবে আর আমাদের সৈন্যদের মধ্যে জন্ম নেবে পরাজয়ের গ্লানি’।
তিনি নৌবাহিনীর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বললেন, ‘ওরা এ জন্যই ধ্বংস হলো যে, দীর্ঘদিন ওরা বাড়ী ছাড়া ছিল। ফলে তাদের উদ্যমে ভাটা পড়েছিল। বায়তুল মোকাদ্দাসের মহান বিজয়ের পর এমন কিছু করা ঠিক নয়, যাতে মুসলিম বিশ্বে নতুন করে যে আবেগ ও জাগরণ সৃষ্টি হচ্ছে তা বাঁধাগ্রস্ত হয়। যদি জাহাজে নতুন বিপর্যয় দেখা না দিত তবে আমরা আগামীকাল টায়ারে আক্রমণ চালাতাম। এখন এই দুর্ঘটনার পর আদৌ অভিযান চালানো ঠিক হবে কিনা তোমরা ভেবেচিন্তে মতামত দাও’।
সুলতান আইয়ুবী সকলের মতামত গ্রহন করলেন। সম্মিলিত মতামতের প্রেক্ষিতে তিনি আদেশ দিলেন, ‘অভিযান আপাতত স্থগিত করা হলো। অধিকৃত অঞ্চল ছাড়া বাইরের যে সব সৈন্য আছে তাদের বেতন বোনাস দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দাও’। তিনি তার রক্ষী বাহিনীর কিছু সৈন্যকেও ছুটি দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। এরপর তিনি অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে আক্রার দিকে যাত্রা করলেন।
২০ জানুয়ারী ১১৮৮। আক্রায় পৌঁছে তিনি আরো কিছু সৈন্যকে ছুটি দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। নিজেও সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুদিন বিশ্রাম করবেন। মার্চ পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকলেন এবং পরবর্তী অভিযানের নকশা ও পরিকল্পনা তৈরি করতে লাগলেন।
ক্রুসেড যুদ্ধ শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিল। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয় সমস্ত ইউরোপকে একটা কঠিন ধাক্কা দিয়ে কাপিয়ে দিল।
সুলতান আইয়ুবী তার জীবনের লক্ষ্য ও সপ্ন পূরণ করেছিলেন এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ইসলামের সুরক্ষার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাস খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করাই যথেষ্ট ছিল না, বিশ্বব্যাপী ইসলামী চেতনার বিস্তার ও তা সংরক্ষণও জরুরী ছিল।
সুলতান আইয়ুবী প্রথমেই এই পবিত্র শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ় করলেন। শহরের প্রাচীর সুদৃঢ় করার সাথে সাথে বায়তুল মোকাদ্দাসকে ক্রুসেড বাহিনীর আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখার জন্য আশেপাশের এলাকা দূর দুরান্ত পর্যন্ত নিজ অধিকারে নিয়ে নেয়ার কথা ভাবলেন। উপকূলবর্তী এলাকা নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়ার কথাও উপলব্ধি করলেন তিনি।
সুলতান আইয়ুবী আগেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন। অবশিষ্ট যে দু’একটি স্থান ছিল সেখানেও তিনি তার কমাণ্ডো বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন। তারা একের পর এক আক্রমণ করে ওই সব অঞ্চল দখল করে চলছিল।
বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে খৃষ্টান বাসিন্দারা পালিয়ে যাচ্ছিল। যে সব স্থানে খৃষ্টান শাসন ছিল সেখানে মুসলমানদের জান-মাল ও জীবন ছিল দুর্বিষহ। মুসলমানদের পাইকারীভাবে হত্যা করা ছিল তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর এই হত্যাকাণ্ড চালাতো তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে।
কিন্তু সুলতান আইয়ুবী প্রতিশোধ পরায়ন আচরণ থেকে বিরত রইলেন। এমনকি ক্ষিপ্ত মুসলমানরা যেন কেউ কেবল খৃষ্টান হওয়ার কারণে কারো ওপর চড়াও হতে না পারে তা নিশ্চিত করলেন।
তিনি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সেনাপ্রহরা বসালেন। অধিকৃত এলাকার খৃষ্টান বাসিন্দারা যাতে নিরাপদে তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারে সে জন্য তাদের সঙ্গে নিরাপত্তা প্রহরী দিলেন।
এ অধিকার কাউকে আন্দোলন বা দাবী করে আদায় করতে হয়নি। বরং সুলতান আইয়ুবী নিজে থেকেই এসব ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন। যুদ্ধের পর কোন বেসামরিক লোককে তাদের অতীত অপকর্মের জন্য শাস্তি না দিয়ে তিনি তাদের ক্ষমার চোখে দেখলেন।
তিনি শুধু তাদেরকেই যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক করলেন যারা ক্রুসেড বাহিনীর সৈন্য ছিল এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। যুদ্ধে আহত সৈন্যদের তিনি উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। ক্রমান্বয়ে তিনি সমগ্র ফিলিস্তিনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করলেন।
সুলতান আইয়ুবীর প্রত্যেকে বাহিনী হেডকোয়ার্টার থেকে যত দুরেই থাকুক না কেন, তারা যথারীতি সুলতানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথ নিষ্ঠার সাথে পালন করছিল। যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল তখনো তিনি কব্জা করতে পারেননি সেগুলো দখল করার জন্য কমাণ্ডো বাহিনী প্রেরন করলেন। কমাণ্ডো সৈন্যরা তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাতো। তাদের সে আক্রমণ ছিল চিতা বাঘের মতই ক্ষিপ্র ও বেপরোয়া।
পাহাড়ে, জঙ্গলে, মরুভূমিতে সর্বত্র তারা ছুটে বেড়াতো শিকারী বাজের মতো সন্ধানী দৃষ্টি মেলে। খৃষ্টান বাহিনীর সন্ধান পেলে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিতো তাদের বাহিনী। তারা তাদের রসদপত্র কেড়ে নিতো। কেড়ে নিতো যুদ্ধের বাহন ঘোড়াগুলো আর সব অস্ত্রশস্ত্র।
এই কমাণ্ডো বাহিনীর বর্ণালী অভিযানের অসংখ্য ঘটনা ঠাই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তাদের ঘটনাবহুল, সাড়া জাগানো বীরত্বপূর্ণ কাহিনীগুলো আজও দুনিয়াব্যাপী প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করছে।
এই কমাণ্ডোদের দিয়েই সুলতান আইয়ুবী ফিলিস্তিনের প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করলেন। তারা সমগ্র ফিলিস্তিনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলো।
প্রতি দশ জনের একটি দল পরিচালিত হতো একজন কমাণ্ডারের নেতৃত্বে। তারা আবার দুইজন বা চারজনের ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে টহল দিত অধিকৃত অঞ্চলে। কখনো কোন অভিযানে গেলে দশ জনের ছোট্ট কমাণ্ডো বাহিনী শতাধিক খৃষ্টান সৈন্যের কোন ক্যাম্প বা কাফেলায় আক্রমণ করতে কখনো দ্বিধা করতো না।
তারা রাতের অন্ধকারে আক্রমণ চালিয়ে রাতেই আবার অদৃশ্য হয়ে যেতো। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্ব শরীর রক্তাক্ত করেও শত্রুর কাছ থেকে কেড়ে নিত রসদপত্র।
মাঝে মাঝে তারা বেরিয়ে পড়তো শত্রুর সন্ধানে। চলে যেতো কোন পাহাড়ে। সেখানে টিলার পর টিলা পার হয়ে যেতো। উপত্যকা এবং গুহায় খুঁজে বেড়াতো দুশমন। কখনো পাড়ি জমাতো বিশাল মরুভূমিতে। কড়া রোদ বা তুহীন শীত আটকাতে পারতোনা তাদের।
এ ধরনের অভিযানে অনেক সময় ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়তে হতো ওদের। প্রাণপণ যুদ্ধ চালানো আর শত্রুশিবিরে আগুন দিতে গিয়েও মাঝে মধ্যে বিপদে পড়ে যেতো ওরা।
কখনো দেখা যেতো, জ্বলন্ত আগুন থেকে বেরোতে গিয়ে দুশমন বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। বেকায়দায় পড়ে অনেক সময় সেই আগুনে জ্যান্ত পুড়ে মরার ঘটনাও ঘটে যেতো। এ সব সৈন্যদের ভাগ্যে কখনো দাফন কাফন জুটতো না। এ রকমই ছিল কমাণ্ডোদের জীবন।
শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া গেরিলাদের দেখলে তারা আজরাইলের কথাও ভুলে যেতো। মনে হতো তাদের ওপর আল্লাহ্র গজব নেমে এসেছে। তারা চরম অভিশাপের মত চড়াও হতো দুশমনের ওপর।
এই জানবাজদের ওপর নির্ভর করেই সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাসে জয় লাভের পর তাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমস্ত ফিলিস্তিনে। তারা বাঘের মত শিকার খুঁজে বেড়াতো আর হামলা করতো সিংহের মতো।
সুলতান আইয়ুবীর এই কমাণ্ডো বাহিনী সম্পর্কে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক স্ত্যানলি লেনপোল লিখেছেন, ‘এই সব মুসলমান গেরিলারা আমাদের নাইটদের মত লোহার ভারী পোশাক পরতো না বটে, তবে আমাদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও নাইটদের নাকানি চুবানি খাওয়াতে ওরা ছিল ওস্তাদ। তারা থাকতো অদৃশ্য অবস্থায়। আঘাত করার জন্য তাদের খুঁজে পাওয়া যেতো না।
আবার তারা আক্রমণ চালালে পালানোর সুযোগও পেতো না আমাদের সৈন্যরা। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ঘোড়া গুলো ছিল তাদের দখলে।
এসব মুসলমান কমাণ্ডোরা কখনও উদাস বা দুর্বল হতো না। তারা মৌমাছির মতই ছিল অনন্ত পরিশ্রমী। যদি তাদের থেকে বাঁচতে চাও তবে তাদের চোখের আড়ালেই থাকবে। তারা পাহাড়ি ঢলের মতই খরস্রোতা বেগবান। তাদের সয়লাব ক্রুসেড বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো।
আমাদের নাইটদের প্রতিটি পদক্ষেপ তারা তছনছ করে দিত। আমাদের ক্রুসেড বাহিনীর অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়াতো তাদের সামনে পড়লে। এমন বেপরোয়া বাহিনীর সাক্ষাৎ পৃথিবী খুব কমই পেয়েছে।
বর্তমানে যে স্থানটি ইসরাইল নামে পরিচিত, সুলতান আইয়ুবীর যুগে সে অঞ্চলটি ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস। তিনি সে শহর ও এলাকা খৃষ্টানদের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য যে লড়াই করেন সে লড়াইয়ে আল্লাহ্র হাজারো সৈনিক তাদের রক্তের নজরানা পেশ করেছিল।
সুলতান আইয়ুবী ও তার সৈন্যরা যুদ্ধের ময়দানে যে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেন, যেভাবে মেতে উঠেন ধ্বংসের খেলায় তাতে মনে হতে পারে তাদের অন্তরে কোন দয়ামায়া নেই।
কিন্তু যখন প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করতো তখন তাদের প্রতি এমন দয়া মায়া প্রদর্শন করা হতো, প্রতিপক্ষও তা দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে উঠতো। ইসলামের এই সৌন্দর্য সত্যি পৃথিবী বাসীর জন্য বিস্ময়কর ব্যাপার।
ন্যায়নীতি, সততা, সত্য ও সুন্দরের জন্যই ইসলামের লড়াই। এখানে ব্যক্তিগত ঘৃণা, ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার কোন অবকাশ নেই। ইসলাম কোন ধর্ম, বর্ণ, বংশ বা জাতির কল্যাণের জন্য আসেনি, এসেছে সভ্যতার কল্যাণের জন্য, মানবতার কল্যাণের জন্য।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন জগতবাসীকে। তাই বলা হয় রাহমাতুল্লিল আলামীন সমগ্র বিশ্ব জগতের রহমত। সুলতান আইয়ুবী ও তার সৈন্যরা এই সত্যের বলিষ্ঠ পরাকাদ্রষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। তাই শত্রুরাও তাদের সেবা ও মমতার স্পর্শ পেয়েছিল।
খৃষ্টান ঐতিহাসিকরা সুলতান আইয়ুবীর এই মমতা পূর্ণ আচরণের জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন তাদের গ্রন্থে। তাদের লেখায় পাওয়া যায় তাঁর মহত্ব ও করুণার অসংখ্য বিবরণ। এই মহত্ব থেকে যেমন বঞ্চিত হয়নি কোন সম্রাট বা রাণী, তেমনি বঞ্চিত হয়নি কোন সাধারন সৈনিক, খৃষ্টান জনসাধারণ, নারী, শিশু বা তরতাজা যুবক।
খৃষ্টানদের এক রাণী। তার নাম ছিল সাবিলা। তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ খৃষ্টান সম্রাট রিমাণ্ডের স্ত্রী। হাতিনের যুদ্ধের সময় তিনি তিব্বিয়ার শাসক ছিলেন। সম্রাট রিমাণ্ড হাতিনের যুদ্ধের সময় ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী সাবিলা তিবরিয়ার কেল্লা সুলতান আইয়ুবীর হাতে তুলে দিলেন। সুলতান আইয়ুবী এই মহিলাকে বন্দী না করে সসম্মানের সাথে তাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
হাতিনের যুদ্ধেই সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসক গে অব লুজিয়ানকে যুদ্ধবন্দী করেছিলেন। বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয়ের পর যখন সুলতান আইয়ুবী আক্রাতে এসে ইতি টানলেন এই পর্বের যুদ্ধের, তখন তিনি সংবাদ পেলেন, রাণী সাবিলা তাঁর সাথে দেখা করতে আসছেন। সুলতান আইয়ুবী তাঁর পথ আটকে ধরার পরিবর্তে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সম্বর্ধনা জানালেন।
‘সালাউদ্দিন! রাণী সাবিলা পরাজয় বরণ করার পরও নিজেকে রাণীই দাবী করতেন। কারণ তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ত্রিপোলীর রাণী ছিলেন।