» » রিচার্ডের নৌবহর

বর্ণাকার

এই ধারা চলতেই থাকলো। দাউদ গম্বুজের সামনেও শুরু হয়ে গেল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সে যুদ্ধে উভয় পক্ষ সমান বীরত্ব, ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করতে লাগলো। যুদ্ধের প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছিল, উভয় দলই যুদ্ধের চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখীন। আজই তারা এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি চায়।

ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাসে উভয় পক্ষ ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে যুদ্ধ করছিল। যে সব খৃষ্টান সেনা আহত হতো, তারা শহর প্রাচীরের বাইরেই পড়ে থাকতো। এই হতভাগাদের উঠিয়ে নেয়ার কেউ ছিল না।

রাত শেষ হলো এভাবেই। সেপ্টেম্বরের অসহ্য গরমের আগাম বার্তা নিয়ে রক্তচক্ষু মেলে উদিত হলো রাঙ্গা সূর্য। যুদ্ধ চলতে লাগলো বিরতিহীনভাবে।

দুপুর। প্রচণ্ড রোদ জ্বালিয়ে মারছিল সৈন্যদের। লৌহ পোশাক ধারী খৃষ্টান নাইটরা জ্বলেপুড়ে মরছিল সে রোদে। সে তুলনায় মুসলিম বাহিনীর অবস্থা ছিল অনেক ভাল। আহত মুজাহিদদেরকে মেয়েরা উঠিয়ে নিয়ে সেবা শুশ্রূষা করছিল। তাদের পানি পান করানো আর ব্যাণ্ডেজ বাঁধার কাজ করছিল একাগ্রতার সাথে।

পাহাড়ের পাশের ঝর্ণা থেকে মশক ভরে পানি আনছিল কেউ কেউ। দুপুরের উত্তপ্ত সূর্য মাথায় নিয়ে পানি আনতে গিয়ে তাদের আধমরা অবস্থা হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী এ যুদ্ধ দেখছিলেন আর আবেগে ফেটে পড়ছিলেন।

পাহাড় থেকে ভারী পাথর বহন করে আনার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল খচ্চরের গাড়ী। এই পাথর ব্যবহৃত হচ্ছিল মেঞ্জানিক কামানে।

বিরতিহীন এই যুদ্ধে আরো প্রচণ্ড রূপ নিল দুপুরের পর। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত যেন কোন দলই থামতে রাজি নয়। প্রাচীরের ওপর থেকে খৃষ্টানরা ছুঁড়ছিল দুরপাল্লার কামানের গোলা। মুসলমানরা ছুঁড়ছিল মেঞ্জানিক।

চারদিকে আহতদের চিৎকার, চেঁচামেচি। তীরের শন শন আওয়াজ। এই হট্টগোলের মধ্যেই রাগী সূর্য তার রক্তচক্ষু নিয়ে চলে গেল পশ্চিমের আকাশে।

রাত নামলো। পাথর নিক্ষেপ তখনো চলছিল অব্যাহত গতিতে। মুজাহিদদের পাথর ও অগ্নিগোলা প্রাচীরের ওপর গিয়ে পড়ছিল। কখনো কখনো প্রাচীর পার হয়ে শহরের ভেতরও গিয়ে পড়তো।

অন্যদিকে প্রাচীর এবং গম্বুজ থেকেও গোলা ও পাথর বর্ষণ করছিল খৃষ্টানরা। তাদের এক জ্বলন্ত অগ্নিবান গিয়ে পড়লো মুসলিম বাহিনীর এক মেঞ্জানিকের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তাতে আগুন ধরে গেল। পাশাপাশি আরো দু’তিনটি মেঞ্জানিকে ছড়িয়ে পড়লো সে আগুন। মেঞ্জানিকের সাথে পুড়ে গেল তাতে কর্মরত সৈন্যরাও।

অন্য মেঞ্জানিকগুলো থেকে পাথর নিক্ষেপ চলতেই থাকলো। প্রাচীর এবং গম্বুজ থেকেও গোলা ও পাথর বর্ষণ চলতে থাকলো সমান তালে। তীরও বর্ষিত হচ্ছিল দু’পক্ষ থেকে। রাতের প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হলো। প্রাচীরের বিভিন্ন দিক থেকেও পাথর ও অগ্নিবোমা নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল মুজাহিদ বাহিনীর ওপর।

বাইরে কোথাও কোথাও উঁচু টিলা ছিল। সে সব টিলার ওপর সরিয়ে নেয়া হলো বেশ কয়েকটি মেঞ্জানিক। ওখান থেকে যখন পাথর ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ শুরু হলো তখন দেখা গেল, সে সব গোলা প্রাচীর পার হয়ে শহরের ভেতরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। মুজাহিদরা এবার পাথর বাদ দিয়ে সলতে ওয়ালা জ্বলন্ত তীর নিক্ষেপ শুরু করলো শহরের বিভিন্ন স্থানে। সঙ্গে সঙ্গে সে সব জায়গায় আগুন ধরে গেল। ধোঁয়া ও আগুনের শিখা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল।

তিন ধরনের খৃষ্টান সেনা ছিল শহরে। একদল যারা পূর্ব থেকেই শহরে ছিল। যুদ্ধের এ পর্যায়ে এসেও তাদের মনোবল ছিল দৃঢ়। কিন্তু অন্য স্থান থেকে যেসব সৈন্যরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল শহরে, তাদের কারো কারো মনে ছিল প্রতিশোধের স্পৃহা। তবে পালিয়ে আসা অধিকাংশ সৈন্যদের মনেই কাজ করছিল ধ্বংসের বিভীষিকা।

যদিও ওরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করছিল, কিন্তু তাদের মনোবল ছিল একেক জনের একেক রকম। শহরের সৈন্যরা তখনো সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিতে পারবে এমন ধারনা নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তারাই বার বার নাইটদের সঙ্গে গেট দিয়ে বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করছিল মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গে।

অন্য এক গেট দিয়ে এবার বেরিয়ে এলো আরেকদল নাইট সৈন্য। তারা বেরিয়েই অবরোধকারী সৈন্যদের উপর আক্রমণ শুরু করলো।

তাদের মনোবল সতেজ থাকলেও শহরবাসীর মনোবল ছিল সৈন্যদের থেকে পৃথক। এই শহরে তখন অবস্থান করছিল আক্রা ও আসকালান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা। তারা আগে থেকেই আতংকগ্রস্ত ছিল, সুলতানের বাহিনী শহর অবরোধ করেছে জেনে তারা সমস্ত শহরে আতঙ্কের গুজব ছড়িয়ে দিল।

তারা বললো, ‘সুলতানের বাহিনীতে জ্বীন আছে। জ্বীনেরা সুলতানের পক্ষে যুদ্ধ করে বলেই অল্পসংখ্যক হয়েও তারা আমাদের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে যায়।

আমরা নিজের চোখে জ্বীনদের তাণ্ডব দেখেছি। তারা মুহূর্তে আমাদের সামনে কয়েকটি গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। তারা বাতাসের ওপর ভোর দিয়ে চলে এবং মুহূর্তে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে পারে’। এ ধরনের গুজবে আতংক বন্যার পানির মত একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছিল।

বায়তুল মোকাদ্দাসের সমস্ত গির্জা থেকে ক্রমাগত ঘণ্টা ধ্বনি বাজছিল। যুদ্ধের তাণ্ডবে রাত ও দিন সব একাকার হয়ে গিয়েছিল। শহরের খৃষ্টানরা গির্জায় জড়ো হয়ে পাদীর সাথে সুর মিলিয়ে উচ্চস্বরে প্রার্থনা সঙ্গীত গাইতে লাগলো।

শহরের বাইরে সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা তাকবীর ধ্বনি দিচ্ছিল। সেই তাকবীর ধ্বনির আওয়াজ শহরের ভেতর থেকেও শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন বাইরে মেঘ গর্জন করছে।

মেঞ্জানিকের অগ্নিতীর লেগে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আগুন ধরে শহরের মধ্যে ভীতির এক স্রোত বয়ে গেল। জ্বলন্ত অগ্নিশিখা যেন আতংকগ্রস্ত খৃষ্টান নাগরিকদের শেষ মনোবলটুকুও নিঃশেষ করে দিল।

সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা, যারা খৃষ্টান ছদ্মবেশে শহরের মধ্যে ছিল তারা আগুনের মধ্যে ঘি ঢালার কাজ করছিল। তারা এমন ভয় পাওয়ার ভান করছিল যাতে শহরের খৃষ্টানরা মানসিকভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।

তারা নানা রকম ভয়ংকর গুজব ছড়িয়ে লোকের মধ্যে আতঙ্কের পাহাড় চাপিয়ে দিচ্ছিল। একজন বললো, ‘শুনেছি সুলতান আইয়ুবী জেরুজালে দখল করতে চান না। তিনি নাকি শহরটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে সমস্ত খৃষ্টান হত্যা করবেন’।

‘হ্যাঁ, আমিও শুনেছি, তিনি নাকি সৈন্যদের হুকুম দিয়েছেন, এমনভাবে হামলা চালাবে যাতে এখানে কোনদিন শহর ছিল তাঁর চিহ্নও না থাকে। কোন খৃস্টানকে বাঁচতে কে দেবে না। তবে তাদের কোন যুবতী মেয়ে যদি তোমাদের পছন্দ হয়ে যায় তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারো, তাতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না’। বলছিল অন্য কেউ।

তাদের মধ্যে নতুন আতংকের বাণী প্রচার করলো সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা। তারা বলতে লাগলো, ‘শুনেছো, আমাদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক আক্রার সবচে বড় ক্রুশ চিহ্নটি নাকি এখন সুলতান আইয়ুবীর হাতে। পাদীরা বলেছেন, এই ক্রুশ যার হাতে থাকে সে পরাজিত হয় না। তাহলে এখন উপায়!’

ক্রমে এ খবর ডালপালা মেলতে লাগলো। আক্রা থেকে আগত শরণার্থীরা স্বীকার করলো এর সত্যতা। তারা বললো, ‘ঈশ্বর নাকি খৃষ্টান সম্রাটদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ক্রুশটি সুলতান আইয়ুবীর হাতে তুলে দিয়েছেন’।

কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে বললো, ‘শুনেছি সুলতান আইয়ুবী ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ নিয়েছেন। ঈশ্বরের অভিশাপ প্রাপ্ত খৃষ্টান সম্রাট ও তার দোসরদের তিনি কিছুতেই রেহাই দেবেন না। এর অর্থ হলো, ইসা মসীহ এখন খৃষ্টান সম্রাটদের উপর নারাজ’। এসব কথা যে সত্য তার প্রমাণ তো তারা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে। ঈশ্বর নারাজ না হলে এ রকম জাঁদরেল নাইটরা সামান্য সৈন্যদের হাতে মারা যায়!

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আইয়ুবীর গোয়েন্দারা সে সময় সুকৌশলে খৃষ্টানদের মনে তাদের অতীত পাপের জন্য ভীষণ ভয় জাগিয়ে তুলেছিল।

খৃষ্টানরা বায়তুল মোকাদ্দাস জয়ের পর সেখানে মুসলমানদের ওপর যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লোকজন একে অন্যকে দোষারোপ করছিল। তারা বলছিল, মনে নেই, আমাদের সৈন্যরা শিশুদের বর্শার আগায় বিদ্ধ করে আনন্দ নৃত্য করেছিল? মুসলমান মহিলা ও যুবতীদের উপর বলাৎকার করেছিল? মসজিদের ভেতর তাদের উলঙ্গ লাশ ফেলে রেখেছিল? তাদের পবিত্র ঘর মসজিদ এবং পবিত্রগ্রন্থ কোরআনের অবমাননা করেছিল? আল্লাহ্‌ এত অত্যাচার সইবে কেন?

এ কথার রেশ ধরেই অন্য জন হয়তো বলছিল, নব্বই বছর ধরে সেই অভিশাপ আমাদের মাথার ওপর ঘুরপাক খেয়েছে। যিশুর পরম প্রেমের বাণী ভুলে আমাদের পূর্ব পুরুষরা মুসলমানদের উপর যে উৎপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েছিল তার শোধ নেয়ার জন্য প্রভু এই গজব পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের ওপর’।

খৃষ্টানদের জঘন্য বর্বরতার শিকার মুসলমানরা এসব কথায় নতুন করে প্রাণ পাচ্ছিল আর খৃষ্টানরা এসব কথা স্মরণ করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য গির্জায় গিয়ে পাদ্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছিল।

বর্তমান যুগের পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক এন্থনী এলিয়েট অনেক ঐতিহাসিকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, সে সময় বায়তুল মোকাদ্দাসে খৃষ্টানরা অবরোধের কারণে চরম বিভীষিকার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। এই আমেরিকান ঐতিহাসিক আরো লিখেছেন, অবরোধের সময় অনেক খৃষ্টানকে শহরের গলিতে গলিতে ঘুরে বুক চাপড়াতে দেখা গেছে। কেউ কেউ রাস্তায় ঘুরে নিজেই নিজেকে চাবুক মারতো আর মাতম করতো। ওরা মনে করতো, এটা খোদার কাছে পাপ ক্ষয়ের এক পদ্ধতি।

যাদের যুবতী মেয়ে ছিল তার মা তাদের মাথার চুল ন্যাড়া করে দিয়েছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে প্রভু সদয় হয়ে মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষা করবেন।

পাদ্রীরা নাগরিকদের মন থেকে এই ভয় দূর করার জন্য ক্রমাগত নছিহত করে যাচ্ছিলো। কিন্তু কোন নছিহতই তাদের মন থেকে এই ভীতি দূর করতে পারছিল না।

মুসলমানদের অবস্থা ছিল এমন, সেখানে তিন হাজারের অধিক মুসলিম নর-নারী ও শিশু কয়েদখানায় বন্দী ছিল। আর যারা বাড়ীতে ছিল তারাও ছিল মূলতঃ গৃহবন্দী। তারা খৃষ্টানদের ভয়ে মসজিদে যেতেও সাহস পেতো না। সুলতান আইয়ুবীর অবরোধের সঙ্গে সঙ্গেই সকল মুসলমান জেনে গেলো, সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাস অবরোধ করেছেন।

গৃহবন্দী মুসলমানরা খৃষ্টানদের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতা লক্ষ্য করে সাহসী হয়ে উঠলো। তাদের দুরন্ত যুবকরা বাড়ীর ছাদে উঠে আজান দিতে আরম্ভ করলো। যারা কয়েদ খানায় ছিল তারা সজোরে কোরআন পাঠ শুরু করে দিল। কেউ বা উচ্চস্বরে দোয়া দরুদ পাঠ করতে লাগলো। নারী ও শিশুরা, যারা গৃহবন্দী ও জেল বন্দী ছিল তারা সবাই দু’হাত তুলে আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করতে লাগলো। তারা আইয়ুবীর বিজয় চেয়ে আল্লাহ্‌র কাছে কান্নাকাটি করতে লাগলো।

খৃষ্টানরা তাদের কার্যকলাপ দেখছিল, কিন্তু কিছু বলার সাহস বা শক্তি তখন তাদের ছিল না। কারণ তারা বুঝতে পারছিল, তাদের অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিফল ভোগ করার সময় এসে গেছে। তারা আসন্ন শাস্তির ভয়ে কাঁপতে লাগলো। তাই মুসলমানদের আজান ও কোরআন পাঠের শব্দ শুনেও তারা কোন টু শব্দও করছিল না।

মুসলমান যুবকরা যখন খৃষ্টানদের এ অবস্থা দেখলো তখন তারা পথে নেমে এলো। তারা অলি গলিতে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো, ‘ইমাম মেহেদী এসে গেছেন, আমাদের মুক্তি আসন্ন। মুসলমানরা, ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসো। শহরের দেয়াল ভেঙ্গে আসতে দাও মুক্তিদুতকে। শহরের গেট খুলে দাও’।

তখন শহরের মধ্যে শুরু হয়ে গেল হক ও বাতিলের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব। গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি ও আজানের সংঘর্ষ চলতে লাগলো শহর জুড়ে। আর বাইরে ঘোড়া, তলোয়ার, বর্শা ও তীর নিয়ে মহা সমরে নেমে পড়েছে খৃষ্টান ও মুসলিম শক্তি।

গির্জায় ঘণ্টা যত বেশী জোরে বাজে তারচে জোরে শোনা যায় আজানের ধ্বনি। বাড়ীতে বাড়ীতে কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ বেড়ে যায়। ছোট ছোট শিশুরাও আলাহু আকবার ধ্বনি নিয়ে নেমে আসে রাস্তায়।

কিন্তু বাইরে তখন কেয়ামতের তাণ্ডব বইছে। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা জীবন বাজী রেখে চেষ্টা করছে দেয়াল ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশের। প্রাচীরের উপর থেকে বৃষ্টির মত তীর বর্ষণ করে খৃষ্টানরা চেষ্টা করছে তাদের ঠেকিয়ে রাখার। বাইরে যেসব নাইট যোদ্ধা কমাণ্ডো আক্রমনের জন্য ওঁত পেতে বসেছিল তারা সুলতানের বাহিনীর ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালাতে লাগলো বার বার।

সুলতানের সৈন্যরা মেঞ্জানিক থেকে অনবরত নিক্ষেপ করছিল পাথর ও অগ্নিগোলা। প্রাচীরের ওপর গম্বুজ থেকে কামান দাগছিল খৃষ্টানরা। পাথর বহনকারীদের শরীরগুলো রক্তাক্ত হয়ে উঠছিল। লৌহবর্ম পরা নাইটরা হাঁপিয়ে উঠছিল অস্ত্রের ভারে। বাইরে ভেতরে চলছিল তুমুল লড়াই।

রক্তাক্ত সমরাঙ্গনে লড়ছে দুই জানবাজ বাহিনী। এ যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ, বিশ্বাস ও চেতনার যুদ্ধ। তাই বেঁচে থেকে কেউ পরাজয় মেনে নিতে রাজি নয়।

সমুদ্র উপকুল থেকে চল্লিশ মাইল দূরে ভুমধ্যসাগরে আল ফারেসের ছয়টি যুদ্ধ জাহাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাহারা দিচ্ছে সমুদ্র পথ। টায়ার সমুদ্র বন্দরে খৃষ্টানদের আর কোন সমুদ্র জাহাজ যাতে ভিড়তে না পারে সে জন্য রাখছে বিশেষ নজর। কোন অস্ত্র ও রসদবাহী খৃষ্টান জাহাজ দেখলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত নৌসেনারা।

মেয়ে দুটি তখনো জাহাজেই ছিল। আল ফারেসের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সুলতানের চূড়ান্ত হামলার খবর। টানটান উত্তেজনা নিয়ে তিনি তদারক করছিলেন বাহিনীর প্রস্তুতি। সবাইকে যুদ্ধের জন্য সতর্ক করে প্রস্তুত অবস্থায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন ডিউটিতে। ফলে মেয়েদের দিকে দৃষ্টি দেয়ার মত সময় কারো ছিল না।

অভিযান শুরু করার মুহূর্তে সুলতান আইয়ুবী আল ফারেসকে তার বিরাট দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। আলা ফারেস সে কথা মনে গেঁথে নিয়ে ছুটছিলেন এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে। কখনও নিজে জাহাজের মাস্তলের মাথায় বাঁধা মাচানে বসে দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখতেন কোন যুদ্ধ জাহাজ ধরা পড়ে কিনা দৃষ্টিসীমায়। আবার নেমে গিয়ে দেখতেন নৌসেনারা যার যার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছে কিনা?

এই সুযোগে দায়িত্ব পালনের নাম করে রউফ কুর্দি দেখা করতো ফ্লোরীর সাথে। তারা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিত গোপন সাক্ষাতে। সবাই যার যার দায়িত্বে ব্যস্ত থাকায় এদিকে নজর দেয়ার কেউ ছিল না। সবার অজান্তেই চলছিল তাদের এ গোপন অভিসার।

কিন্তু একজন, হাসান বিন আবদুল্লাহর কাছ থেকে মেয়েদের ওপর নজর রাখার দায়িত্ব নিয়ে যে গোয়েন্দা এসেছিল সে তাদের দু’ জনের মেলামেশা ঠিকই টের পেলো এবং সে তাদের গতিবিধির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখতে শুরু করলো।

মিশরের নৌবহর ভুমধ্যসাগরে দূর দুরান্ত পর্যন্ত টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। কারণ ভয় ছিল, ইউরোপ, বিশেষ করে ইংল্যাণ্ড থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই জাহাজ আসতে পারে।

সুলতান আইয়ুবী ক্ষীপ্র গতিতে অভিযান ও খৃষ্টানদের সমস্ত কেল্লা ও ফাঁড়ি দখলের ভয়ে জার্মানির সম্রাট ফ্রেডারিক ইংল্যাণ্ডের সম্রাট রিচারডকে খবর পাঠালেন, ‘আরবরা খৃষ্টান ও ক্রুসেডারদের নিপাত করে চলেছে। বায়তুল মোকাদ্দাস রক্ষা করা দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি জেরুজালেমে দ্রুত সাহায্য পাঠান, নইলে জেরুজালেম আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় আছে’।

তিনি আরো লিখলেন, ‘জেরুজালেম একবার আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেলে তার জন্য আমাদের মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে। আমি আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি, দেরী না করে আপনি জেরুজালেম রক্ষায় এগিয়ে যান।

আমরা যারা ক্রুসেড যুদ্ধের শপথ নিয়েছি তাদের কাছে নিজের দেশ আর অন্য খৃষ্টান দেশে কোন পার্থক্য নেই। জেরুজালেমে আঘাত হানতে এসে আইয়ুবী মূলতঃ আমাদের সবাইকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে’।

সুলতান আইয়ুবীর ধারনা ছিল, বায়তুল মোকাদ্দাসের যুদ্ধ ভুমধ্যসাগরেও চলবে আর সে যুদ্ধ হবে ভয়ংকর। কিন্তু জার্মানি ও ইংল্যাণ্ড থেকে তখনো পর্যন্ত তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

পরাজিত খৃষ্টান নৌবহরের জাহাজগুলো টায়ার বন্দরে নোঙ্গর করা ছিল। তাদের কোন তৎপরতা না দেখে এই নিরবতা ভয়ংকর কোন হামলার আলামত কিনা এই আশংকায় শংকিত হয়ে পড়লেন সুলতান আইয়ুবীর নৌবাহিনীর প্রধান। তিনি শত্রুর এই নিরবতাকে ভয়ের আলামত মনে করে সতর্কতা আরো বৃদ্ধির করার কথা ভাবলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বার্তা পাঠালেন এডমিরালদের কাছে।

বায়তুল মোকাদ্দাস অবরোধের চতুর্থ রাত। এখনো পর্যন্ত যুদ্ধের গতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি, মুহূর্তের জন্য থামেনি কোন পক্ষ। ফলে সাফল্য ও ব্যর্থতা নিরূপণের কোন অবস্থা এখনো সৃষ্টি হয়নি।

খৃষ্টান নাইট ও তাদের সহযোদ্ধারা শহরের বাইরে এসে যেমন বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করছিল তেমনি বীরত্বের সাথেই লড়ছিল আইয়ুবীর জানবাজ বাহিনী।

সুলতান আইয়ুবী যখন দেখলেন চারদিন চলে যাওয়ার পরও খৃষ্টান সৈন্যদের আবেগে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি তখন তার মাথা ঘুরে গেল। যদিও তখনো পর্যন্ত যথেষ্ট সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল তাঁর হাতে তবু খৃষ্টানদের এই জোশ তাকে চিন্তায় ফেলে দিল। বিশেষ করে বিজিত কেল্লা ও শহর থেকে পাওয়া বহু অস্ত্রশস্ত্র জমা পড়েছিল মুসলমানদের হাতে। কিন্তু সৈন্য সংখ্যা কমে যাচ্ছিল দ্রুত।

সুলতান আইয়ুবী তাকিয়ে ছিলেন বাইয়তুল মোকাদ্দাসের প্রাচীরের দিকে। তাঁর মনে হলো সেই বিরাট পাথর প্রাচীর তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে দুর্বোধ্য হাসি হাসছে।

পঞ্চম দিনে সুলতান আইয়ুবী পশ্চিম দিক অর্থাৎ দাউদ গম্বুজের সামনের ক্যাম্পটি উঠিয়ে নিলেন। সেখানকার যুদ্ধ বন্ধ করে তাদের সরিয়ে নিলেন উত্তর দিকে। উত্তর দিকে প্রাচীরের এক জায়গা তাঁর কাছে কিছুটা দুর্বল মনে হলো।

সুলতান আইয়ুবী যখন পশ্চিম দিক থেকে ক্যাম্প উঠিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, তিনি অবরোধ উঠিয়ে নিচ্ছেন। প্রাচীরের উপরে যে সব খৃষ্টান সৈন্য ছিল তারা শহরে প্রচার করে দিল, ‘অবরোধ উঠে যাচ্ছে, মুসলমান সইন্যরান পিছু হটে যাচ্ছে’।

সুলতান আইয়ুবী পশ্চিম দিকের সৈন্য বাহিনী ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। তারা সেখান থেকে সম্পূর্ণ সরে পড়ার আগেই আবারও একটি সন্ধ্যা নেমে এলো। শহরে খৃষ্টান বাসিন্দাদের মধ্যে যেখানে ক্রন্দন ও আহাজারী শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে আবার আনন্দের হিল্লোল এসে গেল।

রাতে সমস্ত খৃষ্টান গির্জায় একত্রিত হয়ে ঈশ্বরের আরাধনায় মেতে উঠলো। খৃষ্টানরা সন্ধ্যা পর্যন্ত অতীতের পাপের জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছিল, কিন্তু দেখা গেল, সন্ধ্যার পর তাদের প্রার্থনার ভাষা বদলে গেছে। তারা এখন শহরের মুসলমানদের নির্মূল করার শক্তি প্রার্থনা করতে লাগলো।

অন্য দিকে এই ঘোষণা শোনার সাথে সাথে মুসলমানরা একদম নিরব ও নিথর হয়ে গেল।

পরের দিন। ১১৮৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। দিনটি ছিল জুম্মা বার। খৃষ্টানরা সারা রাত প্রার্থনা করে সকালে প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে দেখলো, উত্তর দিকে জায়তুন পাহাড়ের উপর সুলতান আইয়ুবীর পতাকা উড়ছে।

তার একটু আগে প্রাচীরের কিছু দূরে মেঞ্জানিক স্থাপন করা হয়েছে। কমবেশি দশ হাজার তীরন্দাজ, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য আক্রমনের জন্য হুকুমের প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথমে ওরা ধারনা করলো, শুক্রবার মুসলমানদের পবিত্র দিন। হয়তো সুলতান আইয়ুবী শুক্রবার দিন জুম্মার খুৎবা দেয়ার জন্য সৈন্য সমাবেশ করেছেন। কিন্তু একটু পরেই তাদের ভুল ভাঙলো।

সুলতান আইয়ুবী সব সময় শুক্রবার (দিন ?) যুদ্ধ শুরু করতেন। সুলতান আইয়ুবী নয়ুন উদ্যমে নতুন পরিকল্পনায় আবার বায়তুল মোকাদ্দাস উদ্ধারের যুদ্ধ শুরু করলেন।

শহরের উপরে নতুন করে শুরু হলো পাথর ও পেট্রোল নিক্ষেপ। আগের চেয়ে এ আক্রমণ ছিল অনেক বেশী তীব্র ও ব্যাপক। শহরে গুজব ছড়িয়ে গেল, সুলতান আইয়ুবীর আরও বহু সৈন্য এসে যুদ্ধে শামিল হয়েছে। এখন শহরের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

শহরে যেন কিয়ামত শুরু হয়ে গেল। লোকেরা ঘরবাড়ী ছেড়ে রাস্তায় হা-হুতাশ ও ছুটাছুটি করতে লাগলো। মুসলমানদের মধ্যে আবার ফিরে এলো উদ্যম। তারা আবার ছাদে উঠে আজান দিতে শুরু করলো।

খৃষ্টানদের করুণ অবস্থা বুঝতে পেরে পাদ্রী ক্রুশ হাতে নেমে এলেন রাস্তায়। তিনি শহরের রাস্তায়, অলিতে গলিতে সেই ক্রুশ দেখিয়ে লোকদের শান্তনা? দিতে লাগলেন। নিরাশ ও ক্রন্দনরত জনগণকে সান্তনা? দেয়ার জন্য তিনি তাদের নিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন।

ক্রুসেড বাহিনী শেষবারের মত সুলতান আইয়ুবীর মেঞ্জানিকের উপর আক্রমণ চালালো। সুলতান আইয়ুবী এখন যুদ্ধের পরিচালনা নিজ দায়িত্বে নিয়েছিলেন। তাঁর দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী দল ক্ষীপ্রগতিতে তিন দিক থেকে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এই বাহিনী নিমেষে সামনে যাকে পেলো তাকেই পিষে মারলো।

ক্রুসেড বাহিনী আর সামনে অগ্রসর হটে পারলো না। হামলা করার পরিবর্তে এবার তারা প্রতিরোধ করতে শুরু করলো। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী সমস্ত শক্তি এক করে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন এবার। স্রোতের মত সুলতানের বাহিনী এগিয়ে প্রাচীর ও ফটকের দিকে।

দুই বাহিনী মুখোমুখি থাকায় তীরন্দাজ বাহিনী তীর ছুড়তে পারছিল না। ফলে লড়াই হচ্ছিল মূলতঃ অশ্বারোহী বাহিনীর মধ্যে।

মুসলমানরা এই প্রথম বড় ধরনের হামলা করলো। এই হামলায় নিহত হলো ক্রুসেড বাহিনীর অনেক সদস্য এবং নাইটরা। লাশের স্তূপ রেখে পিছু হটলো খৃষ্টান বাহিনী। সুলতানের অশ্বারোহী দলও ফিরে এলো তীরন্দাজদের আওতার বাইরে। এরপর ক্রুসেড বাহিনী আরও দু’বার বাইরে এসে আক্রমণ চালালো মুজাহিদদের ওপর। কিন্তু মুসলমানদের জানবাজ অশ্বারোহী বাহিনী তাদের গেটের বাইরে বেশী দূর অগ্রসর হটে দিল না।

সুলতান আইয়ুবী এবার তাঁর প্রাচীর ভাঙ্গার একদল জানবাজকে হুকুম দিলেন উত্তরের অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রাচীরের পাশে ছুটে যেতে। তারা প্রত্যেকে হাতে লোহার ঢাল নিয়ে ছুটলো প্রাচীরের দিকে।

তাদের আপাদমস্তক তারা ঢাল দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল। প্রাচীর থেকে তীর বর্ষণের ভয় ছিল বলে সুলতান আইয়ুবী তাঁর তীরন্দাজ বাহিনীকে আগেই মুষলধারে তীর বর্ষণ করার জন্য হুকুম দিয়েছিলেন। ফলে ব্যাপক তীর বর্ষণের কারণে খৃষ্টান তীরন্দাজরা পিছু হটে গিয়েছিল।

এই সুযোগে প্রাচীর ভাঙ্গা বাহিনী ছুটে গিয়ে প্রাচীরের কাছে আশ্রয় নিল এবং নিজেদেরকে প্রাচীরের সাথে লাগিয়ে রাখলো। ক্রুসেড তীরন্দাজদের নিচে তাকানোর কোন সুযোগ ছিল না। সুলতানের তীরন্দাজ বাহিনীর তীব্র বর্ষণ তেমনি অব্যাহত ও তীব্র রইলো। এই সুযোগে দেয়াল ভাঙ্গার কাজে লেগে গেল সেখানকার সৈন্যরা। এই জায়গাটা ছিল শহরের পেছন দিক। এখানে একটা ছোট দরজা ছিল খিড়কি দরজার মত। দরজার উপরে ছিল শক্ত প্রাচীর।

সুলতানের বাহিনী সহজেই প্রথম দরজাটা ভেঙ্গে ফেললো। কিন্তু দেখা গেল দরজার পেছন দেয়ালে আরো একটা শক্ত দরজা। সেই দরজার পেছনে আবার নিরেট দেয়াল।

ওরা প্রথম দরজা ভেঙ্গে দ্বিতীয় দরজাও ভেঙ্গে ফেললো। দেখা গেল দরজার পাশ দিয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই ওরা দেখতে পেলো তারা একটি রুমে এসে পড়েছে। কিন্তু এই রুম থেকে শহরে ঢুকার কোন দরজা তারা খুঁজে পেলো না। এমনকি প্রাচীরের ওপর উঠে যাওয়ারও কোন সুরং পথ বের করতে পারলো না তারা। কিন্তু প্রাচীরের গায়ে কামরা থাকায় এ অংশটা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। ওরা কামরা থেকে বেরিয়ে এসে কামরার অংশতি চিহ্নিত করে দাগ দিল। তারপর একজন ছুটে গিয়ে এই খবর জানালো সুলতানকে।

সুলতান দেখলেন দাগ দেয়া অংশটি। বুঝলেন এটি একটি সেন্ট্রিবক্স। পেছন দিকে নজর রাখার জন্য এ বক্সটি তৈরি করা হয়েছে। নিশ্চয়ই শহর থেকে এ বক্সে আসার জন্য কোন সুরং আছে। হয়তো মেঝেতে পাথর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সেই সুরং মুখ। আবার এমনও হতে পারে, দেয়ালের কোন অংশে সেই সুরং মুখটি আছে।

যাই হোক, সুলতান এ নিয়ে গবেষণা না করে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গির আমলে তৈরি ভারী ও মজবুত মেঞ্জানিক দিয়ে সেই দাগ দেয়া অংশে ভারী ভারী পাথর নিক্ষেপ শুরু করলেন।

দেয়াল খুবই মোটা ও পুরু ছিল। কিন্তু অনবরত বিরাট বিরাট পাথর নিক্ষেপের ফলে দেয়াল ভেঙ্গে পড়তে শুরু করলো। কামরার বাইরের দিকের অংশ ভেঙ্গে গিয়ে ভেতরের দেয়ালে সৃষ্টি হলো ফাটল। পাথর নিক্ষেপের বিকট শব্দে শহরবাসীর রক্ত শুকিয়ে হিম হয়ে যাচ্ছিল।

দিনের বেলা প্রাচীরের দাগ দেয়া অংশের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল প্রাচীর ভাঙ্গার দলটি। দিনভর পাথর নিক্ষেপের ফলে সেখানে পাথরের স্তূপ জমে গিয়েছিল। দেয়ালেও ফাটল ধরে ছিল।

রাত নেমে এলো। সুলতান মেঞ্জানিক নিক্ষেপ বন্ধ করে ওদের ইশারা করলেন কাজ শুরু করতে। তারা বিরাট বিরাট পাথর সরিয়ে পৌঁছে গেল দেয়ালের ফাটলের কাছে।

মাথার ওপরে ঢালের মত ঝুঁকে ছিল কামরার ছাদ। ফলে উপরের তীরন্দাজদের তীর নিক্ষেপের ভয় আর রইলো না তাদের। তারা নিশ্চিন্ত মনে দেয়ালের গায়ে সুরং খোদাই করতে শুরু করলো।

উপর থেকে কোন তীর তাদের আঘাত করতে পারবে না জানার ফলে কাজ এগুলো খুব দ্রুত। রাতের মধ্যেই কয়েকশো জানবাজ মুজাহিদ ত্রিশ গজের মত লম্বা সুরং করে ফেললো সেখানে। তাদের মাথার ওপর ছিল দালান ঘরের ছাদ ও কাঠের বিম।

রাত ভোর হওয়ার আগেই সুলতান খবর নিলেন কাজ কত দূর এগিয়েছে। তিনি যখন জানতে পারলেন ত্রিশ গজের মত বিশাল একটি সুরং সেখানে তৈরি করতে পেরেছে মুজাহিদরা তখন তিনি তাদের সেখান থেকে সরে আসার হুকুম দিলেন। এবার ওখানে অভিযানের দায়িত্ব নিল একদল কমাণ্ডো।

সুলতান আইয়ুবী তাদের বুঝিয়ে দিলেন কি করতে হবে। কমাণ্ডো বাহিনী এগিয়ে গেলো সুরঙ্গের কাছে। তারা সুরঙ্গের মধ্যে শুকনো ঘাস ও খড়ি এনে জড়ো করলো। তারপর তাতে ছিটিয়ে দিল পেট্রোল। শেষ মাথায় ভরে দিল একগাদা বিস্ফোরক।

তারপর সেখান থেকে সমস্ত জানবাজ দ্রুত সরে আসার আগে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। একটু পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বসে গেল সমস্ত দালান ও প্রাচীর। দালান ও প্রাচীর ভাঙলো ঠিকই কিন্তু ভাঙা টুকরোগুলো উপরে উঠে আবার যখন নিচে নেমে এলো তখন সেখানে পাথরের বিশাল স্তূপ জমে গেল।

এই স্তূপীকৃত ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে শহরে প্রবেশ করা আগের মতই কঠিন হয়ে রইলো। সঙ্গে সঙ্গে সুলতানের নির্দেশে শুরু হয়ে গেল ধ্বংসাবশেষ সরানোর কাজ।

জেরুজালেম শহরের মানুষ আরো একটি দুর্লভ সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পেলো। রাতেই তারা ধরে নিয়েছিল আগামীকালের সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আর তাদের হবে না। বিশেষ করে ভোর রাতের বিকট শব্দ তাদের বলছিল, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের স্বর্গে পাড়ি জমাতে হবে। এমন শব্দ শোনার জন্যও আর তাদের জায়গা হবে না এ পৃথিবীতে।

এই বিস্ফোরণের পর গির্জার ঘণ্টাধ্বনি শব্দ আরও তীব্রতর হয়ে উঠলো। জোরালো কণ্ঠের আজানের শব্দও ভেসে আসতে লাগলো অনবরত।

ক্রুসেড বাহিনীর জেনারেল ও সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে গেল। জেনারেলরা এক জরুরী বৈঠকে বসলো। সেখানে জেনারেলরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বললো, ‘শহরে যত সৈন্য ও খৃষ্টান আছে সবাইকে নিয়ে এক সাথে বাইরে গিয়ে হামলা করা উচিত আমাদের’।

জেনারেল হারকিউলিস এ মত সমর্থন না করে বললো, ‘এখন পরাজয়ের মুখে শহরে শুধু নারী বা শিশুদের রেখে গেলে তারা মুসলমান বাহিনীর প্রতিহিংসার শিকার হবে’।

অন্য একজন বললো, ‘যুদ্ধের যা অবস্থা তাতে সুলতানের সাথে আমাদের আপোষ রফা করা উচিত’।

ব্যাপক আলোচনার পর ক্রুসেড জেনারেল ও সেনাপতিরা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, ‘সুলতান আইয়ুবীর সাথে শান্তির জন্য আপোষ প্রস্তাব দেয়া হবে’।এই আপোষ প্রস্তাব দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হলো প্রখ্যাত খৃষ্টান নেতা সরদার বালিয়ানের উপর।

সূর্যের উত্তাপ তখনো প্রখর হয়নি। বাইরে থেকে সুলতান আইয়ুবী লক্ষ্য করলেন, তারা যে স্থানটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন তার ওপাশে একটি সাদা নিশান উড়ছে।

তিনি তার বাহিনীকে যুদ্ধ বন্ধ করার হুকুম দিলেন। তীরন্দাজরা তীর চালনা থামিয়ে দিল। বন্ধ হয়ে গেল মেঞ্জানিকের বোমা বর্ষণ।

একটু পর। সুলতান আইয়ুবী দেখলেন শহরের ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসছে চার ব্যক্তি। তাদের হাতে সাদা পতাকা। তারা মুসলিম বাহিনীর কাছে এসে বললো, ‘আমরা সুলতান আইয়ুবীর কাছে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছি’।

সুলতান আইয়ুবী তার প্রহরীদের বললেন, ‘ওদের স্বসম্মানে আমার এখানে নিয়ে এসো’।