» » রিচার্ডের নৌবহর

বর্ণাকার
🕮

‘কিন্তু সেও তো আমার কাছে আসেনি?’

‘আল ফারেসের ভয়ে সে আপনার কাছে যায়নি, যদি আল ফারেস অসন্তুষ্ট হয়?’ রউফের বুকের ভেতর শুরু হলো অদ্ভুত এক ভুকম্পন। তার জীবনে এ রকম ঘটনা আর ঘটেনি। কোন মেয়ে তাকে সপ্নপুরুষ ভাবে মনে হতেই এক অদ্ভুত তৃপ্তিবোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার হৃদয়। পুরুষের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্বলতায় আচ্ছন্ন হয়ে অন্তর থেকে তখনই সে আত্মসমর্পণ করলো ফ্লোরীর প্রেমে।

সে জীবনে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে কিন্তু হৃদয় ব্যাকুল করা আকর্ষণ আর কারো মধ্যে খুঁজে পায়নি। সে যখন জানতে পারলো, এই দুই রুপসীর একজন তাকে ভালবাসে তখন তার আবেগের নদীতে বান ডাকলো।

সেই বানের তোড়ে সে ভেসে চললো সেই পথে, প্রেমে পড়লে মানুষ যে পথে ভেসে যায়। এ এমন এক পথ, যে পথে ভেসে যাওয়া যায়, কিন্তু সেই স্রোতে পড়ে গেলে সেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না।

রোজী তাকে তার যাদুর পরশে জ্ঞানশুন্য করে দিয়ে চলে গেল। সে নিজের ক্যাবিনে ফিরে যেতে গিয়ে সিঁড়িতে পা দিয়ে তাকালো পিছন দিকে, দেখলো, রউফ কুর্দি ধীরে ধীরে ফ্লোরীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

‘আজ রাতে ঘুমাবে না জোশী?’ রউফ ফ্লোরীর নাম জোশী বললো, কারণ এ নামেই আল ফারেস তাকে ডাকতো। রোজী এ নামেই আল ফারেসের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আর নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘আমার নাম মীরা’। রোজীর ধারনা ছিল, আরব বেদুইন মেয়েদের এ ধরনের নামই পছন্দ হবে মুসলিম সৈনিকদের।

রউফ কুর্দি তার পাশে এসে দাঁড়াতেই ট্রেনিং অনুসারে সে এমন ভঙ্গিতে লজ্জার ভান নিয়ে হাসলো যে, এমন লজ্জা কোন কুমারী বা নববধুও পায় না। সে একেবারে জড়সড় হয়ে কার্নিশের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে রইলো। রউফ বললো, ‘কি ব্যাপার! আমি এখানে আসায় তুমি খুশী হওনি?’

মেয়েটি এ কথার কোন জবাব না দিয়ে আরো জড়সড় হয়ে গেল। রউফ তাকে আশ্বস্ত করার জন্য তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বললো, ‘মীরা তোমার সম্পর্কে আমাকে কিছু কথা বলেছে। তার এ সব কথা কি সত্যি?’

ফ্লোরী তার দিকে পলকের জন্য তাকালো। ঠোঁটে ক্ষীণ চাঁদের বাঁকা হাসি। মুহূর্তেই লজ্জায় আরক্ত হয়ে মাথা নত করে সমুদ্রের অথৈ পানির দিকে তাকিয়ে রইলো।

রউফ কুর্দি নিচু স্বরে বললো, ‘কথা বলো। সত্যি করে বলো, মীরা যা বলেছে তা কি সত্যি?’

ফ্লোরী এবারও কোন কথা বললো না। রউফের এক হাত আলতো করে স্পর্শ করে ছিল ফ্লোরীর কাঁধ, অন্য হাতটি ছিল জাহাজের কার্নিশে। ফ্লোরী তার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে নিজের কোমল হাত দিয়ে সেই হাত স্পর্শ করলো এবং নিজের আঙ্গুলগুলো রউফের আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। এটুকু স্পর্শেই রউফের জবান বন্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তে সে একজন সৈনিক থেকে বনে গেল এক মুগ্ধ প্রেমিকে। এখন সে আর আইয়ুবীর সৈনিক নেই, ফ্লোরীর প্রেম ভিখারী এক তৃষ্ণার্ত প্রেমিকে রূপান্তরিত হয়ে গেল।

একটু পর। জাহাজের ছাদে এসে পড়ছিল অবারিত চাঁদের আলো। সমুদ্রের পানিতে খেলা করছিল রুপালী জ্যোৎস্না। ফ্লোরী ও রউফ পাশাপাশি বসেছিল ছাদের ওপর। তাদের একজনের হাতের ওপর অন্য জনের হাত। কখনো নিচু স্বরে ওরা কথা বলছিল। কখনো নিস্তব্ধতার সমুদ্রে ডুবে গিয়ে কথা বলছিল পরস্পরের হৃদয়ের সাথে।

জাহাজ নোঙ্গর করা ছিল তীর থেকে যথেষ্ট দূরে। কয়েকটি সার্চলাইটের আলো সমুদ্রের পানিতে ঘুরাফেরা করছিল। এ আলোগুলো আল ফারেসেরই বহরের বিভিন্ন জাহাজের ছিল। আলোগুলো টহল দিচ্ছিল সমুদ্রের ঘোলা জলে।

মাঝ রাত পেরিয়ে গেল। রউফ কুর্দি ফ্লোরীকে বললো, ‘তুমি আমার ক্যাবিনে চলে যাও। আমি পরে আসছি’। ফ্লোরী চলে গেল। জাহাজের ছাদে যখন ফজরের আযান হলো তখন ফ্লোরী রউফের ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ক্যাবিনে চলে গেলো।

রাতে সে আল ফারেসের সহযোগী রউফকে বলেছে, ‘আমি তোমাকে মনে প্রানে ভালবেসে ফেলেছি। আল ফারেস মীরাকে ভালবাসে। আমি কখনও আল ফারেসকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করতে পারবো না। আমি কারো দ্বিতীয় স্ত্রী হতে চাই না’।

সে রউফ কুর্দিকে আরও বললো, ‘আল ফারেসই তোমার প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি একদিন আমাকে বললেন, ‘রউফ কুর্দির সাথে কোন কথা বলবে না, লোকটা ভীষণ খারাপ’।

এ কথা শোনার পর তোমার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। কারণ আমি ভেবে দেখলাম, আসলে তিনি নিজেই খুব খারাপ লোক। তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়ে আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন আর এক সাথে আমাদের দু’জনকে ভোগ করতে চাচ্ছেন। কেন, মীরাকে ভাল লাগলে তাকে তুই বিয়ে কর। এক সাথে দুইজনকে বিয়ে করার লোভ কেন? মেয়ে মানুষ দেখলেই তার দিকে হাত বাড়াতে হবে? আমি ওকে বলেছি, দু’জনকে তুমি এক সাথে পেতে পারো না। আগে ঠিক করো কাকে গ্রহন করবে’। তাতেই সে আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।

যদি আমরা অসহায় না হতাম তবে সে আমদের কাছে এত বেশী মূল্য চাইতে পারতো না। তুমিই বলো, যেখানে প্রেম ভালবাসা নেই সেখানে শরীরের কি দাম? আমরা কি তার হাতের খেলনা পুতুল?

রউফ কুর্দির মনে ভালবাসার ছলনা ও আল ফারেসের সাথে শত্রুতা সৃষ্টি করে তার ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে এলো ফ্লোরী। আল ফারেসের কাছ থেকে যে সব গোপন তথ্য এতদিন সংগ্রহ করতে পারেনি, সে সব তথ্য রউফ কুর্দির নিকট থেকে সহজেই পেয়ে গেল সে।

সে রাতে সুলতান আইয়ুবী মোটেও ঘুমাতে পারেননি। সমস্ত রাত তাঁর আলোচনা সভাতেই কেটে গেল। এবার তিনি আর এমন কোন বিপদের ঝুঁকি নিতে চান না, যাতে বায়তুল মোকাদ্দাসের অবরোধ ও অভিযান ব্যর্থ হতে পারে। তিনি সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযানের সুবিধাজনক রাস্তার নকশা দেখিয়ে দিলেন। কোথায় কোথায় খৃষ্টানদের সৈন্য ফাঁড়ি(Out Post) আছে সেগুলো চিহ্নিত করে জানিয়ে দিলেন তাদের।

যেখানে খৃষ্টানদের শক্ত কেল্লা ও ঘাঁটি আছে সে সব জায়গা দেখিয়ে সুলতান আইয়ুবী সকলকে বললেন, ‘এগুলো আক্রমনের প্রয়োজন নেই, কারণ এগুলোর পিছনে শক্তি ক্ষয় করে দুর্বল হতে চাই না’।

তিনি বললেন, ‘এ সব ঘাঁটি খুব উঁচু স্থানে। আমরা এগুলো পাশ কাটিয়ে দূর দিয়ে এগিয়ে যাবো। ওখানে যে সব সৈন্য আছে তারা শান্তিতে বসে থাক। তারা দেখলেও অল্প সৈন্য নিয়ে আমাদের পথে বাঁধা দিতে আসবে না’।

‘কিন্তু দূর থেকে দেখে তাদের সংবাদ দাতারা বায়তুল মোকাদ্দাস গিয়ে সংবাদ পৌঁছাবে’। এক সেনাপতি বললো, ‘তবে তো আমরা বায়তুল মোকাদ্দাসে গোপনে অতর্কিতে আক্রমণ চালাতে পারবো না’।

‘গোপনে যাওয়ার আশা অন্তর থেকে দূর করে দাও’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘খৃষ্টান বাহিনী ভাল করেই জানে, আমরা বায়তুল মোকাদ্দাস যাচ্ছি’।

তাদের যুদ্ধের গতিই বলে দিচ্ছে, এবার তারা বাইরের ময়দানে এসে যুদ্ধ করবে না। শহরে তাদের যে সৈন্য আছে তারা শহর রক্ষার কাজে নিয়োজিত। বাইরে এসে যুদ্ধ করার অভ্যাস তাদের নেই। এমন ঝুঁকি নিতেও তারা প্রস্তুত নয়।

সেখান থেকে আমাদের গোয়েন্দারা সংবাদ এনেছে, সেখানে সৈন্য বাহিনী প্রতিরক্ষার কৌশল আয়ত্ব করছে। তারা সেই ট্রেনিং নিয়েই ব্যস্ত। আরো খবর এসেছে, আমরা যে সকল স্থান দখল করেছি সেখানকার কিছু পলাতক সৈন্য গিয়ে সেখানে সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়েছে। তাদের মধ্যে লৌহ পোশাকধারী কিছু নাইটও আছে। আমাদের গোয়েন্দারা আরো জানিয়েছে, অবরোধ কালে এসব নাইটরা বাইরে এসে যুদ্ধ করবে।

তারা এরই মধ্যে শহরের বাইরে এসে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। তারা ‘আঘাত করো ও পিছু হটো’ এ নীতিতে আমাদের ওপর আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যুদ্ধের এ কৌশল তারা আমাদের কাছ থেকেই শিখেছে।

সুতরাং একথা মনে করার কোন অবকাশ নেই যে, শত্রুর উপর আমরা অজান্তে আক্রমণ করতে পারবো। শত্রুরা আমাদের অপেক্ষায় প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমিও কিছু ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছি।

খৃষ্টানদের কোন ফাঁড়ি থেকেই কোন লোক সংবাদ নিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাস যেতে পারবে না। তাদের সকল ফাঁড়ি থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস যাওয়ার প্রতিটি পথে আমাদের সতর্ক কমাণ্ডো বাহিনী ওঁৎ পেতে বসে আছে।

তারা চারদিকে সতর্ক নজর রাখছে। তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে কোন সংবাদই বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছতে পারবে না বলে আশা রাখি। কমাণ্ডোরা এ ধরনের সংবাদ বাহকদের কাউকেই জীবিত রাখবে না’।

‘শত্রু সেনাদের সংখ্যা সম্পর্কে গোয়েন্দাদের রিপোর্ট কি?’ এক সেনাপতি জানতে চাইলো।

‘শত্রু সেনাদের সংখ্যা সম্পর্কে গোয়েন্দারা বিভিন্ন সংবাদ এনেছে। তাদের রিপোর্ট থেকে আমি যেটুকু অনুমান করতে পারি তা হলো, বায়তুল মোকাদ্দাসের মধ্যে হিসাব মতে তাদের সৈন্য সংখ্যা ষাট হাজারের কিছু বেশী হবে।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, সেখানকার মুসলমানরা এখন বন্দী বা নজরবন্দী অবস্থায় আছে। তারা ভেতর থেকে আমাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না। অন্যদিকে খৃষ্টান নাগরিকরা তাদের সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে। তারা এটাকে ধর্মযুদ্ধ মনে করে। ফলে তারা এই অবরোধ ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করবে।

আমি আরো খবর পেয়েছি, খৃষ্টানরা তাদের নারী এবং শিশুদেরও যুদ্ধের ট্রেনিং দিচ্ছে। শহরের প্রাচীরের ওপর থেকে তারা মুষলধারে তীর বর্ষণ করবে। আমি আরো খবর পেয়েছি, খৃষ্টানরা তীর বর্ষণের জন্য দক্ষ এক কমাণ্ড গঠন করেছে। তারা নতুন এক ধরনের তীরও আবিষ্কার করেছে, যে তীর অনেক দূরে চলে যায় এবং সঠিকভাবে লক্ষ্য ভেদ করে’।

তিনি অবরোধের কর্মকৌশল ও পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর বললেন, ‘এটাই আমাদের শেষ অধিবেশন। যদি কারো কিছু বুঝতে বাকি থাকে এখনই বুঝে নাও। মনের ভেতর কেউ কোন প্রশ্ন জমা করে রাখবে না। আর প্রশ্ন যত তুচ্ছই হোক তাকে কখনোই তুচ্ছ মনে করবে না’।

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সুলতান আইয়ুবী এ সম্মেলন রাসুলুল্লাহ(সাঃ)-এঁর এই হাদিসটি বর্ণনা করে শেষ করেন, ‘যাদের জন্য সফলতার দুয়ার খুলে যায় তাদের জলদি সেখানে প্রবেশ করা উচিত। কেউ জানে না, সে দরোজা কখন বন্ধ হয়ে যাবে’।

সুলতান আইয়ুবী অতি দ্রুত খৃষ্টান অধিকৃত অঞ্চল ও কেল্লাগুলোতে তাঁর দখল প্রতিষ্ঠা করে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু তাই বলে এ কথা বলার উপায় নেই যে, বায়তুল মোকাদ্দাস আক্রমনের দুর্বল পরিকল্পনা নিয়ে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন। দুরন্ত বেগে আক্রমণ করা আর আক্রমনের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করা এক কথা নয়। তিনি এগুচ্ছিলেন পরিকল্পিতভাবে কিন্তু দুর্বার বেগে। তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ্‌ আমাদের জন্য সফলতার দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। বন্ধ হওয়ার আগেই সেখানে প্রবেশ করতে হবে’।

‘হে আমার বন্ধুগন’। তিনি নকশাটি সরিয়ে রেখে বললেন, ‘হাতিনের যুদ্ধের আগে আমি তোমাদের বেশ কিছু উপদেশ ও নির্দেশ দিয়েছিলাম। তাঁর কিছু কথা আবার বলা দরকার। কারণ এর পরে আমি হয়তো আর কথা বলার সুযোগ পাবো না। কেউ বলতে পারে না, আমরা আবার সকলকে ও একে অপরকে জীবিত দেখতে পাবো কিনা।

এর আগে আমরা অনেক যুদ্ধ করেছি। গৃহযুদ্ধে একে অপরের রক্ত প্রবাহিত করেছি। আর এই করতে গিয়ে শ্ত্রুদের আমরা অনেক সময় ও সুযোগ দিয়েছি। এরই ফলে তারা মুসলমান এলাকায়ও তাদের ঘাঁটি করার সুযোগ পেয়েছে। সেই কেল্লা মজবুত করারও সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগে তারা বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রতিরোধ শক্তি আরও মজবুত করে নিয়েছে। তবুও আমরা শেষ মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য জীবন মরণ যুদ্ধ চালাতে এসেছি।

তোমরা জানো, ইহুদী ও খৃষ্টান মেয়েদের অভিনয় ও প্রেমের ছলনায় আমাদের অনেক দক্ষ সেনানায়ক ও কমাণ্ডার ধরাশায়ী হয়েছে। তাদের চক্রান্তের জালে আটকা পরে ধ্বংস হয়ে গেছে আমাদের শাসকদের এক বিরাট অংশ। তাই অস্ত্রের লড়াইয়ের চাইতে সাংস্কৃতিক লড়াইকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই আমাদের।

আলী বিন সুফিয়ান, গিয়াস বিলকিস ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা অসংখ্য ধ্বংসাত্বক যুদ্ধে নিজেদের প্রাণের নজরানা দিয়ে বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তাদের দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা, সৃজনশীলতা, আপোষহীনতা, দেশপ্রেম ও ঈমানের মজবুতি সবই আমাদের জন্য অনুপ্রেরনার উৎস। তারা আমাদের জন্য রনাঙ্গনের পথ সহজ করে দিয়েছে। তারা সময় মতো আমাদের চোখ কান খুলে দিয়ে আমাদের রক্ষা করেছে বিপর্যয়ের গর্ত থেকে। তারা আমাদের মধ্যে যে উইপোকা আছে তাদের সনাক্ত করে দিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য যাচাই বাছাই করে আমার অনেক যোগ্য শাসক, দক্ষ সেনাপতি, অভিজ্ঞ অফিসার, সাহসী কমাণ্ডারকে গাদ্দারীর জন্য চরম শাস্তি দিতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের মাঝে বিদ্রোহ হয়েছে, আমরা সে বিদ্রোহ নির্মম হস্তে দমন করেছি।

বন্ধুরা, অস্ত্র নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। আগে জানতে হবে শত্রুর উদ্দেশ্য কি? জানতে হবে কোন পথে কিভাবে তারা আমাদের ঈমান ও আকীদার ওপর হামলা চালাচ্ছে। তারপর বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সাথে তাঁর মোকাবেলা করতে হবে।

একেই বলে জিহাদ। আর এই জিহাদ প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ। আমাদের জিহাদ চলবে রাজনৈতিক ময়দানে। জিহাদ চলবে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ময়দানে। তাদের কূটনৈতিক তৎপরতার মোকাবেলা করতে হবে পরিচ্ছন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে। সময়ের গতি ধারায় তারা নিত্য নতুন যত সেক্টর খুলবে প্রতিটি সেক্টরেই লড়াইয়ে নামতে হবে আমাদের। এটাই একজন মুজাহিদের কাছে আজকের সময়ের দাবী।

তারা নিত্য নতুন ইজম বা মতবাদ দিয়ে আমাদের বিশ্বাসে ফাটল ও ভাঙ্গন ধরাতে চাইবে। আমাদের আগামী দিনের নাগরিকদের বিলাসপ্রিয় ও আরামে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য তারা জঘন্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে’।

তিনি বললেন, শত্রুরা অতীতের মত ভবিষ্যতেও আমাদের ঈমান ক্রয়ের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাবে। আমাদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি করবে বেঈমান ও গাদ্দারের বাহিনী।

এই গাদ্দারদের সহযোগিতার ফলেই তারা এতদিন ধরে আমাদের প্রথম কেবলার উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। বেঈমান ও দালালদের সহযোগিতায় তারা মক্কা মুয়াজ্জামা এবং মদীনা মনোয়ারাও দখল করার চেষ্টা করেছে। অতএব যতটুকু সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে শত্রুদের দিকে ততটুকু দৃষ্টি রাখতে হবে নিজেদের দিকেও। কিছুতেই গাদ্দার সৃষ্টির বীজ বুনতে দেয়া যাবে না দুশমনকে।

আমি আশা করি, তোমরা এখনও ভুলে যাওনি, পাঁচ বছর আগে যখন আমি উত্তরাঞ্চলে শত্রুদের সাথে যুদ্ধে আটকে ছিলাম, তখন ত্রিপোলীর সম্রাট রিনাল্ট ও আক্রার সম্রাট আরনাত মদীনা মনোয়ারা থেকে মাত্র চার মাইল দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সে সময় আমার ভাই তকিউদ্দদিন ও এডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলু যে সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছে সে জন্য তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ক্রুসেড বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আমি সম্রাট আরনাতকে নিজ হাতে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নিয়েছি।

শত্রুদের উদ্দেশ্য, আমাদেরকে ধর্মের উৎস মূল থেকে দূরে রাখা এবং খৃষ্টান ধর্মের উৎস গ্রহনে আমাদের বাধ্য করা। অতএব আমাদের উদ্দেশ্য হবে নিজের ধর্ম আঁকড়ে ধরে শত্রুর লক্ষ্য ও পরিকল্পনাকে সমূলে ধ্বংস করা। সুতরাং এ যুদ্ধ কেবল জেরুজালেম জয়ের যুদ্ধ নয়, এ যুদ্ধ আদর্শের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আমাদের বিশ্বাস ও চেতনা সংরক্ষনের যুদ্ধ। আমাদের ধর্ম তলোয়ারের জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, প্রেম ও মানবিকতার আকর্ষণেই অধিকার বঞ্চিত, মানবতা বঞ্চিত মানুষ এ ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু মানুষের ওপর প্রভুত্বকামী লোকেরা এটা মেনে নিতে পারেনি। তারা গরীবের আশ্রয়, নিরন্নের আশ্রয়, সভ্যতার আশ্রয় এই ধর্মকে দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য বার বার অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এর অনুসারীদের ওপর। ফলে সভ্যতা ও মানবতা রক্ষার স্বার্থে বার বার এ ধর্মের অনুসারীদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছে। তাই আমি মনে করি, ধর্মকে রক্ষা করার জন্য আজো আমাদের তলোয়ারের শক্তির প্রয়োজন আছে। কিন্তু এ তলোয়ার ব্যবহৃত হবে কেবলমাত্র পশুশক্তির বিরুদ্ধে। যেখানে মানবতা লাঞ্চিত হবে সেখানেই গর্জে উঠবে মুজাহিদের তলোয়ার।

জাতি শুধু সৈন্যদের হাতেই তলোয়ার দিয়ে রেখেছে। অতএব এ জাতির নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদেরই বহন করতে হবে। জাতির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে করুণ নয়নে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ওরা আর কিইবা করতে পারে। তাই জাতির দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে।

আল্লাহ্‌ রাব্বুল ইজ্জতও তাঁর মহব্বতের দৃষ্টি এ জাতির মুজাহিদদের প্রতিই নিবদ্ধ রেখেছেন। আল্লাহ্‌র প্রিয় হাবীবের পবিত্র আত্মাও তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এখন চিন্তা করো, আমদের দায়িত্ব ও জিম্মাদারী কত বড়, কত পবিত্র ও কত মহান।

আমরা আল্লাহ্‌র সৈনিক। আল্লাহ্‌র সৈন্যরা কখনো শাসন ক্ষমতা ও গদীতে বসে থাকে না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহ্‌র এ দুনিয়ায় আল্লাহ্‌র শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং তা অটুট রাখার জন্য বদ্ধপরিকর থাকা’।

সুলতান আইয়ুবী সামান্য বিরতি দিলেন। তারপর তিনি আবার বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। ‘হায় আমার বন্ধুরা! ষোল হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের কথা তোমরা স্মরণ করো। যখন উমর বিন আস(রাঃ) ও তাঁর সাথী সেনাপতিরা বায়তুল মোকাদ্দাস কাফেরদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন।

আমিরুল মোমেনীন হযরত উমর(রাঃ) তখন মুসলিম জাহানের খলিফা। এই খোশখবর পেয়ে তিনি নিজে বায়তুল মোকাদ্দাস ছুটে গেলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু হযরত বেলাল(রাঃ)। তিনি মসজিদুল আকসায় সকল মুসলমানদের নিয়ে নামাজ পড়লেন। সেখানে দীর্ঘদিন হযরত বেলালই(রাঃ) আজান দিয়েছিলেন।

হযরত বেলাল(রাঃ) রাসুলুল্লাহর(সাঃ) ওফাতের পর এমন নিরব হয়ে গেলেন যে লোকে তাঁর সুর ভুলতে বসেছিল। কারণ তিনি আজান দেয়া একরকম বাদই দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মসজিদুল আকসায় এসে যখন হযরত উমার(রাঃ) তাঁকে বললেন, ‘বেলাল! মসজিদুল আকসা, এর দরজা জানালা ও বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রাচীর দীর্ঘকাল ধরে কোন আজান শোনেনি। মুক্ত বায়তুল মোকাদ্দাসে কি তুমি আযান দেবে না?’

হুজুর(সাঃ)-এর ওফাতের পর হযরত বেলাল(রাঃ)সেই প্রথম আজান দিলেন। যখন তিনি করুণ কান্নার সুরে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ বললেন, তখন উপস্থিত সকলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

হে আমার প্রিয় বন্ধুগণ! আমরা এই যুগেও মসজিদুল আকসায় সেই আজানের সুর আবার উচ্চকিত করতে চাই। নব্বই বছরের মত সময় ধরে এই মসজিদ আজানের প্রতিক্ষায় কোন মুয়াজ্জিনের পথ পানে চেয়ে আছে। তোমরা মনে রেখো, মসজিদুল আকসার আজান বিশ্বের সমস্ত প্রান্তরে আবার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলবে।

খৃষ্টানরা এ মসজিদের আজান গলা টিপে বন্ধ করে রেখেছে। এই পবিত্র লক্ষ্যকে সামনে রাখো। আমরা কোন সাধারন যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না, আমরা আমাদের রক্ত দিয়ে ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। যে ইতিহাস হযরত উমর(রাঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ লিখে গিয়েছেন।

তাদের পরে অবসাদগ্রস্ত মুসলমানরা সে উজ্জ্বল অধ্যায়ে কালি লেপন করেছে। তোমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়াও। তোমরা যদি সেই কলংকের কালিমা মুছতে চাও, আমি বিশ্বাস করি, মহান আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে তাঁর নুরানী আলো দান করবেন। পৃথিবী আবার উজ্জ্বল আলোর রৌশনীতে ভরে যাবে।

তোমরা এই আশা নিয়ে লড়াই করবে, তোমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তোমাদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞ চিত্তে তোমাদের জন্য দোয়া করে। মরহুম সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি বিশ বছর আগে তৈরি করা সুন্দর মিম্বার তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসের মেহরাবে রাখতে চেয়েছিলেন, এখন সে দায়িত্ব তোমাদের উপরে অর্পিত’। 43p

তিনি সেই মিম্বরটি সকলকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই মিম্বারটি জঙ্গি মরহুমের বিধবা স্ত্রী ও তাঁর কন্যা আমার কাছে এসে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমরা আমাদের এক মেয়ের দেয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেন লজ্জার শিকার না হই।

আমাদের এই মেয়ে জাতির আরো দুইশ মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসেছে। যদি তোমরা যুদ্ধের ময়দানে পানির পিপাসায় মারা যেতে থাকো বা আহত হয়ে সেবা ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাও তবে তারা চিকিৎসা ও সেবা যত্ন দিয়ে তোমাদের সাহায্য করতে যায়।

তোমরা জানো, যুদ্ধের ময়দানে মেয়েদের অংশ নেয়ার আমি পক্ষপাতি নই। তবুও এদের আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। বন্ধুরা, আমি তাদের এ জন্যই ফিরিয়ে দেইনি, যেনো এদের কথা মনে রেখে তোমরা উৎসাহ ও উদ্দীপনায় উদ্বেল হতে পারো।

এই মেয়েরা আমাদের অন্তরে প্রেরনার যে বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে তা যেন আমাদের চলার পথকে আলোকিত করে দেয়। আর তোমাদের যেন মনে করিয়ে দেয় এমন বহু মেয়েরা বায়তুল মোকাদ্দাসে কাফেরদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল এবং আজো তাদের দুর্ভাগ্যের রজনী শেষ হয়নি।

আমি তোমাদের আগেও অনেকবার বলেছি, শহীদের যে জাতি ভুলে যায় সে জাতিকে আল্লাহও ভুলে যান। তাদের ভাগ্য সিল মারা হয়ে যায় লৌহ মাহফুজে, আর চির অভিশাপে পড়ে যায় তারা।

এখন তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তোমরা কিয়ামতে অভিশপ্ত জাতি হয়ে উঠবে অথবা সেই জাতির মত উঠবে, যে জাতির জন্য রাসুলুল্লাহ(সাঃ) আল্লাহকে বলবেন, ‘হে আল্লাহ্‌, এই সে জাতি যাদের কোরবানি ও আত্মত্যাগের সামনে কাফেরদের ঝুঞ্ঝা-তুফান প্রতিহত হয়েছিল আর তোমার সত্য দ্বীনের সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছিল’।

সুলতান আইয়ুবী এমন আবেগময় ভাষণ দিতে অভ্যস্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী এবং জরুরী কথাই শুধু তিনি বলতেন। কিন্তু বায়তুল মোকাদ্দাসের ব্যাপারে তিনি এত বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন, যা তাঁর ভাষণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল।

যখনই তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসের নাম উচ্চারন করতেন তাঁর চোখ আশ্রুসজল হয়ে উঠতো। তিনি আবেগে ও ক্ষোভে এক হাতের তালুতে অন্য হাত দিয়ে ঘুষি মারতেন এবং অধীর হয়ে পায়চারী শুরু করতেন।

তিনি যুদ্ধপূর্ব এই সমাবেশে সেনাপতিদেরকে এত বেশী আবেগময় ও উত্তেজিত করে তোললেন যে, তিনি যখন বের হয়ে গেলেন তখন কেউ আর কোন কথা বলতে পারলো না। সবার চোখে তখন ভাসছিল যুদ্ধের ময়দান আর অস্ত্রের ঝনঝনানি।

একটু পর। সেনাপতিরা প্রত্যেকেই যার যার বাহিনীর কাছে চলে গেল। তারা তাদের সৈন্যদেরও প্রস্তুত হতে বললো। উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়ে তারা তাদের সৈন্যদেরও ঈমানী অস্ত্রে সজ্জিত করে তুলছিল।

সবাই চলে গেল সুলতান আইয়ুবী নৌবাহিনীর এডমিরাল আল ফারেসকে কাছে ডেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাগরের কি অবস্থা’?

আল ফারেস তাঁকে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বললেন, ‘জাহাজগুলো ঠিক মতই টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আলেকজান্দ্রিয়া থেকেও সংবাদ পাচ্ছি নিয়মিত। খৃষ্টানদের কোন নৌবহর সাগরে নেই, শুধু টায়েরের সমুদ্র বন্দরে তাদের কিছু যুদ্ধ জাহাজ আছে। আমার গোয়েন্দারা জেলেদের ছদ্মবেশে সেখানে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। টায়ের ও তার আশেপাশে খৃষ্টানদের নৌবহরের অস্বাভাবিক কোন সমাবেশ ঘটেনি। তবে তাদের যে সব জাহাজ ওখানে আছে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত অবস্থায়ই আছে। খৃষ্টান নৌবাহিনীর সদস্যরা বারুদ নিয়ে কামানের পাশে বসে আছে। এসব কামানের আগুন নাকি অনেক দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে’।

‘ওদের কামানের নল অনেক লম্বা। তবে তোমাদের সলতেওয়ালা তীর যত দূর যায় এ নলের আগুন তারচে বেশী দূরে যাওয়ার কথা নয়’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ওদের লম্বা নলের কামান দেখে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই’।

‘আমাদের কারো মধ্যে এ নিয়ে কোন ভয় ভীতি নেই’। আল ফারেস বললেন, ‘নৌবাহিনীর কমাণ্ডো দল প্রস্তুত হয়ে আছে। যুদ্ধের সময় ছোট ছোট নৌকায় করে বা ডুব সাঁতারে ওরা শত্রুর জাহাজের নিকট গিয়ে জাহাজ ফুটো করে দেবে অথবা জাহাজে আগুন লাগিয়ে দেবে’।

‘যুদ্ধ যেন রাতে শুরু হয়’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘দিনের বেলায় কোন কমাণ্ডো সৈন্য সাগরে নামাবে না। এতে অহেতুক জীবন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খুব সাবধানে থাকবে’।

সুলতান বললেন, ‘তোমরা যেমন জেলেদের ছদ্মবেশে টায়েরে গোয়েন্দা পাঠাচ্ছো ঠিক তেমনি শত্রুর গোয়েন্দাও তোমাদের জাহাজের কাছে আসবে। আগত ফেরিওয়ালাদের দিকে নজর রাখবে, যেন অতর্কিতে আক্রমনে তোমরা দুশমনের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে না যাও। তোমরা এমনভাবে তোমাদের জাহাজগুলোকে সাজিয়ে রাখবে যেন শত্রুর জাহাজ এলে তোমরাই তাদের ঘেরাও করে ফেলতে পারো। দিনের বেলা পতাকা ও রাতে আলো জ্বেলে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করবে’। যখন আল ফারেস সুলতান আইয়ুবীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন, তখন ভোর হয়ে গেছে। তিনি ফজরের নামাজের জন্য সেখানেই এক জামাতে দাঁড়িয়ে গেলেন।

‘আল ফারেস’! সালাম ফিরাতেই তিনি শুনতে পেলেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে তিনি দেখতে পেলেন, পাশেই গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হাসান বিন আব্দুল্লাহ দাঁড়িয়ে।

আল ফারেস উঠে তার সাথে করমর্দন করলেন। হাসান বিন আবদুল্লাহ তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তা কেমন আছো আল ফারেস? শুনলাম একই সাথে দুই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছো? দু’জনকেই কি সঙ্গে রেখেছো?’

‘ও, হো, ভাই হাসান’। আল ফারেস আনন্দিত স্বরে বললেন, ‘আরে না, ওরা তো আমার আশ্রিতা’।

‘আশ্রিতা! তুমি আবার দানবীর হলে কবে? কোথায় পেলে মেয়েদের?’

‘তারা দু’জন সাগর তীরে দাঁড়িয়ে ছিল। বললো, বেদুইনের মেয়ে। তাদের পুরো বংশ যুদ্ধের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে’।

‘সবাই মরে গেল আর এই দুই মেয়ে নিরাপদে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে রইলো শুধু তোমার কাছে ধরা দেবে বলে?’ হাসান বিন আব্দুল্লাহর কণ্ঠে শ্লেষ।

তিনি বললেন, ‘খৃষ্টান বাহিনী বেদুইনের সমস্ত লোককে অশ্ব পদতলে পিষে মেরে ফেলতে পারলো আর এই দুই সুন্দরী মেয়েকে জীবিত ছেড়ে দিল? আসলে তুমি সাগরে থাকতে থাকতে ডাঙ্গার অনেক কিছুই ভুলে গেছো। তুমি কি নিজেকে মারতে চাও নাকি?’

আল ফারেস হাসলেন। বললেন, ‘ভাই হাসান, তুমি গোয়েন্দাগিরি করতে করতে শেষে কাক চিলকেও গোয়েন্দা মনে করতে শুরু করেছো। তুমি কি বলতে চাচ্ছো, ওই মেয়ে দুটিও শত্রুদের গোয়েন্দা?’

‘হতে পারে’। হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘তুমি একটু বেশী রকমের সরল মানুষ আল ফারেস। এই মেয়ে দুটিকে টায়েরের উপকূলে নামিয়ে দিয়ে আসো। অজানা মেয়েদের যুদ্ধ জাহাজে রাখা মোটেই উচিত নয়’।

‘আমি যদি তাদের মিশরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করি তবে তাতে কি কোন সওয়াব হবে না?’ আল ফারেস বললেন, ‘যদি এদের একজনকে আমি বিয়ে করি ও অন্যজনকে কোন ভাল লোকের সাথে বিয়ে দেই? মেয়ে দুটি বড় অসহায়। তাদের যদি আবার উপকূলে ছেড়ে দেই তবে জানো খৃষ্টানরা তাদের নিয়ে কি খেলা খেলা খেলবে?’

‘যদি মেয়ে দুটি খৃষ্টান হয়?’ হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘শোন আল ফারেস! তুমি শিশু নও। সাধারন কোন সৈন্যও নও। তুমি নৌবাহিনীর এক যোগ্য কমাণ্ডার। একটু বুঝতে ও চিন্তা করতে চেষ্টা করো। আমি শুনেছি, তুমি অবসর সময় ওদের সাথে হাসি তামাশা ও খেলা করে কাটিয়ে দাও। শরিয়ত তোমাকে এমন অধিকার কবে থেকে দিল? তুমি হাজার বার কসম করলেও আমি বিশ্বাস করবো না, মেয়ে দুটি পবিত্র।

যদি তারা তোমাকে ধোঁকা না দিতে পারে তবে তুমি নিজেই ধোঁকায় পড়ে যাবে। সুন্দরী ও যুবতী মেয়েরা মানুষকে সহজেই ফরজ দায়িত্ব থেকে বিপথগামী করতে পারে। যাই হোক আল ফারেস, এখনও সময় আছে, মেয়ে দুটিকে তুমি জলদি জাহাজ থেকে সরানোর ব্যবস্থা করো’।

‘যদি তোমার কথা না মানি, তবে?’

‘তবে আমাকে দেখতে হবে মেয়ে দুটি কেমন?’ হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘যদি সন্দেহ হয় তবে তাদেরকে তোমার জাহাজ থেকে নামিয়ে এনে পরীক্ষা করবো।

কিন্তু সে দায়িত্বটা আমি পালন করতে চাই না। এটুকু দায়িত্ব আমি তোমার উপরই ছেড়ে দিতে চাই। কারণ তুমি আমার পুরাতন বন্ধু। তুমি নিজে চেষ্টা করে দেখো এ থেকে বাঁচতে পারো কিনা? নইলে আমাকে বন্ধুত্ব কোরবানী করে ওদের ধরে আনতে হবে’।

‘তুমি আমার পুরনো বন্ধু। এতদিনেও কি আমাকে চিনতে পারলে না? আমাকে নিয়ে কোন বাজে চিন্তা তুমি কি করে করতে পারো হাসান?’

আল ফারেস বললেন, ‘তুমি বন্ধুত্বের কথা বলেছো, আমি তো দায়িত্বের কথা বলছি। দ্বীনের পথে দায়িত্ব পালনে আমি আমার জীবনটাই কোরবানি করে দেবো। দুটি অসহায় মেয়েকে আমি আশ্রয় দিয়েছি ঠিক, কিন্তু তুমি বিশ্বাস না করলেও বলবো, ওদের আমি অপবিত্র করিনি। আর দেখে নিও, এ মেয়েরা আমার দায়িত্ব পালনে কোন বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না। এমনকি তারা আমার কোন ক্ষতি সাধনও করতে পারবে না। তাদের প্রতি আমার সামান্য সন্দেহ হলেও আমি তাদেরকে সাগর উপকূলে নামিয়ে দিয়ে আসবো নইলে জীবন্ত সাগরে ফেলে দেবো’।

‘তুমি কখন ফিরে যাচ্ছো?’ হাসান বিন আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন।

‘ভাবছি, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবো। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি।সামান্য ঘুমিয়ে নিয়েই নাস্তা সেরে রওনা হয়ে যাবো’। আল ফারেস বললেন, ‘সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌকা আমার জন্য উপকূলে অপেক্ষা করবে। তার আগেই আমি জাহাজে পৌঁছে যাবো’।

আল ফারেসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসান বিন আবদুল্লাহ তার নিজের কামরার দিকে চলে গেলেন। ওখানে পৌঁছেই তিনি তার এক কমাণ্ডারকে ডেকে পাঠালেন।

কমাণ্ডার এলে তিনি তাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘আল ফারেসের নৌবাহিনীর জাহাজ অমুক স্থানে নোঙ্গর করা আছে। কোন একটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে তুমি সেখানে যাবে। আল ফারেসের সহকারী ক্যাপ্টেন রউফ কুর্দিকে বলবে, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি’।

রউফ কুর্দিকে হাসান একটি চিঠি দিলেন। তাতে তিনি লিখলেন, ‘এই লোককে জাহাজের কোন ডিউটিতে লাগিয়ে দেবে। আমি জানতে পেরেছি, জাহাজে দুটি মেয়ে আছে। ওই মেয়েদের সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য তার জাহাজে থাকা প্রয়োজন। আমি জানতে চাই, তাদের অনুসরণ করে জাহাজের পিছনে কোন গোপন ছায়া অনুসরণ করছে কিনা? যদি তেমন দেখা যায় তবে একে দিয়ে মেয়েদেরকে গোয়েন্দা হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেবে’।

হাসান বিন আবদুল্লাহ কমাণ্ডারকে বললেন, ‘দেরী না করে এখনই রওনা হও। কোন পালতোলা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে চলে যাও জাহাজে। মেয়েদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখবে ওরা খৃষ্টান গোয়েন্দা কিনা? কোন রকম সন্দেহ হলে ওদের নিয়ে চলে আসবে হেডকোয়ার্টারে’।

বাতাস বেশ জোরে বইছিল। বাতাসের গতিও ছিল অনুকূল। দুপুরের আগেই নৌকা জাহাজের কাছে পৌঁছে গেল। রউফ কুর্দির নাম বলতেই রশির সিঁড়ি ফেলে তাকে জাহাজে তুলে নিল খালাসীরা।

লোকটি উপরে উঠেই কুর্দির সাথে সাক্ষাৎ করলো। হাসান বিন আব্দুল্লাহর দেয়া চিঠি তুলে দিল তার হাতে। নিজের পরিচয় ও উদ্দেশ্য খুলে বললো মুখে।