» » রিচার্ডের নৌবহর

বর্ণাকার
🕮

সুলতান আইয়ুবী তাদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং তাদের নিয়ে নিজের তাবুতে প্রবেশ করলেন।

আলোচনা শুরু করলেন খৃষ্টান সরদার বালিয়ান। বললেন, ‘আগে মুসলিম অবরোধ উঠিয়ে নেবেন। তারপর আপনার শর্ত নিয়ে আমরা আলোচনায় বসবো’।

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কিন্তু অবরোধ উঠিয়ে নেবো কোন শর্তে? আপনারা কি বায়তুল মোকাদ্দাস ছেড়ে দিতে সম্মত আছেন? তাহলে আপনারা শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসুন, আমি আমার অবরোধ তুলে নিচ্ছি’।

‘না, বায়তুল মোকাদ্দাস ছাড়ার জন্য প্রস্তুত নই আমরা’।

‘তাহলে আমার পক্ষেও অবরোধ উঠিয়ে নেয়া সম্ভব নয়’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আগে আমি বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করি। তারপর আপনাদের যে কোন আলোচনাই আমি শুনতে প্রস্তুত’।

‘দেখুন, এখনও আপনার একটি সৈন্যও শহরে প্রবেশ করেনি। আপনি এমন দাবীও করতে পারেন না যে, আপনি শহর অধিকার করে নিয়েছেন। বরং এখনও খৃষ্টান সৈন্যরাই শহরের নিয়ন্ত্রন ধরে রেখেছে। আমরা অধিক রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য আপনার কাছে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম’।

‘আমিও অধিক রক্তপাত চাই না। শান্তি আলোচনার জন্য আমি সব সময় প্রস্তুত। কিন্তু চুক্তি হওয়ার আগে আমরা আমাদের অবস্থান ছাড়তে পারি না’।

এভাবেই প্রথম দফা শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হয়ে গেল। খৃষ্টান প্রতিনিধি দল ফিরে গেল শহরে। সুলতান আইয়ুবী তার সৈন্যদের অবরোধ আরো দৃঢ় করতে হুকুম দিলেন।

প্রথম দফা শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হলে আবার শুরু হয়ে গেল লড়াই। দু’ পক্ষই পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধ করার জন্য নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেলো। সুলতান আইয়ুবী ধ্বংস প্রাপ্ত প্রাচীরের পাথর সরিয়ে রাস্তা উন্মুক্ত করার হুকুম দিলেন।

মুজাহিদরা নব উদ্যমে বীরবিক্রমে ধ্বংসাবশেষের পাথর সরানোর কাজে মেতে উঠলো। দুপুরের আগেই শহরে প্রবেশের মত পথ তৈরি হয়ে গেলো। সুলতানের সৈন্যরা সে পথে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করলও।

এ সময় আবার বেরিয়ে এলো খৃষ্টানদের শান্তি প্রস্তাবকারী দলটি। পেছন দিয়ে মুসলিম সৈন্য প্রবেশ শুরু করেছে এ খবর তখনো তাদের কাছে যায়নি। সুলতান আইয়ুবীর কাছেও এ খবর যায়নি। তাকে শুধু জানানো হয়েছে, ‘পাথর সরিয়ে রাস্তা উন্মুক্ত করা হয়েছে’।

সংবাদদাতাকে তিনি বললেন, ‘সৈন্যদের শহরে প্রবেশ করতে বলো’। এ সময় খৃষ্টান প্রতিনিধি দল আবার সেখানে হাজির হলে তিনি তাদের নিয়ে তাবুর মধ্যে ঢুকে গেলেন। নতুন করে শান্তি আলোচনা শুরু হলো।

এ দিকে সুলতানের হুকুম পেয়ে মুসলিম জানবাজরা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করলো। দেয়াল ভাঙ্গার কাজে নিয়োজিত দলটি মনোযোগ দিল পথটি আরো প্রশস্ত করার দিকে। খৃষ্টানরা শহর ছেড়ে দিতে কিছুতেই প্রস্তুত ছিল না। তারা বাঁধা দিল ওদের। দু’পক্ষে তীব্র সংঘর্ষ বেঁধে গেল।

মুসলিম সৈন্যদের মাঝে তখন বিরাজ করছিল এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। প্রায় একশো বছর পর আবার মসজিদুল আকসায় প্রবেশের পথ তাদের সামনে এখন উন্মুক্ত। তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। তারা খৃষ্টান সৈন্যদের বাঁধা অতিক্রম করতে দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ হলো।

বাইরে থেকে সৈন্যরা খৃষ্টানদের বাঁধা অতিক্রম করে প্লাবনের মত ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলো। খৃস্টানরাও সর্ব শক্তি দিয়ে বাঁধা দিল তাদের।

খৃষ্টানরা তখন এতটাই মরিয়া হয়ে গেছে যে, তাদের কোন হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। তাদের মনে তখন যে ভয়টি সবচে বেশী কাজ করছিল টা হলো, পরাজয়ের অর্থই হচ্ছে মৃত্যু। এতকাল তারা মুসলমানদের উপর যে অন্যায় অত্যাচার ও নির্যাতন করেছে মুসলমানরা এবার তার নির্মম প্রতিশোধ গ্রহন করবে। নিশ্চয়ই তারা জেরুজালেমে কোন খৃষ্টানকেই আর জীবিত রাখবে না।

তারা ভাবলো,জেরুজালেম দখল করার সময় আমরা যেভাবে ওদের নির্বিচারে হত্যা করেছি তারাও আমাদের সেভাবে হত্যা করে বদলা নেবে। অতএব মরতেই যদি হয় যুদ্ধ করে মরাই ভাল। ফলে তা তারা বাঁধার দুর্ভেদ্য দেয়াল দাঁড় করিয়ে দিল শহরে প্রবেশকারীদের সামনে।

খৃষ্টানদের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করতে লাগলো শত শত মুসলিম সৈন্য। কেউ মারা গেল তীরন্দাজদের তীরের আঘাতে, কেউ বর্শার আঘাতে। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরাও বেপরোয়া। তারা বাঁধা দান কারীদের পদদলিত করে সামনে এগিয়ে চললো।

যুদ্ধ এক ভয়াবহ রক্তাক্ত রূপ ধারন করলো। যারা প্রবল বাঁধা ডিঙিয়ে ঢুকে পড়েছিল শহরে তারা শহরের রাস্তায় রাস্তায় খৃষ্টান সৈন্য ও যুবকদের আক্রমণের শিকার হলো।

মুসলিম জানবাজরা তখনো স্রোতের মতো ঢুকছে শহরে। ইতিমধ্যে শহরে ঢুকে পড়া একদল মুসলিম সৈন্য বাঁধা মাড়িয়ে শহরের প্রধান ফটক খুলে দিল।

শহরের রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয়ে গেল তলোয়ারের ঠোকাঠুকি। একশো বছর পর আবার বায়তুল মোকাদ্দাসের রাজপথে ঢল নামলো রক্তের।

রক্তরঞ্জিত পথে চলছিল মরণ পণ লড়াই।

ইতিমধ্যে এক মুসলিম মুজাহিদ বড় গেটের উপরে গম্বুজের মাথায় ক্রুসেডদের যে পতাকা ছিল তা নামিয়ে আনলো। সেখানে উড়িয়ে দিল ইসলামী পতাকা।

যুদ্ধ এখন আর কেবল সৈন্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। হাতাহাতি লড়াই চলছিল শহরের সর্বত্র। শহরের নিয়ন্ত্রন তখন কারো হাতে নেই। খৃষ্টান নাইট ও সৈন্যরা শহরময় ছুটাছুটি করছিল। মুসলিম মুজাহিদরাও ছুটছিল সমান তালে। যে যেখানে যাকে যেভাবে পারছে, মারছে।

অন্য সময় এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতে পড়লে ক্রুসেড বাহিনীর সৈন্যরা তো বটেই, অনেক সেনাপতি এবং নাইটরাও পালিয়ে আত্ম্রক্ষার চেষ্টা করতো। কিন্তু আজ কারো মনেই পালাবার চিন্তা এলো না। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার একটাই উপায়, প্রতিপক্ষকে নিধন করা। সবাই তোড়ে জোড়ে সে কাজটিই করছিল।

সুলতান আইয়ুবীর জানবাজ বাহিনীর সামনেও তখন একটাই কাজ, প্রতিপক্ষের প্রতিটি সৈন্যকে হত্যা করে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া। তারা সরবোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেও সেই কাজটিই করছিল।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল মুসলমান নারী পুরুষ সবাই। তারাও বাঁচার পথ পরিষ্কার করছিল খৃষ্টানদের হত্যা করে। ফলে যুদ্ধ কেবল সৈনিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। খৃষ্টান ও মুসলমান উভয় দলের সৈন্য ও জনগনও এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। মুহূর্তে যুদ্ধটি সর্বাত্মক যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করলো। একদল মুসলিম সৈন্য মসজিদুল আকসার উপর থেকে ক্রুশ চিহ্নটি সরিয়ে ফেলে সেখানে ইসলামী পতাকা উড়িয়ে দিল। তখনও শহরের অলিতে গলিতে দু’পক্ষের মধ্যে চলছে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কিন্তু যতই সময় যেতে লাগলো ক্রুসেড বাহিনীর ক্ষিপ্রতা ততোই শিথিল হয়ে আসতে লাগলো।

সুলতান আইয়ুবী তখনও খৃষ্টানদের শান্তি মিশনের সাথে আপোষ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বাইরে ও শহরের মধ্যে কি ঘটছে সে খবর তারা কিছুই জানতেন না।

তিনি বালিয়ানকে বললেন, ‘আমি বায়তুল মোকাদ্দাস শক্তি দিয়ে মুক্ত করার শপথ নিয়েছি। যদি আপনারা শহরটি এ শর্তে ছেড়ে দেন যে, আমি শহর জয় করেছি, তবেই আপোষের আলোচনা চলতে পারে’।

‘সালাউদ্দিন!’ বালিয়ান একটু গম্ভীর স্বরেই বললেন, ‘এই শহরের নাম এখনও জেরুজালেমই আছে, বায়তুল মোকাদ্দাস হয়নি। যদি আপোষ করতে না চান তবে আপনাকে বাধ্য করবো না।

কিন্তু এ কথা শুনে নিন, আপনার চার হাজার সৈন্য এখনো ক্রুসেড বাহিনীর কাছে যুদ্ধবন্দী অবস্থায় আছে। আর যেসব মুসলমান এ শহরে বন্দী অবস্থায় বাস করছে তাদের সংখ্যাও তিন হাজার। আমরা এসব বন্দী ও শহরের প্রতিটি মুসলমান নাগরিককে- হোক সে নারী, হোক সে শিশু, হোক সে বৃদ্ধ বা যুবক, সকলকেই নির্বিচারে হত্যা করে প্রতিশোধ নেবো আপনার আক্রমনের’।

সুলতান আইয়ুবীর চোখ রাগে রক্তবর্ণ হয়ে গেল। তাঁর ঠোঁট কাঁপতে লাগলো। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এ সময় তাবুর পর্দা ঠেলে এক কমাণ্ডার প্রবেশ করলো।

কমাণ্ডার ইশারায় সুলতানকে কাছে ডেকে তাঁর কানে কানে বললো, ‘শহর দখল হয়ে গেছে। প্রধান ফটক ও মসজিদুল আকসার উপর ইসলামী পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে’।

সুলতান আইয়ুবী বালিয়ানের ধমকের উত্তর পেয়ে গেছেন। তাঁর রক্তলালা চোখে তখন অসাধারণ এক চমক দেখা গেল।

তিনি জোরে হাতের তালুতে হাত মেরে খৃষ্টান সরদার বালিয়ানকে বললেন, ‘বিজয়ী কখনও বিজিতের সাথে শর্ত মেনে আপোষ করে না। এখন একটি মুসলমানও তোমাদের কয়েদী নেই’।

সুলতান আইয়ুবী যদিও ধৈর্যের সাথে কথা বলছিলেন, কিন্তু বালিয়ানের ধমকের চাইতেও তাঁর কণ্ঠ ছিল বলিষ্ঠ ও ভরাট। তিনি রূঢ়ভাবেই বললেন, ‘এখন তোমরাই আমার কয়েদী। তোমাদের সমস্ত সৈন্যই আমাদের যুদ্ধবন্দী। শহরে বসবাসকারী খৃষ্টানরা আমাদের কাছে বন্দী। এখন শহরের সে সব খৃষ্টান বেরিয়ে যেতে পারবে যারা আমার নির্ধারিত অর্থ জরিমানা দিতে পারবে। এখন যাও, দেখো এ শহর জেরুজালেম নাকি বায়তুল মোকাদ্দাস’।

সরদার বালিয়ান ও তার সাথীরা ভয় পেয়ে গেল। তাবু থেকে বেরিয়ে তারা দেখলো, সুলতান আইয়ুবীর অধিকাংশ সৈন্য শহরে প্রবেশ করেছে এবং শহরের প্রধান গেটে ইসলামী পতাকা উড়ছে।

এটা একটা আকস্মিক ঘটনা নাকি সুলতান আইয়ুবীর প্ল্যানই এমন ছিল অথবা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের এমনই ছিল ইচ্ছা বুঝতে পারলো না বালিয়ান।

সুলতান আইয়ুবী জুম্মার দিন ৬ অক্টোবর মুতাবেক ৬ই রজব ৫৮৩ হিজরী সনে শহরে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন। এই রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মেরাজে গিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌র এ এক অপার মহিমা যে সেই রজব মাসেই তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করার সুযোগ করে দিলেন মুসলমানদের।

সুলতান আইয়ুবী যখন শহরে প্রবেশ করলেন তখন মুসলমানরা সবাই ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এসেছিল। মেয়েরা খুশীতে তাদের মাথার চাদর ও ওড়না রাস্তায় বিছিয়ে দিতে লাগলো তাঁর সম্মানে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী সেগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে বললেন। কারণ তিনি মানুষ পুজা ও তোষামোদকে খুব ঘৃণা করতেন।

সুলতানের রক্ষী বাহিনী রাস্তা থেকে মেয়েদের ওড়নাগুলো উঠিয়ে দিল আর ওদের বললো, ‘ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করো। এ বিজয় তাঁর দান। সুলতান এবং আমরা নিমিত্ত মাত্র’। তখন ওরাও মুক্তির আনন্দে পুরুষের মত উচ্চস্বরে তাকবীর ধ্বনি দিতে লাগলো। কেউ কেউ রাস্তার ওপরই সিজদায় পড়ে আল্লাহ্‌র শোকর আদায় করলো।

সুলতান শহরে পা দিতেই সেখানে এক অভাবিত দৃশ্যের অবতারনা হলো। আনন্দ বেদনার বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে গেল তাদের হ্রিদয়গুলো। সবার চোখে উছলে উঠলো আনন্দের অশ্রুধারা। সকৃতজ্ঞ নয়নে সবাই ছুটে এলো কিংবদন্তীর নায়ক তাদের এ মহান মুক্তিদূত কে এক নজর দেখার জন্য।

সেখানে সৃষ্টি হলো এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের! সুলতান আইয়ুবী নিজেও এতবেশী আবেগময় হয়ে উঠলেন যে, তিনিও সবার সাথে তাকবীর ধ্বনি দিতে লাগলেন।( ?)

শ্লোগানের তালে তালে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছিল জনতার মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো। তাতে প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের সংকল্প ও দৃঢ়তার বলিষ্ঠতা।

সুলতান আইয়ুবী হাত নেড়ে জবাব দিচ্ছিলেন জনতার এ স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনের। কিন্তু তার মুখে কোন হাসি ও আনন্দের আভা ছিল না, বরং তিনি ঠোঁট কামড়ে সংযত করার চেষ্টা করছিলেন নিজের আবেগ।

আবেগের উচ্ছাসে তাঁর বার বার কান্না পাচ্ছিল। এ কান্না কৃতজ্ঞতার কান্না। যে মহান সত্ত্বা এই অভাবিত বিজয় দান করলেন তাঁর জন্য বার বার কৃতজ্ঞতায় তাঁর মাথা নুয়ে আসছিল। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন নিজেকে সম্বরণ করতে। কিন্তু কান্না এসে বার বার তাঁর আবেগে ঝড় তুলছিল। খৃষ্টানরা দুয়ার এঁটে তাদের ঘরে বসে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। তারা তাদের যুবতী মেয়েদের লুকিয়ে রাখলো। মেয়েদেরকে পুরুষের লেবাস পরিয়ে দিল। তাদের ধারনা ছিল, মুসলিম বাহিনী যখন প্রতিশোধ নেয়া শুরু করবে তখন তারা কেউ রেহাই পাবে না। তারা মেয়েদের উপর অত্যাচার করবে। পুরুষদের হত্যা করবে।

কিন্তু ইউরোপের লেখক লেনপোল লিখেছেন, ‘সুলতান সালআউদ্দিন সেখানে যে উদার মনোভাব ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন তা সত্যি অভাবিত। এমন দৃশ্য ওখানকার কেউ আগে কখনোই দেখেনি।যখন তাঁর সৈন্যদল ক্রুসেড বাহিনীর কবল থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করে, তখন তিনি তাঁর বাহিনীর কমাণ্ডার ও সেনাপতিদের শহরে শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করতে কঠোর নির্দেশ দেন।

শহরে যেন কোন প্রকার অন্যায় অত্যাচার না হয় সে জন্য সৈন্যদের টহল দিতে আদেশ দেন তিনি। শহরের অধিবাসী মুসলমান, যারা এতদিন খৃষ্টানদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল তাদের কেউ যেন খৃষ্টানদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আক্রমণ চালাতে না পারে তিনি সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেও হুকুম জারী করেন’।

সুলতান আইয়ুবীর সমস্ত আদেশ ছিল ইনসাফ ও করুণা ভিত্তিক। কোন খৃস্টানকেই তিনি শহরর থেকে বিতাড়িত করেননি। কারো ওপর যেন কোন জুলুম অত্যাচার না হয় তা নিশ্চিত করে তিনি মসজিদুল আকসার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর পা যতই মসজিদুল আকসার দিকে যাচ্ছিল ততোই তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠছিলেন।

মসজিদের দৃশ্য যখন তাঁর চোখে দৃষ্টিগোচর হলো তিনি আল্লাহু আকবর বলে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠলেন। তখন তাঁর শরীর আবেগে থরথর করে কাঁপছিল। সুলতান আইয়ুবী মসজিদুল আকসায় পৌঁছেই আবেগের আতিশয্যে মসজিদের বারান্দায় বসে পড়লেন এবং সেখানেই সিজদায় পড়ে গেলেন।

সুলতান আইয়ুবীর চোখ দিয়ে তখন অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। যেন তিনি এ মসজিদের বারান্দা চোখের পানিতে ধুয়ে দিচ্ছেন।

মসজিদের অবস্থা ছিল তখন খুবই শোচনীয়। অতীতে মুসলিম শাসকরা যুগে যুগে এ মসজিদকে সোনার ঝাড়বাতি ও রৌপ্যের আগরবাতি এবং মুল্যবান উপহার ও উপঢৌকন দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলেন। সে সব জিনিশ খৃষ্টানরা সবই লুট করে নিয়ে গেছে।

মর্মর পাথরের মেঝেও জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে। দেয়ালের পলেস্তরা খসে গেছে। এসব দেখে বেদনায় তাঁর অন্তর ভেঙ্গে যাচ্ছিল। তিনি মসজিদটি পুনঃ মেরামতের সিদ্ধান্ত নিলেন। মসজিদ পুনঃ নির্মাণের আগে সুলতান আইয়ুবী শহরের প্রশাসনিক কাজের দিকে মনোযোগ দিলেন।

খৃষ্টানরা ছিল ভীত, শঙ্কিত, চিন্তাগ্রস্ত। তাদের ভাগ্যে কি আছে এই দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম হচ্ছিল না। তাদের মনে হচ্ছিল তারা এক অদৃশ্য জিন্দান খানায় বন্দী হয়ে পড়েছে।

সুলতান আইয়ুবী প্রথমেই এই পরাজিত খৃষ্টানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করতে চাইলেন। তিনি খৃষ্টানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাঁর উপদেষ্টাদের জরুরী সভা আহবান করলেন। পরামর্শ সভার সিদ্ধান্ত ক্রমে তিনি আদেশ জারি করলেন, ‘প্রত্যেক খৃষ্টান পুরুষ দশ দিনার, মেয়েরা পাঁচ দিনার এবং শিশুরা এক দিনার মুক্তিপণ দিয়ে শহর থেকে বের হয়ে যেতে পারবে’।

এ ঘোষণা খৃষ্টানদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করলো। তারা মানসিক বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেলো। যারা সেখানে থাকতে চাইলো না তারা মুক্তিপণ দিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

শহরের প্রধান ফটকে দাউদ গম্বুজের নিচে মুসলিম অফিসার বসলো মুক্তিপণ আদায় করতে। এখানে এসে মুক্তিপণ দিয়ে খৃষ্টান বাসিন্দারা শহর ছেড়ে চলে যেতে আরম্ভ করলো।

প্রথমেই মুক্তিপণ দিয়ে শহর থেকে বের হলো খৃষ্টান সরদার বালিয়ান। তাঁর কাছে ছিল ইংল্যাণ্ডের সম্রাট হেনরীর পাঠানো অনেক অর্থ। তিনি সেই অর্থ থেকে ত্রিশ হাজার দিনার ব্যয় করলেন শহরের খৃষ্টান দের মুক্ত করার কাজে। ফলে শুরুতেই দশ হাজার খৃষ্টান মুক্ত হয়ে গেল এই অর্থের বিনিময়ে।

দাউদ গম্বুজের প্রধান ফটকে বিদায়ী খৃষ্টানদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার বিরাট লাইন লেগে গেল। তারা প্রত্যেকে আপন বংশ ও পরিবারের মুক্তিপণ দিয়ে দলে দলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। চিরকালই এটা যুদ্ধের নিয়ম যে, বিজয়ী সৈন্যরা বিজয়ের পর সেই শহরে লুটতরাজ করে। বায়তুল মোকাদ্দাস ছিল এমন শহর যেখানকার অধিবাসীরা এর আগেও লুটতরাজের সম্মুখীন হয়েছিল। ক্রুসেড বাহিনী ও খৃষ্টানরা বিজয় লাভের পর পাইকারীহারে মুসলমান নিধন করেছিল এ শহরে। তারা মুসলমানদের অর্থ সম্পদ সবই লুট করে নিয়েছিল। তাদের স্ত্রী কন্যাদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছিল। মসজিদ অপবিত্র করেছিল। খৃষ্টানরা ধারনা করেছিল, এবার তাদের ভাগ্যে জুটবে সেই দুর্গতি ও লাঞ্চনা।

কিন্তু মুসলমানরা যখন শহর অধিকার করলো তখন ঘটলো এর বিপরীত ঘটনা। তারা লুটপাট বা অন্যায় অত্যাচার তো করলোই না বরং খৃষ্টানদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধানের জন্য জরুরী ব্যবস্থা গ্রহন করলো।

সুলতান আইয়ুবী মুসলমান ব্যবসায়ীদেরকে বললেন, ‘তোমরা উপযুক্ত মূল্য দিয়ে খৃষ্টানদের মালপত্র ক্রয় করবে যাতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং মুক্তিপণ আদায় করে শহর থেকে বের হতে পারে’।

এভাবে যেসব খৃষ্টানদের কাছে নগদ অর্থ ছিল না তারাও মালপত্র বিক্রি করে মুক্ত হয়ে গেল। মুক্তি পণের বাইরে খৃষ্টানদের কোন সম্পদেই হাত দেয়ার কোন অধিকার ছিল না মুসলমানদের জন্য।

এ সময়ের একটি ঘটনা পরবর্তী কালে জানাজানি হয়ে গেলে বিশ্বব্যাপী ধিক্কার ও নিন্দা কুড়িয়েছে। ঘটনাটি ছিল এরকম, বায়তুল মোকাদ্দাসের সবচেয়ে বড় পাদ্রী বেত্রিক হারকিউলিস এক কাণ্ড করে বসলেন। তিনি গির্জায় গচ্ছিত সমস্ত সোনা দানা ও অর্থ সম্পদ তার নিজস্ব ফাণ্ডে জমা করে নিলেন।

ঐতিহাসিকরা বলেছেন, এসব অর্থ এত বিপুল পরিমাণ ছিল যে এগুলো মুক্তিপণ হিসাবে দিয়ে তিনি অবশিষ্ট খৃষ্টানদের সহজেই মুক্ত করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার মুক্তিপণ দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান।

যে অফিসার মুক্তিপণ আদায় করছিলেন তিনি দেখলেন বহু অর্থ সম্পদ সাথে নিয়ে পাদ্রী সাহেব চলে যাচ্ছেন। তিনি খবরটি সুলতান আইয়ুবীকে জানিয়ে জানতে চাইলেন, এত বিপুল পরিমাণ সোনাদানা ও মুল্যবান সম্পদ নিয়ে তিনি তাকে যেতে দেবেন কিনা?

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যদি সে তার মুক্তিপণ দিয়ে থাকে তবে তাকে আর বাঁধা দিওনা। আমি তো বলেই দিয়েছি, যে যতটুকু সঙ্গে নিতে পারে তা সে নিয়ে যেতে পারবে। এই সম্পদ তার নাকি গির্জার সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমি আমার কথার বিরুদ্ধে যেতে পারবো না’।

পাদ্রী মহাশয় গির্জা থেকে চুরি করা সমুদয় অর্থ সম্পদ ও দামী পন্য সামগ্রী নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সুলতান আইয়ুবী মুক্তি পণ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য খৃষ্টানদের চল্লিশ দিন সময় ধার্য করে দিয়েছিলেন। চল্লিশ দিন শেষ হয়ে গেল। দেখা গেল তখনও কয়েক হাজার গরীব খৃষ্টান শহরে রয়ে গেছে।

নব্বই বছর আগে যখন খৃষ্টানরা শহরটি দখল করেছিল তখন দেশ বিদেশ থেকে বহু খৃষ্টান এই শহরে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তারা কোনদিন আশা করেনি, আবার তাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। চল্লিশ দিন শেষ হয়ে যাওয়ার পর সুলতান আইয়ুবী এই গরীব খৃষ্টানদের কি করবেন ভাবছিলেন। তখন তাঁর ভাই সুলতান তকিউদ্দিন সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে এক আবেদন নিয়ে হাজির হলেন।

‘সম্মানিত সুলতান’। তকিউদ্দিন বললেন, ‘আপনি জানেন এই শহর জয় করতে আমি ও আমার বাহিনী কেমন ত্যাগ স্বীকার করেছি। তার বিনিময়ে আমাকে এক হাজার খৃষ্টান দাস হিসেবে দান করুন’।

‘এত দাস দিয়ে তুমি কি করবে?’ সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।

‘সেটা আমার ব্যাপার! আমি মনে মনে কোন পরিকল্পনা স্থির করেই আপনার কাছে এ আবেদন করেছি’।

সুলতান আইয়ুবী তাকে এক হাজার খৃষ্টান দাস হিসাবে দেয়ার আদেশ দান করলেন। তকিউদ্দিন এক হাজার খৃস্টানকে বেছে নিলেন। তিনি তাদের নিয়ে দাউদ গেটে গেলেন এবং সবাইকে মুক্ত করে ফিরে এলেন।

‘সম্মানিত সুলতান’। তকিউদ্দিন ফিরে এসে সুলতানকে বললেন, ‘আমি তাদের সকলকে মুক্ত করে গেটের বাইরে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। তাদের কাছে মুক্তিপণের কোন অর্থ ছিল না’।

‘আমি জানতাম তুমি তাই করবে’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘নতুবা তোমার হাতে একজন খৃষ্টানকেও দাস হিসেবে দিতাম না। মানুষ মানুষের দাস হতে পারে না, আল্লাহ্‌ তোমার এ পুণ্য কাজ গ্রহন করুন’।

এ ঘটনা কোন গল্প কথা নয়। এমন আরো অনেক ঘটনা ঐতিহাসিকরা তাদের বইতে বর্ণনা করেছেন।

এ রকম আরেকটি ঘটনাঃ খৃষ্টান মেয়েদের একটি দল সুলতান আইয়ুবীর কাছে গেল। এরা সকলেই সেই সব ক্রুসেড সৈন্যদের স্ত্রী, মা ,বোন ও কন্যা ছিল যারা এই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল বা যুদ্ধবন্দী হিসাবে সুলতানের কাছে বন্দী ছিল। তাদের কাছে মুক্তিপণের কোন টাকা ছিল না।

তারা সুলতানের কাছে তাদের দুঃখের কথা তুলে ধরলো। সুলতান আইয়ুবী তাদের বললেন, ‘তোমাদের মুক্তি পণের টাকা দিতে হবে না। আমি দাউদ গেটে বলে দিচ্ছি, তোমাদেরকে যেনো মুক্তিপণ ছাড়াই বাইরে যেতে দেয়া হয় এবং আরো বলে দিচ্ছি, তোমাদের প্রত্যেককেই যেনো কিছু অর্থ সাহায্য হিসেবে দেয়া হয়’। তারা ফটকে পৌঁছলে সেখানকার অফিসার তাদের নাম ধরে ডাকলো এবং প্রত্যেকের হাতে কিছু নগদ অর্থ দিয়ে তাদের বিদায় করলো।

এরপর তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘যে সব খৃষ্টান এখনও শহরে রয়ে গেছে তাদের কোন মুক্তিপণ লাগবে না। তাদের মুক্তিপণ মাফ করে দেয়া হলো। তারা বিনা বাধায় নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেতে পারবে। যুদ্ধবন্দী হিসাবে থাকবে শুধু সৈন্যরা, যারা যুদ্ধের সময় আত্মসমর্পণ করেছিল’।

এরপর সুলতান আইয়ুবী মনোনিবেশ করলেন মসজিদুল আকসার মেরামত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে। এই কাজে তিনি নিজেও সৈন্যদের সাথে মিলেমিশে সাধারন শ্রমিকের মতই চুনসুরকি ও ইট বহনের কাজ করেছেন।

১১৮৭ সালের ১৯ অক্টোবর। সেদিনটি ছিল জুম্মাবার। সুলতান আইয়ুবী জুম্মার নামাজের জন্য মসজিদে গেলেন। তিনি সেই মিম্বারটি, যেটি মরহুম সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি তৈরি করে রেখেছিলেন এবং তাঁর বিধবা স্ত্রী ও কন্যা বহন করে এনে সুলতানকে দিয়েছিলেন সেটি তিনি নিজ হাতে মসজিদুল আকসায় স্থাপন করলেন। সেদিন জুম্মার খোৎবা দান করেছিলেন দামেশকের খতিব।

এরপর সুলতান আইয়ুবী মসজিদের সাজসজ্জার প্রতি মনোনিবেশ করলেন। মর্মর পাথর এনে মসজিদের মেঝেতে সুন্দর ভাবে লাগিয়ে দিলেন এবং মসজিদটিকে এক মনোমুগ্ধকর ভবনে রূপান্তরিত করলেন।

যে সব মূল্যবান ও সুন্দর পাথর সুলতান আইয়ুবী নিজ হাতেই ওখানে স্থাপন করেন আজও সেই পাথরগুলো সেখানেই আছে এবং তার সৌন্দর্য আজও ম্লান হয়নি।

বায়তুল মোকাদ্দাসের বিজয় ইসলামের ইতিহাসে এক বিরাট সফলতার মাইলফলক। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে সুলতান আইয়ুবীর সংগ্রাম ও সাধনা শেষ হলেও তিনি যে ক্রুসেডের মোকাবেলা করেছিলেন সেই ক্রুসেড এখনও শেষ হয়নি। আজো পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে ঘোষিত ও অঘোষিত ক্রুসেড।

তিনি আরব ভূমি ও ফিলিস্তিনকে ক্রুসেড বাহিনীর রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার অবর্তমানে ফিলিস্তিন, ইরাক এবং আরবের বিভিন্ন দেশে চলছে ক্রুসেড বাহিনীর নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ।

শুধু আরব দেশই নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত মুসলমানদের জানমালও আজ নিরাপত্তাহীন। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঘাড়ে আজো চেপে আছে বেহায়া সাম্রাজ্যবাদের সিন্দাবাদী দৈত্য।

তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসকে এক মজবুত কেল্লা ও মুজাহিদদের সুদৃঢ় ঘাঁটি বানাতে চেয়েছিলেন। এ জন্য এই পবিত্র স্থানে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক সমৃদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র। কিন্তু আজ সেখানে আবার গেড়ে বসেছে নাসারাদের দোসর ও উপদেষ্টা অভিশপ্ত ইহুদীরা।

৫ রমজান ৫৮৩ হিজরী মুতাবেক ৮ নভেম্বর ১১৮৭ খৃষ্টাব্দ। সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে স্বসৈন্যে যাত্রা করলেন। তাঁর গতি ছিল উত্তরের দিকে।

বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে বেরিয়েই তিনি তাঁর সন্তান আল মালেক আল জাহেরকে সংবাদ পাঠালেন খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর কাছে চলে আসে। সুলতান তাকে আরো জানালেন, ‘আমি টায়ারে যাচ্ছি। পথে দেখা না হলে তুমি সেনাবাহিনীসহ টায়ারে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে’।

সুলতান তখন টায়ারে আক্রমণ করতে যাচ্ছিলেন। টায়ার ভুমধ্যসাগর তীরের এক সমৃদ্ধ সমুদ্র বন্দর। বন্দরটি ছিল খৃষ্টানদের মজবুত ঘাঁটি। এখানে তাদের একাধিক রণতরীও ছিল।

সুলতান আইয়ুবী তাঁর নৌবাহিনীর কমাণ্ডার এডমিরাল আল ফারেসকে সংবাদ পাঠালেন, সে যেন টায়ার বন্দরের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। তিনি যখন টায়ারে আক্রমণ ও অবরোধ করবেন তখন যেন আল ফারেস টায়ারে বন্দরে অবস্থানরত খৃষ্টান নৌবহরের উপর আক্রমণ করে।

দুটি মেয়েই তখনো আল ফারেসের জাহাজে ছিল। হাসান বিন আবদুল্লাহর গোয়েন্দা তখন সেখানে ছিল না।

বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয়ের পর হাসান বিন আব্দুল্লাহ আবার তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন তাঁর মনে পড়ে গেলো, আল ফারেসের জাহাজে তাঁর এক গোয়েন্দা রয়েছে। তিনি আবার এক কাসেদকে রউফ কুর্দির কাছে পাঠালেন।

কাসেদকে বললেন, ‘ওখানে আমাদের যে গোয়েন্দা আছে এখনো সে কি করছে দেখে এসো। রউফ কুর্দিকে বলবে, প্রয়োজন না থাকলে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে’।

সে লোক হুকুম পেয়ে জাহাজে পৌঁছলো। রউফ কুর্দির কাছে জানতে চাইলো গোয়েন্দার খবর। রউফ কুর্দি তাকে জানালো, ‘ হাসান বিন আবদুল্লাহ যে গোয়েন্দাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন সে তো অনেকদিন আগেই চলে গেছে’।

কিছুদিন আগের কথা। সেই গোয়েন্দা রউফ কুর্দিকে একদিন জানালো, সে মেয়ে দুটিকে আর এখানে থাকতে দেবে না। কারণ সে এখন নিশ্চিত, এরা খৃষ্টানদের গোয়েন্দা।

তার এমন ধারনার কারণ, সে লক্ষ্য করেছে, যখন জাহাজ কুলের দিকে নোঙ্গর করা থাকে তখন জেলের বেশে ছোট ছোট নৌকায় করে কিছু লোক সেখানে আসে ফলমূল ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করতে। তাদের মধ্যে এক লোককে সে তিন চার জায়গায় দেখতে পেলো। মেয়ে দুটি প্রতিবারই তাকে রশির মই নামিয়ে উপরে তুলে নেয়। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে জিনিশ কেনার পরিবর্তে তার সাথে কি যেন পরামর্শ করে।

জাহাজ দশ বারো মাইল দূরে থাকলেও লোকটি ঝুঁকি নিয়ে সেখানে যায়। ফলে লোকটাকে গোয়েন্দার সন্দেহ হলো। ফ্লোরী ততো দিনে রউফ কুর্দির বুদ্ধি বিবেক পুরোপুরিই কিনে নিয়েছিল। সে তার কাছে নানা রকম গোপন তথ্য জানতে চাইতো। রউফ কুর্দি তাকে আপন মনে করে সব কিছু বলে দিত নির্ভয়ে।

আল ফারেস তখন খুব ব্যস্ত। তিনি নিয়মিত অন্য জাহাজে চলে যান তাদের খোঁজ খবর নিতে। সেদিন রাতেও তিনি তার দায়িত্ব পালনের জন্য অন্য জাহাজে চলে গিয়েছিলেন।

সেই রাতে রউফ কুর্দি যখন ফ্লোরীর প্রেমে মত্ত তখন সে ফ্লোরীকে বললো, ‘জাহাজে এক বিপজ্জনক লোক আছে। তার সাথে কোন কথা বলবে না’।