মুসলমান চার মেয়ে চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছিল এই বাগাড়ম্বর। এ ছাড়া তাদের করার কিছুই ছিল না।
খৃস্টান এক মেয়ে এ সময় আবার বলে উঠল, ’শুনেছি সম্রাট তাদের বিয়ে করে বউ বানাবে। আহলে কিতাবদের মধ্যে বিয়ে জায়েজ করা হয়েছে কোরানেও। সুতরাং তোমাদের আর অসুবিধা কি!’
এ সময় এক মুসলমান মেয়ে বলে উঠল, ‘খোদার দোহাই লাগে, ভণ্ডামী করার জন্য ধর্মকে টেনে এনো না।’
ফোঁস করে টিপ্পনি কাটল এক খৃস্টান মেয়ে, ‘ঠিকই তো বলেছে সে। শুধু শুধু ধর্ম নিয়ে টানাটানি করছিস কেন! মেয়েদের আবার ধর্ম কি! মেয়েরা তো পানির মত। যেই পাত্রে রাখো সেই রং ধারণ করে। মেয়ে মানুষও তেমনি। স্বামী হোক আর যেই হোক, যার অধীনে সে থাকে, সেই মানুষটাই তার প্রভু। সে লোকের ধর্মই তার ধর্ম। যে ব্যক্তি দেশের রাজা তিনি তো আমাদের দেহেরও রাজা, মনেরও রাজা।’
এ ভাবেই চার মুসলিম মেয়েকে বিপথগামী করার জন্য চার খৃস্টান মেয়ে উঠেপড়ে লাগল। বিলডন তাদের ডেকে বলল, ‘এই মেয়েদের ওপর কোন কঠোরতা আরোপ করবে না। তাদের ওপর নির্যাতন চালাবে না। কোন রকম কষ্ট দেবে না। তাদেরকে কখনো ধমক দিয়ে কথা বলবে না।’ বিলডন আরো বলল, ‘এরা খুবই সুন্দরী ও নব যুবতী। এদেরকে ট্রেনিং দিয়ে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আমি এই মেয়েদেরকে শুধু বিলাস ও ভোগের সামগ্রী বানাতে চাই না। দরকার হলে এদের সাথে আপন কন্যাদের মত ব্যবহার করো। দরকার হলে ওদের উত্তম বান্ধবী হও তোমরা। তাদেরকে রাজকুমারীর মত বিলাস সামগ্রী সরবরাহ করো। তাদের মনে স্বপ্নের আলপনা আঁকো! কথায় কথায় তাদেরকে আকাশের তারা বানিয়ে দাও।’
এই চার মুসলিম মেয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। এক মেয়ে বলল, “ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে আমাদের সম্ভ্রমের কোরবানী দিতেই হবে।’
‘তার আগে আমরা এদের হাত থেকে পালাতে পারি না?’
‘সেটা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। তারচে এখানে থেকেই এদের ওপর আমাদের প্রতিশোধ নেয়া উচিত।’ অপর মেয়ে বললো।
‘কিন্তু প্রতিশোধ নেয়া ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যে পর্যন্ত ওরা আমাদেরকে তাদের প্রতি আন্তরিক ও বিশ্বস্ত না পাবে।’ প্রথম মেয়েটি বললো, “ওদেরকে বুঝাতে হবে, আমরা ওদের বশ্যতা মেনে নিয়েছি এবং তাদের ভাগ্যের সাথেই আমাদের ভাগ্য জুড়ে দিয়েছি।’
‘আমার পিতা সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনীতে আছেন।’ অপর মেয়েটি বললো, ‘তিনি বর্তমানে মিশরে আছেন। তিনি বলেছিলেন, কাফের মেয়েরা জাতির জন্য তাদের মান-সম্ভ্রম পর্যন্ত বিলিয়ে দেয়। তারা আমাদের বড় বড় আমীর ও অফিসারদের হাতে তাদের ইজ্জত তুলে দিয়ে তাদেরকে ক্রুসেড বাহিনীর তাবেদার বানিয়ে নেয়। যদি কাউকে হত্যা করার ইচ্ছা থাকে, সেই তাবেদারকে দিয়েই তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আমাদের সেনাবাহিনীর গোপন তথ্য জেনে নিয়ে তারা খৃস্টানদের কাছে পৌঁছে দেয়।’
‘আমি তা জানি।’ তার সাথী অন্য মেয়েটি বললো, ‘সেই মেয়েরা এমন কাজ করে যা আমাদের পুরুষ গোয়েন্দারা শত্রুর দেশে গিয়ে করে থাকে।’ এ কথা বলেই সে চুপ হয়ে গেল এবং এদিক-ওদিক তাকিয়ে লক্ষ্য করলো আশেপাশে কেউ আছে কিনা, কেউ গোপনে তাদের কথা শুনছে কিনা। আশেপাশে কেউ নেই দেখে সে বললো, ‘যদি আমরা বলি, আমরা তাদের বশ্যতা মেনে নিয়েছি, তাতে এমন সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে, আমরা একদিন সম্রাটকেও হত্যা করতে পারবো।’
‘আর কিছু না হোক পালানোর সুযোগ তো পাবো।’ অন্য মেয়েটি বললো।
যে রাতে বিলডনের সেনাবাহিনী হিম্মত দুর্গ অবরোধ করেছিল, তার দুই রাত আগের কথা। মুসলমান মেয়েরা খৃষ্টান মেয়েদের বলল, ‘আচ্ছা, আমরা বিধর্মী হওয়ার পরও তোমরা আমাদের এমন আদর যত্ন করো কেন?’
‘বাহ, তাতে কি হয়েছে, তোমাদের আর আমাদের খোদা তো একজনই। তোমাকে যে আল্লাহ সৃষ্টি করেছে, আমাকেও তো সে আল্লাহই বানিয়েছে। তাহলে ধর্মের কারণে আমরা তোমাদের দূরে ঠেলে ফেলবো কেন?”
‘ভাল কথা বলেছো তো! তোমরা যদি আমাদের এতটাই আপন করে নিতে পারো, তাহলে আমরাই বা দূরে থাকবো কেন? আমরা যদি আমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে তোমাদের ধর্ম গ্রহণ করতে চাই, সে সুযোগ আমাদের দেবে?’
‘কেন নয়? তোমরা চাইলে অবশ্যই তা সম্ভব।’
খৃস্টান মেয়েরা তখনি সে কথা সম্রাট বিলডনকে জানালো। খুশী হয়ে সম্রাট বিলডন চার মেয়েকে চারটি মূল্যবান হার দান করলেন। তারপর তাদের ডেকে চার মেয়ের গলায় ছোট ছোট চারটি ক্রুশ ঝুলিয়ে দিলেন।
কিন্তু তিনি খৃস্টান মেয়েদের আলাদা ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আমি এই চারজনের হাতে কোন খানাপিনা করবো না। কারণ তারা ভয়ের কারণে ধর্ম পরিবর্তন করেছে, নাকি মন থেকে করেছে, আগে বুঝতে হবে। ধর্ম পরিবর্তনের কথা মুখে বলা যত সহজ মন থেকে মেনে নেয়া তত সহজ নয়। তবে তারা যখন বলেছে, তাদের মন জয় করতে চেষ্টা করো। মুসলমানকে কেনা সহজ কিন্তু তাকে বিশ্বাস করা ও তার উপর ভরসা করা কঠিন ব্যাপার! যে মুসলমান বলিষ্ঠ ঈমানের অধিকারী, তারা এমন কঠিন কঠিন কোরবানী ও ত্যাগ স্বীকার করে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এই মেয়েদের উপর কড়া দৃষ্টি রাখবে, যেন কোথাও পালিয়ে যেতে না পারে। সতর্ক থাকবে, যেন সুযোগ মত আমাদের উপর আঘাত হেনে ক্ষতি না করে।’
অবরোধের প্রথম রাত। এই চার মেয়ে পৃথক এক তাঁবুতে শুয়ে ছিল। বিলডনও তাদের সাথে কিছুক্ষণ হাসি-তামাশা করে নিজের তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন।
কমাণ্ডার ও সৈন্যরা ক্লান্তি ও অবসাদের কারণে শোয়ার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। শুধু ক্যাম্প প্রহরী ও বিলডনের দেহরক্ষী চার-পাঁচজন জেগে ছিল।
হিম্মত পর্বতশৃঙ্গের পাশে এক সবুজ শ্যামল প্রান্তর। এই প্রান্তরে কমবেশী এক হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে ঘাপটি মেরে বসেছিলেন সুলতান তকিউদ্দিন। রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমে এলো। রাত বাড়তে লাগল একটু একটু করে। মধ্যরাতের সামান্য আগে সুলতান তকিউদ্দিন গোপন সংকেত দিলেন।
আস্তে পা টিপে টিপে সেই প্রান্তর থেকে গোপনে বের হয়ে গেল সেই সেনাবাহিনী। কমাণ্ডার তাদেরকে ছোট ছোট সৈন্য দলে বিভক্ত করে ছড়িয়ে দিলো। রাতের নিস্তব্ধতা যেন নষ্ট না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল সেই কাফেলা। তারা সামনে অগ্রসর হয়ে বিলডনের সেনা ক্যাম্প ঘেরাও করে দাঁড়াল।
এই সে সেনাদল, যাদেরকে নিয়ে তকিউদ্দিন হিম্মত কেল্লা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কেল্লায় সামান্য সৈন্যই রেখেছিলেন তিনি। তার বিশ্বাস সত্যে পরিণত হলো। তিনি ধারণা করেছিলেন, ক্রুসেড বাহিনী হিম্মত কেল্লা অবরোধ করবে। সুতরাং তিনি তার মূল সেনাশক্তি হিম্মত পর্বতের পাশে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কেল্লায় যারা ছিল তাদের অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘খৃস্টান বাহিনী তোমাদের অবরোধ করলে ভয় পেয়ো না। তাদের সাথে তোমাদের নয়, লড়াই হবে আমাদের। ওরা তোমাদের অবরোধ করলে আমরা তাদের ওপর মরু সাইমুমের ঝড় হয়ে ছুটে আসবো।’
এ জন্যই কেল্লাধিপতি ক্রুসেড বাহিনীর চ্যালেঞ্জের বীরোচিত উত্তর দিয়েছিলেন। তার বলিষ্ঠ ভাষা ও সাহসিকতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সম্রাট বিলডন।
এই কেল্লার অধিপতি ছিলেন তকিউদ্দিনের মামা শিহাবুদ্দিন আল হাশমী।
রাতে তকিউদ্দিনের এক হাজার পদাতিক সৈন্য ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে কমাণ্ডো আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলো। তারপর তকিউদ্দিনের ইঙ্গিত পাওয়ার সাথে সাথে প্রথমে তারা তাঁবুর রশি ও দড়িদড়া দ্রুত হাতে কেটে ফেললো। তারপর ওপর থেকে বর্শাবিদ্ধ করে মাছ মারার মত ক্রুসেডদের বিদ্ধ করতে লাগলো। তাঁবুর নিচে ঘুমন্ত সৈন্যরা টেরই পেল না, কোন ফাঁকে মৃত্যু এসে তাদের পরপারে পাঠিয়ে দিল।
এরা এই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পেয়েছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছ থেকে। আইয়ুবী এই যুদ্ধের নাম দিয়েছিল, ‘আঘাত করো আর পালাও!’
এতবড় বিশাল বাহিনীর সাথে মাত্র এক হাজার পদাতিক সৈন্যের সম্মুখ লড়াইয়ের প্রশ্নই আসে না। যত বড় বীর আর যোদ্ধাই হোক, হাজার হাজার মৌমাছি আঁকড়ে ধরলে সেও কুপোকাত হয়ে যায়। এই বিশাল বাহিনীর সামনে তকিউদ্দিনের বাহিনীর অবস্থা ছিল অনেকটা সেরকম। তাই তকিউদ্দিন সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি তার বাহিনীকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে বিভিন্ন গ্রুপের ওপর আলাদা দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। কিছু গ্রুপের ওপর দায়িত্ব ছিল, ক্যাম্প প্রহরীদেরকে কোন রকম আওয়াজ করার সুযোগ না দিয়ে গায়েব করে ফেলা।
কিছু গ্রুপ শত্রুদের ঘোড়া, উট ও খচ্চরের বাঁধন কেটে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিল। এ দুই কাজে শ’দুই সৈন্য রেখে বাকী আটশো সৈন্যকে তিনি প্রস্তুত রেখেছিলেন মূল আক্রমণের জন্য। এই আটশো সৈন্য ধূমকেতুর মত ঘুমন্ত বাহিনীর ওপর টুটে পড়লো। চোখের নিমিষে তারা এমন ত্রাস সৃষ্টি করলো যে, ক্রুসেড সৈন্যদের আতংকিত আর্ত চিৎকারে পুরো এলাকা নরক গুলজার হয়ে উঠল। তাদের আর্তনাদের ধ্বনি দিকদিগন্তে ছড়িয়ে পড়লো। তখনো যারা আক্রান্ত হয়নি তারা দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে দেখলো, কেয়ামতের প্রলয় শুরু হয়ে গেছে ক্যাম্পে। সহসা তারাও আর্ত চিৎকার দিয়ে ছুটাছুটি শুরু করল প্রাণ নিয়ে পালাতে। কিন্তু চিতাবাঘের মতই ক্ষিপ্রগতিতে তাদের ওপর লাফিয়ে পড়ছিল মরণজয়ী মুজাহিদরা। সহসা যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল ক্যাম্পে। আকাশ-পাতাল কেঁপে উঠলো মানুষ ও পশুর সম্মিলিত চিৎকারে।
সম্রাট বিলডন চোখ খোললেন। তার কমাণ্ডাররাও জেগে উঠলো। তাঁবুর বাইরে গিয়ে দেখতে পেলো, সেনা ক্যাম্পের তাঁবুতে সর্বত্র শুধু আগুন জ্বলছে। তকিউদ্দিনের পদাতিক বাহিনীর ছোট ছোট দলগুলো দ্রুত আঘাতের পর আঘাত করছিল আর সাথে সাথে তাঁবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। তারা আঘাত করছিল আর তাকবীর-ধ্বনি দিচ্ছিল।
এই ধ্বনি অন্য সবার মত সেই চার মুসলিম মেয়েও শুনতে পেলো। তারা বুঝতে পারলো, রাতের আঁধারে যে ফৌজ এই সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা মুসলমান।
তারা চারজন একই তাঁবুতে ছিল। একজন বলে উঠল, ‘চলো পালিয়ে যাই।’
‘না, আমি পালাবো না। আমার বুকের মধ্যে প্রতিশোধের যে আগুন জ্বলছে, এখন আমি সেই আগুন নেভাবো। আমি সম্রাট বিলডনকে হত্যা করবো।’
বিলডনের তাঁবু সেনা ক্যাম্প থেকে একটু দূরে ছিল। সেখানে মশাল জ্বলছিল। বিলডনের দেহরক্ষীরা অশ্বপৃষ্ঠে আৱোহন করে তার চারপাশে পাহারা দিচ্ছিল।
সহসা কেঁপে উঠলো সেখানকার মাটি। হাজার হাজার দুরন্ত অশ্বের মিলিত পদধ্বনি শোনা গেল। এগুলো ছিল তকিউদ্দিনের অশ্বারোহী বাহিনী। এই অশ্বারোহীর সংখ্যা মুসলমান ঐতিহাসিকগণ দুই হাজার বলে উল্লেখ করেছেন, আর খৃস্টান ঐতিহাসিকরা চার হাজার বলেছেন। এই অশ্বারোহী বাহিনী বিদ্যুৎগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ক্রুসেড বাহিনীর ওপর। এদের মোকাবেলা করার কোন প্রস্তুতিই ছিল না ক্রুসেড বাহিনীর। তারা তখনও জানতেও পারেনি, কি হচ্ছে আর কারা তাদের আক্রমণ করেছে। শুধু তাদের তকবীর ধ্বনি থেকে বুঝা যাচ্ছিল, এরা মুসলমান।
তকিউদ্দিনের অশ্বারোহীরা ক্রুসেড বাহিনীর ক্যাম্প ছিন্নভিন্ন করে হাতের কাছে যেখানে যাকে পেল ঘোড়ার পদতলে পিষে ফেলতে লাগল। যারা ঘোড়ার পায়ের তলে পড়েনি তাদেরকে তলোয়ারের আঘাতে পরপারে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। কেউ আবার বর্শায় বিদ্ধ করে তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছিল মৃত্যুর কোলে। প্রায় এক ঘন্টা এই তুফান চালানোর পর হঠাৎ কমাণ্ডার ফিরে যাওয়ার সংকেত দিল। সাথে সাথে অশ্বারোহী বাহিনী উধাও হয়ে গেল ময়দান থেকে।
বিলডনের মনে হলো, সে ভয়ংকর কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে। এটা যে বাস্তব তাই সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে দেখতে পেল, কোন প্রতিরোধ ছাড়াই একদল অশ্বারোহী এলো এবং স্বাধীনভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে চোখের নিমিষে আবার হাওয়া হয়ে গেল।
ক্রুসেড বাহিনী হিম্মত দুর্গ অবরোধ করে নিয়েছিল। সে কারণে দুর্গের দুই পাশেই তারা ক্যাম্প করেছিল। এক পাশে যখন এই কেয়ামত চলছিল কেল্লার অপর পাশের ক্রুসেড বাহিনী তখনো ছিল আক্রমণের বাইরে। তারা এদিকে শোরগোল শুনতে পেল। শুনতে পেল আহত ও মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিকদের মরণ চিৎকার। এদিকের যে দু’চার জন সৈন্য এ বিভীষিকার হাত থেকে নিজেকে কোন মতে বাঁচাতে পারল তারা ছুটল অপর পাশের সেনা ক্যাম্পে।
সেখানে পালিয়ে যারা আশ্রয় নিল তাদের কাছে ওরা জানতে চাইল কি ঘটেছে। কিন্তু ওরা যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল প্রথমে ওরা কিছুই বলতে পারল না। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে একজন বলল, ‘কি ঘটেছে আমরা জানি না। আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমাদের ওপর দিয়ে হাজার হাজার ঘোড় উট ও খচ্চরকে ছুটে যেতে দেখলাম। আমাদের অনেকে সেইসব বোবা জানোয়ারের পায়ের তলে পিষে মারা পড়ল। কেউ হয়তো আমাদের পশুগুলোর বাঁধন কেটে দিয়েছিল। সেগুলো ছুটাছুটি করে আমাদের দলিত মথিত করছিল। প্রাণ ভয়ে আমরা পালিয়ে এসেছি।’
এদিকে চারজন মুসলিম মেয়েই বেরিয়ে এলো তাদের তাঁবু থেকে। খৃস্টান সৈন্যদের নিজেদেরই তখন মরণ দশা। ফলে বন্দী মেয়েরা কে কোথায় যাচ্ছে সেদিকে নজর দেয়ার মত অবস্থা তাদের ছিল না, কেউ তাদের দিকে তাকালোও না।
মেয়েরা ছুটে গেল মুসলিম ফৌজের কাছে। তারা চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘সম্রাট বিলডন এদিকে। তোমরা আমাদের কথা শোন। বিলডনকে গ্রেফতার করো।’
কিন্তু তখন সেখানে এমন হট্টগোল চলছিল যে, মেয়েদের দিকে নজর দেয়ার মত সময় কারো ছিল না। কেউ তাদের কথা গ্রাহ্য করল না। কেউ শুনতেও পেল না তাদের চিৎকার। অশ্বারোহীরা এত দ্রুতবেগে ছুটে যাচ্ছিল যে, তাদের কানে মেয়েদের কথা পৌঁছতেই পারছিল না। এক মেয়ে ছুটে হট্টগোলের ভেতর ঢুকে গেল। মুহূর্তে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল অন্য মেয়েদের থেকে।
সে এক অশ্বারোহীর পেছনে ছুটছিল আর চিৎকার করে বলছিল, ‘ঘোড়া থামাও, আমার কথা শোন। সম্রাট বিলডন এদিকে।’
কিছু দূর যাওয়ার পর অশ্বারোহীর মনে হলো, কোন মেয়ে চিৎকার করছে। সে ক্ষিপ্রগতি ঘোড়ার বাগ টেনে ধরল।
ঘোড়ার গতি কমে এলে মেয়েটি ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল ঘোড়ার বাগ। মেয়েটি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, ‘আমি মুসলমান। আমার মত আরও তিনজন মুসলিম মেয়ে খৃস্টান সম্রাট বিলডনের বন্দীনী হয়ে ওদের সাথে আছি।’
‘কোথায় ওরা? সম্রাট বিলডন কোথায়?”
‘আমার সাথে এসো, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তার তাঁবু।’ মেয়েটি বলল।
এই অশ্বারোহী এক কমাণ্ডার ছিল। সে মেয়েটিকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে বলল, ‘কোন দিকে?’
মেয়েটি দিক নির্দেশ করল। কমাণ্ডার সেদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
কিছু দূর যাওয়ার পরই সে এক সেনাপতির সামনে পড়ে গেল। ঘোড়া থামিয়ে সে সেনাপতিকে বলল, “এই মেয়ে সম্রাট বিলডনের ক্যাম্পের খোঁজ জানে। আমি সেখানে যাচ্ছি।’
সেনাপতি বলল, ‘দাঁড়াও। সেখানে তোমার একা যাওয়া ঠিক হবে না। সেখানে নিশ্চয়ই তার রক্ষী বাহিনী আছে।’
সেনাপতি মেয়েটির কথা শুনলো। মেয়েটি সম্রাট বিলডনের তাঁবুর দিক নির্দেশ করে বলল, সেখানে আমার মত আরও তিনটি মুসলিম মেয়ে আছে।’
সেনাপতি সম্রাট বিলডনের তাঁবুতে কমাণ্ডো আক্রমণ চালানোর জন্য দু’টি কমাণ্ডা গ্রুপকে সঙ্গে দিলেন তার। কমাণ্ডারের নেতৃত্বে এই বাহিনী অনতিবিলম্বে বিলডনের তাঁবুর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল এবং দ্রুত সেখানে গিয়ে পৌঁছল।
তারা বিলডনের তাঁবু অবরোধ করে দাঁড়াল। কমাণ্ডার সম্রাট বিলডনকে চ্যালেঞ্জ করলো, তার ক্যাম্পে আগুন লাগানোর হুমকি দিল। কিন্তু, কেউ তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল না, কেউ তার হুমকীর কোন জবাবও দিল না।
কমাণ্ডার দুই সৈন্যকে তাঁবুতে ঢুকার হুকুম দিল। তারা তাঁবুতে ঢুকে দেখতে পেল, বিলডন সেখানে নেই। তার বডিগার্ডরাও কেউ নেই যে, অস্ত্র সমর্পণ করতে আসবে।
তারা আশপাশের তাবুগুলোতে তল্লাশী চালিয়ে কিছু মেয়ে, সেই মুসলিম মেয়ে তিনটি এবং কয়েকজন চাকর-বাকর ও রক্ষীর সন্ধান পেল। কমাণ্ডার তাদের সকলকেই গ্রেফতার করে সেনাপতির সামনে হাজির করল।
বন্দীদের কাছে বিলডন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো সেনাপতি, কিন্তু কেউ তার হদিস বলতে পারলো না।
বিলডন ভয় পেয়ে ততক্ষণে পালিয়ে গেছেন। ঘুম থেকে জেগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এটা মুসলিম কমাণ্ডো বাহিনীর কাজ। এ অবস্থায় তার করার কিছুই ছিল না। তিনি যখন দেখলেন, তার বাহিনী কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে কেবল চিৎকার ও ছুটাছুটি করছে, তখনই তিনি পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তার রক্ষী বাহিনী নিয়ে চুপিসারে সেখান থেকে সটকে পড়লেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরই তিনি এক কমাণ্ডো গ্রুপের সামনে পড়ে গেলেন। এই গ্রুপের দায়িত্ব ছিল, কেউ এ পথে পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে বাঁধা দান করা।
সম্রাট বিলডন এই বাহিনীর সামনে পড়ে বুঝতে পারলেন, মুসলিম বাহিনী তাদের পালাবার পথও বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি আর সামনে অগ্রসর হওয়ার সাহস পেলেন না। বাধ্য হয়ে তিনি আবার তার ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহরক্ষীরাও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল।
তিনি তার ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এ সময় তার এক পলাতক অশ্বারোহী সামনে পড়ে গেল। সেই অশ্বারোহী তাকে বললো, ‘আপনি অন্য কোথাও চলে যান, ক্যাম্পে আর যাবেন না। কারণ সেখানে মুসলমান সৈন্যরা পৌঁছে গেছে।’ বিলডন সেখান থেকেই ঘোড়ার গতি আবার অন্যদিকে ফিরিয়ে দিলেন।
যে অশ্বারোহী বাহিনী এতক্ষণ ক্রুসেড বাহিনীর একাংশের ওপর প্রলয়কাণ্ড ঘটাচ্ছিল, মুহূর্তে তারা সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল। একটু পর একই রকম ডাক-চিৎকার শুরু হলো ক্রুসেড বাহিনীর অপর অংশ থেকে। সেখানেও সিংহ বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রথমে তকিউদ্দিনের পদাতিক বাহিনী ও পরে অশ্বারোহী বাহিনী।
তকিউদ্দিনের পদাতিক বাহিনী এই বাহিনীর ওপর আঘাত হানতে এসে তুমুল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। কারণ তখন তারা জেনে গিয়েছিল, মুসলিম বাহিনী রাতের অন্ধকার অগ্রাহ্য করে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যদি সময় মতো অশ্বারোহী বাহিনী এসে না পড়তো, তবে পদাতিক বাহিনী বড় রকমের বেকায়দায় পড়ে যেতো। এরই মধ্যে অনেকে শহীদ হয়ে গিয়েছিল, অনেকে আহত হয়েছিল।
সারা রাত তকিউদ্দিনের বাহিনী ‘আঘাত হানো আর পালাও!’ যুদ্ধে লিপ্ত রইল। যখন ভোর হলো, দেখা গেল, হিম্মত দুর্গের আশপাশে ছড়িয়ে আছে খৃস্টানদের অগণিত লাশ। চারদিকে লাল রক্তের ছড়াছড়ি। বহু আহত সৈন্য পালাতে না পেরে মরণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
এসব লাশ ও আহত সৈন্যদের মধ্যে তকিউদ্দিনের মুসলিম মুজাহিদরাও ছিল। খৃস্টানদের উট, ঘোড়া ও খচ্চরগুলো দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে চড়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু সেখানে বিলডনও ছিল না, তার সেনাবাহিনী বা বডিগার্ডরাও ছিল না। ক্রুসেড বাহিনী তাদের বিস্তর রসদপত্র ফেলে পালিয়ে গেছে।
তকিউদ্দিন তার বাহিনীকে আদেশ দিলেন, আহতদের সেবা ও চিকিৎসা করতে। আরেকটি দলকে হুকুম দিলেন, সকল মৃত ব্যক্তি ও শহীদ সৈন্যদের দাফনের ব্যবস্থা করতে। অন্য একটি দলকে বললেন, দুশমনের ফেলে যাওয়া মাল সামান সব এক জায়গায় জমা করো। তাদের যে পশুগুলো বেওয়ারিশ অবস্থায় মরুভূমিতে ও পাহাড়ের আশেপাশে চড়ে বেড়াচ্ছে, সেগুলো ধরে এনে বেঁধে রাখো।
তকিউদ্দিনের এ আক্রমণ ছিল অসাধারণ সাহস ও বীরত্বপূর্ণ কাজ। যুদ্ধের কলা-কৌশল, আবেগ ও জোশের দিক থেকে এ আক্রমণ ছিল অনন্য ও অসাধারণ। কিন্তু এ যুদ্ধের ফলাফল বা লাভ-ক্ষতির দিক বিবেচনা করে ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, শত্রু বাহিনী যখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাচ্ছিল, সে সময় যদি তাদের পিছু ধাওয়া করে তাদের সামরিক শক্তি একেবারে ধ্বংস করে দেয়া যেতো তবেই এ সফলতা পূর্ণাঙ্গ হতো।
তাছাড়া তকিউদ্দিন যদি আরেকটু সাহসিকতা প্রদর্শন করে অধিকৃত এলাকায় অগ্রাভিযান চালাতে এবং নিজস্ব বন্দীদের মুক্ত করার ব্যবস্থা করতো তবে ক্রুসেড বাহিনীর সাধ্য ছিল না তাদের প্রতিরোধ করে।
কিন্তু সুলতান তকিউদ্দিন এ ঝুঁকি নিতে চাননি। কারণ তার হাতে পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না। যেটুকু বিজয় অর্জিত হয়েছে সেটুকু হাতছাড়া হয়ে যাক, তা তিনি চাননি। কমাণ্ডো হামলা করে আঁধার রাতে ঘুমন্ত বিশাল বাহিনীকে লণ্ডভণ্ড করা আর বিশাল এলাকায় নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এক কথা নয়। কিন্তু এটুকু বিজয়ও কম সফলতা ছিল না। রমলার পরাজয়। মুসলমান সৈন্যদের মনে যে অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছিল এই বিজয়ের ফলে তা দূর হয়ে গেল। তারা আবার নতুন প্রেরণা ও আবেগ নিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠল। আইয়ুবীর পরাজয় এবং খৃস্টানদের বিশাল বহর দেখে জনমনে এবং সৈন্যদের মধ্যে যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল এই বিজয় তা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিল। খৃস্টানরা মুসলমানদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী এই ধারনার পরিবর্তে বিজয়ের মালিক যে আল্লাহ এই ধারনা আবার তাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এই আস্থা ফিরে এলো যে, এখন তারা খৃস্টানদেরকে যে কোন ময়দানে পরাজিত করতে পারবে। এখন প্রয়োজন সৈন্য বাড়ানো।
খৃস্টানরা এ যুদ্ধে বড় রকমের ধাক্কা খেল। তারা ভেবেছিল, আইয়ুবী যখন পরাজিত হয়েছে তখন তাদের অগ্রগতি আর কোথাও বাঁধাপ্রাপ্ত হবে না। তারা স্রোতের মত সমগ্র মুসলিম সালতানাতে খৃস্টবাদের বন্যা বইয়ে দেবে। অধিকৃত অঞ্চলগুলো ভাগ বাটোয়ারা করে নেবে নিজেদের মধ্যে। আর এ বাটোয়ারার মূলনীতি হবে, যে যতটুকু অঞ্চল দখল করতে পারবে, সেটুকু তার অঞ্চল বলে গণ্য হবে।
কিন্তু এই ব্যর্থতা তাদের অগ্রাভিযানের গতি থামিয়ে দিল। খৃস্টান সৈন্যরা বিজয় যতটা সহজ ভেবেছিল, তত তেলতেলে আর রইল না। মুসলমানরা যুদ্ধের সময় অলৌকিক ও কুদরতি সাহায্য পায় বলে খৃস্টান সৈন্যদের মনে সব সময়ই যে ভীতি কাজ করতো, সেই ভীতিটা আবার তাদের পেয়ে বসল। সবচেয়ে বড় কথা হল, যে হিম্মত দুর্গ নিয়ে এ লড়াই হলো, সে দুর্গ মুসলমানদের হাতেই রয়ে গেল। খৃষ্টান বাহিনীকে এগুতে হলে এ দুর্গের পতন ঘটিয়েই সামনে এগুতে হবে। কিন্তু এ দুর্গ দখল করা কতটা কঠিন, আর কেউ না হলেও খৃস্টান সম্রাট বিলডন তা হাড়ে হাড়ে টের পেল।
যুদ্ধের পর দিন। সুলতান তকিউদ্দিন তার হেডকোয়ার্টারে বসে আফসোস করছিলেন। তার সেনাপতিদের অবস্থাও ছিল উত্তেজনা ও আবেগে পরিপূর্ণ। তকিউদ্দিন বলছিলেন, ‘যদি আমার কাছে আরও কিছু সৈন্য থাকতো, তবে কমাণ্ডো আক্রমণের এই সফলতার পর আরো বড় ধরনের বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারতাম। সম্রাট বিলডন তার বাহিনীর কিছুই ফেরত নিতে পারতেন না। হয় তারা মারা যেত, নয় বন্দী হতো।’
একই রকমের আক্ষেপ ধ্বনিত হচ্ছিল তার সেনা অফিসারদের কণ্ঠ থেকেও।
তকিউদ্দিন তার কাতেবকে ডাকালেন। তিনি তার বড় ভাই সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে চিঠি লিখতে বসলেন। তিনি লিখলেনঃ
শ্রদ্ধেয় বড় ভাই, মিশরের সম্মানিত সুলতান!
‘আল্লাহ আপনাকে ইসলামী সাম্রাজ্যের শক্তি ও সম্মান বৃদ্ধি করার জন্য আরো দীর্ঘ কাল বাঁচিয়ে রাখুন। আমি এই আশা নিয়েই চিঠি লিখছি, আপনি সুস্থ্য ও মঙ্গল মতেই কায়রো পৌঁছে গেছেন। প্রথমে গুজব শুনেছিলাম, আপনি নাকি শহীদ হয়ে গেছেন। পরে জানতে পারলাম, আপনি সামান্য আহত হয়েছেন। আমি ও আমার সেনাপতিগণ আপনার প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য খুবই উদগ্রীব ছিলাম। আপনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কাসেদ মারফত আপনার জীবিত ও সুস্থ্য থাকার খবর আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন বলে আমরা কৃতজ্ঞ।
আমি আশা রাখি, আপনি রমলার আকস্মিক পরাজয়ের ব্যথা অন্তরে লালন করে নিজেকে কষ্ট দেবেন না। আমরা ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবো। হারানো এলাকা আবার উদ্ধার করবো এবং বায়তুল মুকাদ্দাসও আমরা মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। আপনি পরাজয়ের কারণগুলো অবশ্যই খুঁটিয়ে দেখছেন। আমি এ ত্রুটি সৈন্যদের ওপর চাপাতে চাই না। আমাদের পরাজয় দেখার জন্য আমাদের ভাইয়েরা যেদিন থেকে দলবদ্ধ হয়েছিল, সেদিন থেকে তারা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অস্ত্রধারণ করেছিল। যখন দুই ভাই পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তখন শত্রুরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও দরদ দেখিয়ে গোপনে পরস্পরকে উত্তেজিত করতে থাকে।
আমাদের ভাইদেরকে গদি ও রাজ্যের নেশা অন্ধ করে দিয়েছিল। আমাদের যে অর্থ ও শক্তি ইসলামী সাম্রাজ্যের মজবুতির জন্য ব্যয় করা প্রয়োজন ছিল, সে সব গৃহযুদ্ধ করে আমরা শেষ করে ফেলেছি। আমাদের বিশাল সমরিক শক্তি এবং পরীক্ষিত সৈন্যরা এই যুদ্ধে নিহত বা আহত হয়ে আমাদের দুর্বল করে দিয়েছে।
বিদ্রোহীদের সৈন্য বাহিনী এই ইসলামী খেলাফতেরই সৈন্য ছিল। এই সেনাবাহিনী শুধু এ জন্যই নষ্ট হয়ে গেল যে, জাতির কিছু লোক ক্ষমতা ও গদীর লোভে নিজেদের বাদশাহ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। তারা ইসলামী খেলাফত ও হুকুমতকে নিজ নিজ অংশে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছিল। তাদের পরস্পরের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, লোভের বশে তারা নিজের পায়ে কুড়াল মারতেও প্রস্তুত।
এখন আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, জাতি যেন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে না থাকে। মাজহাবী মতপার্থক্যই কি কম বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে? রাজত্ব ভাগ-বাটোয়ারার মত জাতিকেও বিভক্ত রাখার অপচেষ্টা চলছে। আমি মনে করি, এই দলাদলিই আমাদের পরাজয়ের কারণ। দলাদলি করে গুটিকয় লোক, কিন্তু এর শাস্তি ভোগ করতে হয় সমগ্র জাতিকে। এ কথা এখন আমাদের সেনাপতি ও সামরিক অফিসাররা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। জাতির প্রতিটি নাগরিককে আজ এ কথা বুঝাতে হবে।
গৃহযুদ্ধে আমাদের শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি নষ্ট হয়ে গেলে সেই শূন্যতা আমরা পূরণ করেছি নতুন সৈন্য ভর্তি করে। অনভিজ্ঞ সৈন্যদেরকে সমরক্ষেত্রে পাঠানোর কারণেই আমাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হলো। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া সমস্ত সৈন্যই নতুন ও আনাড়ী ছিল। তাদেরকে শক্তিতে পরিণত করতে হলে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে, নিশ্চয়ই আপনি তা স্বীকার করবেন।
আমি ও আমার সেনাপতিগণ রমলার পরাজয়ের পরপরই প্রমাণ করে দিয়েছি, আমাদের সেনাবাহিনী পরাজিত হয়নি। আপনি যে পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য আমার কমাণ্ডে রেখে গিয়েছিলেন; তারা খৃস্টান বাহিনীকে হিম্মত দূর্গে ঢুকতে দেয়নি। হিম্মত দুর্গের বাইরেই আমরা তাদের কবর রচনা করেছি। অন্ধকার তাদের সহায় হয়েছিল, নইলে তাদের কাউকে আমরা পালিয়ে যাবার সুযোগ দিতাম না।
আপনি আমাকে ও আমার বাহিনীকে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সংরক্ষিত রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা এমন আকস্মিকভাবে বদলে গেল যে, আপনার আদেশ নেয়ার সুযোগও হলো না। সমরাঙ্গণে কি হচ্ছে, সেখানে আমার প্রয়োজন আছে কি না, আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি, এসব কিছু জানার আগেই আপনার পরাজয়ের খবর আমার কাছে পৌঁছে যায়।
আপনাকে সাহায্য করার জন্য তখনি আমি বাহিনী নিয়ে রওনা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার রেখে যাওয়া অভিজ্ঞ অফিসাররা আমাকে থামিয়ে দেয়। তারা আমাকে উত্তেজিত হয়ে আবেগের বশে কোন সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করে। এ জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে অশেষ উপকার করেছে।
তাদের পরামর্শেই আমি আমার সমস্ত আবেগ ও উত্তেজনা প্রশমিত করে নিলাম। তারপর ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে দেখলাম, হিম্মতের অবস্থান টিকিয়ে রাখাই এ মুহূর্তে সবচে জরুরী। আমি আমার সৈন্য দলকে সেভাবেই পরিচালনা করলাম।
আপনার পরাজয়ের খবর আমার বাহিনীকেও ভীষণভাবে আহত করেছিল। আমি আল্লাহর দরবারে তাদের মনোবল ও সাহসের জন্য প্রার্থনা করলাম। দুশমনের প্রতিটি তৎপরতা জানার জন্য আমি গোয়েন্দা লাগিয়ে দিলাম। এক গোয়েন্দা আমাকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানালো। সে বলল, সম্রাট বিলডন তার সেনাবাহিনী নিয়ে এদিকেই ছুটে আসছে। সাথে সাথে আমি আপনার কথা স্মরণ করলাম। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, যদি আমার ভাই এ পরিস্থিতিতে পড়তেন তবে কি করতেন? এ প্রশ্নের যে উত্তর পেলাম সেভাবেই আমি যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম।
বিলডন দুর্গ অবরোধ করল। সে ধরেই নিল, আমার সমস্ত বাহিনী হিম্মত দুর্গেই আশ্রয় নিয়েছে। বিলডনের বাহিনী আমাকে সদলবলে বন্দী করার জন্য হিম্মত দুর্গ অবরোধ করে বসে রইল।
আমি আপনার যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করে আমার বাহিনীর মূল অংশ আগেই দুর্গ থেকে বের করে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখলাম। কেল্লাধিপতিকে কি করতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে আমি এসে যোগ দিলাম মূল বাহিনীর সাথে। আমার আশা আল্লাহ পূরণ করলেন। সম্রাট বিলডনের সৈন্য সংখ্যা আমার বাহিনীর দশগুণেরও বেশী ছিল। রাতের বেলা আমাদের জানবাজ সৈন্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বীরের মত কমাণ্ডো আক্রমণ চালালো। নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদদের ত্যাগ, কোরবানী ও সাহসিকতার বর্ণনা দেয়ার ভাষা আমার নেই। শুধু এতটুকু বলব, জয়-পরাজয়ের দায়িত্ব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে যদি কোন বাহিনী তার সমগ্র শক্তি ময়দানে হাজির করতে পারে তবে আল্লাহ কখনো তাদের নিরাশ করেন না, এই বিশ্বাসের বাস্তবতা আমি সচক্ষে দেখেছি।
যদি আপনি সে দৃশ্য দেখতেন, যে দৃশ্য আমরা সেদিন সকালে সূর্যের আলোয় দেখেছি, তবে আপনার পরাজয়ের বেদনা ও গ্লানি সত্যি ভুলে যেতেন। আমার সবচেয়ে আফসোস এই, বিলডন আমার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, তাকে আমি ধরতে পারিনি।
আমি এখন পাহাড়ের এক চূড়ায় বসে কাতিব দিয়ে চিঠি লিখাচ্ছি। এখান থেকে হিম্মত দুর্গ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে এখনও মিশরের ইসলামী পতাকা পতপত করে উড়ছে।
কেল্লার আশেপাশে ক্রুসেড সৈন্যদের লাশ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। আমি তাদের দাফন করার কথা বললেও তা শেষ করতে আরো দু’তিন দিন লেগে যাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত লাশগুলো সেখানে থাকবে কিনা আমি বলতে পারি না। কারণ হাজার হাজার শকুন আকাশে উড়ছে। শকুনেরা ভীড় করে লাশ খেতে শুরু করেছে। কোন কোন স্থান থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। এসব আগুন গত রাতে আমার কমান্ডো বাহিনী লাগিয়েছিল। বিলডনের কত সৈন্য মারা গেছে আর কত সৈন্য পালিয়ে যেতে পেরেছে, এখনও আমি সে শুমারী করতে পারিনি।
আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, বিলডন এখনি কোন প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালানোর কথা চিন্তা করতে পারবে না। কিন্তু তাই বলে আমরা অপ্রস্তুত অবস্থায় নেই। আমরা পরিপূর্ণ সতর্কতা ও প্রস্তুতি নিয়েই এখানে অপেক্ষা করছি।
আমার কাছে এখন যে পরিমাণ সৈন্য আছে আর এই পরিমাণ সৈন্য থাকলে আমি পলায়নপর ক্রুসেডদের পিছু তাড়া করতাম। আর তা করতে পারলে রমলাসহ যেটুকু অঞ্চল খৃস্টানরা দখল করে নিয়েছে তা ফিরিয়ে দিয়ে তবেই তারা নিজেদের জান বাঁচাতে পারতো। আর কিছু সৈন্য থাকলেই পরাজয়কে আমি বিজয়ে রূপান্তর করে দিতাম।
আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমার সেনাপতি, কমাণ্ডার ও সেনাবাহিনীর সমস্ত যোদ্ধাদের মনে যুদ্ধ করার বলিষ্ঠ আগ্রহ ও মনোবল রয়েছে। আমি এটাও জানি, আপনি নিশ্চিন্তে ও আরামে বসে নেই। নিশ্চয়ই আপনি নতুন সৈন্য ভর্তি ও তাদের ট্রেনিংয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
আপনি সেই ব্যস্ততা নিয়েই প্রশান্ত মনে প্রস্তুতি নিতে থাকুন। আমি সুযোগ মত কমাণ্ডো লড়াই অব্যাহত রাখবো। শত্রুদের কখনও আরামে বসে থাকতে দেবো না। এই সৈন্য নিয়ে হয়তো কোন অঞ্চল অধিকার করে ধরে রাখতে পারবো না, কিন্তু আপনি যেন প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পান সে ব্যবস্থা আমি করবো।
আমি দামেশকে ভাই শামসুদ্দিনকেও চিঠি পাঠিয়েছি, তিনি যেন কিছু সৈন্য ও সামানপত্র পাঠান। হলবে আল-মালেকুস সালেহকেও সংবাদ পাঠিয়েছি, তার সাথে আপনার যে চুক্তি হয়েছে সে চুক্তি অনুসারে সে যেন আমাকে সাহায্য পাঠায়।
আমি আপনাকে আল্লাহর উপর ভরসা করেই, এ কথা বলতে চাই, আপনি আমার সম্পর্কে কোন চিন্তা করবেন না। আমি ও আমার সঙ্গী সেনাপতিগণ আপনার মঙ্গল ও তৎপরতা সম্পর্কে জানার জন্য অধীর আগ্রহে চেয়ে আছি। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। আমরা তারই করুণার ছায়া চাচ্ছি। কারণ আমরা জানি, আমাদের সকলকে একদিন তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।’
আপনার স্নেহের ভাই তকিউদ্দিন।
তকিউদ্দিন চিঠিতে দস্তখত করে কাসেদের হাতে দিয়ে দ্রুত তা কায়রো পৌঁছে দেয়ার হুকুম দিলেন। কাসেদ সে চিঠি নিয়ে ছুটল কায়রোর পথে।
সমাপ্ত