সুলতান আইয়ুবী অফিসারকে নিয়ে যেদিক থেকে ধূলি উড়ছিল সেদিকে কিছু দূর এগিয়ে গেলেন। ততক্ষণে ধূলি মেঘ আরো কাছে চলে এসেছে। সহসা ধূলি মেঘের মধ্যে দু’টি অশ্ব দেখা গেল।
অশ্বারোহীরা আরো কাছে এলে তিনি একজনকে চিনতে পারলেন। একটি অশ্বের উপর ছিলেন আলী বিন সুফিয়ান, অপর আরোহীকে তিনি চিনতে পারলেন না। সে ছিল ত্রিপলী থেকে ইমাম সাহেবের পাঠানো সেই গোয়েন্দা, যে ত্রিপলী থেকে রওনা দিয়েছিল উটের আরোহী হয়ে।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বেশ কিছু দিন পর সে কায়রো এসে পৌঁছে। আলী বিন সুফিয়ান তার কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়ে দেরী না করেই তাকে নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসলেন। উদ্দেশ্য, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ রিপোর্ট সুলতান আইয়ুবীকে পৌঁছানো।
গোয়েন্দা সুলতান আইয়ুবীকে জানালো, ‘ক্রুসেড বাহিনী ঝড়ের গতিতে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের সৈন্য সমাবেশ শুরু হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশী সৈন্য নিয়ে এসেছে সম্রাট রিনাল্ট। তিনি এই বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে চান।’
‘এই সে রিনাল্ট, যাকে নূরুদ্দিন জঙ্গী গ্রেফতার করে যুদ্ধবন্দী হিসেবে কারাগারে রেখেছিলেন।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তিনি তাকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জঙ্গীর অকস্মাৎ মৃত্যুতে রিনাল্টের মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। ক্ষমতা ও অর্থ লোভী আমীররা মরহুম জঙ্গীর নাবালক সন্তানকে গদীতে বসিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য রিনাল্টকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে দেয়। আজ সেই রিনাল্টই ইসলামকে মিটিয়ে দিতে আসছে। হ্যাঁ, পরবর্তী রিপোর্ট শোনাও! তারই তো আক্রমণ করা উচিত, সে ছাড়া আর কে করবে?”
‘ত্রিপলীর সম্রাট রিমাণ্ড এই যুদ্ধের মূল পরিকল্পনাকারী। অধিকাংশ সৈন্য ওখানেই সমবেত হচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের খৃস্টান সম্রাটরা ওখানে বসেই আক্রমণের পরিকল্পনা চুড়ান্ত করছেন। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন সম্রাট বিনডন। তার সৈন্য সংখ্যাও কম নয়। ক্রুসেড বাহিনী কবে নাগাদ আক্রমণ চালাবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে আক্রমণ হবে হলব, হারান ও হিম্মতের দিক দিয়ে এই সংবাদ পাওয়া গেছে।
যুদ্ধে জেতার জন্য তারা সিরিয়াকেও ব্যবহার করবে। সিরিয়া ব্যাপক আক্রমণে না গেলেও সীমান্তে গোলযোগ সৃষ্টি করে আপনাকে ব্যতিব্যস্ত ও পেরেশান করবে। যুদ্ধের চূড়ান্ত দিন তারিখ ঠিক না হলেও শীঘ্রই তারা যুদ্ধ যাত্রা করবে, এটা বুঝা যাচ্ছে।’
‘আলী বিন সুফিয়ান!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘ত্রিপলী থেকে শেষ সংবাদ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবো আমি। সুনির্দিষ্ট দিন তারিখের খবর অবশ্যই তুমি পাবে। ওই পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে চাই। আমি জানতে চাই, তারা কোন পথে কত সৈন্য নিয়ে যাত্রা করছে।’
‘সে সংবাদের জন্য অপেক্ষা করার সময় আপনি পাবেন না সুলতান।’ আলী বিন সুফিয়ান নয়, কথাটা বললো সেই গোয়েন্দা, যে ত্রিপলী থেকে এসেছিল। ‘ক্রুসেড বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে আমাদের যে দু’জন গোয়েন্দা ছিল, তারা দু’জনেই মারা গেছে।’
রাশেদ চেঙ্গিস ও ভিক্টরের ঘটনা তুলে ধরে সে বললো, ‘সম্রাট রিনাল্ট দাবী করেছেন, তার বাহিনীতে আড়াই’শ নাইট রয়েছে।’
সুলতান আইয়ুবীর চোখ রাগে লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘যুদ্ধে প্রথম পরাজয় ঘটে যখন কোন বাহিনী প্রতিপক্ষের শক্তি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে না পারে। ইমাম সাহেব তোমাকে আর কিছু বলেছেন?”
ইমাম সাহেব জানিয়েছেন, ‘সেই দুই গোয়েন্দা মরার আগে বলে গেছে, ক্রুসেড যোদ্ধারা আপনার গেরিলা বাহিনীকে এবার আর অতর্কিত অন্ধকারে আক্রমণের সুযোগ দেবে না। তারা এমন কিছু ফন্দি এঁটেছে, যাতে কমাণ্ডো বাহিনী বেকায়দায় পড়ে যাবে।’
‘আর! আর কোন খবর আছে?’
‘আপনার দুর্বলতাটুকু জানা আছে ক্রুসেড বাহিনীর। তারা জানে, আপনার সৈন্য সংখ্যা কম। অভিজ্ঞ সেনানায়করা বিগত যুদ্ধগুলোতে হয় মারা গেছে, নয়তো পঙ্গু হয়েছে। তাছাড়া আপনার কাছে এখন যুদ্ধ উপকরণও সামান্যই আছে।’ বললো সেই গোয়েন্দা, ‘তাই তারা এবার বিশাল বাহিনী নিয়ে আসছে, যাতে আপনার বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে।’
গোয়েন্দার কাছ থেকে এই সংবাদ পাওয়ার পর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বেশী বাইরে বেরুতে দেখা যেত না। তিনি অধিকাংশ সময় তার নিজের অফিস কক্ষেই থাকতেন। কাগজের উপর সম্ভাব্য যুদ্ধের পরিকল্পনা ও নকশা আঁকতেন। সেই নকশার উপর আক্রমণের ও পাল্টা আক্রমণের রেখা আঁকতেন।
কখনও তিনি সেনাপতিদের ডেকে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। কখনও তাদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে যেতেন। তিনি তাদেরকে বলতেন, “তোমরা ভাল মত চিন্তা-ভাবনা করো। স্বাধীনভাবে সেই মতামত ব্যক্ত করো। উত্তম কোন চাল মাথায় এলে তা প্রকাশ করতে বিলম্ব করো না। এবারের লড়াই হবে বুদ্ধির। সৈন্য সংখ্যা দিয়ে এবার খৃষ্টানদের মোকাবেলা করা যাবে না। জিততে হলে কৌশল ও বুদ্ধির জোরেই জিততে হবে।’
এই সেনাপতিদের মধ্যে একজন ছিলেন ঈশা আল হেকারী। তিনি যেমন যোগ্য সেনাপতি ছিলেন, তেমনি ছিলেন পণ্ডিত ও আইনজ্ঞ। অনেক ঐতিহাসিক তাকে সুলতান আইয়ুবীর দক্ষিণ হস্ত বলে উল্লেখ করেছেন।
একদিন সুলতান আইয়ুবী হঠাৎ কোন ঘোষণা ছাড়াই সৈন্যদের যুদ্ধ যাত্রা করার হুকুম দিলেন। তিনি তাঁর বাহিনীর এক বিরাট অংশকে সুদানের সীমান্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন। কারণ ওদিক থেকে আক্রমণের যে আশংকা ব্যক্ত করছিল গোয়েন্দা, তিনি তার যৌক্তিকতা বুঝতে পারছিলেন।
সিরিয়া বর্ডারে গোলমাল সৃষ্টি করলে তাদের মদদ জোগাবে ক্রুসেড বাহিনী। এই অবস্থায় ক্রুসেড বাহিনীর মোকাবেলার জন্য তিনি মিশরের সব সৈন্যকে সঙ্গে নিতে পারছিলেন না।
তিনি যখন যুদ্ধ যাত্রা করলেন তখন, ঐতিহাসিকদের মতে তাঁর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র এক হাজার পদাতিক বাহিনী। এরা সবাই ছিল মামলুক বংশের। এরা সাহসী, বীর ও যোদ্ধা। এ ছাড়া আট হাজার ছিল অশ্বারোহী সৈন্য। এদের অধিকাংশই ছিল মিশরী ও সুদানী। ১১৬৯ সালে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে তাদের সেনা বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তাদেরকে এক উর্বর অঞ্চলে কৃষিকাজে নিয়োজিত করা হয়। এখন তারা মিশরের এমন অনুগত প্রজা, যাদের উপর ভরসা করা যায়। এই আট হাজার অশ্বারোহী ও এক হাজার পদাতিক বাহিনীর সবাই নতুন রিক্রুট করা সৈন্য।
সুলতান আইয়ুবী তাঁর নিজস্ব সৈন্য বাহিনী তার ভাই তকিউদ্দিনের নেতৃত্বে হলবে রেখে এসেছিলেন। তিনি গোপন সূত্রে জানতে পারলেন, এখনও সিরিয়ার সেনা বাহিনী সীমান্তে গোলযোগ সৃষ্টির জন্য কোন প্রস্তুতি নেয়নি।
তিনি তীব্রগতিতে হলব গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে পৌঁছেই তিনি জানতে পারলেন, ক্রুসেড বাহিনী হারান দূর্গ অবরোধ করে রেখেছে। সুলতান আইয়ুবী সেখানে দম না নিয়েই ছুটলেন হারান অভিমুখে। দূর্গ অবরোধকারী ক্রুসেড বাহিনীকে স্তম্ভিত করে তিনি সেই বাহিনীকে পাল্টা অবরোধ করে বসলেন।
সুলতান আইয়ুবীর এই অবরোধ ও আক্রমণ এমন আকস্মিক ছিল যে, ক্রুসেড বাহিনী ফিরে দাঁড়ানোর আগেই তিনি সেই বাহিনীকে তছনছ করে দিলেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ধাওয়া আর পাল্টা ধাওয়া চললো বিক্ষিপ্তভাবে। ক্রুসেড বাহিনী আর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেল না। আইয়ুবীর পাল্টা ধাওয়া খেয়ে ছিন্নভিন্ন ক্রুসেড বাহিনী পালাতে গেল। বিজয়ের স্বপ্ন নিয়ে ত্রিপলী থেকে ছুটে আসা ক্রুসেড বাহিনী পালাতে গিয়ে পড়ল মহা বেকায়দায়। এখানকার পথঘাট তাদের অচেনা, জনগণ তাদের প্রতিপক্ষ। কে তাদের আশ্রয় দেবে, কে দেবে একটু লুকানোর জায়গ?
না, তারা লুকানোর কোন জায়গা পেল না। হারানের জনগণ গণধোলাই দিয়ে তাদের ধরে এনে সুলতানের বাহিনীর হাতে সোপর্দ করতে লাগল। দেখতে দেখতে ক্রুসেড বাহিনীর বহু সৈন্য ধরা পড়লো আইয়ুবীর বাহিনীর হাতে। এই ফাঁকে বেরিয়ে এলো হারান দূর্গের সৈন্যরা। তারা শত্রু সৈন্য বন্দী করার খেলায় মেতে উঠল। বৃষ্টি হলে কৈ মাছ যেমন পানি থেকে উঠে এসে মাঠ জুড়ে ছুটতে থাকে তেমনি ছুটছিল ক্রুসেড বাহিনী। আর গ্রামের ছেলে-বুড়ো কৈ মাছ ধরার মতই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে তাদের ধরে ধরে মুসলিম বাহিনীর হাতে তুলে দিচ্ছিল।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এই সৈন্য ধরা খেলায় অংশ নিলেন না। তিনি দুর্গের সৈন্যদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করে নিজের বাহিনী নিয়ে ছুটলেন অভিযানে। ঝড়ের মত ছুটে গিয়ে খৃস্টান অধিকৃত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি লিডিয়া ও রমলা দখল করে নিলেন।
মিশরের নতুন রিক্রুট সৈন্যদের মনোবল এই বিজয়ে অনেক বেড়ে গেল। তারা ভাবলো, যুদ্ধে বিজয় লাভ করা তো তেমন কঠিন কিছু নয়! শুধু একটু সাহস ও মনোবলের দরকার। তাহলেই দুশমন ফৌজ ধরাশায়ী হয়ে যায়।
তাদের আরো মনে হলো, যেখানে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী থাকবেন, বিজয় সেখানে এসেই চুমু খাবে। তিনি যে বলেছেন, অবশেষে সত্যের সেনানীরাই বিজয়ী হয় এটাই খাঁটি কথা। আমরা লড়াই করি নামে মাত্র, মূল লড়াই তো করে আল্লাহর ফেরেশতারা। তাই বিজয় কেবল আমাদের ভাগ্যেই লেখা আছে।
এই চিন্তা নতুন সৈন্যদের ওপর দু’রকম প্রভাব ফেলল। একদল খুব বেপরোয়া হয়ে গেল। তারা ধরেই নিল, বিজয় যেহেতু আমাদের হাতে, অতএব নির্ভয়ে অস্ত্র চালাও। দুশমন শেষ পর্যন্ত আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আরেকদল এই ভাবনার কারণে অসাবধান হয়ে উঠলো। তাদের ইচ্ছা এ রকম, বিজয় তো আমাদের হবেই। অতএব ঝুঁকি এড়িয়ে গিয়ে ময়দানে একটু দাঁড়াতে পারলেই হয়। তারপর আল্লাহর সাহায্য চলে আসবে এবং আমরা বিজয় নিয়ে ময়দান থেকে আবার ঘরে ফিরে যাবো।
ক্রুসেড বাহিনী এই প্রথম নিজেদের পরিকল্পনা রেখে আইয়ুবীর স্টাইলে যুদ্ধ পরিচালনা করছিল। তারা ইচ্ছে করেই অল্প সংখ্যক সৈন্য দিয়ে হারান দুর্গ অবরোধ করেছিল। তারা জেনে শুনেই ফ্রাঙ্কিসের বাহিনীকে হারান দুর্গ অবরোধ করতে পাঠিয়েছিল। সম্রাট রিনাল্ট ও বিল্ডনের শক্তিশালী বাহিনী তখনও ছিল বেশ দূরে, রমলার কাছে এক পাহাড়ের আড়ালে। তারা জানতো সুলতান আইয়ুবী সহজেই হারানের খৃস্টান বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে। হারানে বিজয় লাভ করলে আইয়ুবী কিছুতেই সেখানে থেমে থাকবে না। সে এগিয়ে লিডিয়া ও রমলার দুর্গ দখল করতে ছুটে আসবে। আর এই সুযোগটিই গ্রহণ করতে হবে আইয়ুবীকে জন্মের মত শিক্ষা দেয়ার জন্য।
সুলতান আইয়ুবীর কাছে ত্রিপলীর গোয়েন্দা ছাড়া আর কোন গোয়েন্দা অসার সুযোগ পায়নি। তার আগেই তিনি ঝড়ের বেগে অভিযানে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ফলে খৃস্টান বাহিনীর চূড়ান্ত অভিযানের খবর আইয়ুবীর কাছে পৌঁছাতেই পারেনি।
রমলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এক নদী। নদীতে তেমন পানি ছিল না। তাই নদীর পাড় ছিল বিস্তৃত। নদীর পাশে বড় বড় বৃক্ষের সারি। নদীর সুবিস্তৃত ঢালুতে লুকিয়ে ছিল খৃস্টানদের বিশাল বাহিনী।
সেনাপতি ঈশা আল হেকারী রমলা জয় করার পর তার সৈন্যদেরকে রমলার আশেপাশে ছড়িয়ে দিলেন। হঠাৎ নদীর ঢালু পাড় বেয়ে পিঁপড়ের সারির মত উঠে এলো ক্রুসেড বাহিনী। আইয়ুবী যেমন অতর্কিতে দুশমন বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবুকিছু তছনছ করে দিতেন, তেমনি ওরা তুফান বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই বাহিনীর ওপর।
নদীর পাড়ে ক্রুসেড বাহিনী লুকিয়ে আছে এ কথা জানা ছিল না হেকারীর বাহিনীর। বিজয়ের পর তারা ঢিলেঢালা মেজাজে পাহাড়ের ঢালে, বৃক্ষের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল। কোথেকে এত ক্রুসেড সৈন্য ছুটে এল এ কথা বুঝার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল অনেক মুজাহিদ। ক্রুসেড বাহিনীর এই প্রবনের সামনে দাঁড়ায় সে শক্তি ঈশা আল হেকারীর সৈন্যদের ছিল না। ক্রুসেড বাহিনীর এ আকস্মিক হামলায় বহু সৈন্য অজ্ঞাতেই মারা পড়ল।
যারা নদী পাড় থেকে দূরে ছিল তারা তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু খৃস্টান বাহিনীর প্লাবনের মুখে খড়-কুটোর মতই ভেসে গেল তারা। যারা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আর মোকাবেলা বরার সুযোগ পেল না। ত্রিপলীর সেই গোয়েন্দার রিপোর্টই সত্য প্রমাণিত হলো, ক্রুসেড বাহিনী এবার এমন চাল চালবে, যা সুলতান আইয়ুবীর ধারনার বাইরে। আইয়ুবীর যুদ্ধের চাল বুঝে ফেলেছে খৃস্টান বাহিনী। পুরোনো চালে লড়ে আর জিততে পারবেন না আইয়ুবী।
ইবনে আসির লিখেছেন, ক্রুসেড বাহিনী নদী থেকে এমন স্রোতের মত পাড়ে প্লাবিত হতে লাগলো, যেন ঘোড়া ও জনতার স্রোত নদীর কুল ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। সুলতান আইয়ুবীর সামান্য সৈন্য সেই স্রোতের মুখে পড়ে অজ্ঞাতেই মারা গেল।’
প্রসিদ্ধ খৃস্টান ঐতিহাসিক জেমস লিখেছেন, ’সম্রাট বিলডন সুলতান আইয়ুবীর আগেই তার বিশাল বাহিনী এনে রমলা নদীর বিস্তৃত ঢালু পাড়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা বুমলা দুর্গ ও শহর দখল করে নিল। তারপর তারা শহরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লে ক্রুসেড বাহিনীর জালে আটকা পড়ল। সফল হলো ক্রুসেড বাহিনীর চাল।
সুলতান আইয়ুবী ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলো। তার বাহিনী পালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ পেল না। তারা সমানে কচুকাটা হতে লাগল। সুলতান আইয়ুবী কিছু সৈন্য একত্রিত করে তার বিশেষ কৌশল খাটাতে গেল। কিন্তু সুবিধা করতে পারল না। যুদ্ধের ময়দান খৃস্টানদের হাতেই রইল। তিনি শুধু পরাজিতই হলেন না বরং চারদিক তাকিয়ে দেখলেন, তার পালিয়ে যাওয়ার পথও বন্ধ।
সুলতান আইয়ুবীর নতুন রিক্রুট করা সৈন্যরা, যারা সহজেই কয়েকটি স্থান দখল করে নিয়েছিল, তারা ভেবেছিল, কেউ তাদের পরাজিত করতে পারবে না। কিন্তু তারা যখন খৃস্টান বাহিনীর সয়লাব ছুটে আসতে দেখল, তখন তারা কেয়ামতের প্রলয় দেখতে পেল। তারা প্রাণ নিয়ে এমন দ্রুত ময়দান ছেড়ে পালালো, যেন তারা হিংস্র বাঘের মুখে পড়ে গেছে। তারা যে পথে এসেছিল, সে পথেই আবার মিশর যাত্রা করলো। যুদ্ধ করার সাধ তাদের জন্মের মত মিটে গেল।
পলাতক সৈন্যদের মধ্যে কোন শৃংখলা ছিল না। অনভিক্ত বালকের মত তারা কেবল প্রাণপণে ছুটছিল। বিশ্ব বিজয়ী অপরাজেয় বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ভাগ্য ভাল, খৃস্টান সৈন্যরা পলায়নপর সৈন্যদের পিছু ধাওয়া করেনি। ফলে কোন ফাঁকে তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে পড়েছিলেন, টের পায়নি কেউ। তাই সে যাত্রা তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।
কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার বইতে যুদ্ধের বিবরণ লিখতে গিয়ে লিখেছেন, সুলতান আইয়ুবী আমাকে তার পরাজয়ের কারণ এইভাবে বলেছেন, ক্রুসেড বাহিনী আমার যুদ্ধের চাল আমার বাহিনীর ওপর চালিয়ে দিল। তারা ঠিক সেই সময় আমাকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে নিল, যখন আমি ও আমার বাহিনী যুদ্ধের পজিশনে ছিলাম না। দ্বিতীয় কারণ হলো, আমার সেনাবাহিনীর পার্শ্বদেশে যে সেনাদল ছিল, তারা নিজেদের মধ্যে স্থান পরিবর্তনের ব্যস্ততায় ছিল। তারা যখন এলোেমলো অবস্থায়, তক্ষুণি ক্রুসেড বাহিনী আমাদের ওপর প্রবল আক্রমণ চালালো। তাদের আক্রমণ এত কঠিন ও আকস্মিক ছিল যে, আমাদের নতুন সৈন্যরা ভীত হয়ে পালালো। পিছু হটতে গিয়ে তারা মাঝ পথে পথ হারালো ও ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমি আর তাদের একত্রিত করতে পারলাম না। শত্রুরা আমাদের অনেক সৈন্যকে ধরে যুদ্ধ বন্দী করলো। তাদের মধ্যে সেনাপতি ঈশা আল হেকাবীও ছিলেন। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে আদেশ দিলাম, যে যেভাবে পারো পালিয়ে যেতে চেষ্টা করো। পথে কোথাও না থেমে সোজা মিশরে চলে যাও।’
কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ আরো লিখেছেন, যুদ্ধের পরে সুলতান আইয়ুবী খৃস্টানদের ষাট হাজার দিনার মুক্তিপণ দিয়ে ঈশা আল হেকারীকে মুক্ত করে আনেন।
এই যুদ্ধ ৫৭৩ হিজরীর জমাদিউল উলা মুতাবেক অক্টোবর ১৯৭৭ সালে সংঘটিত হয়। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নিঃসঙ্গ অবস্থায় কায়রো পৌঁছলেন। তাঁর মাথা ছিল অবনত।
তার সাথে কোন সৈন্য ছিল না। এমনকি তার সাথে কোন রক্ষীও ছিল না। তিনি কায়রো পৌঁছেই আবার নতুন সৈন্য ভর্তি করার আদেশ জারী করলেন। তার ভাই তকিউদ্দিন ও যোগ্য সেনাপতিরা তখন হিম্মত এলাকায়।
যে রমলায় আটশো বছর আগে সুলতান আইয়ুবী ক্রুসেড বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়েছিলেন, আজও সেই রমলা ইসরাইলীদের দখলে। এই রমলা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মাত্র দশ মাইল উত্তরে অবস্থিত।
কিছুদিন আগেও এই রমলা ছিল জর্দানের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আরব ও ইসরাইলের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেই যুদ্ধে ইসরাইল জর্দানের এই অঞ্চল দখল করে নেয়।
জর্দান নদীর পশ্চিম তীর থেকে শুরু করে ইসরাইলের সীমান্ত পর্যন্ত এই এলাকা বিস্তৃত। যুদ্ধের পর কেটে গেছে তিন যুগেরও অধিক সময়, কিন্তু ইসরাইল এই আরব ভূখন্ড মুক্ত করার পরিবর্তে সেখানে আরও শক্ত করে আসন গেড়ে বসেছে। এখন তারা বলছে, ‘দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাদের এখান থেকে সরাতে পারবে না।’
তারা রমলার সেই ঐতিহাসিক অঞ্চলকে এখন মুসলমানদের বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে। যেদিন তারা এ অঞ্চল অধিকার করেছিল, সেদিন থেকেই এ অঞ্চল মুসলমানদের বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। গত কয়েক দশক ধরে রমলার বীর মুসলমানরা স্বাধীনতার দাবীতে ইসরাইল সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছে। আর ইসরাইলীরা এই সব মুসলমানকে তাদের রাইফেলের টার্গেটে পরিণত করছে।
ইসরাইলের এই একগুঁয়ে মনোভাব প্রমাণ করে, ইসরাইলীরা এ অঞ্চল কোনদিনই মুক্ত করবে না। আরবদের অনৈক্য ও শক্রতা সহায় হয়েছে তাদের, তাই ক্ষুদ্র একটি দেশ হয়েও তাদের দম্ভের কোন অন্ত নেই। মুসলিম বিশ্ব তাদের ব্যাপারে নির্বিকার। জাতিসংঘ তাদের মদদগার। ইঙ্গ-মার্কিন-রুশ চক্র তাদের সহায়। তাই আজো মানবতা মরুভূমির বিস্তৃত প্রান্তরে হাহাকার করে মরছে। মানবতা কাঁদছে বিশ্বের অলিতে গলিতে। পৃথিবীতে আজ মুসলমানের অভাব নেই। অভাব নেই তাদের সহায় ও সম্পদের। কিন্তু একজন সুলাহউদ্দিন আইয়ুবীর অভাবে কাঁদছে জগত-সংসার। কাঁদছে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, মিন্দানাও, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা।
কিন্তু আটশো বছর আগে যখন এই এলাকা খৃস্টান বাহিনীর অধিকারে চলে যায়, তখন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এক মুহূর্তের জন্য শান্তিতে বসবাস করতে পারেননি। আরাম আয়েশ ও বিলাসিতার কোন সময় পাননি তিনি। রমলার নির্যাতীত মানুষের কান্না তার রাতের আরাম ও দিনের বিশ্রাম হারাম করে দিয়েছিল। মজলুম মানুষের হাহাকার ছিনিয়ে নিয়েছিল তার সব সুখ ও শান্তি।
যুদ্ধের ময়দান থেকে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেই তিনি আবার নতুন সৈন্য ভর্তির হুকুম দিয়েছিলেন। কষ্ট ও বিপদের বোঝা মাথায় চেপে থাকলেও হতাশা, গ্রাস করতে পারেনি তাকে। পরাজয়ের গ্লানিকে তিনি উদ্যমের শাণিত তরবারী দিয়ে কেটেকুটে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন।
তাঁর সেনাদল যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছিল মিশরে। যারা আসতে পারেনি তারা খৃস্টান বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছিল। আর অবশিষ্ট সৈন্যরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে লালে লাল করে দিয়েছিল রমলার বিশাল প্রান্তর।
কিন্তু সুলতান আইয়ুবী মিশরে ফিরে এসে শুধু গুছিয়েই নেননি বরং তিনি পরাজিত এলাকায় আবার বীর বেশে ছুটে গিয়েছিলেন। যে ক্রুসেড বাহিনী তাঁর ওপর ঝড়ের মত আপতিত হয়েছিল তাদের ওপর তিনি কিয়ামত চাপিয়ে দিয়েছিলেন। রমলা আজ আবার তাকিয়ে আছে তেমনি এক নব্য সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পথের পানে। তেমনি এক বীর আবার কখন রমলার অশ্রু মুছিয়ে দিতে ছুটে আসবে এই প্রশ্ন এখন বিশ্বের বিবেকবান প্রতিটি মানুষের মনে।
সুলতান আইয়ুবীর সামনে সেদিন শুধু এই প্রশ্নই ছিল না, তিনি পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবেন এবং ক্রুসেড বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করবেন। বরং বহু বিপদ ও মুসিবত তাকে ঘেরাও করে ধরেছিল। সে সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই তাকে সামনে অগ্রসর হতে হচ্ছিল।
যে অগণিত বিপদ বাঁধা মোকাবেলা করে তাঁকে অগ্রসর হতে হচ্ছিল, তার এক নম্বরে ছিল বিশ্বাসঘাতকদের ভয়। কারণ বিশ্বাসঘাতকরাই যুগে যুগে মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল।
এ ছাড়া ছিল সুদানের দিক থেকে আক্রমণের আশংকা। কারণ সুদানীরা জানতো, সুলতান আইয়ুবীর কাছে বেশী সৈন্য নেই। যে সব সৈন্য আছে, তারা পরাজিত ও ভগ্ন হৃদয় এবং আহত।
সবচেয়ে ভয়ংকর ও বেশী ভয়ের কারণ ছিল ক্রুসেড বাহিনী। কারণ তারা সংখ্যায় ছিল অনেক বেশী। তারা রমলায় ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল।
এ ছাড়া ছিল সেই সব মুসলমান আমীর ও সুলতানদের ভয়, যারা সুলতান আইয়ুবীর বিরোধী ছিল। তারা সুলতানের পরাজয়ে যেমন খুশী হয়েছিল তেমনি আশায় ছিল, যদি সুযোগ পাওয়া যায় তবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে আবার পরাজিত করবে।
আরও একটি আশংকার কারণ ছিল খৃস্টানদের গোয়েন্দা তৎপরতা। হরমনের দক্ষ হাতের পরিচালনায় সে সময় এ ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছিল। চারদিকে শক্ত জাল বিছিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। তারা জনগণের মধ্যে মিশে গিয়ে জনমনে গুজব ছড়িয়ে জাতির মনোবল ভেঙ্গে দিচ্ছিল।
এই পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে সুলতান আইয়ুবীর ভাই সুলতান তকিউদ্দিন হিম্মত দুর্গ ছেড়ে হিম্মত পৰ্বত চূড়ায় উঠে যান তার বাহিনী নিয়ে। তিনি আশংকা করলেন, ক্রুসেড বাহিনী এই বিজয়ের পর হিম্মত দুর্গ অবরোধ করে বসতে পারে।
তার আশংকা সত্যে পরিণত হলো। ক্রুসেড বাহিনী সুলতানকে পরাজিত করে হিম্মতের দিকে অগ্রসর হলো।
তকিউদ্দিন তার ভাইয়ের মতই যোগ্য সেনাপতি ছিলেন। তার সঙ্গী-সাথী সেনাপতিরাও ছিল রণ-নিপুন, বীর এবং মর্দে মুজাহিদ। সুলতান আইয়ুবীর মতই দৃঢ় ঈমানের অধিকারী ছিল এরাও। কারণ, তকিউদ্দিনসহ এরা সবাই ছিল সুলতান আইয়ুবীর শাগরেদ। যুদ্ধের কলা-কৌশলও তারা শিখেছিল আইয়ুবীর কাছ থেকেই।
তকিউদ্দিন ও তাঁর সাথীরা একমত হলো, ক্রুসেড বাহিনী এত বড় ও এত সহজ বিজয় লাভের পর শুধু রমলা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে না। রমলা জয়ের পর তাদের প্রথম টার্গেট হবে হিম্মত।
তিনি তাঁর গোয়েন্দাদেরকে ছদ্মবেশে রমলার পথে পথে ছড়িয়ে পড়তে বললেন। এর মধ্যেই তিনি খবর পেয়ে গেলেন, তার ভাই সুলতান আইয়ুবী মিশরে চলে গেছেন।
তাঁদের ধারণা সঠিক ছিল। গোয়েন্দা এসে সংবাদ দিল, ক্রুসেড বাহিনী হিম্মতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
তকিউদ্দিন তার সৈন্যদের অবস্থা দেখলেন। আইয়ুবীর পরাজয় সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। যে বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসছে তার মোকাবেলায় তাদের ঘোড়া এবং উটের সংখ্যাও কম। খাদ্য শস্যের মজুতও সন্তোষজনক নয়। সুতরাং বাস্তব অবস্থা সামনে রেখেই তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন।
তিনি তার সৈন্যদেরকে সেই এলাকায় সরিয়ে নিলেন, যেখানে সবুজ মাঠ ছিল। খাওয়ার মত পর্যাপ্ত পানি ছিল, আর এলাকাটি ছিল পাহাড় পরিবেষ্টিত। তকিউদ্দিন সৈন্যদেরকে এক স্থানে একত্রিত করলেন।
তিনি যুদ্ধের সরঞ্জাম ও পশুর তদারকী করতে গিয়ে দেখতে পেলেন, তার ধারনার চাইতেও বেশী উট আহত। তিনি সে উটগুলো জবেহ করে সৈন্যদের বললেন, “তোমরা পেট ভর্তি করে উটের গোস্ত খাও।’
মুহূর্তে সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো এ খুশীর খবর। সৈন্যদের মধ্যে উৎসাহ উদ্যম ফিরে এলো।
রাতে তারা এক বিশাল ময়দানে উটের গোস্ত খাওয়ার উৎসবের আয়োজন করলো। সেই সন্ধ্যায়ই তিনি হলব ও দামেশকে কাসেদ মারফত সংবাদ পাঠালেন, তোমরা যে পরিমাণ রসদ, পশু ও অস্ত্র সম্ভব হয়, জলদি পাঠাও।
রাতের উৎসব জমে উঠল। সৈন্যরা পেট ভরে তৃপ্তির সাথে উটের গোস্ত আহার করল। খাওয়া দাওয়ার পর সুলতান তকিউদ্দিন এক উঁচু স্থানে উঠে দাঁড়ালেন। তার ডানে ও বায়ে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে গেলো দুই রক্ষী সেনা।
তিনি বুলন্দ আওয়াজে বললেন, ‘আল্লাহ ও রাসূলের বীর মুজাহিদবৃন্দ! তোমরা এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নাও যে, আমরা যে কারণেই হোক পরাজিত হয়েছি। তোমরা কি এই পরাজিত অবস্থায় তোমার মায়ের সামনে, তোমার বোনের সামনে, তোমার বিবি ও বাচ্চাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চাও? তোমরা কি তাদেরকে এই কথা শোনাতে চাও, আমরা আমাদের রাসূলের বিরোধীদের হাতে পরাজিত হয়ে বাড়ীতে ফিরে এসেছি? তোমরা কি মনে করো, এই খবর পেলে তারা খুশী হবে? নাকি তোমাদের মায়ের দুধের কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, পরাজয়ের খবর শোনানোর জন্যই কি আমরা তোমাদের বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছিলাম?’
তিনি একটু দম নিলেন। তারপর আবার সেই দরাজ গলায় বললেন, ‘তারা এই আশা নিয়ে ঘরে বসে আছে যে, আমাদের প্রথম কেবলা কাফেরদের কবল থেকে মুক্ত করতে আমার যে সন্তানেরা ছুটে গেছে, একদিন বিজয়ের পতাক উড়িয়ে তারা আবার ফিরে আসবে। তারা এ কথাও জানে, যে এলাকায় কাফেররা পা রাখে, সেখানে তারা মুসলমান মেয়েদের সম্মান ও সম্ভ্রম লুণ্ঠন করে। আজ রমলায় লুণ্ঠিত হচ্ছে তাদের ইজ্জত, এই ঝড়ের গতি থামাতে না পারতে কাল লুষ্ঠিত হবে আমার মা ও বোনের সম্মান। বন্ধুরা আমার! একটু গভীর ভাবে চিন্তা করো, যদি কখনে এমন দিন তোমার সামনে আসে, সে দিন কি তুমি তোমার মা ও বোনদের সামনে মুখ দেখাতে পারবে? তাই আমি বলতে চাই, আজকের এ লড়াই, আমাদের ইজ্জত ও মর্যাদার লড়াই। আজকের এ লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই, আজকের এ লড়াই আমাদের ঈমানের চূড়ান্ত পরীক্ষার লড়াই।
আমি কাউকে জোর করে লড়াইয়ের ময়দানে টেনে নিতে চাই না। জোর করে কাউকে ধরে রাখতে চাই না সত্যের এ কাফেলায়। হকের পথে এগিয়ে যাওয়ার হিম্মত যাদের আছে, তারা আমার সামনে বসো। যারা মৃত্যুকে ভয় পাও, যারা লড়াই ছেড়ে প্রাণ নিয়ে বাড়ী ফিরে যেতে চাও, তারা পৃথক হয়ে যাও। আমি স্বেচ্ছায় তাদের বাড়ী যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি। তোমাদের বাড়ী যাওয়ার পথে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না, এই নিশ্চয়তাও দিচ্ছি তোমাদের। এখন আমি তোমাদের সরে দাঁড়ানোর সুযোেগ দিচ্ছি। উঠে দাঁড়াও এবং একদিকে সরে যাও তোমরা।’
সুলতান তকিউদ্দিন চুপ করলেন। তাকিয়ে রইলেন সৈন্যদের দিকে। সৈন্যদের মাঝেও বিরাজ করছিল অখণ্ড নীরবতা। একটি সৈন্যও উঠে দাঁড়াল না। কেউ পৃথক হলো না সেই যুথবদ্ধ সমাবেশ থেকে। এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছু সময়।
তখন দেখা গেল সমাবেশের সামনের সারি থেকে একজন উঠে দাঁড়াল। সে পিছন ফিরে সৈন্যদের মুখখামুখি হলো। বললো, ‘তোমরা কেউ বাড়ী ফিরে যেতে চাও?’
রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে সমবেত কণ্ঠের সম্মিলিত ধ্বনি ভেসে এলো, ‘না, আমরা কেউ ময়দানে পিঠ দেখানোর জন্য এখানে আসিনি।’
তখন সেই লোক ঘুরে দাঁড়ালো সুলতান তকিউদ্দিনের দিকে। বললো, ‘আমাদের প্রাণপ্রিয় সেনাপতি! আপনাকে কে বলেছে, আমরা বাড়ী চলে যেতে চাই? আপনি আপনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করুন! কোন কঠিন ময়দানে আমাদের নিয়ে যেতে চান, নির্দেশ করুন। আপনি আমাদেরকে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়তে বললে আমরা তাই করবো। যদি আপনি বলেন আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে, আমাদের একজনও পিছন ফিরে তাকাবে না। আমরা সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবো।’
পিছন থেকে আরেকজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যদি আমরা পিছু হটে মারা যাই, তবে যেন আমাদের লাশ দাফন করা না হয়। আমাদের লাশ যেন শকুন ও শিয়ালের জন্য ফেলে রাখা হয়।’ আরও কয়েকটি ধ্বনি শোনা গেল সমবেত সৈন্যদের মধ্য থেকে। প্রত্যেকেই কথা বলছিল আবেগময় স্বরে এবং বলিষ্ঠ প্রত্যয় নিয়ে।
তকিউদ্দিনের বুক ফুলে উঠলো। তিনি সৈন্যদের বললেন, ‘তোমাদের শত্রুরা এগিয়ে আসছে। তোমাদের প্রমাণ করতে হবে, রমলাই তাদের শেষ বিজয়। আজ রাত ও কালকের দিনটা পূর্ণ বিশ্রাম করো। কাল রাতে আমি তোমাদের বলবো, তোমাদের কি করতে হবে এবং আমরা কি করতে চাই।’
তকিউদ্দিন সৈন্যদের থেকে বিদায় নিয়ে তাঁর ক্যাম্পে সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের ডাকলেন। তাদের তিনি বললেন, আগামীকাল রাতে তিনি কি করতে চান এবং এই সেনাবাহিনীকে কোথায় নিয়ে যেতে চান। হিম্মতের দুর্গ সেখান থেকে কাছেই ছিল। কিন্তু তিনি সেই দুর্গে আশ্রয় নিলেন না, সেনাবাহিনীকেও সেখানে যেতে দিলেন না।
ক্রুসেড বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সম্রাট বিলডন। তিনি জানতেন, সামনেই হিম্মত দুর্গ। এ দুর্গে অবস্থান করছে সুলতান আইয়ুবীর ভাই সুলতান তকিউদ্দিন। আইয়ুবীর পরাজয়ের পর এবার তার পালা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে তার ভাইয়ের পরাজয়ের খবর পেয়েছে। সেই খবরে তাঁর মনে ভীতির সঞ্চার হওয়াই স্বাভাবিক। সে যখন দেখতে পাবে, আইয়ুবীকে যারা পরাজিত করেছিল সেই বীর বাহিনী এসে তাকে অবরোধ করে বসেছে, ভয়ের চোটেই সে হয়তো হাতিয়ার সমর্পণ করে দেবে।
খৃস্টান সম্রাট বিলডন এই আশা নিয়েই বিদ্যুৎগতিতে অগ্রসর হয়ে হিম্মত দুর্গ অবরোধ করে বসলো। অবরোধ করার পর তারা ঘোষণা করল, ‘কেল্লার দরজা খুলে দাও, নইলে এ কেল্লা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে।’
তারা ভেবেছিল, সুলতান তকিউদ্দিনের হাতে যুদ্ধ করার মত তেমন সৈন্য নেই। ফলে এ ঘোষণা শুনেই সে হাতিয়ার সমর্পন করে দেবে। কিন্তু দেখা গেল, হাতিয়ার সমর্পন করার জন্য কেউ এগিয়ে এলো না। এমনকি কেউ তাদের আহবানের কোন জবাবও দিল না।
ধাঁধাঁয় পড়ে গেল বিলডন। এমন তো হওয়ার কথা নয়! কেউ আত্মসমর্পনের জন্য এগিয়ে আসছে না কেন? বিলডন আবার ঘোষণা করল, ‘বৃথা রক্ত প্রবাহিত করে নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনো না। হাতিয়ার সমর্পন করো। এখন আর লড়াই করে কোন লাভ হবে না, কেবল রক্ত ক্ষয় করবে। এ রক্ত তোমাদের কোন কাজে আসবে না। তোমরা যুদ্ধ করে জিততে পারবে না। তাই বিনা যুদ্ধেই দুৰ্গটা আমাদের কাছে সমর্পণ করো। আমি অঙ্গীকার করছি, কোন বন্দীর সাথে দুর্ব্যবহার করা হবে না।
সঙ্গে সঙ্গে কেল্লার উপর থেকে উত্তর এলো, ‘সাবধান! আমাদের তীরর আওতা থেকে দয়া করে দূরে থাকো। কারণ আমাদের তীর কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। এ দুর্গ কোনদিনই তোমরা হাতে পাবে না। প্রয়োজনে এ কেল্লা আমরা নিজ হাতে ধ্বংস করে দেবো, কিন্তু তোমাদের হাতে দেবো না। আর আমাদের রক্ত! আমাদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। আমরা জানি, আমাদের রক্ত শরীরে থাকলে যেমন লাভ, শরীর থেকে বেরিয়ে গেলে আরো লাভ। আমাদের দেহের প্রতি ফোটা রক্ত তখন আমাদের বেহেশতের জামিন হয়ে যায়। উদ্দেশ্যহীনভাবে আমরা রক্ত দেই না, বরং তোমরাই লড়াই করতে নেমে অনর্থক মারা যাও।’
দুর্গ প্রাচীরে যে সব সৈন্য দাঁড়িয়েছিল, তারা দেখতে পেল, ক্রুসেড বাহিনী কেল্লার চারদিকে সাগরের তরঙ্গের মত ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়ছে। উত্তাল তরঙ্গ যেমন বড় বড় পাথর গ্রাস করে তলিয়ে দেয় পানির নিচে, তেমনি এ কেল্লাকে যেন ওরা গ্রাস করে নেবে। এদের মোকাবেলায় কেল্লায় যে পরিমাণ সৈন্য ছিল, তা অতি নগণ্য। কিন্তু এই সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়েই সত্যের মুজাহিদ লড়াই করার জন্য ইস্পাতকঠিন সংকল্প ঘোষণা করল। কেল্লার কমাণ্ডার অস্ত্র সমর্পণ করতে কিছুতেই রাজী না হওয়ায় স্তম্ভিত হয়ে গেল বিলডন।
সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। ক্রুসেড বাহিনী রাতের অন্ধকারে হামলা করার ঝুঁকি নিল না। তারা ভাবল, রাত কাটুক, কাল ভোরে ধীরে সুস্থে ওদের পাকড়াও করলেই হবে।
এমনিতেই দীর্ঘ পথ মার্চ করে এসে তারা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সৈন্যদেরকে আর কষ্ট দিতে চাচ্ছিল না বিলডন। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, কি করে সুলতান তকিউদ্দিনকে জীবিত ধরা যায়। কারণ, সুলতান আইয়ুবীর ভাই হিসেবে তকিউদ্দিন খুবই মূল্যবান কয়েদী হবে। তাঁর বিনিময়ে ভাল শর্ত আদায় করা যাবে। চাই কি, কোন অঞ্চলও পেয়ে যেতে পারি।
বিলডনের মনে পূর্ণ আশা ও বিশ্বাস ছিল, এই কেল্লা ও কেল্লার সৈন্যদের তিনি সহজেই প্রেফতার করতে পারবেন।
সম্রাট বিলডন তার সৈন্য বাহিনীকে কেল্লা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। এখন কেল্লা থেকে তীর বর্ষণ করলেও সে তীর এখানে পৌঁছতে পারবে না। তাদের মনে এমন কোন আশংকাই ছিল না, কোন সেনাদল বাইরে থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে।
তারা এই ভেবেও অনেকটা স্বস্তি অনুভব করছিল, সুলতান আইয়ুবী এখানে নেই। তার সেনাবাহিনীও না। বিলডন কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছিল, হিম্মত দুর্গের পতন হয়েছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে তার নিশান। বাহ্যত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, হিম্মত দুর্গের পতন সামান্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সন্ধ্যার পর তিনি তার কমাণ্ডারদের পরবর্তী দিনের কার্যাবলী বুঝিয়ে দিয়ে নিজের তাঁবুতে ফিরে গেলেন। তার জন্য তাঁবু খাটানো হলো সৈন্যদের ঘাঁটি থেকে কিছু দূরে। সে যুগে যুদ্ধের সময়ও সম্রাটদের তাঁবু খাটানো হতো আলীশান মহলের মত করে। সেখানে থাকতো সম্রাটদের আনন্দ ও বিনোদনের ব্যবস্থা।
বিলডন যেহেতু একজন বিজয়ী সম্রাট, তাই তার ক্যাম্পও সেভাবেই সাজানো হলো। তার মনোরঞ্জনের জন্য পাঠানো হলো চারটি খৃস্টান মেয়ে ও চারজন মুসলমান মেয়ে। এই মুসলমান মেয়েদের ধরে আনা হয়েছিল বিজিত এলাকা রমলা থেকে। এ মেয়েদের সবাই ছিল অভিজাত ঘরের সন্তান। তারা কেবল যুবতীই ছিল না, ছিল নজরকাড়া সুন্দরীও।
খৃস্টান মেয়েরা তাদের বলছিল, ‘এখন কান্নাকাটি করে কোন লাভ হবে না। তোমাদের মুক্ত করার জন্য ছুটে আসবে না কোন রাজপুত্তুর। তাই বৃথা চেষ্টা করো না।’
তাদেরকে আরও বলা হলো, ‘আরে, তোমরা তো ভাগ্যবতী মেয়ে! কোন সাধারণ সেপাই বা কমাণ্ডার নয়, তোমরা স্বয়ং সম্রাটের নজরে পড়েছে।’
আরেক মেয়ে তাদের বলছিল, ‘মহাপ্রভুর শুকরিয়া আদায় করো। যেসব মেয়েরা খৃষ্টান সেনাদের কবলে পড়েছে, তারা এখন বুঝতে পারছে, দুনিয়া কত ভয়ংকর! তারা এখন বার বার হাত বদল হচ্ছে, আর তাদের চিৎকারে জমিন ও আসমান কেঁপে উঠছে।’
অন্য মেয়ে বলছিল, “তোমাদের ভাগ্যে বড়জোর কোন আমীর বা মুসলমান অফিসার জুটতো! সেখানে তুমি খৃস্টান সম্রাটের সঙ্গিনী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছো, এটা কি কম কথা!’
‘আরে, মুসলমান আমীর ও নবাবজাদাদের স্বভাব আমার জানা আছে। দু-চার বছর পর যৌবনে ভাটা পড়লে আপন বিবিকেও তারা বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়।’ বলছিল আরেকজন।