চেঙ্গিস এই সুযোগটা নিল, সে ভিক্টরকে পাশ থেকে আঘাত করলো। কিন্তু ভিক্টর ছিল ঠাণ্ডা মাথার লোক। চেঙ্গিস যে মরিয়া হয়ে তাকে আঘাত করতে চেষ্টা করবে, এটা তার ভাল করেই জানা ছিল। সে একদিকে সরে কোন রকমে এ যাত্রা আত্মরক্ষা করলো।
কিন্তু চেঙ্গিস তাকে ছেড়ে দেয়ার মত পাত্র ছিল না। সে এবার উল্টো পাশে লাফিয়ে পড়ে খঞ্জরের এক ঘা বসিয়ে দিল ভিক্টরের কাঁধে।
ভিক্টর এবার তার রূপ পাল্টাতে বাধ্য হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে সেও পাল্টা আক্রমণ চালালো। সে ভাবতে বাধ্য হলো, চেঙ্গিসকে বাঁচিয়ে রাখাও এখন ভয়ের কারণ। ভিক্টরের খঞ্জরের আঘাত চেঙ্গিসের পিঠে লাগলো। চেঙ্গিস খঞ্জরের আঘাত খেয়ে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ভিক্টরকে আক্রমণ করলো। চেঙ্গিসের আঘাত ভিক্টরের বাহুতে লেগে কিছুটা ফেড়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে তার খঞ্জর সজোরে চেঙ্গিসের বুকে বসিয়ে দিল।
চেঙ্গিস একে তো মদের নেশায় মাতাল ছিল, তার ওপর অতিরিক্ত ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে বেসামাল ছিল। ভিক্টরের এ আঘাতের ধকল সে সইতে পারল না, টলমল পায়ে কয়েক কদম পেছনে গিয়ে চেঙ্গিস মাটিতে পড়ে গেল। ভিক্টর মেয়েটির নাড়িতে হাত রাখলো। দেখলো তার প্রাণ স্পন্দন শেষ হয়ে গেছে। চেঙ্গিসের কাছে গেল সে। তারও তখন প্রাণ বায়ু বের হওয়ার পথে। না মরলেও তার তখন কোন জ্ঞান ছিল না।
ভিক্টরের কাঁধ ও বাহু থেকে রক্ত ঝরছে। সে মেয়েটির ওড়না ছিড়ে তার বাহু ও কাঁধে পট্টি বেঁধে নিল, যাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর সে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়ার তাড়া অনুভব করলো। সে সেখান থেকে সরে পড়ার জন্য দ্রুত হাঁটা শুরু করলো।
ক্ষতস্থানে পট্টি বাঁধার পরও রক্ত পড়া বন্ধ হলো না। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় ছিল না ভিক্টরের, সে দ্রুত গতিতে বাগান থেকে বেরিয়ে এলো। বাগান থেকে বেরিয়েই সে একটি চিপা গলির মধ্যে প্রবেশ করলো। দু’তিনটা মোড় ঘুরে এই গলি এক প্রশস্ত রাস্তায় গিয়ে শেষ হয়েছিল। সে অন্ধকার গলি অতিক্রম করে বড় রাস্তায় চলে এলো।
তার ভাগ্য ভাল যে, তখন অনেক রাত। ত্রিপলী শহরের বাসিন্দারা গভীর নিদ্রায় বিভোর। সুনসান, নিস্তব্ধ সড়কের দু’পাশের প্রতিটি বাড়ীর গেট বন্ধ।
কিন্তু একটি ঘরের দরজা তখনো খোলা ছিল। সেই ঘর আল্লাহর ঘর। এই ঘরে কোনদিন ঢুকেনি ভিক্টর, তবে জানে মসজিদের ইমাম সাহেবের কামরার দরোজা সব সময় কিছু লোকের জন্য খোলা থাকে। একটু ধাক্কা বা যুৎসই টোকা দিতে পারলেই তা খুলে যায়।
ভিক্টর এই প্রথম মসজিদে এলো। চেঙ্গিস বলেছিল, যদি কখনও ইমাম সাহেবের সাথে দেখা করার প্রয়োজন হয়, তবে মসজিদের বারান্দায় চলে যাবে। বারান্দার বাম দিকের দেয়ালে একটি দরজা আছে, সেটিই ইমাম সাহেবের কামরার দরোজা।
ভিক্টর মসজিদের সিড়িতে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল। তার মনে পড়ে গেল, এই পবিত্র ঘরে ঢোকার সময় সবাইকে সে জুতা খুলে প্রবেশ করতে দেখেছে। সে তার জুতা খুলে হাতে নিল এবং বারান্দা পেরিয়ে ইমাম সাহেবের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এই মসজিদ ছিল ত্রিপলীতে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগের হেড কোয়ার্টার। আর মসজিদের ইমাম শুধু একজন ইমামই ছিলেন না, তিনি ত্রিপলীর গোয়েন্দা বিভাগেরও প্রধান।
রাত তখন অর্ধেকের বেশী পার হয়ে গেছে। ইমাম সাহেব গভীর নিদ্রায় ডুবে ছিলেন। দরোজার টোকা তাকে জাগিয়ে দিল। তিনি সজাগ হয়ে একটু থামলেন। এ সময় তিনি আবার দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পেলেন। দরজায় টোকা দেয়ারও একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গি ঠিক করে দেয়া ছিল গোয়েন্দাদের জন্য। তিনি সেই সাংকেতিক টোকাই শুনতে পেলেন।
বিছানা ছেড়ে উঠলেন তিনি। সাবধানতার জন্য একটি লম্বা খঞ্জর হাতে নিলেন। তারপর দরজা ফাঁক করে বললেন, ‘কে?’
‘আমি ভিক্টর। আগে ভেতরে চলুন, জরুরী কথা আছে।’
‘রক্তের গন্ধ আসছে কোত্থেকে?’ ইমাম সাহেব অন্ধকারেই রক্তের গন্ধ পেয়ে প্রশ্ন করে বসলেন।
‘জ্বি, আমার শরীর থেকেই!’ ভিক্টর উত্তর দিল। ইমাম সাহেব আর কোন প্রশ্ন না করে তাকে ভেতরে টেনে নিয়ে গেলেন। প্রদীপ জ্বালিয়ে দেখতে পেলেন, ভিক্টরের কাপড়ে রক্তের লাল দাগ। এখনও তা টাটকা ও ভেজা।
ভিক্টরের পরিচয় ইমাম সাহেবের জানা ছিল। সে কোথায় এবং কি দায়িত্বে আছে, তাও জানতেন তিনি। যদিও তিক্টরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না তিনি, তবে ভিক্টর নামের একজন অপারেটর সম্রাট রিমাণ্ডের রাজপরিবারে খাদ্য বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে এ কথা এখানকার দায়িত্বে এসেই জানতে পেরেছিলেন তিনি। নিয়ম মত তিনি তার কাজের রিপোর্টও পাচ্ছিলেন। সে যে খৃস্টান তাও জানতেন তিনি। এ ধরনের অপারেটরদের সামনে আনা বিপদজনক বিধায় তিনি কোন দিনই তাকে এখানে ডাকেননি, পরিচিত হতে চাননি। কিন্তু আজ যেহেতু সে নিজেই ছুটে এসেছে তখন বুঝতে হবে, বড় রকমের কোন সমস্যা হয়ে গেছে।
তিনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তার সাথে কিছু সাংকেতিক কথা বিনিময় করলেন। এতে এই লোকই যে ভিক্টর সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন তিনি। এটাই গোয়েন্দাদের পরস্পরকে চেনার সহজ পদ্ধতি।
‘তুমি এলে যে! চেঙ্গিস কোথায়?’ সে আসেনি কেন?’ ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
‘সে আর কোনদিন আসতে পারবে না।’ ভিক্টর বললো।
“কেন?” ইমাম সাহেব ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কি ধরা পড়ে গেছে?’
‘তার পাপ তাকে গ্রেফতার করেছে।’ ভিক্টর উত্তর দিল, ‘আর আমার খঞ্জর তার পাপের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। আমার কাঁধ ও বাহু থেকে এখনো রক্ত ঝরছে। আমার রক্ত পড়া বন্ধ করার কোন ব্যবস্থা করতে পারবেন আপনি?’
‘দাঁড়াও, আমি এখনি নতুন করে ব্যাণ্ডেজ করে দিচ্ছি। তুমি ভয় পেয়ো না।’
ইমাম সাহেব জলদি ঔষুধ বের করলেন। পানি এনে তার আহত স্থান পরিষ্কার করতে করতে বললেন, ‘কি ঘটেছে বলে তো!”
‘বলছি। পেরেশান হওয়ার মত এখন আর কিছু নেই। যা ঘটার তা ঘটেই গেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করুন, চেঙ্গিস জীবিত নেই। সে বেঁচে থাকলে আমাদের কেউ কারাগারের নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে পারতাম না।’
ইমাম সাহেব তার জখম পরিষ্কার করে সেখানে ঔষধ ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন। ভিক্টর ধীরে ধীরে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা ইমাম সাহেবকে খুলে বলতে লাগলো। সে বলল, ‘যখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, এই মেয়ে চরম ধোঁকা ও প্রতারণা দিয়ে চেঙ্গিসকে মহা বিপদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি তাকে বাঁধা দিলাম। আমি সেই বুড়ো জেনারেলের খোঁজ নিলাম, যার আশ্রয়ে মেয়েটি আছে বলে জানিয়েছিল চেঙ্গিসকে। কিন্তু এই নামে তাদের কোন জেনারেলই নেই। মেয়েটি কোথায় থাকে এ খোঁজ নিতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেছি। মেয়েটি ক্রুসেড বাহিনীর গোয়েন্দাদের কোয়ার্টারে থাকে।
গত কয়েকদিন ধরেই প্রতি রাতে সে চেঙ্গিসের পথ আগলে দাঁড়াচ্ছিল। এতে করে চেঙ্গিস আর আপনার কাছে পৌঁছতে পারছিল না। যে সব গুরুত্বপূর্ণ খবর আপনার কাছে পৌঁছানো জরুরী ভেবে তাকে আপনার কাছে পাঠাতাম, সেগুলো তার পকেটেই পড়ে থাকতো, আপনার কাছ পর্যন্ত পৌঁছতো না। এটা যে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক, এ কথাটুকু বুঝার ক্ষমতাও তার লোপ পেয়েছিল।
মেয়েটা তার কাছে আসতো ধোঁকা দিয়ে তার মুখোশ খুলে দিতে। সে প্রতি মুহূর্তে চেঙ্গিসের ওপর দৃষ্টি রাখতো। নইলে সে যখনি বাগানে প্রবেশ করতো, মেয়েটি কোথেকে তার কাছে ছুটে আসতো? আমি এসব বলে যখনই চেঙ্গিসকে সাবধান করতে চেষ্টা করেছি, তখনই সে আমার উপর রাগে ফেটে পড়েছে।
আপনি শুনলে অবাক হবেন, সে মদ পান করতে শুরু করেছিল। আমার সন্দেহ হচ্ছে, তাকে মদের সাথে হাশিশও পান করানো হয়েছিল। নইলে চেঙ্গিসের মত দৃঢ়চেতা লোক প্রতারণার শিকার হতে পারে না। আগেও অনেক সুন্দরী মেয়ে তাকে ভালবাসার জালে আবদ্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু সে, ওদের কোন পাত্তাই দেয়নি। ভালবাসার প্রস্তাব শুনলেই সে ওসব হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। এই মেয়েটা তাকে ঘায়েল করেছিল একই সঙ্গে তার রূপ, যৌবন, মদ আর হাশিশ প্রয়োগ করে। ফলে সে শারিরীক ভাবে না হলেও মানসিক ভাবে মেয়েটির ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল।
চেঙ্গিস যখন আমাকে বললো, সে গোয়েন্দা এ কথা মেয়েটির কাছে ফাঁস করে দিয়েছে, তখনই আমার প্রাণ কেঁপে উঠেছিল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, চেঙ্গিস যে অপরাধ করছে তাতে সে একা মরবে না, আমাদের সবাইকে সে ডুবিয়ে মারবে। এর শাস্তি স্বরূপ এমন বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, যাতে মিশরের স্বাধীনতারও মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা আছে।
আমি তাকে এসবই বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মেয়েটি তার মাথা এমন ভাবে খেয়ে ফেলেছিল যে, তার দায়িত্ব এবং ঈমানের দাবীর চাইতেও সে মেয়েটির কথাকে বেশী গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল।
আমি তখন মনে মনে সংকল্প করলাম, এ বিপদ এড়াতে হলে একটাই পথ খোলা আছে, আর তা হলো, মেয়েটাকে হত্যা করা। এতেও যদি চেঙ্গিসের হুশ না হয়, তবে তাকেও দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। দেশ ও জাতির চাইতে কোন একক মানুষের মূল্য অধিক হতে পারে না। দেশের জন্য, জাতির জন্য, ধর্মের জন্য ব্যক্তির জীবন দান, নতুন কোন বিষয় নয়। যুগে যুগে এমনি নজরানা পেশ করার ফলেই সভ্যতা টিকে আছে। আর গোয়েন্দাদের ব্যাপারটি তো আরো নাজুক। এ জন্য সর্ব মহলের স্বীকৃত নীতিমালা হচ্ছে, দলে কেউ গাদ্দারী করলে বা তার দ্বারা গোপন তথ্য প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, তাকে সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে দাও।
তবুও আমি তাকে হত্যা করতে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছি। কিন্তু সে যখন আমাকে হত্যা করতে পাগল পারা হয়ে উঠলো…….’
‘এটাও তো হতে পারে, তুমি তাকে ভুল ধারণায় খুন করে ফেলেছো!’ ইমাম সাহেব বললেন, ’এমনও তো হতে পারে, মেয়েটি মুসলমানই ছিল, সে সরল মনেই আমাদের জন্য কাজ করছিল এবং আরো করার ইচ্ছা ছিল!’
‘হ্যাঁ! তা হতে পারতো।’ ভিক্টর বললো, ‘কিন্তু আমি যখন প্রমাণ পেলাম, তখন তো আর অনুমানের প্রশ্ন থাকে না। আমি নিজেই মেয়েটিকে তাদের ক্যাম্পে দেখেছি। এক জেনারেলের আশ্রিতা বলে সে যে কথা রটিয়েছে, সে কথাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই মেয়েটি সেখানেই থাকতো, যেখানে হরমনের গুপ্তচর বাহিনীর মেয়েরা থাকে। আজও সে ওই ক্যাম্প থেকেই রাতে বেরিয়ে এসেছিল এবং চেঙ্গিসকে অনুসরণ করে বাগানে ঢুকে তার সাথে অভিসারে মেতে উঠেছিল।
তারা যেখানে বসে গল্প করছিল তার থেকে কয়েকগজ দূরেই একটি ঝোপের আড়ালে বসে আমি তাদের সমস্ত আলাপ শুনেছি। মেয়েটি যেভাবে চেঙ্গিসের কাছ থেকে গোপন তথ্য বের করে নিচ্ছিল তা শুনলে যে কেউ বুঝতে পারতো, সেই মেয়ে সত্যি ক্রুসেড বাহিনীর পাঠানো গোয়েন্দা। সে জানতে চাচ্ছিল, ত্রিপলীতে আমাদের কতজন গোয়েন্দা আছে। এখানে আমাদের কোন কমান্ডো বাহিনী আছে কিনা। এ তথ্য বের করার জন্য সে চেঙ্গিসকে একটি কাল্পনিক গল্প শোনাল। বলল, ক্রুসেড বাহিনীর বেশুমার রসদ ও আসবাবপত্র এক জায়গায় স্তূপ করে রাখা আছে। সেখানে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র, পেট্রোল ও বিস্ফোরক দ্রব্য আছে। এসব ধ্বংস করার জন্য কমাণ্ডো বাহিনী দরকার। আমি এই শহরেই একজন সতর্ক গোয়েন্দা। আমি ভাল করেই জানি, যেখানে রসদ মওজুদ আছে বলে জানিয়েছে মেয়েটি, সেখানে এর কিছুই নেই। ইচ্ছে করলে আপনি নিজেই কাল সেখানে গিয়ে একবার দেখে আসতে পারেন।
চেঙ্গিস তার কাছে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের সমস্ত তথ্য দিয়ে দিল। সে আমার নাম নিয়ে এটাও বলল, খৃস্টান হলে আমি মুসলিম বাহিনীর পক্ষে কাজ করছি। আপনি জানেন আমি এমন জায়গায় বসে আছি, যেখানে সকল সংবাদ, গোপন তথ্য সহজেই জেনে নেয়া যায়। মেয়েটি যখন আমা নাম শুনলো, সে এতই আশ্চর্য হলো যে, অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথাই বলতে পারল না।
সব তথ্য নেয়ার পর মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো এবং চেঙ্গিসে কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেই ক্যাম্পের দিকেই রওনা দিল।
আমি ভেবে দেখলাম, মেয়েটি আমাদের সমস্ত গোপন তথ্য নিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এ তথ্য সোজা চলে যাবে হরমন সাহেবের কাছে। আর তার পরিণাম ফল তো আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন।
আমি তৎক্ষণাৎ উঠে মেয়েটাকে ধরে ফেললাম ও আমার খঞ্জর তার বুকে বসিয়ে দিলাম। চেঙ্গিস আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাকে অনেক বুঝালাম, সত্য ঘটনা বললাম, কিন্তু মদের নেশা তাকে পশু বানিয়ে দিয়েছিল। আমি তার খঞ্জরে আঘাতে আহত হলাম, তবুও তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলা কিন্তু তার চিন্তা করবার ও বুঝবার ক্ষমতা লোপ পেয়েছিল।
আমি ভেবে দেখলাম, যদি সে জীবিত থাকে তবে আমাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। তাতেও আমার কোন দুঃখ ছিল না। কিন্তু সে বেঁচে থাকলে আমাদের দলের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। শেষে বাধ্য হয়ে তাকেও দুনিয়া থেকে বিদায় করলাম।’
‘তুমি ভালই করেছো!’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি তোমার সিদ্ধান্তকে মেনে নিলাম। তুমি এখন ত্রিপলী থেকে বের হয়ে যাও। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
‘না!’ ভিক্টর বললো, ‘ভোর বেলা লোকেরা উঠে চেঙ্গিস ও মেয়েটির লাশ দেখতে পাবে। মেয়েটিকে হরমন সাহেবই এ কাজে নিযুক্ত করেছেন। অতএব তার এ কথা বুঝতে কোনই অসুবিধা হবে না যে, এই দু’জনকে মুসলমান গোয়েন্দারাই হত্যা করেছে। তখন খুনীকে ধরার জন্য মুসলমানদের ওপর কিয়ামত শুরু হয়ে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে এ ক্ষমতা আগেই দেয়া হয়েছে যে, এখানে কোন লোকের উপর তার সন্দেহ হলে তিনি তাকে কারাগারে নিতে পারবেন, ইচ্ছে করলে তাকে হত্যাও করতে পারবেন।
ত্রিপলীর প্রতিটি মুসলিম বাড়ীতেই এখন গোয়েন্দা লাগানো আছে। তারা মুসলমানদের উপরে জুলুম অত্যাচার চালানোর জন্য কোন একটু সূত্র খুঁজছে। এই খুন তাদের হাতে সেই সূত্র তুলে দেবে। এটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না।’ ভিক্টর বললো, “আমি আমার ডিউটিতে ফিরে যাচ্ছি। এই হত্যাকাণ্ড আমিই করেছি, এর দায়িত্বও আমিই বহন করবো। কারণ হিসাবে বলবো, চেঙ্গিস আমার প্রিয়তমাকে বিপথগামী করেছিলো।’
‘আমি এত বড় কোরবানী তোমার কাছ থেকে নিতে পারি না।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি তোমার সাথে একজন লোক দিচ্ছি, সে তোমাকে কায়রো পৌঁছে দেবে।’
‘আমি আমার জীবনের কোরবানীই তো দিতে চাই।’ ভিক্টর বললো, “আজ আমার জীবনের সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে, যখন আমাদের শহরে দুই খৃস্টান সামরিক অফিসার আমার বোনের উপর নজর দিয়েছিল। তারা তাদের সৈন্যদের আদেশ দিয়েছিল আমার বোনকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য। কোন খৃষ্টানই আমার বোনকে তাদের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করতে রাজি হয়নি। কিন্তু সেদিন মাত্র তিনজন মুসলিম নওজোয়ান তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। লড়াই করতে করতে এক যুবক ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং বাকী দুই যুবক আহত হয়। কিন্তু তারা হার মানেনি, তারা আমার বোনকে উদ্ধার করতে পেরেছিল।
এই ঘটনাই আমাকে মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে। এক ভাই হয়ে আমি যা পারিনি, এক মুসলিম যুবক নিজের জীবন দিয়ে সেই অসাধ্য সাধন করেছিল। আমি এর শোকর আদায় করার সুযোগ খুঁজছিলাম। তাই যখন মুসলমানদের পক্ষ থেকে আমাকে গুপ্তচরবৃত্তি করার আহবান জানানো হলো, আমি তাতে রাজি হয়ে যাই। আমি আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দিয়েছিলাম সেই শহীদ যুবকের বদলা দিতে। আমি আপনার কাছে সে উপকারের বদলা দেয়ার একটু সুযোগ চাই। আমার মত একজন মানুষের কোরবানী যদি একটি জাতিকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়, তবে এটা কি এক বিশাল পাওনা নয় আমার জন্য? তাহলে আপনি কেন আমাকে এই মহত্তর বদলা দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন? আমি আমার অপরাধ স্বীকার করে ত্রিপলীর মুসলমানদের জীবন ও সম্মান রক্ষা করার সামান্য সুযোগ চাই আপনার কাছে।’
সে ইমাম সাহেবকে আরো বললো, ‘ক্রুসেড বাহিনী তাদের সৈন্যদেরকে একত্রিত করা শুরু করেছে। তাদের সমরাভিযান শুরু হবে হলবের দিক থেকে। তারা আগে হলব ও হারান অধিকার করার প্ল্যান নিয়েছে। এখনও জানা যায়নি, কবে তারা অভিযান শুরু করবে। আর এটাও জানা যায়নি, তাদের সকল সৈন্য কি এক দিনেই আক্রমণ চালাবে, নাকি বিভিন্ন দিকে ভাগ হয়ে যাবে, কিংবা একই সাথে সব সেক্টরেই যুদ্ধ চালাবে। সুলতান আইয়ুবীর কাছে এই সংবাদ অতি দ্রুত পৌঁছানো দরকার, তিনি যেন মিশরেই বসে না থাকেন।’
ভিক্টর যা কিছু জানতো সব কিছুই ইমাম সাহেবকে জানিয়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। ইমাম সাহেবের আপত্তি সত্বেও সে বললো, আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনাকে বা অন্য কাউকে এ ঘটনার জন্য কোন প্রশ্নই করবে না খৃস্টানরা।’
মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলো ভিক্টর। তার শরীর থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইমাম সাহেব তার আহত স্থানে ভাল মত পট্টি বেঁধে দিয়েছিলেন। সে যার কাছে যাচ্ছিল, সে যদি জানতে চায়, তোমার পট্টি বেঁধে দিল কে, এই ভয়ে সে তার পট্টি খুলে ফেললো। ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলতেই তার ক্ষতস্থান থেকে আবার রক্ত পড়া শুরু হলো।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে চেঙ্গিস ও মেয়েটির লাশ যেখানে পড়েছিল প্রথমে সে ওখানে গেল। রাতের শেষ প্রহর। মাথার ওপর থেকে ভাঙা চাঁদ গড়িয়ে পড়ছিল পশ্চিম দিগন্তে।
ভিক্টরের চোখের সামনে এতীমের মত পড়েছিল মদের সুরাহী ও দু’টি পিয়ালা। চাঁদের আলোয় সে ভাল করে তাকালো মেয়েটির দিকে। কি অপরূপ মায়াময় মিষ্টি মুখ! মৃত্যুও তার সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করতে পারেনি। একগুচ্ছ খোলা রেশমী কোমল চুল তার বুকের উপর ছড়িয়ে ছিল। লালিত্যময় হাত দু’টো দিয়ে তখনো সে আঁকড়ে ধরে ছিল, বুকের সে ক্ষতস্থান, যেখানটা ভিক্টর তার খঞ্জর দিয়ে ফুটো করে দিয়েছিল।
ভিক্টর তাকালো মদের সুরাহীর দিকে। মেয়েটির পাশেই কাত হয়ে পড়েছিল সেই সুরাহী। সেদিকে তাকিয়ে ভিক্টর বিড় বিড় করে বললো, ‘মানুষ তার নিজের ধ্বংসের উপকরণ কেমন অপরূপ করে তৈরি করেছে, দেখো!’
মেয়েটির কাছ থেকে সরে সে গেল চেঙ্গিসের লাশের পাশে। তার দিকে দীর্ঘক্ষণ অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলো। তার চোখ ঠেলে বেরিয়ে এলো অশান্ত অশ্রু রাশি। সে তার কাছে বসে পড়ল। হাত দিল চেঙ্গিসের শরীরে। বরফের মাত ঠাণ্ডা শরীর।
একটু আগেও এই শরীরে জীবনের উত্তাপ ছিল। সে নিজ হাতে সেই উত্তাপ কেড়ে নিয়েছে। অনেক দিন তারা একত্রে ছিল। বহু সুখ-দুঃখ তারা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এক জনের কষ্ট মুছিয়ে দিয়েছে অন্য জন। এক জনের শোকে অন্য জন শান্তনা দিয়েছে। সেই অন্তরঙ্গ বন্ধুকে নিজ হাতে খুন করেছে ভিক্টর! নিয়তির কি নির্মম পরিহাস!
তাকে খুন করে ভিক্টর অনুতপ্ত নয়, বরং তৃপ্তি অনুভব করছে! ওকে খুন না করলে খুন হয়ে যেতো একটি জাতি! চরম সর্বনাশের হাত থেকে সেই জাতিকে সে রক্ষা করেছে, পৃথিবীতে যারা মানবতার নিশান উড়াতে চায়।
চেঙ্গিসের হাত তার হাতের মধ্যে নিয়ে আবেগ ভরা কণ্ঠে সে বললো, তুমি ভাল করেই জানতে, মদের নেশা বাদশাহকেও সিংহাসন থেকে নামিয়ে দেয়। তুমি এই দুর্বলতাকে নিজের মধ্যে কেন ঠাঁই দিয়েছিলে বন্ধু!
তুমি এও জানতে, ছলনাময়ী নারীর খপ্পড়ে পড়ে কত রাজ্য আর রাজা ধ্বংস গেছে। কেন তুমি তেমনি এক নারীর খপ্পড়ে পড়ে গেলে বন্ধু!
তোমার ধর্ম কত মহান! নারীর সাথে মেলামেশার সে এমন সুন্দর বিধান দিয়েছে, যা মানলে এই মাটির পৃথিবীতেই বেহেশতের সুখ অনুভব করা যায়! কেন সেই পথে না গিয়ে গোপন মেলামেশার পথ বেছে নিলে বন্ধু!
তুমি যদি এ পথে পা না বাড়াতে তাহলে আমাকে আর জল্লাদ হতে হতো না। তোমার ধর্মের যে সৌন্দর্য দেখে আমি অভিভুত হয়ে তার হেফাজতের জন্য সর্বস্ব পণ করে বসে আছি, তুমি সেই ধর্মের অনুসারী হয়েও কেন তার সৌন্দর্য দেখতে পেলে না বন্ধু!
চেঙ্গিসের লাশ আঁকড়ে ধরে সেই জনশূন্য বাগানে একাকী বসে বিলাপ করছিল ভিক্টর। তার সেই বিলাপের শেষ কয়টি কথা ছিল এমনঃ ‘আমিও আসছি প্রিয় বন্ধু! জল্লাদ শীঘ্রই আমাকে তোমার কাছে পৌঁছে দেবে। আমি তোমার প্রভুর কাছে কড়জোড়ে প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ, আমার এই বন্ধু তোমার দ্বীনের জন্যই সর্বধ পণ করে এই বাহিনীতে শামিল হয়েছিল। সারা জীবন, বিশেষ করে যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় সে তোমার পথে ব্যয় করেছে। তার এ ক্ষণিক ক্রটি তুমি ক্ষমা করে দিও প্রভু! আমরা একই গন্তব্যের যাত্রী।
এতদিন তোমার দ্বীনের জন্য কাজ করলেও দ্বীনের হুকুম আহকাম কিছুই মানতে পারিনি। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে তোমার দ্বীন কবুলও করিনি। তবু তুমি জানো আমার অন্তরের খবর। যেদিন তিন মুজাহিদ আমার বোনকে খৃস্টানের কবল থেকে উদ্ধার করেছিল, সেদিন থেকেই আমিও মনে মনে তোমার দ্বীনকে গ্রহণ করে নিয়েছিলাম। আল্লাহ, আমাকে তুমি তোমার দ্বীনের পথের এক সামান্য গোলাম হিসাবে কবুল করে নাও।
সে লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল আর বলছিল, ‘আমিও আসছি বন্ধু! একটু অপেক্ষা করো। এই তো আমি আসছি বলে!’
সে সেখান থেকে উঠলো ও দ্রুত পদক্ষেপে সেই মহলের দিকে চললো, যেখানে শহরের পুলিশ প্রধান থাকেন।
তার শরীর থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল। সে খাপ থেকে খঞ্জর বের করলো। খঞ্জরের জমাট রক্ত কালচে হয়ে গিয়েছিল। সে তার দেহের তাজা রক্ত দিয়ে খঞ্জরটি ভিজিয়ে নিল এবং খঞ্জর হাতেই রাখলো। অতিরিক্ত রক্ত বের হওয়ায় সে খুব দুর্বল বোধ করছিল।
অতি কষ্টে সে কোন মতে পুলিশ প্রধানের ফটক পর্যন্ত পৌঁছল। এগিয়ে গিয়ে আঘাত করলো ফটকে। এক সেন্ট্রি এসে ফটক খুলে দিল।
ভিক্টর অফিসারের নাম নিয়ে বললো, ‘জলদি তাকে জাগিয়ে দাও। আর বলো, এক খুনী আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।’
এ কথা শুনে সেন্ট্রিবক্স থেকে আরেক সিপাই ছুটলো ভেতরে। কয়েক মিনিট কেটে গেল চুপচাপ। এরপরই ভেতর থেকে শোনা গেল গালি-গালাজের আওয়াজ। পুলিশ প্রধান গালি দিতে দিতে বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে এসে গর্জে উঠে বললো, “ও তুমি? কার সাথে এমন লড়াই শুরু হয়েছিল? পুলিশ প্রধান তাকে চিনতে পারলো।’
‘আমি দু’টি মানুষের খুনের স্বীকারোক্তি করতে এসেছি।’ ভিক্টর বললো, ‘আমাকে গ্রেফতার করুন।’
পুলিশ প্রধান তার মুখে জোরে এক থাপ্পড় মেরে বললো, ‘তুমি আর খুন করার সময় পাওনি? দিনের বেলায় কি করেছিলে? আমি তোমার বাবার চাকর নাকি যে, এখন তোমাকে গ্রেফতার করতে যাবো? কি আমার নবাবজাদা! আমাকে গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বলে, আমাকে গ্রেফতার করুন!’
ক্ষিপ্ত পুলিশ প্রধান সেন্ট্রিকে বললো, ‘একে নিয়ে যা তো, কারাগারে বন্দী করে দে।’
সেন্ট্রি ভিক্টরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার হাত ধরলো, পুলিশ প্রধান আবার গর্জে উঠলো, ‘ওরে, দাঁড়া, বোকা কোথাকার! তুই কি একটুও চিন্তা করিসনি, এই খুনী তোকেও খুন করে ফেলতে পারে? একে ভেতরে নিয়ে আয়। সে কি কেস করেছে?’
‘আমি এক পুরুষ ও এক নারীকে হত্যা করেছি স্যার!’ ভিক্টর জোরেই বললো।
‘খুন করেছো?’ পুলিশ প্রধান আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যি তুমি খুন করেছে? যদি মুসলমানকে খুন করে থাকো, তবে যাও, ক্ষত স্থানে মলম ব্যান্ডেজ করো। বাকীটা আমি দেখবো। আর যদি কোন খৃস্টানকে খুন করে থাকো, তবে তার সাজা অবশ্যই তোমাকে পেতে হবে। চলো, ভেতরে গিয়ে কথা বলি।’
‘আপনি তো আমার সাথে এক সুন্দর যুবককে দেখেছেন! রাশেদ চেঙ্গিস।’ ভিক্টর ভেতরে গিয়ে বললো, ‘আমার এক সুন্দরী যুবতীর সাথে ভালবাসা ছিল। সে ছিল আমার বন্ধু। আমাদের প্রেমের বিষয়টা সে জানতে এবং মেয়েটিকেও চিনতো। সেই গাদ্দার সব জেনেশুনেও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। সে মেয়েটিকে ফুসলিয়ে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিল এবং নিজে তার সাথে প্রেম করা শুরু করল। এই নিয়ে তার সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। সে আমাকে চরম ভাবে অপমান করে। আমি মেয়েটির অন্ধ প্রেমিক ছিলাম। কিছুতেই তাকে হারাতে রাজি ছিলাম না আমি। মেয়েটি চেঙ্গিসের সাথে তার সম্পর্কের কথা অস্বীকার করলো। কিন্তু গত রাতে অভিসাররত অবস্থায় আমি তাদের দু’জনকে হাতেনাতে ধরে ফেলি।
তখন চেঙ্গিস আমাকে খুন করার জন্য ছুটে আসে। মেয়েটি ছুটে এসে তাকে বাধা দিতে চেষ্টা করে। সে আমাকে আঘাত করতে চাইলে সে আঘাত আমার পরিবর্তে মেয়েটির বুকে বিদ্ধ হয়। খুন হয়ে যায় আমার প্রেমিকা। আমার মাথায়ও তখন খুন চেপে যায়। আমি চেঙ্গিসের ওপর খঞ্জর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সেও আমাকে খুন করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
সে আমার কয়েক জায়গায় জখম করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আমিও ছেড়ে দেয়ার পাত্র ছিলাম না। আমি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম এবং শেষ পর্যন্ত আমিই সফল হলাম।
অবশেষে তারা দু’জনেই মারা যায়। আমার যখন হুঁশ হলো তখন ভাবলাম, হায়, আমি এ কি করলাম! সেই থেকে আমার মন অস্থির হয়ে উঠল। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম, আমার মুক্তির যদি কেউ ব্যাবস্থা করতে পারে, সে কেবল আপনি। তাই আমি সেখান থেকে সোজা আপনার কাছে চলে এলাম।’
পুলিশ প্রধান তাকে বললো, ‘মেয়ে মানুষের জন্য খুন-খারাবী করা তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ঠিক আছে, তুমি বাসায় চলে যাও, আমি দেখছি কি করা যায়।’
পুলিশ প্রধান তাকে গ্রেফতার না করে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। কারণ ভিক্টর ছিল সম্রাট রিমাণ্ডের রাজ কর্মচারী। পুলিশ প্রধানের বিবেচনায় এমন দু’একটা খুন সে করতেই পারে।
কিন্তু সকাল বেলা সকলেই দু’জনের লাশ দেখে তো হতবাক। হরমন এবং তার সহকারীর কাছেও গিয়ে পৌঁছল এ খবর। তারা যখন এ খবর জানতে পারলো, তখন তারা দু’জনেই রেগে আগুন হয়ে গেল।
মেয়েটি তাদের অত্যন্ত করিৎকর্মা গোয়েন্দা ছিল আর চেঙ্গিস ছিল তার শিকার। চেঙ্গিসকে অবলম্বন করেই তারা ত্রিপলীতে অবস্থানরত মুসলিম গোয়েন্দাদের পুরো দলটাকে ধরার জাল পেতেছিল। দলটা এরই মধ্যে জালের ভেতর মাথা ঢুকিয়েও দিয়েছিল, এখন শুধু জাল গুটিয়ে আনা বাকী।
এই অবস্থায় কেবল শিকার নয়, জাল এবং জেলে শুদ্ধ সবকিছু গায়েব করে দিল যে আহাম্মক, আক্রোশটা তার ওপর গিয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। তার কারণে মুসলিম গোয়েন্দাদের ধরার যে সূত্রটি তাদের হাতে এসেছিল, তা গায়েব হয়ে গেল। সেই সাথে গায়েব হয়ে গেল তাদের চৌকস গুপ্তচর কন্যা। সব মিলে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, ভিক্টরের মত একশ গর্দভকে খুন করলেও তার বদলা আদায় হবার নয়।
ক্রুদ্ধ আক্রোশে এ সবই ভাবছিল হরমন। সঙ্গে সঙ্গে তার সহকারীকে হুকুম দিল, “ওই গর্দভটাকে ধরে এনে আচ্ছা মত পিটুনি লাগাও।’
ভিক্টরের ক্ষত স্থান থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল! কেউ তাকে ঔষুধ দেয়ার বা সেই ক্ষতে ব্যাণ্ডেজ করার প্রয়োজনও বোধ করলো না। সেই অবস্থায় তাকে ধরে আনা হল।
হরমনের মত তার সহকারীও প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ছিল ভিক্টরের ওপর। তাকে হাতের কাছে পেয়েই সে সমানে পিটাতে শুরু করলো। ভিক্টর শেষে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। তার পরে আর তার জ্ঞান ফেরেনি। পরের দিন অজ্ঞান অবস্থায়ই তাকে জল্লাদের সামনে উপস্থিত করা হলো। জল্লাদ তাকে এক চৌকির ওপর শুইয়ে ধারালো অস্ত্রের এক আঘাতেই দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিল।
তার দেহ ও মাথা পথক দুই গর্তে যখন পুতে ফেলা হচ্ছিল, সে সময় ইমামের প্রেরিত এক গোয়েন্দা ত্রিপলী থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। উটের উপর সওয়ার হয়ে সে যাচ্ছিল কায়রোর দিকে। কায়রো সেখান থেকে অনেক দূর। এমন দীর্ঘ সফরের ধকল কেবলমাত্র উটই সহ্য করতে পারে। এই দুর্গম পথের কষ্টকর সফরের মাঝেও সেই পথিক এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করছিল। কারণ এমন মূল্যবান তথ্য নিয়ে এই প্রথম সে যাচ্ছিল মুসলমানদের আশা ভরসার কেন্দ্র সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে।
❀ ❀ ❀
৫৭৩ হিজরী মুতাবেক ১১৭৭ খৃস্টাব্দের প্রথম দিকের ঘটনা। কায়রোর প্যারেড গ্রাউণ্ডে অসাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। নতুন ভর্তি সৈন্যরা ট্রেনিং শেষে ওখানে কুচকাওয়াজ করছিল। কখনো সেখানে চলছিল ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা। কখনো নেজাবাজি, তলোয়ার যুদ্ধ, মল্ল যুদ্ধ, তীরের নিশানা। পদাতিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের পর মাঠে এলো উষ্ট্রারোহী বাহিনী। তাদের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল ঘোড় সওয়ার বাহিনী।
কায়রো শহরের বাইরে এক পাহাড়ী এলাকা। কেউ দেখলে ভাববে এখানে দুই পক্ষে তুমুল লড়াই চলছে। আসলে সেখানে আইয়ুবীর নতুন সৈন্যদের মহড়া চলছিল।
সৈন্যরা সেখানে পেট্রোল বোঝাই হাড়ি নিক্ষেপ করে তাতে অগ্নিবান নিক্ষেপ করল। সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ পঞ্চাশ হাত এলাকা জুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। অশ্বারোহীরা সেই আগুনের মধ্য দিয়ে তীরবেগে ছুটে গেল একদিক থেকে অন্য দিকে।
এ রকম যুদ্ধ মহড়া শুরু হলো মরু অঞ্চলেও। কোন সৈন্যেরই সেখানে সঙ্গে পানি রাখার অনুমতি ছিল না।
এ সবই ছিল কঠিন প্রশিক্ষণের শেষ পর্যায়। নতুন রিক্রুট সৈন্যরা পরম উৎসাহে তাতে অংশ নিচ্ছিল। ভর্তি কার্যক্রমও তখন চলছিল সমান তালে। সামরিক বাহিনীর সমস্ত সেনাপতি, কমাণ্ডার ও অফিসাররা ট্রেনিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীকে এ কাজে লাগিয়ে দিয়ে দেশের প্রশাসনিক কাজের দিকে মনযোগ দিলেন। দিনে ব্যস্ত থাকতেন প্রশাসনিক কাজে, রাতে সেনাপতি এবং অফিসারদের নির্দেশ দিতেই তার রাত শেষ হয়ে যেতো।
এক রাতে তিনি অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন। তিনি উপস্থিত অফিসারদের বললেন, ’যদি ক্রুসেড বাহিনী এ মুহূর্তে সেনা অভিযান না চালায় তবে তোমরা হয়তো ভাবতে পারো, তারা যুদ্ধ করতে অপারগ। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা যায় না। তারা অবশ্যই আসবে, সিরিয়ার দিক দিয়ে না হোক, অন্য কোন দিক দিয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা আক্রমণ চালাবেই এবং তা অতি তাড়াতাড়ি।’
পরদিন তিনি সৈন্যদের মহড়া পরিদর্শনে গেলেন। তিনি এক উপত্যকায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধের মহড়া দেখছিলেন। এক সেনাপতি সুলতানকে বললেন, ‘এ পর্যন্ত শত্রু কবলিত অঞ্চল থেকে কোন না কোন ব্যক্তির আসা প্রয়োজন ছিল।’
সুলতান আইয়ুবী তার দিকে ফিরলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো। আমিও এ কথাই ভাবছিলাম। ক্রুসেড বাহিনী অবশ্যই আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে। তবে তারা কোন দিক থেকে আসবে সে সংবাদ শুধু গোয়েন্দারাই বলতে পারবে। তারাই বলতে পারবে দুশমন কোথায় প্রথম আক্রমণ করবে এবং তাদের সৈন্য সংখ্যা কত। শত্রু অঞ্চল থেকে আমাদের গোয়েন্দারা যতক্ষণ এ খবর না দিচ্ছে, ততক্ষণ আমরা অন্ধকারেই থাকবো।’
তিনি কথা বলছিলেন আর উপত্যকায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন দূর পাহাড়ের দৃশ্যাবলী। তখন তার নজরে পড়লো, দূরে ধূলি উড়ছে। এই ধূলি এক কিংবা দু’টি অশ্বারোহীর ছুটে আসার আগাম খবর দিচ্ছিল। তিনি পাশের অফিসারকে বললেন, ‘দেখোতো, ওদিক দিয়ে কেউ আসছে মনে হয়!’
সঙ্গী অফিসার সেদিকে তাকিয়ে বললো, “মোহতারাম সুলতান! মনে হয় আমাদের কোন সঙ্গীই আসছে।’