্যাডমিরাল চিন্তিত হলেন। এমন অভ্যার্থনা তিনি আশা করেননি। তিনি অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করলেন। সেনাপতিদের পরামর্শে তিনি আরো কয়েকটি নৌকাকে নতুন করে পাঠালেন উপকূল অভিমুখে।
সতর্কতার সাথে আরও কয়েকটি ছোট ছোট নৌকা রাতের আঁধারে এগিয়ে গেল। তারা এক সাথে না গিয়ে পর পর সারিবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। উপকূলে পৌঁছার আগেই আক্রান্ত হলো তারা। সামনের দুটো নৌকা উল্টে গেল। আহত সৈন্যরা সমুদ্রে সাঁতার কেটে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে লাগলো। বাকী নৌকাগুলোকে ওরা সামান্য পিছনে সরিয়ে নিয়ে এক সারিতে দাঁড় করালো। এরপর আক্রমণ প্রতিহত করে উপকূল পর্যন্ত পৌঁছার সংকল্প নিয়ে ওরা আবার এগিয়ে গেল।
বেশী দূর যেতে হলো না, একটি নির্দিষ্ট সীমানায় পৌঁছতেই আবার আক্রান্ত হলো ওরা। ওরাও পাল্টা হামলা করলো। দু’পক্ষের মধ্যে তীর বিনিময় হতে লাগলো থেমে থেমে।
একটি নৌকা এই খবর নিয়ে ছুটলো গভীর সমুদ্রের দিকে। জাহাজের কাছে পৌঁছে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘রশি ফেলো! রশি ফেলো! জাহাজ নোঙ্গর করো। ওরা সমুদ্র উপকূলে আমাদের কমাণ্ডোদের ওপর হামলা করে দিয়েছে।’
নৌকা থেকে এক কমাণ্ডোকে আধ মরা অবস্থায় জাহাজে তোলা হলো। দুশমনের পর পর তিনটি তীর বিদ্ধ হয়েছিল তার শরীরে।
নৌকা নিয়ে ফিরে আসা কমাণ্ডো বললো, ‘আমাদের দুটো নৌকা প্রথম ধাক্কাতেই উল্টে যায়। খৃস্টানরা আমাদের একটি নৌকা আটক করতে সমর্থ হয়েছে। বাকীরা লড়াই করছে ওদের সাথে।’
‘তোমরা কি টহল বাহিনীর পাল্লায় পড়েছিলে?’
‘এরা কোন টহল বাহিনী নয়। খৃস্টান নৌবাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্য ওরা। তাদের নৌকাগুলো সবই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।’
হেশামুদ্দিন এবার তার নিয়মিত বাহিনীর একটি বড়সড় দলকে পাঠালেন আক্রান্ত নৌকাগুলোকে উদ্ধার করতে। বললেন, ‘ওদের বিতাড়িত করে তীরে নামার ব্যবস্থা আমাদের করতেই হবে। তোমরা চেষ্টা করে দেখো, না পারলে আমি অন্য ব্যবস্থা করবো।’
এই বাহিনী যুদ্ধরত বাহিনীর সাথে গিয়ে মিলিত হলো। তারা দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে পাশ থেকে আক্রমণকারীদের ওপর আঘাত হানলো। ডানে বায়ে এবং সামনে থেকে একযোগে আক্রান্ত হয়ে খৃস্টান নৌসেনারা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লো আত্মরক্ষার্থে। এ যুদ্ধে ওদের কিছু সৈন্য মারা পড়লো এবং কিছু লোক ধরা পড়লো।
ওদেরকে নিয়ে আসা হল জাহাজে। ওদের কাছ থেকে জানা গেল, হেশামুদ্দিন প্রথমে যে দলটিকে পাঠিয়েছিলেন, অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রায় সবাইকে বন্দী করা হয়।
এতে বোঝা গেল, মুসলিম নৌবহরের আগমন সংবাদ তারা আগে থেকেই জানতো। এখন বন্দীদের কাছ থেকে মুসলিম নৌবাহিনীর শক্তি সম্পর্কেও তারা একটি পরিষ্কার ধারণা নিয়ে নিতে পারবে।
হেশামুদ্দিন তার নৌবহরকে সমুদ্রের এতটা গভীরে নিয়ে গেলেন যে, সন্ধ্যায় জাহাজ ছাড়লে অর্ধ রাতের একটু পর যেন জাহাজগুলো বৈরুতের কূলে ভিড়তে পারে। তিনি শেষ রাতের দিকে খৃস্টান বাহিনীর অগোচরে তার বাহিনী তীরে নামিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।
খৃস্টানরা মুসলিম বাহিনীকে বাঁধ দেয়ার জন্য আগে থেকেই সমুদ্র উপকূল হালকা ও ভারী মেনজানিক স্থাপন করে বসেছিল। জাহাজের অগ্রযাত্রা রোধে এ এক পরীক্ষিত পদ্ধতি। মেনজানিক দ্বারা অগ্নি গোল নিক্ষেপ করলে জাহাজ এগুতে পারে না। কারণ জাহাজে গোলা পড়লে সেই জাহাজ বাঁচানো মুস্কিল।
হেশামুদ্দিন সবই বুঝতে পারলেন। খৃস্টানরা যে তাদের অগ্রগতি রোধ করার জন্য মেনজানিক কামান ব্যবহার করবে একথা বুঝার জন্য বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। এই সহজ প্রতিরোধ পদ্ধতির কথাই প্রথমে সবার মনে পড়বে।
কিন্তু তাই বলে তো চুপ করে বসে থাকা যায় না। সুলতান আইয়ুবী এখন যুদ্ধের ময়দানে। এ যুদ্ধে জিততে হলে সমুদ্রের দিক থেকেও তার বিশেষ সাহায্য দরকার। উপরে যুদ্ধ হবে আর সাগরে বসে বসে মুজাহিদরা সেই দৃশ্য দেখবে, তাতো হয় না। মনে মনে ঝুঁকি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন।
এ সময় দেখা গেল তীরের দিক থেকে একটা নৌকা এগিয়ে আসছে। নৌকাটা মুসলিম নৌবাহিনীর। নৌকা আরো কাছে এলে দেখ গেল, মুসলিম নৌসেনারা দু’জন খৃস্টান নৌসেনাকে ধরে এনেছে। এর সেই খৃস্টান সেনা, জেলে সাজা মুসলিম নৌকমাণ্ডোদের ধরে যারা বন্দী করেছিল। হেশামুদ্দিনের পাঠানো নৌবহরের সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে ওর যখন দেখলো অবস্থা বেগতিক, তখন এরাও অন্যান্যদের সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরা সাঁতার কাটতে কাটতে বহু দূরে সরে যাওয়ায় মুসলিম বাহিনী আগে তাদের দেখা পায়নি। পরে অনেক দূর থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়।
ওদেরকে যখন হাত পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া হলো তখন তারা বললো, ‘সমুদ্র উপকূলে বিলডনের সৈন্যরা প্রস্তুত হয়ে আছে। আর জাহাজে আগুন লাগানোর জন্য মেনজানিক কামান পাতা হয়েছে উপকূলে।’
এই সৈন্যদের কাছ থেকেই হেশামুদ্দিন জানতে পারলেন, ‘শহর রক্ষার জন্য বৈরুতের অভ্যান্তরে অল্প সংখ্যক সৈন্য রেখে বাদবাকি সব খৃস্টান সৈন্য শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন সম্রাট বিলডন। বিপুল সংখ্যক সৈন্য এখন সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর পেছনে এবং তার রাস্তার দুই পাশে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে। সুলতানকে ফাঁদে ফেলে পিষে মারতে চায় তারা।’
এই সংবাদ মারাত্মক এক বিপদের বার্তা বহন করছিল। এই ভয়ংকর সংবাদে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন ও তার সেনাপতিগণ। তারা গভীরভাবে বিষয়টি চিন্তা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, খৃস্টানরা আমাদের আগমনের সংবাদ আগেই পেয়ে গেছে। আমরা জানি না, সুলতান আইয়ুবী এ সংবাদ জানেন কিনা।
হেশামুদ্দিন সেনাপতিদের বললেন, ‘সুলতান আইয়ুবী এ সংবাদ জানেন কিনা আমরা জানি না। আমরা যখন বিষয়টি জানতে পেরেছি তখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এ খবর অবিলম্বে সুলতানকে পৌঁছানো। এখন তাকে বৈরুতের কাছাকাছি পাওয়ারই সম্ভাবনা। আমি তাঁর কাছে এ খবর পাঠানোর জন্য এখুনি কাসেদ পাঠাতে চাই।’
সেনাপতিরা এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হলো। তারাও বললো, ‘আপনার চিন্তা নির্ভুল। আমরাও কাসেদ পাঠানোর পক্ষে।’
সঙ্গে সঙ্গে একটি নৌকায় দুটি ঘোড়া ও দু’জন কাসেদকে তুলে দিয়ে তাদের বললেন, ‘এখন তোমরা এ উপকূলে নামতে পারবেনা। তোমরা নৌকা নিয়ে গভীর সমুদ্র পথে উজানের দিকে চলে যাও। রাত নামার পর অন্ধকারে কোন গ্রামের পাশে নির্জন উপকূলে নেমে যাবে। সেখান থেকে ঘোড়া নিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যাবে বৈরুতের কাছাকাছি।
বৈরুত শহরের বাইরে আমাদের যে বাহিনী আছে সাবধানে তাদের কাছে পৌঁছ যাবে তোমরা। তারপর সুলতানকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলবে।’
এক সেনাপতি সেইসাথে যোগ করলো, ‘বিশেষ করে তাকে জানাবে, আপনার পেছনে শত্রুদের বিশাল বাহিনী ওঁৎ পেতে আছে। তারা যেকোন সময় আপনার ওপর বড় ধরনের হামলা করে বসতে পারে। আপনার এ অভিযানের খবর খৃস্টানরা আগেই পেয়ে গেছে। তাই তারা এবার আপনাকে পিষে মারার ফন্দি এঁটেছে।’
এ ছাড়া তারা সুলতানকে আরো কি কি বলবে সব বুঝিয়ে দিয়ে কাসেদকে হুকুম করলেন, ‘এবার বেরিয়ে পড়ো অভিযানে। মনে রেখো, যুদ্ধের মোড় পাল্টে দেয়ার জন্য এ খবর সুলতান আইয়ুবীর কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। যে করেই হোক, সুলতানের কানে এ খবর পৌঁছাতে হবে তোমাদের।’
হেশামুদ্দিন থামলে কাসেদ দু’জন তাকে সালাম জানিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল।
পাল তোলা নৌকায় করে জাহাজ থেকে ক্রমে দূরে যাচ্ছে কাসেদ দু’জন। যতক্ষণ তাদের দেখা গেল, তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন হেশামুদ্দিন। এক সময় দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল ওরা। বাতাস বইছিল উপকূল বরাবর। সন্ধ্যার পর বৈরুত থেকে দূরে দক্ষিণের এক সমুদ্রকুলে গিয়ে নৌকা ভিড়ালো কাসেদ দু’জন। সেখানকার সাগরের পাড়টা ছিল এক পাহাড়ের ঢালে।
ওরা নৌকা থেকে ঘোড়া নামালো। নৌকাটা টেনে একদম চরায় তুলে ফেললো। পাহাড়ী এক বৃক্ষের গোড়ায় শক্ত কর বাঁধলো নৌকাটা। তারপর তারা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো।
সওয়ারী পিঠে চাপতেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া দু’টো রওনা হলো। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল তারা। তারপর ঘোড়ার মুখ বৈরুতের দিকে ফিরিয়ে হাওয়ার বেগে ছুটলো সেদিকে।
প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে শেষ রাতের দিকে তারা বৈরুতের উপকন্ঠে পৌঁছলো।
মুসলিম বাহিনীর নাগাল পেতে বেশী বেগ পেতে হয়নি তাদের। ফজরের আগেই তারা সুলতান আইয়ুবীর সামনে গিয়ে হাজির হলো।
রাতভর আইয়ুবী সেনাপতিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। খৃস্টানদের তৎপরতা তার কাছে বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে। শহরের ভেতর থেকে যে প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন তিনি, তেমন কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি তাদের মধ্যে। এর একটাই কারণ থাকতে পারে, খৃস্টানরা এবার যুদ্ধের কোন নতুন চালের কথা চিন্তা করছে। কিন্তু কি হতে পারে তাদের সেই নতুন চাল?
সমস্যাটা ভাবিয়ে তুললো সুলতানকে। এই নিয়েই সারা রাত দরবার করেছেন তিনি। তবে কি আমরা ওদের কোন ফাঁদের মধ্য পা দিয়েছি? সারা রাত বৈঠক করেও এর কোন নিশ্চিত জবাব বের করতে পারেননি তিনি।
তিনি সেনাপতিদের বলছিলেন, ‘বৈরুতকে আমরা অবরোধ করে নিয়েছি। বৈরুত কোন যেনতেন শহর নয়। এটা রক্ষা করার জন্য খৃস্টানদের মরিয়া হয়ে চেষ্টা করার কথা। কিন্তু গতকাল আমি আমার রিজার্ভ ফোর্সের একটি অংশকে পাঠিয়েছিলাম পরীক্ষামূলক আক্রমণ করার জন্য।
কিন্তু তাদের কথা হচ্ছে, খৃস্টানরা খুব অবহেলার সাথে তাদের মোকাবেলা করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, রিজার্ভ বাহিনী ছাড়াই এ যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা নয়।
শহরের বাইরে যে যুদ্ধ হচ্ছিল সেখানকার রিপোর্ট হচ্ছে, কমাণ্ডো বাহিনী আঘাত হানলেই তারা পিছনে সরে যাচ্ছে। কোথাও বড় আকারের সংঘাতের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না তারা। এটাও কোন ভাল লক্ষণ নয়।’
তখন মধ্য রাত পার হয়ে গেছে। সুলতানের বৈঠক তখনো চলছিল, এ সময় কমাণ্ডো বাহিনীর একটি গ্রুপের মাত্র একজন সৈন্য রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটে এল সেখানে।
কমাণ্ডো বৈঠকের সদস্যদের সামনেই সুলতানকে একটি দুঃসংবাদ শুনালো। বললো, ‘আমরা খৃস্টানদের একটি ক্যাম্পে হানা দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা রাতে বিশ্রামে না গিয়ে যে কোন ধরনের আক্রমণ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল। আমরা হামলা করতেই ওরা আমাদেরকে চারদিক থকে ঘিরে ফেলল।
তারা আমাদের সবাইকে শহীদ কর দিয়েছে। আমি যে তাদের ঘেরাও থেকে বেঁচে আসতে পারবো তেমন কোন সম্ভাবনা ছিল না। হয়তো আপনাকে এখবর জানানোর জন্যই আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
এক সেনাপতি বললো, ‘আমার মনে হয় অবরোধ করতে আসা আমাদের বাহিনী খৃস্টানদের বিরাট অবরোধের মধ্যে পড়ে গেছে।’
এ ঘটনার একটু পরেই নৌবাহিনীর কাসেদ সেখানে এসে উপস্থিত হলো। তারা সাগরের অবস্থা বর্ণনা করে বললো, ‘এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলু বলছেন, আমরা যে অভিযানে আসছি এ খবর খৃস্টানরা অনেক আগেই পেয়ে গেছে। তাই তারা আমাদের প্রতিরোধ করার জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থাই নিয়েছে বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে সমুদ্র অভিযান ব্যর্থ কর দেয়ার জন্য তারা শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে। এ অবস্থায় আমার জন্য আপনার কি আদেশ তা কাসেদ মারফত জানিয়ে বাধিত করবেন।’
‘খৃস্টানদের এমন সবদিক থেকে সতর্ক ও প্রস্তুত অবস্থায় আমি এর আগে কোন দিন দেখিনি।’ সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতিদের বলছিলেন, ‘এখন স্পষ্ট বোঝা গেল, আমাদের পরিকল্পনার খবর সঙ্গে সঙ্গেই গোয়েন্দা মারফত বৈরুতে পৌঁছে গিয়েছিল। যে বৈরুত আমরা গোপনে অবরোধ করতে এসেছি সেখানে কোন গোপনীয়তাই গোপন থাকেনি।’
‘এটা জানার পর আমরা ওদের পাতা ফাঁদে পা দিতে পারি না। এই অবরোধ নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবা উচিৎ।’ বললেন এক সেমাপতি।
সুলতান এর সাথে একমত হয়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছো। আমরা অবশ্যই নতুন করে যুদ্ধের ছক আঁকবো।’
তিনি এ্যামিরাল হেশামুদ্দিনের পাঠানো কাসেদদের দিকে ফিরে বললেন, ‘হেশামুদ্দিনকে বলবে, তাঁর নৌবহর যেন সে বৈরুতের উপকন্ঠ থেকে সরিয়ে নেয়। সবাইকে নিয়ে তাকে আলেকজান্দ্রিয় ফিরে যেতে বলবে। সৈন্যদেরকে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে অবতরণ করিয়ে তাদেরকে যেন সোজা দামেশকে পাঠিয়ে দেয়।’
কাসেদরা বিদায় হয়ে গেল। পরদিন ভোরে সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীকে মুশেলের দিকে পিছু সরে যেতে আদেশ দিলেন। বললেন, ‘কমাণ্ডোরা খৃস্টান সৈন্যদের সাথে মোকাবেলা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু মূল বাহিনী ধীরে ধীরে পিছু হটে মুশেলের দিকে এগিয়ে যাবে।’
এই পিছু হটার বিষয়টাও সহজ ব্যাপার ছিল না। পিছু হটতে গিয়েও কমাণ্ডো বাহিনীর সাহায্য নিতে হলো মূল বাহিনীকে। নইলে খৃস্টানদের লুকিয়ে থাকা বাহিনীর আক্রমণে তাদের নাস্তানাবুদ হতে হতো।
কমাণ্ডো বাহিনী তাদের জীবন ও রক্ত দিয়ে সৈন্যদেরকে অবরোধ মুক্ত করে আনে। খৃস্টান সম্রাট বিলডনের ধারণা ছিল, সুলতান আইয়ুবী এখনো ময়দানে এসে পৌঁছাননি। সময় ক্ষেপনের জন্য মুসলিম বাহিনী জায়গা বদল করছে। তাই তিনি পিছু হটা বাহিনীকে ধাওয়া করার আদেশ জারী করেননি। মুসলিম বাহিনীর সৌভাগ্য যে, সম্রাট বিলডন একটি ভুলের মধ্যে ছিলেন, নইলে অবস্থা আরো অনেক বেশী নাজুক হতে পারতো।
মুশেলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ সুলতান আইয়ুবীর সাথে মুশেল থেকে আসা এক গোয়েন্দার সাক্ষাত হলো। ইসহাক তুর্কী বৈরুত থেকে ফিরে এলে এই গোয়েন্দার সাথে তার সাক্ষাত হয়েছিল। ইসহাক তুর্কীর কাছ থেকেই সে শুনেছিল বৈরুতের সর্বশেষ পরিস্থিতি।
সুলতান আইয়ুবীর কাছে গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কীর কথা উল্লেখ করে বললো, সে আমাদের কাছে বৈরুতের ঘটনা উল্লেখ করে আর দেরা করেনি। আমাদের কাছ থেকে মুশেলে আপনার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তার বিবরণ শুনে পরদিনই কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা করে যায়। এটা বেশ কিছুদিন আগের কথা।’
‘মুশেলে আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র হচ্ছে?’ প্রশ্ন করলেন সুলতান আইয়ুবী।
গোয়েন্দা ইয়াজউদ্দিন মাসুদের সমস্ত পরিকল্পনা সুলতানের সামনে তুলে ধরলেন।
গোয়েন্দার রিপোর্ট শুনে সুলতান আইয়ুবী রাগে লাল হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গ তিনি আদেশ দিলেন, ‘এখনি মুশেল অবরোধ করে তাকে দখল করে নাও।’
বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার ডাইরিতে লিখেছেন, ‘সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী ১০ নভেম্বর ১১৮২ সালে মুশেলের নিকটে এসে পৌঁছেন।
সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী মুশেল আসছেন এ খবরে ইয়াজউদ্দিন মাসুদ বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদ চলে গেলেন খলিফার সাহায্য চাইতে। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ আমাকে বলেছেন, ‘সুলতানের আগমনের খবর পেয়ে আমি দজলার স্রোতে দ্রুতগামী নৌকায় চড়ে বাগদাদ পৌঁছে গেলাম। মাত্র দুইদিন দুই ঘন্টায় আমি আমি এ দূরত্ব অতিক্রম করেছিলাম।
খলিফার কাছে আমি সাহায্যের আবেদন জানালে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি শায়খুল উলামাকে গিয়ে বলো সুলতান আইয়ুবীর সাথে তিনি যেন তোমাকে আপোষ করিয়ে দেন।’ কিন্তু শায়খুল উলামা আমার পক্ষ কথা বলবেন, এমনটা আমি আশা করতে পারিনি বলে সেখান থেকে আমি আজারবাইজান চলে গেলাম তাদের কাছে সাহায্য চাইতে। আজারবাইজানের শাসক সাহায্যের বিনিময়ে যে শর্ত আরোপ করলেন, আমার মনে হলো তার চেয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করা অনেক ভাল। ফলে আমি ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সেখান থেকেও ফিরে এলাম।’
সুলতান মুশেল এসেই ইয়াজউদ্দিন মাসুদের কাছে অস্ত্র সমর্পণের প্রস্তাব পাঠালেন।ইয়াজউদ্দিন মাসুদ সংঘাতে না গিয়ে অস্ত্র সমর্পণের জন্য কয়েকদিন সময় প্রার্থনা করে। পরে বাগদাদের খলিফার পরামর্শ মতে শায়খুল উলামার মধ্যস্থতায় তাদের মধ্যে আপোষ মিমাংসা হয়।
১১৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সুলতান আইয়ুবী মুশেল থেকে অবরোধ উঠিয়ে নাসিবা নামক স্থানে ক্যাম্প করেন। তিনি নাসিবাকে হেড কোয়ার্টার বানিয়ে পরবর্তী যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করে দেন।
‘বৈরুতের অবরোধ খৃস্টানরা ব্যর্থ করেনি, করেছে আমার বেঈমান ভাইয়েরা।’ সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের বললেন, ‘আমি শুধু রক্তক্ষয় থেকে বিরত থাকার জন্যই এই আপোসরফা মেনে নিলাম।’
বৈরুতের অবরোধ ব্যর্থ হওয়া সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর দ্বিতীয় নিষ্ফল অভিযান হিসাবে বিবেচিত হয়। এ ব্যর্থতায় তিনি কিছু হারানওনি, কিছু পানওনি। সে কারণেই তার এ অভিযানকে পরাজয় না বলে ঐতিহাসিকরা ব্যর্থতা বলেই চিহ্নিত করেছেন।
অবশ্য কেউ কেউ এটাকে সুলতান আইয়ুবীর ব্যর্থতা না বলে তার গোয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা বলেছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কেমন কথা যে, সুলতান বৈরুত অবরোধ করবেন এ কথা আগেই সেখানে পৌঁছে যায়?
খৃস্টানদের কাছে এ সংবাদ নিশ্চয়ই কায়রো থেকেই পৌঁছেছিল। কিন্তু এটাতো ছিল এক গোপন সংবাদ। সুলতান আইয়ুবীর একান্ত বিশ্বস্ত এবং সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুটিকয় সেনাপতি ছাড়া এখবর তো কেউ জানতো না।
সুলতান আইয়ুবীর পরবর্তী লক্ষস্থল কোথায় এ কথা যারা জানতে পারে, তাহলে তাদের মধ্যেও গাদ্দার আছে? প্রশ্নটা সঙ্গত এবং এর উত্তরও হ্যাঁ-বাচক। তাহলে বলতেই হয় সেই গাদ্দার কে? কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছেই ছিল না।
‘আপনি একে পরাজয় বলবেন না।’ সুলতান আইয়ুবীর চিন্তিত চেহারার দিকে তাকিয়ে এক সেনাপতি বললো, ‘বৈরুত যেখানে ছিল সেখানেই আছে, আর সেখানেই থাকবে। আমরা আবারো সেই শহরে আক্রমণ চালাবো এবং দখল করে নেবো।’
‘এত বড় শিকার আমাদের হাত থেকে ছুটে গেল!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তো সেই শহর অবরোধ করে সেখানে ইসলামের ঝাণ্ডা উড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখতে পেলাম, আমি নিজেই ওদের অবরোধের মধ্যে পড়ে আছি। যুদ্ধের ছক এমনভাবে পাল্টে গেল যে, অবশেষে নিজেদেরকেই সেই অবরোধ থেকে বের করে আনতে হলো। এটা পরাজয় নয়তো আর কি?’
‘হ্যাঁ, এভাবে দেখলে এটা আমাদের পরাজয়ই। তবে ওদের পেটের মধ্যে ঢুকে আমরা যে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, এটাও কম কথা নয়। ওরা চাইলে আমাদের আরো অনেক ক্ষতি করতে পারতো।’
‘এই শান্তনা নিয়েই বসে থাকো। কিন্তু কেন এ ব্যর্থতা বরণ করতে হলো সেটা স্মরণ করলে তোমার চোখের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। দুশমন আমার চাল ব্যর্থ করে দিয়েছে, এটাকে আমি কখনোই পরাজয় মনে করি না। একবার সে আমার চাল ব্যর্থ করেছে, আমি দশবার তার চাল ব্যর্থ করে দিয়ে এর প্রতিশোধ নিতে পারি। কিন্তু দুশমন তো আমাকে আঘাত করার সময়ই পায়নি, তার আগেই তো আমি কুপোকাত হয়ে বসে আছি।’
তিনি বললেন, ‘আমার ঘরে যে অদৃশ্য সাপ ঘুরে বেডাচ্ছে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিনা, এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে? তুমি বলো, আমি বৈরুতে অভিযান চালাতে চাই এ খবর কয়জন জানতো?’
আমি যাদেরকে নিজের চাইতেও বেশী বিশ্বাস করি তারা ছাড়া কোন কাক পক্ষীও তো এ খবর জানতো না। আমি যদি তোমাদের বিশ্বাসই করতে না পারি তবে তোমাদের নিয়ে কোন সাহসে অভিযানে বের হবো?’
পৃথিবীর সবচেয়ে তিক্ততম সত্য কথাটিই বেরিয়ে এসেছিল সুলতানের কন্ঠ থেকে। এর কোন জবাব দেয়ার ভাষা ছিল না কারো কাছে। সত্যি তো! সুলতান এখন কাকে নিয়ে পরামর্শ করবেন? কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে কারো না কারো কাছে তো তা প্রকাশ করতেই হবে। কে সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি, যার কাছে গোপন পরিকল্পনা বলে সুলতান স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলবেন?
সুলতান আইয়ুবীর তাঁবুর মধ্যে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। নাসিবা নামক স্থানে সেনা ক্যাম্পে বসে ছিলেন তিনি। এখানে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অবস্থান করছেন।
এখানে এভাবে অবস্থান করার নানা কারণ নানা জনে বলে। কেউ বলে, তাঁর সেনাদল বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক সৈন্য আহতও ছল। এই সৈন্যবাহিনা দুর্বার গতিতে পথের সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে কায়রো থেকে বৈরুত পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিল।
এক মাসের পথ তারা কয়েক দিনে অতিক্রম করেছে। পথের বিশাল দূরত্ব অল্প সময়ে অতিক্রম করে এসেই তারা দুশমনের অবরোধে আটকা পড়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি খৃস্টানদের সেই অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে তাদের রক্তাক্ত সংগ্রাম করতে হয়েছে।
অবশেষে অনেক কষ্টে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে নিরাপদ স্থানে ফিরতে হয়েছে তাদের। সুলতান আইয়ুবী এই সব সৈন্যদের পূর্ণ বিশ্রাম দেয়ার জন্যই নাসিবা নামক স্থানে ক্যাম্প করে সৈন্যদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু এই বিশ্রাম ও ক্লান্তি শুধু সৈন্যদের জন্যই ছিল। সুলতান আইয়ুবীর জন্য ছিল সীমাহীন দুশ্চিন্তা আর নিদ্রাহীন রাত। তিনি নিকট বন্ধুদের মধ্যে শত্রু খুঁজতে খুঁজত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। নিরাশার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল তার আশার প্রতিটি স্ফুলিঙ্গ।
দিনের বেলা তিনি অশান্তভাবে তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করতেন। সেনাপতিরা সেই তাঁবুর মধ্যে এসে সুলতানের চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কোন কথা বলার সাহস পেত না। তারা দীর্ঘক্ষণ তাঁবুর মধ্যে বসে থেকে আবার চলে যেতো।
তিনি বিশ্বস্ত সেনাপতিদের সাথে কথা বলতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। একদিন তিনি এমনি অশান্ত চিত্তে তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করছিলেন। এক সেনাপতি তাঁবুর মধ্যে ঢুকে সাহস করে তাকে শান্তনা দিতে গেলো। বললো, ‘মুহতারাম, একে আপনি পরাজয় মনে করবেন না।’
সুলতান আইয়ুবী এ কথার কোন উত্তর দিলেন না, তিনি চুপ করে রইলেন। সেনাপতি আর কোন কথা না পেয়ে নিরব হয়ে গেল।
সুলতান আপন মনে তাঁবুতে পায়চারী করতে লাগলেন। এ সময় আরো একজন সেনাপতি সেখানে এলো। অনেক্ষণ পর্যন্ত দুই সেনাপতিই চুপ করে তাকিয়ে রইলো সুলতানের দিকে। আইয়ুবীর চেহারায় রাগ বা ক্ষোভ নেই, আছে শুধু দুশ্চিন্তা। এই চিন্তা কি করে দূর করবে ওরা?
সহসা তাদের সামনে এসে থামলেন সুলতান। বললেন, ‘তোমরা কিছু বলবে?’
‘আমরা আপনাকে বলতে চাচ্ছি, এটা দুশ্চিন্তা করার সময় নয় সুলতান। আপনি এভাবে দুশ্চিন্তা করতে থাকলে আমরা স্বপ্নহীন মানুষে পরিনত হয়ে যাবো।
অথচ পৃথিবীর নির্যাতীত মানুষের জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আমাদের মাঝে একজন গাদ্দার থাকলে দশজন আছে মুজাহীদ। এইসব মুজাহিদরা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় বসে আছে। আপনি তাদের অনন্তকাল এভাবে নিশ্চল বসিয়ে রাখতে পারেন না।’
তারা সুলতান আইয়ুবীকে আরো বললো, ‘আপনাকে এখন নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই দুশ্চিন্তা আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। আমাদের আবেদন, আপনি আবার গা ঝাড়া দিন। আবার আমাদের ময়দানে নিয়ে চলুন। আমরা কেবল আপনাকে পরাজয়ের কষ্টই দেইনি, বিজয়ের আনন্দও তো দিয়েছি।’ আবেগ ভরা কন্ঠে বললো এক সেনাপতি। আমরা এর আগেও পরাজিত হয়েছি। রমলায় আমাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল সে সময়ও আপনাকে এতটা বিমর্ষ হতে দেখিনি।এবারের ব্যর্থতা রমলা পরাজয়ের চাইতে মারাত্মক তো নয় সুলতান! রমলার পরাজয়কে যদি আমরা বিজয়ে রুপান্তরিত করতে পারি তবে এবারের ব্যর্থতাকেও আমরা সফলতায় রুপান্তরিত করতে পারবো। আপনি নিজের আবেগকে ঠাণ্ডা করুন। আবেগ মুক্ত হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে নির্ধারণ করুন। আঁধার রাতের পর নিশ্চয়ই সোনালী সূর্য উঠবে।’
‘আমি চিন্তা করছি, কাফেররা তো আমাদের ডালপালা কেটে এবার মূল শিকড় কাটা ধরেছে। এ শিকড় কাটা হয়ে গেলে আমাদের জাতিসত্ত্বা বলে কিছু থাকবে কি? আমাদের জাতির অস্তিত্ত্ব বলে কিছু থাকবে কি?’
‘মোহতারাম সুলতান! আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহ নিজেই হেফাজত করবেন। আল্লাহর দ্বীন টিকে থাকলে এ জাতিও টিকে থাকবে। অনন্ত কালের দায়িত্ব আমাদের কাঁধে বর্তাবে না। আমরা শুধু আমাদের সময়ের জন্য দায়িত্বশীল। জয়-পরাজয়ও আমাদের হাতে নয়, ওটাও আল্লাহই নির্ধারণ করেন।
ভবিষ্যতে আমাদের চাইতে যোগ্যতর কেও এ জাতির হাল ধরবে না, এমন কথা আমরা বলতে পারিনা। আমরা আমাদের যোগ্যতার যথাযথ ব্যবহার করলাম কিনা, পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলাম কিনা, হায়াতের যে সময় আমাদের আল্লাহ দিয়েছেন সেই সময়ের সঠিক ব্যবহার করলাম কিনা, কাল হাশরে আমাদের কাছে আল্লাহ শুধু তাই জানতে চাইবেন। যদি এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা হ্যাঁ বলতে পারি, তবে আমি মনে করি আমরা আমাদের জীবনকে সফল জীবন হিসাবে গণ্য করতে পারি।’
‘আর এ দায়িত্ব কাঁধ নিয়ে আমরা যে গাদ্দারী করি তাকে কি বলবে? যে গাদ্দারীর কারণে আমাদের মুখে কলঙ্কের কালি মাখতে হয় সেই পাপের শাস্তি কে ভোগ করবে?’
‘মোহতারাম সুলতান! শত কলঙ্কের পরও এখনো আমরা আমাদের মাটিতেই দাঁড়িয় আছি। দুশমন আমাদের কব্জা করতে পারেনি, বরং আমরাই এখন আমাদের প্রথম কেবলা ফিলিস্তিন মুক্ত করার স্বপ্ন দেখছি। আমরা এখন খৃস্টানদের সাথে তাদের মাটিতে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করছি।’
বার বার খৃস্টানরা আমাদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সশস্ত্র আঘাত হেনেছে, আমরা সেইসব আক্রমণের মোকাবেলা করেছি। এই অর্জন আমাদের নয়, আমাদের সততা, আন্তরিকতার ও বিশ্বস্ততার। আল্লাহ আমাদের অন্তর দেখেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের এই সব সফলতা দান করেছেন। আল্লাহর এই দয়ার শোকরিয়া আদায় করার উপায় হলো তার কাজে আরো বেশী নিবেদিত হওয়া। দুশ্চিন্তা করে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারবো না।’
‘তুমি নির্ভুল ও সময়োচিত কথা বলেছো, এ জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তোমার কাছ থেকে আরো কিছু কথা শুনতে চাই। এ সব প্রশ্নের কিছু জবাব আমার কাছে আছে। তবু আমি তোমার জবাবের সাথে আমার জবাব মিলিয়ে দেখতে চাই।
জাতির নেতৃত্ব এখন যাদের হাতে আল্লাহর কাছে তো তাদেরও জবাবদিহি করত হবে। মুসলিম মিল্লাতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো এখন তাদেরই কাঁধে। হলবের শাসক ইমামুদ্দিন এবং মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দীন এখন কোথায়? বিভিন্ন পরগণার শাসক ও আমিররা এখন কি করছে?
তারা তো আমাদের সামরিক জোটের অংশীদার, ইসলামের পথে লড়াই করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। তারা কি এখন এই প্রয়োজনের সময় আমাদের সৈন্য ও রসদ দিয়ে সাহায্য করবে? তাদের শিথিল মনোভাব প্রমাণ করছে, তারা এখনও খৃস্টানদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এখনও তাদের খেলার পুতুল সেজে কাজ করছে। তাহলে এখন আমরা কার সাথে লড়াই করবো? জাতির এইসব গাদ্দারদের বিরুদ্ধে নাকি শত্রুর বিরুদ্ধে?’
‘আপনি বারবার এদেরকে আমাদের ভাই আখ্যায়িত করে এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্ত তাদের কাজ প্রমাণ করছে, দুশমনের চাইতেও এরা মুসলিম জাতিসত্ত্বার অধিক অন্তরায়।
আমি তাদের মুনাফিক বলতে চাইনা, কারণ ফতোয়াবাজি করা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু কোরআন ও হাদিসে মোনাফিকরা যেসব কাজ করবে বলা হয়েছে, এরা এখন তাই করছে। আর হাদিসে আছে, মোনাফিকরা দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। এতে প্রমাণিত হয়, কাফেরের চাইতেও জাতির জন্য তারা অধিক ক্ষতিকর। আপনি যতই ওদের ক্ষমার চোখে দেখেন না কেন, সুযোগ পেলেই ওরা জাতির শিরায় আঘাত হানবেই।’