» » সামনে বৈরুত

বর্ণাকার

ইয়াজউদ্দীন দেরী না করে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার এসে তার নাড়ি পরীক্ষা করে ঔষুধ দিল। উনুশী সেই ঔষুধ এক পাশে সরিয়ে রেখে বললো,‘আপনারা যান, ঔষুধ আমি নিজেই খেয়ে নেবো। ঔষুধের চেয়ে এখন আমার বিশ্রাম বেশী প্রয়োজন।’

ডাক্তার এবং ইয়াজউদ্দীন বেরিয়ে গেলেন কামরা থেকে। ইয়াজউদ্দীন হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘হঠাৎ আবার কি হলো মেয়েটির?’

‘ও কিছু না সেরে যাবে। দুশ্চিন্তা বা অধিক রাত জাগা ও অতিরিক্ত মদ পান করলে এমনটি হতে পারে। হয়তো মেয়েটি শরীরের ওপর বেশী অত্যাচার করছে, তাই এমন হয়েছে।’

ইয়াজউদ্দীন ও ডাক্তার চলে গেল। উনুশী দরোজা ভেতর থেকে বন্ধ করে শোয়ার পরিবর্তে কামরায় পায়চারী করতে লাগলো।

উনুশী ছিল খুবই অশান্ত। হঠাৎ একটি ঘটনা জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় এনে ফেলেছে তাকে। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। সে একবার জানালার পাশে যায়, একবার এসে দাঁড়ায় ঘরের মাঝখানে। কখনো জানালায় এসে পর্দা উঠিয়ে বাইরে তাকায়। কিছুক্ষন এভাবে পায়চারী করে হঠাৎ বিছনায় এসে দপ করে বসে পড়লো। তারপর মাথার কাছ থেকে টেনে নিল তার গহনার ছোট্ট বাক্সটা।

তার এ গহনার ছোট্ট বাক্সটা খুবই সুন্দর। এক আরবী ধনী আমীর এ সৌখিন বাক্সটা তাকে উপহার দিয়েছিল কয়েক বছর আগে।

সে বাক্সটা খুলে দেখলো। তার ভেতর থেকে বের করলো একটা আঙ্গুরী। সুদানী পরী উনুশী আংটির নকশার দিকে তাকিয়ে রইলো তন্ময় হয়ে।

এই আংটির নিচটা ভরাট। কী-তে চাপ দিলে খুলে যায় পাল্লাটা। আসলে এটা একটা ছোট্ট কৌটা।

সে কৌটার মুখটা খুলল। কৌটায় সামান্য সাদা পাউডার। সে বিষন্ন মনে পাউডারের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।

পাউডারের দিকে তাকিয়ে সে মনকে স্থির করতে চেষ্টা করলো। তাতে তার অশান্তি কিছুটা দূর হলো। একটা শান্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো মনে।

হৃদয়ের অশান্তি ও উদাস ভাব কিছুটা উপশম হলে সে কৌটার মুখ আবার বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো।

রাত ততক্ষনে অর্ধেক পার হয়ে গেছে। পাশের কামরায় ঘুমুচ্ছে তার নিজস্ব দাসী। উনুশীর অসুস্থতা দেখে দাসী তার কামরাতেই ছিল অনেক রাত পর্যন্ত। শেষে এক সময় উনুশীই তাকে বললো,‘যা, তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আজ রাতে আর কিছু লাগবে না।’

দাসী তারপরও কিছুক্ষন ছিল, শেষে যখন ঘুমে আর বসে থাকতে পারছিল না তখন উঠে নিজের কামরাই চলে গেল।

উনুশী রাতের কিছু পর দাসীর কামরায় গিয়ে তাকে জাগিয়ে তুললো। তাকে বললো, ‘যা, আমের বিন উসমানকে ডেকে নিয়ে আয়।’

দাসী আমের বিন উসমানের সাথে উনুশীর সম্পর্কের কথা জানতো। সে ছিল তাদের গোপন মেলামেশার একমাত্র সহকারী ও সাক্ষী। সে আমের বিন উসমানে কামরায় গিয়ে তাকে ডেকে তুললো। বললো, ‘উনুশী আপনাকে এখুনি একবার যেতে বলেছে।’

আমেরকে নিয়ে ফিরে এলো দাসী। উনুশী দাসীকে বললো, ‘তুই এখন পাহারা দিবি। বাইরে বসে থাক, আমের না যাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে কোথাও নড়বি না।’

উনুশী আমেরকে ভেতরে টেনে এনে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল।

‘আমের!’ উনুশী এমন স্বরে কথা বললো যে শব্দের সাথে আমেরের পরিচয় ছিল না। ‘তুমি জানো, আমি কে?’

উনুশী এ কথা বলে আমেরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমের বুঝে পেল না, এ প্রশ্নের কি জবাব সে দেবে।

আমের চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। উনুশী বললো, ‘আজ সন্ধায় যে লোকটা শাহী বাগে তোমাদের সাথে বসেছিল, কে সে?’

‘কেউ না।’ আমের থতমত খেয়ে না জানার ভান করে উত্তর দিল, ‘আমার কাছে তো কেউ আসেনি!’

‘তোমার কাছে কেউ যায় নি, না?’ উনুশীর কন্ঠে সাপের হিসহিসানির মত শাসানি।

‘আমি তো ওদের সাথে যাই রক্ষী হিসাবে। আমি দূর হতে ওদের অনুসরণ করি মাত্র, আমার কাছে কে আসবে!’

‘আমের!’ সম্পূর্ণ পাল্টে গেল উনুশীর কন্ঠ। বললো, ‘আমি জানি, তুমি আমার অন্তরের গভীরে যত খবর লুকিয়ে আছে সব সংবাদ জানতে চাও। ঠিক আছে সব খবরই তুমি জেনে নাও। আমি তোমাকে অন্তরের গভীর থেকে ভালবাসি। তাই তোমার চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখবো না।

কিন্তু তুমি আমাকে মরুভূমির সহজ সরল মেয়ের মত যতটা সহজ ও বোকা মনে করেছো, আমি ততটা বোকা নই। তুমি, রাজিয়া খাতুন, শামসুন নেছা এবং খাদেমা বাগানের ভেতর এক সাথেই বসেছিলে। এক আগন্তুককে নিয়ে ঝোঁপের আড়ালে তোমরা গোপন বৈঠক করেছো। সেখানে অনেক গোপন আলাপ হলো তোমাদের মধ্যে। প্রয়োজনীয় আলাপ সারতে সারতে তোমাদের রাত হয়ে গিয়েছিল। আমি কি এগুলো সব স্বপ্নে দেখেছি?’

মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল আমের, কোন জবাব দিল না। উনুশী বললো, ‘আমি কারো কাছ থেকে শুনে এসব কথা বলছি না। আমি নিজে তখন ঝোপের উল্টো পাশে বসেছিলাম। তোমাদের কানাঘুষা সব শুনেছি। তোমার কথাও শুনেছি। তুমি কি বলেছিলে সে কথা আমার কাছ থেকে শুনতে চাও? বলবো সে কথা?’

আমের চুপ। উনুশী বললো, ‘তোমাদের সবাইকে আমি জানি, চিনি। কিন্তু আগন্তুক লোকটাকে আমি চিনতে পারিনি। তার পরিচয় আমার জানা দরকার। লোকটা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে না পড়লে ঠিকই আমি তার পরিচয় বের করে ফেলতাম। কিন্তু লোকটি সেখান থেকে উঠে চলে গেল। আমিও সেখান থেকে উঠে চলে এলাম বলে তার পরিচয় আর জানা হয়নি।’

ইসহাক তুর্কী যখন ওখান থেকে উঠে চলে যাচ্ছিল, তখন সে কারো পায়ের চাপা পদধ্বনি শুনেছিল। একটু দূরে একটি ছায়া মূর্তিও আবছা দেখতে পেয়েছিল। সেই পদধ্বনি ও ছায়াটি ছিল উনুশীর। সে-ই রাজিয়া খাতুন, শামসুন নেছা ও আমেরের পিছনে লুকিয়ে তাদের কথোপকথন শুনেছিল।

আমের বিন উসমানের মুখে আর কোন কথা সরলো না। উনুশী ছিল সুদক্ষ গোয়েন্দা। আমেরের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, তার সন্দেহ যথার্থ। আমেরই তার মতই এখানে কারো হয় গোয়েন্দাগিরি করছে। কিন্তু কার? প্রশ্নটা জটিল হলেও উত্তর খুবই সোজা। সে আমাদের গোয়েন্দা নয়। হলব ও মুশেলের লোকদের এখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার নেই। তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর একটাই, এ লোক সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর গুপ্তচর। ‘আমের!’ অত্যান্ত মোলায়েম কন্ঠে উনুশী বললো, ‘যদি শুধু শামসুন নেছা একা তোমার সাথে বসা থাকতো, তবে আমি বুঝে নিতাম, সে শাহজাদী তোমাকে বশীভূত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা তো অন্য রকম ছিল। যদিও সব কথা আমি স্পষ্ট কর শুনতে পাইনি, কিন্তু এটা তো ঠিক, সবাই মিলে তোমরা কোন গোপন শলাপরামর্শ করছিলে?’

আমের হাসার চেষ্টা করতে করতে বললো, ‘এ সব কথার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে। আমাকে দয়া করে ওদের কাছে বসতে দিয়েছে এই তো ঢের। সামান্য রক্ষী হয়ে ওদের রাজকীয় ব্যাপারে নাক গলানো কি আমার শোভা পায়, নাকি ওতে জড়ানো আমার উচিত?’

‘আমের!’ উনুশী রাগের সাথে বললো, ‘তুমি জানো, আমি কে? আমার ইশারায় এ শহরের ইট দিয়ে আমি ইট ভাঙতে পারি। ভালবাসার পিপাসায় আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে গিয়েছিলাম। মন থেকে তোমাকে ভালবেসেছিলাম। আর সেই সুযোগে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে নিয়েছো। তবুও তোমার জন্য আমার অন্তরে যে অফুরন্ত ভালবাসা জন্মলাভ করেছিল তা আমি নষ্ট হতে দেব না। নইলে এতক্ষনে তুমি পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে না। আমার সামান্য ইশারাতে তুমি কারাগারের অন্ধ কুঠরিতে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে। কারাগারে গোয়েন্দাদের কি কষ্ট দেয়া হয়, কি অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয় সে অভিজ্ঞতা হয়তো তোমার নেই। তাই এখনো তুমি আমার সামনে মিথ্যা বলার সাহস পাচ্ছো।

আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্যের অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করে তোমাকে সেই জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছি। তুমি এও জানো, ইচ্ছে করলেই আমি তোমাকে এমনভাবে গুম করে দিতে পারতাম, যেমন একটি মশাকে টিপে মারার পর কেউ তার হদিস বের করতে পারেনা। শুধু প্রেমের খাতিরে আমি এসব কিছুই করিনি।

আমের! আমার একমাত্র ভালবাসা! আমার একমাত্র প্রেম! আমার জীবন! আমার মরণ ! তুমি শুধু এইটুকু কথা বলে দাও, যে আগন্তুক এসেছিল, তাকে তোমরা কি তথ্য দিয়েছো এবং এই তথ্য নিয়ে সে কোথায় গেছে?’

থামল উনুশী। একটু দম নিল। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, ‘আমার খাঁটি প্রেমের নিদর্শন দেখো, আমি তোমাদের সেই গোয়েন্দাকে বিনা বাধায় যেতে দিয়েছি। আমি ইচ্ছে করলেই তাকে আটকে ফেলতে পারতাম। কিন্তু তোমাকে ভালবাসার কারণে সে বিষয়ও আমাকে হজম করতে হয়েছে।’

উনুশীর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। সে কাঁদছিল আর বলছিল, ‘আমি যে এক হৃদয়স্পর্শী ধোঁকা। জীবনভর মানুষকে ধোঁকা দিয়ে এসেছি। অথচ যখন তোমাকে সত্যিকার ভালবাসা দিতে গেলাম তখন নিজেই কেমন মর্মান্তিক ধোঁকার স্বীকার হয়ে গেলাম। তুমি জিতে গেলে আর আমি হেরে গেলাম।

আমের, তুমি সত্যি করে বলো! সত্যি কথা বলো। তুমি যে আমার জীবন! তোমার কোন ভয় নেই। তোমার কোন ক্ষতি হওয়ার আগে আমার ক্ষতি হবে। আমি বেঁচে থাকবো আর তোমার ক্ষতি দেখবো, এমনটি কখনো হবে না।’

‘হ্যাঁ, উনুশী।’ আমের বললো, ‘তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছো। আমিও আমার দায়িত্য পালন করেছি। এবার তুমি আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে দাও। তোমার যা খুশি করো, আমার কিছু বলার নেই।’

উনুশীর চোখে তখন অশ্রুর বন্যা। কিন্তু সে সজোরেই হেসে উঠলো এবং বললো, ‘ব্যাস আমের! আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছো এবং সত্য কথা বলেছো, এটুকুই আমার দেখার ছিল। তুমি নিঃসংকোচে সত্য উচ্চারণ করেছো, এতেই আমি খুশি। তোমাকে আমি কখনো কারাগারে পাঠাবো না আমি প্রেমের মনোরম পিঞ্জরা থেকে মুক্ত হতে চাই না। আমি বাঁচলে তোমাকে নিয়ে বাঁচবো, মরলে তোমার সাথেই মরবো।’

আবেগতপ্ত কন্ঠে কথা বলছিল উনুশী। হঠাৎ সে চোখের পানি মুছে ঠোঁটে জড়িয়ে নিল হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করা হাসি। বললো, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। আজ আমার আনন্দের দিন। আমার ভালবাসাকে আজ আমি একান্ত করে পেয়েছি। আজকের এ আনন্দ দিনে তোমাকে আমি কি দিয়ে বরণ করবো ! তুমি তো মদ পান করো না। ঠিক আছে, মদ আমি তোমাকে দেব না। আজ আমি তোমাকে শাহী শরবত দিয়ে বরণ করে নেবো।’

সে সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালো। ওখানে সাজানো ছিল শরবতের পাত্র ও পিয়ালা। তার পিঠ আমেরের দিকে। উনুশী দুটি পিয়ালায় শরবত বানিয়ে নিয়ে আমেরের কাছে এলো। তার আগে আংটির সাথে জড়ানো কৌটাটি খুলে তার ভেতর থেকে সামান্য পাউডার মিশিয়ে নিল শরবতের সাথে।

আমের সে সব কিছুই দেখছিল না। সে তখন হারিয়ে গিয়েছিল ভাবনার অতল তলে। ভাবছিল, জীবন কি? প্রেম কি? উনুশী যে মহত্ব দেখালো তার বিনিময় কি?

উনুশী একটি পিয়ালা আমেরের হাতে দিয়ে দ্বিতীয় পিয়ালাটা তুলে নিল নিজের হাতে।

‘শুঁকে দেখো।’ উনুশী বললো, ‘এটা মদ নয় শরবত, আমার ভালবাসার শরাবান তহুরা! পান করো।’

সে পিয়ালা তার নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে নিল। আমেরও তার পিয়ালা ঠোঁটে লাগালো। এক চুমুক পান করে পিয়ালা থেকে ঠোঁট সরিয়ে তাকালো একে অন্যের দিকে। তারপর দু’জনেই পরষ্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার চুমুক দিল। আবারও পিয়ালা থেকে মুখ সরিয়ে মিষ্টি করে হাসলো উনুশী। আমের সে হাসির জবাব দিল হাসি দিয়ে। আবার ওরা চুমুক দিল এবং পিয়ালা শূন্য করে দিল।

উনুশী আমেরের হাত থেকে পিয়ালা নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর আমেরের গলা জড়িয়ে ধরে আবেগমাখা কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘এখন আমরা মুক্ত, আমের! পৃথিবীর কোন দ্বন্দ সংঘাত, নষ্টামী, স্বর্থপরতা আর আমাদের পরাজিত করতে পারবে না।’

আমেরের শরীর ঝিম ঝিম করতে লাগলো। গা অবশ হয়ে এলো। চেতনা নিস্তজ হয়ে গেলো। সে কোন রকমে উনুশীর বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘উনুশী! আমার যেন কেমন লাগছে। আমার হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। তুমিও কি ক্লান্তি অনুভব করছো? আমরা কি মারা যাচ্ছি উনুশী!’

‘না আমের!’ উনুশী উত্তর দিল, ‘আমরা গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে যাচ্ছি। চির শান্তির ঘুম। বড় আরামের ঘুম। দেখো না, আমাদের চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৃপ্তির ঘুমে ঢলে পড়ছে নশ্বর শরীর। এ ঘুম আর কোন দিন ভাঙবে না। কেউ আমাদের আর জাগাতে পারবে না।’

উনুশীর শেসের দিকের কথাগুলো কেমন জড়িয়ে গেলো।

‘উনুশী! এ তুমি কি করলে! আমি যে প্রচণ্ড ক্লান্তি বোধ করছি। তোমাকে বাইরে নিয়ে যাবো, ডাক্তার ডাকবো, সে শক্তিটুকুও যে আমার নেই।’

‘আমি তোমার থেকেও অধিক ক্লান্ত আমের। পাপ আমাকে তোমার চেয়েও বেশি ক্লান্ত করে দিয়েছে। বেশি কথা বলার সময় নেই আমের! শুধু শুনে রাখো, তুমি আমার প্রথম ও শেষ ভালবাসা। আমাদের দু’জনকে যে পরকালে একসাথে উঠানো হয় সে জন্য প্রার্থনা করো।’

‘হায় উনুশী! পৃথিবীতে এখনো যে অনেক কাজ পড়ে আছে। আইয়ুবীকে সতর্ক করতে হবে। গাদ্দারদের নির্মূল করতে হবে। কে করবে সে কাজ?’

‘দুঃখ করো না আমের! আমরা আমাদের ফরজ আদায় করেছি। তুমি তোমার ফরজ পূর্ণ করেছো, আমিও আমার ফরজ পূরণ করেছি। আমাদের ফরজ পূর্ণ হওয়ার পর আর কি কাজ বাকী থাকতে পারে! তাই তো আমি এ শরবতে বিষ মিশিয়েছি। যখন আমাদের মত মেয়েদেরকে কোন দায়িত্ব দিয়ে অন্য দেশে পাঠানো হয় তখনই এই বিষ আমাদের সাথে দিয়ে দেয়া হয়। কাজ শেষ হয়ে গেলে এই বিষ পান করে আমরা শান্তির রাজ্যে চলে যাই। দেখো, এই বিষ কত মধুর ও প্রশান্তিময়। এ বিষ পান করলে কোন কষ্ট ও তিক্ততা বোধ থাকে না। এক মিষ্টি আমেজের মধ্যে আস্তে আস্তে মানুষ চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যায়।’

আমের উঠে দরজা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। সে চাচ্ছিল, কোনমতে দরজা খুলে দাসীকে বলে, ‘আমরা বিষ খেয়ে ফেলেছি। জলদি ডাক্তার ডাকো। আমাদের বাঁচাও!’

কিন্তু সে উঠে দরজা খুলতে পারলো না, কিছু বলতেও পারলো না।

উনুশী তাকিয়ে ছিল আমেরের দিকে। আমেরও উনুশীর দিকে তাকিয়ে ছিল। আমেরকে দরজা খোলার চেষ্টা করতে দেখে উনুশী বললো, ‘পারবে না আমের, পারবে না। আর কেনইবা বেঁচে থাকতে চাও? এখন বেঁচে থাকলে পৃথিবী তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। তুমি কি সেখানে গিয়ে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে চাও? আমি বাঁচতে চাই না। কারাগারে তোমাকে যে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে, তা দেখার জন্য আমার বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া বেঁচে থাকলে কোন মেয়ে যদি এসে আমার আমেরকে তার বলে দাবী করে বসে, সে সুযোগ আমি কেন তাকে দেবো?’

আমের বিন উসমান লুটিয়ে পড়েছিল মেঝের ওপর। উনুশীর কোন কথাই এখন আর সে শুনতে পাচ্ছিল না। তার চোখ দু’টোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

উনুশীর মাথা তখনো সামান্য দুলছিল। সে তার টলোমলো পা নিয়ে দরোজা পর্যন্ত গেল। খাদেমা কাছেই বসেছিল। উনুশী তাকে ডেকে বললো, ‘আমরা দু’জনেই বিষ পান করেছি। তুমি সবাইকে জানিয়ে দিও, আমরা স্বেচ্ছায় বিষ পান করেছি। আমাদের অন্য কেউ বিষ পান করায়নি। কোন খৃস্টান যদি জিজ্ঞেস করে, তবে তাকে বলবে, সুদানের পরী তার দায়িত্ব পালন করেই মরেছে।’

সে আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু কন্ঠ দিয়ে আর কোন স্বর এলো না। তার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। সে আমেরের গায়ের ওপরই লুটিয়ে পড়লো।

খাদেমা দৌড়ে পাহারাদারের কাছে চলে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাহারাদারসহ কয়েকজন লোক ছুটে এলো সেখানে।

তারা এসে দেখলো ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ফেলল ওরা। কামরায় ঢুকেই দেখতে পেলো, দরজার পাশেই পড়ে আছে আমের বিন উসমানের লাশ। তার উপর কাত হয়ে পড়ে আছে উনুশী। তার মাথা আমেরের বুকের উপর এবং আমেরের মাথার চুলের মধ্যে তার এক হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকানো।

ইসহাক তুর্কী মুশেল থেকে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিল। সে যে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা এ কথা জেনেও উনুশী তাকে ধরিয় দেয়নি বা পিছু নেয়নি। তাকে গ্রেফতার করার কথা যখন মনে এলো তখনি আমেরের কথা স্মরণ হলো তার। আমের! এক অলীক বাস্তবতা। উনুশী ভেবে দেখলো, যদিও আমেরের ভালবাসা ছলনায় ভরা কিন্তু তার ভালবাসা তো ছলনাবিহীন, নির্ভেজাল। আর আমেরের ছলনাময় ভালবাসার কি কোন মূল্য নেই? যদি এ ছলনাটুকুও সে না দিত তবে কি করতে পারতাম আমি?

আমেরের এই ছলনাময় ভালবাসার খাতিরেই সে সিদ্ধান্ত নিল, না এই আগন্তুককে আমি রেহাই দেবো।

ইসহাক তুর্কীর কায়রো পৌঁছতে আরো কয়েকদিনের রাস্তা বাকি ছিল, এই সময় পাহাড়ী সাপে তার ঘোড়াকে দংশন করলো। তারপর কি অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট সয়ে পায়ে হেঁটে সে এগিয়ে গিয়েছিল সেই বর্ণনা ‘ইহুদী কন্যা’য় বলা হয়েছে।

ইসহাক তুর্কী খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে কায়রো যাচ্ছিল। ইসলামের সম্মান ও অপমান নির্ভর করছিল এ সংবাদ ঠিক জায়গায় সময় মত পৌঁছানো বা না পৌঁছানোর ওপর।

সে ছিল নির্ভিক এক মুজাহিদ। তাই এমন ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর মরুভূমি অতিক্রম করে কায়রো পৌঁছানোর জন্য সে একাকীই পথে নেমে এসেছিল। তার ঘোড়াকে সাপে দংশন না করলে ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো।

কিন্তু সাপে দংশন করার পরও দমে যাওয়ার পাত্র সে ছিল না। পদব্রজে হেঁটেই সে নিষ্ঠুর মরুভূমি পাড়ি দেয়ার সংকল্প নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু মানুষের সহ্য গুনেরও একটি সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম হয়ে গেলে এক সময় সে মরুভূমিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে খৃস্টানদের এক ক্যাম্পে। ক্যাম্পটি ছিল খৃস্টান গোয়েন্দাদের। বারো জনের এক ছোট্ট কাফেলা। দশজন পুরুষ আর দু’টি মেয়ে কায়রো থেকে যাচ্ছিল বৈরুত। মেয়েদের একজন খৃস্টান, অন্যজন ইহুদী। খৃস্টান কন্যা মেরিনা আর ইহুদী কন্যা বারবারাকে নিয়ে দলে চলছিল এক অঘোষিত যুদ্ধ। ইসহাক তুর্কী বেহুশ অবস্থায় বিড়বিড় করে কথা বলছিল। তার কথা শুনে খৃস্টানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, এ লোক মুসলমান গোয়েন্দা। সে কোন জরুরী সংবাদ নিয়ে কাযরো যাচ্ছে।

কমাণ্ডারকে নিয়ে মেরিনা ও বারবারার মধ্যে চলছিল প্রকাশ্য শত্রুতা। প্রত্যেকেই কমাণ্ডারকে নিজের করায়ত্ত্বে রাখার জন্য সচেষ্ট ছিল। কিন্তু কমাণ্ডার বারবারার সাথে ছলনা করে মেরিনার সাথে গভীর সখ্যতা গড়ে তুললো।

বারবারা এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইসহাককে গোপনে সতর্ক করে দেয়।

সে যে খৃস্টান গোয়েন্দাদের ফাঁদে পড়ে গেছে এ তথ্য জানতে পেরে ইসহাক পড়ে যায় মহা ফাঁপড়ে। কারণ ইসহাক এরই মধ্যে স্বীকার করে ফেলেছিল, সে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা এবং হলব থেকে কায়রো যাচ্ছে।

খৃস্টান কমাণ্ডার তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি সংবাদ নিয়ে কায়রো যাচ্ছ?’

ইসহাক জবাবে বললো, ‘খবর তো খুবই চমকপ্রদ ও মুখরোচক। নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুন রানী হওয়ার লোভে হলবের শাসনকর্তা ইয়াজউদ্দীনকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।’

খৃস্টান কমাণ্ডার বললো,’ এ সংবাদ তো অনেক পুরানো হয়ে গেছে। এখন তো সুলতান আইয়ুবী বৈরুতের দিকে অভিযানে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তুমি আসল খবর বলছো না কেন।’

‘সুলতান যে বৈরুত অভিযানে বের হচ্ছেন সেই খবরই তে আমি জানি না, তো বলবো কোত্থেকে?’

খৃস্টান কমাণ্ডার বললো, ‘শোন ইসহাক, আমি তোমাকে একটি সদুপদেশ দিতে চাই। তুমি আইয়ুবির গোয়েন্দা, এ কথা ভুলে যাও। পক্ষ ত্যাগ করে তুমি আমাদের দলে শামিল হয়ে যাও। এতে তোমার অনেক লাভ হবে।

তুমি কায়রোতে কি গোপন খবর নিয়ে যাচ্ছিলে আমাকে বলে দাও। আর বৈরুতে তোমাদের যে গোয়েন্দা আছ তাদের নাম কি, তারা কে কোথায় আছে সব আমাকে বলো।

তুমি যদি স্বেচ্ছায় এসব তথ্য আমাদের না জানাও তবে তোমাকে বৈরুতে নিয়ে গিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেবো। কারাগারের গোপন কক্ষে গোয়েন্দাদের কেমন শাস্তি দেয়া হয় নিশ্চয়ই তুমি তা জানো?’

ইসহাক এই প্রস্তাব মেনে না নিয়ে বিদ্রোহ করতে পারতো। কিন্তু তাতে বিপদ বাড়াবে ছাড়া কমবে না। তাই সে কৌশলের আশ্রয় নিল। বললো, ‘আমাকে একটু সময় দাও, ভেবে দেখি।’

সে এই আশায় সময় নিল, যাতে পালাবার কোন পথ পেলে তাকে কাজে লাগাতে পারে। সে ছিল নিষ্ঠাবান এক মুজাহিদ। কোন ভয়ভিতী বা প্রলোভন দেখিয়ে তাকে বিপথগামী করা সম্ভব ছিল না।

খৃস্টান গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার পর সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, কিছুতেই খৃস্টানদের গোয়েন্দাদের হাতে আমি আসল গোপন খবর তুলে দেবো না। যত প্রলোভনই দেখানো হোক, তারা জানে না, কোন প্রকৃত মুজাহিদ কখনো দল ত্যাগ করে না। ঈমানদার তো দ্বীনের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়, কিন্তু কখনো মাথা নত করে না। শত্রুর রক্তচক্ষুকেও ভয় পায় না।

সে বৈরুত সম্পর্কে কোন কথাই বললো না ওদের। বরং ওরা যখন বৈরুত সম্পর্কে জানতে চাইলো, সে বললো, ‘আমি তো বৈরুত কখনো যাইনি, তাই বৈরুতের পথঘাট চেনা নেই আমার।’

দলের কমাণ্ডার বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি ভেবে দেখ কি করবে। মতামত কাল জানালেও চলবে। আমরা রাতেই বৈরুতের পথে যাত্রা শুরু করবো। তুমি সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত বন্দী হিসাবে আমাদের সাথে পথ চলবে।’

ইসহাক যখন শুনলো, তারা বৈরুত যাচ্ছে, তখন তার পেরেশানী আরো বেড়ে গেল। সে অস্থির হয়ে ভাবতে লাগলো, সেখানে গেলেই তো নাইটের সাথে দেখা হবে। নাইট যদি জানতে পারে সে গোয়েন্দা, তাহলে তার আর বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। কিন্তু এটিই তার বড় সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হলো, সুলতান আইয়ুবীকে সম্রাট বিলডনের যুদ্ধের প্ল্যান ও সামরিক প্রস্তুতির সংবাদ জানানে। এখানে বন্দী হয়ে পড়ে থাকলে এ খবর কখনোই তার কাছে পৌঁছবেনা। আর এ খবর না পেয়ে তিনি যদি বৈরুত অবরোধ করে বসেন তাহলে মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে তাকে।

ইসহাক মনে মনে সংকল্প করলো, এই সংবাদ জানানোর জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করবো। প্রয়োজনে এ জীবন বিলিয়ে দেবো কিন্তু এমন মারাত্মক খবর বুকে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

রাতে কাফেলা সেখান থেকে যাত্রা শুরু করলো। ইসহাকের দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল এক কমাণ্ডো। সেই অবস্থায় তাকে তুলে দেয়া হলো এক উটের ওপর। তার সাথে উটে চাপানো হলো নানা রকম সরঞ্জাম।

সুলতান আইয়ুবীর বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কী গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে বৈরুত থেকে রওয়ানা হয়েছিল কায়রো। পথে অন্তহীন সমস্যা ও বিপদে পড়ে এখন আবার বৈরুত ফিরে যাচ্ছে বন্দী অবস্থায়। এ পথও ভয়ংকর বিপদসংকুল। তার ওপর নজর রাখছে দুর্ধর্ষ খৃস্টান কমাণ্ডোরা। যাত্রা পথ দীর্ঘ।

ইসহাক তুর্কী এদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবার আশা নিয়ে বসে আছে উটের পিঠে। সে জানে না, তার এ আশা আদৌ সফল হবে কিনা।

❀ ❀ ❀