» » সামনে বৈরুত

বর্ণাকার

রাতটি নিরাপদেই কাটলো তার। অনেকদিন পর দেখা হলো পুরনো বন্ধুদের সাথে। তাদের কাছ থেকে সে জেনে নিল শহরের বর্তমান হাল হাকিকত। শাসকদের মনোভাব সম্পর্কেও মোটামুটি একটি ধারনা পেল।

ইচ্ছে ছিল সকালেই এখান থেকে রওনা হয়ে যাবে। সফরের ক্লান্তি দুর করার জন্য যতটা সম্ভব ঘুমিয়ে কাটাবে রাত। সকালে নাস্তা শেষে ঘোড়া পাল্টে আবার পথে নামবে।

কিন্তু সাথীদের কাছ থেকে সে এমন একটি তথ্য পেলো, যা তার চিন্তারও বাইরে ছিল। সে জানতে পারলো, মহিয়সী রাজিয়া খাতুন এখন হলব নয়, মুশেলে অবস্থান করছেন। হলব ও মুশেলের শাসকরা রাজ্য বদল করার কারনে ইয়াজউদ্দীনের সাথে তাকেও মুশেল চল আসতে হয়েছে।

ইসহাক তুর্কী ভেবে দেখলো, রাজিয়া খাতুন মুশেল থাকার অর্থ হচ্ছে, তার দাসীও এখন হলব ছেড়ে মুশেলে চলে এসেছে। এই দাসীর সাথে দেখা না করে তো যাওয়া যায় না!

তাছাড়া সুযোগ পেলে রাজিয়া খাতুনের সাথেও একটু দেখা করতে চায় সে। তিনি কোন পরামর্শ দেন কিনা তা না জেনেই এখান থেকে বিদায় হওয়ার কথা সে ভাবতে পারলো না। ফলে ভোরেই রওনা হওয়ার চিন্তা সে বাদ দিয়ে সে সাথীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘুমুতে চলে গেল।

এতদিনে ইয়াজুদ্দীনের মনে একটি নিশ্চিত ধারনা জন্মেছে যে, রাজিয়া খাতুন তার স্বামীত্বকে বরণ করে নিয়েছে এবং তার বন্যতা মেনে নিয়েছে। কারণ, হলবে সেই যে একদিন তার সাথে তিক্ত কথোপকথন হয়েছিল এরপর থেকে রাজিয়া খাতুন আর কোনদিন রাজনৈতিক ব্যাপারে তাকে কোন প্রশ্ন করেনি এবং অবাধ্যতা দেখায়নি। বরং দু’দিনেই নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

ইয়াজউদ্দীনের মনে একটি ভয় ছিল, হয়তো হলব থেকে মুশেল আসার ব্যাপারে রাজিয়া খাতুন তাকে প্রশ্ন করবে এবং বিষয়টি সহজভাবে মেনে নেবে না। কিন্তু ইয়াজউদ্দীন অবাক হয়ে গেল, রাজিয়া খাতুন এটা কেবল মেনেই নেয়নি, বরং তাকে এখন আগের চাইতে সন্তুষ্টচিত্ত দেখাচ্ছে। এতে ইয়াজউদ্দীনও খুশি হলো।

রাজিয়া খাতুন বুদ্ধিমতি মহিলা ছিলেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ইয়াজউদ্দীনকে বিয়ে করেছেন তা সফল হবার নয়। গাদ্দারীর যে রোগে তাকে পেয়েছে তা কোনদিন নিরাময় হবে না। তার সাথে এখন লাগালাগি করতে গেলে বিপদ বরং বাড়বে। এজ্যনই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন এবং নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন।

গাজী সালাউদ্দন আইয়ুবী সর্বত্র গোয়েন্দাদের যে জাল বিছিয়ে রেখেছিলেন তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন তিনি। ইয়াজউদ্দীন তার জন্য যে দাসী নিয়োগ করে রেখেছিলেন সেই দাসী ছিল আইয়ুবীর এক নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা। এই দাসীই তার দুর্দিনে শান্তনার বানী নিয়ে এলো এবং কর্মের এক নতুন পথ তার সামনে মেলে ধরলো

রাজিয়া খাতুনের কন্যা শামসুন নেছা এতদিন রাজমহলে রাজকন্যার মতই নিশ্চিন্ত জীবন কাটিয়েছে। সেই শান্তিময় জীবন থেকে রাজিয়া খাতুন তাকে কঠিন বাস্তবতার ময়দানে টেনে নিয়ে এলেন। যে জগত সম্পর্কে কিছুই জানতো না সে, যে জগতের কোন ধারনাও তার ছিল না, তাকে নিয়ে আসা হলো সেই রহস্যময় জগতের একেবারে কেন্দ্রস্থলে।

এতদিন আমের বিন উসমানকে কেন্দ্র করে সে মনে মনে যে কল্পনার জগত গড়ে তুলেছিল, সেই সাধের পৃথিবী ছেড়ে সে আছড়ে পড়লো এক ঊষর মরুভূমিতে। রাজিয়া খাতুন তার সামনে মেলে ধরলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপি যে ষড়যন্ত্র চলছে তার এক নিখুঁত চিত্র। এ চিত্র দেখে শিউরে উঠলো চির আদরে লালিত এক রাজকন্যা, শামসুন নেছা।

এখন আর সে কোন আদুরে দুলালী নয়, সে হয়ে উঠল জেহাদের জঙ্গী পুরুষ নূরিদ্দীন জঙ্গীর বিপ্লবী চেতনার দোসর। শামসুন নেছা এখন কেবল তাঁর রক্ত সম্বন্ধীয় মেয়ে নয়, তার মানসকন্যাও। রাজিয়া খাতুনের কাছ থেকে বিপ্লবের আহবান পেয়ে মোহের পর্দা ছিঁড়ে জিহাদী জীবন বরণ করে নিল শামসুন নেছা।

অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজিয়া খাতুন তাকে নিবেদিতপ্রাণ এক গোয়েন্দা বানিয়ে নিলেন। গোয়েন্দাগিরিতে নাম লিখিয়েই শামসুন নেছাকে এমন কোরবানী দিতে হলো, পৃথিবীতে কখনো কেউ কাউকে দেয় না। নিজের ভালবাসার জনকে স্বেচ্ছায় ও আপোষে তুলে দিতে হলো এক বদ মেয়ের হাতে।

আমের বিন উসমান উনুশীর কাছ থেকে যেসব গোপন তথ্য বের করে নিয়েছে শামসুন নেছার মাধ্যমে তার সবই জেনে নিয়েছিলেন রাজিয়া খাতুন। তিনি এ সংবাদ অতি দ্রুত কায়রো পাঠানো জরুরী মনে করছিলেন। হলব থেকে আসার সময় দাসী ছাড়াও যে সব গোয়েন্দা তাদের সাথে এসেছিল তিনি তাদের একজনকে বললেন, ‘জরুরী খবর আছে। এ খবর নিয়ে জলদি কায়রো রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।’

মুশেলের গোয়েন্দা প্রধানের কানে গেল এ খবর। তিনি সেই গোয়েন্দাকে বললেন, ‘মোহতারামা রাজিয়া খাতুনকে গিয়ে বলো, ইসহাক তুর্কী নামে আমাদের এক গোয়েন্দাকে বৈরুত পাঠানো হয়েছে। ওখানকার খবর নিয়ে এদিক হয়েই তার কায়রো যাওয়ার কথা। বৈরুতের খবর ছাড়া সব খবরই অসম্পূর্ণ।

আলী বিন সুফিয়ান আমাদের বলে দিয়েছেন, খৃস্টানরা আগামীতে কি পদক্ষেপ গ্রহন করছে তার ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু। তাই আমার মনে হয়, ইসহাকের জন্য আরো দু’একদিন অপেক্ষা করা যেতে পারে। যদি তার আসতে খুব বেশি দেরী হয় তবে না হয় আমি এখানকার খবর নিয়েই তোমাকে কায়রো পাঠিয়ে দেবো। উনুশীর দেয়া তথ্যে কোন ফাঁক ছিল না। সে খুব ঝানু গোয়েন্দা ছিল এবং দরবারের সমস্ত আমীরদের সে হাতের ইশারায় নাচাতে পারতো। সে ভাল মতই জানতো, কখন কার সাথে কি ব্যবহার করতে হবে এবং কার কাছ থেকে কি তথ্য বের করে আনতে হবে।

আমের উনুশীর মত দক্ষ গোয়েন্দা না হলেও সে ছিল খুবই দায়িত্ববান লোক। কাজে কর্মে নিষ্ঠা থাকার কারণেই সে এত অল্প বয়সে এত উন্নতি করতে পেরেছে। আমের এমনভাবে উনুশীর সাথে ভালবাসার অভিনয় করছিল যে, উনুশী কখনো তাকে গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করার অবকাশ পায়নি। তাই সে আমেরের কাছে অবলীলায় সব গোপন কথা প্রকাশ করে দিয়েছিল।

ইয়াজউদ্দীন মাসুদ এখন রাজিয়া খাতুনের ব্যবহারে সন্তুষ্ট। তাই তিনি রাজিয়া খাতুনের মন জুগিয়ে চলার জন্য চেষ্টা করতেন। কখনো কখনো ওরা বিকেলে শহরের সন্নিকটে শাহী বাগানে বেড়াতে যেতেন। ইয়াজউদ্দীন ব্যস্ত থাকলে রাজিয়া খাতুন কন্যা শামসুন নেছাকে নিয়ে বৈকালিক ভ্রমনে বের হতেন। বাগানটি শহরের বাইরে বলে সবসময়ই তাদের সাথে থাকতো নিরাপত্তা রক্ষী।

ইয়াজউদ্দীন মাসুদ আমের বিন উসমানকে খুব বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি রাজিয়া খাতুনদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমেরের ওপরই দিয়ে রেখেছিলেন। আমের এ দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করছিলো। তারা বাগানে রওনা হলে আমের নিজেও তাদের সাথে বাগানে চলে যেতো।

সেদিনও বিকেলে ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ে বাগানের দিকে রওনা দিলেন রাজিয়া খাতুন। সঙ্গে শামসুন নেছা এবং দাসী। রক্ষী হিসাবে তাদের সঙ্গে চললো আমের বিন উসমান।

শহরের পাশেই সবুজ উদ্যানে প্রবেশ করলো তাদের ঘোড়ার গাড়ী। রাজিয়া খাতুন গাড়ী ছেড়ে বাগানে নেমে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে শামসুন নেছা, দাসী এবং আমেরও নেমে তাকে অনুসরণ করলো।

জায়গাটি অতি মনোরম। বাগানের একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী।অন্য পাশে জনগনের চলাচলের রাস্তা।

এ বাগানে জনগনের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র শাহী পরিবারের লোকজন ও মেহমানদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল এ বাগান।

রাজিয়া খাতুন কেবল ভ্রমনের উদ্দেশ্যেই এ বৈকালিক সফরে বের হতেন না। এ সফর থেকে তিনি আরো কিছু ফায়দা হাসিল করে নিতেন। আমের উনুশীর কাছ থেকে যে সব তথ্য সংগ্রহ করতো সে সব তথ্য তিনি জেনে নিতেন এই ফাঁকে। সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তাদের করণীয় কি হতে পারে তাও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করে নিতেন।

রাজিয়া খাতুন ঝর্ণার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলেন। রাজিয়া খাতুনের পাশে শামসুন নেছা, পেছনে দাসী ও আমের পাশাপাশি।

ওরা যখন বাগানে কথা বলছিল, ইসহাক তুর্কীকে তখন তার এক সঙ্গী বলছিল, ‘তুমি যে দাসীর সাথে দেখা করার জন্য সারাদিন ধরে বসে আছো, সন্ধার পর সে একবার রিপোর্ট করতে আসবে ঠিকই, কিন্তু ইচ্ছে করলে তার আগেও তুমি তার সাথে দেখা করতে পারো।’

‘কিভাবে?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ইসহাক তুর্কী।

এইমাত্র আমি দেখে এলাম, রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছা শাহী বাগানে বেড়াতে বেরিয়েছে। তাদের সঙ্গে আছে দাসী এবং আমের বিন উসমান নামে এক রক্ষী। এই রক্ষীও গোপনে আমাদের সাহায্য করছে।’

খবরটা ইসহাক তুর্কীকে দারুণভাবে পুলকিত করলো। দাসীর সাথে দেখা করার সঙ্গে সঙ্গে রাজিয়া খাতুনের সাথে একটু দেখা করার ইচ্ছা আগে থেকেই তার মনে উঁকিঝুকি মারছিল। কিন্তু দাসীর সাথে আলাপ না করে এ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ইসহাক তুর্কী আর দেরী করলো না, সঙ্গে সঙ্গে বাগানের দিকে রওনা হয়ে গেল।

রাজিয়া খাতুন ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। শামসুন নেছা এবং দাসীও তার সাথেই ছিল। আমের গত রাতে উনুশীর কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছিল তা ওদেরকে শোনাচ্ছিল।

আমের বলছিল, ‘ইয়াজউদ্দীনের মনোভাব মোটেই সুবিধের নয়। সে এরই মধ্যে সম্রাট বিলডনের সাথে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। প্রকাশ্যে সে সুলতানের সাথে নিজেকে জোটবদ্ধ শক্তি হিসাবেই প্রকাশ করবে। কিন্তু কার্যতঃ সময় মত সে সুলতানকে সহযোগীতা করবে না।

সুলতান রসদ চেয়ে পাঠালে সে প্রতারণা করবে। সেনা চেয়ে পাঠালে বাহানা করে বলবে, ‘আরমেনীয়দের হামলার আশংকায় এমনিতেই আমি অস্থির। তাই একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্বেও এই মুহূর্তে সৈন্য পাঠাতে পারছিন বলে দুঃখিত।’

কথা শেষ হলে ঝরণার পাশ থেকে উঠে এলো আমের। রাজিয়া খাতুন শামসুন নেছা বসে রইল ঝরণার দিকে মুখ করে। দাসীও ওদের সাথেই বসেছিল, একটু পর উঠে ওদের কাছ থেকে সামান্য সরে গিয়ে ফুলের সৌন্দর্য দেখতে লাগলো।

আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ফুলের সৌন্দর্য দেখছে দাসা, হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো অদ্ভুত এক গানের কলি। তেমন সুরেলা নয়, বোঝাই যাচ্ছে এ লোক পেশাদার কোন গায়ক নয়, কিন্তু বড় দরদ দিয়ে গাইছে গানটি। গানের কথাগুলো নতুন এবং ইঙ্গিতধর্মী। কান পাতলো দাসী। লোকটি তখন গাইছে:

আমি এক মরুভূমির যাত্রী

তারার লক্ষ্য পানে ছুটে চলেছি

বহু দূর দেশ থেকে

একবার দেখা পেতে

অনেক কষ্টে আমি ছুটে এসেছি।

বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাই

একবার তব দেখা যদি আমি পাই

এ আশায় আনমনে গেয়ে চলেছি।

ভ্রমনের নাম করে তুমিও এসেছ জানি

লুকিয়ে রেখেছ কি কথার খনি

সে কথা জানতে শুধু ব্যকুল হয়েছি।

আমি এক মরুভুমির যাত্রী

তারার লক্ষ্য পানে বাগানের পাশ ঘেঁষে ছুটে চলেছি।

চমকে উঠল দাসী! এ কেমন কথা! কি কথা জানতে চায় যুবক! কার কাছে জানতে চায়!

সে চোখ তুলে তাকাল বাগানের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে সেদিকে। তাকিয়েই সে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এক যুবক তার দিকেই তাকিয়ে আছে অনিমেষ চোখে। যদিও সে খুব আস্তে ধীরে হাঁটছে, কিন্তু রাস্তার দিকে তার চোখ নেই, মুহূর্তের জন্যও সে চোখ ফেরাচ্ছে না-অন্যদিকে।

দাসী ঝোঁপঝাড়ের আড়াল নিয়ে যুবকের দিকে এগিয়ে গেল। গান শুনেই সে বুঝেছিল, এটা কোন গান নয়। কোন গোয়েন্দা কারো সাথে দেখা করার জন্য এ গানের মাধ্যমে গোপন সংকেত দিচ্ছে। কেউ শুনলে ভাববে, আপনভোলা কোন পথিক আপন মনে গান গাইছে। কিন্তু যাদের গোয়েন্দা কাজের সামান্য অভিজ্ঞতা আছে সেই বুঝবে, এ গান কাউকে ডাকছে।

যুবকটি তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মানে তাকে উদ্দেশ্য করেই এ গান গাইছিল যুবক? কিন্তু কে এই যুবক?

কৌতুহলী দাসী যুবকের আরো কাছে গিয়ে ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ ফেললো যুবকের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেললো ইসহাককে। ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো দাসী। ইসহাক বললো, ‘তাড়াতাড়ি শোন, হাতে বেশি সময় নেই।’

দাসী আরো কয়েক কদম এগিয়ে বললো, ‘ভয় নেই, ভেতরে চলে আসুন এবং আমাকে অনুসরণ করুন।

এই বলে দাসী আর দাঁড়াল না, একদিকে হাঁটা দিল। ইসহাক এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে বাগানে ঢুকে গেল এবং কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাসীর পিছে পিছে হাঁটতে লাগলো।

দাসী রাজিয়া খাতুনের কাছে গিয়ে আস্তে বললো, ‘এদিকে আসুন।’

ওর কন্ঠস্বরে চমকে গেলেন রাজিয়া খাতুন। কিন্তু প্রশ্ন না করে তাকে অনুসরণ করলেন।

সন্ধা হয়ে গিয়েছিল। গাছের ছায়ায় জমা হচ্ছিল চাপ চাপ অন্ধকার। দাসী তেমনি এক অন্ধকার ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গেল রাজিয়া খাতুনকে। ওখানেই অপেক্ষা করছিল ইসহাক তুর্কী।

রাজিয়া খাতুনকে অনুসরণ করে শামসুন নেছা এবং আমের বিন উসমানও সেখানে পৌঁছে গেল। দাসী বললো, ‘এই হচ্ছে ইসহাক তুর্কী, যার কথা আপনাকে আগেও বলেছি।’

রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘বসো বাছা। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।’

ওরা সেখানে সবাই বসে পড়লো। জায়গাটার চারদিকে ছোট বড় বেশ কয়েকটি ঝোঁপ। দূর থেকে তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। ওরা বাগানের সেই অন্ধকার কোণে বসে আলাপ শুরু করলো।

ইসহাক তুর্কী বললো, ‘আমি জানতাম না আপনি এখানে। এখানে এসেই শুনতে পেলাম, আপনি হলব থেকে মুশেল চলে এসেছেন। তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আপনার সাথে দেখা না করে যাবো না আমি। যাক, সহজেই আপনার সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম, সে জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করছি। এবার বলুন, আমার জন্য আপনার কি হুকুম।’

‘তোমাকে হুকুম করবো তেমন অবস্থা আমার নেই। তুমি জানো না, আমি এখন কিভাবে দিন কাটাচ্ছি। মরহুম নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর কাউকে আমি বিয়ে করবো এমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু আমাকে যখন বলা হলো, ইয়াজউদ্দীনকে সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য আমার তাকে বিয়ে করা দরকার, কেবল ইসলামের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই আমি সে প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম।

কিন্তু আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। আমি বুঝতে পারিনি, ইয়াজউদ্দীন বিয়ের নামে আমাকে বন্দি করার ফন্দি এঁটেছে। তার ষড়যন্ত্র সে সফল হয়েছে। সে আমাকে তার হেরেমে এনে বন্দি করেছে, যাতে আমি আর দামেশকের জনগনকে জিহাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে না পারি।

মরহুম নুরুদ্দীন জঙ্গী ইসলামকে বিজয়ী করার যে স্বপ্ন দেখতেন, ইয়াজউদ্দীনকে সেই স্বপ্ন পূরনের সেনাপতি বানানোর সংকল্প নিয়ে তার ঘরে এসেই আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম।

ইয়াজউদ্দীন সুলতান আইয়ুবীর সামরিক জোটে থাকলেও তলে তলে সে যে গাদ্দারীর খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে, তা আমি বা সুলতান কেউ জানতাম না। তার হেরেমে বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি এসবের কিছুই জানতাম না। যখন জানলাম তখন আমার আর কিছুই করার ছিল না। তবু আল্লাহর শোকর আদায় করি, এই দাসী আইয়ুবীর গোয়েন্দা থাকার ফলে দ্বীনের সামান্য খেদমত করার পথ সে আমার জন্য খুলে দিয়েছে।’

রাজিয়া খাতুনের গলা ধরে এসেছিল। তিনি একটু বিরতি নিয়ে আবার বলতে নুরু করলেন, ‘ইচ্ছে ছিল, ইয়াজউদ্দীনকে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর দক্ষিণ হস্ত বানাবো। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর সফল উত্তরাধিকারী বানাবো।

কিন্তু সে স্বপ্নের যেদিন মৃত্যু ঘটল, সেদিন নিজেকে সামলাতে পারলাম না, যদি আইয়ুবীর এই গোয়েন্দার সাক্ষাত না পেতাম। আমি তোমাকে এখানকার অবস্থা বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি। দ্রুত এ খবর আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দাও, যাতে আমার মত তাকেও ধোঁকায় পড়তে না হয়।’

এরপর তিনি মুশেলের সামগ্রিক পরিস্থিতি ইসহাক তুর্কীর সামনে তুলে ধরলেন।

‘আপনি ইয়াজউদ্দীন ও ইমামউদ্দীনের ওপর কোন ভরসা করবেন না। এরা আমাদের কোন সাহায্য করবে না। আপনি সুলতান আইয়ুবীকে বলবেন, ‘বৈরুত অবরোধের আগে সুলতান যেন হলব ও মুশেলে অভিযান চালিয়ে এইসব গাদ্দারদের আগে শায়েস্তা করেন। এতেই ইসলামের বিরাট খেদমত হবে।’ রাজিয়া খাতুনের কথা শেষ হলে উদ্বিগ্ন শামসুন নেছা আক্ষেপের সুরে বলল।

‘মুসলিম শাসকদের অবস্থা যদি এই হয়, সামান্য লোভ লালসায় পড়ে যদি তারা গাদ্দারীর খাতায় নাম লিখিয়ে দেয়, তবে আমার ভয় হয়, বায়তুল মুকাদ্দাসের মতো কাবা শরীফও না জানি কবে ইহুদি ও খৃস্টানরা দখল করে নেয়।’ এবার কথা বললো আমের বিন উসমান।

‘এতটা নিরাশ হয়ো না আমের। ইসলামের ইতিহাসে শুধু গাদ্দার নয় মুজাহিদও আছে। নিজের বাপ-দাদাদের ইতিহাসের দিকে তাকাও। যখন শাসকরা দ্বীন ও দেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, মুজাহিদরা বসে থাকেনি, নিজের রক্ত ঢেলে তারা জাতির গৌরব রক্ষা করেছে। তারা অকাতরে রক্ত দিয়েছে, আহত হয়েছে, নিহত হয়েছে। কিন্তু জাতির সম্মান ভূলুন্ঠিত হতে দেয়নি। এ ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।’

এবার মুখ খুললেন রাজিয়া খাতুন, সে আমি জানি বেটা। তবু যখন জাতির বিলাস প্রিয় আমির ও শাসকরা শত্রুদের পাঠানো মদ ও সুন্দরী নারীদের খপ্পরে পড়ে ভুলে যায় জাতির কথা, তখন বড় কষ্ট পাই। যখন দেখি ধনরত্ন ও সম্পদের নিচে চাপা পড়ে যায় মুসলমানদের ঈমান, তখন সে কষ্ট আরো বেড়ে যায়।’

‘শুধু ওদের কথাই বললেন! আপনি কি দেখছেন না আল্লাহর সৈনিকরা দুস্তর মরু, সুউচ্চ পাহাড় আর অথৈ সমুদ্রের বাঁধাকেও থোড়াই তোয়াক্কা করছে? আমাদের প্রিয় নেতা সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী তো পুরোটা জীবনই মরুভূমি ও পাহাড়ে যুদ্ধ করে কাটিয়ে দিলেন।’

‘হ্যাঁ, আমার প্রথম স্বামীও সারা জীবন শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন। কিন্তু এখন যে শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের জ্ঞাতি ভাইয়েরা! যখন তুমি বেঈমান শাসকদের বিরুদ্ধ অস্ত্র ধরবে তখন তারা তোমাদেরকেই জাতির দুষমন ও খুনি বলে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বসবে।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমরা জানি এগুলো নিত্য নতুন ফেৎনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা এসব ফেৎনা ফাসাদের পরোয়া করি না। খৃস্টান ও ইহুদিরা এসব ফেৎনা সৃষ্টি করে আমাদের দুর্বল করতে চাইছে। আমরা এসব ফেৎনার মূল উপড়ে ফেলে জাতির দৃষ্টি থেকে মিথ্যার আবরণ সরিয়ে দেব, আপনি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

‘সাবাস বেটা ! এই তো চাই। তোমরা এসো, এসো ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম বেগে, এসো মরু সাইমুম হয়ে। তুফানের মত সব বাঁধা মাড়িয়ে তোমরা এসো, এসো রহমতের বৃষ্টি ধারার মত। আমি তোমাদের জন্য কেবল দোয়া করবো না। আমিও সেই বৃষ্টি ধারার সামান্য ফোটা হতে চাই। আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের জন্য ময়দান পরিষ্কার করে রাখবো। এখানকার প্রতিটি শিশুও তোমার সঙ্গী হবে।’

প্রচণ্ড আবেগে তখন তিনি কাঁপছিলেন। চেহারায় খেলা করছিল সাহস ও প্রেরণার জ্যোতি।

ইসহাক তুর্কী আর কথা বাড়াল না, সে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

সে সেই ছায়াঘন জায়গা থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছে, মনে হলো ঝোপের উল্টো দিকে কারো পদধ্বনি। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। অন্ধকার তখন বেশ চেপে বসেছে, তবু তার মনে হলো ঝোপের ওপাশ দিয়ে একটি ছায়া হেঁটে যাচ্ছে। সে গলা বাড়িয়ে দেখতে গেল, ততক্ষনে ছায়াটি ঝোপের মধ্যে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।

এ নিয়ে সে আর খোঁজাখুঁজি করতে গেল না ইসহাক। কারণ কায়রো যাওয়ার চিন্তা তার মনকে তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, যে প্রকারেই হোক যত দ্রুত সম্ভব তাকে কায়রো পোঁছতে হবে।

সে ওখান থেকে রাস্তায় এসে উঠল। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা রকম চিন্তা, সুলতান আইয়ুবী তো এরই মধ্যে স্বসৈন্যে অভিযানে বেরিয়ে পড়েননি!

এখানকার কাজ তার শেষ। প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সকল সাথীদের সাথেই দেখা হয়েছে। এবার দ্রুত রওনা হতে হয়।

সে যেখানে তার ঘোড়া রেখেছিল সেখানে পৌঁছে গেল। কালবিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি সামান্য কিছু মুখে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু করলো। গন্তব্য তার কায়রো কিন্তু সুলতান যদি হলবের অবস্থা জানতে চান? তাছাড়া তার কমাণ্ডার হলবে অবস্থান করছেন।

হলবের খবর জানা এবং কমাণ্ডারকে সব জানানো দু’কারণেই তার হলব যাওয়া জরুরী। পথে নেমেই সে সিদ্ধান্ত নিল, হলব হয়েই সে কায়রো যাবে।

অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে সে হলবে পৌঁছালো। কমাণ্ডারের দেখা করে সংক্ষেপে খুলে বললো সব কথা। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে কমাণ্ডার তাকে বললো, ‘তুমি সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নাও। আমি তোমার ঘোড়া পাল্টাবার ব্যবস্থা করছি।’

ইসহাক বিশ্রামে গেল। কমাণ্ডার তার জন্য উন্নত জাতের তাজাদম ঘোড়া প্রস্তুত করলো। পানির মশক ভরে ঝুলিয়ে দিল ঘোড়ার সাথে। শুকনো খাবার এবং সফরের আরো কিছু টুকিটাকি জিনিস থলিতে বেঁধে ঘোড়ার সাথে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ইসহাক তুর্কীকে ডেকে বললো, ‘তোমার ঘোড়া প্রস্তুত।’

ইসহাক তুর্কী নতুন ঘোড়ায় চেপে কায়রোর দিকে যাত্রা করলো।

সে রাতের ঘটনা; যে রাতে ইসহাক তুর্কী সন্ধ্যার অন্ধকারে নিরাপদ শাহী বাগানের নিভৃত কোণে রাজিয়া খাতুনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল।

আমের, রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছা যথাসময়ে মহলে ফিরে এলো। সবাই এটাকে প্রতিদিনের মত এক নির্দোষ ভ্রমণ বলেই ধরে নিল। সেখানে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের আদান প্রদান হয়েছে মহলের কারোরই সে কথা জানার কথা নয়।

সে রাতে ইয়াজউদ্দীন তার দরবারে এক মাহফিলের আয়োজন করেছিল। মাহফিল মানে সমাজের উচ্চবিত্ত ও উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের নিয়ে একত্রে খানাপিনা করা, গান শোনা, নাচ দেখা এবং একত্রে বসে মৌজ করে মদ পান করা।

সন্ধার পর থেকেই অতিথিরা আসতে শুরু করলো। একটু পর শুরু হলো নাচ গান।

ইয়াজউদ্দীন মাহফিলে আসন গ্রহণ করলেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন অভ্যাগত লোকদের। শিল্পীদের সারির দিকে তাকিয়ে তার মনটা দমে গেল। একটা শুন্যতা হাহাকার করে উঠলো মনের ভেতর।

উনুশীকে তার খুব পছন্দ। সে শিল্পীদের সারিতে তাকে দেখতে পেল না। ইয়াজউদ্দীন ভাবলো, হয়তো সাজগোছ করতে একটু সময় নিচ্ছে। এসে পড়বে এক্ষুণি।

অনুষ্ঠান চলছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে অনুষ্ঠানের দিকে মন নেই ইয়াজউদ্দীনের। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো কাটছে তার কষ্টকর এক যন্ত্রণায়। এক সময় অধৈর্য হয়ে তিনি এক রক্ষীকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘উনুশীর কামরায় যাও। সে এখনো এলো না কেন দেখে এসো। তাকে বলবে, আমি তাকে আসতে বলেছি।’

রক্ষী গেল উনুশীর কামরায়। দেখলো মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছে উনুশী।

রক্ষী ইয়াজউদ্দীনের ইচ্ছার কথা জানালো তাকে। উনুশী বললো, ‘তাকে গিয়ে বলো, উনুশীর শরীর খারাপ। সে আজ আসতে পারবে না।’

ফিরে গেল রক্ষী। ইয়াজউদ্দীনকে জানালো উনুশীর কথা। ইয়াজুদ্দীনের মন এতে আরো খারাপ হয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, বিকেলেও তো ওকে বেশ হাসিখুশি দেখলাম! চঞ্চল হরিণীর মত গুরে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। হঠাৎ আবার কি হলো তার?

তিনি তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান শেষ করে উনুশীর কামরায় চলে এলেন।

‘মাহফিলে যাওনি কেন সোনা?’ মোলায়েম কন্ঠে জানতে চাইলেন ইয়াজউদ্দীন মাসুদ।

উনুশী তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসলো। বললো, শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল, তাই যেতে পারিনি।’

ইয়াজউদ্দীন উনুশীর ম্লান ও বিষণ্ন চেহারার দিকে তাকালেন। তার দু’চোখে রাজ্যের মায়া ও অবসন্নতা। সে যে কথা বলছে, সেই কথার স্বরও কেমন যেন অস্পষ্ট, বাধো বাধো, অসংলগ্ন।