» » সামনে বৈরুত

বর্ণাকার

সুলতান আইয়ুবী তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করছিলেন। হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। উপরের দিকে মুখ করে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘হায়! আমার প্রিয় রাসুলের উম্মতের মধ্যে আজ একি অবক্ষয় ও অধপতন শুরু হয়ে গেছে!’

তিনি সেনাপতিদের দিকে ফিরে বললেন, ‘যখন বাতিল ধর্মের প্রভাব জাতি গ্রহন করে নেয় তখন তাদের পরিণাম এমনটিই হয়, যেমনটি তোমরা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছো। ইহুদি ও খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে গোলাম ও তাবেদার বানানোর জন্য মানব চরিত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক থেকে আঘাত করছে। এই দুর্বল দিকটার নাম হলো লালসা।

এই লালসার আছে বিচিত্র রুপ। স্রোতের টানে দুই পাড় ভেঙ্গে যেমন নালা কেবল বড় হয়, এই লালসার স্রোতও তেমনি। মানুষের আকাঙ্খা ও অতৃপ্তি কেবল তাতে বাড়তেই থাকে।

মানুষের উপর আধিপত্য করার লালসা, শাসন ক্ষমতা লাভের লালসা, রাজা বা শাসক হওয়ার লালসা, রাজকুমার হওয়ার লালসা, সোনার পালংকে নরম গদিতে থাকার লালসা, লাল গালিচা বিছানো পথ দিয়ে চলার লালসা, এই লালসার কি শেষ আছে?

শাসকরা ভাবে, জনগন বালি, কংকর ও কাঁটার মধ্য দিয়ে খালি পায়ে পথ চলবে। তারা পর্ণকুটির ও খড়ের চালার নিচে বসবাস করবে। জীবন ধারনের জন্য নিম্মমানের খাদ্য খেয়ে খুশি থাকবে। কখনো কোন সমস্যায় পড়লে রাজার কাছে মাথা নত করে আবেদন জানাবে।

প্রিয় বন্ধুরা আমার! যখন মানুষের মনে এমন প্রভূত্ব করার লালসা জেগে উঠে তখন তার অন্তর থেকে ঈমান, ভালবাসা, জাতীয়তাবোধ ও ধর্মবোধ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ক্ষমতা ও সম্পদ মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির উপর এমন কালো পর্দা টেনে দেয় যে, সেই পর্দা ছিন্ন করার কোন শক্তি আর তার মধ্যে থকে না।

তখন তার মধ্যে ধর্মীয় ও জাতীয় স্বকীয়তা বোধ বলে কিছু থাকে না। এ সবই তখন অর্থহীন হয়ে যায়।

মানুষের অন্তরে যখন লালসা চরম আকার ধারন করে তখন সে বিশ্বাসঘাতক, গাদ্দার ও প্রতারক সেজে গর্ব বোধ করে। যে যত বড় প্রতারক সমাজ তাকেই তত বড় বুদ্ধিমান গণ্য করে। অত্যাচারীকে মনে করে শক্তিমান।

ইহুদি ও খৃস্টানরা আমাদের শাসক গোষ্ঠিকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, এখন আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধের কোন কদর নেই তাদের কাছে।

এইসব শাসকদের কারণেই আজ মুসলিম সমাজ নির্লজ্জতা ও অসভ্যতায় ছেয়ে গেছে। যখন সমাজে সভ্যতা বলে কিছু থাকে না তখন ধর্ম একটি দুর্বল আবরণ মাত্র হয়ে যায়। সে আবরণ যেকোন সময় ছুঁড়ে ফেলে দেয়া সম্ভব। আবার প্রয়োজনে বা জাতিকে ধোঁকা দেয়ার জন্য যখন তখন তা গায়ে তুলে নেয়াও যায়।’

দুই সেনাপতিই অখণ্ড মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর হৃদয় মথিত কথাগুলো। কথা বলতে বলতে তিনি এক সময় নিরব হয়ে গেলেন। সেনাপতিরা তখনো চুপ করে বসা। তাদের চোখগুলো ছেয়ে আছে নির্মম উদাসীনতায়। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে পতনশীল এক সমাজের দ্রুত পতনের ভয়ার্ত মুহূর্তের শংকিত চিত্র।

দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন সুলতান। বললেন, ‘তোমরা কি মনে করো না, এটাও আমাদেরই ব্যর্থতা? আমরা জনগনকে সজাগ রাখতে পারিনি, শাসকদের ফেরাতে পারিনি অন্ধকারের অরণ্য থেকে? এটাও কি আমাদের পরাজয় নয়, যখন মুজাহিদ বেশে আমাদের রনাঙ্গনে থাকার কথা তখন আমরা নারীর মত তাঁবুর পর্দার ভেতর দাঁড়িয়ে কথা বলছি? এখন তো আমাদের বায়তুল মুকাদ্দাসে থাকার কথা ছিল। মসজিদুল আকসায় লুটিয়ে পড়ে অধীর হয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করার কথা ছিল।’ চুপ করলেন সুলতান।

এক সেনাপতি বললো, ‘আমরাও সেই কথাই বলছি সুলতান। আমাদের যে সাথীরা আপন রক্ত দিয়ে ফিলিস্তিনের পথ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছে সেই সব শহীদদের রক্তের প্রতিদান দিতে হবে আমাদের। যারা ফিলিস্তিনের সম্মান ও স্বাধীনতার জন্য জীবন কোরবান করেছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এনে তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে।’

সুলতান আইয়ুবীর চেহারা বেদনায় মলিন হয় গেল। তিনি পায়চারী করতে করতে সেনাপতিদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার অস্থিরতা দেখে তোমরা পেরেশান হচ্ছো। কিন্তু অস্থির না হয় আমার উপায় কি বলো? আমি সেই এতিম শিশুদের সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো, যারা আমার আদেশ পালন করতে গিয়ে ওদের পিতৃহীন করেছে?

সেই বিধবাদের আমি কি বলবো, যাদের স্বামীরা আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে আমার সঙ্গে জিহাদে এসেছিল আর তাদের রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে অশ্বপদ তলে পিষে মাংসের পিণ্ড হয়ে গেছে? সেই সব সুদর্শন যুবক, যারা কমাণ্ডো বাহিনীতে শামিল হয়ে শহীদ হয়ে গেছে তাদের আমি কেমন করে ভুলবো?

তার নিজের দেশ ও জাতি থেকে বহু দূরে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে একাকী লড়াই করেছে, গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে দরা পড়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রনা সহ্য করতে করতে শহীদ হয়ে গেছে, আমি তাদের মায়েদের সামনে যেতে ভয় পাই।

আমি এজন্য ভয় পাই যে, যদি সেই মা আমাকে বলে, আমার বেটাকে ফেরত দাও নইলে যেই মসজিদুল আকসা উদ্ধার করবে বলে আমার বেটাকে জেহাদে শরীর হতে বলেছিলে সেই মসজিদে আমাকে নিয়ে চলো। আমি সেই মসজিদ লুটিয়ে পড়ে আমার সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবো, আমি সেই মাকে কি উত্তর দিব?’

‘শহীদদের রক্তের দান কোন দিন বৃথা যায় না মুহতারাম সুলতান! কমাণ্ডো বাহিনীর প্রধান সালেম মিশরী তাঁবুতে ঢুকে আইয়ুবীর বক্তব্য শুনে বললো, ‘কোন শহীদের মা তার সন্তানের রক্তের হিসাব আপনার কাছে চাইতে আসবে না। যে মায়েরা তাদের বুকে আল্লাহর কালাম ও রাসুলের বাণী ধারণ করেছে সেই মায়েদের দুধ আবে জমজমের মতই পবিত্র ও বিশুদ্ধ।

সেই দুধে পালিত সন্তান আপনার আদেশে নয় আল্লাহর হুকুমে যুদ্ধ করেছে। আপনি তাদের রক্তের প্রতিদানের দায়িত্ব নিজে নিতে যান কেন? আমরা অবশ্যই তাদের সমবেদনা ও সহানুভূতি জানাবো, কিন্তু সেই রক্তের জন্য কখনো আফসোস করবো না।

আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে তারা এখন আল্লাহর মেহমান হয়ে গেছে। আপনি বরং সেইসব বেঈমান ও গাদ্দারদের কথা বলুন, যাদের গাদ্দারীর কারণে তাদের রক্তের ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। আমাদের তলোয়ার এই সব বিশ্বাসঘাতকদের রক্তের পিপাসায় কাতরাচ্ছে। আপনি আমাদের তলোয়ারের পিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা করুন।’

‘তুমি আমার চেতনার প্রাণ সঞ্চার করেছো সালেম।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমার এই দুই বন্ধুও আমাকে ঠিক তাই বলেছে। তারাও আমাকে বলেছে, আমাদের নিরাশ ও উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই।’

সালেম মিশরী বললেন, ‘তারা ঠিক কথাই বলেছেন। পরাজয় কোন চিরস্থায়ী জিনিস নয়। আমরা পরাজয়কে বিজয়ে রুপান্তরিত করতে পারি। অতীতেও আমরা এর প্রমাণ দিয়েছি, ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ আমরা পরাজয়কে বিজয়ে পরিনত করে দেখাবো।’

‘যদি এ আলোচনা যুদ্ধের ময়দানের হতো তবে আমার একটি বাহু ছিন্ন হলেও তোমরা আমার মুখে হাসি দেখতে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমার অস্থিরতার কারণ, শত্রু এখন আমার ঘরের মধ্যে বসবাস করছে। ইহুদি ও খৃস্টানরা আমাদের জাতির মধ্যে এমন বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে, যে বিষের প্রভাব খুবই আকর্ষণীয় ও জাদুময়। এ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা বড়ই কঠিন।

জাতির সৈনিকদের ব্যাপারে আমার ভরসা আছে। সৈনিক ও জনতা এসব কুপ্রভাব থেকে এখনো মুক্ত। সমস্যা হচ্ছে জাতির শাসক, আমীর ও প্রভাবশালী লোকদের নিয়ে। এ কুপ্রভাব তারাই গ্রহণ করে নিচ্ছে। তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে জাতির ওপর।

শাসক, আমীর ও প্রশাসনের উচ্চস্তরের লোকেরা আরো উর্ধে উঠার জন্য ন্যায়নীতি বিসর্জন দিচ্ছে। গাদ্দারীর খাতায়ও তারাই নাম লেখাচ্ছে। সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হচ্ছে, কতিপয় ধর্মীয় নেতাও শামিল হয়েছে এই ষড়যন্ত্রকারীদের দলে।’

‘হ্যাঁ সুলতান, এই ধর্মীয় নেতারাই এখন ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমনে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর কালামকে অল্প মূল্যে বিক্রি করতে নিষেধ করেছে কোরআন। অথচ তারা তাই করছে। কোরআনকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন না করে তাকে আংশিকভাবে এবং বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে।

আপনার ওপর তারা অসন্তুষ্ট এ কারণে যে, আপনি তাদের রুটি রুজির ওপর হাত দিয়েছেন। কোনরকম কাজকর্ম না করেও এতদিন তাদের সংসার ভালই চলছিল। জনগণ ভক্তিভরে তাদের নজর নিয়াজ দিচ্ছিল। প্রথমে তারা জনগণকে কিছু দোয়া কালাম শিখিয়ে দিচ্ছিল, যাতে তারা পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারে। জনগনও সহজে বেহেশত পাওয়ার পথ পেয়ে তাদের ওপর সন্তুষ্ট ছিল।

কিন্তু আপনি জাতির যুবকদের মনে নতুন চিন্তা ঢুকিয়ে দিলেন। তাদের শোনালেন জেহাদের মন্ত্র। বললেন, কোরআন পড়তে, হাদিস পড়তে এবং দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে জানতে ও গ্রহণ করতে। নতুন জোশ, নতুন আশা ও উদ্দিপনায় উজ্জীবিত হয়ে যুবকরা দলে দলে জেহাদের ঝাণ্ডা তলে শামিল হলো। ইসলাম যে পরিপূর্ণ জীবন বিধান তারা তা বুঝতে পারলো। জীবনের প্রতিটি কাজ ইসলামের আলোকে সাজিয়ে নেয়ার জন্য জনগণ যখন উদ্যোগী হলো তখন প্রমাদ গুনলেন ধর্মব্যাবসায়ীরা।’

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অপর সেনাপতি বললো, ‘এখন তারাও জেহাদের কথা বলে। জনগণকে জেহাদের মর্ম বুঝাতে গিয়ে বলে, জিহাদ ফরজ। কিন্তু এই ফরজ আদায় করতে হলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।

এখন আমাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময়। জিহাদ করতে হলে আমাদের অস্ত্র কিনতে হবে। অস্ত্র কিনতে অর্থের দরকার। অতএব স্বাবলম্বী হওয়ার সংগ্রামই এখন আমাদের মূল সংগ্রাম। নজর নিয়াজের পরিবর্তে এভাবেই তারা এখন সম্পদ সংগ্রহ করছে এবং এভাবেই নিজেদের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখছে।’

‘শুধু তাই নয়।’ বললো অন্য সেনাপতি, ‘এরা গোপনে শত্রুর সাথে আঁতাত করে আপনার অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার নানা রকম বুদ্ধি নিচ্ছে। দুশমনও তাদের সাহায্য করতে খুবই আগ্রহী। কারণ দুশমনের পক্ষে যা সম্ভব নয় সেই অসাধ্য তারা সফলতার সাথেই সাধন করছে। গোপনে তাদের সহযোগীতা করছে বিভিন্ন মুসলিম শাসকরাও। কারণ এইসব শাসকরা মনে করছে, তাদের গদি কেবল এইসব আলেমরাই নিরাপদ রাখতে পারে।’

‘শুধু তাই নয়।’ কথা বললো সেনাপতি সালেম মিশরী, ‘বেঈমান ও গাদ্দাররা সাধারণ লোকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মের ধোঁকা দিয়ে তাদের মধ্যে উম্মাদনা সৃস্টি করছে। মুসলমানদেরকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে সংঘাত জিইয়ে রেখে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে।

ইহুদি ও খৃস্টানরা এইসব আলেমদের বলছে, ‘তোমরা জনগণকে অন্ধের হাতি দেখার মত ইসলাম দেখাবে। কেউ হাতির কান দেখে বলবে, হাতি হচ্ছে কুলার মত, কেউ লেজ দেখেে বলবে ঝাড়ুর মত, কেউ পা দেখে বলবে থামের মত। হাতিই দেখাবে তাদের কিন্তু হাতির আসল অবয়ব যেন তারা কিছুতেই জানতে না পারে।

তোমরা কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই তাদের পথ দেখাবে, কিন্তু ইসলামের প্রাণসত্ত্বার সাথে যেন তাদের কখনো দেখা না হয়। শুধু মুসলমান নয়, মানবতা এবং বিশ্বসভ্যতা রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার ইসলাম, এ কথা যেন মুসলমানরা জানতে না পারে।

তারা যদি জেনে যায়, এ বিশ্ব সংসার আল্লাহর। আল্লাহর বান্দা হিসাবে এ বিশ্ব সংসার দেখার দায়িত্ব মুসলমানদের, তাহলে তাদের মধ্যে যে উদারতা এবং ভালবাসা জন্মাবে সেই ভালবাসা দিয়ে তারা সারা বিশ্ব জয় করে নেবে। তখন তোমার বা আমার স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহার করার আর কোন উপায় থাকবে না।’

‘কিন্তু আমরা সবজান্তা নই।’ এক সেনাপতি তার বক্তব্যের মধ্যে বাধা দিয়ে বললো, ‘আমরা মসজিদের খতিবও নই, ইমামও নই। অস্ত্র ত্যাগ করে জনগনকে ওয়াজ নসিহত করে সৎপথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের নয়।

আপনার কথাগুলো সত্য, কিন্তু দুনিয়ার সব কাজের দায়িত্ব আমরা কাঁধে নিতে পারি না। যে সকল সমস্যা তলোয়ার দিয়ে সমাধান করা যায়, আমাদের দায়িত্ব তার সমাধান করা। অন্যায় যেখানেই হবে এবং যেই করবে আমাদের তলোয়ার সেখানেই ঝলসে উঠতে দ্বিধা করবে না।

মুসলমনারা আজ খৃস্টানদের হাতে নির্যাতীত হচ্ছে, তাই খৃস্টানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছি আমরা। ইহুদীরা আঘাত করছে মুসলমানদের ওপর তাই আমরা ওদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। তেমনি যদি কোন অমুসলমান অঞ্চলে আজ নির্যাতন চলে, তাদের হেফাজত করার জিম্মাও আমাদেরই কাঁধে তুলে নিতে হবে।’

‘তুমি ঠিকই বলেছো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কোন ব্যক্তি বা ধর্মের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ নয়, আমাদের লড়াই সততা ও নীতির পক্ষে। অন্যায়ের পাথর পিণ্ডকে অশ্বখুরের আঘাতে গুঁড়ো করে দিয়ে সরল রাস্তা বানানোই আমাদের কাজ।

তোমাদের দু’জনের চেতনাতে কোন পার্থক্য নেই। সালেম মিশরী যাদের কথা বলেছে এ সব লোকেরা কুরআনের বিরোধী।’

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কুরআন স্পষ্ট বলে দিয়েছে, বিধর্মী কাফেরদের তোমরা বন্ধু বানিও না। তাদের কথা ও পরামর্শ গ্রহন করো না। তোমরা জানো না, তাদের মন সর্বদা আমাদের মন্দ ও ক্ষতির চিন্তায় থাকে।’

‘এর শুধু নামে মুসলমান।’ সালেম মিশরী বললো, ‘কুরআন ও সুন্নার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এই অবস্থা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কারণ এরা এক হাতে কুরআন ধরে রেখেছে অপরদিকে কাফেরদের ইশারায় নাচতে শুরু করেছে।

জাতি সর্বদা এমন নেতা ও শাসকদের হাতে মার খেয়ে আসছে। কারণ এদের হাতে রয়েছে কোরআন আর অন্তরে রয়েছে ক্রুশ। জাতি তাদের আসল রুপ দেখতে পায় না, তাদের অন্তরের ধ্বনিও শুনতে পায় না। এমন অবস্থার মধ্যে পড়েই আমরা বারবার গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হচ্ছি আর একে অপরের রক্ত প্রবাহ করছি। পরবর্তী গৃহযুদ্ধের তলোয়ারও আমাদের ঘাড়ের উপর ঝুলছে।’

‘এই তুফানকে আমাদের অবশ্যই বাধা দিতে হবে।’ এক সেনাপতি বললো, ‘এ জন্য আমি বলতে চাই, এখন আর কোন আপোষ চুক্তির অবকাশ নেই। এখন গাদ্দারদের খুঁজে বের করতে হবে। জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের মারতে এবং মরতেও প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের।’

এ কথায় সুলতান আইয়ুবীর চেহারা আবার উদাস হয়ে গেল। শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে জমা হচ্ছিল অপরিসীম বেদনা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে।

তাঁবুতে অখণ্ড নিরবতা বিরাজ করছিল। তিন সেনাপতিই অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল সুলতানের দিকে। তারা সুলতান আইয়ুবীকে চিনতো। জানতো, গৃহযুদ্ধের কথা শুনলেই তিনি উদাস হয়ে যান। তাই তারা চুপ করে রইলো।

‘হে আমার প্রিয় বন্ধুরা!’ সুলতান আইয়ুবী বেদনামাখা স্বরে বললেন, ‘আমার চোখে ভাসছে আমাদের প্রিয় নেতা রাসুলে মকবুলের উম্মতের রক্তাক্ত চেহারা। ভবিষ্যতের দিক তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি, রক্তের নদীতে ভাসছে মুসলমানরা। তারা নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ করে নিজেরাই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আর এই আপোসের গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রাখছে ইহুদী ও খৃস্টানরা। এ জন্য আজ একে উস্কে দিচ্ছে, তো কাল তাকে। প্রয়োজনে দু’পক্ষকেই সাহায্য ও সহযোগীতা দিতে ওরা প্রস্তুত।

শাসন ক্ষমতা লাভের লোভ দেখিয়ে ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। সেই রক্তে লালে লাল হচ্ছে ফিলিস্তিনের মাটি। আমি দেখতে পাচ্ছি, মুসলিম রাজ্যগুলো খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত রাজ্যের শাসকরা সবাই রাজা বাদশাহ বনে যাচ্ছে। তারা বিলাসিতা ও আরাম আয়েসের জীবন বেছে নিয়েছে।

এ অবস্থায় আমি জানি, আমাদের প্রথম কেবলা রাসুলের প্রিয় উম্মতকে ডাকতে থাকবে, কিন্তু সে আহবানে সাড়া দেয়ার প্রয়োজন মনে করবে না কোন মুসলমান। তারা সে ডাক কানেও তুলবে না।

যদি কোন লোক ফিলিস্তিন মুক্ত করার সংকল্প করে তবে তাকে আমাদের মত উন্মাদ হতে হবে। জাতির কিছু লোক যদি স্বাধীনতার জন্য পাগলপারা হতে না পারে তবে সে জাতি কোনদিনই স্বাধীনতার স্বাদ পাবে না।’

‘কিন্তু আজাদী পাগল এই সব মুসলমানদের মুসলিম শাসকরাই ধোঁকা ও প্রতারণায় ফেলে ঠাণ্ডা করে দেবে। তারা প্রকাশ্যে মিল্লাতের রক্ষাকর্তা সাজবে আর গোপনে বন্ধু হবে ওদের।’

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তোমরা বলছো, আমরা এই তুফানকে থামিয়ে দিতে পারবো। আল্লাহ চাইলে হয়তো আমরা সত্যি এ তুফান থামিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু আমাদের মরার পর এই তুফান আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।’

‘পুনরায় আর এক সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম হবে।’ সেনাপতি সালেম মিশরী বললেন, ‘আরও এক নুরুদ্দিন জঙ্গীর জন্ম হবে। মুসলিম মায়েরা এমন বীর মুজাহিদ সেনাদের জন্ম দিতেই থাকবে। নিশ্চয়ই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ তার দ্বীনকে হেফাজত করবেন।’

‘আমিও জানি, নিশ্চয়ই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ তার দ্বীনকে হেফাজত করবেন। তবে এই মুজাহিদদের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে বিলাস ও আরাম প্রিয় শাসক।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এমন সময়ও আসবে, সেনাবাহিনীও অলস ও আরাম প্রিয় হয়ে উঠবে। আর তাদের সেনাপতিরা কাফেরদের হাতের খেলার পুতুল হয়ে যাবে।’

সুলতান আইয়ুবী এ কথা বলেই আবার নিরব হয়ে গেলেন। তার চোখ বলছিল, তিনি ভবিষ্যতের সেই অনাগত দুর্যোগময় দিনগুলো যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন।

সালেম মিশরী বললেন, ‘কিন্তু সুলতান, আমরা এমন কথা আর কতকাল বলতে থাকবো? আমরা চারজন এই তাঁবুর মধ্যে বসে যতই আলাপ করি না কেন, তাতে সমস্যার কোন সমাধান হবে না।’

‘আল্লাহর সৈনিকদেরকে কথা নয় কাজে পারঙ্গম হতে হবে।’ এক সেনাপতি বললো, ‘সুলতান, ময়দান আমাদের ডাকছে। আমাদের কাজ দিন, আবার আমাদের ময়দানে নিয়ে চলুন।’

সুলতান আইয়ুবী সেই সেনাপতির দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন সালেম মিশরীর দিকে। বললেন, ‘বন্ধু সালেম! তুমি আমার নির্দেশিত স্থানগুলোতে কমাণ্ডো বাহিনী ছড়িয়ে রেখেছো। তুমি জানো, আমার এই ক্যাম্প কেমন বিপদ ও আশংকাজনক স্থানে আছে।’

‘হ্যাঁ, ভাল করেই জানি সুলতানে মুহতারাম! ‘ সেনাপতি সালেম মিশরী বললেন, ‘আমরা বৈরুতের অবরোধ উঠিয়ে এই দিকে এসেছিলাম। আমাদের আশংকা মতো খৃস্টানরা আমাদের পিছু ধাওয়া করেনি। কিন্তু এতে এই খুশিতে বিভোর হওয়া উচিত নয় যে, খৃস্টানরা আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছে।

আমি দৃঢ়তার সাথ বলতে পারি, তারা আর আগের মত আমাদের ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ চালাতে আসবে না। এখন থেকে তারাও আমাদের মত অন্ধকারে কমাণ্ডো আক্রমণ চালাবে। তাদের সেই কমাণ্ডো আক্রমণ ও অতর্কিত হামলার পর্যায় শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ক্যম্প থেকে বহু দূরে খৃস্টান সৈন্যরা আমাদের প্রহরীদের উপরে ছোট খাটো হামলা করা শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যেই এমন কিছু হামলার সংবাদ আমাদের কানে এসেছে।

আমি আমার কমাণ্ডো দলগুলোকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছি। আমি খবর পেয়েছি, কাফেরদের তৎপরতা এখন মুশেলেই অধিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন তাদেরকে আশ্রয় ও সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে।’

‘যদি এ খবর সত্যি হয় তবে এর ব্যবস্থা আমি করবো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যদি মুশেলেই খৃস্টানরা গোপন আড্ডা বানিয়ে থাকে তবে তার ব্যবস্থা করতে আমাদের বেশী বেগ পেতে হবে না।’

তিনি সেনাপতিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমাদের সাথে আমি একমত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখন আমাকে সেই সিদ্ধান্তই গ্রহন করতে হবে, যা আমার জন্য কষ্ট ও যাতনার কারণ। আমাদেরকে এখন সেই দূর্গগুলো আগে দখল করতে হবে, যেগুলো মুশেল ও হলবের মধ্যে রয়েছে।

আমি এই দুই শহরকে পরষ্পর বিছিন্ন করে দিতে চাই, যাতে পরে তারা আর একে অন্যকে সাহায্য করার সুযোগ না পায়। তাদের কাসেদ চলাচলের পথও বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে তারা সংবাদ আদান প্রদান করতে না পারে।’

সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় খেলা করছিল সেনাপতিসুলভ দৃঢ়তা। একটু আগের বিষন্নতার জায়গাটুকু দখল করে নিয়েছিল ইস্পাতকঠিন সংকল্প।

তিনি উপস্থিত সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি, আমার তলোয়ার যেন কোন মুসলমান নামধারীর বিরুদ্ধে কোষমুক্ত না হয়। কিন্তু এখন আমি নিরুপায়। আমি আমার ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিতে বাধ্য হচ্ছি। আমি সেই সব আমির ও শাসকদের শেষ দেখে ছাড়বো, যারা খৃস্টান কাফেরদের বন্ধু। আমি নিজে কখনো জাতির জন্য বোঝা হবো না, বোঝা হয়ে কাউকে জাতির ঘাড়ে চেপে থাকতেও দেবো না। যারা জাতিকে বিভ্রান্ত ও বিপদগামী করছে তাদের সে খেলা আমি বন্ধ করে দেবো।’

সুলতান আইয়ুবী তাঁর নতুন প্ল্যান সেনাপতিদের সামনে ব্যাখ্যা করা শুরু করলেন।

***

বৈরুতে সম্রাট বিলডনের মহল। কয়েকজন খৃস্টান ছাড়াও দাওয়াত পেয়েছেন সেনাবাহিনীর অফিসার, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নাইট, বিভিন্ন বাহিনী প্রধান ও সেনাপতিরা। সুলতান আইয়ুবীর নিষ্ফল আক্রমণের ব্যর্থতাকে সেলিব্রেট করার জন্যই এ বিরাট আয়োজন।

রাজকীয় এ ভোজসভায় নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন অসংখ্য মেহমান। তাদের প্রায় সকলেই সমাজের নেতৃস্থানীয় খৃস্টান। এই অসংখ্য মেহমানের মধ্যে দেখা গেল দু’জন মুসলমানও আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তারা কেবল আমন্ত্রণই পাননি, যথাসময়ে অনুষ্ঠানে হাজিরও হয়েছেন।

উর্বশী মেয়েরা ঘুরেঘুরে মদ পরিবেশন করছিল। মেয়েদের পরনে চুমকি বসানো হালকা রেশমী কাপড়। ফিনফিনে কাপড়ের ভেতর থেকে উপচে পড়ছিল রুপের জৌলুস। মেহমানরা মদের পিয়ালা হাতে করে ঘুরে ঘুরে পরষ্পরের সাথে কুশল বিনিময় করছিল। যতই মদের পরিবেশন বেড়ে চলছিল ততই মেহমানদের হাতগুলো জড়িয়ে ধরছিল মেয়েদেরকে। মেয়েরাও ক্রমশ নির্লজ্জ হয়ে উঠছিল।

মুসলমান মেহমান দুজনও খৃস্টানদের চাইতে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। তারাও সমানে মদ পান করছিল। দুটো মেয়ে তাদের ক্রমাগত তাদের মদ ঢেলে দিচ্ছে মনে হচ্ছে, মুসলমান মেহমানদের আদর আপ্যায়নের দিকে বিশেষ নজর রাখার জন্য তাদের ওপর হুকুম রয়েছে। মেয়ে দুজন বিলোল কটাক্ষ হেনে তাদের পাশে ঘুর ঘুর করছিল। যেন তারা এই দুই মেহমানকে মদ পান করাতে বিশেষ মজা পাচ্ছে।

ওরা এই মেহমান দু’জনের সাথে হাসি ঠাট্টা ও রং তামাশা করছে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ওদের গায়ের ওপর, এ সময় এক খৃস্টান এসে ওদের দু’জনকে বললো, ‘সম্রাট বিলডন আপনাদেরকে তাঁর খাস কামরায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’

এই দুই মুসলমান অতিথির পোষাক-পরিচ্ছদ ও চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল এরা কোন শাহী খান্দানের লোক।

মেয়েরা সরে দাঁড়ালো। এই দুই অতিথি সেই খৃস্টানদের সাথে এগিয়ে গেল সম্রাট বিলডনের খাস কামরার দিকে। ওরা সম্রাট বিলডনের কামরায় প্রবেশ করলো। কামরার বাইরে দুই সিপাই বর্শা হাতে পায়চারী করছে। তাদের পোষাক সাধারণ সৈনিকদের মতো নয়। আরো কেতাদুরস্ত ও জমকালো। তাদের কোমরে শোভা পাচ্ছে শাহী তলোয়ার। তলোয়ারের খাপ বিশেষভাবে পালিশ করা, তাই সে খাপ চমকাচ্ছে। একই রকম চমকাচ্ছে তাদের মাথার শিরস্ত্রাণ।

এই মহলেরই এক রক্ষী, যার দায়িত্ব ছিল মেহমানদের দেখাশোনা করা, বহিরাগত আগন্তুকদের প্রতি নজর রাখা এবং গোপন দেয়ালের অভ্যন্তরে যেসব মেয়েরা আছে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা, মেহমানদের পিছু পিছু সেও বিলডনের কামরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।

ঝাড়বাতির আলোকে তার পোষাকও চমকাচ্ছিল। সে সাধারণ সিপাই ছিল না, বরং সে ছিল এক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যোদ্ধা, যার দায়িত্ব ছিল মাহফিলে আগত সকলের নিরাপত্তা বিধান করা।

সে দুজন মুসলমানকে সম্রাট বিলডনের কামরায় নিয়ে যেতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সেখানে। তার গায়ের রং ছিল ফর্সা, বলিষ্ঠ দেহের গড়ন, চেহারায় বুদ্ধির শানিত ছাপ।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দুই অতিথিকে সম্রাট বিলডনের কামরায় প্রবেশ করতে দেখলো। মেহমানরা কামরায় প্রবেশ করতেই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সম্রাটের দুই রক্ষীর একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘হ্যালো জ্যাকোব, এদিকে ঘুরছো কেন? ওদিকে যাও, পরীর নাচ দেখো গিয়ে। যে রসের কপাল নিয়ে জন্মেছো, তাকে সার্থক করে তোল। আমাদের কপাল মন্দ, কখনো এক পাও এদিক ওদিক হতে পারি না।’

জ্যাকব তাদের কৌতুকের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘এই যে দু’জন ভেতরে গেল, এদেরকে তো মুসলমান মনে হয়! এরা কারা? ‘

‘এদের ব্যাপারে এত আগ্রহ দেখনোর কি আছে? এর তো আর তোমার নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে যাচ্ছে না! সম্রাট যখন নিজেই তাদের ডেকে এনেছেন, তাদেরকে নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে।’

‘কি বলছো তোমরা! এদের সম্পর্কে আগ্রহ থাকবে না তো কার সম্পর্কে থাকবে?’ জ্যাকব বললো, ‘তোমরা কি জানো না, মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমাদের মনে কি প্রচণ্ড ঘৃণা কাজ করছে? সমগ্র খৃস্টান সমাজ পারলে তেতো ঔষধর মতোই ওদের গিলে ফেলতো। এরা তো অচিরেই কোন ইহুদী বা খৃস্টানের হাতে খুন হয়ে যাবে! এদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, অথচ আমাকে এখনো জানানো হয়নি, এরা সত্যি মুসলমান, নাকি আমাদেরই কোন ভাই মুসলিম এলাকায় থাকে বলে এই ছদ্মবেশ ধারণ করেছে!’

‘এরা মুসলমান এবং মুসলিম এলাকাতেই থাকে।’ এক প্রহরী বললো, ‘নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও যতদূর জানি, এরা মুশেল থেকে এসেছে এবং সম্ভবত ইয়াজউদ্দিন মাসুদের দূত।’

‘সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সাহায্য নিতে এসেছে?’ জ্যাকব বললো, ‘এই দূতদের বলে দাও, সালাউদ্দিন আইয়ুবী শেষ হয়ে গেছে। রমলার রণক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিল। আবার এসেছিল বৈরুত অবরোধ করতে। কিন্তু আমাদের দেখেই তার আত্মার পানি শুকিয়ে যায়, সাগরের পানিও তার সেই ভয়ের পিপাসা মিটাতে পারেনি। তার সামুদ্রিক নৌবহর কূলে ভেড়ার সাহস পায়নি। সামরিক বাহিনী আঘাত করা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে থাকারও হিম্মত রাখেনি।’

জ্যাকব তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, ‘আমার সব সময়ই এই আফসোস থেকে যাবে, তাঁর পরাজিত সৈন্যদেরকে আমাদের সৈন্যরা কেন পিছু তাড়া করলো না। নইলে আজ সালাউদ্দিন আইয়ুবী আমাদের হাতে বন্দী অবস্থায় থাকতো।’

‘তুমি তোমার কাজ করো বন্ধু!’ বিলডনের প্রহরী বিরক্ত হয়ে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী বন্দী হলেও তোমার হাতে রাজ্য আসবে না, সম্রাট বিলডন মারা গেলে বৈরুত শহরের বাদশাহীও তোমার ভাগ্যে জুটবে না।’

জ্যাকব সেখান থেকে সরে এলো বটে কিন্তু মুহূর্তের জন্যও বিলডনের বন্ধ দরজা থেকে চোখ সরালো না। তার সমগ্র অস্তিত্ব আছন্ন করে রেখেছিল দুই মুসলিম দূত।

ওরা দু’জন সত্যি সত্যি ইয়াজউদ্দিন মাসুদের রাজদূত ছিল। সুলতান আইয়ুবী যখন বৈরুতের অবরোধ উঠিয়ে মুশেলের দিকে চলে যান, তখন ইয়াজউদ্দিন মাসুদ বাগদাদের খলিফার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন ভয়ে। বাগদাদের খলিফা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শায়খুল উলামার মাধ্যমে সুলতান আইয়ুবীর সাথে একটা আপোষ রফায় আসতে। শায়খুল উলামার অনুরোধে সুলতান আইয়ুবী ইয়াজউদ্দিন মাসুদক ক্ষমা করে দেন। বিনিময়ে ইয়াজউদ্দিন মাসুদ প্রকাশ্যে সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্র সমার্পনের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু তিনি গোপনে দূতকে খৃস্টান সম্রাট বিলডনের দরবারে পাঠিয়ে দেন। এরাই সে দূত, যারা সম্রাট বিলডনের কামরায় বসেছিল।

‘মুশেলের শাসক বলেছেন, আপনি সুলতান আইয়ুবীর পিছু ধাওয়া না করে একটা বিরাট ভুল করেছেন।’ এক দূত বিলডনকে বললো, ‘আপনি তার সৈন্যদের বিশ্রাম করার সুযোগ করে দিয়েছেন।’

‘ইয়াজউদ্দিন মাসুদের অভিপ্রায় কি? তিনি কি তোমাদের কোন লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন?’ জানতে চাইলেন সম্রাট বিলডন।

‘রাস্তায় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকায় তিনি কোন লিখিত পয়গাম পাঠাতে পারেননি। যা বলার তা আমাদের বুকে গেঁথে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মহামান্য সম্রাট! আমাদের সম্মিলিত দুশমন আবার ময়দানে নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। কিন্তু তার আগের উদ্যম ও সাহস আর নেই। তাই সে বৈরুত অবরোধ করেও পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। তাকে শায়েস্তা করার এটাই উপযুক্ত সময়। আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দামেশকের দিকে অভিযান চালান। এই শহরই সুলতান আইয়ুবীর শক্তি ও ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু। সুলতান এখন এই শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। এই সুযোগে আপনি যদি শহরটাকে অবরোধ করে আপনার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারেন তবে আমার বিশ্বাস সুলতান আইয়ুবী আর কখনোই দামেশকে উঠতে পারবে না।

মহামান্য সম্রাট! আপনি অভিযান দ্রুত চালাবেন। আপনার দামেশক পৌঁছার সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত আমি চেষ্টা করবো সুলতান আইয়ুবীকে আটকে রাখতে। তিনি এখন মুশেলের কাছে নাসিবা নামক স্থানে ক্যাম্প করে বসে আছেন। আমি সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর ওপর সারাক্ষণ নজর রাখছি।’

সম্রাটের কামরায় বসে কথা বলছিল ওরা। জানালা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল আকাশের চাঁদ। রাতের সেই চাঁদ অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখছিল রাসূলের প্রিয় উম্মতের মধ্যে থেকে জন্ম নেয়া দুই বিশ্বাসঘাতকের কর্মকাণ্ড। চাঁদের কলঙ্কের মতই মুসলিম জাতির মধ্যে কলঙ্ক হয়ে ওরা যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকে, পার্থক্য শুধু এটুকু, চাঁদের কলঙ্ক দেখা যায় কিন্তু জাতির কলঙ্ক সহজে সনাক্ত করা যায় না।

সমাপ্ত