» » সামনে বৈরুত

বর্ণাকার

‘আমি আর একদিনও এখানে অপেক্ষা করতে পারবো না।’ সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘সৈন্যদল সব প্রস্তুত হয়ে আছে। এই অবস্থায় সৈন্যদের বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাহলে সৈন্যদের আবেগ ও উচ্ছ্বাস কমে যাবে। সামরিক দক্ষতা নিস্প্রভ হয়ে যাবে। এমন অবস্থা যুদ্ধের জন্য ক্ষতির কারণ হয়।

তাছাড়া আমি খৃস্টানদের অপ্রস্তুত অবস্থায় অবরোধ করে ঘেরাও করে ফেলতে চাই। আমরা এতদিন যুদ্ধ করেছি নিজেদের মাটিতে পা রেখে। তাতে একটু সাফল্যে আমরা খুশি হয় যেতাম এই ভেবে, আমরা শত্রুদের তাড়িয়ে দিয়েছি।

শত্রুরা আমাদেরই মাটিতে আমাদের আক্রমণ করতো, আমাদের মাটিতেই রক্ত ঝরতো আমাদের। এখন আমার পদক্ষেপ হবে নিষ্ঠুর ও নির্দয় আকারের। বারবার যারা আমাদের ওপর আঘাত হেনেছে এবার আমরা তাদের আস্তানা গুড়িয়ে দিতে চাই।

কিন্তু তুমি এই প্রথম আমাকে চরমভাবে নিরাশ করলে। তাদের অবস্থা ও তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। এমন অন্ধকারে অভিযান চালানো আমার নীতি বিরুদ্ধ। কিন্তু অবস্থা যা, তাতে আমি নিরুপায়। আমার যে এবার পথে নামতেই হয়।’

‘যদি সম্রাট বিলডন কোন তৎপরতা চালাতো তবে এতদিনে অবশ্যই সে সংবাদ পাওয়া যেতো। আমার ধারণা, সম্রাট বিলডন ও অন্যান্য খৃস্টান সম্রাটরা এখনো ষড়যন্ত্রেই মেতে আছে। তারা আমাদের মুসলমান শাসকদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এ জন্যই বৈরুত থেকে কোন সংবাদ আমরা পাচ্ছি না।’ বিনয়ের সাথে বললো আলী বিন সুফিয়ান।

‘যদি তাই হয় তাহলেও আমার এখানে বসে থাকার সময় নেই। তারা আর একবার আমাদের মাঝে গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর আগেই তাদের ওপর আমাদের চড়াও হতে হবে। তাদের ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে যাওয়ার আগেই আমি বৈরুত অবরোধ করে নিতে চাই। যদি আল্লাহর সাহায্য পাই এবং আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি বৈরুত দখল করে নিতে পারি, তবে তাদের ষড়যন্ত্র আর কোনদিনই তাদের কাজে আসবে না।’

এরপর তিনি তার বিশ্বাসভাজন সেনাপতিদের নিয়ে এক বৈঠকে বসলেন। সেই বৈঠকে সুলতানের নৌবাহিনীর এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলুও উপস্থিত ছিলেন। এই ব্যক্তি সামুদ্রিক যুদ্ধে অসাধারণ যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। বৈরুত যেহেতু ভূমধ্যসাগরের তীরে, সে জন্য সুলতান আইয়ুবী বৈরুত অবরোধ করার জন্য নৌবহর পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি তাকে আগেই জানিয়েছিলেন, ‘নৌবাহিনীর যে সকল সৈন্য এই যুদ্ধে অংশগ্রহন করবে তুমি তাদেরকে আলেকজান্দ্রিয়া পাঠিয়ে দাও। তারা পরবর্তী নির্দেশ পাওয়া পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে অবস্থান করবে। নির্দেশ পেলে তারা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বৈরুত যাত্রা করবে।’

হেশামুদ্দিন লুলু বৈঠকে সুলতানকে জানালেন, ‘নৌবাহিনীর সকল সৈন্য আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছে গেছে।’

সুলতান নৌবাহিনী প্রধান হেশামুদ্দিনকে বললেন, ‘আমি চাই নৌবাহিনীর যুদ্ধযাত্রীরা সমুদ্রপথে বৈরুতের উপকন্ঠে একটু আগেই যেন পৌঁছে যায়। সামরিক বাহিনী স্থলপথে মরুভূমি ও পাহাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে যাবে। নৌ যোদ্ধারা উপকূলে পৌঁছেই যেন কাসেদ পাঠায়।’

তিনি উপস্থিত সেনাপতিদের বললেন, ‘এবার বৈরুতের ওপর যে আক্রমণ হবে, তা হতে হবে ভীষণ ভয়ংকর, তীব্র ও প্রচণ্ড। যদি খৃস্টানরা অস্ত্র সমর্পণ না করে তবে তোমরা র্নিদ্বিধায় শহরের ওপর বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দ্বিধা করবে না। তবে একটি কথা মনে রাখবে, নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং যারা অসুস্থ তাদের ওপর কোন জুলুম যেন না হয়। তাদেরকে নিজেদের আশ্রয়ে নিয়ে নেবে।

আরেকটি কথা, প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞের সময়ও তোমাদের মনে রাখতে হবে, সৈন্যদের হত্যা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যদি ওরা অস্ত্র সমর্পণ করে তবে সসম্মানে তাদের বন্দী করবে। কখনোই যেন আমাদের সৈন্যরা আক্রোশের বশে কোনরুপ বাড়াবাড়ি না করে। কোন অবস্থাতেই লুটপাট করা চলবেনা।

স্থলপথে অগ্রসর হওয়ার সময় ফৌজি অভিযান হবে তীব্রতর। পথে বিশ্রাম করতে হবে তাঁবু ছাড়া। অস্ত্র ও অপরিহার্য সামগ্রী ছাড়া সঙ্গে কোন জিনিস বা আসবাবপত্র নেয়া যাবে না। সৈন্যদের জন্য খাদ্য ও পানি থাকবে। কিন্তু সফরের সময় সৈন্য ও অফিসার সবাইকে প্রয়োজনের চাইতে কম খাবার ও পানি সরবরাহ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সবাই যেন সম পরিমান পায়।

সফরে খাবার রান্না করার কোন সুযোগ থাকবে না এ জন্য খেজুর ও অন্যান্য শুকনো খাবার সঙ্গে রাখতে হবে। কিন্তু পশুদের আহার দিতে হবে পরিমাণ মত।’

সুলতান আইয়ুবী বড়সড় একটি বোর্ডে কায়রো থেকে বৈরুত যাওয়ার পথের নকশা আঁকলেন। তারপর সেই নকশায় আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে বললেন ‘এই হলো আমাদের অগ্রাভিযানের রাস্তা।’

বৈঠকে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিল। এই নিরবতা আরো গভীর ভাব ধারণ করলো। সুলতান আইয়ুবী সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘তোমরা সব চুপ করে আছো কেন? কেন বলছো না, আমরা এখন শত্রুর এলাকা দিয় চলেছি। আমরা এখন শত্রুর এই এলাকা অতিক্রম করলাম?

কেউ কোন কথা বললো না। সুলতান আইয়ুবী নিজেই আবার মুখ খুললেন।

‘হে আমার প্রিয় বন্ধুরা! এতদিন আমরা যুদ্ধ করেছি সতর্কতার নিয়ম মেনে। অগ্রাভিযানের সময় আমরা প্রথমেই খেয়াল রাখতাম, আমাদের পিছন দিকটা যেন সুরক্ষা থাকে। তার পরিনাম ফল এই হয়েছে যে, খৃস্টানরা ফিলিস্তিনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছে। তারা দামেশক ও বাগদাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বার বার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ চেষ্টা সফল হলেই তারা মক্কা ও মদীনার দিকে অগ্রসর হবে।

যদি জিয়াদের পুত্র তারেক দূরন্ত সাগর পাড়ি না দিয়ে মিসরের মাটিতে বসে থাকতেন, তবে ইউরোপের মাটিতে ইসলামের পতাকা কোনদিন উড্ডীন হতো না। কাশেমের বীর সন্তান মুহাম্মাদ যদি ভয়াবহ ও দীর্ঘ সমুদ্র পথ অতিক্রম করে হিন্দুস্থানে না পৌঁছতেন, তবে আজ ভারতের ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল হতো না।

খৃস্টানরা বহু দূর থেকে আমাদের দেশে এসেছিল। যদি আমরা ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করতে চাই তবে আমাদেরও আগুনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সুউচ্চ পাহাড়, দুস্তর মরুভূমি ও উত্তাল সাগরের ঢেউ মাড়িয়ে আমাদের আঘাত হানতে হবে শত্রুর দুর্ভেদ্য দুর্গে।

আর যদি রাজ্য শাসন করাই হয় আমাদের উদ্দেশ্য, যদি আপনারা শুধু শাসক ও আমীর হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চান, তবে আসুন, মিশর ও সিরিয়াকে আমরা খণ্ড খণ্ড করে ভাগ করে নেই। তারপর সবাই বাদশাহ ও আমীর হয়ে আরাম আয়েশের জীবন যাপন করি।

তখন আমাদের নিজেদের রাজ্য রক্ষা ও ভোগের সামগ্রীর জন্য ইহুদী ও খৃস্টানদের কাছে হাত পাতবো। আমাদের কাছ থেকে অর্থ ঋন ও সাহায্য নিয়ে আমরা আমাদের বিলাসী জীবন চালাবো। বিনিময়ে তাদের কাছে আমাদের ঈমান ও ধর্ম বন্ধক রেখে দেবো।’

‘সুলতানে মুহতারাম!’ এক সেনাপতি দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমরা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় আছি। আমাদের কেউ ভীত নয়। শত্রুর এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের কারো হাত-পা কাঁপবে না। আমরা শুধু জানতে চাই, আমরা কখন রওয়ানা হবো আর কোন নিয়মে অগ্রসর হবো।’

‘হ্যাঁ!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এবার আমি সেই কথাই তোমাদের বলতে চাচ্ছিলাম। প্রত্যেক ডিভিশন স্বাধীনভাবে তাদের অগ্রাভিযান জারী রাখবে।

সামনে, পেছনে, ডানে, বামে কি ঘটছে সেদিকে কারো কোন খেয়াল করার দরকার নেই। আমাদের রসদ বহনের জন্য একাধিক আলাদা ইউনিট করা হয়েছে। তারা নিজ দায়িত্বে যথাসময়ে স্ব স্ব বাহিনীর কাছে রসদ পৌঁছে দেবে। শত্রুরা যাতে রসদ ধ্বংস করতে না পারে সে জন্যও আলাদা বাহিনীর ওপর দায়িত্ব দেয়া আছে।

সমগ্র বাহিনী ও সব কয়টা ডিভিশনের মধ্যে সমন্বয় ও শৃংখলা রক্ষার জন্য নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। এই তদারকী ও সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে কমাণ্ডো গ্রুপগুলো।

এসব গ্রুপের নেতৃত্ব দেবে কমাণ্ডো বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ সেনাপতি সালেম মিশরী। এ নির্দেশ তিনি অনেক আগেই পেয়েছেন। তিনি কমাণ্ডো বাহিনীগুলোকে এ জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিং দিয়ে রেখেছেন। প্রত্যেকে যার যার দায়িত্ব পালন করবে আর সব সময় খেয়াল রাখবে, বৈরুতের দিকে আমরা কতটুকু এগিয়ে যেতে পারলাম।’

সুলতান আইয়ুবী অভিযানের সমস্ত নির্দেশনা দান করে বললেন, ‘এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের অভিযান কখন শুরু হবে? তার আগে আমি জানতে চাই, আমি যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছি তিনি তা সঠিকভাবে বুঝে নিয়েছেন কিনা? নাকি এখনো কারো কিছু জানার বা বুঝার আছে? এ প্রশ্নের সমাধা হলেই আমি অভিযান শুরু করার সময় ঘোষণা করবো।’

সবাই হাত তুলে সমস্বরে বললো, ‘আমরা আমাদের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছি। এবার আপনি অভিযান শুরু করার সময় ঘোষণা করুন।’

সুলতান আইয়ুবী খানিক বিরতি নিলেন। সবার ওপর দিয়ে একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আজ রাতের প্রথম প্রহরেই কাফেলা যাত্রা করবে। তবে সব শেষে আমি একটি সতর্কবানী উচ্চারণ করতে চাই। আর তা হলো, আমাদের লক্ষ্যস্থল কোথায় তা যেন এ কামরার বাইরে কেউ জানতে না পারে। সাধারণ সৈন্য তো দূরের কথা, কমাণ্ডোদের কানও যেন না জানে, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

সুলতান আইয়ুবী পরম বিশ্বাসে তার একান্ত বিশ্বস্ত সেনাপতিদের কাছে এ কথা বলছিলেন, তার অনেক আগেই এ খবর বৈরুত পৌঁছে গিয়েছিল। যখন এ খবর বৈরুত পৌঁছায় তখনো এখানকার অনেক সেনাপতিই জানতেন না, সুলতান আইয়ুবীর পরবর্তী স্বপ্ন কি।

সুলতান নিজেও স্বপ্নেও ভাবেননি, তার এ অভিযানের খবর বৈরুত পৌঁছে গেছে। তিনি জানতেন না, যাদের ধ্বংস করার সংকল্প নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছেন তিনি, তারা এ আক্রমণ চ্যালেন্জ করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। এখন আর আগের মত অতর্কীতে আক্রমণ চালিয়ে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। রাতে যখন মুসলিম বাহিনী সৈন্য অভিযানে বের হচ্ছিল তখন সুলতান আইয়ুবী তাঁর হাই কমাণ্ডের সেনাপতিদের নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সৈন্যদের বিদায় অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। সৈন্যরা প্যারেড করে তাকে সালাম জানাচ্ছিল ও দোয়া নিচ্ছিল।

সুলতানের পাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলেন আইয়ুবীর সন্তানের এক শিক্ষক। সুলতান আইয়ুবী শিক্ষক ও উলামাদের খুব সমাদর করতেন।

ইতিহাসবিদ মুহাম্মাদ ফরিদ আবু হাদিদ বর্ণনা করেন, সৈন্যদের শেষ ব্যাটালিয়ানও চলে গেল। সুলতান আইয়ুবীও মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন, তখন সেই শিক্ষক আরবীতে একটি কবিতা পাঠ করলেন। কবিতাটির অর্থ হলো:

‘কায়রো বাসী!

যারা ফুলের সুগন্ধ পছন্দ করো

তারা এই নিরব রাতে ঘরের বাইরে চলে এসো।

দেখো, চারদিক মৌ মৌ করছে

বসরাই গোলাপের গন্ধে।

যত পারো এই সৌরভ মেখে নাও

নিজের অঙ্গে।

হয়তো কাল প্রত্যুষের পর থেকে

এই আমোদিত সৌরভ

আর নাও পেতে পারো

হয়তো যে ফুল আজ রাতে

সৌরভ বিলাচ্ছে এই কায়রো শহরে

কাল সন্ধায় সে ফুল

অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে

হয়তো এ ফুলের সৌরভ

আর পাবে না মিশর।’

মিশরের এক ইতিহাসবিদ লিখেছেন, এই কবিতা শোনার পর সুলতান আইয়ুবী কেমন নিরব ও উদাস হয়ে গেলেন। আনন্দের পরিবর্তে বিষাদে ছেয়ে গেল তার মন। তিনি বিদায়ের সময় এই কবিতাকে অশুভ ইঙ্গিত মনে করলেন।

তিনি আপন সৈন্য বাহিনীর পিছনে পিছনে যাত্রা করলেন। কিন্তু মনের বিষাদভার তার মোটেও লাঘব হলো না।

রাস্তায় তিনি তার সঙ্গী সেনাপতিদের বললেন, ‘মুরুব্বী বিদায়ের সময় আমাদের জন্য দোয়া দিবেন। তা না করে তিনি এমন এক কবিতা শোনালেন, যে কবিতা আমার বুকে বিরাট বোঝা হয়ে আছে।’

কিন্তু এই শিক্ষকের কবিতাটি অনাগত ভবিষ্যতের অভ্যর্থ ইঙ্গিত হয়ে দেখা দেবে, তা কে জানতো? ইতিহাস এই কবিতাটিকে অভ্যর্থ সত্যে পরিনত করে দিল। সবাই জানেন, সেই যে সুলতান আইয়ুবী কায়রো থেকে যাত্রা করেছিলেন, আর কোনদিন তিনি মিশরে ফিরে আসার সুযোগ পাননি। তার অবশিষ্ট জীবন আরবের ঊষর ভূমিতে যুদ্ধ বিগ্রহেই কেটে গেছে। মিশরবাশীর ভাগ্যে এই ফুল আর কোনদিন ফোটেনি।

১১৮২ সালের মে মাসে সুলতান আইয়ুবী মিশর থেকে যাত্রা করেন। অভিযানের যে নকশা তিনি এঁকেছিলেন, সেই পথটা ছিল দুর্গম মরুভূমির মধ্য দিয়ে। কোথাও অপ্রতিরোধ্য পাহাড়, কোথাও ভয়াবহ কন্টক ও উত্তপ্ত বালির সমুদ্র। এমন ভয়ানক অঞ্চলটা দিয়ে যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল, দুশমন যেন এ অভিযানের খবর না পায়।

কিন্তু সুলতানের জানা ছিল না, তাঁর এ অভিযানের খবর আগেই বৈরুত পৌঁছে গিয়েছিল। খৃস্টান গোয়েন্দা ও দুষ্কৃতিকারীরা ওঁৎ পেতে বসেছিল পথের বাঁকে বাঁকে।

যে সুলতানকে এ ব্যাপারে সতর্ক করতে পারতো, সেই ইসহাক তুর্কী খৃস্টান গোয়েন্দাদের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছিল। সে কায়রোর পরিবর্তে বন্দী অবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল বৈরুত।

যদিও এখন তার হাত বাঁধা নেই, কিন্তু কিছু করারও নেই তার। সতর্ক গোয়েন্দারা নজর রাখছে তার ওপর। পালাবার কোন সুযোগই সে সৃষ্টি করতে পারছেনা।

প্রথম দুই দিন ও দুই রাত খাওয়ার সময় ছাড়া তার হাত বাঁধ তাকতো। তখন সে খৃস্টান কমাণ্ডারকে বললো, ‘অযথা আমাকে কেন বেধে রেখে কষ্ট দিচ্ছো? তুমি কি মনে করো, মুক্ত থাকলেই আমি পালিয়ে যাবো? কিন্তু একবারও ভাবলে না, কি করে পালাবো আমি? পালিয়ে যাবই বা কোথায়? পায়ে হেঁটে তো আর এই মরুভূমি পাড়ি দিতে পারবোনা, আর তোমাদের এতগুলো লোকের সাথে খালি হাতে আমি লড়াই করেও পারবোনা। নাকি আমাকে ভয় পাও তোমরা?’

কমাণ্ডারের প্রিয়ভাজন খৃস্টান কন্যা মেরিনা বললো, ‘তোমাকে ভয় পাবো কেন? কি মনে করো তুমি নিজেকে? বাঘ না ভাল্লুক? উস্তাদ, আপনি এখনি ওর হাতের বাঁধন খুলে দিন, দেখি সে কেমন বাহাদুর।’

মার্টিন বললো, ‘মেরিনা ঠিকই বলেছে ওস্তাদ। ওকে যদি এখন ছেড়েও দেই তাহলে সে বেশী হলে দুক্রোশ রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে পারবে। তারপর মরুভূমি তাকে আগের মতই বেহুশ করে ছুড়ে ফেলবে তপ্ত বালিতে। সেখানেই তাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে।

খৃস্টান গোয়েন্দা কমাণ্ডার সাথীদের পরামর্শে তাকে মুক্ত করে দিল। তবে সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বললো, ‘ওকে আমি মরতে দিতে পারি না। তাহলে আমাদের ভাগ্যে কোন পুরষ্কারই জুটবেনা। তাকে আমি জ্যান্ত বৈরুত নিয়ে যেতে চাই। তাই সবাই তার ওপর কড়া নজর রাখবে, সে যেন মরতে না পারে।’

ইসহাক তুর্কী তাদের ওপর প্রভাব ফেলার জন্য নতুন চাল শুরু করলো। তাকে মরুভূমিতে ফেলে না দেয়ায় সে সবার ওপর বেশ কৃতজ্ঞ হয় উঠলো। তাদের সাথে সহযোগিতা করার প্রস্তাব সে মেনে নিল।

কমাণ্ডার বললো, ‘সত্যি যদি তুমি আমাদের সহযোগীতা করতে রাজি হও তাহলে তোমার ভাগ্য বদলে যাবে। কারাগারের বদলে তুমি পাবে অঢেল সম্পদ। মেরিনার মত মেয়েরা তোমার সেবা করে ধন্য হবে। জীবন তো একটাই, কেন হেলায় ভাগ্যের এ দান ঠেলে ফেলবে?’

‘আমিতো ভাগ্যকে নতুন করে গড়ে নিতেই চাই, যদি আপনি আমাকে সে সুযোগ দান করেন। সুলতান আইয়ুবীর চাকরী করে আমি কোনমতে আমার সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন যদি আপনি আমার ওপর দয়া করেন, তবে আমি আমার ভাগ্যকে কেন গড়ে নেব না?’

এরপর ইসহাক তুর্কী সুলতান আইয়ুবী সম্পর্কে খুব খারাপ খারাপ মন্তব্য করতে লাগলো। তার সঙ্গী সাথীদের গালাগাল ও তাদের জন্য আফসোস করতে লাগলো। বলতে লাগলো, ‘হায়রে দুর্ভাগারা! পোড়া কপাল নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিলি, আমি কি করতে পারি! নইলে বলতাম, দেখ, একেই বলে ভাগ্য। নইলে আমি তো মরেই যেতাম। এরা আমাকে বাঁচিয়ে তুলল। আমাকে নতুন জীবন দিল। নইলে আমার মত এক কীটকে মেরে মরুভূমিতে ফেলে দিলে আমি কি করতে পারতাম!’

তার এসব আক্ষেপ শুনে খৃস্টানদের বিশ্বাস জন্মে গেল, এ লোক সত্যি তাদের দলে যোগ দেবে। সুলতান আইয়ুবীর একজন গোয়েন্দাকে নিজের দলে টানতে পারা কম সৌভাগ্যের বিষয় নয়।

খৃস্টান কমাণ্ডার এবং দলের অন্যান্যরা এজন্য নিজেদের খুব ভাগ্যবান মনে করতে শুরু করলো। বিশেষ করে মেরিনা এ জন্য মস্তবড় পুরুষ্কার পাবে বলে ধারনা করলো। কিন্তু যখনই তাকে জিজ্ঞেস করা হতো, কি গোপন তথ্য নিয়ে তুমি কায়রো যাচ্ছিলে?’ তখন সে সঠিক জবাব না দিয়ে নানা রকম গল্প ফেঁদে তাদের বিভ্রান্ত করে দিত।

দুই খৃস্টান মেয়ের পারস্পারিক রেষারেষী তখন তুঙ্গে। মেরিনা কমাণ্ডারের প্রিয়ভাজন। এই সুবাদে সে বারবারাকে কথায় কথায় ধিক্কার ও তিরস্কার করতো। মেরিনার বিদ্রুপে ব্যথিত বারবারা এতে অপমানিত বোধ করলেও নিরুপায় হয়ে সে প্রায়ই নিরব থাকতো।

মেরিনা সবসময় ইসহাকের সাথে লেগে থাকতো। কেমন করে তার কাছ থেকে গোপন কথা উদ্ধার করা যায় বিরতিহীনভাবে সে সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছিল।

গভীর রাতে সে চলে আসতো ইসহাকের কাছে। তার পাশে বসে তাকে নানা রকম প্রলোভন দেখাতো, তাকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করতো। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। ইসহাক যেন এক পাথরের মূর্তি। সে পাথরের মতই শক্ত ও নিরব হয়ে বসে থাকতো। কোন রকম আবেগ ও চিত্তচাঞ্চল্যই সে সে বাইরে প্রকাশ করতো না।

বারবারা মেরিনার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নানা রকম ফন্দি ফিকির আঁটছিল। কিন্তু কি করলে মেরিনাকে জব্দ করা যাবে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না সে।

কমাণ্ডারের পরেই দলে মার্টিনের মর্যাদা ছিল সবচেয়ে বেশী। মেরিনাকে দলনেতা কব্জা করে নেয়ায় এই লোক বারবারাকে প্রেমের খাঁচায় বন্দী করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বারবারা তাকে পাত্তা দিচ্ছিল না। এ জন্য সে মার্টিনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল।

বারবারার কাছে পাত্তা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মার্টিন। সে বারবারাকে হুমকী দিল, এর জন্য তোমাকে পস্তাতে হবে। সে বৈরুতে গিয়ে তাকে শাস্তি দেয়ার ভয়ও দেখালো।

এমন ভয় এক সময় তাকে কমাণ্ডারও দেখিয়েছিল। কিন্তু কমাণ্ডার কয়েকদিন তাকে ভোগ করে শেষে মেরিনার দিকে ঝুঁকে গেলো। এই প্রতারণায় তার মন পুরুষ মানুষের প্রতি বিষিয়ে উঠেছিল।

বারবারার রাগ তখন চরমে। মেরিনার ব্যঙ্গ বিদ্রুপে অতিষ্ঠ। মেরিনা বারবারাকে বলতো, ‘কে তোমাকে গোয়েন্দা দলে আসতে বলেছিল? মাথায় গোবর নিয়ে স্পাই হওয়া যায় না। তুমি কোন পতিতালয়ে গেলেই ভাল করতে! আমাকে দেখো, মরুভূমিতেও আমি কেমন চমৎকার কৌশলে এক মুসলমান গোয়েন্দা ধরে ফেলেছি।

শোন, এটা কিন্তু আমার শিকার, তুমি এর ধারে কাছেও যাবে না। বৈরুতে গিয়ে আমি যখন পুরুষ্কার নেবো তখন আবার লালা ফেলো না।’

বারবারা এসব কথা যত শুনতো ততোই জ্বলে উঠতো।

সে রাতে মেরিনার তিরষ্কারে এমনিতেই তার মাথাটা খারাপ হয়ে ছিল। মার্টিনের উৎপাতও তখনো বন্ধ হয়নি। হয়তো একটু পরেই মার্টিন তাঁবুর পর্দা তুলে ফিসফিস করে ডাকবে, ‘বারবারা’।

মন খারাপ করে শুয়েছিল সে। সত্যি সত্যি একটু পর মার্টিন এলো। আজ বারবারা তাকে ফিরিয়ে না দিয়ে বললো, ‘ভেতরে এসো।’

মার্টিন খুশিতে গদগদ হয়ে তাঁবুতে ঢুকলো। বারবারার একটি হাত তুলে নিল নিজের হাতে। বারবারা বললো, ‘মার্টিন, আমার মনটা খুব খারাপ। মেরিনার অত্যাচারে বিষিয়ে উঠেছে আমার মন। আর সহ্য করতে পারছি না। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই।’

‘কি করতে চাও তুমি?’ আগ্রহ নিয়ে বললো মার্টিন।

‘আমি জানি না। কি করলে মেরিনাকে জব্দ করা যাবে সেটাই তো তোমার কাছে জানতে চাই।’

‘বারবারা, একবার বৈরুত পৌঁছে গেলে তুমি আর কিছুই করতে পারবে না। যদি কিছু করতে চাও তবে এখনি করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে সহযোগিতা করবো, তুমি শুধু বলো, আর কোনদিন আমাকে অবজ্ঞা করবে না?’

বারবারা নিজেকে একান্ত অসহায় মনে করছিল। এ মুহূর্তে তার একজন সহযোগী দরকার। মার্টিন তার প্রেমাকাঙ্খী। তার ওপর সে দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য। বারবারা ভেবে দেখলো, মার্টিনকে প্রত্যাখ্যান করলে তার সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। সে মার্টিনের প্রস্তাব মেনে নিল।

বারবারা এক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। সতীত্ব বিসর্জন দেয়ার শিক্ষা তাদের প্রথমেই দেয়া হয়। পাপের মধ্যে প্রতিপালিত এক মেয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মার্টিন এতে দারুণভাবে খুশি হলো। তাকে বললো, ‘এখন থেকে আমি তোমার হয়ে গেলাম। আমি ওয়াদা করছি, মেরিনাকে আমি উপযুক্ত শিক্ষা দেবো। তাকে এমন শিক্ষা দেবো, যাতে সে আর কোনদিন তোমাকে নিয়ে মশকরা করার সাহস না পায়।’

এরপর ওরা অনেক শলাপরামর্শ করলো। মেরিনাকে জব্দ করার নানা রকম ফন্দি আঁটলো। কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রই তাদের মনপূত হলো না।

অবশেষে মার্টিন বললো, ‘বারবারা, আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে। পরিকল্পনাটি ভয়ংকর, কিন্তু কাজ দেবে কল্পনার চেয়েও বেশী। একেবারে জোঁকের মুখে নুন দেয়ার মত ব্যাপার।’

সে তার পরিকল্পনাটি খুলে বললো বারবারাকে। শুনে বারবারা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।

‘হ্যাঁ, তোমার এই বুদ্ধি আমার মনপুত হয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষা হবে মেরিনার। এটাই করতে হবে।’

মার্টিন বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি প্রস্তুত থেকো। আগামীকাল রাতেই আমরা অপারেশনে নেমে যাবো।’

পরের দিন রাত। মরুভুমির ভয়াবহ এক স্থানে তাঁবু গাড়লো কাফেলা। সেখানে অদ্ভুত ধরণের কয়েকটি টিলা মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে ছিল। কতক টিলা স্তম্ভের মত, কতক মিনারের মত খাঁড়া। কোনটা আবার আঁকাবাঁকা দেয়ালের মত। প্রাণীর আকৃতির মত দুটো টিলা তাঁবুর একেবারে কাছেই।

টিলা গুলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পানির নাম গন্ধও নেই সেখানে।

রাতে এই টিলাগুলো দৈত্য দানোর মত ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। সন্ধ্যার পর পরই কাফেলা থামলো সেখানে।

মার্টিন রাতের অন্ধকার গাঢ়তর হওয়ার অপেক্ষা করছিল। প্রথম সুযোগেই সে কাজটা সেরে ফেলতে চায়।

সে তার ঘোড়া তাঁবুর সামনে বাঁধলো। ঘোড়া থেকে জীন নামিয়ে তাঁবুর পাশে রেখে দিল। ইসহাকের জন্য আলাদা তাঁবুর ব্যবস্থা ছিল। মার্টিন হাঁটতে হাঁটতে তার তাঁবুর কাছে গেল।

ইসহাক সম্পর্কে কমাণ্ডারসহ দলের সবাই এখন বেশ আস্বস্ত। সে পালিয়ে যাবে এমন আশংকা দূর হয়ে গিয়েছিল ওদের মন থেকে।

রাতে ঘোড়া ও উটের কাছাকাছি প্রহরীরা শুয়ে থাকতো। এমন কোন সম্ভাবনা ছিল না যে, ইসহাক ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাবে।

কাফেলার লোকেরা দীর্ঘ সফরের কারণে খুব ক্লান্ত ছিল। খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমোতে চলে গেল। ইসহাকও ঘুমিয়ে পড়েছিল।