» » টার্গেট ফিলিস্তিন

বর্ণাকার

সারাদিন দাউদ ও হারেস ঘরের বাইরে এলো না। বাড়ীর একদম পেছনের কামরায় চুপচাপ দুই বন্ধু আত্মগোপন করে রইলো। বাইরের দিকের কামরায় সাইফুদ্দিন ও তার সহকারী দরজা বন্ধ করে শুয়ে বসে সময় কাটালো, তারাও কেউ ঘরের বাইরে গেল না।

অতিরিক্ত চারজন বলিষ্ঠ পুরুষ এ বাড়ীতে আছে, পাড়াপড়শীরা এ জন্যই তা টের পেলো না। বুড়োও এসব দিকে খেয়াল রাখছিল। বাড়ীর বাইরে সামনের চত্বরে এটা ওটা করার বাহানায় বলতে গেলে সারাটা দিন বুড়ো বাইরেই কাটিয়ে দিল।

দিনের বেলা ফৌজি বেশ কয়েকবার তার কামরায় গিয়েছিল। সে সাইফুদ্দিনের সাথে কথা বলতো, কিন্তু ধরা দিতো না। তার এ লুকোচুরি স্বভাবের কারণে সাইফুদ্দিন আরো গভীরভাবে ঝুঁকে পড়লো মেয়েটির দিকে। সে ফৌজিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা! তোমার যে ভাই আমার বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে আছে, তাকে যদি আমি কমান্ডার পদে উন্নীত করে দেই, কেমন হয়?’

‘কেমন আবার! যেমন হবার তেমন হয়!’ তরল কোমল কৌতুক মেশানো কন্ঠ ফৌজির।

‘আর যদি তোমাকে, তোমার ভাবী ও বাবাকে আমি যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাই, তাহলে কেমন নয়!’

‘পঁচা হয়!’

‘কেন?’

‘বাহ, কনের সাথে কেউ তার বাবাকে আর ভাবীকে নেয় নাকি! কি বোকা বোকা কথা!’

এভাবেই হাস্য-তরল আলাপের মধ্য দিয়ে দিনটি কাটিয়ে দিল সাইফুদ্দিন। ফৌজির বাবাও দু’একবার সে কামরায় ঢু দিয়েছে। তাদের কিছু লাগবে কিনা, কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা, এইসব খোঁজখবর নিয়েছে। মূলতঃ সাইফুদ্দিনকে বৃদ্ধ বুঝাতে চাচ্ছিলো, সে তার খুব বাধ্য ও অনুগত একজন প্রজা।

দিন পেরিয়ে রাত এলো। বৃদ্ধ উতকর্ণ হয়ে বসেছিল, কখন আবার দরজায় করাঘাত শুনবে। রাতের প্রথম প্রহরেই এলো সে কমান্ডার। দরজায় করাঘাত শুনেই বৃদ্ধ এগিয়ে দরজা খুলে ধরলো। বাইরে সাইফুদ্দিনের হলব থেকে আগত কমান্ডার দাঁড়িয়ে ছিল। বৃদ্ধ তাকে সাইফুদ্দিনের কামরায় পাঠিয়ে দিয়ে ঘোড়াটি অন্য ঘোড়াগুলোর পাশে নিয়ে বেঁধে রাখলো।

বৃদ্ধ যখন ঘরে ঢুকলো তখন কমান্ডার বলছিল, ‘সারা পথ আমি খুব দ্রুত বেগে ছুটে এসেছি। রাস্তায় কোথাও থামেনি। সে কারণে রাস্তায় আমার খাওয়া দাওয়াও সম্ভব হয়নি।’

এ কথা শুনেই বৃদ্ধ কমান্ডারের খাবার আনতে ভেতরে চলে গেল। ফৌজি বললো, ‘বাবা, তুমি শুয়ে পড়োগে। আমি নিজেই ওর খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’

ফৌজির বুড়ো বাপ বাধ্য ছেলের মত বিছানায় উঠে গেল। কমান্ডারের জন্য খাবার নিয়ে কামরায় ঢুকলো ফৌজি। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল কমান্ডারের কথা। সাইফুদ্দিন হেসে বললো, ‘তুমি কথা বলো, এ মেয়ে এখন আমাদেরই একজন।’

ফৌজি কমান্ডারের সামনে খাবার রেখে সাইফুদ্দিনের পাশে গিয়ে বসলো। এই প্রথম সে সাইফুদ্দিনের খুব কাছাকাছি গিয়ে বসেছিলো। সাইফুদ্দিন তার একটি হাত নিজের হাতে টেনে নিল। ফৌজির দিনের চাপল্য কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। নিস্তরঙ্গ রাত যেন তার মধ্যেও নিবেদনের এক ধরনের আর্তি নিয়ে এসেছে। সে হাত ছাড়িয়ে না নিয়ে মুগ্ধ চোখে সাইফুদ্দিনের হাতের আংটির সৌন্দর্য দেখতে লাগলো। ফৌজির এ আচরণ যে খৃস্টানের এক বন্ধুকে হাতের মুঠোয় আটকানোর কৌশল, সাইফুদ্দিন তা একটুও টের পেলো না।

‘হলবের সামরিক অবস্থা প্রশংসার যোগ্য।’ কমান্ডার আবার কথা বলা শুরু করলো। ফৌজি ছোট্ট খুকির মত সাইফুদ্দিনের আঙ্গুলের হীরার আংটি নাড়াচাড়া করতে লাগলো। সে এমন তন্ময় হয়ে আংটি দেখছিল, কমান্ডারের কথা দিকে তার যেন কোন খেয়ালই নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কান ছিল সম্পুর্ণ সজাগ। মাথা নিচু করে সে কমান্ডারের প্রতিটি কথা গিলছিল।

‘আল মালেকুস সালেহ সুলতান আইয়ুবীকে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়ে চিঠি দিয়েছেন।’

‘কি! সন্ধির চিঠি?’ সাইফুদ্দিন চমকে উঠে বললো।

‘জ্বী! আপোষ-মিমাংসার চিঠি!’ কমান্ডার বললো, ‘কিন্তু আমি জেনেছি, তাঁর খৃস্টান বন্ধুরা যুদ্ধে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তাকে পর্যাপ্ত সাজ সরঞ্জাম ও অস্ত্র দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা তাকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করারও চেষ্টা করছে। তারা তাকে পরামর্শ দিয়েছে, মুশেল ও হারানের সেনাবাহিনীকে এক কমান্ডে নিয়ে জলদি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ওপর আক্রমণ চালানোর। যদি সুলতান আইয়ুবী আশপাশের এলাকা থেকে সৈন্য সংগ্রহের পর্যাপ্ত অবসর ও সুযোগ পেয়ে যায়, তবে তার অগ্রাভিযানে বাঁধা দেয়া দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। গোয়েন্দারা সংবাদ এনেছে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী স্বসৈন্যে তুর্কমানের শস্য-শ্যামল প্রান্তরে ক্যাম্প করে নতুন সৈন্য ভর্তি করছে। আইয়ুবী দ্রুত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আল মালেকুস সালেহের সেনাপতিরাও একমত, তুর্কমান ক্যাম্পে সুলতান আইয়ুবীর ওপর দ্রুত আক্রমণ করা দরকার।

আমি হলবের এক খৃস্টান উপদেষ্টার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, ‘আইয়ুবীর ওপর জলদি আক্রমণ আমি সমর্থন করি না, কারণ সে যোগ্যতা এখন আমাদের নেই।’ তিনি বললো, ‘এতে তোমাদের বহু ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে আক্রমণ করে তাকে পরাজিত করতে না পারলেও, এতে তার প্রস্তুতির সুযোগ নষ্ট হবে। তার অপরাজেয় বাহিনীকে প্রস্তুতির সুযোগ দিলে তা ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে তোমাদের জন্য। তাকে তুর্কমান এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ও উত্যক্ত করে আটকে রাখতে হবে। এমন কৌশলে যুদ্ধ করতে হবে, যেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। প্রবল আকারের যুদ্ধ না হোক, খন্ড যুদ্ধ অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। যুদ্ধের কৌশলটা হবে ঠিক সুলতান আইয়ুবীর মত, আঘাত করো আর পালিয়ে যাও।’

‘খুবই উত্তম প্রস্তাব।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘এমন যুদ্ধ আমার শার্দুল ভাই সেনাপতি মুজাফফরুদ্দিনই করতে পারে। সে দীর্ঘদিন সুলতান আইয়ুবীর সহ-সেনাপতি ছিল। আইয়ুবীর প্রতিটি চাল তার মুখস্ত। আমিও একমত, আমাদের সম্মিলিত শক্তি একক কমান্ডে নিতে হবে।’

‘আর তিন বাহিনীর যুক্ত কমান্ডের দায়িত্ব থাকতে হবে আপনার ওপর। কেবল আপনিই সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে মরু শৃগালের ধোঁকা দিয়ে মারতে পারবেন।’ বললো তার সহ-সেনাপতি।

ফৌজি তখনো আংটি নিয়ে খেলা করছিল। কমান্ডার বললো, ‘আমি চেষ্টা করেছিলাম আল মালেকুস সালেহের সাথে দেখা করার। কিন্তু তার সেনাপতি ও অন্যান্য আমীররা তাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে, আমি তার কাছেও যেতে পারলাম না।’

‘তোমাকে আজই আবার হলব রওনা করতে হবে।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘আল মালেকুস সালেহকে আমার চিঠি পৌঁছে দেবে।’

সাইফুদ্দিন সে রাতেই আল মালেকুস সালেহের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লিখলো। তাতে লিখলোঃ ‘প্রিয় আল মালেকুস সালেহ! সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে তুমি আমাদের ঐক্যজোটে যে ভাঙ্গনের সৃষ্টি করেছো, এর ভয়াবহ পরিণতির কথা কি কখনো চিন্তা করেছো? আমাদের না জানিয়ে আমাদের সকলের জানের দুশমন আইয়ুবীর সাথে সন্ধি করে তুমি কি হাসিল করতে চাও আমার বুঝে আসছে না। তুমি কি মনে করো আইয়ুবী তোমাকে রেহাই দেবে? হলব দখল না করে দেশে ফিরে যাবে আইয়ুবী? তুমি এখনো খুব ছোট ও অবুঝ। রাজনীতির খেলা এখনো তোমার রপ্ত হয়নি। আইয়ুবী কিছুতেই তোমাকে রেহাই দেবে না। অন্যদিকে এ চুক্তির মাধ্যমে তুমি আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছো। আগে তোমার ওপর হামলা হলে আমরা মনে করতান, এ হামলা হয়েছে আমাদের সবার ওপর। আমরা তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কিন্তু এখন? এখন তোমার ধ্বংস তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর কি করার আছে!

সালেহ! এ চুক্তির মাধ্যমে তুমি প্রকারান্তরে আইয়ুবীর সাহস ও উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিয়েছো। কিন্তু আমরা জানি, তিনি আমাদের কাউকে ক্ষমা করবেন না। হয়তো তুমি ভয় পেয়ে গেছো। অথবা তোমার সেনাপতিরা যুদ্ধ থেকে বাচাঁর আশায় তোমাকে এ পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এ পথে তোমার মুক্তি মিলবে না। তুমি আমাদের না জানিয়ে সন্ধি করে যে অপরাধ করেছো, যে ধোঁকা তুমি আমাদের দিয়েছো, তাতে তোমাকে আমাদের বয়কট করা উচিৎ ছিল। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকিয়ে সেসব আমি ভুলে যেতে রাজি আছি। বাঁচতে হলে আমাদের এক কমান্ডে সম্মিলিত শক্তি একত্রিত করে অনতিবিলম্বে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। তুমি কি করতে চাও শিঘ্র জানাও আমাকে।’

– আমীরে মুশেল সাইফুদ্দিন গাজী।

ভোর রাতে কমান্ডারকে ডেকে তুলে সাইফুদ্দিন গাজী বললো, ‘তোমাকে এ অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। তোমাকে যেন গ্রামের কোন লোক দেখতে না পায় সে জন্যই এ সতর্কতা। যত দ্রুত পারো এ চিঠি হলবে পৌঁছবে এবং সরাসরি সালেহের হাতে এ চিঠি দেবে।’

সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডার সে চিঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এ চিঠির জবাবই ভাগ্যক্রমে পড়েছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর হাতে। কিন্তু এ চিঠিতে কি লেখা হয়েছে জানতে পারলো না ফৌজি। আর ফৌজির না জানার কারণে তা জানতে পারলো না দাউদ বা হারেস,কেউ। ফৌজি যে সব আলোচনা শুনেছিল সবই দাউদকে বলে দিয়েছিল। তথ্যগুলো খুব কাজেরও ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত তারা এইসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সকালে ফজর নামাজের পর হারেস ও তার বাবা ঘুমিয়ে গিয়েছিল। দাউদ বাড়ীর পেছন দিক দিয়ে ভোরের মুক্ত হাওয়া সেবনের জন্য একটু বাইরে বেরিয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালো তার ঘোড়ার কাছে। ফৌজিও আলতো পায়ে বেরিয়ে এলো তার পেছন পেছন।

‘তুমি এর চেয়ে বড় কাজ আমাকে বলো।’ ফৌজি বললো, ‘আমি তোমার জন্য আমার জীবনও দিয়ে দিতে পারি।’

‘আমার জন্য নয়। প্রাণ দেবে তোমার জাতির জন্য, তোমার ধর্মের জন্য।’ দাউদ বললো, ‘তুমি যে কাজ করছো, এটাও অনেক বড় কাজ। আমরা যারা গোয়েন্দা, এ কাজের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের জীবন কোরবানী করি। এটাই এখন আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এটাই আমার দায়িত্ব। আমার এ কাজ আমি তোমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছি। এতে তোমাকে কিন্তু অনেক বড় বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে।’

‘বিপদ কেমন?’

‘এ কাজটাই বিপদজনক। তুমি যে তথ্য পাচার করছো তা জানতে পারলে তোমার খুব বিপদ হবে।’ দাউদ বললো, ‘সাইফুদ্দিন একজন বাদশাহ। এই কুটিরেও তিনি বাদশাহই আছেন।’

‘তাতে কি? বাদশাহ কি আমাকে খেয়ে ফেলবে?’ ফৌজি বললো, ‘আমি খুব চালাক মেয়ে না হলেও একেবারে সহজ সরল বোকা মেয়েও নই।’

‘কিন্তু তার বাদশাহীর চমক দেখতে বোকা হতে কতক্ষণ!’ দাউদ বললো, ‘এ সব লোকেরা জৌলুস দেখেই অন্ধ হয়ে তাদের ঈমান বিক্রি করেছে এবং ইসলামের মূল কাটছে। আমার ভয় হয় তুমি না আবার তার জালে আটকা পড়ে যাও।’

‘তোমার বাড়ী কোথায়?’

‘আমার কোন বাড়ী নেই।’ দাউদ উত্তর দিল, ‘আমি এক গোয়েন্দা ও কমান্ডো বাহিনীর লোক। কমান্ডোদের কোন বাড়ীঘর থাকতে নেই। যেখানে শত্রুদের হাতে ধরা পড়বো, সেখানেই মারা যাবো। সেই বধ্যভূমিই আমার মাতৃভূমি। সেখানকার মাটিই আমাদের দেহকে তার কোলে আশ্রয় দিবে। শহীদের রক্ত যে মাটিতে পড়ে সে জমিন মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তুর্ভুক্ত হবেই। সে মাটিকে কুফর থেকে পবিত্র করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হয়ে যায়। আমাদের মা ও বোনেরা আমাদের লালন-পালন করে বড় করেছে, আর আল্লাহর পথে সঁপে দিয়েছে। তারা তাদের বুকের ওপর পাথর বেঁধে আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আশাও ত্যাগ করেছে।’

‘তোমার কি কখনো বাড়ী যাওয়ার ও তোমার মা-বোনদের সাথে দেখা করার ইচ্ছা হয় না?’ ফৌজি আবেগ ভরা কন্ঠে বললো।

‘মানুষ ইচ্ছার দাস হয়ে গেলে ফরজ কাজ শিথিল হয়ে যায়।’ দাউদ বললো, ‘জীবনের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আবেগের ইচ্ছাকে কোরবানী করতে হয়। এ কাজ করতে হলে তোমাকেও মনে সব স্বপ্ন-আশা কোরবানী দিতে হবে।’ ফৌজি তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তাহলে কি সব সময় আমাকে তোমার পাশে রাখবে?’

‘না, অসম্ভব! সব সময় তোমাকে কি করে পাশে রাখবো?’ দাউদ বললো।

‘কেন, তোমার সাথে আমাকে নিয়ে যাবে, আর যদি নিতে না পারো তাহলে তুমিই এখানে থেকে যাও!’ ফৌজির কন্ঠে আবেগ।

‘আমার দায়িত্ব যতদিন প্রয়োজন মনে করবো, ততদিন তো আমি এখানে অবশ্যই থাকবো।’ দাউদ বললো, ‘কিন্তু আমাকে তুমি তোমার কাছে রাখতে চাচ্ছো কেন?’

‘আমি তোমাকে কাছে রাখতে চাইনি। কিন্তু আমার মন সারাক্ষণ তোমার কাছে কাছে থাকতে চায়।’ ফৌজি বললো, ‘তুমি যখন থেকে এসেছো আর আমি তোমার কথা শুনেছি, তখন থেকেই আমার মন তোমার কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। এমন আবেগ ও উদ্দীপনার কথা আমি আগে কখনো শুনিনি। আমার মন বলে, আমি তোমার সাথেই থাকি, আর সারাক্ষণ তোমার কথা শুনি।’

‘আমার পায়ে শিকল পড়াতে চেষ্টা করো না ফৌজি!’ দাউদ বললো, ‘তুমি নিজেকেও আবেগের শিকল থেকে মুক্ত করে ফেলো। আমাদের সামনে এখন কঠিন পথ। এ পথ আমাদের অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। যতক্ষণ প্রয়োজন এক সাথে চলবো আমরা কিন্তু তাই বলে একে অন্যকে বন্দী করার চেষ্টা করবো না।’ দাউদ একটু চিন্তা করে বললো, ‘ফৌজি, তুমি বেশী দূর আমার সাথে চলতে পারবে না। আমার দায়িত্ব বড় ভয়ংকর। এ কাজ পুরুষেরই সাজে।’

‘কিন্তু এখন যে এ কাজ আমাকে দিয়ে করাচ্ছো! আমি তো এক নারী!’ অভিমানী কন্ঠে বললো ফৌজি।

দাউদ এর কোন জবাব দিল না। ফৌজির চেহারা ছেয়ে গেল আশ্চর্য এক উদাসীনতায়। সে দাউদকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। দাউদ ঝট করে তার বাহু টেনে ধরে তার চোখে চোখ রাখলো। ফৌজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে কি বুঝলো, আস্তে গিয়ে মিশে যেতে চাইলো দাউদের সাথে।

দাউদ তাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। ফৌজি আবেগ কম্পিত কন্ঠে বললো, ‘যে কাজ পুরুষের, সে কাজ নারীও করতে পারে। আমার সম্ভ্রম ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, ইচ্ছে হলেই যে কেউ কামড় বসাতে পারবে।’ ফৌজি বললো, ‘তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমার কথা আমার মনে নতুন স্বপ্নের ইমারত গড়েছে। তুমি আমাকে যে রাস্তা দেখিয়েছ সে পথটিও আমার মনে ধরেছে। আমি তোমার পাশে এ জন্য থাকতে চাই।’

‘কিন্তু ফৌজি, এপথ বড় বন্ধুর! বড় ভয়ংকর! নিরূপায় না হলে এ কাজে মেয়েদের ব্যবহার করতে নেই!’

‘বুঝি! কিন্তু এটাও জানি, এ বন্ধুর পথে চলার জন্যই চাই নারীর সান্বিধ্য। চাই মায়ের স্নেহ, বোনের মমতা ও স্ত্রীর ভালবাসা। না হলে পুরুষ চলতে চলতে হাঁপিয়ে উঠে। তুমি খুব ক্লান্ত হয়ে উঠেছো দাউদ! আমার ভাবী আমাকে বলেছে, পুরুষ যখন ক্লান্ত হয়ে ঘরে আসে, তখন তার ক্লান্তি একমাত্র নারী ছাড়া কেউ দূর করতে পারে না। নারী না থাকলে পুরুষের মন শুকিয়ে যায়। আমি ভয় পাচ্ছি, একাকী চলতে গিয়ে তোমার আত্মা যদি শুকিয়ে যায়, তখন কি হবে দাউদ?’

দাউদ হেসে উঠলো। তার গালে টোকা দিয়ে বললো, ‘তোমার এ মন ভুলানো কথা শুনেই আমার আত্মা তাজা হয়ে গেছে।’

‘আমার কথায় তুমি কিছু মনে করোনি তো? আমার ভাইকে আবার বলে দিও না, আমি তোমার কাছে এসেছিলাম!’

‘না, তা বলবো কেন?’ দাউদ বললো, ‘তোমার ভাইকে আমি এসব কথা কিছুই বলবো না। আর তোমার কোন কথাই আমার খারাপ লাগেনি।’

‘দাউদ! আমাদের স্বপ্ন এক, লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যও এক।’ ফৌজি বললো, ‘তাই তো তোমার সাথে কথা বলে আমি মনে শান্তি পাই।’

‘তুমি তোমার মনের কথাই বলেছো ফৌজি!’ দাউদ বললো, ‘আমি তোমার মনের কথা বুঝে নিয়েছি। তুমি ঠিকই বলেছো, আমাদের লক্ষ্য ও গন্তব্য এক! কিন্তু এ কথা ভুলে যেও না, সামনে প্রবাহিত হচ্ছে রক্তের নদী। এ নদীতে কোন সাঁকো নেই। আমাকে এ নদী পার হতে হবে সাঁতরে। যদি তুমি আমার চির সঙ্গী হতে চাও, তবে আমাদের কাবিননামা লিখতে হবে রক্তের কালিতে। সত্য পথের সৈনিক ও যাত্রীদের বিবাহ উৎসব হয় আকাশে। তাদের বরযাত্রীরা পথ চলে ধুমকেতুর রাস্তা ধরে। আকাশের তারকারাজি তো সেই উৎসব- আনন্দেই হেসে উঠে আলো ছড়ায়!’

ফৌজি যখন সেখান থেকে বিদায় নেয়, তখন তার মুখে ছিল আনন্দের হাসি। সে হাসিতে প্রকাশ পাচ্ছিল দৃঢ়তা ও সংকল্পের প্রত্যয়দীপ্ত আভা।

এর দু’দিন পরের কথা। সাইফুদ্দিন যে কমান্ডারকে হলব পাঠিয়েছিল, সে ফিরে এলো। কমান্ডার জানালো, সে আল মালেকুস সালেহের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেনি, তবে তাকে সাইফুদ্দিনের চিঠি পৌঁছে দিয়েছে।

‘তুমি কি তার কাছ থেকে এ চিঠির কোন জবাব নিয়ে আসতে পারোনি?’ জানতে চাইলো সাইফুদ্দিন।

‘না। তবে আমি বলে এসেছি, তিনি যেন সত্ত্বর এ চিঠির লিখিত উত্তর পাঠান।’

‘তুমি কি তাকে আমার ঠিকানা দিয়ে এসেছো?’

‘জ্বী।’ কমান্ডার বললো, ‘আপনার বর্তমান ঠিকানা এবং এখানে আসার একটি নকশাও এঁকে দিয়ে এসেছি।’

সাইফুদ্দিন তার চিঠির উত্তরের আশায় বসে রইলো। একদিন গেলো, দু’দিন গেলো, কিন্তু কোন উত্তর এলো না। অস্থির হয়ে উঠলো সাইফুদ্দিন। তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও কোন জবাব না পেয়ে নিজেই হলব যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

‘আমি নিজেই হলব চলে যাই না কেন?’ সহ-সেনাপতিকে বললো সাইফুদ্দিন, ‘হলবের সেনাবাহিনী সালাহউদ্দিনের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি করে থাকলে খুব ভেবে-চিন্তে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গুমাস্তগীনের ওপর ভরসা করা যায় না। আমার একার পক্ষে তো যুদ্ধে নামা সম্ভব নয়। এ নিয়ে খৃস্টানদের সাথে আলাপ করা দরকার। সম্মিলিত পরিকল্পনা গ্রহণের চিন্তা তো তারাও করছে।’

‘এটা কি সম্ভব, আইয়ুবীর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে সালেহ যুদ্ধের ফায়সালা নেবে?’ সহ-সেনাপতি বললো।

‘হ্যাঁ, এটা সম্ভব!’ কমান্ডার বললো, ‘আমি সেখানে তার যে সব সেনাপতি ও কমান্ডারের সাথে আলাপ করেছি, তারা প্রায় সবাই বলেছে, আল মালেকুস সালেহ সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে সুলতানের সাথে প্রতারণা করেছে মাত্র। এটা স্রেফ ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। তার কোন সেনাপতি ও আমীরই চায় না, সালেহ এ চুক্তি মেনে চলুক। খৃস্টান উপদেষ্টারাও তাকে শীঘ্র আক্রমণের পরামর্শ দিয়েছে।’

‘তাহলে আপনার শীঘ্রই হলব চলে যাওয়া উচিৎ।’ সহ-সেনাপতি বললো, ‘আর আমি মুশেল চলে যাই।’

‘তুমি আরো একবার হলব যাও!’ সাইফুদ্দিন কমান্ডারকে বললো, ‘আল মালেকুস সালেহকে গিয়ে বলো, আমি আসছি। তুমি আজ যাত্রা করলে আমি আগামীকাল রাতে রওনা করবো। এমনও হতে পারে, সে আমার সাথে নাও দেখা করতে পারে। হলব শহরের বাইরে আল মুবারক নামে যে ঝরণা ও উদ্যান আছে, সেখানে আমি ক্যাম্প করবো। আল মালেকুস সালেহকে বলবে, ওখানেই সে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে। সে যদি আমার সাথে দেখা করতে না চায়, সে কথাও আমাকে তুমি আল মুবারকে এসে বলে যাবে।’

‘ওখানে কি আপনার একা যাওয়া উচিৎ হবে?’ কমান্ডার বললো।

‘এ এলাকায় তো কোন ভয় নেই।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘আমি রাতে রওনা হবো। পথ চলবো সাধারণ বেশে। কেউ কি আর জানতে পারবে, তাদের সামনে দিয়ে মুশেলের আমীর যাচ্ছে!’

‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা ও কমান্ডো বাহিনী বড় হুশিয়ার।‘

সহ-সেনাপতি বললো, ‘সে ভয় নিয়ে তো আর ঘরে বসে থাকা যাবা না। ওভাবে ভাবলে তো বলতে হয়, তাদের থেকে আমরা কোথাও নিরাপদ নই।’

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘এটুকু ঝুঁকি আমাকে নিতেই হবে। তাহলে আজই তুমি মুশেল যাত্রা করো, ও রওনা হোক হলবে। আর আমি কাল রাতে হলব যাত্রা করছি।’

ওরা যখন এসব বলাবলি করছিল, হারেস ও দাউদ দরজায় কান লাগিয়ে শুনছিল সব কথা। সাইফুদ্দিনের পুরো কর্মসূচীই জানা হয়ে গেল ওদের। দু’জনই সেখানে থেকে সরে তাদের কামরায় চলে এলো। তারা গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো। দাউদকে তো সাইফুদ্দিনকে অনুসরণ করতেই হবে কিন্তু কি ভাবে করবে তাই সে ভাবছিল। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর হারেসের মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। সে বললো, ‘আমরা সাইফুদ্দিনের দেহরক্ষী সেজে তার সাথে হলব যাত্রা করতে পারি না! আমরা হঠাৎ তার সামনে গিয়ে উপস্থিত হবো। আমার কথা তো তিনি জানেনই। তাকে বলবো, আমরা তার বাহিনীরই সৈনিক। যুদ্ধের পরাজয়ের পর এ ক’দিন এক জায়গায় লুকিয়ে থেকে আজ ফিরলাম। তারপর তিনি যখন রওনা করতে যাবেন, আমরা তাকে বলবো, আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের আমীরকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিরাপত্তাহীনভাবে কোথাও যেতে দিতে পারি না। আপনি যেখানেই যাবেন, আপনার দেহরক্ষী হিসাবে আপনার সাথে থাকবো।’

‘যদি তিনি বলেন, তোমরা মুশেল চলে যাও, তখন কি করবে?’ দাউদ তাকে প্রশ্ন করলো।

‘তখন অন্য কোন কৌশল বের করতে চেষ্টা করবো।’ হারেস বললো।

‘যদি তোমার সে কৌশলও ব্যর্থ হয়ে যায়, তবে?’

‘তবে তিনিও হলব যেতে পারবেন না।’ হারেস মুখমন্ডল কঠিন করে বললো।

দাউদ বললো, ‘তোমার প্রস্তাবটি মন্দ নয়। তবে এখনি সিদ্ধান্তে পৌঁছার দরকার নেই। তুমি আরো একটু ভাবো, আমিও ভেবে দেখি।’

সে রাতেই সাইফুদ্দিন কামরার দরজা বন্ধ করে তার সহ-সেনাপতি ও কমান্ডারকে শেষ নির্দেশ দান করছিল।

রাতের প্রথম প্রহর শেষ হতে চললো, প্রথমে সেখান থেকে বিদায় নিল কমান্ডার। হারেসের বাবা তার ঘোড়া খুলে এনে তুলে দিল তার হাতে। একটু পর সহ-সেনাপতিও বিদায় নিল। কামরায় এখন শুধু একা সাইফুদ্দিন গাজী।

সঙ্গীদের বিদায় করে সাইফুদ্দিন গাজী শুয়ে পড়েছিল। সহসা ভেতর দিকের দরজা জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললো কেউ। এমন জোরে আওয়াজ হলো দরজা খোলার, তিনি ভয় পেয়ে উঠে বসলেন। দেখলেন, ফৌজি খুশীতে বাগ বাগ হয়ে দৌড়ে আসছে। সাইফুদ্দিন সহাস্যে বললো, ‘কি ব্যাপার ফৌজি! আনন্দে দেখি একদম আটখানা হয়ে গেছো!’

ফৌজি ছুটে সাইফুদ্দিনের পাশে গিয়ে তার দুই হাত চেপে ধরে বললো, ‘ভাইয়া এসেছে! তার সঙ্গে তার এক বন্ধুও এসেছে!’ ফৌজি খুশীতে ডগমগ করছিল।

সাইফুদ্দিনের চেহারা মুহুর্তে পাল্টে গেল। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি তাদের বলে দিয়েছো, আমি এখানে আছি!’

‘হ্যাঁ!’ ফৌজি উত্তর দিল, ‘আমি আপনার কথা বলতেই তারা তো আকাশ থেকে পড়লো। ভাইয়া আমার কথা বিশ্বাস করতে পারলো না, বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আব্বা! তোমার মেয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ আব্বা বললো, ‘নারে বেটা, ওর মাথা খারাপ হয়নি। সত্যি আল্লাহ আমাদের ঘরে এক সম্মানিত মেহমান পাঠিয়ে দিয়েছেন।’ এ কথা শুনে ওরা তো মহা খুশী! ভাইয়া বললো, ‘যা তো ফৌজি, মেহমান যদি না ঘুমিয়ে থাকে, বলবি, ভাইয়ারা আপনাকে সালাম করা অনুমতি চাইছে।’

সাইফুদ্দিন অন্তরের পেরেশানী লুকিয়ে রেখে মুখে হাসি টেনে বললো, ‘যাও , ওদের নিয়ে এসো।’