দাউদ ও হারেস তাকে উৎসাহিত করার জন্য খুব আবেগের সাথে ফৌজির কথা বার বার বলে তার প্ল্যানের নকশাও জেনে নিতে লাগলো। সাইফুদ্দিন কিভাবে অভিযান চালাবে প্রশ্ন করে তার খুঁটিনাটি জেনে নিল।
‘তোমরা এখন দু’জনই তোমাদের নিজ নিজ ব্যাটেলিয়ানে চলে যাও।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘এখন আমার রক্ষী দল এসে গেছে। আবারও বলছি, আমি তোমাদের দু’জনকে চিরকাল মনে রাখবো।’
তিনটি বাহিনী একত্রিত হয়ে রাতের অন্ধকারে যাত্রা করলো। দাউদ ও হারেস মুশেলের সেনাবাহিনীর একটি দলে ঢুকে পড়লো। হারেসকে সিপাইরা চিনতো। কারন সে ওদের দলেরই ছিল। দাউদ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে হারেস বললো, ‘মুশেলের আমীর তাকে আমার সঙ্গে পাঠিয়েছে। সে অন্য ব্যাটেলিয়ানে ছিল, এখন এখানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আমীর।’
ফলে দাউদের পরিচয় নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন তুলল না।
তিনটি বাহিনী সতর্কতার সাথে পথ চলতে লাগলো। মধ্যরাত। বাহিনী একটি পাহাড়ী এলাকায় এসে পড়লো। পাহাড়ের সংকীর্ণ পথে সৈনিকদের লাইন ঠিক রাখা সম্ভব হল না। লাইন এলোমেলো হয়ে যেতেই দাউদ হারেসকে বললো, ‘জলদি এখান থেকে বের হও। পালাবার এটাই উত্তম সময়!’
রাতের অন্ধকার ও এলোমেলো কাফেলার সুযোগে দু’জন তাদের ঘোড়াকে ধীরে ধীরে একদিকে সরিয়ে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাহিনী থেকে দূরে সরে গেল ওরা। দাউদ হারেসকে বললো, ‘ভোর হলেই সম্মিলিত বাহিনী কোথাও ক্যাম্প করে রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে। দিনে ওরা পথ চলবে না। আমরা সারাদিন পথ চললে রাতের মধ্যে তুর্কমান পৌঁছে যেতে পারবো। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে আসন্ন হামলার খবর আমরা একদিন আগেই পৌঁছে দিতে পারবো। তখন সুলতান আইয়ুবী বুঝবেন, কিভাবে শত্রুদের স্বাগত জানালে উত্তম হবে।’
দাউদ তার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল। তার পরিপূর্ণ ভরসা ও আশা ছিল, এ অভিযানে সে অবশ্যই সফল হবে। কিন্তু তার জানা ছিল না, আশেপাশের এলাকাগুলোতে সম্মিলিত বাহিনীর অজস্র গোয়েন্দা ও কমান্ডোরা ছড়িয়ে আছে।
তারা দু’জনই বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডান দিকে বহু দূর চলে এসেছিল। যখন বুঝলো, তারা নিরাপদ স্থানে চলে এসেছে, তখন তারা দিক পরিবর্তন করে তুর্কমানের রাস্তা ধরলো।
এতক্ষণ তারা হালকা গতিতে পথ চলছিল, এবার অশ্বের গতি কিছুটা দ্রুততর করলো। হারেস বললো, ‘গতি খুব দ্রুত করো না, কারণ আমাদের অবিরাম পথ চলতে হবে। ঘোড়াকে বেশী ক্লান্ত ও দুর্বল করা যাবে না।’ দাউদও তার সাথে একমত হলো এবং বিরতিহীনভাবে মধ্যম গতিতে এগিয়ে চললো। সারা রাত এভাবেই পথ চললো তারা। আসতে আস্তে রাতে অন্ধকার ফিঁকে হয়ে এলো। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়লো পাহাড়ী রাস্তায়।
দাউদ ঘোড়া থেকে নেমে পাহাড়ের এক উঁচু চূড়ায় উঠে গেল। নিচে ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হারেস। দাউদ চারদিকে দৃষ্টি বুলালো। কোথাও কোন জনমানব নেই। রাস্তায় কোন পথিক বা কাফেলা নেই। পেছনে অনেক দূরে ধুলোর আবছা মেঘ দেখা যাচ্ছ। এ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না তার। ধূলোর মেঘ দেখে আশ্বস্ত হলো সে, বাহিনী এখনো পথ চলছে ঠিকই, তবে তারা অনেক দূরে এবং একটু পরই তারা কোথাও লুকিয়ে পড়বে। ফলে অগ্রযাত্রা থেকে যাবে তাদের। কিন্তু হারেস ও দাউদ কোথাও থামবে না, ফলে বাহিনীর অনেক আগেই তারা তুর্কমান পৌঁছে যেতে পারবে।
কিন্তু তার জানা ছিল না, দুশমন গোয়েন্দা জালের মত ছড়িয়ে আছে তার চলার পথে। সে নিচে নেমে এলো। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে দু’জনই আবার আগের গতিতে চলতে শুরু করলো।
অঞ্চলটি ছিল বালি ও পাথরে ভরা। কোথাও কোন সবুজ নেই, ঘাস বা বৃক্ষ নেই। নিরেট দুর্গম পাথুরে ভূমি।
দু’জন টিলার মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনে একটা মোড়। ওরা মোড়ের কাছে পৌঁছে যেই ঘোড়ার মুখ ঘুরালো, চারজন অশ্বারোহী বর্শা হাতে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
‘অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামো।’ এক অশ্বারোহী গম্ভীর কন্ঠে হুকুম করলো, ‘আগে বলো, তোমরা কারা, কোত্থেকে এসেছো এবং কোথায় যাচ্ছো!’
‘আমরা মুসাফির!’ ঘোড়া থেকে না নেমেই বললো দাউদ।
‘মুসাফির মুশেলের সেনা পোষাকে কোথাও যেতে পারে না।’ অশ্বারোহী বললো, ‘মুসাফিরের হাতে সেনাবাহিনীর অস্ত্র থাকে না, যেমন তোমাদের হাতে আছে। তোমরা যে কেউ হওনা কেন, তোমাদের হলব ফিরে যেতে হবে। আমরা তোমাদের আর এক কদমও সামনে বাড়তে দেবো না।‘
এরা ছিল হলবের চার কমান্ডো। রাস্তায় সন্দেহজনক ব্যক্তি পেলে তাদেরকে ধরে হলবে নিয়ে যাওয়ার হুকুম ছিল ওদের ওপর। হলব থেকে তুর্কমান পর্যন্ত পুরো পথেই ছড়িয়ে ছিল এই কমান্ডো ও গোয়েন্দা বাহিনী।
অশ্বারোহী চারজন ওদের দু’জনকে ঘিরে ফেললো। দাউদ হারেসকে আস্তে করে বললো, ‘সময় হয়ে গেছে ভাই।’
হারেস তার ঘোড়ার লাগাম ঝটকা মেরে টেনে ধরলো। ঘোড়া সামনের পা শূন্যে তুলে লাফিয়ে উঠলো। পা নামাতেই তীরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল হারেস।
তার আগেই, ঘোড়া যখন লাফিয়ে উঠেছিল, হারেস সঙ্গে সঙ্গে সামনের লোকটির বুকে বর্শা দিয়ে আঘাত করলো। আঘাতের ধকল সইতে না পেরে লোকটি নিচে পড়ে গেল। কিন্তু তার বাম পাশের লোকটি ততক্ষণে বর্শা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হারেসের ওপর। লোকটির বর্শা বিদ্ধ হলো হারেসের কাঁধে। হারেস জবাবী হামলা করার পরিবর্তে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
দাউদ ছিল কমান্ডো যোদ্ধা। এ ধরনের পরস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে আত্মরক্ষার কৌশল জানা ছিল তার। সে তার ঘোড়া ছুটানোর সাথে সাথে প্রতিপক্ষের একজনকে পিছন থেকে ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো ঘোড়ার সামনে। লোকটির দেহ পিষ্ট হয়ে গেলো ঘোড়ার পদতলে। হামলাকারীরা ছিল চারজন, দু’জন এরই মধ্যে ধরাশায়ী হলেও বাকী দু’জন ছিল অক্ষত। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়েই ওরা ধাওয়া করে ছুটিল ওদের পেছনে।
হারেস ছিল আহত। সে ঠিকমত ঘোড়া ছুটাতে পারছিল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওদের ধরে ফেললো ধাওয়াকারীরা।
এ স্থানটা ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধ করার উপযুক্ত ছিল না। দু’দিকেই ছিল উঁচু টিলা। ঘোড়া লাফাতে ও চিৎকার করতে লাগলো। বর্শার সাথে বর্শার ঘর্ষণের কর্কশ আওয়াজ আচ্ছন্ন করে ফেলল হারেসকে। বেশীক্ষণ সে ওদের প্রতিরোধ করতে পারলো না। উপর্যুপুরি বর্শার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হারেস অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গেল।
দাউদও এর মধ্যে আহত হয়েছে, আহত হয়েছে তার প্রতিপক্ষও। হারেস পড়ে যেতেই তার আহত প্রতিপক্ষ দাউদের দিকে ফিরল। লড়াইয়ের অবস্থা তাদের অনুকূলে বুঝতে পেরে ছুটলো তাদের দিকে। ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিল হারেস। হুশ ফিরতেই দেখলো, যে বর্শাধারী তাকে আহত করেছিল, সে তাকে মৃত ভেবে এবার ছুটে যাচ্ছে দাউদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে যেন খোদায়ী শক্তি ভর করলো। সে তার বর্শাটি কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারলো ছুটন্ত দুশমনের দিকে। পথের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটি, আর উঠতে পারল না।
তখনো লড়াই হচ্ছে দাউদ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে। দু’জনের অবস্থাই গুরুতর। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত উভয়ের দেহ। আরেকজনকে আঘাত করে চলেছে, কিন্তু সে আঘাতের সুষ্পষ্ট টার্গেট কেউ ঠিক রাখতে পারছে না। এলোমেলোভাবে যেন অভ্যাসের বশে একজন আরেকজনকে আঘাত করে চলেছে। দাউদের ঠিক মনে নেই এরপর কি ঘটেছিল। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলো ছয়টি আহত ঘোড়া পাহাড়ের সংকীর্ণ কুচিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের আরোহীদের রক্তাক্ত নিথর দেহগুলো পড়ে আছে পাথুরে মাটির ওপর।
দাউদ উঠে বসলো। লম্বা করে দম নিল কয়েকবার। ক্ষত থেকে তখনো গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। সে খঞ্জর বের করে জামা ছিঁড়ে কয়েক জায়গায় ব্যান্ডেজ করলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে। উঠে বসলো ঘোড়ার পিঠে।
যুদ্ধ শেষ। আহত রক্তাক্ত দাউদ তুর্কমানের পরিবর্তে হারেসের বাড়ীর দিকে যাত্রা করলো।
হারেসকে একনজর কাছে গিয়ে দেখার কথাও মনে এলো না তার। সে ধরেই নিয়েছিল, তার কমান্ডোর মত হারেসও মারা গেছে। হয়তো একটু পর সে নিজেও মারা যাবে।
তখনি তার মনে পড়লো, দুশমন এসে পড়ার আগেই সুলতানের কাছে খবর পৌঁছানো দরকার। আর এ খবর পৌঁছাতে হতে তাকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।
তার শরীর থেকে এত বেশী রক্ত ঝরে গিয়েছিল যে, ঘোড়ার জ্বীন ও পিঠ ভিজে গিয়েছিল। সে অনুমান করে দেখলো, তুর্কমান অনেক দূর। তারচেয়ে হারেসের গ্রাম অনেক কাছে। তার লক্ষ্য হারেসের বাবা। একবার ওখানে পৌঁছতে পারলে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ তার শহীদ সন্তানের আত্মার শান্তির জন্য তুর্কমান ছুটে গিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে সংবাদ দিতে রাজি হবে।
সে প্রানপণে ঘোড়া ছুটাচ্ছিল। ঘোড়ার দোলা ও ঝাঁকিতে রক্ত ঝরা বেড়ে যাচ্ছিল। পিপাসায় শুকিয়ে আসছিল তার কন্ঠ। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। একটু পর পর সে মাথা ঝাঁকি দিয়ে চেতনা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। সে পথ চলছিল আর কোরআনের আয়াত পাঠ করছিল। মাঝে মাঝে কোরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছিল, ‘হে আকাশ ও মাটির মালিক, দোহাই তোমার রাসূলের, তুমি আমাকে আর সামান্য কিছু সময় বেঁচে থাকার সুযোগ দান করো।’
ঘোড়া দ্রুত তালে দৌঁড়ে চলেছে। দাউদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠলো। সে অনুভব করলো, মৃত্যু তার একদম কাছে চলে এসেছে। তার সর্ব শরীর নিঃসাড় হয়ে যাচ্ছিল। বার বার মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে নিচ্ছিল।
সে অনুভব করলো, হারেসদের বাড়ী আর বেশী দূরে নেই। কিন্তু সে আর অশ্বপৃষ্ঠে বসে থাকতে পারছিল না। সে ঘোড়ার পিঠে শুয়ে পড়লো, খামছে ধরলো ঘোড়ার পশম।
এভাবে এগিয়ে গেলো আরো কিছু পথ। ঘুমে জড়িয়ে এলো চোখ দুটো। নিজকে সামলে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করলো দাউদ, কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারলো না। এক সময় সে পায়ের তলায় মাটি অনুভব করলো। ধীরে ধীরে সুপ্তির অতলে হারিয়ে গেল সে, জ্ঞান হারালো দাউদ।
তার যখন হুশ হলো, অনুভব করলো, কেউ একজন তাকে ধরে রেখেছে। নিশ্চয়ই এখন রাত, অন্ধকার দূর করার জন্য পাশেই মশাল জ্বলছে।
সে নিজেকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করলো। তার কানে ভেসে এলো নারী কন্ঠের আওয়াজ, ‘দাউদ তুমি বাড়ীতে, ভয় পেওনা!’
নারী কন্ঠটি চিনতে পারলো দাউদ। এ যে ফৌজির কন্ঠ! সে অজ্ঞান অবস্থায় তাহলে এখানে এসে পৌঁছে গিয়েছিল! আল্লাহর দরবারে তার ফরিয়াদ তাহলে বৃথা যায়নি!
‘বাবা কোথায়?’ শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করলো দাউদ।
‘তিনি বাইরে গেছেন!’ ফৌজি বললো।
‘কখন ফিরবেন?’ দাউদের কন্ঠে অস্থিরতা।
‘তিনি কাল অথবা পরশু আসবেন।’
ফৌজি ও তার ভাবী ক্ষত ধুয়ে পরিষ্কার করছিল, পানি চাইলো দাউদ। ফৌজি মশক থেকে পানি ঢেলে ওর ঠোঁটের কাছে তুলে ধরলো, কাত হয়ে পানি পান করে সে।
পানি খাওয়া হয়ে গেলে দাউদ নিঃসাড় হয়ে কিছুক্ষণ পড়ে রইলো ওভাবে। চোখ বন্ধ করে ভাবলো কিছুক্ষণ। এক সময় চোখ মেলে ফৌজির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ফৌজি, তুমি বলেছিলে পুরুষের কাজ মেয়েরাও করতে পারে।’ তার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবু সে কথা বন্ধ না করে বলতে লাগলো, ‘আমার ক্ষত পরিষ্কার করার বৃথা চেষ্টা বাদ দাও। আমার শরীরে আর কোন রক্ত নেই। আমি যদি সুস্থ্য থাকতাম, তবে তোমার বাইরে যাওয়া আমি কিছুতেই সহ্য করতাম না। যা করার আমি নিজেই করতাম। কিন্তু এখনকার অবস্থা ভিন্ন। আমি এখন যে কথা বলছি, এটা শুধু আমার ও তোমার নিজস্ব ব্যাপার নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের রাসূলে পাকের সম্মান। জড়িয়ে আছে জাতীয় মর্যাদা ও ইজ্জতের প্রশ্ন।’
‘বলো দাউদ! তোমার আমার স্বপ্ন এক, আশা এক। জাতীয় কোন দায়িত্ব আমাদের দেয়ার কথা ভেবে থাকলে এটাকে আমি আমার পরম সৌভাগ্য মনে করবো। আমাদের উদ্দেশ্য আমাদের জীবনের চাইতেও মহৎ, প্রাণের চেয়েও মূল্যবান। জাতির কোন সেবা করার সুযোগ পেলে সে দায়িত্ব আমি প্রাণ দিয়ে পালন করবো।’ দাউদ ফৌজিকে তুর্কমানের রাস্তা বলে দিল। আর বললো, ‘একটু কাগজ নাও, আমি যা বলছি লিখে নাও।’
দাউদ ফৌজিকে দিয়ে একটি চিঠি লিখালো। তারপর সে চিঠিতে দস্তখত দিয়ে তুলে দিল ফৌজির হাতে। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘হলব, হারান ও মুশেলের সম্মিলিত বাহিনী তুর্কমানে আক্রমণের জন্য হলব থেকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। তারা যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছে তাতে আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে তুর্কমানে চড়াও হয়ে যেতে পারে।’
চিঠিটি ফৌজির হাতে দিয়ে দাউদ বললো, ‘ফৌজি, এ চিঠির গুরুত্ব বুঝানোর জন্য তোমাকে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করি, এ খবর পৌঁছানোর জন্যই আমার এ আহত ও রক্তাক্ত অবস্থা, এ ফরজ আদায় করতে গিয়েই শহীদ হয়ে গেছে তোমার একমাত্র সহোদর প্রিয় ভাই। দুশমন চড়াও হওয়ার আগেই এ চিঠি আইয়ুবীর কাছে পৌঁছাতে হবে। যাওয়ার পথে যদি দুশমন গোয়েন্দার হাতে ধরা পড়ে যাও, নষ্ট করে ফেলবে চিঠি। তারপর যদি ওদের হাত গলে বেরিয়ে যেতে পারো তবে সোজা তুর্কমানে গিয়ে সব কথা সুলতান আইয়ুবীর কাছে খুলে বলবে।’
ফৌজি প্রস্তুত হয়ে গেল, তার সাথে রওনা হলো হারেসের স্ত্রীও। একটা ঘোড়া বাড়ীতে ছিল, দ্বিতীয় ঘোড়াটি নিল দাউদের। কিন্তু দাউদকে এ অবস্থায় ফেলে যেতে ভয় পাচ্ছি ফৌজি ও তার ভাবী।
‘ফৌজি!’ দাউদ দুর্বল স্বরে বললো, ‘আমার কাছে এসো।’
ফৌজি যখন তার কাছে গেলো, দাউদ তার হাত ধরে বললো, ‘সত্য পথের সৈনিক ও যাত্রীদের বিবাহ উৎসব হয় আকাশে। তাদের বরযাত্রীরা পথ চলে ধুমকেতুর রাস্তা ধরে। আকাশের তারকারাজি তো সেই উৎসব-আনন্দেই হেসে উঠে আলো ছড়ায়! তুমি ভেবো না, আমাদের বিয়ের আনন্দ-উতসব আকাশের তারকারাজিই করবে।’
দাউদের জবান বন্ধ হয়ে গেল। একদিন ঢলে পড়লো তার মাথা। ফৌজি আবেগে তাকে জড়িয়ে ধরে ডাকলো, ‘দাউদ! দাউদ!’ কিন্তু ততক্ষণে বর বেশে ধুমকেতুর পথে যাত্রা শুরু হয়ে গেছে দাউদের। দুনিয়ার মায়া ছেড়ে তার আত্মা বিলীন হয়ে গেছে অসীম শূন্যতায়।
ফৌজিকে সব কিছুই বুঝিয়ে বলেছিল দাউদ। তার মৃত্যুর পর শোক যেন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। সংকল্পে দৃঢ় হলো তার চোয়াল। বললো, ‘ভাবী, দাউদ তার প্রভুর কাছে রওনা হয়ে গেছে। এখন আর তাকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। সে যে জিম্মাদারী দিয়ে গেছে আমাদের ওপর, আগে সে জিম্মাদারী পূরণ করতে হবে। চলো, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।’
‘কিন্তু তার লাশ!’
‘লাশ এখানেই থাকবে।’ তার বান্দার লাশের ফায়সালা করবেন তার প্রভু। উদ্দেশ্যের জন্যই জীবন, উদ্দেশ্যের জন্যই মরণ। তার লাশের চাইতে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। উদ্দেশ্যের কথা ভুলে লাশ নিয়ে পড়ে থাকলে পাপ হবে ভাবী।’
বাড়ী এবং দাউদের লাশ আল্লাহর হাওলা করে ফৌজি ও তার ভাবী বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ঘোড়ার ওপর জ্বীন এঁটে দু’জনে চড়ে বসলো দুই ঘোড়ার ওপর। ফৌজি চড়লো দাউদের ঘোড়ায়। ঘোড়ার জীনে তখনো লেগে আছে রক্ত।
তারা যখন ঘর থেকে বেরোয় তখন পৃথিবীর সৌন্দর্য ঢেকে দিয়েছিল রাতে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই দু’টি ঘোড়া গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ পথে ঢুকে গেল। দু’জন নারী পথ চলছিল একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে। রাস্তাঘাট সবই তাদের অচেনা। নক্ষত্রের দিকে লক্ষ্য রেখে দাউদের এঁকে দেয়া নকশা অনুযায়ী ছুটে চললো ওরা। পথ হারাবার ভয় এবং পথের যাবতীয় বিপদ আপদকে তুচ্ছ করে অন্ধকার পথে তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে তুই নারী।
তিন বাহিনীর যুক্ত কমান্ড সারাদিন ক্যাম্প করে শুয়ে থেকে রাতে আবার যাত্রা করলো। তুর্কমান এখন আর খুব বেশী দূরে নেই। আজ সারা রাত পথ চললে তুর্কমানের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া যাবে। কাল দিনের বেলা ইচ্ছা করলে হামলা করা যায়, কিন্তু সাইফুদ্দিন ভেবে দেখলো, যদি কালকের দিনটা কোন মতে গোপনে তুর্কমানের কাছে কোন পাহাড় কুচিতে কাটিয়ে দেয়া যায় সেটাই ভাল হবে। তাহলে রাতের অন্ধকারে অপ্রস্তুত অবস্থায় আইয়ুবীর ওপর অতর্কিত হামলা চালানো যাবে।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এ বাহিনীর আগমন সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিফহাল ছিলেন না। তার কোন গোয়েন্দা হয়তো এখনো এ বাহিনীর আগমন সংবাদ পায়নি অথবা যারা পেয়েছে তারা সবাই সম্মিলিত বাহিনীর গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়া গেছে।
কারণ যাই হোক, মূল কথা হচ্ছে, আইয়ুবী ওদের আগমন এখনো টের পাননি। তিনি তার বাহিনীর সৈন্যদের দেখাশোনা ও নতুন ভর্তি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। শত্রুরা যে আটঘাট বেঁধে সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছে তাকে আঘাত করার জন্য, এমন কোন ধারনাও ছিল না আইয়ুবীর। তিনি তখন ভাবছেন, শত্রুরা এত তাড়াতাড়ি সংগঠিত হতে পারবে না। সালেহ ও সাইফুদ্দিনের যোগাযোগের মাধ্যম যে চিঠি, সেই চিঠি তো এখন তারই হাতে!
সাইফুদ্দিন তার কমান্ডো বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল, ‘বারবার আইয়ুবী গোয়েন্দা তৎপরতায় আমাদের থেকে এগিয়ে থাকে। তার সাফল্যের এটা অন্যতম কারণ। যুদ্ধে জিততে হলে এবার প্রথম থেকেই জিততে হবে। আমাদের আগমনের খবর যেন আইয়ুবী না পায় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’
সাইফুদ্দিন আরো বললো, ‘তুর্কমানের আশেপাশে এমন লোকও দেখা যাবে, যারা গ্রাম্য পোষাকে এবং ভবঘুরে ও দিনমজুরের বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা ভবঘুরে, দিনমজুর বা গ্রাম্য লোক নয়, ওরা সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা। আইয়ুবীর পক্ষে রাস্তা দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত আছে ওরা। এ ধরনের লোকদেরও পাকড়াও করে হলবে পাঠিয়ে দেবে, যাতে আইয়ুবী আমাদের অভিযানের খবর কিছুতেই জানতে না পারে।’
সাইফুদ্দিন গাজীর এ সতর্কতার কারণে জীবনে এই প্রথম সুলতান আইয়ুবী প্রতিপক্ষের আগমন সম্পর্কে সম্পুর্ণ বে-খবর ছিলেন। এ বাহিনী যেভাবে এগুচ্ছে, যদি শেষ পর্যন্ত সুলতান আইয়ুবীকে অন্ধকারে রেখে তারা আইয়ুবীর অপ্রস্তুত বাহিনীর ওপর সত্যি আঘাত হানতে পারতো, তবে আইয়ুবীর আসলেই নিষ্কৃতির কোন পথ নেই।
ফৌজি ও তার ভাবী পাগলিনীর মত ছুটতে ছুটতে রাত পার করে দিল। ক্ষুধা, পিপাসা, ক্লান্তি, ভয় কোন কিছুরই বোধ ছিলনা ওদের। ওরা ছুটছে তো ছুটছেই। এভাবে ছুটতে ছুটতেই ওরা সারারাত ঘোড়ার ওপর কাটিয়ে দিল।
ভোরের আলো ফুটলো পাহাড়ের চুড়ায়, এখানে ওখানে। ফৌজি একটি পাথরে হেলান দিয়ে এক লোককে বসে থাকতে দেখলো। তার কাপড়ে রক্তের দাগ, মাথা একদিকে হেলে পড়ে আছে। ফৌজি তার ভাবীকে বললো, ‘ভাবী, দেখো! দেখো! সামনে এক আহতকে দেখা যাচ্ছে।’
‘থাক, ওর দিকে নজর দেয়ার সময় নেই আমাদের।’
‘লোকটা বেঁচে আছে, না মরে গেছে তাও দেখবো না!’
‘না, থামার সময় নেই ফৌজি! সবার আগে আমাদের তুর্কমান পৌঁছতে হবে।’
রাস্তার পাশেই বসেছিল লোকটি। দেখতে দেখতে ওরা তার কাছে চলে এলো। অচেতন অবস্থা থেকে জেগে উঠলো লোকটি। ঘোড়ার আওয়াজ পেয়ে চোখ মেলে চাইল সেদিকে। ওদের এগিয়ে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল।
ঘোড়া একদম কাছে চলে এসেছিল, লোকটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো ফৌজি, ‘ভাইয়া!’
তারা ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো। কিন্তু ফৌজির চিৎকার শুনতে পেলো না সে, তার আগেই উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালো হারেস।
হারেস লড়াইয়ের সময় প্রচন্ডভাবে আহত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে শহীদ হয়ে যায়নি। তার বেঁচে থাকাটা এক অলৌকিক ব্যাপার। শরীরে বর্শার অসংখ্য আঘাত খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল সে জানে না। যখন চেতনা পেল, পাশের এ পাথরের গায়ে এসে হেলান দিয়ে বসেছিল।
ফৌজির ঘোড়ার সাহতে পানি ছোট মশক ছিল। ফৌজি তাড়াতাড়ি মশক এনে হারেসের চোখেমুখে পানির ছিটা দিল। হারেস অস্ফুটকন্ঠে বললো, ‘পানি! পানি!’
ওরা ওর মুখে পানি ঢেলে দিল, পানি পান করে হারেস চোখ খুললো। নিজের বোন ও বেগমকে তার মুখের ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি এখন কোথায়? বাড়ীতে? দাউদ কোথায়?’
ফৌজি তাকে সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে খুলে বললো। সব শুনে হারেস বললো, ‘তোমরা আমাকে জলদি ঘোড়ায় উঠাও। তাড়াতাড়ি করো, আমাকে তুর্কমানে দিকে নিয়ে চলো।’
অসীম সাহসী দুই নারী অনেক কষ্টে তাকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিল। ফৌজি বসলো ভাইয়ের পিছনে। হারেস শুধু তার অসম্ভব আত্মশক্তি বলে বেঁচে ছিল নতুবা তার শরীরে শক্তি বলে কিছুই ছিল না। একটা ফরজ সমাধা করার জন্যই যেন আল্লাহর তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
ফৌজি তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছিল, যেন সে ঘোড়া থেকে পড়ে না যায়। হারেস অস্ফুটস্বরে ফৌজিকে রাস্তা বলে দিচ্ছিল।
সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তিনটি বাহিনী সাইফুদ্দিনের কমান্ডে তুর্কমানের দিকে অগ্রসব হচ্ছিল। অন্যদিকে ফৌজি, হারেস ও হারেসের স্ত্রী কে নিরাপদ পথে ধরে ছুটছিল তুর্কমানের দিকে।
ভোরের সূর্য বেশ উপরে উঠে এলো। আকাশের দিগন্তে ক্রমশ বাদামী আভা ছড়িয়ে পড়ছিল।
দিগন্তের বাদামী আভা ক্রমশ উপরে উঠতে লাগলো। ক্রমে সে আভা গাঢ় হয়ে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করছিল। দেখতে দেখতে রোদের তেজ ঢেকে দিল উড়ন্ত ধূলি মেঘ। ফৌজির ভাবী ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘ফৌজি, ওদিকে তাকাও’!
হারেস অনুচ্চ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ফৌজি?’
‘ধূলি ঝড়!’ ফৌজি বললো ভীত কম্পিত কন্ঠে।
এই পাহাড় ও মরুভূমির লোকেরা ধূলিঝড় কি জিনিস খুব ভাল করেই জানে। ধূলিঝড়কে ওরা বলে খোদার অভিশাপ। যে অঞ্চল দিয়ে এ ধূলিঝড় বয়ে যায়, সে অঞ্চলটি মুহূর্তে পরিণত হয়ে যায় ধ্বংসস্তুপে। সম্পদের বিনাশ আর অগণিত প্রাণের আর্ত আহাজারীতে মুখর হয়ে উঠে সাজানো লোকালয়। মানুষ ও পশুদের জন্য এ ঝড় নিয়ে আসে কিয়ামতের প্রলয়।
ধুলিঝড় মরুভূমির বালিকে উড়িয়ে নিয়ে প্রবল শক্তিতে একদিকে ছুটে যেতে থাকে। সেই বালির নিচে উপত্যকা, লোকালয় যা কিছুই পড়ে, সবকিছু ঢেকে যায় অন্ধকারে। বালির পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে মানুষ, পশু, ঘরবাড়ি, সবকিছু।
ফৌজি, তার ভাবী ও হারেস তাকিয়েছিল এই ভয়ংকর ঝড়ের দিকে। চোখেমুখে শঙ্কা ও ভয়ের কাঁপন। দেখতে দেখতে চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল।
আল মালেকুস সালেহ, গুমাস্তগীন ও সাইফুদ্দিনের সম্মিলিত বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর ওপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য তুর্কমানের কাছাকাছি এসে এক পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে তখন বিশ্রাম করছিল। আজ সারাদিন এখানে অবস্থান করে রাতে আইয়ুবীর বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা তাদের। সারা রাত ওরা নির্ঘুম পথ চলেছে। পথ চলেছে আগামী রাতটির জন্য। আজ রাতেই আইয়ুবীর ওপর অতর্কিত এমন আক্রমণ চালানো হবে, যেন দুনিয়া থেকে মুছে যায় আইয়ুবীর নাম। তাঁবু ফেলার পরপরই সৈন্যরা তড়িঘড়ি নাস্তা সেরে শুয়ে পড়লো। দুই রাতের ঘুম একসাথে সেরে নিচ্ছিল ওরা।
পাহাড়ের কোলে ছায়ার মধ্যে তাঁবু টানিয়ে ঘুমিয়ে আছে সম্মিলিত বাহিনী। ভয়ংকর মরু সাইমুম ছুটে আসছে ওদের নাস্তানাবূদ করতে, তাঁবুর ভেতর শুয়ে এ কথা কেউ জানতেও পারল না। যারা ছাউনি পাহারায় ছিল, ঘুমে ঢুলছিল ওরাও, তাই ওদের চোখেও প্রথমে ধরা পড়েনি সেই মরুঝড়।
ওদিকে আইয়ুবীর ক্যাম্পে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী প্রশিক্ষণরত সৈনিকদের সামনে তখন বক্তৃতা করছিলেন। তিনি ওদের বলছিলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য পাগলপারা মুজাহিদ বাহিনী! আল্লাহ তোমাদের বাহুর শক্তি আরো বাড়িয়ে দিন! তোমাদের হিম্মত ও কুওত বৃদ্ধি করে দিন। তোমাদের তলোয়ারে হযরত আলী (রাঃ)-এর তেজ ও চমক দান করুন। তোমাদের তীরের গতি হোক চোখ ধাঁধানো। ঘোড়াগুলো হোক দুলদুল অশ্বের মত গতিশীল ও তেজস্বী! আমাদের দুশমন কখনো হারানের গুমাস্তগীন, মুশেলের সাইফুদ্দিন বা হলবের আমীর আল মালেকুস সালেহ নয়। দুশমন আমাদের ক্রুসেডাররা! আগ্রাসী খৃস্টানরা! যারা আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে আমাদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসা। ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করেছে আমাদের ভাইদের। অপবিত্র করেছে আমাদের একমাত্র বাতিঘর পবিত্র কোরআন। লুন্ঠন করেছে আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত ও সম্ভ্রম। মুজাহিদ ভাইয়েরা আমার! ফিলিস্তিনের পবিত্র মাটি থেকে নাপাক শক্তিকে উচ্ছেদ করতে হবে। আমাদের ভাইদের কান্না, বোনদের আহাজারী ব্যাকুল কন্ঠে ডাকছে আমাদের। মনে রেখো, এখন আমাদের টার্গেট ফিলিস্তিন! এখানে যথেষ্ট সময় আমরা পেয়েছি প্রস্তুতির। এই প্রস্তুতিকে সম্বল করে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা ও ভরসা রেখে এবার টার্গেটের দিকে কদম বাড়াতে হবে আমাদের। যদি আমাদের লাশ আল্লাহর মঞ্জুর হয়, তবে সে লাশ যেন পড়ে ফিলিস্তিনের মাটিতে, আর যদি আল্লাহর মঞ্জুর নয় আমাদের বিজয়, তবে মসজিদুল আকসায় শোকরানা নামায পড়ার আগে আমরা কোথাও থামবো না। আমাদের গতি হবে ঝড়ের মত উদ্দাম! টার্গেটে পৌঁছার আগে এ ঝড় কোথাও থামবে না, এ শপথ ও সংকল্পে দৃঢ় করা সবার চিত্ত। মনের ভেতর গেঁথে নাও একটি মাত্র শব্ধ, ফিলিস্তিন! ফিলিস্তিন!
আইয়ুবীর কন্ঠ থেমে গেল। মরুভূমির বাতাসে, ইথারে ইথারে ভাসতে লাগল আইয়ুবীর সেই কন্ঠধ্বনিঃ “বন্ধুরা আমার! ভাইয়েরা আমার! এখন আমাদের টার্গেট ফিলিস্তিন! ফিলিস্তি……”