মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিন গাজী বৃদ্ধের পর্ণকুটিরে মেঝের বিছানায় শুয়ে গভীর নিদ্রায় ডুবে ছিল। গত কয়েক রাত আতংকে তাকে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। আজ একটু নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ত হয়ে এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল যে, ঘরের দরজায় এসে ওরা যখন টোকা দিল, তখনও তার ঘুম ভাঙ্গল না।
রাত অর্ধেকের বেশী পার হয়ে গেছে। মধ্য রাতে একবার ঘুম থেকে উঠতে হয়েছিল সাইফুদ্দিনের জন্য, অনেক রাতে আবার ঘুমিয়েছে বাড়ীর লোকজন, তাই ঘুম ভাঙ্গতে সময় লাগলো ওদের। উপর্যুপরি দরজায় করাঘাত শুনে প্রথমেই ঘুম ভাঙ্গল বৃদ্ধের। চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসলো বৃদ্ধ। তার মেয়ে এবং পুত্র বধূও জেগে উঠলো। বৃদ্ধ বিরক্তির স্বরে বললো, ‘মনে হচ্ছে সুলতান আইয়ুবীর তাড়া খেয়ে আবার কোন সৈন্য বা কমান্ডার এসেছে। রাস্তার পাশে বাড়ী হওয়ার এই এক বিপদ!’
বৃদ্ধ উঠে গিয়ে দরজা খুললো। দেখলো, বাইরের অন্ধকারে দুই অশ্বারোহী দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে এলো হারেস। বাবাকে সালাম করে বললো, ‘আব্বা, আপনারা সবাই ভাল আছেন?’
বৃদ্ধ এগিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো পুত্রকে। বললো, ‘বেটা! আমরা ভাল আছি। আমি খুব খুশি হয়েছি, তুমি অবৈধ মৃত্যুর কবল থেকে সরে আসতে পেরেছো। নইলে যতদিন আমি বেঁচে থাকতাম, লোকজন আমাকে বলতো, ‘তোমার ছেলে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।’
বৃদ্ধ তার ছেলের বন্ধু দাউদের সাথেও মুসাফেহা করলো।
দাউদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, বৃদ্ধ তার ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে ফিসফিস করে বললো, ‘তোমাদের প্রধান সেনাপতি আমীর সাইফুদ্দিন গাজী পাশের কামরায় ঘুমিয়ে আছেন। ঘোড়া বেঁধে রেখে তোমরা সন্তর্পনে ভেতরে চলে আসো।‘
‘সাইফুদ্দিন গাজী!’ হারেস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তিনি কেমন করে এখানে এলেন?’
‘পরাজিত হয়ে পালাতে গিয়ে এখানে চলে এসেছেন!’ বৃদ্ধ চুপি চুপি বললো, ‘তোমরা ভেতরে চলো।’
ঘোড়া বেঁধে রেখে হারেস দাউদকে নিয়ে তার নিজের কামরায় গেল। বৃদ্ধ ছাড়াও সেখানে বসেছিল তার বোন ও স্ত্রী। সে দাউদকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আমার এ বন্ধুর নাম দাউদ! এর চেয়ে উত্তম বন্ধু আর কেউ হতে পারে না।’
‘তুমিও কি পালিয়ে এসেছো?’ বৃদ্ধ দাউদকে জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি সৈনিক নই।’ দাউদ উত্তরে বললো, ‘আমি মুশেলে যাচ্ছি। যুদ্ধ আমাকে এ পথে আসতে বাধ্য করলো। পথে হারেসকে সঙ্গী হিসাবে পেয়ে গেলাম আর তার সাথে এখানে চলে এলাম।’
‘বাবা, আমাকে বলো মুশেলের আমীর এখানে কেন?’ হারেস তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো।
বৃদ্ধ ওদের জানালো কেমন করে তিনি এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তার সাথে তার সহকারী সেনাপতি ও একজন কমান্ডার এসেছিল। তিনি তাদের দু’জনকে কোথায় যেন পাঠিয়ে দিয়েছেন।‘
‘তাদের কোথায় পাঠিয়েছেন কিছুই শোনেননি আপনি?’
‘আমার কানে শুধু এ শব্দটুকুই ঢুকেছিল, ‘সৈন্যদের একত্রিত করো। আর আমাকে জানাও, আমি মুশেল চলে আসবো, না কি আরো কিছুদিন লুকিয়ে থাকবো।’ আমি তখন দরজার কাছেই ছিলাম।’
‘আপনার কি মনে হয়, তিনি মুশেলের সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করে আবার যুদ্ধে যেতে চাচ্ছেন?’ দাউদ জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ। যদিও এখন তিনি ভয়ের মধ্যে আছেন, আমাকে বলেছেন কেউ যেন ঘুর্নাক্ষরেও জানতে না পারে তিনি এখানে আছেন। তবু তার চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়নি আমার।’ বৃদ্ধ বললো, ‘আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প তার অবশ্যই আছে। তিনি সহকারী সেনাপতিকে মুশেল পাঠালেও তার কমান্ডারকে মুশেল নয়, অন্য কোথাও পাঠিয়েছেন।‘
‘আমি তাকে খুন করবো।’ হারেস বললো, ‘তিনি মুসলিম মিল্লাতকে বিভক্ত করে দিয়েছেন। মুসলমান সৈনিকদেরকে লেলিয়ে দিয়েছেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়েছেন। খৃস্টানদের খুশী করতে স্বজাতির রক্তে রঙিন করেছেন নিজের হাত। আমি তাকে খুন করবো।’ প্রচন্ড রাগ ঠিকরে পড়ছিল তার চেহারা থেকে। দেয়ালের সাথে তার পিতার তলোয়ার লটকানো ছিল, সে সেটি খপ করে হাতে নিল। বৃদ্ধ পিতা পেছন থেকে চেপে ধরলো তাকে। দাউদ ছুটে গিয়ে তার হাত চেপে ধরে ছিনিয়ে নিলো তলোয়ার। হারেস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেল। বৃদ্ধ ছেলেকে বললো, ‘আহাম্মক, আগে আমার কথা শুনে নাও।’
দাউদও তাকে টেনে তুলে বললো, ‘এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবকিছু ভাল ভাবে চিন্তা করে নেয়া ভাল। আগে নিজেদের মধ্যে একটা যুক্তি পরামর্শ করে নাও।‘
হারেস অবশেষে মেনে নিল তাদের কথা। সে সুস্থির হয়ে বসলো কিন্তু তার রাগ মিটলো না। তার চোখে মুখে রাগের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল।
‘তাকে হত্যা করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়!’ বৃদ্ধ তার ক্ষুদ্ধ পুত্রকে শান্ত করতে বললো, ‘তিনি এখন গভীর ঘুমে অচেতন। এখন তো আমার এক দুর্বল বাহুও তাকে হত্যা করতে পারবে। তাঁর লাশও গোপন করা সম্ভব। কিন্তু তার দুই সাথী, যারা চলে গেছে, তারা তো আমাকে ছাড়বে না। তারা সন্দেহ করে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তোমার যুবতী বোন ও বৌমাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করবে। যদি আমি তাদের বলি, মুশেলের আমীর এখান থেকে চলে গেছেন, তারা কিছুতেই সে কথা মানবে না। কারণ তারা তো তাকে এখানেই রেখে গেছে। আবার তারা এখানেই তার কাছে ফিরে আসবে খবর নিয়ে।’
‘মনে হচ্ছে আপনি সাইফুদ্দিনকে ভাল মানুষ মনে করেন?’
হারেস বললো, ‘আপনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ করা জায়েজ মনে করেন?’
‘তাকে আমার গৃহে হত্যা করার ব্যাপারে আপত্তির এও এক কারণ।’ বৃদ্ধ বললো, ‘আমি তার সঙ্গীদের সামনেই তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি, তিনি ভুল পথে চলছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, তুমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পৃষ্ঠপোষক মনে হচ্ছে? তিনি আমাকে লোভও দেখিয়েছেন। বলেছেন, যদি তোমার ছেলে এ যুদ্ধে মারা গিয়ে থাকে তবে তার বিনিময়ে তোমাকে অঢেল অর্থ দান করবো। আমি তাকে বলেছি, আমি কামনা করি আমার ছেলে শহীদ হোক, কিন্তু হারাম মৃত্যু ও হারাম মাল কখনো আমার কাম্য নয়। সাইফুদ্দিন আমার সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করেন। তাকে হত্যা করে লাশ গোপন করে দিলে তাতে চরম বিশ্বাসঘাতকতা হবে। তার কমান্ডার ও সহকারী সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রেফতার করবে। বলবে, তুমি সালাহউদ্দিনের সমর্থক বলে মুশেলের আমীরকে হত্যা করেছো!’
‘দাউদ ভাই!’ হারেস দাউদকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি বলো এখন আমি কি করি! তুমি তো আমার মনের কথা জানো। তুমি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলে, আল্লাহ আমার গোনাহের কাফফারা আদায় করার জন্য জীবিত রেখেছেন। কাফফারা আদায়ের এমন সুযোগ আর কি হতে পারে! যার দরুন অসংখ্য মুসলমান নিহত হয়েছে এবং বেঁচে থাকলে আরো হবে তাকে শেষ করে দেয়াই কি বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়?’
‘এই একটি মাত্র লোককে হত্যা করে কোন লাভ হবে না।’ দাউদ বললো, ‘এর যারা বন্ধু, মিত্র বাহিনী ও উপদেষ্টা আছে, এ লড়াই তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ফসল। তারা হলবে ও হারানে বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। বহু সেনাপতি ও কমান্ডার আছে এ তিন সেনাদলে। মাত্র এক সাইফুদ্দিনকে হত্যা করে এ যুদ্ধ বন্ধ করা যাবে না। এদেরকে নিরস্ত্র করার জন্য অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন যুদ্ধের ময়দান। প্রবল প্রতিরোধ ও চাপের মুখেই তারা অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হবে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীই কেবল তাদের উপযুক্ত দাওয়াই দিতে পারেন।’
‘তুমি ঠিকই বলেছো। এত বড় কাজ একমাত্র সুলতান আইয়ুবী ছাড়া আর কে করবেন।’ হারেস বললো, ‘কিন্তু আমার বুকের মধ্যে প্রতিশোধের যে আগুন জ্বলছে, তা কেমন করে নিভবে? তিন মুজাহিদকে হত্যার কাফফারা কেমন করে আদায় করবো আমি?’
মুশেলের আমীরকে অযাচিতভাবে পেয়ে দাউদ খুব খুশী হয়েছিল। সে যে একজন গোয়েন্দা এ কথা হারেস ও তার বাবাকে বলতে ভয় পাচ্ছিল। আবেগ ও উত্তেজনার বশে নিজের পরিচয় প্রকাশ করা কোন গোয়েন্দার কাজ নয়। কিন্তু পরিচয় প্রকাশ না করলে ওদের সাহায্য সহযোগিতা নেয়া দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সাইফুদ্দিন যেখানেই যাক, সে ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করবে। তার প্রতিটি তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র গভীরভাবে লক্ষ্য করবে। কিন্তু ততদিন কি বলে সে হারেসের গৃহে অবস্থান করবে! এ জন্যই সব কথা হারেস ও তার বাবাকে খুলে বলা দরকার। তার পরিচয় প্রকাশ করলে যে খুব বিপদ হবে, তা মনে হয় না। হারস তো সাইফুদ্দিনকে হত্যা করতেই চেয়েছিল। তার বাবাও সাইফুদ্দিনের কাজকে তার মুখের ওপর ভুল বলেছে। এসব ভেবেই দাউদ বললো, ‘যদি আমি তোমাকে এমন উপায় বলে দেই, যাতে সাইফুদ্দিন ভবিষ্যতে আর দাঁড়ানোর সুযোগ না পায়, তবে কি তোমরা আমার সঙ্গী হবে?’
‘আশা করি আমার ছেলের মত তুমি আবেগের বশে কিছু বলবে না। সুচিন্তিত উপায় বের করতে পারলে তুমি অবশ্যই আমাদের সহযোগিতা পাবে।’ হারেসের বাবা বললেন।
‘তাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন সিদ্ধান্তই আমার মনে ধরবে না।’ হারেস বললো।
‘হারেস, যদি তুমি তোমার আবেগ ও চিন্তা ভাবনা সব কিছু আমার নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিতে রাজি হও, তবে তোমাকে এমন কাজে লাগাবো, যাতে তোমার আত্মা শান্তি ও তৃপ্তিতে ভরে যায়।’ দাউদ হারেসের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো।
হারেসের স্ত্রী ও বোন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। দাউদ তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমাকে একটি কোরআন শরীফ দিতে পারো?’
হারেসের বোন তাক থেকে কোরআন নিয়ে বুকে ও চোখে লাগিয়ে চুমো দিয়ে দাউদের দিকে এগিয়ে দিল। দাউদ কোরআন শরীফ খুলে এক জায়গায় আঙ্গুল রেখে পড়তে শুরু করলো, ‘শয়তান তাকে তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে, আর আল্লাহর ভয় ও স্মরণ তার মন থেকে দূর হয়ে গেছে। এ দলগুলো শয়তানের বাহিনী। আর স্মরণ রেখো, শয়তানের বাহিনী ধ্বংস ও ক্ষতি সাধনকারী। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে, সে অবশ্যই লাঞ্চিত ও ঘৃণিত হবে।’
এটা আটাশ পারার আঠারো সূরার উনিশ আয়াত। দাউদ আয়াতটি পড়া শেষ করে কোরআন শরীফ বন্ধ করে বললো, ‘এটা পবিত্র আল্লাহর পবিত্র কালাম। আমি কোন মনগড়া কথা বলছি না, এ কথাগুলো সরাসরি আল্লাহই বলেছেন। এ আয়াত স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে, সম্মিলিত বাহিনী মূলতঃ শয়তানের বাহিনী। কোরআন বলছে, যে লোকেরা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতা করবে, তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত হবে। কিন্তু তারা সে পর্যন্ত লাঞ্ছিত ও পদদলিত হবে না, যতক্ষণ না আমরা তাদের পদদলিত করতে এগিয়ে যাবো। ওরা শয়তানের দল, এ কথা জানার পর ওদের লাঞ্ছিত ও পদদলিত করা আমাদের ওপর ফরজ হয়ে গেছে।’
সে কোরআন দু’হাতের ওপর রেখে হাত সামনে বাড়িয়ে সবাইকে বললো, ‘সবাই যার যার ডান হাত আল্লাহর এ পাক কালামের ওপর রাখো। তারপর আমার সামনে অঙ্গীকার করো, যে গোপন কথা আমি তোমাদের বলবো, তা কখনো প্রকাশ করবে না। শত্রুদের পরাজিত ও ধ্বংস করতে নিজের জীবন আল্লাহর ওয়াস্তে কোরবানী দেবে।’
মেয়ে দু’জনসহ সকলেই কোরআনের ওপর হাত রেখে অঙ্গীকার করলো। কোরআনের শপথ তাদের মনে বজ্রকঠিন সংকল্প সৃষ্টি করে দিল। তাদের চেহারায় সে অভিব্যক্তি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কামরার মধ্যে বিরাজ করছিল পিনপতন নীরবতা। কারো নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না। সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে ছিল দাউদের দিকে।
‘তোমরা সবাই কোরআনের ওপর হাত রেখে কসম খেয়েছো।’ দাউদ বললো, ‘আল্লাহতায়ালা কোরআন তোমাদের ভাষাতেই অবতীর্ণ করেছেন। তোমরা এ পবিত্র কিতাবের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বুঝতে পারো। যদি তোমরা এ শপথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, সে শাস্তির কথা কোরআনেই উল্লেখ আছে। তোমাদেরকে আল্লাহ তাদের মত লাঞ্ছিত ও পদদলিত করবেন, যেমন শয়তানের বাহিনীকে করা হবে।’
‘তুমি কে?’ বৃদ্ধ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি বড় ওলি-দরবেশের অনুসারী মনে হয়!’
‘আমার কাছে কোন ওলি-দরবেশের বিদ্যা বা জ্ঞান নেই।’ দাউদ বললো, ‘আমার কাছে আছে আল্লাহর কালাম ও সেই কালামের নির্দেশ, যা সব সময় আমাকে পথ দেখায়। আমি কোরআনের আলোয় পথ চলতে ও কাজ করতে গিয়ে জানবাজি রেখে এখানে এসে পৌঁছেছি। এ শিক্ষা কোন আলেম ও পীরের কাছ থেকে লাভ করিনি, আমার শিক্ষক ও আমার নেতা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। আমি মুশেলের বাসিন্দা নই। দামেশকের নাগরিক আমি। সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা হিসাবে আমি এখানে এসেছি। এই সে গোপন কথা, যে কথা গোপন রাখার জন্য আমি তোমাদেরকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করিয়েছি, যেন তোমরা এ গোপন তথ্য ফাঁস করে না দাও। তোমাদের সহযোগিতা দরকার আমার। আমাকে আশ্বাস দাও, তোমরা আমাকে সহযোগিতা করবে?’
‘হ্যাঁ, আমরা কোরআনের কসম করে এ আশ্বাস তোমাকে দিচ্ছি।’ বৃদ্ধ বললো, ‘তুমি এখন কিভাবে কি করতে চাও সব খুলে বলো।’
‘আল্লাহর অসীম রহমত আমার ওপর।’ দাউদ বললো, ‘আমি যে লোকটির মনের কথা বের করার জন্য সুলতান আইয়ুবীর কাছ থেকে মুশেলের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, সে লোকটি এখন এখানে এই কুটিরের চালার নিচে শুয়ে আছে। আল্লাহ আমাকে তার কুদরতি মদদে সঠিক স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। এখন আমাকে জানতে হবে, সাইফুদ্দিন ও তার সাথীরা পরবর্তীতে কি সংকল্প ও কি কর্মসূচী গ্রহণ করে। যদি এরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে তবে সে তৎপরতার খবর আগেই পৌঁছে দিতে হবে আইয়ুবীর দরবারে। যাতে তিনি তাদের সব ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পারেন। এখন তাদের পরিকল্পনা ও ইচ্ছা জানাই আমার কাজ। আল্লাহ না করুক, তারা যদি সুলতান আইয়ুবীকে অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করে বসে তাহলে তার কি পরিণাম হবে ভাবতে পারেন?’
‘সৈন্যদের লেলিয়ে দিয়ে যারা মুসলমানদের হত্যা করতে চায়, তাদেরকে কি হত্যার করার অনুমতি দেয়া হবে?’ হারেস জিজ্ঞেস করলো।
‘সে কথাও আমি বলছি তোমাকে।’ দাউদ বললো, ‘খেয়ালের বশে হত্যা না করাই উচিৎ। তোমাকে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ধীরস্থীর মাথায় চিন্তা-ভাবনা করা উঠাতে হবে। এখন সাইফুদ্দিনের ওপর কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে আমাদের। তাকে অনুসরণ করে জানতে হবে তার পরিকল্পনা কি। তিনি এখন এখানে আত্মগোপন করে আছেন। তুমি এবং আমিও আত্মগোপন করে কৌশলে তার গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকবো। তারপর যখন সময় হবে তখন আমি বলবো, হ্যাঁ, এবার তুমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে পারো। তার আগে তাকে হত্যা করার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দাও।’
সাইফুদ্দিন তখনো সেই বাড়িতেই এক কামরায় গভীর নিদ্রায় শায়িত। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। বৃদ্ধ একটু উঁকি মেরে দেখলো তখনো ঘুমিয়ে আছে মুশেলের আমীর। দেখতে দেখতে সূর্য উপরে উঠে গেল। অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল তার। হারেসের স্ত্রী ও বোন সকালের নাস্তা নিয়ে প্রবেশ করলো তার কামরায়। সাইফুদ্দিন হারেসের বোনে দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো। নাস্তা রেখে চলে যাচ্ছিল সে, সাইফুদ্দিন তাকে কাছে ডাকলো। বললো, ‘তুমি আমার যে খেদমত করছো, আমি অবশ্যই তার যথাযথ মূল্য দান করবো। যে দান তুমি কোন দিন কল্পনাও করোনি। আমি তোমাকে আমার শাহী মহলে সুখের পায়রা বানিয়ে রাখবো।’
‘যদি আমি আপনাকে এই কুটিরেই মেহমান বানিয়ে রাখি, তাতে কি আপনি খুশী হবেন না?’ মেয়েটি হেসে বললো।
‘আমি তো মরুভূমিতেও থাকতে পারি।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘কিন্তু তুমি তো ফুলের সাথে সাজিয়ে রাখার জিনিস।’
‘আপনার কি বিশ্বাস, আপনার ভাগ্যে আবার মহলে ফিরে যাওয়া লেখা আছে?’ মেয়েটি বললো।
‘এমন কথা তুমি কেমন করে বললে?’
‘আপনার অবস্থা দেখে বলছি।’ মেয়েটি বললো, ‘আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার! শাহী মহলের পরিবর্তে লুকিয়ে আছে এক গরীবের কুটিরে। পাইক-পেয়াদা, সৈন্য-সামন্ত, মন্ত্রী-পারিষদ কেউ পাশে নেই। আপনি তো এখন এক রাজ্যহারা রাজা।’
‘না, সবকিছু তুমি জানো না। সৈন্যরা এখনো আমার সঙ্গ ছাড়েনি।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘একটু বিশ্রামের জন্য আমি এখানে থেমেছি। মহল শুধু আমার ভাগ্যে নয়, তোমার ভাগ্যেও লেখা আছে। তুমি কি আমার সাথে যেতে রাজী হবে?’
হারেসের স্ত্রী কামরা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, বোনটি কথা বলছিল সাইফুদ্দিনের সাথে। সাইফুদ্দিনের প্রস্তাব শুনে সে বললো, ‘যদি আপনার জায়গায় আমি হতাম, তবে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে পরাজিত না করে মহলের নামও মুখে আনতাম না। যদি আমাকে আপনার পছন্দ হয়ে থাকে, তবে আমার মনোভাবও আপনার জানা দরকার। লুকিয়ে থাকা লোক আমি মোটেও পছন্দ করি না। যদি যোদ্ধার বেশে দুঃসাহসী সেনাপতির মত আপনি প্রকাশ্যে বের হয়ে নিজের সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করে সুলতান আইয়ুবীকে আক্রমণ করতে পারেন, কেবল তখনই আমি আপনার মহলে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারি।’
কৈশোরের চাপল্য এখনো কাটেনি মেয়েটির। যৌবনের ঘরে সবেমাত্র পা দিতে শুরু করেছে। এ বয়েসী মেয়েদের চেহারায় সারল্য যেমন তিরতির করে, বয়স্ক মেয়েদের মত পাকামীও অদ্ভুত সুন্দর লাগে। তার সে সারল্যভরা গাম্ভীর্যের মোহময় সৌন্দর্য সাইফুদ্দিনের অন্তরে এক ধরনের পুলক ও আকর্ষণ সৃষ্টি করছিল। সাইফুদ্দিন আগ্রহভরে দেখছিল ফুটনোন্মোখ এক পুষ্পের প্রস্ফুটন। মেয়েটির ঠোঁটে এমন হাসি ছিল, যার মধ্য ছিল কিছু দুষ্টুমি, কিছু অনুরাগ।
‘একদম রানীর মত কথা বলেছো তুমি। রাজার ঘর আলোকিত করার জন্য এমন মেয়েই তো চাই!’
‘আমি কোন শাহজাদী নই।’ মেয়েটি বললো, ‘এ পাহাড়ী উপত্যকায় জন্মগ্রহণ করেছি আমি। এখানেই লালিত-পালিত হয়ে বড় হয়েছি। আমি এক সৈনিকের কন্যা, আরেক সৈনিকের বোন। মহলে নয়, যদি যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা করেন তবে আপনার সাথে যেতে পারি। আপনি তখন আমার সাথে তলোয়ার যুদ্ধ খেলতে পারবেন, পাহাড়ের ওপর ছুটাছুটি করতে পারবেন, ঘোড়দৌড় খেলতে পারবেন। কি, যাবেন যুদ্ধে?’
‘বাহ! তুমি তো কেবল সুন্দরী নও, বীরাঙ্গনা যোদ্ধাও দেখছি! দেখো তো, পংখীরাজের ঘোড়ায় চড়ে আসা রাজপুত্তুর মনে হয় না আমাকে?’ সাইফুদ্দিন তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বললো, ‘কি রেশম কোমল চুল! এমন আকর্ষণীয় চুল আমি খুব কমই দেখেছি।’
মেয়েটি তার হাত আস্তে সরিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমার চুল নয়, আপনার প্রয়োজন এখন শক্ত বাহুর। বলুন, এখন আপনার কি ইচ্ছা?’
‘আমি কি আমার রানীর ইচ্ছা পায়ে ঠেলতে পারি! তবে ভয় কি জানো, তোমার বাবা অতি ভয়ংকর লোক! মনে হয় সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সমর্থক। আমাকে তেমন পছন্দ করে না। তোমার বাবা তো আমাকে আবার ধোঁকা দেবে না?’
মেয়েটি শিশুর মত হেসে বললো, ‘বাবা বুড়ো মানুষ, জানি না আপনার সাথে কি কথা বলেছে। আমার সামনে রাতে তো বাবা আপনার প্রশংসাই করলো। তিনি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শুধু নামই শুনেছেন, কোনদিন চোখেও দেখেননি। বাবার তার সমর্থক হতে যাবেন কেন? বাবাকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর তিনি তো বৃদ্ধ মানুষ, আপনার কিইবা ক্ষতি করতে পারবে। আপনার তো বাবাকে দরকার নেই। আমাকে পছন্দ হলে আমাকে বলবেন। আপনার সাথে বাবা যাবেন না, গেলে আমি যাবো।’
সাইফুদ্দিন তার দিকে হাত বাড়ালো। মেয়েটি খিলখিল করে হেসে দ্রুত পিছনে সরে গেল। বললো, ‘অ-মা, সবুরে মেওয়া ফলে তাও জানো না! আমি তো বলেছি, ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা টিকটিকি আমি একদম পছন্দ করি না। জানো না, বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা। আগে সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করো। তারপর…’
‘তারপর কি রানী!’
‘কচু!’ মেয়েটি ভেংচি কেটে বললো। তারপর দু’কদম সামনে এগিয়ে স্বর গম্ভীর করে বললো, ‘এখন আপনি বিপদগ্রস্থ। কেন বুঝেন না, এ সময় অন্য কোন চিন্তা মাথায় রাখা ঠিক নয়। এবার বলুন, আপনার ইচ্ছাটা কি? যুদ্ধের ব্যাপারে কি পরিকল্পনা করছেন?’
সাইফুদ্দিন ছিল চতুন নারী শিকারী। যুবতী ও সুন্দরী মেয়ে তার কাছে কোন নতুন ও বিরল জিনিস ছিল না। কিন্তু তিনি এ মেয়ের মধ্যে এমন আশ্চর্য সরলতা ও আন্তরিকতা লক্ষ্য করলেন যে, নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। সে ডাকলে যে কোন মেয়েই পোষা বিড়ালের মত কাছ চলে আসে। তার ইশারায় তারা হাসে, তার ইশারায় নাচে। কিন্তু এ কেমন অদ্ভুত ময়ে, ধরাও দেয় না, সরেও যায় না! অথচ এ মেয়ে এমন সাংঘাতিক, অবলীলায় তার পৌরুষে আঘাত করতেও ভয় পায় না। এক বাদশাহর সাথে কথা বলতে যে সম্ভ্রম ও সৌজন্য প্রকাশ করতে হয়, এ মেয়ে যেন তা জানেই না।
‘আচ্ছা তাই হবে।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘তুমি আমাকে পরীক্ষা করতে চাচ্ছো তো, আমি ওয়াদা করছি, যে পর্যন্ত আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর তলোয়ার কেড়ে নিতে না পারবো সে পর্যন্ত আমি তোমাকে স্পর্শও করবো না। তুমি অঙ্গীকার করো, তার ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে আমি যখন তোমার কাছে আসবো, তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে না?’
‘অঙ্গীকারের দরকার কি! আপনি আমাকে সঙ্গে করে নিয় চলুন, যুদ্ধের ময়দানেও আমি আপনার পাশে থাকবো।’ বললো মেয়েটি।
‘না!’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘আমি এখন আমার সৈন্যদের একত্রিত করবো। নতুনভাবে সেনাবাহিনী গড়ে তুলবো। আমি আমার সহকারীকে মোশেল পাঠিয়েছি। তাকে বলে দিয়েছি সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করতে। যত দ্রুত সম্ভব সৈন্যদের সংগঠিত করেই আমি সালাহউদ্দিনের ওপর আক্রমণ চালাবো। কিছুতেই তাকে আমি আমাদের শহরগুলো অবরোধ করার সুযোগ দেবো না। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই আমার পাঠানো দু’জন লোকই ফিরে আসবে। তারা এলেই জানতে পারবো, হলব ও হারানের সৈন্যরা কি অবস্থায় আছে। আমি পরাজয় মেনে নিয়ে পালিয়ে থাকার লোক নই। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, আমি আবার আক্রমণ চালাবো এবং তা অতিশীঘ্রই।’
সাইফুদ্দিন গাজী কি ধরনের লোক বুঝা হয়ে গেল মেয়েটির। লোকটি কেবল চরিত্রহীন নয়, ব্যক্তিত্বহীনও। যে লোক গ্রামের এক কিশোরী কন্যার কথার জালে আটকা পড়ে যুদ্ধের মত স্পর্শকাতর বিষয়ের গোপন কথা ফাঁস করে দিতে পারে, তার মত দুর্বল চরিত্রের লোকের কোন প্রয়োজন নেই দেশ ও জাতির। এ ধরনের লোকেরা লোভে পড়ে নিজের দেশ, এমনকি নিজের ঈমানটুকুও নিলামে বিক্রি করে দিতে পারে। মেয়েটি সাইফুদ্দিনের কথা শুনে এমন একটি ভাব করলো, যেন যুদ্ধ যাত্রার কথা শুনে সে খুব খুশী হয়েছে এবং এ ভাব প্রকাশ করার জন্যই সে তার কাছটিতে গিয়ে তার একটি হাত তুলে নিল নিজের হাতে, চকিতে সে হাতে একটি চুমু খেয়ে দ্রুত ছুটে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল।
সাইফুদ্দিনের যে দুই সঙ্গীর একজন মুশেল ও অন্য জন হলবে গিয়েছিল, তাদের কেউ তখনো ফিরে আসেনি। মেয়েটি কামরা থেকে বেরিয়ে সোজা তার বাবা, ভাই হারেস ও দাউদ যে রুমে বসেছিল, সেখানে চলে গেল। তাদের সে শোনাল সাইফুদ্দিনের পরিকল্পনার কথা। বললো, ‘তার পরিকল্পনা হলো, তিনটি বাহিনীকে একত্রিত করে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ওপর দ্রুত আক্রমণ করা, যাতে আইয়ুবী অগ্রসর হয়ে তাদের শহর ও এলাকা অধিকার ও অবরোধ করতে না পারে। যে দুই লোক চলে গেছে, তারা এসে বলবে, সৈন্যরা যুদ্ধের অবস্থায় আছে, কি নেই।’
এ মেয়েটির নাম ছিল ফৌজি। সে কেবল রূপসীই ছিল না, অসম্ভব চালাক এবং বুদ্ধিমতিও ছিল। দাউদ তাকে বললো, ‘তুমি খুব মূল্যবান খবর এনেছো! ট্রেনিং ছাড়াই তুমি এসব খবর কেমন করে তার পেট থেকে বের করলে?’
‘রাতে আপনি বলেছিলেন, সাইফুদ্দিনের পরবর্তী পরিকল্পনা কি তা জানা আপনার খুবই দরকার। তাই একটু চেষ্টা করে দেখলাম।’
‘খুবই ভাল করেছো। আমি তোমাকে কি করে গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে হয় শিখিয়ে দেবো।’
দাউদ ফৌজিকে গোয়েন্দা হিসাবে কাজকর্ম করার জন্য প্রাথমিক কিছু নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিল। তারপর বললো, ‘সাইফুদ্দিন দুশ্চরিত্র ও আরামপ্রিয় লোক। তার প্রতারণার জাল থেকে সাবধান থাকবে।’
ফৌজি এ দায়িত্ব খুশী মনে গ্রহণ করলো। সে যেভাবে সাইফুদ্দিনের কাছ থেকে কথা বের করে নিয়েছিল, তাতে দাউদ বুঝতে পেরেছিল, এ মেয়ে সাইফুদ্দিনকে ঠিকই ঘায়েল করতে পারবে।
গভীর রাত। হঠাৎ কোন আওয়াজে বৃদ্ধের ঘুম ভেংগে গেল। ঘুম ভাঙতেই মনে হলো কেউ দরজায় করাঘাত করছে। বৃদ্ধ বিছানায় উঠে বসলো। এ সময় কানে এলো ঘোড়ায় হ্রেষা ধ্বনি। দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুললো বৃদ্ধ। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সাইফুদ্দিনের সহকারী সেনাপতি। বৃদ্ধ তার ঘোড়া নিয়ে বাড়ীর পেছনে বেঁধে রাখলো। কামরায় এলে সাইফুদ্দিন তাকে বললো, ‘তুমি গিয়ে শুয়ে থাকো।’
বৃদ্ধ আদবের সাথে সালাম করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। ভেতরের কামরায় গিয়ে ডেকে তুললো দাউদকে। ফিসফিস করে বললো, ‘সহকারী সেনাপতি ফিরে এসেছে!’ তারা উভয়েই দরজায় কান লাগিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগলো।
‘গুমাস্তগীন সম্পর্কে জানতে পারলাম, তিনি আল মালেকুস সালেহের সাথে হলবে আছেন।’ সহকারী সেনাপতি বললো, ‘মুশেলের অবস্থা তেমন খারাপ নয়। আমাদের যে সৈন্যরা ওখানে আছে তাদের যখন ইচ্ছা ময়দানে নিয়ে নেয়া যাবে। আমাদের অর্ধেকের বেশী সৈন্য ফিরে আসতে পেরেছে। অবশিষ্ট সৈন্যদের কিছু নিহত হয়েছে, অধিকাংশই বন্দী হয়েছে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী অগ্রাভিযান বন্ধ করে দিয়ে তুর্কমানে ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছেন। খৃস্টান গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, তারা আল-জাজায়ের, বাকার, দাইয়ার ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে লোকদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করছে। মনে হয়, আইয়ুবী সহসা কোন অভিযানের চিন্তা করছে না। হয়তো সে অবস্থাও তার নেই।’
সাইফুদ্দিন বললো, ‘তুমি আইয়ুবীকে চেনো না। সে অবশ্যই অভিযান চালাবে! আর তার সে অভিযানের গতি হবে ঝড়ের মত দ্রুত!’
‘কিন্তু তাদের ক্যাম্পের অবস্থা বলছে, তারা সেখানে দীর্ঘদিন থাকবে। আমি খবর পেয়েছি আমাদের বহু সৈন্য তাদের হাতে বন্দী হওয়ায় তারা ভাবছে, আমরা যুদ্ধ করার অবস্থায় নেই, আমরা শেষ হয়ে গেছি। উঠে দাঁড়াতে হলে আমাদের অনেকদিন লাগবে।’
‘তাহলে আমরা যদি এক কাজ করি, আমাদের হাতে যে সৈন্য আছে তা নিয়ে এখনি সুলতান সালাহউদ্দিনের ওপর আক্রমণ করে বসি, তাহলে কেমন হয়?’ সাইফুদ্দিন তাকে প্রশ্ন করলো, ‘অযাচিত হামলার শিকার হলে ওরা নির্ঘাত ধরা খাবে। মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়ার আগেই আমরা ওদের তছনছ ও নাস্তানাবুদ করে দিতে পারবো!’
‘শুধু আমাদের সৈন্য এ আক্রমণের জন্য যথেষ্ট নয়।’ সহকারী সেনাপতি উত্তরে বললো, ‘আল মালেকুস সালেহ ও গুমাস্তগীনকেও সঙ্গে নেয়া প্রয়োজন। খৃস্টান উপদেষ্টারা আমাকে এ পরামর্শই দিয়েছে।‘
‘তুমি কি তাদের বলে দিয়েছো, আমি কোথায়?’ সাইফুদ্দিন জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি এখানকার ঠিকানা বলিনি!’ সহকারী সেনাপতি উত্তর দিলো, ‘আমি তাদের বলেছি, আপনি তুর্কমানের আশে পাশেই ঘোরাফেরা করছেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গতিবিধি লক্ষ্য করে পাল্টা হামলার চেষ্টা করছেন। আমার মনে হয়, এখানে বেশী দিন থাকা আপনার ঠিক হবে না। তিন-চার দিনের মধ্যেই আপনার মুশেল চলে যাওয়া উচিৎ।’
‘আগে আমাকে হলবের সংবাদ জানতে দাও!’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘কমান্ডার আজ না এলেও আগামীকালের মধ্যেই ফিরে আসবে। তুমি জানো, গুমাস্তগীন শয়তান প্রকৃতির লোক! তার তো নিজের দূর্গ হারানে চলে যাওয়া উচিৎ ছিল। সেখানে না গিয়ে হলবে বসে কি করছে গুমাস্তগীন? শোন, আমি মুশেল যাওয়ার আগে হলবে যাবো। গুমাস্তগীন আমাদের ঐক্যজোটের শরীক হলেও তাকে আমি বন্ধু বলতে পারি না। সে ওখানে কি করছে দেখতে হবে আমাকে। তাছাড়া আল মালেকুস সালেহের সাথেও সামনের লড়াই সম্পর্কে একটা বোঝাপড়া করতে হবে। আমরা আক্রমণ করতে যত দেরী করবো ততই সুলতান আইয়ুবীর লাভ। আমরা এ সুযোগ তাকে দিতে পারি না, এ বিষয়টিও সালেহকে বুঝাতে হবে। নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই, যা করার জলদি করতে হবে।’
‘হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে, এবার আর তিন বাহিনীকে আলাদা রাখা যাবে না। তিনটি বাহিনীই একটি একক কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করবে। আর সম্মিলিত বাহিনীর হাইকমান্ড থাকবে যোগ্য সেনাপতির হাতে।’
‘তুমি ঠিকই বলেছো। আমরা শুধু এ কারণেই পরাজিত হয়েছি, আমাদের সৈন্যরা পৃথক পৃথক কমান্ডে লড়াই করেছিল। আমরা একে অন্যের যুদ্ধের চাল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। নইলে মুজাফফরুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর পাশ থেকে যে প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়েছিল, তার কখনো ব্যর্থ হওয়ার কথা ছিল না।’
‘আমার আরেকটি কথা, কেন্দ্রীয় কমান্ড আপনার হাতেই থাকতে হবে।’ সহকারী সেনাপতি বললো।
‘এবং আমাদের বন্ধুদের দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।’ হেসে বললো সাইফুদ্দিন, ‘খৃস্টানরা কি আমাদের ঠিক মত সাহায্য দিবে?’
‘তারা তো আর সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবে না।’ সহকারী সেনাপতি বললো, ‘উট, ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র এসব সরবরাহ করবে।’
সহকারী সেনাপতি কথার মোড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
‘না!’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘বৃদ্ধকে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হচ্ছে। তার মেয়েটাও জালে আটকা পড়ে গেছে। মেয়েটা বড় আবেগী আর স্ফূর্তিবাজ। সে আমাকে বলে কি জানো, আগে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে পরাজিত করেন, তার তলোয়ার কেড়ে নিয়ে তার অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বিজয়ীর বেশে আসুন, আমি আপনার সাথে যাবো।’
সহকারী সেনাপতি হো হো করে হেসে উঠলো। হারেস, তার বাবা এবং দাউদ দরজায় কান লাগিয়ে ওদের সব কথাই শুনছিল। সাইফুদ্দিন ও তার সহকারী জানতেও পারেনি, এ বাড়ীতে বৃদ্ধ এবং দু’টি মেয়ে মানুষ ছাড়া আরো দু’জন নওজোয়ান আছে, যারা যে কোন সময় তাদের হত্যা করতে পারে। সাইফুদ্দিনের দুর্ভাগ্য, ফৌজিকে জালে জড়ানোর পরিবর্তে নিজেই যে এক কঠিন জালে আটকা পড়ে আছে, এ কথাটাও জানতো না সাইফুদ্দিন, এমনকি এরকম কোন সন্দেহও তার মনে জাগেনি কখনো।