সে এগারো বারো বছর আগের কথা! খলিল তখন সতেরো আঠারো বছরের নওজোয়ান। খলিলের মন থেকে প্রায় মুছেই গিয়েছিল সেই স্মৃতি। হঠাৎ করে এত বছর পর সেই স্মৃতির কথা মনে হতেই বিষন্নতায় ছেয়ে গেল তার মন।
তখন সে দামেশক থেকে কিছু দূরে একটি গ্রামে বাস করতো। বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করতো মাঠে গিয়ে। দেখতে সে খুবই সুন্দর ছিল, বয়সটাও ছিল কাঁচা হলুদের মত। নবীন যুবকের সজীবতা ছিল তার মুখমন্ডলে।
সে ছিল খুব হাসি খুশী ও প্রাণবন্ত। রসিকতা পছন্দ করতো। কথাবার্তায় চটপটে ও সর্বদা প্রফুল্ল হৃদয় থাকায় গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই তাকে খুব ভালবাসতো।
সে সময় বিভিন্ন অঞ্চলে খৃস্টানদের আধিপত্য ছিল। ফলে মুসলমানদের ওপর জোর-জুলুম ও নির্যাতন চলতেই থাকতো। এই নির্যাতনের শিকার হয়ে সেখান থেকে হিযরত করে মুসলমান শাসিত অঞ্চলে চলে যেত লোকজন। এই হিজরতের সময় স্থানীয় লোকেরা তাদেরকে পূর্ণ সহযোগিতা করতো। যেখানে হিজরত করতো সেখানকার লোকেরা সাধ্যমত তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিত।
এমনি একটি পরিবার কোথাও থেকে হিজরত করে খলিলদের গ্রামে এলো। সেই পরিবারে হুমায়রা নামে একটি এগারো বছরের বালিকা ছিল। সেই কিশোরীর চাপল্যভরা কমনীয় চেহারা খোদাই হয়ে গিয়েছিল নবীন যুবক খলিলের মনে।
গ্রামবাসীরা সে পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিল। তাদের চাষাবাদের জন্য ও আসবাবপত্রের ব্যবস্থাও করে দিল। হুমায়রার ভাই বোন ছিল ছোট। কাজ করা ও সংসার চালানোর দায়িত্ব পুরোপুরি তার বাবার উপরেই ছিল।
খলিল তার সংসারের কাজে সহযোগিতা করতে শুরু করলো। হুমায়রা ও খলিল কাজের ফাঁকে মেতে থাকতো হাসি- তামাশায়। খলিলের চটপটে কথা, উজ্জ্বল হাসি, মায়াভরা চাউনি সবই খুব ভাল লাগতো হুমায়রার। খলিলেরও মেয়েটাকে ভাল লাগতো।
মেয়েটি খলিলদের বাড়ি আসা যাওয়া করতো। বাড়িতে হোক অথবা ক্ষেতে খামারে হোক, সময় পেলেই হুমায়রা তার কাছে গল্প শোনার জন্য ছুটে আসতো। খলিলও সুন্দর সুন্দর গল্প বানিয়ে রাখতো তাকে শোনানোর জন্য।
দু’চার মাস পর হুমায়রার বাবার কি যে হলো, ক্ষেত-খামারের কাজে অমনোযোগী হয়ে উঠলেন। দামেশক শহর কাছেই ছিল। সে সকালে শহরে চলে যেত আর সন্ধ্যায় ফিরে আসতো শহর থেকে।
এক বছর পর সে কৃষি কাজ পুরোপুরিই ছেড়ে দিল। কেউ জানতো না, সে উপার্জনের কি পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, দিন দিন তাঁর আর্থিক অবস্থার বেশ উন্নতি হচ্ছে।
হুমায়রা ও খলিলের মধ্যে আন্তরিকতা গভীর হয়ে গেল। সে ক্ষেত-খামারের কাজে মাঠে যেত, হুমায়রাও চলে যেত সেখানে। যদি বাড়িতে থাকতো, তবে সে চলে আসতো খলিলদের বাড়িতে।
এখন সে তেরো বছরের তরুণী। নিজের ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় একটু একটু বুঝতে শিখেছে। খলিল একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার বাবা কি কাজ করেন?’
হুমায়রা বললো, ‘বাবা কি কাজ করেন, কোত্থেকে আয় করেন, সে সব কিছুই আমি জানিনা। বাবা তো ঘুম থেকে উঠেই শহরে চলে যান, ফিরে সেই রাত করে।’
‘তোমার বাবা প্রায়ই শহর থেকে নেশা করে বাড়িতে আসেন, এটা আমার ভাল লাগে না।’
হুমায়রা লজ্জিত হয়ে বললো, ‘আসলে তোমাকে কখনো বলা হয় নি, এ লোক আমার বাবা নন! আমার মা ও বাবা যখন মারা যান তখন আমি পাঁচ ছয় বছরের শিশু। এ লোক আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন।
তিনি আমাকে আপন কন্যার মত স্নেহ-যত্ন করতে লাগলেন দেখে আমি তাকে বাবা বলে ডাকতে লাগলাম। আমি তোমার সাথে একমত, এ লোক কোন ভাল মানুষ নয়।’
দেড় দুই বছর কেটে গেল। । হুমায়রা ও খলিলের কৈশোরের খেলা এখন ভালবাসায় রুপ নিয়েছে। যৌবনের রঙ লেগেছে দুই তরুণ-তরুণীর মনে। হুমায়রার সারা অঙ্গে এখন মুগ্ধতার আমেজ। চেহারা টুইটুম্বুর বর্ষার নদী। নয়নে শিকারীর সুতীক্ষ্ণ বান। কণ্ঠে দূরাগত ঝর্নার গান।
একদিন সে পেরেশান প্রাণে ছুটে গেল খলিলের কাছে। মনে হলো আচমকা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে গিয়েছিল। উদ্বেগ ও উত্তেজনায় হাপড়ের মত উঠানামা করছে তার বুক। একটু দম নিয়ে সে খলিলকে বললো, ‘বাবা আমাকে বিয়ের কথা বলে এক আগন্তুকের কাছে বিক্রি করে দিতে চায়! আমাকে বাঁচাও খলিল!’
‘কি বলছো তুমি!’ খলিল যেন আকাশ থেকে পড়ল।
‘হ্যাঁ, বাবার সঙ্গে একটি লোক এসেছে। বাবা তাকে অনেক আদর আপ্যায়ন করলেন এবং অনেকক্ষণ পরে সেখানে আমাকে ডেকে নিয়ে দেখালেন। আগন্তুক দীর্ঘ সময় ধরে গভীরভাবে আমাকে দেখলো।’ হুমায়রা বলতে থাকলো, ‘আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসব কি হচ্ছে! কেন ডাকা হয়েছে আমাকে?’
বাবা আমতা আমতা করতে লাগলো। কোন সদুত্তর পেলাম না বাবার কাছ থেকে।’
হুমায়রা কথা শেষ করলো না, খলিলের হাত জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না, এই বিপদের হাত থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও।’
খলিল তাকে বললো, ‘আমি এ নিয়ে আজই আমার বাবা মায়ের সঙ্গে আলোচনা করবো। তুমি কোন চিন্তা করো না, আম্মা তোমাকে খুবই পছন্দ করেন। বাবাকে তিনি নিশ্চয়ই রাজি করাতে পারবেন। তারা কেউ বিয়েতে অমত না করলে শীঘ্রই তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাকাপোক্ত করে নেবো।’
হুমায়রা যাকে বাবা বলে ডাকতো, সে তার আসল বাবা ছিল না। ফলে হুমায়রার ভবিষ্যত নিয়ে তার কোন উদ্বেগ বা চিন্তাই ছিল না। তাছাড়া সে যুগে এমনিতেই মেয়েদের কোন মর্যাদা ছিল না। অনেক টাকার বিনিময়ে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার প্রচলন সে যুগে সবখানেই ছিল।
আমীর ও ধনী ব্যক্তিরা রঙমহল বানিয়ে রেখেছিল আমোদ স্ফূর্তির জন্য। নতুন নতুন সুন্দরী মেয়েদের ক্রয় করে সেখানে তাদের সাজিয়ে রাখতো ওরা। যদি হুমায়রার বাবা তাকে বিক্রি করে দেয় তাতে সামাজিকভাবে অপরাধি সাব্যস্ত করা হবে না বা এতে কেউ আশ্চর্যও হবে না।
খলিল ধনী বাবা মায়ের আদরের দুলাল ছিল না যে, তার বাপ সন্তানের যে কোন আবদার মেনে নেবেন। খলিলের মত ছেলের জন্য তিনি যেখানে ধনীর দুলালী এবং যৌতুক দু’টোই সংগ্রহ করতে পারবেন, সেখানে এ বিয়ে তিনি মেনে না-ও নিতে পারেন।
তা ছাড়া হুমায়রার পিতা তার আসল বাবা নয় জানলে খলিলের বাবা এ বিয়েতে অসম্মতি জানাতে পারেন। তাহলে কি হবে? দারুন চিন্তায় পড়ে গেল খলিল। হুমায়রার সাথে তার সম্পর্ক এখন এতটা নিবিড়, ইচ্ছে করলেই একজন আরেকজন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না।
হুমায়রাকে পাঠিয়ে দিয়ে এসবই ভাবছিল খলিল। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, যদি বাবা এ বিয়েতে রাজি না হন তাহলে হুমায়রাকে নিয়ে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো।
পালিয়ে গেলে কোথায় আত্মগোপন করা যায় তাই নিয়ে এবার চিন্তা করতে লাগলো খলিল। এ চিন্তা করতে করতে দীর্ঘ সময় পার করে দিল সে।
তিন দিনের দিন ঘটলো সে অনাকাঙ্ক্ষিত করুণ ঘটনা। হুমায়রা খলিলকে ডাকতে ডাকতে পাগলের মত ছুটে এল সে যে মাঠে কজ করছিল, সেখানে। খলিল তাকিয়ে দেখলো, তিন জন লোক তার পিছন পিছন দৌড়ে আসছে। এদের একজন হুমায়রার বাব, অন্য দু’জনকে সে চিনতে পারলো না।
একটু পর গ্রামের বহুলোক জড়ো হয়ে গেল। এরা সবাই শুধু তামাশা দেখতে এসেছে। বাস্তবে তাদের করার কিছু ছিল না। কেউ হুমায়রার সাহায্যে এগিয়ে যেতে পারলো না, কারণ তাঁর পিছনে হুমায়রার বাবাও আছে। এ ক্ষেত্রে বাবার ওপর দিয়ে কারো কথা বলা সাজে না।
হুমায়রা খলিলের পিছনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো, ‘এ দু’জন লোক আমাকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। তারা বলছে, বাবা নাকি তাদের কাছে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। আমি এ বিক্রয় মানি না, বাবাকে বলো ওদের টাকা ফিরিয়ে দিতে। এই অচেনা লোকদের চলে যেতে বলো, আমি যাবো না ওদের সাথে।’
হুমায়রার বাবা খলিলের পিছন থেকে হুমায়রাকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করলো। খলিল তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘সাবধান! এর গায়ে হাত লাগানোর আগে প্রথমে আমার সাথে কথা বলো।’
‘ও আমার মেয়ে!’ বাবা বললো, ‘তুমি বাঁধা দেয়ার কে?’
‘এ তোমার মেয়ে নয়।’ খলিল জোর দিয়ে বললো।
উপস্থিত লোকজন সব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।
লোক দু’জন হুমায়রাকে ধরার জন্য তার দিকে এগিয়ে এলো। হুমায়রা লুকিয়ে ছিল খলিলের পিছনে, একজন তলোয়ার বের করে আক্রমণ করলো খলিলকে। খলিলের হাতে ছিল কোদাল, সে কোদাল ফিয়ে আঘাত ঠেকিয়ে পাল্টা আঘাত করলো হামলাকারীর ওপর।
লোকটা এতটা আশা করে নি, সে কিছু বুঝে উঠার আহেই কোদালের আঘাত তার মাথায় গিয়ে পড়লো। হাত থেকে ছিটকে পড়লো তলোয়ার।
অন্য লোকটিও তলোয়ার বের করে আঘাত করতে গেল খলিলকে। খলিল দ্রুত প্রথম আক্রমণকারির তলোয়ারটি উঠিয়ে নিল।
তলোয়ার চালানোর অভ্যাস ছিল না তার, তবুও সে হামলাকারীর আঘাত থামিয়ে দিল। লোকটি তলোয়ার চালনায় পটু ছিল, খলিল আঘাত করার পরিবর্তে আঘাত প্রতিহত করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু তলোয়ার যুদ্ধেরও বেশীক্ষণ সুযোগ পেল না সে, কোন ভারী জিনিস এসে তার মাথায় আঘাত করলো।
চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল তার। সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ে গেল। যখন তার জ্ঞান ফিরলো, তখন সে বাড়িতে বিছানায় শুয়ে ছিল।
সে আবেগে ও রাগে উঠে বসলো। কিন্তু তার বাব ও দু’তিন জন লোক তাকে চেপে ধরলো। বললো, ‘বিশ্রাম নাও বাবা, অনেক্ষণ পর তোমার হুঁশ ফিরেছে। যা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে আমাদের।’
‘হুমায়রা কোথায়?’ ব্যাকুল কন্ঠে প্রশ্ন করলো সে।
‘ওকে ওর বাব সে লোক দুটোর হাতে তুলে দিয়েছে। ওরা মেয়েটিকে নিয়ে অনেক আগেই গ্রাম থেকে চলে গিয়েছে।’
খলিল ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘একটি মেয়েকে এভাবে বিক্রি করতে দিলে তোমরা?’
তাকে বলা হলো, ‘বিয়ে পড়িয়েই বিদায় দেয়া হয়েছে তাকে।’
খলিলের অবস্থা এমন ছিল যে, সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে করে কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তার মাথায় ভীষণ আঘাত লেগেছিল।
মুরব্বিগণ উপদেশ দিলেন, ‘হুমায়রার ব্যাপারে তোমার কথা বলে জায়েজ নয়। কারণ যদি বিক্রিও করে থাকে, তবুও নিয়মানুসারে বিয়ে কবুল পড়ানোর পরই তাকে ওদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।’
সুতরাং খলিলের জন্য ব্যাপারটি মারাত্মক দুর্ঘটনা হয়ে রইলো।
খলিল একটু সুস্থ্য হয়ে হুমায়রাদের বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেল বাড়িতে কেউ নেই। মেয়েকে লোকগুলোর হাতে তুলে দেয়ার পরদিনই তার বাবা পরিবার পরিজন নিয়ে চিরদিনের জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।
❀ ❀ ❀
আলী বিন সুফিয়ান তার বাহিনীকে কেবল সামরিক প্রশিক্ষণই দিতেন না, তাদের নৈতিক ও ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী করে তোলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতেন। ফলে তার বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের অন্তরে ইসলামী জোশ ও জযবা থাকতো অটুট।
খলিল এই বাহিনীতে শামিল হওয়ার পর জীবন ও জিন্দেগীর যে অর্থ ও স্বাদ খুঁজে পেয়েছিল তাতে হুমায়রার কথা সে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল। কারণ কাউকে মনে রাখার মত সময় ও অবসর কোথায় তার! কিন্তু এই নতুন নর্তকী তার মনে নতুন করে হুমায়রার স্মৃতি জাগিয়ে দিল।
হুমায়রার সাথে তার দেখা নেই সাত-আট বছর। সে সময় হুমায়রা ছিল নবীন যুবতী। বয়স মাত্র পনেরো-ষোল। এই নতুন নর্তকী ভরা যৌবনের, বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে। হুমায়রার মত সুন্দরী হলেও তার চেহারায় সেই সরলতা ও নির্মলতার ছাপ নেই। নেই সে শালীনতা ও লজ্জার ভূষণ।
এই উলঙ্গপ্রায় নর্তকী কি করে সেই হুমায়রা হবে? খলিলের মনে এ প্রশ্ন যেমন দানা বাঁধল, তেমনি তার চেহারা, চোখের চাউনি এবং আর কিছু মুদ্রা তাকে বলতে লাগলো, ‘এই সে হুমায়রা। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এক সঙ্গকটময় আবর্তে পড়ে গেল খলিল।
নর্তকী তৃতীয় দিনের মত যখন তাদের সামনে এসে খলিলের সিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো তখন খলিলও দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘তোমার নাম নাম কি?’ নর্তকী জিজ্ঞেস করলো।
খলিল তার আসল নাম গোপন করে যে নামে সে এখানে ভর্তি হয়েছে সে নাম বললো। আর বললো, ‘আপনি আমার নাম কেন জিজ্ঞেস করেছেন?’
‘ঘুরে ফিরে তোমাকেই বেশী ডিউটিতে দেখি, তাই তোমার নাম জিজ্ঞেস করে রাখলাম, যদি কখনো দরকার পড়ে।’ নর্তকী এমন ভঙ্গি ও ভাষায় কথা বললো যেমন ভদ্র মহিলারা বলে থাকে! তার কথায় তেমন কোন সংকেত বা আবেদন ছিল না, তেমনি ছিল না কোন সংকোচ বা আড়ষ্ঠতা। সে আরো বললো, ‘নিজের কাজের দিকে ঠিকমত খেয়াল রেখো।’
মেয়েটির এ কথায় খলিলের আত্মসম্মানে আঘাত লাগলো বটে, তবে সে খুশী হলো এই ভেবে, ‘যাক বাব, এ মেয়ে হুমায়রা নয়। হুমায়রা তো সাধাসিধা এক সরল মেয়ে।’
সেদিন সন্ধ্যা হলে ভোজসভায় আয়োজন চলছে। রিমান্ডের গোয়েন্দা কমান্ডার উইগুসারের সম্মানে আজকের এ ভোজসভা। খলিল বুঝে গিয়েছিল, এ লোক বড় ধুরন্ধর। গোয়েন্দা কাজে খুবই দক্ষ। নিশ্চয়ই সে এখানকার ফাঁকফোঁকরগুলো খুঁজে পেতে চেষ্টা করবে। নতুন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করার জন্য সে কি কি পদক্ষেপ নেয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগলো খলিল।
সন্ধ্যার অন্ধকার গভীর হয়ে এলো। হলরুমে মেহমানদের আগমন শুরু হয়ে গেছে। ডিউটিতে এলো খলিল ও তার বন্ধু। একটু পর খাবার পরিবেশন শুরু হবে, সেই সাথে চলবে শরাব পরিবেশন ও নাচ। লোকজন তারই অপেক্ষায়।
এখনও উইগুসার আসেনি। লোকজন এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে-বসে গল্পগুজব করছিল। খলিল ও তার সঙ্গী দাঁড়িয়েছিল হলের দরজায়।
কিছুক্ষণ পরই উইগুসারকে আসতে দেখলো খলিল। সে প্রহরী দু’জনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। গভীরভাবে দেখলো ওদের। শেষে খলিলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তুমি খলিফার রক্ষী হিসেবে কতদিন হলো এসেছ?’
‘এখানে আসার পরই আমাকে রক্ষী দলে নেয়া হয়েছে।’ খলিল উত্তর দিল, ‘তার আগে আমি দামেশকের সেনাবাহিনীতে ছিলাম।’
‘তুমি মিশরও গিয়েছিলে?’ উইগুসার প্রশ্ন করলো।
‘না।’
উইগুসার পাশের প্রহরীকে খলিলের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি একে কতদিন থেকে জানো, চেনো?’
‘আমরা দু’জন দামেশকের সেনাবাহিনীতে এক সাথেই ছিলাম।’ অন্য প্রহরী বললো, ‘আমরা একে ওপরকে খুব ভালমতই চিনি।’
‘আমি সম্ভবত, তোমাদের দুজনকেই ভালমত জানি।’ উইগুসার একটু হেসে বললো, ‘আমার সঙ্গে একটু এসো।’
সে ওদেরকে ডিউটি থেকে সরিয়ে তার সঙ্গে নিয়ে গেল। উইগুসার ঘাগু গোয়েন্দা। এখানে এসেই সে প্রতিটি দেহরক্ষী সম্পর্কে তত্ত্ব-তালাশ নিতে শুরু করেছিল। খলিলকে দেখেই তার মনে খটকা লেগেছিল। যখন তার সাথীকে দেখলো তখন তার সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। আর সন্দেহটা ভুলও ছিল না।
খলিল ও তার সাথী তিন চার বছর হলো গোয়েন্দা বিভাগে আছে। তারা দু’জনেই বরাবর একসাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। ফলে তাদের বন্ধুত্ব দিনে দিনে গাঢ় ও অটুট হয়েছে।
উইগুসার তাদেরকে নিজের কামরায় নিয়ে গেল। হলরুম থেকে একটু দূরে আরেকটি প্রাসাদে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল তার।
সে কামরায় মশালের আলোয় ওদের মুখোমুখি বসে উইগুসার বললো, ‘যদি তোমরা আমাকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করো যে, তোমরা এখানে খুব বিশ্বস্ত আর সালহউদ্দিন আইয়ুবীকে তোমরা শত্রু ভাবো, তবুও তোমাদেরকে আমি ছেড়ে দেবো না, বরং এমন কাজে লাগিয়ে দেবো যেখানে তোমরা আরামেই থাকবে।’ উইগুসার বললো, ‘তাই বলছি, মিথ্যে বলবে না। মিথ্যে বললে শেষে পস্তাতে হবে তোমাদের।’
‘আমরা খলিফার অনুগত!’ খলিল বললো।
‘তোমাদের আনুগত্য কবে বদল করেছো?’ উইগুসার বললো, ‘আর কেন করেছো?’
‘খোদা ও তার রাসূলের পরই খলিফার স্থান!’ খলিল বললো, ‘এখানে সালহউদ্দিন আইয়ুবীর কোন স্থান নেই।’
‘মিশর থেকে কবে এসেছো?’ উইগুসার জিজ্ঞেস করে বললো উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললো, ‘তোমরা মনে হয় আমাকে চিনতে পারোনি। আমিও তোমাদের মত গোয়েন্দা। তোমার নাম হয়ত ভুলে গেছি কিন্তু চেহারা তো আর ভুলিনি। আলী বিন সুফিয়ান এখন কোথায়? মিশরে, না দামেশকে?’
‘আমি তার কিছুই জানি না।’ খলিলের সাথী বললো, ‘আমরা সাধারণ সিপাই মাত্র।’
উইগুসার দরজার কাছে গিয়ে তার চাকরকে ডাকলো। চাকর এলে একটি মেয়ের নাম বললো, ‘ওকে ডেকে দাও।’
মেয়েটি কাছের কোন কামরায় ছিল। একটু পর সে এসে প্রবেশ করলো কামরায়, সাথে সেই নর্তকী, খলিল যাকে আগেই দেখেছে, কথাও বলেছে, যাকে দেখে খলিলের মনে হুমায়রার কথা জেগে উঠেছিল।
উইগুসার খৃস্টান মেয়েটির সাথে আরবী ভাষায় কথা বললো। হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই নাচনেওয়ালীকে আবার সঙ্গে আনলে কেন?’
মেয়েটি উত্তরে বললো, ‘ও আমার কামরাতেই ছিল। আপনি যখন ডাকলেন, ভাবলাম দাওয়াত খেতে যাচ্ছেন, ও রেডি হয়েই এসেছিল, তাই সাথেই নিয়ে এলাম।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কোন অসুবিধা নেই।’ উইগুসার বললো, ‘ভালোই হলো, এসেছে যখন তামাশা দেখেই যাক।’
সে খৃস্টান মেয়েটিকে বললো, ‘দাওয়াত খাওয়ার জন্য নয়, অন্য কাজে ডেকেছি তোমাকে।’
প্রহরী দু’জনের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, ‘এ দু’জনের চেহারা দিকে একটু ভাল করে দেখো ত। হয়তো তোমার মনে কিছু স্মরণ হতে পারে।’
মেয়েটি তাকালো ওদের দিকে। গভীরভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপালে চিন্তার রেখা টেনে বললো, ‘কই, কিছু মনে পড়ছে নাতো।’
‘আরে ভাল করে দেখো, নিশ্চয়ই মনে পড়বে।’
ও আবার দেখলো, আর তখনই তার মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে খলিল ও তার সাথীকে জিজ্ঞেস করে বললো, ‘তোমাদের জ্ঞান ফিরেছিল কখন?’
দু’জন একে অপরের দিকে তাকালো, তারপরে তাকালো মেয়েটার দিকে। খলিলের উপস্থিত বুদ্ধি ছিল প্রখর। সে বুঝতে পারলো, ওরা ঠিকই তাদের চিনে ফেলেছে। সে বাঁচার পথ চিন্তা করতে লাগলো।
তখন শুরু হলো তার বুদ্ধির খেলা, সে ছেলেমানুষী করে করে বললো, ‘আমি বুঝতে পারছি না, আপনি আমাদের ডিউটি থেকে সরিয়ে এনে কেন এমন ঠাট্টা মজাক করছেন। আমরা ডিউটিতে নেই জানতে পারলে কিন্তু কঠিন শাস্তি দেবে আমাদের।’
‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল।’ উইগুসার বললো, ‘তোমাদের দু’জনকে সেখানে দাঁড় করানোর পরিবর্তে ও জায়গা খালি থাকাই ভাল। তোমরা যে আসলে প্রহরো নও, আমার চেয়ে তোমরাই তা ভাল জানো।’
সে খলিলের কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘এখানে আসার আগে তোমার চেহারাটা একটু পাল্টানোর দরকার ছিল। সুলতান আইয়ুবী ও আলী বিন সুফিয়ান গোয়েন্দাগিরিতে উস্তাদ, কিন্তু আমিও আনাড়ি নই। তোমরা নিজেকে বিপদে ফেলো না, বরং স্বীকার করো, তোমরা মিশর থেকে গোয়েন্দাগিরি করার জন্যই এখানে এসেছো।
তোমাদের সাথে আমার ও এ খৃস্টান মেয়েটির সাক্ষাৎ হয়েছিল মিশরে। তুমি আমাকে চিনতে পারোনি, কারণ তখন আমি ছদ্মবেশে ছিলাম। আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি, কারণ তুমি আজও সেই বেশে আছ, যেমন সেদিন ছিলে। মনে করতে চেষ্টা করো, অবশ্যই তোমারও স্মরণ হবে সে কথা।’
সামান্য বিরতি দিল উইগুসার। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, ‘মনে করতে চেষ্টা করো, মিশরের উত্তরে একটি কাফেলা এগিয়ে যাচ্ছিল, তোমার মনে সন্দেহ জাগলো কাফেলা সম্পর্কে। তুমি এবং তোমার বন্ধুও যাত্রা করলো উত্তরে। রাতে এসে মিলিত হলে আমাদের সাথে। একসাথে রাত কাটালে। কিন্তু তোমাদের দুর্ভাগ্য, ভোরে যখন চোখ খুললে, তখন তোমরা মরুভূমিতে একাকী পড়েছিলে। যে কাফেলাটিকে তুমি সন্দেহ করেছিলে, তারা তখন তোমাদের ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে, দূরে, বহুদূরে চলে গেছে।
উইগুসার তাকে স্মরণ করিয়ে দিল পুরনো দিনের স্মৃতি। খলিল ও তার এই বন্ধু তখন টহল ডিউটিতে ছিল। সে আজ থেকে আড়াই তিন বছর আগের কথা। সুদানীদের পরাজিত করার পর খৃস্টানদের সহযোগিতায় তারা মিশর আক্রমণের পায়তারা করছিল। মিশরে খৃস্টান গোয়েন্দাদের তৎপরতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম খুব বেড়ে গিয়েছিল।
তাদের অনুসন্ধানে আলী বিন সুফিয়ান গোয়েন্দা বিভাগকে বিশেষভাবে তৎপর করে তোলেন। সীমান্ত এলাকায় টহলদার বাহিনীকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দিলেন সীমান্তের গোয়েন্দারা মুসাফিরের বেশে সে এলাকায় ঘোরাফেরা করতে থাকে।
একবার খলিল তার এই সাথীর সঙ্গে মিশরের উত্তরে এমনি এক টহল ডিউটিতে ব্যস্ত ছিল। দু’জনই পথ চলছিল উটের ওপর বসে। মরু মুসাফিরের সাধারণ পোশাক পরণে ওদের। তারা কয়েকটি কাফেলাকে যেতে দেখলো। তাদের সঙ্গে বহু উট ও কয়েকটি ঘোড়া। কাফেলার মধ্যে বৃদ্ধ, যুবক, শিশু এবং নারীও আছে।
খলিল ও তার সঙ্গী গোয়েন্দা হলেও এই বেশে তারা কাফেলা থামিয়ে চেক করতে পারছিল না। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল, কোন কাফেলার ওপর সামান্যতম সন্দেহ হলেও, তারা যেন নিকটবর্তী ফাঁড়িতে সংবাদ দেয়। আর ফাঁড়ির দায়িত্ব ছিল, কাফেলা থামিয়ে অনুসন্ধান চালানো এবং তাদের আসবাবপত্র তদন্ত করে দেখা।
খলিল ও তার সাথী কাফেলার লোকদের সাথে শামিল হয়ে গেল এবং তাদের সাথে একত্রে চলার আগ্রহ প্রকাশ করলো।
সে যুগে নিয়ম ছিল, মুসাফিররা দল বেঁধে পথ চলতো। তাতে দীর্ঘ পথের একাকীত্ব দূর হতো এবং ডাকাতদের লুটপাটের ভয়ও কম থাকতো। কাফেলার লোকেরা তাদের দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে নিল।
দুজন গল্প গুজবের ফাঁকে ফাঁকে সন্ধান দিতে লাগলো, এই কাফেলা কোত্থেকে এসেছে, কোথায় যাবে, এসব। তাদের আশা ছিল, সামনের সীমান্ত ফাঁড়িতে এদের ওপর তল্লাশী চালাবে। কিন্তু তারা দেখলো কাফেলা এমন দিকে যাত্রা করেছে, যেদিকে কোন ফাঁড়ি নেই।
টহলদার সিপাহী ও পুলিশ ফাঁড়ির দৃষ্টি এড়িয়েও পথ চলার বিস্তর অবকাশ ছিল যাত্রীদের। পুলিশ ফাঁড়ি এড়িয়ে চলা এবং উটের ওপর মালসামানের বহর দেখে খলিলদের সন্দেহ আরো দৃঢ় হলো। কারণ, বড় বড় পাত্র ও জড়ানো তাঁবুর মধ্যে কি জিনিস লুকানো আছে তা ওরা অনুমান করতেও পারছে না। মোট কথা, এসবের মধ্যে কোন সাধারণ জিনিস ছিল না। ফলে ওরাও কাফেলার সাথে এগিয়ে চললো।
খলিল ও তার সাথী মরুভূমির যাযাবর হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল নিজেদের। কাফেলার মধ্যে চারজন যুবতী ছিল, তাদের পোশাক পরিচ্ছদও যাযাবরের মত। তাদের মাথার চুলের ভঙ্গি প্রমাণ করছে, এরা এখনো সভ্যতার স্পর্শ পায়নি, কিন্তু তাদের চেহারা, চোখের রঙ এবং আকর্ষণীয় দেহবল্লরী বলছে, এরা ছদ্মবেশী যাত্রী।
সেই কাফেলার একজন বৃদ্ধ লোক ছিল। তার কুঁচকানো চামড়া, মাথার সাদা চুল ও সাদা পশম তাঁকে বুড়ো প্রমাণ করলেও দাঁত ও চোখের জ্যোতি বলছিল, এ লোকের বয়স বেশী নয়।
সেই বুড়ো খলিল তো তার সঙ্গীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিল এবং খুব আদর করে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘তোমরা কোথা থেকে আসছো, কোথায় যাচ্ছো?’ খলিল তার সব প্রশ্নেরই মিথ্যা জবাব দিয়ে গেল এবং তার কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করলো, কাফেলা কোথায় যাচ্ছে? তাদের উটের পিঠে এতসব সামানপত্রে কি আছে? সে বৃদ্ধ এমন সুন্দরভাবে কথা বলছিল যে, খলিল ও তার সাথী তার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে গেল।
কাফেলা চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওরা কোথাও থামলো না। শেষে রাত গভীর হলো, তবু কাফেলা চলতেই লাগলো। খলিল কাফেলার গতি ঘুরাতে চেষ্টা করলো। সে বৃদ্ধকে বললো, ‘অমুক দিক দিয়ে গেলে জলদি ঠিকানায় পৌঁছে যাওয়া যাবে।’
তার উদ্দেশ্য ছিল, তাদেরকে ফাঁড়ির পাশ দিয়ে নেয়া। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল, কাফেলা ফাঁড়ির আক্রমণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে।
খলিলের কথায় কাফেলার যাত্রীদের সন্দেহও দৃঢ় হতে লাগলো। কিছুদূর এগুনোর পর বিশ্রাম নেয়ের মত উপযুক্ত স্থান পাওয়া গেল। কাফেলা থেমে গেল ও সকলে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিতে লাগল।
খলিল ও তার সাথী একটু দূরে আলাদা জায়গায় বসে চিন্তা করতে লাগলো, যখন সবাই ঘুমিয়ে যাবে তখন তাদের সামান তল্লাশী করা হবে। একজন নিরবে বের হয়ে গিয়ে কাছের ফাঁড়িতে খবর দেবে, যাতে কাফেলার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালানো যায়।
কিন্তু তাদের ভয় হলো, কাফেলার লোকেরা টের পেলে একজন মাত্র গোয়েন্দাকে হয় হত্যা করে ফেলবে, নয়তো ধরে নিয়ে দ্রুতগতিতে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তাই তারা আগের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিল।
কাফেলার লোকেরা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু খলিলরা না ঘুমিয়ে বরং জেগে থাকার চেষ্টা করলো।
সবাই ঘুমিয়ে গেলে কাফেলার দুই যাযাবর মেয়ে চুপিসারে তাদের কাছে এসে চোরের মত তাদের পাশে বসে পড়লো। মরুভূমির আঞ্চলিক ভাষায় মেয়ে দুটি খলিল ও তার সাথীর সাথে নিচু স্বরে গল্প জুরে দিল।
তারা বললো, ‘যদি আমরা তোমাদের কাছে গোপন বিষয় ফাঁস করি, তবে কি তোমরা আমাদের সাহায্য করবে?’
‘গোপন রহস্য’ এমন একটি কথা, যা শুনে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দুই গোয়েন্দা চমকে উঠলো। কারণ তারা তো গোপন বিষয় উদ্ধারের জন্যই তাদের পিছু নিয়েছে।
তারা বললো, ‘তোমরা যদি মনে করো আমাদের সাহায্য তোমাদের কোন কাজে লাগবে, তবে অবশ্যই আমরা সে সাহায্য তোমাদের দেবো।’
মেয়েরা তখন বললো, ‘এই কাফেলা একটি নাচের পার্টি। ওরা আমাদের চারজন যাযাবর মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা জানিনা কোথায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে এবং আমাদের ভাগ্যে কি আছে।’
মেয়েরা আরো বললো, ‘আমরা মুসলিম যাযাবর, এই খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্তি চাই আমরা।’
একটি মেয়ে খলিলকে বললো, ‘আমাদের আরেকটু দূরে গিয়ে বসা উচিত।’ সে খলিলকে নয়ে আরেকটু দূরে গিয়ে বসল।
মেয়েটির কথায় সরলতা ছিল, আকর্ষণও ছিল। সে খলিলকে বললো, ‘যদি আমাকে নিয়ে পালাতে পারো তবে সমস্ত জীবন তোমার খেদমত করে কাটিয়ে দেবো।’
সে এমন কথাও বললো, ‘তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছে তুমি আমাকে মুক্ত করতে এসেছো। বিশ্বাস করো, তমাকে আমি মনে প্রাণে ভালবেসে ফেলেছি।’
সে ওদের উৎপীড়নের এমন বর্ণনা শুনালো যে, খলিল সমস্ত মেয়েদের মুক্ত করার কথা চিন্তা করতে লাগলো।
অন্য মেয়েটিও খলিলের সঙ্গীর সাথে বসে বসে একই রকম কথা বলছিল।
কোন নারীর শুধু নারী হওয়াই একটা শক্তি। কারণ নারী যখন সুন্দরী ও যুবতী হয় এবং সেই সাথে মজলুম ও উৎপীড়িত হয়, তখন পুরুষ তার ব্যথা-বেদনায় এক রকম গলেই যায়। এই অবস্থায়ই হলো এ দুই যুবকের। দু’জনেই এ মেয়েদের উদ্ধারের জন্য পাগল হয়ে উঠল।
তাছাড়া সে সময় সৈন্যদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করা হতো, মেয়েদেরকে সর্বক্ষেত্রে রক্ষা করার জন্য, সে নিজের হোক বা অন্যের। ফলে, দু’জনেই ওদের মুক্ত করার ওয়াদা দিল।
ওয়াদা পেয়ে মেয়ে দু’টি খুবই খুশি। কি করে ওদের আদর আপ্যায়ন করবে তাই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। একটি মেয়ে জগ ভর্তি শরবত নিয়ে এলো। খুবই সুস্বাদু শরবত। উভয়েই মাত্রাতিক্ত পান করে ফেললো।
কিছুক্ষণ পর।
তাদের চোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। যখন তাদের ঘুম ভাঙ্গল তখন বেলা অনেক। সূর্য দিগন্ত থেকে অনেক উপরে উঠে গেছে। সারা রাত ও দিনের অনেক বেলা পর্যন্ত তারা শুয়েই কাটিয়ে ছিলো।
মরুভূমির উত্তপ্ত রোদ, শরীর ঝলসানো গরমও তাদের জাগাতে পারলো না। নির্দিষ্ট সময় পরে নেশার রেশ কাটতেই তারা হতচকিত হয়ে উঠে বসলো। সেখানে কোন কাফেলা ছিল না, তাদের নিজেরদেরও উট ছিল না। আর তারা সে জায়গায়ও ছিল না, যেখানে তারা রাত কাটানোর জন্য থেমে ছিল।
‘একি! কাফেলা কোথায়? আমাদের উট কোথায়?’ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো খলিল।
‘আমরা যেখানে থেমেছিলাম এটা সে জায়গা নয়! এ আমরা কোথায় এলাম!’ বললো তার সঙ্গী।
তারা উঠে দাঁড়ালো। আশে পাশে মাটি ও বালির টিলা। দু’জন দৌড়ে একটি টিলার উপরে গিয়ে উঠলো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো। একটি নিরেট পাহাড়ী অঞ্চল ও সুদূর বিস্তৃত বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না তাদের।
❀ ❀ ❀