» » সর্প কেল্লার খুনী

বর্ণাকার

মাজেদ হেজাযী তার কাহিনী শুনে খুবই খুশি। এ জমিদারের সঙ্গে হলব যেতে পারবো। সেখানে গিয়ে খলিফাকে বলতে পারবো, ‘একশো সৈন্যের কমান্ডার ছিলাম আমি। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে আমিও দামেশকে প্রবেশ করেছিলাম। কিন্তু আমি মূলত নূরুদ্দিন জঙ্গীর সৈনিক। তাঁর অবর্তমানে তার একমাত্র সন্তান হিসেবে আমার আনুগত্য পাওয়ার হকদার আপনি। এখন আমি নিজেকে আপনার হাতে পেশ করছি। আপনার নগন্য এ গোলামকে এখন আপনি যে কোন কাজে লাগাতে পারেন। আপনি যদি আমাকে আপনার রক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেন তবে তা হবে এ গোলামের বড় পাওনা।’

ওরা আবার হলবের পথে রওনা হলো। সামনে জমিদারের যুবত স্ত্রী, পেছনে জমিদার ও মাজেদ পাশাপাশি গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ জমিদার প্রশ্ন করে বসলো। ‘আচ্ছা, যদি তুমি রক্ষী হিসেবে আমার কাছে থাকো, তবে তুমি কেমন বেতন দাবী করবে? দামেশকে আমি জমিদার ছিলাম, যেখানে যাচ্ছি সেখানেও রাজার হালেই থাকবো আশা করি, আমার রক্ষী হতে তোমার কোন আপত্তি আছে?’

‘যদি আমাকে আপনার রক্ষী হিসেবে নিয়োগ করেন তবে আপনার কোন সময় সমর উপদেষ্টার প্রয়োজন হবে না।’ মাজেদ হেজাযী বললো, ‘আমার কাজের যোগ্যতা দেখে আপনি আমার যা বেতন
ধার্য করবেন আশা করি তাতেই আমি সন্তুষ্ট হবো। এ ব্যাপারে এখন এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে পারবো না।’

জমিদার এ নিয়ে চাপাচাপি করলো না। বললো, ‘ঠিক আছে, এখন থেকেই তোমাকে আমাদের দেহরক্ষী নিয়োগ করা হলো।’

এভাবেই খলিফার এক দরবারীর সাথে সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা একাত্ত হয়ে গেলো। এ জমিদারের কাছে সীমাহীন ধনরত্ন ছিল। তিনি সেই ধনরত্ন তুচ্ছ ও নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এ আসবাবপত্রের হেফাজতের তার একজন রক্ষীর প্রয়োজন ছিল। মাজেদকে পেয়ে তার ষে অভাব পুরণ হলো।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। অস্তমিত লাল সূর্যের রক্তিম আভায় তাদের দেহ-কাঠামোও রঙ্গিন হয়ে উঠল। প্রকৃতিতে ফিরে এল শান্ত সমাহিত এক স্নিগ্ধতার আমেজ।

পাহাড়ের পাদদেশে এক ছায়াস্নিগ্ধ বাগানে এসে ঘোড়ার বাগ টেনে ধরল মাজেদ। বললো, ‘এখানে রাত কাটানোই উত্তম হবে।’

জমিদার তাকালো স্ত্রীর দিকে, তার নিরব সম্মতি পেয়ে তিনিও সায় দিলেন এ প্রস্তাবে। সেখানেই রাত কাটালো তারা।

পরদিন ভোর। যখন ঘুম থেকে উঠলো জমিদার ও জমিদার গিন্নী তখন তাদের মাঝে অপরিচিতির আর কোন ব্যবধান রইলো না। মাজেদের ওপর তাদের বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা যেন এক রাতেই পূর্ণতা পেয়ে গেল।

❀ ❀ ❀

দীর্ঘ যাত্রার পর তারা হলবে গিয়ে পৌঁছলো। সে সময় হলবের আমীর ছিলেন শামসুদ্দিন। কিছুদিন আগে খ্রিস্টানদের বশ্যতা স্বীকার করে সন্ধির মাধ্যমে নিজের গদি রক্ষা করে শামসুদ্দিন। খলিফা আল মালেকুস সালেহ দামেশক থেকে পালিয়ে সেখানেই গিয়ে আশ্রয় নিলো। তার উজির এবং পরিষদবর্গও আশ্রয় নিল তার সাথে। আরো আশ্রয় নিল তার দেহরক্ষী বাহিনী।

সালেহ হলবের আমীরের সহায়তায় সেখানে নতুন করে সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে শুরু করলো। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আনাড়ি লোকদেরকেও সেনাবাহিনীতে ভর্তি করতে বাধ্য হলো কিশোর খলিফা। দামেশক ছেড়ে আসার সময় স্বর্ণ, রৌপ্য ও প্রচুর অর্থ সম্পদ সঙ্গে এনেছেন তিনি। অর্থের কোন অভাব নেই, অভাব শুধু সৈন্য ও কমান্ডারের। তিনি ও তার পরিষদবর্গ খেলাফত পুনরুদ্ধারের জন্য সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

তাদের কার্যকলাপে পরিষ্কার প্রকাশ পাচ্ছিল, তাদের শত্রু খ্রিস্টানরা নয়, তাদের শত্রু হচ্ছে সুলতান আইয়ুবী।

তারা খলিফার সীলমোহরযুক্ত চিঠি নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে ছুটাছুটি করতে লাগলো। সেইসব চিঠির বক্তব্য একটাই, তারা যেন খলিফা আল মালেকুস সালেহকে সামরিক সাহায্য দিয়ে সহযোগিতা করে।

হেমস, হেসাত ও মুসালের শাসনকর্তার কাছেও গেল খলিফার বিশেষ দূত। এসব রাজ্যের আমীরদের কারো দিক থেকে আশাপ্রদ উত্তর পাওয়া গেল, কারো কাছ থেকে শুধু পাওয়া গেল সহযোগিতার মৌখিক সমর্থন।

এই জমিদার যখন হলবে এসে পৌঁছলো তখন খলিফা তাকে খোশ আমদেদ জানালেন। খলিফা সালেহর তিনি অন্যতম যুদ্ধ উপদেষ্টা ছিলেন। তাকে পেয়ে খলিফার উদ্যম আরো বেড়ে গেল। হলবে তাকে একটি পরিপূর্ণ বাড়ি দেয়া হলো বসবাসের জন্য।

এখানে আসার সাথে সাথে তিনি এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, সকালে খলিফার সাথে বের হয়ে যান, আর মধ্যরাতে বাসায় ফিরেন।

এদিকে নিঃসঙ্গ যুবতি স্ত্রী একাকী থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠল। এই একাকীত্ত কাটাতে গিয়ে মাজেদ হেজাযীর সঙ্গে বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল তার।

মাজেদ হেজাযীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ ও মনিব পত্নির প্রতি আন্তরিক সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্যে এক আশ্চর্য সমন্বয় লক্ষ্য করে বিস্মিত হন জমিদার পত্নি। বডিগার্ড হিসেবেই সে কেবল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য নয়, পারিবারিক যে কোন কাজেই তার ওপর আস্থা স্থাপন করা যায়।

মাজেদের চমৎকার আচরণ, যাদুর পরশ ছোঁয়া কণ্ঠস্বর, আন্তরিক ব্যবহার, বিশ্বস্ত বন্ধুর ন্যায় সহানুভুতিপূর্ণ আর্দ্র হৃদয় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুবতির হৃদয় মন জয় করে নিল।

মাজেদ তার মিশন সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। সে মুহূর্তের জন্যেও তার দায়িত্বের কথা থেকে বিস্মৃত হলো না। সঠিকভাবেই তার মিশনের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো।

মেয়েটি তার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য বেছে নিল মাজেদকে। চোখের আড়ালে গেলেই তার সে মাজেদকে ডেকে নেয় তার কাছে। তার সম্পর্কে গল্প করে কাটিয়ে দেয় সময়।

গল্পচ্ছলেই একদিন মাজেদ তাকে জিজ্ঞেস করলো মনিবের অন্য চারজন স্ত্রীর কথা।

মেয়েটি বললো, ‘তুমি তাদের সম্পর্কে কি জানতে চাও? দেখতে শুনতে তারা কেউ অসুন্দরী নয়। বংশ, মর্যাদা, ব্যবহার সবই ভালো। স্বামী তাদের অপছন্দ করেছে পুরনো বলে। বয়স কম বলেই আমি স্বামীর প্রিয়ভাজন হতে পেরেছি।’

‘কিন্তু পালাবার সময় কেউ নিজের স্ত্রীদের ফেলে আসে?’

‘আমার মতো যুবতি সঙ্গে থাকলে তার যে অন্য কারো দরকার নেই। কেন বেহুদা ওদের নিয়ে টানাটানি করবেন তিনি?’

‘নিজের প্রয়োজনটাই সব। তার মানে এমনিভাবে কোন একদিন তোমাকেও ত্যাগ করে তিনি অন্য কাউকে নিয়ে আসবেন?’

‘ধনীদের চরিত্রই এরকম। হাতে যখন টাকা থাকে, বাজারের সেরা জিনিসটাই সব সময় হাতের কাছে রাখতে চায় তারা। আমাদের মতো মেয়েদের সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যে তাদের কি এসে যায়।’

‘তুমি এমনভাবে কথা বলছো, যেনো স্বামীকে ঘৃণা করো?’

‘করই তো। যদি আমি তোমাকে আমার মনের কথা বলি, তবে তুমি কি ভাববে আমি জানি না। কিন্তু আমার বলতে খুব ইচ্ছে করছে।’

‘তাহলে বলো। তোমাকে কে নিষেধ করেছে?’

‘কিন্তু তুমি তা স্বামীর কাছে বলে দিবে না তো?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাকে বিপদে ফেলবে না তো?’

‘আমার স্বভাবে যদি কোন প্রবঞ্ছনা ও ধোঁকা থাকতো তবে পথেই তোমার স্বামীকে হত্যা করে তোমাদের ধনরত্ন এবং তোমাকে আমি সহজেই ছিনিয়ে নিতে পারতাম।’ মাজেদ হেজাযী বললো, ‘আমি যুবক, কিন্তু আল্লাহকে ভয় করি। কোন নারীকে বিপদে ফেলা সত্যিকার মুসলমানের স্বভাব নয়।’

‘মাজেদ, আমাকে ক্ষমা করো। আমি আর আমার মনের কথা বেশীক্ষণ গোপন রাখতে পারছি না। তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, তবু আমি বলবো, তোমাকে আমি ভালবাসি।’

মেয়েটি বললো, ‘আর এটাও জেনে রেখো, কোনদিন আমি আমার স্বামীকে ভালবাসিনি, তাকে আমি ঘৃণা করি।’

‘এ তুমি কি বলছো! একজিন বিবাহিত নারী হয়ে পরপুরূষকে ভালবাসা অন্যায়।’ প্রতিবাদ করে উঠল মাজেদ।

‘হ্যাঁ, অন্যায়। কিন্তু আমার কাহিনী তুমি জানো না, জানলে এভাবে তুমি বলতে পারতে না। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কাছে আমার বিয়ে দেয়া হয়েছে। বলতে পারো, আমি তার কাছে বিক্রি হওয়া মেয়ে। কতবার আমি আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছি, কিন্তু আমি বড় ভীতু মেয়ে। আত্মহত্যা করার সাহসটুকুও আমি সঞ্চয় করতে পারিনি।’ কান্না কাতর কন্ঠ মেয়েটির।

‘তোমার স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত লোক। অর্থ-বিত্ত, মান-সম্মান, পৌরুষ কোনটারই আত্র কোন অভাব নেই। তুমি তাকে ঘৃণা করতে যাবে কেনো?’

‘আমাদের চিন্তা চেতনা ও আদর্শ ভিন্ন। মরহুম জঙ্গীর স্ত্রী আমার মনে ইসলামের যে আলো জ্বেলে দিয়েছেন, ইসলামের যে শিক্ষায় আমাকে শিক্ষিতো করে তুলেছেন, সে শিক্ষার প্রতি আমার স্বামীর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। যে লোক আল্লাহর বান্দা হয়ে আল্লাহকেই ভালবাসে না, যে আল্লাহ তাকে এতো সম্মান ও নেয়ামত দিয়েছেন তার শোকর আদায় করে না, সে তো মানুষ নামের অযোগ্য।

আমার স্বামী যা করে বেড়ায় তার সবই সভ্যতা ও মানবতার জন্য অকল্যাণকর। এমন লোককে ঘৃণা ছাড়া আর কিইবা দিতে পারি। এ লোক আমার জীবনটা ব্যর্থ করে দিয়েছে। মরণ ছাড়া তাইতো এখন আমার আর চাওয়ার কিছু নেই।’

‘কিন্তু এইনা বললে, আমাকে তুমি ভালবাসো। আমাকে ভালোবাসো বলেই কি এখন মরতে চাচ্ছো?’

‘না, সে কারণে নয়।’ মেয়েটি বললো, ‘মরতে চাচ্ছি আমার বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে বলে।’

‘আমার মনে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পরকে খুবই উচ্চ ধারণা ছিলো। নুরুদ্দিন জঙ্গীর চেয়েও তার কাছে আমার প্রত্যাশা ছিলো বেশী। তুমি আমার সে ধারণা ও বিশ্বাস কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছো। সত্যি কি সালাহউদ্দিন এতই খারাপ, যেমন তুমি বলেছো?’

‘সালেহা!’ মাজেদ হেজাযী বললো, ‘তোমার গোপণীয়তা তুমি আমার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছো। বিনিময়ে আমিও তোমাকে কিছু গোপন কথা বলতে চাই। আমি তোমার কাছ থেকে এর জন্য কোন ওয়াদা নিতে চাই না, কিন্তু এটুকু বলতে চাই, যদি আমার গোপন কথা ফাঁস হয়ে যায়, তবে তুমিও বাঁচবে না, তোমার স্বামীও বাচবে না।’

‘ভয় নেই, তুমি নিঃসঙ্কোচে তোমার মনের কথা বলতে পারো। আমার ভালোবাসাই তোমার গোপন কথার জামিন্দার।’ বললো সালেহা।

‘আমি সুলতান আইয়ুবীর সামান্য এক গোয়েন্দা। আমি তোমাকে এটুকু বলতে পারি, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্বন্ধে তোমার যে ধারণা, তার চেয়েও তিনি অনেক পবিত্র ও মহান।

তিনি সেই আমীর ও বাদশাহদের শত্রু, যারা যুবতি মেয়েদেরকে তাদের অন্দরমহলে বন্দী করে রেখেছে। পুরূষ নারীদেরকে শুধু আমোদ- ফুর্তির উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করবে, তিনি এই প্রথার ঘোর বিরোধী। তিনি নারী ও পুরূষের সমতা বিধানের এবং শরীয়ত সম্মত জীবন যাপনএর বিধানে বিশ্বাসী। এ জন্যই তিনি মেয়েদের কে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের পক্ষে।

আমি তোমার স্বামীর বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য মিথ্যা কথা বলেছিলাম। আইয়ুবীর সেনাবাহিনী দামেশক থেকে পলাতক লোকদের ওপর লুটতরাজ চালিয়েছে এবং তাদের মেয়েদের ধরে আনার জন্য সৈন্য পাঠিয়েছে, এ তথ্য ডাহা মিথ্যা। তিনি ইসলামের পতাকাবাহি কাফেলার নেতা। ইসলামি কাফেলা কখনো অন্যায় করে না, এবং অন্যায় বরদাশত ও করে না । আমি সে ইসলামেরই এক নগন্য খাদেম। ইসলামের স্বার্থেই সুলতান আইয়ুবীর পক্ষ থেকে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য এসেছি আমি!’

মেয়েটির চোখে মুখে আনন্দের বিদ্যুৎ বয়ে গেলো। সে মাজেদ হেজাযীর একটি হাত চেপে ধরে বললো, ‘তোমার এ গোপন কথা কোনদিন ফাঁস হবে না। তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। তুমি এখানে কেনো এসেছো আমি বুঝে গেছি। তোমাকে আমি কি সাহায্য করতে পারি শুধু তাই বলো।’

‘উতলা হয়ো না। তোমাকে কিছু করতে হবে না, যা করার আমিই করছি।’

‘ভয় পেয়ো না। আমাকে অবলা নারী ভেবো না। আমি সেই দলের মহিলা, যাদেরকে নুরূদ্দিন জঙ্গীর স্ত্রী ট্রেনিং দিয়েছিল যুদ্ধ করার জন্য। জঙ্গী বেঁচে থাকতেই আমরা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ট্রেনিং পেয়েছিলাম।’

মুহূর্ত খানেক থামলো সালেহা। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, ‘আমার বাবা এসব পছন্দ করতেন না। তিনি খুব লোভী লোক ছিলেন। তার কাছে ক্রুশ ও হেলালে কোন পার্থক্য ছিল না। তিনি ছিলেন টাকার গোলাম। টাকা পেয়ে তিনি আমাকে এই লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি জানি, এই কেনা বেচাকে সমাজ বিবাহ বললেও ইসলাম একে বিবাহ বলে না। ইসলামে নারীর পছন্দ ও সম্মতি ছাড়া বিবাহ হয় না।’

‘ইসলাম মেয়েদের সম্মান, মর্যাদা এবং অধিকার দেয় বলেই অতীতে মহীয়সী মহিলারা যুদ্ধের ময়দানে জেহাদের ঝাণ্ডা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস দেখিয়েছেন। জাতীয় বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজেই মেয়েরা পুরুষদের তাক লাগিয়ে দিতে পারে, এমনকি যুদ্ধে শত্রুদের গতি স্তব্ধ করে দিতে পারে।’ সালেহার কথার রেশ ধরে বললো মাজেদ।

‘তুমি ঠিকই বলেছ। সেই মেয়েদেরকে যদি অন্দরমহলে বন্দী রাখা হয়, তখন সে বিড়াল হয়ে যায়। যেমন হয়েছে আমার অবস্থা।’ বললো সালেহা, ‘যদি আমার স্বামী সাধারণ কোন লোক হতো তবে অনেক আগেই আমি বিদ্রোহ করতাম। তার থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এ লোকের কাছে অর্থ আছে, শক্তি আছে। খলিফার তিনি সামরিক উপদেষ্টা। খলিফার রক্ষীবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই তার নিজস্ব। তাদের তিনিই রক্ষী বাহিনীতে ভর্তি করিয়েছেন।

আমি তার ছোট বিবি। যুবতি ও সুন্দরী বলেই আমি তার খেলনার পাত্রী ও সামগ্রী। ইচ্ছে থাকলেও তার এই বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়াতে পারিনি।

কিন্তু তার কাছে এসে আমার আত্মা মরে গেছে। বেঁচে আছে শুধু দেহটা। বাইরের দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন আমি যে দুনিয়াতে বন্দী আছি, সেখানে শুধু শরাব, নাচ ও গানের মাতামাতি। আর আছে আইয়ুবীকে হত্যা করার বিরামহীন চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র।’

কথা কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে থেমে গেলো সালেহা। মাজেদ হেজাযীকে ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘তুমি কি আমার কথা শুনছো?’ তুমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা হও বা আমার স্বামীর গোয়েন্দা হও, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি যদি আমার স্বামীর গোয়েন্দা হও তবে তাকে সব কথা ঠিকঠাক মত বলে দিও। তিনি আমাকে যেমন খুশি শাস্তি দিক, আমি তার পরোয়া করি না। এখন আমি যে কোন শাস্তি সহ্য করার জন্য প্রস্তুত। আত্মা তো আমার আগেই মরে গেছে, এ পোড়া দেহ আর কতটুকুই বা কষ্ট পাবে।’

‘না, তোমার আত্মা মারা যায় নি।’ মাজেদ হাজাযী বললো, ‘আমার দৃষ্টি তোমার আত্মার গভীর তলদেশ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, সেখানে এক মুজাহিদের সতেজ আত্মা তোলপাড় করছে। এখন নয়, আরো আগেই আমি সে আত্মার সন্ধান পেয়েছিলাম। সেই ভরসাতেই আমি তোমার কাছে আমার গোপন কথা ব্যক্ত করেছি।

আমি রুপ, যৌবন ও সৌন্দর্য দেখে বশীভূত হওয়ার মতো লোক নই। ইসলামের সৌন্দর্য দেখার পর আর কোন সৌন্দর্য দেখার প্রয়োজন নেই আমার। ইসলামের জন্য এ জীবন আমি উৎসর্গ করে দিয়েছি।

তোমার মনে আগ্নেয়গিরির যে লাভা টগবগ করে ফুটছে তা বের হয়ে আসতে দাও। তোমার যত কথা আছে সব খুলে বলো আমাকে। মনটা হালকা করো। আমি মনোযোগ দিয়েই তোমার কথা শুনছি।’

‘না মাজেদ, আমার মনের কষ্ট প্রকাশ করে তোমার আত্মাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার দুঃখের কাহিনী আমার বুকেই কবর হয়ে যাক।’

‘কিন্তু সালেহা। তোমার এ কাহিনী নতুন কিছু নয়। এটাই যে আজ প্রত্যেক মুসলমান নারীর জীবন কথা, মর্মব্যথা। যে দিন থেকে ইসলামের অধঃপতন শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই মুসলমানদের অন্দরমহলগুলো এ চাপা কান্নায় ভরে উঠেছে।

সুন্দরী মেয়েদের কিনে এনে বন্দী করার বর্বরতা ইসলাম কোন মানুষকে শিখায় নি।’

‘অধঃপতনের এখানেই শেষ নয় নয়। তুমি শুনলে অবাক হবে, খ্রিস্টান যুবতীদের নিয়ে এখন আমীর ও বিত্তবানদের হেরেমগুলো ভরে উঠেছে।’

‘জানি, আমরা এ সবই জানি। আমীরদের মহলগুলো খ্রিস্টান যুবতী ও সুন্দরীদের নিয়ে ভরে উঠার পরও তারা কেবল মুসলমানই থাকছে না, এই অসভ্যতার পরও তারা মুসলমানদের নেতা বনে যাচ্ছে।’

‘আমার স্বামীর মহলেও তাই হয়েছে। মেয়েটি বললো, ‘আমার চোখের সামনেই খ্রিস্টান মেয়েরা আমার স্বামীকে নিয়ে আড্ডা মারে, তাকে শরাব পান করায়। তখন কান্না ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকে না।’

‘কিন্তু এতে যে আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীতে ফাটল ধরছে, এই বোধটুকুও নেই আমাদের আমীরদের।’

‘না, ওই মেয়েরা আমার স্বামীকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়েছে, এ জন্যে আমি মোটেও দুঃখিত নই, আমার একমাত্র আফসোস ও দুঃখ হচ্ছে তারা তাকে ইসলাম থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। অথচ ইসলামের জন্যই আমাদের জীবন মরণ। কেবল তারই এবাদত করার জন্য আল্লাহ আমদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।’

মাজেদ হেজাযী তাকে আর এগুতে দিলো না। বললো, ‘এখন ওসব আবেগের কথা রাখো। যে কাজের জন্য আমি এখানে এসেছি সেই কাজের কথা শুনো।’

মাজেদ হেজাযী তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার স্বামীর ওপর তোমার প্রভাব কেমন? সে কি তোমাকে বিশ্বাস করে? তার কাছ থেকে তার মনের গোপন কথা কি তুমি বের করে আনতে পারবে?’

মেয়েটির মুখে তাচ্ছিল্লের হাসি খেলে গেল। বললো, ‘তা না পারার কি আছে। দুই পেয়ালা শরাব আর একটু আদর মনের গভীর গহীন থেকে এমন কোন কথা নেই যা বের করে আনা সম্ভব নয়।’ মেয়েটি বললো, ‘তুমি কি তথ্য জানতে চাও?’

সে একটু চিন্তা করে হেসে বললো, ‘তুমি আমার ব্যক্তিগত একটি শর্ত মেনে নিবে? আমি যদি তোমার কাজ করে দেই তবে কি তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে? এই বন্দীশালা থেকে মুক্তি দেবে আমাকে?’

মাজেদ হেজাযী তার শর্ত মেনে নিলো। বললো, ‘খলিফা আল মালেকুস সালেহ মাত্র এগারো বছরের বালক। তিনি আমীরদের হাতের খেলনা মাত্র। এসব আমীর ও উজিররা সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করে ইসলামি সাম্রাজ্যকে খন্ড বিখন্ড করে একেকজন সেই ক্ষুদ্র অংশের শাসক হতে চায়। খ্রিস্টানরাও তাই চায়। ইসলামী সালতানাত খন্ড বিখন্ড হলে তা গ্রাস করা সহজ হয়ে যাবে তাদের পক্ষে। সহজেই তার ইসলামের নাম নিশানা মুছে দিতে পারবে।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বলেন, ‘যে জাতি তার রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে, সে জাতি কোন দিন বেঁচে থাকতে পারে না।’ আমাদের এ সকল আমীররা খ্রিস্টানদের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছে। খ্রিস্টানরাও নিজেদের স্বার্থেই তাদের সাহায্য করতে এহিয়ে এসেছে।

আমি এ কথা জানার জন্যই এখানে এসেছি, খলিফার দরবারে কি পরিকল্পনা হচ্ছে, খ্রিস্টানরা তাকে কিভাবে এবং কতটুকু সাহায্য দিচ্ছে। জাতীয় স্বার্থে এ সংবাদ জানা খুবই জরুরী। আমাকে অতিসত্তর এ সংবাদ সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছাতে হবে, যাতে তিনি সেই মোতাবেক প্রস্তুতি নিতে পারেন। নইলে এমনও হতে পারে, সুলতান আইয়ুবী খ্রিস্টানদের আক্রমণের মুখে পড়ে যেতে পারেন।’

‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কি মুসলমান আমীরদের উপরও আক্রমণ চালাবেন?’ মেয়েটি প্রশ্ন করলো।

‘যদি প্রয়োজন হয় তিনি তাতে দ্বিধাবোধ করবেন না।’

এই জবাব শুনে মেয়েটির চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে আবেগ তাড়িত কণ্ঠে বললো, ‘হায়! সেই দিনগুলোও আমাদের দেখতে হলো, একই রাসূলের উম্মতরা আজ শত্রুদের রেখে নিজেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে হাতে।’

‘এ ছাড়া যে আর কোন গতি নেই আমাদের!’ মাজেদ হেজাযী বললো, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তো বাদশাহ নন, তিনি আল্লাহর সৈনিক। তিনি বলেন, ‘দেশ ও জাতিকে ভয় ও আশংকা থেকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব আল্লাহ সৈনিকদের ওপরই ন্যস্ত করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেনাবাহিনী সরকারের হাতের খেলার পুতুল হতে পারে না। তাদের দায়িত্ব জাতির, জান, মান-সম্মান ও আজাদি রক্ষা করা। আর তা করতে গিয়ে যদি গাদ্দার ও ক্ষমতালোভীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়, তাহলে আমাদের তাও ধরতে হবে।’

‘উনি ঠিকই বলেছেন। গায়ের ফোঁড়া না কাটলে তাতে পচন ধরে। সেই পচন কখনো কখনো মৃত্যুর কারণও হতে পারে। জাতির ভাগ্য বিক্রি করে যারা নিজেদের ভাগ্য গড়তে চায় তারা সমাজদেহের বিষাক্ত ফোড়া, এই ফোড়া যত তাড়াতাড়ি সরানো যায় তাতই মঙ্গল। এখন বলো, ‘এ ক্ষেত্রে আমি তোমাকে কি সাহায্য করতে পারি?’

‘সামরিক বাহিনী সরকারের শক্তির অন্যতম উৎস এ এখন তোমার কাজ হলো, স্বামীর কাছ থেকে তাদের পরিকল্পনা এবং গোপন তথ্য সব জেনে দেওয়া।’

‘আমি গোপন তথ্যও দেবো, আন্তরিক দোয়া ও শুভেচ্ছা ও জানাবো। কিন্তু আমার একটি দাবী আছে, যখন তুমি এখান থেকে দামেশক রওনা হবে, তখন তোমার গোপন তথ্যের সাথে তার সরবরাহকারীকেও রাখতে হবে। এ শর্তের কথা কিন্তু ভুলে যেয়ো না।’ বললো মেয়েটি।

❀ ❀ ❀