উট ও ঘোড়ার কাফেলা তার আগমনের সুসংবাদ নিয়ে আগে আগে যায়। ঘোড় সওয়াররা সামনের গ্রামগুলোতে পৌছে চিৎকার করে বলতে থাকে, তিনি আসছেন! পীর সাহেব তশরিফ আনছেন। কোথায় তোমরা, চারদিকে এ খবর পৌছে দাও! তোমাদের সব সমস্যা সমাধা করে দেবেন তিনি! যে যেখানে আছো, অমুক প্রান্তরে গিয়ে সমবেত হও!’
লোকজন চারদিক থেকে ঘিরে ধরে তাদের। তারা লোকজনকে শুনায় তার কেরামতীর গল্প তার রুহানী শক্তির অপূর্ব সব কাহিনী। গ্রামের লোকের মধ্যে সাজ সাজ সাড়া পড়ে যায়। আশপাশের দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে পীর সাহেবের আগমনের আনন্দ বার্তা।
সেনাবাহিনীকে পিছনে রেখে আলীকে নিয়ে রাতের আঁধারে কায়রোর পথ ধরেছিলেন সুলতান আইয়ুবী। যখন তিনি কায়রো শহরে প্রবেশ করেন তখনো শহর তেমন জেগে উঠেনি। ফজরের নামাজ পড়ে দু’একজন প্রবীণ ব্যক্তি প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছেন। এ ছাড়া রাস্তাঘাটে তেমন কোলাহল নেই।
যেন ঘোড়ায় চড়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন এমন একটি গেলেন আলী ও আইয়ুবী। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য যেভাবে মানুষ চোখ মুখ ঢেকে রাখে তাদের চেহারাও সেভাবে নেকাবে ঢাকা। দু’একজন পথচারী যারা তাদের দেখেছে, তারা কেউ ভাবেওনি সুলতান আইয়ুবী এভাবে ফিরে আসতে পারেন। ফলে কেউ তাদের চিনতে পারল না। কেউ টেরও পেল না, সুলতান স্বশরীরে কায়রোতে অবস্থান করছেন।
মহলে প্রবেশ করেই আলীকে নিয়ে তিনি এক কামরায় ঢুকে গেলেন। বিশ্বস্ত এক গার্ডকে ডেকে বললেন, “আমার ঘোড়া পেছনে সরিয়ে নিয়ে যাও। আমি এসেছি, এ কথা যেন কেউ জানতে না পারে।’
আলী কামরার দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন এখন কি করতে চান?”
আগে তুমি ছদ্মবেশ নাও। তারপর তোমার দপ্তরে গিয়ে ভালভাবে চোখ বুলিয়ে নিতে চাই। .
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছদ্মবেশ নিয়ে পথে নামলেন আলী। একটু পরে ফিরে এলেন তালিকা নিয়ে।
সুলতান গভীর মনযোগে একটি একটি করে নাম ও ঠিকানা মনের গভীরে গেথে নিতে লাগলেন। এক সময় আলীকে বললেন, ‘আলী, আল ইদরিসকে একটু ডেকে আনবে?”
আল ইদরিসকে ডেকে আনলেন আলী। এই সে আল ইদরিস, যার দুই যুবক ছেলেকে গাদাররা ধোঁকায় ফেলে খুন করেছে।
আল ইদরিস আসতেই সুলতান তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ছেলেদের কথা তুলে তাকে শান্তুনা দিলেন তিনি।
যদি আমার সন্তানরা যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হতো তবে আমি খুশি হতাম। আমার আফসোস শুধু এটুকুই, তারা দুশমনের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে প্রাণ দিল। আল ইদারস বললেন, জানি এখন সন্তানের জন্য শোক করার সময় নয়। আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন সে কথা বলুন।”
‘আলীর কাছ থেকে কায়রোর অবস্থা আমি শুনেছি। এবার আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে আপনি কতদূর কি জানেন বলুন।”
আল ইদরিস যা জানেন আদ্যোপান্ত সুলতানকে জানালেন। আলীর রিপোর্টে এমন কিছু নাম ছিল যা কয়েকটি নাম উল্লেখ করে বললেন, ‘এদের সম্পর্কে আপনার অভিমত বলুন।
আল ইদরিস তার মতামত পেশ করলেন। সুলতান বললেন, “আমি গোপনে কায়রো প্রবেশ করেছি কিছু বিশেষ কাজে। আমি যে এসেছি এ কথা কাউকে বলবেন না।
তালিকার এ নাম কটি মুখস্ত করে নিন। এরা সবাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কিন্তু আলীর রিপোর্ট সত্য হলে এদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করবো না আমি। আপনি খুব ভালভাবে চিন্তা ভাবনা করুন এবং এদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিন। কাল সকালে আপনি আপনার মতামত জানাবেন।”
আল ইদরিস বিদায় নিলে তিনি আবার তালিকা নিয়ে বসলেন। যতই পড়ছেন ততই বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার চেহারা। তালিকা দিয়েছে তাদের ব্যাপারে খুব ভাল করে খোঁজ খবর নিয়েছো তো?”
“একশোভাগ নিশ্চিত না হয়ে কারো নামই আমি এ তালিকায় তুলিনি। আমার কাছে আরো একটি তালিকা আছে। সন্দেহ হলেও এদের ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত কোন প্রমাণ জোগাড় করতে পারিনি বলে আপনার কাছে দেইনি। দেখতে চাইলে দেখতে পারেন।’
‘না, ওটা এখন তোমার কাছেই থাক, যখন দরকার হবে, চেয়ে নেবো। তুমি বরং পুলিশ প্রধান গিয়াস কামালকে একটু ডেকে দাও।”
গিয়াস কামাল এলে সুলতান তার কাছ থেকেও গাদ্দারদের একটি তালিকা সংগ্রহ করলেন। আলীর দেয়া তালিকার সাথে সে তালিকা মিলিয়ে দেখলেন। আরো কয়েকজন বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে কথা বললেন। তাদের সুচিন্তিত মতামত শোনলেন এবং তাদেরকে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। এভাবে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে কেটে থেকে আগত বাহিনীর অধিনায়কের এক দূত এসে সুলতানের কাছে একটি চিঠি পেশ করল। তাতে সুলতানকে জানানো হয়েছে, সেনাবাহিনীর উত্তেজনা মোটেও কমেনি, তারা মিশরের ছাউনিতে হামলা করার জন্য বদ্ধপরিকর।
কায়রো শহরে রাতের আধার নেমে এল। অন্ধকারে আলীকে নিয়ে আবার ঘোড়ায় চাপলেন তিনি। বিশ্রামহীন দিনের পর শুরু হল বিশ্রামহীন রাত। যথাসময়ে খবর পেয়ে বাহিনীর উদ্দেশ্যে কায়রো থেকে আট দশ মাইল দূবে থাকতেই তাদের পথ রোধ করে থামালেন তিনি। কায়রোর দিকে ছুটে চলা উত্তেজিত ধাবমান বাহিনী সাথে সাথে থমকে দাঁড়াল। তিনি সৈন্যদেরকে সেখানেই অবস্থান করতে আদেশ দিলেন। সুলতানের নির্দেশ পেয়ে সৈন্যরা সেখানে তাবু টানালো বিশ্রামের জন্য।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্য দল কায়রো থেকে আট দশ মাইল দূরে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাঝে প্রচণ্ড উত্তেজনা তোলপাড় করছে। কায়রোর বিদ্রোহী সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার জন্য ব্যগ্র-ব্যাকুল তারা।
তিনি সৈন্যদের মাঝে ঘুরে তাদের মনের আবেগ সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করতে লাগলেন। ঘুরতে ঘুরতে-তিনি এক অশ্বারোহী সৈন্যের কাছে থামলে আশেপাশের সৈন্যরা এসে জমায়েত হলো সেখানে। তিনি তাদের সঙ্গে হালকা মেজাজে আলাপ জুড়ে দিলেন। এক অশ্বারোহী সুলতানকে লক্ষ্য করে বলে উঠলো, অপরাধ ক্ষমা করবেন সালারে আজম! এখানে আমাদের বিশ্রামের কোন দরকার ছিল না।
না থামলে আমরা রাতের প্রথম প্রহরেই কায়রো পৌছে যেতে পারতাম।”
‘তোমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোন রকম বিশ্রাম না নিয়েই সরাসরি কায়রোর পথ ধরেছিলে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এখন স্বাভাবিকভাবেই তোমরা ক্লান্ত!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন কায়রো ঢোকার আগে তোমাদের নিরিবিলি একটু বিশ্রাম দিতে চেয়েছি।
আমরা যুদ্ধ করে এসেছি এবং যাচ্ছিও যুদ্ধ করতে। আমাদের শিয়ার খুন এখনও ঠান্ডা হয়নি, বিশ্রামের কোন দরকার ছিল না আমাদের ; সেই আরোহী বললো।
‘তুমি যুদ্ধ করতে যাচ্ছ?” সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তো তোমাদেরকে কায়রো নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে তোমাদের পুরাতন বন্ধুরা আছে, যারা এক সময় তোমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, যারা তোমাদের সুখ দুঃখের সাখী!’
‘ওরা এখন আর আমাদের সাথী নেই, ওরাই এখন আমাদের শক্র। আরোহী বললো, ‘ওরা নাকি মিশরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চায়, আমরা ওদের বিদ্রোহের সাধ চিরতরে মিটিয়ে দেবো!”
বেঈমানরা কাফেরের চেয়েও ভয়ংকর। আমরা ওদের গাদারীর পাওনা কড়ায় গণ্ডায় আদায় করবো।’ অন্য এক উত্তেজিত সৈন্য বললো, “এ কথা কি সত্য নয় সালারে আযম! কায়রোতে বিশ্বাসঘাতকরা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করছে?’,
হ্যা, এ কথায় কিছু সত্যতা আছে ঠিক, তবে অতিরঞ্জনও আছে। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি অপরাধীদের রেহাই দেবো না, শাস্তি ওদের পেতেই হবে।’
‘আপনি পুরো বাহিনীকে কেমন করে শাস্তি দেবেন। এক সমস্ত ঘটনা আমাদের বলেছেন। আমাদের সঙ্গীরা সুবাকে শহীদ হয়েছে, ক্রাকে শহীদ হয়েছে। এ দুই শহরে আমাদের মা বোনদের সতীত্ব ও সন্ত্রম নষ্ট হয়েছে। ক্রাকে এখনও অগ্নিগোলায় জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে। আমাদের প্রথম কেবলারওপর এখনও কাফেরদের পতাকা উড়ছে। আর আমাদের সৈন্যরা কায়রোতে শান্তিতে বসে বিলাসিতা ও ষড়যন্ত্র করছে? জেহাদী কাফেলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাইছে? যারা শহীদের রক্তের দাম দিতে জানে না, মা বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে জানে না, তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’
আমরা জানতে পেরেছি তারা ইসলামের শত্রুদের বন্ধু হয়ে গেছে। আমরা যতক্ষণ এই গাদারদের নিজ হাতে হত্যা না করবো ততক্ষণ শহীদ ভাইদের আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না। এই আহতদের দেখুন, যাদেরকে আমরা সঙ্গে নিয়ে এসেছি, এদের কারো পা নেই, কারো হাত নেই। তার সার্থীরা শক্রদের বন্ধু হয়ে জাতির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, এটা দেখার জন্যই কি তারা পঙ্গু অবস্থায় অসহায়ের মত বেঁচে থাকবে?’
তার কথার প্রতিধ্বনি করে সৈন্যরা শোরগোল শুরু করে দিল, “আমরা তাদের নিজ হাতে শাস্তি দেবো।
এ শোরগোল শুনে আশপাশ থেকে আরো সৈন্য সেখানে এসে জমা হতে লাগলো। তারা সবাই সুলতান আইয়ুবীর লাগলো। সুলতান গভীর মমতা নিয়ে সৈন্যদের এ আবেগ ও প্রেরণা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলেন।
তিনি সৈনিকদের এই আবেগ ঠাণ্ডা করতে বা তাদের মনে ব্যথা দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি বললেন, “অবশ্যই আমরা তাদের শাস্তি দেবো, তবে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে নয়। আপনারা সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। শাস্তি দেয়ার নাম করে আমরা কোন আহাম্মকী করতে চাই না। আমাদের উপদেষ্টারা আছেন, সালার এবং কমাণ্ডাররা আছেন, তাদের নিয়ে বসে আমি দেখছি এ ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নেয়া যায়।’
তিনি নিজের তাবুতে ফিরে গেলেন এবং উপদেষ্টা ও কমাণ্ডারদের ডাকলেন। সবাই একত্রিত হলে তিনি বললেন, শিক্রর চাল এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। ওরা চায় আমরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে ধ্বংস হয়ে যাই। কিন্তু সে সুযোগ আমি শক্রদের দেবো না। পরবতী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই উত্তেজিত সৈন্যরা এখানেই বিশ্রাম কবরে। গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে হবে আমাদের। আমি আজ রাতে কায়রো যাবো। কেউ যেন না জানে আমি এখানেই নেই। সৈন্যদের উত্তেজনায় আপনারা শরীক হবেন না। আবার এমন কিছু করবেন না বা বলবেন না, যাতে তাদের আবেগে আঘাত লাগে |
তিনি বিশেষভাবে বললেন, কায়রোয় আমাদের যে সব সৈন্য বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করছে তারা আমার দৃষ্টিতে নিরপরাধ। ওদেরকে আমাদের সরকারী কিছু অফিসার ও পদস্থ কর্মকর্তারা উত্তেজিত করেছে। এই কর্মকর্তাদের নির্দেশে ও ছত্রছায়ায় কায়রোসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে যৌনতা, নেশা ও বিলাস সামগ্ৰী ছড়ানো হয়েছে। এই চরিত্র বিধ্বংসী তৎপরতা সমাজে এতটা ব্যাপকভাবে জেকে বসেছে এ জন্য যে, আমাদের প্রশাসন দুষ্কৃতকারীদের গতিরোধ করার পরিবর্তে তাদের সহযোগিতা করেছে। আর এটা ওরা করেছে দুশমনের বেতন খেয়ে। যখন কোন জাতির প্রশাসন, সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিবরা শক্রদের হাতের পুতুল হয়, তখন সে জাতির সর্বনাশ এভাবেই ঘটে।
আমাদের সৈন্যদের একটি অংশ সুদানের উষর মরুভূমিতে যুদ্ধ করছে, প্রাণ দিচ্ছে। অথচ আমাদের প্রশাসন তাদের রসদপত্র, খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে ক্ষুধা ও পিপাসায় সৈন্যদের প্রাণ দিতে বাধ্য করছে।
এদের এ অপকর্মের ফলেই তকিউদিনের সৈন্যরা আজ দুর্দশায় পড়েছে। অস্ত্রসমপণ না করে বাঁচার আর কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে। ওরা কেবল তকিউদ্দিনের বাহিনীকে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ও সম্মান হেয় করার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছে। তকিউদ্দিন পরাজিত হয়ে ফিরে এলে বা বন্দী হলে ওরা বলবে, দেখো পরাজিত সৈন্যরা ফিরে এসেছে। জাতির সম্মান ও ইজ্জত রক্ষার কোন যোগ্যতাই এদের নেই।
এসব গাদ্দাররা মিশরের গদিতে বসার স্বপ্ন দেখছে। এ জন্যই তারা সেনাবাহিনীকে জাতির কাছে ছোট ও ঘৃণিত করতে চায়। তারা যখন জাতির ঘাড়ে সওয়ার হবে তখন যেন সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলে এ জন্যই তারা এ চক্রান্ত করছে। এ অৰস্থায় চুপচাপ বসে থাকার কোন অবকাশ নেই আমাদের।
যদি ওরা দ্বীনের জন্য এ চেষ্টা করতো তবে আমি সে বাহিনীতে সাধারণ সৈনিক হয়ে লড়াই করতাম। কিন্তু ওরা নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য। এ জন্য দুশমনের সাথে হাত মিলাতেও তাদের আপত্তি নেই। ওদের একমাত্র। লক্ষ্য ছলে বলে কৌশলে নিজের ক্ষমতা লাভ | দ্বীন ও ঈমানের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি চাই জাতিকে সেইখানে নিয়ে যেতে, যেখানে সে দ্বীনের শক্রদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বীরের মত বুক ফুলিয়ে চলতে পারে। কুচক্রীদের ঘৃণ্য দৃষ্টি বর্তমান ও ব্যক্তি স্বার্থের দিকে, আমাদের দৃষ্টি জাতির ভবিষ্যত কল্যাণের দিকে।
তিনি একটু থামলেন। এরপর রক্ষী প্রধানকে বললেন, আমার ঘোড়া প্রস্তুত করতে বলো।
এরপর তিনি উপস্থিত উপদেষ্টা ও সালারদের দিকে ফিরে বললেন, “আমি কায়রো যাবো। ওখান থেকে আমি তোমাদের জানাবো তোমরা কখন এখান থেকে রওনা হবে।’
তিনি কয়েকজন কমাণ্ডো লিডারকে তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার জন্য দ্রুত প্রস্তুত হয়ে আসতে বললেন।
তারা উঠে দাঁড়ালে তিনি বললেন খবরদার আমার অনুপস্থিতির খবর যেন সৈনিকরা না জানে। আমার তাবু গুটাবে না, এ অবস্থায় রেখে দেবে। যাতে তাদের সন্দেহ না হয়, আমি এখানে নেই।’
কমাণ্ডো লিডাররা বেরিয়ে গেল। তিনি উপদেষ্টাদের দিকে ফিরে বললেন, আমি আপনাদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, যে সব সৈন্য বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আমি তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবো না। আপনারাও কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোন কটুক্তি করবেন না। কেউ যেন ওই সৈনিক ভাইদের ঘৃণার পাত্ৰ মনে না করে সে চেষ্টা করুন।
আমি এ্যাকশন নেবো তাদের ওপর, যারা সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত করেছে এবং জাতিকে বিপথগামী করার জন্য নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আমি জানি, কায়রোর যে সৈন্যদের নামে আজ অভিযোগ উঠেছে তারা ষড়যন্ত্রের শিকার। এরাই যখন শক্রর সামনে যাবে এবং শক্রর তীর আল্লাহর সৈনিক। বিদ্রোহের পোঁকা তখন তাদের মাথা থেকে পালিয়ে যাবে। আপনারা আপনার সন্তানকে এইসব করছে। দেখবেন, তাদের মন স্বাভাবিকভাবেই জুয়ার দিক থেকে জিহাদের দিকে ফিরে আসবে।
আমি আপনাদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সম্মান কেবলমাত্র এইসব থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। তাদের চতুর্মুখী চক্রান্ত বলছে, ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদদের বিরুদ্ধে তারা একটার পর একটা ষড়যন্ত্র করে যাবে। তাদের সকল তৎপরতার উদ্দেশ্য, দুনিয়ার বুক থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা। আমরা এই অপতৎপরতা বরদাশত করতে পারি না।
মনে রাখবেন, মুজাহিদদের মর্যাদা যখন মুসলমানদের কাছে হেয় বা খাটো হয়ে য়ায় তখন মুসলমানদের জাতীয় মর্যাদা এবং সম্মানও বিশ্ব দরবারে ভূলুষ্ঠিত হয়ে যায়। কোন থাকতে পারে না। আমাদের আজকের ভুল, ইসলামকে আগামী কাল অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে। আমাদের আজকের সঠিক পদক্ষেপ, আগামী প্রজনের জন্য বয়ে আনবে সাফল্যের স্বর্ণতোরণ। আমাদের আজকের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা, আগামী প্রজন্মকে নিয়ে যাবে ক্ষতি ও ধ্বংসের অতল গহবরে।
মাননীয় আমীর! একজন উপদেষ্টা বললেন, “আমাদের ভাইয়েরা গাদারীতে নাম লিখিয়ে আগামী প্রজন্মের নিশ্চিত বরবাদী ও ধ্বংসের কাজ তো সম্পন্ন করেই ফেলেছে। তারা এখন ক্রমাগত গোলাম ও দাসে পরিণত হতে থাকবে। স্বাধীনতা কাকে বলে, জাতীয় সম্মান কি জিনিস। এসব কোন অনুভূতিই তাদের থাকবে না। আমাদের কাছে কি এর কোন চিকিৎসা আছে?”
‘এর চিকিৎসা হচ্ছে জাতির বিবেককে জাগ্রত করা!’ প্রজা নয়, জাতির প্রতিটি নাগরিক তার নিজ নিজ অবস্থানে একজন দায়িত্বশীল। তারা যদি বাদশাহর মত স্বাধীন ও সচেতন হয়, তবে জাতির অস্তিত্ব তারাই রক্ষা করবে। এ জন্য কোন ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করবেন না।
আমাদের নেতাদের মধ্যে বাদশাহ হওয়ার প্রতিযোগিতা ও উন্মাদনা শুরু হয়েছে। এ জন্য তারা জাতির প্রতিটি নাগরিককে প্রজা বানিয়ে নিজেদের বাদশাহী ও ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ পশু নয় যে আমরা তাদের জানোয়ারের মত হাকিয়ে বেড়াবো। মানুষের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি আছে, আত্মসম্মানবোধ আছে এবং জাতীয় মর্যাদার অনুভূতি আছে। জাতির এই গুণগুলো বিকশিত থাকলে জাতি নিজেই চিন্তা করে নেয়, কিসে তার ভাল আর কিসে মন্দ। যদি জাতি মনে করে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর সুরক্ষিত রেখে রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটাতে পারবেন, তাহলে জাতির যে কেউ আমার পথ আগলে যেন উচ্চারণ করে, সালাহউদ্দিন, তুমি এখন মসনদ খালি করো, আমরা তোমার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পেয়েছি। জাতির মধ্যে এ চিন্তা চেতনা ও সাহসের বিস্তার ঘটুক, যাতে কেউ ফেরাউনের মত দাম্ভিক হতে না , পারে। শাসকের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তার শিরচ্ছেদ করার দুঃসাহস যেন জন্ম নিতে না পারে কোন শাসকের মনে।
রক্ষী ভেতরে প্রবেশ করলো। সালাম দিয়ে বললো, আমীর, আপনার ঘোড়া প্রস্তুত।”
ততোক্ষণে সঙ্গে যাবার জন্য যাদের নাম বলেছিলেন, তারাও তৈরী হয়ে চলে এল। সুলতান আইয়ুবী তাদের মধ্য থেকে বারোজনকে সাথে নিলেন। অন্যদের বললেন, “তোমরা এ তাবুর চারপাশে পাহারা দিতে থাকবে। কেউ যেন জানতে না পারে, আমি এখানে নেই।’
তিনি বারজন কমান্ডোকে বললেন, মাইলখানেক পূবে যে ছোট্ট পাহাড় দেখা যাচ্ছে তার ওপাশে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো। প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে যাবে। তোমাদের গতি দেখে কেউ যেন বুঝতে না পারে তোমরা সফরে যাচ্ছো। যাৰে গোপনে এবং একেকজন একেক দিক দিয়ে যাবে।
সফরসঙ্গী বেড়িয়ে গেলে তিনি দ্রুত তৈরী হয়ে বাইরে এলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে রওনা হয়ে গেলেন নির্দিষ্ট স্থানে।
সন্ধ্যায় সাদিয়া ইমামের জন্য খাবার নিয়ে এসে মাহমুদকে দেখে থতমত খেয়ে গেল এবং হেসে দিল।
মাহমুদ বলল তুমি আমার জন্য খাবার আনবে না?
সাদিয়া এর কোন জবাব না দিয়ে ইমামের খাবার রেখে দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রুটি ও বকরির দুধ নিয়ে ফিরে এলো সে।
সাদিয়া চলে যেতেই ইমাম সাহেব বললেন, “এ মেয়েটি গ্রামের সবচে সুন্দরী মেয়ে। বয়স কম, কিন্তু মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতি। আফসোস! মেয়েটি শীগগীরই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
‘বিক্রি হয়ে যাচ্ছে?’ অবাক হয়ে মাহমুদ প্রশ্ন করল, “মানে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে?”
না, বিয়ে নয়, বিক্রি। ইমাম সাহেব বললেন, ‘তুমি তো জানো এ ধরনের গরীব লোকের সুন্দরী মেয়েরা বিয়ের নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু সাদিয়ার ব্যাপারটা আরো ব্যতিক্রম। বলতে গেলে সে সরাসরিই বিক্রি হচ্ছে। যে তাকে খরিদ করতে চায় সে সন্দেহভাজনদের একজন। লোকটি এখানকার বাসিন্দা নয়, মনে হয় যারা আমাকে হুমকি দিয়েছিল সে তাদেরই কেউ।
মাহমুদ কেমন একটু বিমর্ষ হয়ে গেল, কিন্তু কিছু বলল না।
ইমাম সাহেবই মুখ খোললেন আবার, এই মেয়েকে তারা ট্রেনিং দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে, এ কিন্তু সে একটি মুসলিম পরিবারের কন্যা। তার ইজ্জত ও সম্মানের হেফাযত করা ইসলামের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। আমি মেয়েটিকে কিছুতেই বিক্রি হতে দেবো না। সাদিয়ার বাবা আমার ভক্ত। কিন্তু সে গরীব ও অসহায়। মেয়েকে বাঁচানোর কোন সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু আমরা আছি। সাদিয়ার মান সম্মান ও সতীত্ব রক্ষার দায়িত্ব এখন আমাদের। এটা আমাদের ঈমানী ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সুতরাং কঠিন হলেও এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কোন সুযোগ নেই আমাদের।”
প্রকাশ্যে ছাত্র ও তালবে এলেম হলেও আসলে ইমাম সাহেবের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও গার্ড হযে গেল মাহমুদ। এখন নিয়মিত সাদিয়ার সাথে তার একাধিকবার দেখা হয়। দিন যতই যেতে লাগলো, মাহমুদের সঙ্গে সাদিয়ার ঘনিষ্ঠতাও বাড়তে লাগলো। বুদ্ধিমতি সাদিয়া দেশ গ্রামে কখন কি ঘটে সব খোঁজ খবর রাখতো। সাদিয়ার কাছ থেকেই কথায় কথায় মাহমুদ জেনে নিত আশপাশের সব গ্রামের সংবাদাদি। জেনে নিত স্থানীয় জনমত।
এর মধ্যে একদিন একটি ঘটনা ঘটল। সাদিয়া প্রতিদিন চারণভূমিতে বকরী ও উট চরাতে যায়। মাহমুদও সময় পেলেই ছুটে যায় সেখানে। একদিন মাহমুদ সাদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, যে লোকটা তোমাকে খরিদ করতে চায়, সে কে?”
এ কথায় সাদিয়ার চেহারা বিমর্ষ হয়ে গেল। বললো, ‘আমি চিনি না, কোনদিন তাকে দেখিনি। কোথায় বাড়ি, কি করে কিছুই আমার জানা নেই। যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিল সেদিন এক পলকের জন্য একটু দেখেছি, এর বেশি আর কিছু জানি না।’
তাহলে সেই অচেনা লোকটি তোমাকে এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখেও গেছে!
সাদিয়ার মনটা আরো বিমর্ষ হয়ে গেল। মনে পড়ল লোকটা তাকে এমন ভাবে দেখেছে, যেন সে হাট থেকে গরু ছাগল কিনতে এসেছে।
সাদিয়া জানতো, তার যা রূপ যৌবন তাতে সে কোন লোকের স্ত্রী হতে পারবে না। তার আগেই আরবের কোন ধনী বণিক, কোন আমীর বা উজিরের দালাল ছুটে আসবে তাকে কিনে নিতে। গরীবের ঘরের রূপসীদের না পেলে এসব নবাবজাদাদের অন্দর মহলের শোভা বর্ধন হয় না, আভিজাত্য রক্ষা হয় না। তাই টাকার বাণ্ডিল নিয়ে দালালরা ঘুরে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে। কোন ঘরে রূপসী সুন্দরীদের দেখলেই শুরু করে দরদাম। এভাবেই একদিন গ্রামের কুঁড়েঘর থেকে ওরা ঠাই পায় শাহী প্রাসাদে। শোকেসে সাজানো তৈজসপত্রের মতই যুগ যুগ ধরে।
ওরা বন্দী থাকে সুরম্য অট্টালিকায়। সেখানে ওদের কোন ঘর সংসার হয় না, ছেলে সন্তান থাকে না। কেবল দিনে দিনে বয়স বাড়ে, একদিন বুড়ী হয়, তারপর কোন রকম পিছুটান না। রেখেই একদিন টুপ করে মরে যায়। তাদের জন্য এ পৃথিবীতে কান্নারও কেউ থাকে না, প্রার্থনা করারও কেউ না।
যৌবনের কয়েকটা দিন ওরা বেশ সমাদরে থাকে। নাচ গান শিখিয়ে আনন্দ স্ফূর্তির সামগ্ৰী বানিয়ে ওদের পরিবেশন করা হয় মেহমানদের সামনে। মেহমানরা তাদের গান শুনে, নাচ দেখে হাততালি দেয়, এটুকুই তাদের জীবন।
সাদিয়া তাদের গ্রামের এমন অনেক হতভাগ্য মেয়ের জীবন কাহিনী শুনেছে। জানে, তাকে নিয়েও হয়তো একদিন কাহিনী হবে, কিন্তু সমাজ ও সংসারে জায়গা হবে না তার। এ নিয়ে খুব ভাবতো সে। কারণ, গ্রামের সহজ সরল মেয়ে হয়েও সে ছিল খুব বুদ্ধিমতি। তাই সে তার জীবনের ভালমন্দ নিয়ে ভাবতো।
মাহমুদকে দেখার পর তার অন্তরে যে নতুন আবেগ এসে ভর করলো, সে আবেগ তার চিন্তাধারায় এনে দিল নতুন গতি। সে অনুভব করলো, সে যেমন মাহমুদকে ভালবাসে, মাহমুদও তেমনি ভালবাসে তাকে। তার মনে হলো, জীবন মানুষের একটাই, বন্দী পাখির মত ছটফট করে এ জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতা কি! তারচে জীবনকে ভালবেসে যে কটা দিন বাঁচা যায়, সে বাঁচায় আনন্দ আছে, সুখ আছে, সার্থকতা আছে।
না, সে আর বিক্রি হবে না। যদি মাহমুদ রাজি হয় তবে তাকে নিয়ে সে জীবনটাকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তুলবে।
হোক সে জীবন সংক্ষিপ্ত। মানুষ আর কদিন বাঁচে। মহাকালের স্রোতধারায় মানুষের জীবন একটি বুদবুদ বৈ তো নয়! তার বুদবুদটুকু না হয় আরেকটু ছোট হলো!
কিন্তু এসব কি ভাবছে সে! তার বিক্রির কথা তো পাকাপাকি হয়ে গেছে। এখন যে কোন দিন খরিদার এসে টাকা দিয়ে নিয়ে যাবে তাকে।
সে ব্যাকুল নয়নে মাহমুদের দিকে তাকালো। বললো, মাহমুদ, তুমি এ প্রসঙ্গ এখন কেন তুললে! কেন মনে করিয়ে দিলে আমি মানুষ নই, ধনীদের শখের সামগ্ৰী? কেন তুমি এভাবে আমার কষ্টের কথা আমাকে মনে করিয়ে দিলে? তার কণ্ঠে কান্নার মিহিদানা।
তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছো, এ কথা যতবার মনে হয় ততবার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে। ভাবি, একজন মুসলমান হিসাবে আমার কি কিছুই করার নেই? আল্লাহর বিধানে এভাবে নারীদের ক্রয়-বিক্রয় করার কোন সুযোগ নেই। বিক্রি তো দূরের কথা, এমনকি মাতার। অথচ যারা কিনছে, যারা বিক্রি করছে এবং আমরা যারা এ অন্যায় দেখছি ও শুনছি, আমরা সবাই নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করি।
‘আমার আব্বা একজন অসহায় ও গরীব মানুষ। সামাজিক কারণেই এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া আব্বার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমাকে বিয়ে করার জন্য এখনো কেউ প্রস্তাবও দেয়নি, ফলে আব্বা নিরূপায়।”
কেউ যদি বিয়ে করতেচায় তাতে তোমার আব্বা রাজি হবেন?
কেন হবেন না? আব্বা তো ইচ্ছে করে বা টাকার লোভে এ প্রস্তাব কবুল করেননি, করেছেন দায়ে ঠেকে, সামাজিক চাপের মুখে।
আমার কাছে কিছু টাকা থাকলে তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতাম। কিন্তু তাকে খুশি করার মত কিছুই যে নেই আমার কাছে! আমার কাছে যা আছে তাতে তোমার বাবার মন ভরবে না।
আমার বাবার মন কিসে ভরবে আর কিসে ভরবে না প্রস্তাব পাঠানোর আগেই কিভাবে ফয়সালা করলে! তুমি যা দিতে পারো তা আমাকে বলো, আমি বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব নিচ্ছি।’ বলল সাদিয়া।
‘আমার কাছে তো এখন দেয়ার মত একমাত্র মন ছাড়া আর কিছুই নেই সাদিয়া’, মাহমিদ বলল, ‘জানি না আমার মনের মূল্য বোঝ কি না?’
যদি তোমার মনে আমার জন্য ভালবাসা থাকে তবে তা আমার জন্য অনেক বেশি পাওনা। সাদিয়া বললো, তুমি ঠিকই বলেছো, আমার বাবার কাছে এ মূল্য গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু আমি তোমাকে এ কথাও বলবো, আমার বাবা আমাকে বেঁচতে চান না। তার দুর্বলতা, তিনি গরীব ও সংসারের একমাত্র পুরুষ। আমার কোন ভাই নেই। সে লোক বাবাকে হুমকি দিয়েছে, যদি বাবা স্বেচ্ছায় আমাকে বিক্রি না করে তবে আমাকে ওরা কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাবা আমাকেও হারাবে, টাকাও হারাবে। বাবা লোকটাকে পছন্দ করে না, কিন্তু নিরূপায় হয়ে রাজি হয়েছে।
‘তোমার বাবার লোকটাকে পছন্দ না করার কারণ? মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো, ‘এ গ্রামে তো মেয়েদের বিক্রি করা নতুন কিছু নয়?”
বাবা বলেছেন ‘লোকটা মুসলমান নয়’ সাদিয়া বলল, আর আমিও বাবাকে বলে দিয়েছি, ‘আমি কোন অমুসলিমের সাথে যাবো না।’
একটু চুপ করে থেকে সাদিয়া আবার মুখ খুললো। অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, মাহমুদ, তুমি কি সত্যি আমাকে ভালবাসো। বলো, তুমি যদি চাও আমি তোমার সাথে পালিয়ে যেতে প্রস্তুত আছি।
‘তুমি জানো আমি তোমাকে সত্যি ভালবাসি। হ্যা! আমিও প্রস্তুত!’ মাহমুদ আবেগে বললো।
তবে চলো আজ রাতেই আমরা এ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাই।’ সাদিয়াও উৎসাহের সাথে বললো।
না! আজ রাতে নয়!’ মাহমুদের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, আমি আমার দায়িত্ব পূর্ণ না করে যেতে পারবো না।’
‘কোন দায়িত্বের কথা বলছো?” সাদিয়া প্রশ্ন করলো।
মাহমুদ বিন আহমদ চমকে উঠলো। সাদিয়াকে সে দায়িত্বের কথা বলা যায় না। সে তার মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কথাকে গোপন করতে চেষ্টা করলো। সাদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল আমি ইমাম সাহেবের কাছে তালিম নিতে এসেছি। সে শিক্ষা শেষ না করে আমি কোথাও যেতে পারব না।’
জানিনা ততোদিনে আমার পরিণতি কোথায় গিয়ে পৌছবে।’ সাদিয়া আক্ষেপের সুরে বললো।
একটি মেয়ের জন্য মাহমুদ দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীন হতে রাজী নয়। তা ছাড়া মেয়েটি শক্রদের গোয়েন্দা দলের। কেউ নয় এ নিশ্চয়তা কে দেবে! এখনো তার ব্যাপারে আরো খোঁজখবর নেয়া দরকার আছে বলে মনে হলো তার। সাদিয়াকে তার ভাল লাগে ঠিকই, কিন্তু এসব ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে হুট করে কিছু করে ফেলা সে ঠিক মনে করলো না। বললো, সাদিয়া, অস্থির হয়ো না, আল্লাহ আছেন, আমাদের ভাল-মন্দ তিনিই দেখবেন। সবুর করো, আমি তো তোমার কাছেই আছি। তেমন কিছু হলে তখন দেখা যাবে।’
গভীর রাত। মরুভুমির অন্ধকার ভেদ করে প্রাণপণে ছুটে যাচ্ছে চৌদ্দটা ঘোড়া ! সালাহউদ্দিন আইয়ুবী অন্ধকার কেটে যাওয়ার আগেই কায়রো পৌছতে চাচ্ছিলেন। সুলতানের সাথে এ সফরে ছিলেন তার নিত্য সহচর এবং প্রতিটি বিজয়ের গর্বিত অংশীদার আলী বিন সুফিয়ান। আর ছিলেন শত প্রতিকুলতা, সংকট ও সংঘাতে পরীক্ষিত কয়েকজন বিচক্ষণ জানবাজ সহযোদ্ধা।
রাতের আঁধার কেটে যখন তারা তীব্র বেগে ছুটে চলেছেন কায়রোর দিকে, তখন তার সৈন্যরা নিশ্চিন্তে তাবুতে গভীরে নিদ্রায় বিভোর। জাগ্রত প্রহরীরাও জানতে পারেনি সালারে আযম কখন চলে গেছে তাবুর বাইরে।
কায়রোর সেনাবাহিনী এবং অধিবাসীরা জানে সুলতান আইয়ুবী কায়রো থেকে অনেক দূরে ক্রাকের দূর্ভেদ্য দুর্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কল্পনাও করেনি, সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনী নিয়ে কায়রোর এত কাছে অবস্থান করছেন। রাতের শেষ প্রহরে যখন সুলতান আইয়ুবী কায়রো প্রবেশ করেন তখনো ঘুম ভাঙেনি শহরবাসীর।
শহরে প্রবেশ করতে কেউ তাদের বাঁধা দেয়নি, কারণ সেখানে কোন প্রহরীই ছিল না।
সুলতান আইয়ুবী সাথীদের বললেন, শহরের নিরাপত্তা ভার যাদের কাঁধে, তারা কেউ পাহারায় নেই, এটা কি বিদ্রোহ নয়? সৈন্যরা আরামে ঘুমাচ্ছে, তারা নির্ভয় ও দায়িত্বহীন। যে দেশের সৈন্যরা দুটি রণাঙ্গণে প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত, সে দেশের সৈনিকদের এ নির্লিপ্ততা ও দায়িত্বহীনতাই এক ধরনের বিদ্রোহ।”
কায়রোতে তার নির্দিষ্ট স্থানে পৌছলেন সুলতান। সারা রাতের পথশ্রমে ক্লান্ত তিনি, কিন্তু এক মুহূর্তও বিশ্রামের সুযোগ নিলেন না, সঙ্গে সঙ্গে মিশরের প্রতিরক্ষা প্রধানকে ডেকে পাঠালেন। প্রতিরক্ষা প্রধান সুলতান আইয়ুবীকে ভয়ে থতমত খেয়ে গেল।
তিনি কায়রোর প্রতিরক্ষা,প্রধানকে নিয়ে বসলেন। বিশদ রিপোর্ট পেশ করতে। প্রতিরক্ষা প্রধানের বক্তব্য শেষ অবস্থা জানতে চাইলেন। প্রতিরক্ষা প্রধান সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা সুলতানের হাতে তুলে দিলেন।।
সবকিছু শোনার পর সুলতান আদেশ দেয়া আরম্ভ করলেন। বললেন, ‘যে সকল সামরিক অফিসার সন্দেহভাজন তাদেরকে কেন্দ্রীয় কমাণ্ডে নিয়ে যাও। এই মুহুর্তে সেনা ছাউনিতে যত সৈন্য আছে সবাইকে সূর্য উঠার আগেই যুদ্ধ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে বলো। সৈন্যদের বলবে, আমি কায়রোতে এসেছি ওদের নিয়ে যেতে এবং এখুনি তাদেরকে আমার সাথে ময়দানে রওনা হতে হবে।’
তিনি প্রতিরক্ষা প্রধানকে আরও কিছু জরুরী নির্দেশ দিয়ে বিদায় করলেন। ফিরলেন আলী বিন সুফিয়ানের দিকে। আলী বললেন, সুলতান, আমার জন্য আপনার নির্দেশ কি? সুলতান তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বিদায় করলেন।