আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এই জংলী নিগ্রোদের স্বাগত জানানোর অভ্যর্থনাকারী একজন এগিয়ে এসে আগত দলের সরদারকে বললো, “তাহলে ঠিক মতই আসতে পেরেছেন। যাক, মেয়েরা ভালই কাজ দেখাতে পেরেছে।”
“হ্যাঁ।’ সরদার বললো, “আমিও তাদের বাজনার সুর ও নাচের ঝংকার শুনতে পেয়েছি। দশ-বারো জনকে আমি সেখানে দর্শক হিসেবে পাঠিয়েছিলাম। তাদের একজন এসে সংবাদ দিল, মাহফিল খুব জমে উঠেছে, এখন রাস্তা একদম ফাঁকা। সমস্ত প্রহরী ও সৈনিক আসরে চলে গেছে।” এ খবর পেয়ে আর দেরী করিনি, সাথে সাথে চলে এসেছি।”
“নীল নদের পাড় থেকেও ভাল সংবাদ পাওয়া গেছে।” অপর এক অভ্যর্থনাকারী বললো, “ওখানকার মেয়েরাও কাজ গুছিয়ে নিতে পেরেছে। আগামী কাল রাতে যে দু’জন সেন্ট্রি পাহারায় আসবে তাদরেকে এরই মধ্যে ফাঁসিয়ে নিয়েছে ওরা। আমি সংবাদ পাঠিয়েছি, আগামী কাল রাতে কমপক্ষে তিনটি বিশাল নৌকা বোঝাই করে আমাদের লোকেরা যেনো চলে আসে।” তারা সামনে এগিয়ে চললো। পাহাড় ক্রমশ: উঁচুতে উঠে গেছে। বেশ কিছুটা পথ উঠার পর সরদার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে দলের সবাই দাঁড়িয়ে গেল। এরপর আরেক দল লোক এসে ওদের পাহাড়ের অভ্যন্তরে ফেরাউনের তৈরী যে অসংখ্য গুহাঘর ছিল ওখানে নিয়ে গেল। চারদিকে পাহাড়ের অভ্যন্তরে অসংখ্য গুহাঘর, মাঝখানে এক মাঠ। সবাইকে নিয়ে হাজির করা হলো সে মাঠে।
দলের সরদার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল নেতৃস্থানীয়দের সাথে। যেতে যেতে সরদার বললো, “আপনারা ভুলে যাবেন না, এরা সবাই কুসংস্কার ও পূজা-পার্বনে বিশ্বাসী। এরা কোন উদ্ভট ও হাস্যকর আচরণ করলে বিস্মিত হবেন না, বরং সেগুলোকে সম্মানের চোখে দেখবেন।
আমরা তাদেরকে ধর্মের নামে ডেকে এনেছি। তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়েছি, তোমাদেরকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবো, যেখানে ভগবান স্বয়ং বাস করেন। যে ভগবান বালিকে গরম রাখেন, সূর্যকে উত্তপ্ত করেন, আকাশ থেকে পানি ও বিজলী বর্ষণ করেন।”
“এ নিয়ে ভাববেন না আপনি। কোন সমস্যা হবে না।”
“সমস্যা একটা আছে। এ সব লোকেরা কোন অভিযানে বেরোনোর আগে ভগবানের নামে মানুষ কোরবানী দিয়ে অভ্যস্ত।”
‘কোরবানী কি পুরুষ দিতে হবে, না নারী? নাকি নারী ও পুরুষ উভয়কেই দিতে হবে?”
“মানুষ হলেই চলবে। যদি আমরা তাদের এই প্রথা পূরণ করি তবে তারা নিঃশঙ্ক চিত্তে লড়াই করতে পারবে। তারা তখন এমন বেপরোয়া হয়ে যায় যে, কোন বাঁধাকেই পাত্তা দেয় না। কায়রো শহরে ওরা একবার ঢুকতে পারলে ইট দিয়ে ইট ভাঙবে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ওদের সামনে একদিনের বেশী টিকতে পারবে না।”
মাঠে পৌঁছলো সরদার ও নেতৃবর্গ। সরদার সামনে দণ্ডায়মান নিগ্রো বাহিনীকে বললো, “তোমরা সিজদায় পড়ে যাও। কারণ তোমরা এখন ভগবানের ঘরে এসে গেছো।”
সবাই সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় পড়ে গেল। একটু পর সরদারের আদেশে আবার তারা উঠে দাঁড়ালো।
এ দলটি ছিল সুদানের হাবশী ক্রীতদাসদের। এদের মিশরে প্রবেশ করানো হচ্ছিল নাশকতামূলক কাজের জন্য। সীমান্ত রক্ষীদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে এদের মিশর অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করার জন্যই নীলনদের পাড়ে বাণিজ্য কাফেলা এবং এখানে নর্তকী ও গায়ক দলের সমাবেশ ঘটানো হয়। অনুপ্রবেশের জন্য বেছে নেয়া হয় সেই দুৰ্গম ফেরীঘাট, যা পার হয়ে সামান্য এগুলেই অভিশপ্ত পার্বত্য অঞ্চলের ভয়ানক ও বিস্তৃত এলাকা অবস্থিত।
এলাকাটি ভীষণ দুৰ্গম এবং ছোট বড় অসংখ্য পর্বতমালায় সজ্জিত। এখানে আছে ফেরাউনের যুগের পর্বত গহ্বর, যেখানে মাটির নিচে ফেরাউনের তৈরী মহলের অসংখ্য ছোট বড় কামরায় বিরাট সৈন্য দল, ঘোড়া ও উটের বহর অনায়াসে লুকিয়ে রাখা সম্ভব।
সুদানের এই নিগ্রো হাবশীরা রক্তের হোলি খেলায় ছিল ওস্তাদ। মানুষকে তারা পশুর মতই এক প্রকার জন্তু ভাবতো। পশু শিকারের মতই মানুষ শিকারেও ওরা ছিল সিদ্ধহস্ত।
মিশরে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এদের সর্বাত্মক ও গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হলো এই দুৰ্গম পাহাড়ের অভ্যন্তরে।
এমনিতেই যুদ্ধে তারা খুবই পারদর্শী। তাদের মধ্যে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ লেগেই থাকে। এ জন্যই তীরন্দাজী ও বর্শা নিক্ষেপে এদের জুড়ি পাওয়া ভার।
সুদান সরকার খৃস্টানদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে অনেক খৃস্টান সৈন্য ও সামরিক অফিসারকে তাদের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। এরাই সুদানী হাবশীদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের কমান্ডো প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলছে।
এর আগে সুদানী বাহিনী মিশরীয় বাহিনীর কাছে দু’বার পরাজিত হয়েছে। তৃতীয়বার সুলতান আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিন সুদানের ওপর আক্রমণ চালালে সুদানীরা সে আক্রমণ প্ৰতিহত করে।
তকিউদ্দিনের সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়লে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দ্রুত তাদের সাহায্যে এসে কোন রকমে অবশিষ্ট সৈন্যদের ফিরিয়ে এনেছিলেন।
তকিউদিনের বাহিনীর এই বিপর্যয়ের পরও সুদানীরা মিশরীয়দের পিছু ধাওয়া করা বা মিশর আক্রমণের সাহস করেনি। ঐতিহাসিকদের মতে, যদি তখন সুদানীরা মিশর আক্রমণ করতো। তবে তকিউদিনের পক্ষে মিশর রক্ষা করা কঠিন হয়ে যেত।
বারবার ব্যর্থতার কারণে খৃস্টানরা যুদ্ধের পদ্ধতি পরিবর্তন করলো। তারা সুলতান আইয়ুবীর মত গেরিলা যুদ্ধের কথা চিন্তা করতে লাগলো। তারা দেখলো, সুলতান আইয়ুবীর অল্প সংখ্যক কমাণ্ডো বিশাল বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তছনছ করে দেয় তাদের। ওরা সামনাসামনি যুদ্ধ করে না, চোরাগুপ্ত হামলা চালিয়ে মুহুর্তে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এই অল্প সময়েই আক্রান্তরা সম্মুখীন হয় বিপুল ক্ষতির।
এ ধরনের আক্রমণের জন্য দরকার বাছাই করা সৈন্য এবং পর্যাপ্ত ট্রেনিং। সাধারণ সৈন্যরা সামনাসামনি দল বেঁধে যুদ্ধ করতে পারলেও এ ধরনের ঝটিকা আক্রমণে সুবিধা করতে পারে না। এ জন্যই সুদানীরা হাবশীদের নিয়ে এই নতুন বাহিনী গড়ে তোলার জন্য তৎপর হলো।
এদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা আছে, আছে ক্ষিপ্ৰতা ও অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার ট্রেনিং। এই ট্রেনিং আরেকটু শানিয়ে নিলে এরা হবে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তারা কায়রোবাসীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে হয়তো কায়রো দখল করা সম্ভব হতে পারে। কারণ এখন সুলতান আইয়ুবী মিশরে নেই।
এই সুবৰ্ণ সুযোগ ব্যবহারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল সুদানীরা। তাদের বিশ্বাস, সুলতান আইয়ুবীর অবর্তমানে তাদের এ আক্রমণ প্ৰতিহত করার ক্ষমতা মিশরে আর কারো নেই। তারা অনায়াসেই কেল্লা ফতেহ করে নিতে পারবে।
তারা আরো ভাবল, যদি এ আক্রমণের নেতৃত্ব মিশরের কোন গাদ্দার সেনাপতির হাতে দেয়া যায়, তবে সে ভাল করেই জানবে কোথায় কেমন করে আঘাত হানলে সহজে বিজয় অর্জন সম্ভব। অল্প সময়ে, অল্প শক্তি ব্যয় করে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য তারা সুলতান আইয়ুবীর বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ সেনাপতি আলকিন্দিকে বাছাই করলো। আলকিন্দি সুদানীদের টোপ গিলে রাজি হয়ে গেল এই আক্রমণে নেতৃত্ব দিতে।
সুদানের হাবশী সৈন্যদের গোপন স্থানে রাখার ব্যবস্থা আলকিন্দিই করেছিল। সে মিশরের সেনাবাহিনীর চার পাঁচজন জুনিয়র কমাণ্ডারকে কৌশলে তার সঙ্গী বানিয়ে নিল। গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সুদানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিল সে।
ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য হাবশী সৈন্যদের সে এবং তার অনুগত কমাণ্ডাররা গোপনে মিশরের মাটিতে প্ৰবেশ করাচ্ছিল।
সারারাত ক্যাম্পে নাচ-গানের আসর চললো। সকালে অন্য ক্যাম্পের কমান্ডার বিদায় নিয়ে যাত্রার সময় এই ক্যাম্পের কমান্ডারকে বললো, ‘আগামী রাতে তোমার দাওয়াত আমার ক্যাম্পে।”
সে বাদক দল এবং নর্তকীদেরও দাওয়াত দিল এক রাত তার ওখানে থেকে যাওয়ার জন্য। বাদক দল খুশী হয়েই কবুল এ দাওয়াত।
এরা ছিল আলকিন্দির প্রেরিত লোক। ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করার স্বার্থে আলকিন্দি চাচ্ছিল, সুদানী গেরিলারা সীমান্ত রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে মিশরে ঢুকে পড়ুক। তাদের অনুপ্ৰবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই আলকিন্দি এই ফন্দি এঁটেছিল।
এরা অন্য গ্রামে যাচ্ছিল, এটা ছিল মিথ্যা কথা। তারা আগেই প্ল্যান করে এসেছিল, ক্যাম্পের কাছে গিয়ে পানি পান করার বাহানায় তারা ক্যাম্পে ঢুকে যাবে। এরপর ক্যাম্পের লোক ও কমাণ্ডারকে জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করবে।
এদের সাথের নর্তকী দু’জনের চেহারা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। কমাণ্ডার দেখেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হলো। সে এই আনন্দে শরীক হওয়ার জন্য অন্য ক্যাম্পের কমাণ্ডারকেও আমন্ত্রণ জানালো। আর এই আনন্দ উৎসবের সুযোগে পঞ্চাশজন অঞ্চলে প্ৰবেশ করলো।
পরের দিন। সন্ধ্যার পর পর নর্তকী ও বাদক দল নদীর পাড়ের ক্যাম্পে গিয়ে উপস্থিত হলো। সেখানেও নাচ-গানের আসর জমজমাট করে তুললো ওরা।
রাতের দ্বিপ্রহর। নদীর পাড়ে পাহারা দিতে রওনা হলো দুই সিপাহী। সঙ্গীরা বললো, “এমন আসর ছেড়ে ডিউটিতে গিয়ে কি লাভ? থাক না আজ ডিউটি।”
কমাণ্ডার তখন রূপসী নর্তকীদের নিয়েই মহা ব্যস্ত। কে ডিউটিতে যাচ্ছে, আর কে আসছে। সে দিকে তার কোন খেয়াল নেই।
কিন্তু তারা এই বলে যাত্রা শুরু করলো, “তোমরা মউজ করো। আমাদের কপাল মন্দ, কি আর করা! ডিউটিতে অবহেলা করে কমাণ্ডারের গালমন্দ খেয়ে কি লাভ?”
আর মনে মনে বলছিল, “তোমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাও, দুধ টুকু আমরাই খেয়ে আসি।”
ওদের জন্য যে এর চেয়েও আকর্ষণীয় আসর পড়ে আছে, সে কথা কাউকে বললো না। মধুর স্বপ্ন দেখতে দেখতে এগিয়ে চললো দুই সিপাহী। বুকের মধ্যে সেই সুন্দরী মেয়েদের ছবি, যারা কাল প্ৰেম নিবেদন করেছে ওদের কাছে। ওরা বলেছে, তাদের দু’জনেরই স্বামী বৃদ্ধ, তারা সেই বুড়ো স্বামীর হাত থেকে মুক্তি চায়। ঘর বাঁধতে চায় এই সিপাহীদের সাথে।
তাই ডিউটির গরজের চেয়ে রূপসীদের সাথে মিলিত হওয়ার গরজটাই ওদের বেশী। এই গরজটাই ওদের টেনে নিয়ে চললো সেই বাগানের দিকে।
এতদিন ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তাদের তেমন তাড়া ছিল না। ধীরে সুস্থে ঘোড়াকে হটিয়ে নিয়ে পথ চলতো। কিন্তু সে রাতে দু’জন ক্যাম্প থেকে বেরিয়েই বিপুল বেগে ছুটিয়ে দিলো ঘোড়া। বনভূমির কাছে এসে নদীর পাড়ে এক জায়গায় ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়লো। ঘোড়া দু’টো বেঁধে রেখে এগিয়ে গেল দুজন।
কোথায় ওরা মিলিত হবে, আগেই বলে দিয়েছিল মেয়েরা। সে অনুযায়ী আরেকটু এগিয়ে দুই বন্ধু আলাদা হয়ে গেল। ধীর পদে এগিয়ে গেল নির্দিষ্ট জায়গায়।
সময় মতই অভিসারে বেরিয়ে আসে দুই মেয়ে। নির্দিষ্ট জায়গায় বসে সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ওরা।
নদীর পাড় থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের নির্জন গুহায় অভিসারে মেতে উঠলো দুই যুগল। মেয়েরা তাদের রূপ ও যৌবনের পসরা মেলে ধরল সৈন্যদের সামনে। ভালবাসার যাদুর বাণ ছুড়ে দিল তাদের ওপর। দুজনেই বললো, “ঘুমের ওষুধ মেশানো মদ খাইয়ে ঘুমে বিভোর করে রেখে এসেছি স্বামীকে। সারারাত সে আর চোখের পাতা মেলতে পারবে না। আজ সারারাত তোমার সাথে গল্প করে কাটিয়ে দেবো।” ডিউটি ভুলে দুই সিপাই পাহাড়ের নির্জন গুহায় পড়ে রইল মোহময় আচ্ছন্নতায়। জগৎ সংসারের সব কিছু ভুলে ওরা যখন স্বপ্নময় জগতে, ওখান থেকে একটু দূরে, নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে গেল চারটি ছায়ামূর্তি।
কুল কুল রবে বয়ে যাচ্ছে নদীর পানি। লোকগুলো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে পানির ওপর। কোন কিছু অনুসন্ধান করছে ওরা।
নদীর পাড়ে ঘোরাফেরা করতে করতে অধীর হয়ে উঠল ওরা। একজন বলে উঠলো, “এতক্ষণ তো লাগার কথা নয় ওদের আসতে।”
অন্য একজন দূরে তাকিয়েছিল। সে বলে উঠলো, “মনে হয় ওরা আসছে। ওদিকে তাকিয়ে দেখো, ওগুলো নৌকা নয়?” চারজনই তাকালো সেদিকে। “হ্যাঁ, আসছে ওরা।”
জলদি করে তারা একটি লণ্ঠন জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক দোলাতে লাগলো। একটু পর নদীর মাঝেও জ্বলে উঠলো দুটি প্রদীপ, কিন্তু সাথে সাথেই তা আবার নিভেও গেল।
কিছুক্ষণ পরেই একটি বিরাট পাল তোলা নৌকা এসে কুলে ভিড়লো। নৌকার মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে বললো, ‘সাবধান! কেউ কোন শব্দ করবে না।”
পরিপূর্ণ নিরবতার মধ্য দিয়ে কালো হাবশী সুদানীরা নৌকা থেকে একে একে নেমে এলো। একটু পরই তার পাশে এসে ভিড়লো আরও একটি নৌকা। সে নৌকা থেকেও নেমে এলো হাবিশীরা।
দুটো নৌকাই বেশ বড়। কম করেও দুইশ হাবশী নদীর কিনারে নেমে এসেছে।
দ্রুত মাল খালাস করলো ওরা। মাল মানে, যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম ও অন্ত্রপাতি, মালখালাস হতেই মাল্লাদের বলা হলো, জলদি নৌকা ফিরে নিয়ে যাও।
মাল্লারা তাড়াতাড়ি পালের রশি টেনে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে তীর থেকে দূরে সরে গেল। ধীরে ধীরে নৌকা হারিয়ে গেল অন্ধকারে। এভাবেই নৌকায় করে হাবশী সেনাদের আমদানী চলতে থাকলো। নদীর পাড়ে নেমেই ওরা দ্রুত পাহাড়ের দুৰ্গম অঞ্চলে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল।
দুই সিপাহী ক্যাম্পে ফিরে এলো। ততক্ষণে ক্যাম্পের নাচগানের আসর শেষ হয়ে গেছে। রাতভর নাচ দেখে ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরে যাচ্ছে সৈন্যরা। নাচ-গানের জন্য পৃথক তাঁবুর ব্যবস্থা করেছিল কমাণ্ডার। একটি মেয়েকে তার খুব পছন্দ হয়ে গেল। দেখতে মেয়েটি অল্প বয়স্ক ও চঞ্চল। কমাণ্ডার ভাবলো, এরা কেবল নর্তকীই নয়, নিশ্চয়ই পেশাদার নিশিকন্যাও। সে বাজনাদারকে বললো, “এই মেয়েটিকে আমার তাঁবুতে পাঠিয়ে দিও।”
এরা কোন সাধারণ নাচের পার্টি ছিল না, বরং এ লোকগুলো ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। তথ্য সংগ্রহের জন্য আসেনি ওরা, তাদের মিশন ছিল, ক্যাম্পের সৈন্যদের যে কোন মূল্যে ভুলিয়ে ভালিয়ে ক্যাম্পে আটকে রাখা। যাতে সুদান থেকে হাবশী সেনারা নিরাপদে মিশরে প্রবেশ করতে পারে।
তাদের আরও বলে দেয়া হয়েছিল, পারলে কমান্ডার দুজনকে মুঠোয় নিয়ে এসো। ওরা পরেও কাজে লাগতে পারে।”
কমাণ্ডার মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা প্ৰকাশ করতেই সঙ্গে সঙ্গে তার আশা পূরণ করা হলো। মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো কমাণ্ডারের তাঁবুতে।
কমাণ্ডার ছিল মধ্য বয়সী, নর্তকী পূর্ণ যৌবনা। তাঁবুতে যাওয়ার সাথে সাথে মেয়েটির লাস্যময়ী ভাব ও উচ্ছলতা একদম উবে গেল। যে মেয়েটি লম্ফঝম্ফ করে নেচে গেয়ে হাসি তামাশায় দর্শকের মন মাতিয়ে রেখেছিল, নিভে গেল তার দীপ্তি। যে মেয়ের মিষ্টি হাসি কেড়ে নিয়েছিল সবার মন, হারিয়ে গিয়েছিল সে হাসি।
তাঁবুতে তখনও প্ৰদীপ জ্বলছে। মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে তাঁবুর এক কোণে বসে কমাণ্ডারের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইল। কমাণ্ডার বললো, “কি ব্যাপার, তুমি আমন চুপসে গেলে কেনো? আমি ডাকায় মন খারাপ করেছো?”
“আমি কখনও পান করিনা। আমার বাবাও কোন দিন মদ পান করেনি।’ নর্তকী বললো।
“তুমি মদের কথা বললে কেন? আমি তো তোমাকে বলিনি, তুমি মদ পান করো?”
“যারাই ঘরে ডাকে, তারা প্রথমেই বলে, একটু পান করো সুন্দরী। তারপর বলে, আমাকে একটু ঢেলে দেবে?”
“তুমি ঠিকই বলেছো, কথায় বলে, মদ ছাড়া নারী ও নারী ছাড়া মদ একদম বিস্বাদ!” কমাণ্ডার হেসে বললো, “তবে তুমি শুনলে অবাক হবে, আমি কোনদিন মদ পান করিনি, আর ভিন্ন নারীর স্বাদ কেমন তাও জানিনা।”
“ও, তবে তো তুমি এক আনাড়ী পাপী!” নর্তকী বললো, “আমি একটি কথা বললে মন খারাপ করবে?”
“কি কথা?”
কথাটি হলো, ‘গোনাহ করাতে যে মজা, গোনাহ না করার মজা কিন্তু তার চেয়েও বেশী। তুমি পুরুষ মানুষ, এই নির্জন তাঁবুতে আমার মত সুন্দরী মেয়ের কাছ থেকে এ কথা শুনতে হয়তো তোমার ভাল লাগবে না। হয়তো মনে মনে আশ্চর্য ও বিরক্ত হবে। কিন্তু একটু গভীর ভাবে চিন্তা করো, তোমার চেহারাই বলছে, আজ প্রথম তুমি পাপ করার ইচ্ছা পোষণ করেছ। এতো ঠাণ্ডায়ও তোমার কপালে ঘামের ফোটা দেখা যাচ্ছে। এই যে জীবনভর তুমি পাপ থেকে বেঁচে থাকলে, এর মাঝে কি কোন প্রশান্তি নেই?”
“তুমি ঠিকই বলেছ।” মধ্য বয়সী কমাণ্ডার বললো, “আমাকে যখন সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল, তখন পাপ থেকে বাঁচার শিক্ষাও দেয়া হয়েছিল। ট্রেনিংয়ের সময় শারীরিক প্রশিক্ষণের সাথে চারিত্রিক প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত থাকতো। এই কারণেই তো সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী একশ সৈন্য নিয়ে ক্রুসেডদের এক হাজার সৈন্যকে রক্তে ভাসিয়ে দিতে পারতো।”
“কিন্তু এখন তোমার কাছ থেকে একজন দুর্বল মেয়ে অস্ত্ৰ কেড়ে নিতে পারে।” নর্তকী বললো, “তুমি তোমার এতদিনের চারিত্রিক শক্তি সামান্য এক মেয়ের হাতে তুলে দিতে চাও?’
কমাণ্ডার এ কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠলো। সে সহসাই বলে উঠলো, “আমি এমনটি আশা করিনি। তুমি এখানে এসে এ ধরনের কথা বলবে, ভাবিনি। আমি তো চিন্তা করেছিলাম, তুমি এই নির্জনে এসে তোমার চঞ্চল অভিনয়ে, মান অভিমানে আমাকে পাগল বানিয়ে দেবে। তোমার সেই হাসি, গান ও নাচের ভঙ্গি কোথায়, যা আমাকে বাধ্য করেছে তোমাকে ডাকতো?”
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো কমাণ্ডার। তারপর এক সময় মাথা তুলে বললো, “তোমার দলের লোকদের কাছে আমি তোমাকে ভিক্ষা চাই! তোমার দলনেতাকে বলো, বিনিময়ে আমি দুটি আরবী ঘোড়া দেবো।”
“তোমার তলোয়ারও কি দিয়ে দেবে?” মেয়েটি ব্যঙ্গ করে বললো, “তোমার বর্শা, তোমার ঢাল, তোমার খঞ্জর অর্থাৎ তোমার সমস্ত হাতিয়ার কি দিয়ে দেবে?”
সে ব্যগ্র কণ্ঠে বললো, “হ্যাঁ, দেবো, দেবো, সব দিয়ে দেবো!” কিন্তু পরক্ষণেই তার সম্বিত ফিরে এলো। অশান্ত কণ্ঠে সে বললো, “না! সিপাহী কখনও তার হাতিয়ার ছাড়া চলতে পারে না।’
সে তাঁবুর মধ্যেই দ্রুত পায়চারী করতে লাগলো।
হঠাৎ থেমে রাগের সাথে বলে উঠলো, “একজন নর্তকীর মুখে এসব কথা শোভা পায় না। তুমি কি আমার হাত থেকে মুক্তি চাও? এ জন্যই কি এমন কৌশল করছো, যেন আমি তোমার শরীরে হাত না লাগাই?”
“হ্যাঁ। আমি তোমার থেকে আমার দেহ রক্ষা করতে চাই।” মেয়েটি বললো।
‘কেন, তুমি কি অক্ষত? তুমি কি বলতে চাও, তোমার দেহ এখনো পবিত্র?”
“না।’ নর্তকী বললো, “আমি আমার দেহটাকে পবিত্ৰ মনে করি না, এমন দাবীও করি না। কিন্তু আমি আপনার দেহটাকে অপবিত্র করতে চাই না। একজন অপবিত্র লোককে অপবিত্র করায় কোন গ্লানি থাকে না, কিন্তু একজন পবিত্র মানুষকে অপবিত্র করার গ্লানি সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।” কমাণ্ডার তার এ কথা শুনে নির্বোধের মত হয় করে তাকিয়ে রইলো। নর্তকী এবার আরো তীক্ষ্ণ তীর ছুঁড়ে মারলো। বললো, “কোন মেয়েই তার বাবার দেহকে নাপাক করতে চায় না।”
“আহ!” কমাণ্ডার চিৎকার দিয়ে থামিয়ে দিল ওকে। তারপর দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বললো, “ও, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো তুমি। আমি বুড়ো হয়ে গেছি, আর তুমি যে যুবতী!” সে মাথা নত করে বসে রইলো।
নর্তকী উঠে কমাণ্ডারের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “এত নিরাশ হচ্ছেন কেন? আমি তো আপনাকে ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। আপনাকে ছলনাও করছি না। যদি আপনি শুধু একজন পুরুষ রূপেই থাকতে চান, তবে আমি না হয় নর্তকী হয়েই থাকবো। আর নিজের মনকে এই বলে বুঝ দেবো, আমার সামনে এমন একটি পুরুষ পড়েছিল, যে লোক আল্লাহর অভিশাপে পড়ে গিয়েছিল। আমি আপনাকে পিতার মত দেখেছি ও দেখছি। আপনি আমার আর দুটো কথা শুনুন, তারপর যা মনে চায় তাই করবেন, আমি মোটেই বাঁধা দেবো না।’
“কি কথা?”
“আপনার কি মেয়ে আছে?”
“হ্যাঁ, একটি মেয়ে আছে।” কমাণ্ডার উত্তর দিলো।
“তার বয়স কত হবে?”
‘বারো বছর।”
“যদি আপনি মারা যান, আপনার স্ত্রী অসহায় ও দারিদ্রের চাপে আপনার মেয়েকে কোন যাত্রা পার্টি বা নাচের দলে বিক্রি করে দেয়, আপনার আত্মা কি শান্তি পাবে? তখন কি আপনার আত্মা মরুভূমি ও এই পাহাড়ে পর্বতে চিৎকার করে বেড়াবে না? আহাজারি করবে না?”
কমান্ডার বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে।
নর্তকীও অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। দু’জনই চুপচাপ।
একটু পর মেয়েটি আবার বললো, “ভুল বুঝবেন না আমায়। মনে করুন আপনি মরে গেছেন, আপনার মেয়ে এক পাপিষ্ঠের সাথে তার তাঁবুতে বসে আছে। আর সে পাপিষ্ঠ তাকে বলছে, মদ আনো, মদ ছাড়া নারীর কোন মজা নেই।” কমাণ্ডারের ঠোঁট রাগে, অপমানে ও আত্মধিক্কারে কাঁপছিল। সে সহসা গর্জন করে উঠলো, “বেরিয়ে যাও এখান থেকে, বেরিয়ে যাও পাজি মেয়ে।”
মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “যদি আমার বাবা জীবিত থাকতেন, তবে তিনি আমাকে আপনার তাঁবুতে এভাবে দেখতে পেলে দু’জনকেই খুন করে ফেলতেন।”
কথাগুলো বলার সময় আবেগে থর থর করে কাঁপছিল তার গলা। চোখ থেকে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুর ফোঁটা। কমাণ্ডার উঠে তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো। নর্তকী কমাণ্ডারের মানসিক অবস্থা ও রাগকে উপেক্ষা করলো না। বললো, “আমি আপনাকে বৃদ্ধ মনে করে ঘৃণা করেছি, এটা ঠিক না। আমি তো আমার দাদার বয়সী লোকের সাথেও রাত কাটিয়েছি। বয়সের ভার যাকে ভেতর থেকে গুড়ো করে দিয়েছে, সেও তার অর্থের গরমে নিজের লাশের মধ্যে প্ৰাণ সঞ্চার করতে চায়। আপনি এখনও ততটা বুড়ো হননি। কিন্তু আপনার চেহারার সঙ্গে আমার বাবার এত মিল যে, আমি শেষ পর্যন্ত একজন নর্তকী থেকে এক কন্যা হয়ে গেছি।
আমি আপনাকে যে কথাগুলো বললাম, এসব কথা আমার মাথায় আগে কোনদিন আসেনি। এতদিন আমি জানতাম, আমি শুধু নাচতে জানি এবং মানুষকে আঙ্গুলোর ইশারায় নাচাতে জানি। কিন্তু আমি যে এক বাপের কন্যা হতে পারি, আজই প্রথম জানলাম। আমার কথা শুনে আপনি যতো বিস্মিত হচ্ছেন, আমি নিজে বিস্মিত হয়েছি তার চেয়েও বেশী।”
কমাণ্ডার তার দিকে তাকালো, ততক্ষণে তার রাগ পড়ে গেছে।
মেয়েটি আবার বললো, “আমার মা ও বাবার চেহারা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তাদের কোলে পিঠে মানুষ হয়েছিলাম বড় আদরে। তাদের শরীরের উষ্ণতা ও গায়ের গন্ধ এখনো আমি মনে করতে পারি।
আপনার মেয়ের বয়স বারো, আমার তখন বয়স ছিল নয়-দশ। মা-বাবা আমাকে খুব আদর করতেন। আমার বাবা মিশরের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্ষমতায় আসার আগেই তিনি শহীদ হন।
আমার মা তখনও যুবতী। আমরা ছিলাম গরীব। মা আমাকে একটি লোকের হাতে তুলে দিলেন। সে লোক আমার সামনেই মার হাতে আমার মূল্য গুণে দিলো।
লোকটি মাকে বললো, “আপনার মেয়েকে আমি বড় ঘরে ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দেবো।”
বিদায় নেয়ার সময় আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। মা আমাকে সান্তুনা দিয়ে বলেছিলেন, “লোকটি তোমার বাবার বন্ধু। সে তোমাকে তোমার বাবার মতই আদরে রাখবে।”
আমি বারো বছর ধরে আছি লোকটির সাথে। লোকটি আমাকে শুধু আশ্বাস দিচ্ছে, “তোমার নাচ-গান শেখা হলেই তোমাকে ভাল বর, ভাল ঘর দেখে বিয়ে দিয়ে দেবো।”
কিন্তু এখন আমি বড় হয়েছি। বুঝতে পারছি, লোকটি আমার বাবার বন্ধু নয়, বাবাকে সে দেখেওনি কোনদিন। এ লোক কোনদিন আমাকে বিয়ে দেবে না। আমাকে বিয়ে দিলে যে তার আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।
এ লোক আমাকে নর্তকী হতে বাধ্য করলো। নেচে গেয়ে মানুষের মনোরঞ্জনই পেশা হয়ে গেলো আমার। অবশ্য এ লোক আমাকে স্নেহ করেন না, এমন নয়। তিনি আমার মালিক এবং আমার উস্তাদও। আমার সঙ্গে তিনি খুব সদয় ব্যবহার করেন। আমাকে ভাল ভাল খেতে দেন, পরতে দেন।
যখন আমি পরিপূর্ণ যুবতী হলাম তখন আমি নিজেকে নতুন করে চিনতে শিখলাম। বুঝতে শিখলাম আমার জীবনের মূল্য। আর যেদিন আমি তা বুঝতে পারলাম, সেদিন থেকেই আমার আশা ভরসা ও সব স্বপ্ন কল্পনা নিঃশেষ হয়ে গেল।
আমি এখন এক মনোরম মাটির পুতুল। মানুষ এ পুতুল আদর করে মজা পায়, কিন্তু তাতে পুতুলের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আপনাকে দেখে এ পুতুলে আবার প্রাণ ফিরে এলো। জেগে উঠলো বাবা মায়ের সেই আদর ও সোহাগের স্মৃতি।
কথা বলছিল মেয়েটি, কিন্তু তার চোখ দিয়ে অনর্গল গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো, “এখন আমার এমন মনে হচ্ছে, যেন আমার বাবার আত্মা এই তাঁবুর আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। এই তাঁবুতে আসার আগে আমি কি ছিলাম। আর এখন কি হয়ে গেলাম! এমনটি কখনও হয়নি আমার। এখন মনে হচ্ছে, আমার পিতার আত্মা আমার চারপাশে ব্যাকুল হয়ে ছুটাছুটি করছে।”
“তোমার নাচ দেখে বুঝতে পারছি, তুমি বেশ দামী নর্তকী। আমীরদের মহল ও চোখ ধাঁধানো সরাইখানাতেই মানায় তোমাকে। কিন্তু তুমি শহর ছেড়ে এই মরুভূমিতে কেন এসেছে?” শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কমাণ্ডার।
‘আমি উপযুক্ত মূল্য পেয়েই এখানে এসেছি।’ নর্তকী বললো, ‘আমি দলের কাউকে চিনি না। আমাকে শুধু বলা হয়েছে, সীমান্তে যেতে হবে। আর সেখানে যে সকল সেনা ফাড়ি রয়েছে, সেখানকার সিপাহী ও কমাণ্ডারদের মনোরঞ্জন করতে হবে। এর জন্য আমি নতুন করে কোন মূল্য নিতে পারবো না। সৈন্যদের বিনা মূল্যে নাচ দেখাতে ও খুশী করতে হবে আমাকে৷”
“তুমি জানো না, সৈন্যরা দীর্ঘদিন আত্মীয় পরিজন থেকে দূরে থাকতে থাকতে এক সময় নেকড়ে হয়ে যায়? জেনে শুনে তুমি এই নেকড়ের খাঁচায় আসতে রাজি হলে?”
‘কেন আসবো না! আমি কি এক শহীদ পিতার সন্তান নাই? দেশের জন্য আমার বাপ জান দিতে পারলে আমি কি দেশের সেবায় নিয়োজিত মুজাহিদদের একটু মনোরঞ্জনও করতে পারবো না! যে সব সিপাহী ও কমাণ্ডার মিশরের সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত, তাদের আমি সেবা করতে পারছি, এটাই তো আমার বড় পাওয়া!
এই সিপাহীদের খুশী করাই আমার ডিউটি। আমার এই নাচগানে মুজাহিদ পিতার উত্তরসূরীরা যদি চাঙ্গা হয়ে উঠে, শহীদ পিতার আত্মা শান্তি পায়, তবে কেনো আমি তা করবো না।”
কমাণ্ডার এক বাপ হারা মেয়ের বিলাপ শুনছিল, শুনছিল এক নর্তকীর দেশপ্রেমের কাহিনী। বললো, “আমি দুঃখিত, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। এতদিন জানতাম, দেশপ্রেম সৈনিকদের নিজস্ব সম্পদ। আমার সে ভুল ধারনা ভেঙে গেছে, ধোঁকা ও প্ৰবঞ্চনার পর্দা সরে গেছে আমার চোখ থেকে। আজ বুঝতে পারছি, দেশপ্রেম কোন শ্রেণী বা গোষ্ঠীর নয়, দেশপ্রেম দেশের সকল মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ও আদরের সম্পদ। এর জন্য যে কোন ত্যাগ যে কোন সময় হাসিমুখে যারা বরণ করে নিতে পারে, তারাই সত্যিকার মুজাহিদ। তুমি আমাকে কি ভ্ৰান্তি ও ধোঁকার হাত থেকেই না বাঁচালে!”
“আমি আপনাকে কি ধোঁকা থেকে বাঁচাবো, আমার নিজের জীবনটাই তো এক মহা ধোঁকা। এ জীবন যেমন নিজের জন্য ধোঁকা তেমনি অপরের জন্যও। কিন্তু তাই বলে আমি স্বদেশের মুজাহিদদের নাপাক করতে পারবো না। ওই ক্যাম্পের কমাণ্ডার আমাকে তার তাঁবুতে ডেকেছিল।
আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে এসেছি। কিন্তু আপনার কাছে শুধু এ জন্যই এসেছি, আপনার চেহারা অবিকল আমার বাবার মত।’