» » চারদিকে চক্রান্ত

বর্ণাকার

আইয়ুবী এক উঁচু টিলার ওপরে উঠে ময়দানের দৃশ্য দেখলেন। আনন্দ লাভের চেয়ে তার চেহারায় দেখা গেল বিষন্নতার ছায়া।

‘এ দৃশ্য দেখে খোদাও হয়ত বিষন্ন হবেন।’ সুলতান আইয়ুবী তার পাশে দাঁড়ানো অফিসারকে বললেন, “দুদিকেই কাদের রক্ত স্রোত বয়ে যাচ্ছে? মুসলমানদের। এই হলো ইসলামের অবক্ষয়ের নিদর্শনী! যদি মুসলমান এখনও সতর্ক না হয়, তবে কাফেররা এভাবেই মুসলমানদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে নিঃশেষ করে দেবে।”

অফিসাররাও প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত লাশের দিকে তাকিয়েছিল। সে চোখগুলোতে ছিল অপরিসীম বেদনা ও শোকের আর্তি। সুলতান তাদের দিকে ফিরে বললেন, “হে আমার সুখ দুঃখের সাখী ও ভাইয়েরা! তোমাদের কি মনে হয় আমি অন্যায় করছি, ন্যায়ের পথে নেই? যদি বলো তো আমি আমার তলোয়ার আস সালেহের পদতলে রেখে দেই!”

‘না সুলতান! আপনি ঠিক পথেই আছেন। এই যে দেখছেন এতগুলো লাশ, এ লাশগুলো আমাদের ভাইদের। ওদের খুন করেছে আস সালেহের ক্ষমতার মোহ, তার অপরিনামদর্শী চিন্তা ও কাফেরদের ষড়যন্ত্র, আপনি নন।”

অপরজন বললো, “আমাদের অন্তর সাক্ষী, আমরা হকের ওপরেই আছি। মন থেকে সব ওয়াসওয়াসা দূর করুন। এই ষড়যন্ত্রের মূল উৎপাটন করে বাঁচাতে হবে জাতিকে, বাঁচাতে হবে ষড়যন্ত্রের শিকার এইসব ভাইবোনদের, রক্ষা করতে হবে আমাদের ঈমান আমল।”

হলব শহরের প্রতিটি মানুষ আগুনের শিখার মত উত্তেজিত হয়ে ছিল। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা নদী পার হয়ে এগিয়ে চললো হলবের দিকে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল হলব শহরের প্রাসাদের চূড়া।

সুলতান আইয়ুবী তাকিয়ে ছিলেন সেদিকে। তার বিস্তৃতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মনে মনে খতিয়ে দেখছিলেন। ভাবছিলেন, শহরটা কি অবরোধ করবেন, না সরাসরি প্রবেশের জন্য ঝটিকা আক্রমণ চালাবেন।

তিনি তখনও শহরের ভেতরে মানুষে মনের আবেগ ও উত্তেজনার কথা জানতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, শহরের সবাই যেহেতু মুসলমান, দু’পক্ষেরই সমর্থক থাকবে সেখানে। এ চিন্তা থেকেই তিনি এমন পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হলেন, যাতে দুটো পদ্ধতি এক সাথেই কাজে লাগানো যায়। তিনি তার বাহিনী দুই ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগকে অবরোধের নির্দেশ দিয়ে অন্য দল নিয়ে অগ্রসর হলেন সামনে।

যুদ্ধের শুরু হলো তীর বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি অনুভব করলেন, তার বাহিনী পিছু সরে আসছে।

হলব শহরের একদিক থেকে কমপক্ষে দুই হাজার অশ্বারোহী বাহিনী বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই তারা সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর এক পাশে আক্রমণ চালালো।

তাদের গতি ছিল খুব ক্ষিপ্র এবং আক্রমণ ছিল বীরত্বপূর্ণ। সুলতান আইয়ুবী ভেবে পেলেন না, ওরা এতটা বেপরোয়া হওয়ার সাহস পেল কি করে?

অশ্বারোহী বাহিনীর পেছন পেছন বেরিয়ে এল পদাতিক বাহিনী। অশ্বারোহী দল পদাতিক সৈন্যদের আক্রমণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য দু’দিকে ছড়িয়ে পড়ল। মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেল পদাতিক বাহিনী।

কিন্তু সুবিধা করতে পারলো না ওরা। ঘোড়সওয়ারের সাথে লড়তে গিয়ে অনেকেই অশ্ব পদতলে পিশে গেল।

অবস্থা বেগতিক দেখে শহরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নতুন আরেকটি দল। এ দল পদাতিক ও অশ্বারোহীদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের অগ্রযাত্রার সুযোগ করে দিল শহরের বিভিন্ন প্রাসাদের উঁচু জায়গা থেকে ছুটে আসা তীর।

তীরন্দাজদের সহায়তায় এ দলটি সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর কাছাকাছি চলে এলো এবং অদ্ভুত ক্ষীপ্ৰতার সাথে ঢুকে পড়লো আইয়ুবীর বাহিনীর অভ্যন্তরে। মুহুর্তে প্ৰচণ্ড রক্তক্ষয়ী সংঘাত বেধে গেল হলবের ময়দানে।

একদিকে স্বয়ং আইয়ুবীর নেতৃত্বে জান কবুল মুজাহিদ বাহিনী, অন্যদিকে খৃস্টান উপদেষ্টাদের মদদ ও পরিকল্পনায় পরিচালিত খলিফা আস সালেহের রক্ষী বাহিনী।

লড়াইয়ের এ ডামাডোলের মধ্যে সুলতান আইয়ুবীর দুই গোয়েন্দা প্রহরীদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই ওরা সুলতানকে খুঁজতে লাগলো এবং এক সময় তাকে পেয়েও গেল।

সুলতানকে দেখতে পেয়েই তারা ছুটে গেল তার কাছে। বললো, “মাননীয় সুলতান! শহরের জনমতকে তারা আপনার বিরুদ্ধে এমনভাবে ক্ষেপিয়ে তুলেছে যে, শহরের প্রতিরক্ষায় এখন কোন সৈন্যের দরকার নেই, ক্ষিপ্ত জনতাই মরণপণ করে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।”

সুলতান আইয়ুবী আগে থেকেই জানতেন, হলববাসী তার ওপর ক্ষিপ্ত। কিন্তু তারা যে এমন পাগলপারা হয়ে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে, এতটা ভাবতে পারেননি।

এ খবরে তিনি যেমন চিন্তিত হলেন তারচেয়ে বেশী অভিভূত হলেন তাদের এই বীরোচিত ভূমিকায়। আফসোস করে বলতে লাগলেন, ‘হায়! মুসলমানদের এই আবেগ উচ্ছাস ও বীরত্ব প্রদর্শন করার কথা ছিল কাফেরদের বিরুদ্ধে, কিন্তু আফসোস! ষড়যন্ত্রের জালে পড়ে আজ তারা ভাইদের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছে।”

সুলতান আইয়ুবী তাঁর বাহিনীকে পিছনে সরিয়ে নিলেন। এক সহকারী এগিয়ে এসে বলল, সুলতান, শহরে মেঞ্জানিক নিক্ষেপ করার অনুমতি দিন।”

সুলতান আইয়ুবী এই পরামর্শ অস্বীকার করে বললেন, “ওতে শুধু শুধু শহরবাসীর বাড়ী-ঘর ধ্বংস হবে; নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা মারা যাবে। এ কথা চিন্তা করেই আমি কমাণ্ডো বাহিনী পাঠাইনি। এ শহর যদি খৃস্টানদের হতো, তবে তা এতক্ষণে আগুনের শিখার নিচে থাকতো। আমার কমাণ্ডো বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকতো এ শহর।

যে মুসলমানরা যুদ্ধের ময়দানে এসে এখন লড়ছে ও মরছে, এদের সাধ্য হতো না আমার কমাণ্ডো বাহিনীকে বাঁধা দেয়া। যারা ঘরে বসে আছে তাদেরকে আমি মারতে চাই না।”

সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনীকে সংহত করে অবরোধকারী বাহিনীর সাথে শামিল হলেন এবং বললেন, “শুধু প্রতিরক্ষার জন্যই লড়াই করতে হবে, আক্রমণ করার জন্য নয়। আক্রান্ত হলে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে এবং নিজেদের হেফাজত করে অবরোধ দৃঢ় করতে হবে। আমাদের সৈন্য সংখ্যা কম, এ জন্য অযথা সৈন্যক্ষয়ের ঝুঁকি যেমন নিতে চাই না, তেমনি এ শহর ধ্বংস হয়ে যাক, তাও আমি চাই না।”

১১৭৫ খৃস্টাব্দের পূর্ণ জানুয়ারী মাস শহরটি অবরুদ্ধ অবস্থায় রইল। হলবের সৈন্যরা একের পর এক আক্রমণ চালালো অবরোধ মুক্ত করতে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে যেতে হলো তাদের। সুলতান আইয়ুবী তাদের প্রতিটি আঘাতই শক্ত হাতে ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু একবারের জন্যও শহর দখল করার জন্য আক্রমণ চালালেন না।

১১৭৫ খৃস্টাব্দের পহেলা ফেব্রুয়ারী। সুলতান আইয়ুবীর কাছে খবর এলো, ত্রিপোলীর খৃস্টান শাসক রিমান্ড হলবের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। বলা হলো, “সম্রাট রিমাণ্ড বিশাল পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে যাত্রা করেছেন।”

আস সালেহের সহযোগিতায় রিমান্ড এগিয়ে আসবে, জানতেন সুলতান। এ খবরের জন্য মনে মনে তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। রিমাণ্ডের মোকাবেলার জন্য তিনি পরিকল্পনা করেই রেখেছিলেন। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এবার মনযোগ দিলেন তিনি।

সংরক্ষিত সৈন্যদের একটি দলকে তিনি এমন জায়গায় রেখে দিয়েছিলেন, যেখান থেকে রিমাণ্ডকে স্বাগত জানানোর জন্য খুব বেশী দৌড়ঝাপ করতে হবে না।

এ সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই এক কাসেদকে পাঠিয়ে দিলেন সেই রক্ষিত বাহিনীর কাছে। তাকে বলে দিলেন, “যত শিগগির সম্ভব ওদের বলবে, রিমাণ্ডের আসার পথের পাশে উঁচু জায়গায় তীরন্দাজদের বসিয়ে রাখতে। তাদের পেছনে থাকবে অশ্বারোহী বাহিনী। আমি আসছি।

যদি খৃষ্টান বাহিনী আমার আগেই পৌঁছে যায়, তবে সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে ওদের ওপর কমাণ্ডো আক্রমণ চালাতে বলবে। যতক্ষণ ওরা নির্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছে ততক্ষণ ওঁৎ পেতে বসে থাকতে বলবে ওদের।

রাস্তার দু’পাশের প্রতিটি পাহাড় চূড়া যেন কমান্ডোদের দখলে থাকে। ওরা দুৰ্গম পাহাড়ী এলাকায় পুরোপুরি প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত আক্রমণ করতে নিষেধ করবে।

অশ্বারোহী বাহিনী যেন তাদের পেছনে ফেরার রাস্তা বন্ধ করে দেয়। কোন অবস্থাতেই ওদের পিছু হটতে দেবে না। প্রয়োজনে সামনে এগিয়ে আসুক তাতে অসুবিধা নেই।”

সুলতান ওকে বলে দিলেন কোন পাহাড়ের আড়ালে অবস্থান নেবে এই বাহিনী। কাসেদ সুলতানের নির্দেশ নিয়ে দ্রুত রওনা হয়ে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্য পথে।

‘আর রিস্তান’ এক দুর্গম পার্বত্য এলাকার নাম। রিমাণ্ডকে হলব পৌঁছতে হলে এ পথ তাকে অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে।

রিমাণ্ড তার অভিযানের প্ল্যান করলো এভাবে, প্ৰথমে তিনি হেম্মাত পর্যন্ত যাবেন। সেখানে সুলতান আইয়ুবী নেই, অতএব এ দুর্গ পূনরুদ্ধার করা খুব কঠিন হবে না। কারণ সুলতানের বাহিনী এখন হলবের ময়দানে। এতে পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয় দূর হবে এবং এ দুর্গ থেকে রসদপত্রের যোগান বন্ধ হয়ে যাবে সুলতানের।

আর যদি এ খবর পেয়ে সুলতান এগিয়ে আসে তা পুনরুদ্ধার করতে, তবে আস সালেহের বাহিনী তার পিছু ধাওয়া করতে পারবে। এমনটি হলে মরুভূমিতেই দুই বাহিনীর মাঝে ফেলে সুলতানকে পিষে মারা যাবে।

রিমাণ্ডের এগিয়ে আসার খবর পাওয়ার পরের রাত। আকাশে চাঁদ নেই। চারদিকে কুয়াশা ও হিমেল বাতাসের সাথে মিতালি পাতিয়ে ছুটে এসেছে ঘন অন্ধকার। এ অন্ধকারের মাঝেই অবরোধ তুলে নিলেন সুলতান। কিন্তু সৈন্যদের তাঁবু গুটাতে নিষেধ করলেন। তাঁবুর মত পড়ে রইল তাঁবু, সৈন্যরা সওয়ার হয়ে গেল ঘোড়ায়। ছুটলো রিমাণ্ডের এগিয়ে আসা বাহিনীর মোকাবেলা করতে। নদী পেরিয়ে পাহাড়ের আড়ালে একদল সৈন্যকে লুকিয়ে রেখে বাকি সৈন্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন সুলতান।

ভোরে হলবের রক্ষীরা দূর থেকে তাকিয়ে দেখলো সুলতানের তাঁবুগুলো আগের মতই অনড় আছে।

বার বার আঘাত হেনে ক্লান্ত রক্ষীরা অপেক্ষা করছিল রিমাণ্ডের আগমনের। অযথা শক্তি ক্ষয় না করে রিমাণ্ড আসা পর্যন্ত হামলা মুলতবী রাখার জন্য বললো খৃস্টান উপদেষ্টবৃন্দ। এ সিদ্ধান্তে খুশীই হলো হলবের রক্ষী ও সৈন্যরা।

‘আর রিস্তান” চলে এসেছে রিমাণ্ড। পাহাড়ের ওপরে বরফের আস্তর দেখে খুশীই হলেন তিনি। সুলতান আইয়ুবীর মরু শেয়ালরা এই বরফের রাজ্যে থাকতে থাকতে নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে আছে। ইউরোপের চৌকস খৃস্টান সেনাদলের সাথে যুদ্ধ করার মত অবস্থায় নিশ্চয়ই নেই তারা। মনে মনে বেশ পুলক অনুভব করলেন রিমাণ্ড।

সুলতান আইয়ুবী এসে পৌঁছলেন আর রিস্তান অঞ্চলে। তার আগেই ওঁৎ পেতে থাকা তীরন্দাজরা পাহাড়ের চূড়া থেকে তীর বর্ষণ শুরু করলো রিমাণ্ডের বাহিনীর ওপর।

এই আকস্মিক ও অতর্কিত হামলায় রিমাণ্ড বিস্মিত ও শংকিত হলো। পরিস্থিতি কতটা নাজুক হতে পারে এবং হামলাকারীরা কি পরিমাণ শক্তিশালী কিছুই জানা নেই তার। তাই রিমাণ্ড আপাতত মোকাবেলার চিন্তা বাদ দিলেন।

যুদ্ধ না করে সৈন্যদের তিনি সরিয়ে নিতে চাইলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু যেদিকেই আশ্রয় নিতে যায় সেদিক থেকেই ছুটে আসে তীর। রিমাণ্ডের বাহিনী প্রতি পদক্ষেপে লুকানো বিপদের সম্মুখীন হচ্ছিল।

রিমাণ্ড অভিজ্ঞ সেনাপতি। বুঝলেন, যতক্ষণ এখানে থাকবেন। ততক্ষণই লোক ক্ষয় হতে থাকবে তার অদৃশ্য শক্রকে তিনি কিছুই করতে পারবেন না।

তিনি সামনের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। বাহিনী অনুসরণ করল তাকে। যতদূর সম্ভব ঢাল দিয়ে তীরের আঘাত ঠেকিয়ে অনেক দূর এগুনোর পর রিমাণ্ড অনুভব করলো এখন আর তীর আসছে না।

তিনি রাস্তা থেকে সরে এক, পাহাড়ের কোলে গিয়ে ক্যাম্প করলেন।

তীরের আঘাতে যারা ধরাশায়ী হয়েছে তাদের লাশগুলো পড়ে রইল পথের ওপর। আহতদের সেবায় লেগে গেল চিকিৎসকরা। বাকীরা তাঁবু টানিয়ে বিশ্রামে গেল।

শেষ রাতের দিকে শুরু হলো শীতকালীন বর্ষণ। নিচু জায়গায় তাঁবু টানিয়েছিল ওরা। তাঁবুর ভেতর গড়িয়ে এসে পানি ঢুকতে শুরু করলো। সৈন্যরা তাড়াতাড়ি তাঁবু গুটিয়ে সুবিধামত উঁচু জায়গায় তাঁবু খাটাল আবার।

নতুন করে যাত্রা শুরু করার আগে রসদবাহী কাফেলার জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন রিমাণ্ড। দু’এক দিনের মধ্যেই চলে আসার কথা ওদের। চার পাঁচ দিন কেটে গেল, কিন্তু রসদবাহী কাফেলার কোন দেখা নেই।

এদিকে ঘোড়ার শুকনো খোরাক শেষ হয়ে গেল, সৈন্যদেরও রসদের প্রয়োজন দেখা দিল। তবে তাদের সাথে খাবার যথেষ্টই ছিল, খাদ্য নিয়ে কোন দুশ্চিন্তায় পড়ল না ওরা।

তিনি এক কাসেদকে পাঠালেন খবর কি দেখে আসার জন্য। সে ফেরত এসে সংবাদ দিল, “সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে।”

রিমান্ড খুব আশ্চর্য হলো, সুলতান আইয়ুবী এত তাড়াতাড়ি এখানে এলো কেমন করে? তিনি তার দু’জন অফিসারকে পাঠালেন পরিস্থিতি দেখে আসতে। বললেন, “তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। তোমাদের রিপোটের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।”

অফিসাররা ফিরে এল পরদিন। বললো, ‘ঘটনা সত্যি, সুলতানের সৈন্যরা রসদ আমদানীর রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে।” তারা তখনো রিমাণ্ডের তাঁবু ত্যাগ করেনি, এক কাসেদ এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ালো সামনে।

“বলো, কি খবর নিয়ে এসেছে তুমি?”

‘মহামান্য সম্রাট, আইয়ুবী হলবের অবরোধ উঠিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছেন।”

“এর অর্থ হলো, আমার দায়িত্ব শেষ। হলব অবরোধ মুক্ত করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আমাকে। হলব এখন মুক্ত, চলো এবার ত্রিপোলী ফিরে যাই।”

রিমাণ্ড অফিসারদের বললেন, সৈন্যদের তাঁবু গুটাতে বলো। এখানে অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সামনে এগোনোরও দরকার নেই। সৈন্যদের বলো, আমরা এখন ত্রিপোলী ফিরে যাবো।”

সুলতান আইয়ুবীর যখন শুনলেন রিমাণ্ড যুদ্ধ ছাড়াই ত্রিপোলী ফিরে যাচ্ছেন, তখন তিনি খুব অবাক হলেন। রিমাণ্ডকে ফিরে যেতে হলে সেই দুৰ্গম পাহাড়ী অঞ্চল অতিক্রম করতেই হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।

কিন্তু রিমাণ্ড সে রাস্তা আর মাড়াতে চান না। সুলতান আইয়ুবীর সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাক, আর আইয়ুবী তার বাহিনী তছনছ করুক এটা তিনি কিছুতেই হতে দিতে পারেন না। তিনি আইয়ুবীর সাথে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে বিকল্প পথে ফিরে যেতে চাইলেন।

অফিসাররা বললো, “কিন্তু বিকল্প কোন পথ তো নেই!”

রিমাণ্ড বললেন, “তাহলে আমরা প্রয়োজনে পাহাড় ডিঙিয়ে সেই পথ অতিক্রম করবো, যেখানে আইয়ুবী আমাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে। কোন অবস্থাতেই আমি আইয়ুবীর সামনে পড়তে চাই না।”

ঐতিহাসিকরা বলেছেন, কয়েকটি কারণে রিমাণ্ড খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তার ধারনা মিথ্যা প্রমাণ করে মরুভূমির মত বরফের রাজ্যেও মুসলমানদেরকে স্বচ্ছন্দভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। এরপর তিনি রওনা দেয়ার সাথে সাথে সুলতানের খবর পেয়ে যাওয়া এবং তার চাইতে দ্রুতগতিতে ছুটে এসে এই পার্বত্য এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে তার বাহিনীকে আক্রমণ, প্ৰচণ্ড শীত ও বরফ উপেক্ষা করে তার রসদপত্র আমদানীর রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনায় তার মনোবল ভেঙে পড়েছিল। কেউ কেউ আরো একটি কারণ উল্লেখ করেছেন, বলেছেন, তিনি আস সালেহ ও তার আমীরদের ধোঁকা দিতে চাচ্ছিলেন এবং এই ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে বাস্তবে তাই করলেন।

ঐতিহাসিকরা আরো লিখেছেন, সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী রিমাণ্ডের রাজধানী ত্রিপোলী আক্রমণ করতে পারে। এই ভয়ে তিনি দ্রুত সসৈন্যে রাজধানী ফিরে গিয়েছিলেন।

তিনি প্রচুর অর্থ সম্পদের বিনিময়ে আস সালেহকে সাহায্য করার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এ জন্যই তিনি খলিফার আমন্ত্রণে যুদ্ধ যাত্রায় বাধ্য হয়েছিলেন। সুলতান অবরোধ তুলে নিয়েছেন এ খবরে তাই তিনি স্বস্তি বোধ করে বলেছিলেন, “এখন আর যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই।”

মুসলমানরা পরষ্পর যুদ্ধ করে নিঃশেষ হয়ে গেলে তার তো কোন ক্ষতি নেই! বরং লাভ আছে। যে সৈন্যদের হত্যা করার জন্য অস্ত্র ধরতে হতো তাকে, সে সৈন্যরা আজ নিজেরা নিজেরা মারামারি করে মরছে, এরচেয়ে খুশীর খবর তার জন্য আর কি হতে পারে!

তিনি দ্রুত আস সালেহের কাছে এক দূত পাঠালেন। পত্রে তিনি লিখলেন,

‘খলিফা আস সালেহ,

আমি ওয়াদা করেছিলাম, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আপনাকে আক্রমণ করলে আমি আপনার পাশে দাঁড়াবো। অবরোধের খবর পেয়ে আমি নিজেই সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য নিয়ে আপনার সাহায্যে ছুটে এলাম। আমার অগ্রযাত্রার খবর পেয়েই সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী হলবের অবরোধ তুলে পালিয়ে গেল।

আমি খুশী যে, আমি আমার ওয়াদা যথাযথভাবে পূরণ করতে পেরেছি। এই অবরোধ মুক্ত করার পর আমার সঙ্গে আপনার যে সামরিক ওয়াদা ও চুক্তি ছিল সেটা শেষ হয়ে গেল।

আপনার কাছ থেকে অগ্রিম হিসাবে যে সোনা ও অর্থ পেয়েছিলাম তার হক আমি পুরোপুরি আদায় করেছি। এবার আপনার ওখানে আমার যে সামরিক উপদেষ্টা ও প্ৰতিনিধিরা আছে তাদের অতি সত্তর পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। আপনার সাফল্য ও সুস্বাস্থ্যু কামনা করি।”

-সম্রাট রিমাণ্ড, ত্রিপোলী।

আস সালেহ ও তার আমীররা এই চিঠি পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

‘খৃস্টানরা আমাদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।” মাথায় হাত দিয়ে সবাই এ কথাই শুধু বলাবলি করতে লাগলো।

খলিফা ছিল অপরিণত বয়সের নির্বোধ বালক, তার দুই উপদেষ্টা তাকে পরামর্শ দিল, চলুন, সুলতান আইয়ুবীর সাথে আমরা আপোষ করে ফেলি।”

সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীনসহ কয়েকজন আমীর এ প্রস্তাবে বাঁধা দিয়ে বললেন, “সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তো দুদিনের মেহমান।

নতুন করে ফেদাইন গ্রুপ পাঠানো হচ্ছে। তারা সুফি দরবেশের বেশে সালাহউদিনের কাছে এই আবেদন নিয়ে যাচ্ছে, তিনি যেন যুদ্ধ বিগ্ৰহ বন্ধ করে তাবলীগের মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমানের তরক্কীর জন্য কাজ করেন। সুলতান আইয়ুবী তাদেরকে সসম্মানে পাশে বসাবেন। নির্জন কামরায় বসে তিনি যখন তাদের কথা শুনবেন, তখন ফেদাইনরা তাকে আরামের সাথে হত্যা করে বেরিয়ে আসবে। এরা এমন মানুষ, যাদের নিজের জীবনের জন্যও কোন মায়া নেই।”

তারা আস সালেহকে মিথ্যা বলেনি। সুলতান আইয়ুবী যখন ‘আর রিস্তান’ পর্বত মালায় বসে পরবতী পদক্ষেপের প্ল্যান তৈরী করছিলেন, নয়জন পেশাদার ফেদাইন খুনী হলবে বসে প্ল্যান করছিল, কোথায় কিভাবে আইয়ুবীকে হত্যা করা যায়।

মিশরে যেখানে এখন আসোয়ান বাধ, আটশ বছর আগে সেখানে এক রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক সুলতান আইয়ুবীর এই যুদ্ধের কোন উল্লেখই করেননি। কাজী বাহাউদ্দিন শাদাদ তাঁর ডাইরীতে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। লিখেছেন, সুলতানের এক জেনারেল, নাম আলকিন্দি, মিশরের বাসিন্দা। তার মা ছিল সুদানী। এই সুত্ৰ ধরে সুদানীরা যোগাযোগ করে তার সাথে। তাকে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উস্কানী দেয় তারা।

সে সময়কার লেখকদের লেখা থেকেও এই বিদ্রোহের মোটামুটি একটা চিত্র পাওয়া যায়।

❀ ❀ ❀

১১৭৪ খৃস্টাব্দের শেষ দিক থেকেই সুলতান আইয়ুবী মিশরের বাইরে ছিলেন। ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে দুঃসাহসিক অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

নূরুদ্দিন জঙ্গীর ওফাতের পরপরই সিরিয়ায় সুবিধাবাদী আমীররা নূরুদ্দিন জঙ্গীর এগারো বছরের বালককে সিংহাসনে বসিয়ে এবং খৃষ্টানদের সাথে জোট বেঁধে স্বাধীনভাবে চলার যে ষড়যন্ত্র করেছিল, তার মোকাবেলা করছিলেন সুলতান। নইলে ইসলামী জগতের রাজ্যগুলি খণ্ড খণ্ড হয়ে খৃস্টানদের পেটের মধ্যে চলে যেতো।

সুলতান আইয়ুবী দামেশক এসে জনসাধারণের সহযোগিতায় দামেশক করায়ত্ব করলে খলিফা ও তাঁর সহকারী জেনারেল, আমীর ও উজিররা সবাই হলবের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানে তারা প্রচুর অর্থের বিনিময়ে খৃস্টানদের সামরিক সাহায্য লাভের আশ্বাস পায়। কিন্তু খৃস্টানরা অর্থ নিয়ে আশ্বাসের নামে ধোঁকা দেয় তাদের।

সুলতান আইয়ুবী হেম্মাত ও হেমসের কেল্লা দখল করে দীর্ঘ দিন হলব অবরোধ করে রাখার সময় যখন খবর পান তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে ত্রিপোলীর খৃস্টান রাজা, তখন তিনি অবরোধ তুলে ছুটে যান রিমাণ্ডকে বাঁধা দিতে।

সুলতান আইয়ুবীর কৌশল ও সাহসের কাছে পরাজিত হয় রিমাণ্ড, যুদ্ধ না করেই পালিয়ে যায় তার বাহিনী।

কিন্তু তাতেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। বরং বলা যায়, আসল যুদ্ধে শুরু হয় এখান থেকেই।

সুলতান আইয়ুবী আর রিস্তান পর্বতমালার ওপরে ও আশেপাশে তার সৈন্য ছড়িয়ে রেখেছিলেন। এখন তাঁর যুদ্ধ চলছে তিন শক্রর সাথে। একদিকে আস সালেহ ও তার উপরে ছিল হাড় কাঁপানো কঠিন শীত।

১১৭৫ খৃস্টাব্দের জানুয়ারী মাস। পাহাড়ের গায়ে বরফ জমে আছে, চূড়ায় বরফের স্তুপ। তুষার ঝড় বইছে, কখনো আস্তে, কখনো বেশ জোরে। প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে আইয়ুবীর সৈন্যরা। সুলতান ওঁৎ পেতে বসে আছেন রিমাণ্ডের ফিরে আসার অপেক্ষায়। রিমাণ্ডের সাথে বুঝাপড়া শেষ না করে তিনি হলব যেতে পারছেন না, দামেশক বা মিশর ফিরে যেতে হলেও এর একটি সুরাহা করে যেতে হয়।

মিশর সম্পর্কে থেকে থেকেই চিন্তা হচ্ছিল তার। অনেকদিন ওখান থেকে বেরিয়েছেন তিনি। নিশ্চিত নন, সেখানকার সেনা বিভাগ এখন কি করছে। শাসন বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে এসেছেন ছোট ভাইয়ের হাতে। তার কাছে যে সৈন্য ছিল তার থেকে কিছু নিয়ে এসেছেন নিজের সাহায্যের জন্য। কোন হুমকি এলে সে কি এই অল্প সৈন্য নিয়ে নিশ্চিত করতে পারবে মিশরের নিরাপত্তা?

উত্তরে সমুদ্র পথে খৃস্টানদের আক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। দক্ষিণ দিক থেকে সুদানীদের আক্রমণের ভয় তো আগে থেকেই ছিল। খৃস্টান ও সুদানীদের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা তিনি থাকতেই সারা মিশরে ছড়িয়ে পড়েছিল। গোয়েন্দারাও তৎপর ছিল ব্যাপকভাবে।

এ জন্যই সুলতান আইয়ুবী সুদক্ষ গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে কায়রো রেখে এসেছেন। ভাইকেও এই দায়িত্বপূর্ণ বিষয়ে সতর্ক করে অনেক নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর শূন্যতা কি তাতে পূরণ হবে?

মিশরের সীমান্ত ও সাগর উপকূল এলাকা দেখাশোনা করার জন্য সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ও টহলদার বাহিনী নিয়মিত পাহারা দিয়ে যাচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবী ভাইকে বলেছিলেন, ‘সুদানের বর্ডারে সামান্য গোণ্ডগোল দেখা দিলেও কঠিন হাতে তার মোকাবেলা করবে। প্রয়োজনে সুদানের ভেতরে গিয়ে হলেও দমন করবে ওদের।”

কিন্তু একটি বিষয়ে কিছুই বলেননি তাকে। বিষয়টি সীমান্ত রক্ষীদের বদলী সংক্রান্ত। সীমান্ত রক্ষীদের কিছুদিন পর পর বদলী করার কথা তিনি ভাইকে বলে আসেননি। এখন মনে হচ্ছে, এ ব্যাপারেও ওকে সতর্ক করে আসা দরকার ছিল।

সীমান্ত রক্ষী দলের অধিকাংশ সৈন্য ও কমাণ্ডাররা একাধিক বছর ধরে সীমান্তে একই জায়গায় ডিউটি দিয়ে যাচ্ছিল। শক্ৰদের সাথে এরা একাধিক যুদ্ধ করেছে। এ জন্য শক্ৰদের বিরুদ্ধে এরা ছিল আপোষহীন।

এর আগে যে দলটি এখানে ডিউটি করতো, তারা কাজকর্মে বিশ্বস্ততা দেখাতে পারেনি। তাদের চোখের সামনে দিয়ে মিশরের হাটবাজার থেকে খাদ্যশস্য ও দরকারী পণ্য পাচার হয়ে সুদানে চলে যেত। সুলতান আইয়ুবী এ খবর পেয়ে তাদেরকে ওখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন যে বাহিনী সীমান্তে পাঠিয়ে ছিলেন, যুদ্ধ ফেরত সেই সৈন্যরাই এখনো সেখানে ডিউটিতে আছে।

এই বাহিনী সীমান্তে এসেই ভীষণ তোড়জোড় শুরু করে দেয়। টহলদার বাহিনীর চোখে কোন জিনিস একটু নড়াচড়া হলেই গিয়ে ঘাড় চেপে ধরে। তারা খুবই সতর্ক ছিল এবং চারদিকে ওদের সতর্ক দৃষ্টি থাকতো সব সময় সজাগ। তাদের এ সতর্কতার কারণে সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এটা প্রায় দুই আড়াই বছর আগের কথা। প্রথম প্রথম এই বাহিনীর মনে জাতীয় চেতনা ও ঈমানী জযবা অটুট ছিল। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দেয়ার প্রেরণা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছিল তারা। কিন্তু আস্তে আস্তে এ চেতনায় ভাটা পড়তে লাগলো।

সুলতান আইয়ুবী প্রত্যেক দিক, প্রত্যেক কোণ ও প্রতিটি উপাদানের ওপর দৃষ্টি রাখতেন। কিন্তু তিনি মিশরে না থাকায় সীমান্তের প্রহরী সৈন্যদের বদলির ব্যাপারটিতে নজর দিতে পারেননি।

সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল যার হাতে, তার নাম আলকিন্দি। তাঁর ওপর নির্দেশ ছিল, “বছরে অন্তত দু’তিনবার প্রহরীদের বদলী করে অন্য এলাকায় পাঠাবেন।”

কিন্তু তিনি এর প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। তার ফল যা হওয়ার তাই হলো, নানা দোষ ক্রটিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ল সৈন্যরা। একঘেয়েমী ও ঢিলেমী পেয়ে বসলো সৈন্যদের।